“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

খোলা চিঠি তোমাকে

debnath.suniti@gmail.com
[ Sketch by myself  ]































© সুনীতি দেবনাথ



প্রিয় রোমাস কাফেমানাস! ...
আজ বহু যুগ পেরিয়ে বিবর্ণ ধূসর
দিগন্ত থেকে তোমাকে জানাই
ভালবাসা। আজও সেই ভালবাসাই
জানাই যেখানে নেই আংটি বদলের শর্ত,
আর এতেই অভিমান ছিল তোমার।
তাই একদিন ডুব দিয়েছিলে দূরত্বের সমুদ্রে।
যাক্ ওসব কথা।
এতোদিন পরে বুঝে গেছো নিশ্চয়
ভালবাসার নানা রঙ হয় বর্ণালী বাহার হয়!

সেদিন তুমি বাসিন্দা বিজয়ী বিপ্লবের
চল্লিশের এপারের পোক্ত
সমাজতান্ত্রিক মাটিতে, আর আমি?
দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের পর
সংগ্রাম আন্দোলন হরেক রকম আর
প্রাণ দেয়ানেয়া পেরিয়ে গড়ে ওঠা
গণতন্ত্রের প্রত্যাশা উজ্জ্বল দেশে।
মাত্র বিশ বছর স্বাধীনতা আমাদের হস্তগত
তাই প্রত্যাশার ক্ষুধা দুর্নিবার!
মনে হতো পৃথিবীটাই হাতের মুঠোয়।

তুমি বলতে গণতন্ত্র তো ফাঁপা বুলি,
ধনতন্ত্রের নামান্তর, সংখ্যা গরিষ্ঠতা কি আদৌ বাস্তবতা পায়?
এতো ভাগের মায়ের গঙ্গাপ্রাপ্তি।
গণতন্ত্রের বহু বহু উপরে সমাজতন্ত্র
বিপ্লবই তা দিতে পারে।
তোমার পূর্বজগণ কোনো বিপ্লব তো করেননি
স্বাধীনতা চেয়েছিলেন।
আর চুক্তি হয়েছে শুধু ক্ষমতা হস্তান্তরের।
প্রকৃত স্বাধীনতার তো মানেই অন্য।
সিঁড়িভাঙ্গা খেলা জানো?
সমাজতন্ত্রে পৌঁছানো মানে আরও
অনেক সিঁড়ি ভেঙ্গে ধনতন্ত্রের টুঁটি চেপে
তছনছ করে উপরে আরোহণ চাই
তাহলে প্রকৃত মুক্তি কাকে বলে
স্বাধীনতা কাকে বলে জানতে পারবে।

আমার বড় অভিমান হতো,
বড় কষ্ট
হতো রোমাস কাফেমানাস !
মনে হতো সমাজতন্ত্র আর গণতন্ত্রকে তুমি
দাঁড়িপাল্লায় মেপে আমার গণতন্ত্র আর স্বাধীনতাকে
খাটো করতে চাইছো।
একটা দ্বন্দ্ব তবু দিনরাত চোরকাঁটার মত বিঁধে থেকে
সারাবেলাকে কেমন যেন বাউলের
একতারার টুংটাং শোনাতো।

আমি সে সুরকে বিস্তারে আলাপে
ছড়িয়ে গঙ্গা পদ্মা হিমালয় পার করে
ভল্গার তীরে পৌঁছাতে দিতে নারাজ ছিলাম।
বলতাম এ তোমার চিরকালীন পুরুষালি কর্তৃত্বের অহমিকা।
আমার স্বাধীনতার অর্থ তোমার বোধের বাইরে।
তুমি হাসতে মিটিমিটি কল্পনার চোখে দেখতাম স্পষ্ট।

রোমাস কাফেমানাস, আমার পত্রবন্ধু,
তখন তো ইন্টারনেট ছিলনা ছিল
ডাকবাক্সে চিঠি ফেলে দীর্ঘ প্রতীক্ষা।
কবে আসবে জবাব
আপাদমস্তক কাঁপানো অস্তিত্বের
বসতকে ভাঙ্গাচোরা করার দামাল ঝড়ের মত্ততা নিয়ে।
একদিন একটা আংটি তুমি চাইলে,
জানতে না সেটি ততদিনে দিয়ে ফেলেছি অন্য একজনকে,
সে আমার স্বদেশ ।
আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পত্রবন্ধু,
সে সুখসংবাদ যখন জানালাম
একটি পত্র শুধু এলো, একটি পঙক্তির
স্বদেশ যেদিন বিশ্বে মিশে হাসবে
সেদিন স্বাধীনতা হাসবে জেনো
রবি ঠাকুরের দেশের মেয়ে!
তারপর আর কোনো চিঠি তোমার আসেনি ।
শুধু সাইবেরিয়ান শীতল বাতাস
মাঝে মাঝে হু হু কেঁদে যেতো আকুল হয়ে।

আমি তারপর
স্বাধীনতার মানে খুঁজে কত অভিধান ঘেঁটেছি,
গণতন্ত্রের আর সমাজতন্ত্রের অলিতে গলিতে
বহু ঘোরপাঁক খেয়েছি।
উত্তর সব ধাঁধালো
বোধ বাস্তবতার ধারে কাছে নেই,
আজ এতটি বছর পেরিয়ে
আমার দেশের মত আরও সব গণতান্ত্রিক দেশে
জনগণ রুদ্ধশ্বাস,
আকাশ বাতাস এক ক্রন্দনরোলে বিপর্যস্ত।
আর তোমার দেশের সমাজতন্ত্র
তাও টুকরো টুকরো হলো ধনতন্ত্রের মারমুখী সন্ত্রাসে।
আর ধনতন্ত্র?
দেখছি পঙ্গু হয়ে যাবার আগে
আরো বীভৎসতায় নখদন্ত বিদারিত করে আমাদের স্বপ্ন সুখের, স্বাধীনতার গলা
চেপে ধরে হা হা অট্টহাসিতে মত্ত হতে গিয়ে অজান্তে
চোখ ভরা জল নিয়ে ধনতন্ত্রও
মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনি শুনে কান্নায় যেন ডুবে যাচ্ছে।
আর ঐ দূরের দিগন্তে
একটা লাল আলোর রক্তিম আভাস
যেন মুক্তি আর স্বাধীনতার যথার্থ মূর্তিতে স্পষ্ট হচ্ছে,
ক্রান্তিকালের ডাক যাচ্ছে শোনা।
বিদায় বন্ধু
রোমাস কাফেমানাস বিদায়!

....................................................................................
আমার কবিতা ' খোলা চিঠি তোমাকে ' আবৃত্তি করলেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান আবৃত্তি -শিল্পী শ্রদ্ধেয় বদরুল আহসান খান সাহেব। বদরুল সাহেবের কণ্ঠে এটি আমার দশম কবিতা। জানিনা কোন অদৃশ্য সোনালি সুতোয় আমার কবিতা আর বদরুল সাবের কণ্ঠের একটা বিচিত্র বন্ধন সৃষ্টি হয়ে গেছে। তাই অসুস্থ হয়েও শিল্পী আমার কবিতার টানে উতলা হয়ে ওঠেন সুন্দর শোভন উচ্চারণে আমার কবিতায় প্রাণসঞ্চার করার জন্য। আর আমি বিস্ময়ে শুধু শুনি, কান পেতে শুনি। এ খেলা চলতেই থাকবে সারাবেলা! শ্রদ্ধা ও অভিবাদন শিল্পী!




কোন মন্তব্য নেই: