।। রজতকান্তি দাস।।
কোন একটি দেশের মানুষ ঠিক কতটা সুখে-শান্তিতে আছেন তা
নিরূপণ করতে গিয়ে জাতীয় উৎপাদন ও মাথাপিছু আয়ের হিসেব করা হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে
এ ধরণের পদ্ধতি নিয়ে বিপুল সমালোচনা হতে থাকে। কারণ একদল অর্থনীতিবিদ ও
সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন যে এর ফলে প্রকৃত-ভাবে উন্নয়নের ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।
তাই ১৯৮০-র দশক থেকেই জাতিসঙ্ঘ মোট জাতীয় উৎপাদন ও মাথাপিছু আয়ের পরিবর্তে মানব
উন্নয়নের সূচক অনুসারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশগুলোর তালিকা প্রকাশ করতে শুরু করে।
বর্তমানে প্রতি বছরই জাতিসঙ্ঘ এই তালিকা প্রকাশ করে কারণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে
মানব উন্নয়ন আংশিক ভাবে জড়িত থাকলেও সম্পূর্ণভাবে জড়িত নয়। তাই তারা মানব কল্যাণের
পরিমাপ করতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে তিনটি বিষয়কে যুক্ত করা হল। দীর্ঘ ও সুষ্ঠু জীবন,
শিক্ষা ও জ্ঞান
এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন। এ বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে যে পরিসংখ্যান বের করা হয়,
তা হল মানব উন্নয়ন
সূচক (human development Index)।
জাতিসঙ্ঘের উন্নয়ন
কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে প্রতি বছরই এই সূচকের নিরিখে পৃথিবীর দেশগুলোকে মোট চারটি
ভাগে ভাগ করা হয়।
এই নতুন পদ্ধতিতে উন্নয়নের পরিমাপ করলেও দেখা গেছে আর্থিক
দিক থেকে উন্নত দেশগুলোই উপরে থাকে। তাই মোট জাতীয় উৎপাদন ও মাথাপিছু আয় যে মানব
উন্নয়ন বিকাশের ক্ষেত্রে অনেকটাই ভূমিকা পালন করে এটা আজ প্রমাণিত। তাই আফ্রিকার
দেশগুলোতে যেখানে মাথাপিছু আয় কম সেখানে মানব উন্নয়নের সূচকেও দেশগুলো নীচের দিকেই
আছে। তা সত্ত্বেও ব্যতিক্রমও যে নেই তা নয়, তাই মানব উন্নয়ন সূচকের ভাবনাকে উড়িয়ে
দেওয়া যায় না। যেমন বিশ্বব্যাংকের মাথাপিছু আয় অনুসারে চিলি ও আর্জেন্টিনা মধ্য
আয়ের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হলেও এই দুটি দেশ মানব সম্পদ উন্নয়নে উচ্চ মানব সম্পদের
দেশ। ঠিক তেমনি, বাংলাদেশ নিম্ন মাথাপিছু আয়ের দেশ হলেও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচী অনুযায়ী ‘মধ্যম মানব
সম্পদের’ দেশ। তাই বলা যেতে পারে যে মানব উন্নয়নের
সূচক দিয়ে যদি উন্নয়নের পরিমাপ করা হয় তাহলে আরো স্বচ্ছ ভাবে যথার্থ প্রতিচ্ছবি
আমাদের সামনে ধরা পড়ে।
আজকের অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যে উন্নয়নের মানদণ্ডে জাতীয়
উৎপাদন ও মাথাপিছু আয় দিয়ে প্রকৃত অবস্থা পরিমাপ করা অর্থহীন। কেননা, এরকম পরিমাপক দিয়ে
দেশের মধ্যে স্থানগত বা সমাজগত অসমতা কোনভাবে বিবেচনায় আনা হয় না। এছাড়া এরকম
পরিমাপক দিয়ে দেশের অধিকাংশ মানুষের ‘উন্নয়ন ভাবনা’ বা কিভাবে জীবনের মান পরিবর্তন করা যায় তা অস্পষ্ট থাকার
ফলে গণসচেতনতা গড়ে তুলতে কিংবা সরকারি নীতি গ্রহণে খুব একটা সহায়ক ভূমিকা পালন
করতে পারে না। শুধু উপার্জন দিয়ে যে চিত্র আমাদের সামনে ফুটে ওঠে তা নিতান্তই
ঝাপসা। তাই আরো স্বচ্ছ ছবি পেতে গিয়ে পাকিস্তানের অর্থশাস্ত্রী মাহাবুল হক মানব
উন্নয়ন সূচকের কথা বলেন। পরে ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এই ধারণাকে আরো
ব্যাপক আকারে নিয়ে গিয়ে এই সূচক নিরূপণ করার অনেক পন্থা আবিষ্কার করেন। তাই
বর্তমানে কোন দেশের জনগণ কেমন আছেন তা মূলত এই মানব উন্নয়ন সূচক দিয়েই বিচার করা
হয়। পরবর্তী কালে এই সূচকের সঙ্গে পুরুষ-নারী সমতার সূচক যোগ করা হয়।
বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ এখনও নানা ভাবে দারিদ্র
পীড়িত। এদের মধ্যে অধিকাংশেরই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিসেবা গ্রহণের সুযোগ নেই। এই
বিপুল সংখ্যক জনগণ অতি বৈষম্য ও অত্যন্ত সংকটের মধ্যে দিন কাটান। বিশ্বের প্রায় ৮০
কোটি মানুষ যে কোন সময় বিপাক পরিস্থিতিতে আবার দারিদ্র সীমার নিচে চলে যেতে পারেন।
তাছাড়া প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নেই। তাই এই বিশাল
সংখ্যক জনগণের জন্য মানব উন্নয়ন সূচক নির্ধারণ করা অতি প্রয়োজন। এই সূচক
নির্ধারণের ফলে সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে কি ধরণের সহযোগিতা করা যায় তার রূপরেখা
তৈরি করতে সাহায্য করে। যেমন বাংলাদেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) মাধ্যমে
মানব উন্নয়ন সূচকে বিপুল পরিবর্তন আনতে পারা গেছে। তাই গত প্রায় পনেরো বছরে ঐ
দেশটি মানব উন্নয়নে বর্তমানে পৃথিবীর অনেক দেশকেই ছাড়িয়ে গেছে।
মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে গোটা বিশ্বের দেশগুলোকে প্রাথমিক
ভাবে মোট চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন অতি উচ্চ, উচ্চ, মাঝারি ও নিম্ন। ভারত ও তার পার্শ্ববর্তী
দেশগুলোর মধ্যে শেষোক্ত তিন ধরণের সূচক দেখতে পাওয়া যায়। যেমন উন্নত মানব উন্নয়নের
দেশের মধ্যে আছে চীন ও শ্রীলঙ্কা। তেমনি মাঝারি উন্নয়নের দেশগুলো হলো ভারত,
ইন্দোনেশিয়া,
বাংলাদেশ ও ভুটান।
আবার নিম্ন উন্নয়নের দেশ হলো নেপাল ও
পাকিস্তান। জাতিসঙ্ঘের ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুসারে মানব উন্নয়নের নিরিখে ১৮৭টি
দেশের যে সূচক নির্ধারণ করা হয়েছে তার ভিত্তিতে উন্নয়নের ক্রমানুসারে ভারত ও তার
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ক্রম হল শ্রীলঙ্কা (৭৩), চীন (৯১), ইন্দোনেশিয়া (১০৮), ভারত (১৩৫),
ভুটান (১৩৬),
বাংলাদেশ (১৪২),
নেপাল (১৪৫) ও
পাকিস্তান (১৪৬)। অর্থাৎ এই দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা হল সবচেয়ে উন্নত এবং
পাকিস্তান হল সবচেয়ে অনুন্নত।
যে সব বিষয়ের পরিসংখ্যান নিয়ে এই সূচক তৈরি হয়েছে তা হয় তা
কোন দেশের প্রত্যাশিত গড় আয়ু, ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যাশিত শিক্ষা গ্রহণের কাল, মাথাপিছু আয় ও মোট
ঘরোয়া উৎপাদন। এই সব কিছু মাথায় রেখেই মানব উন্নয়নের সূচক তৈরি করা হয়। যেমন গড়
আয়ু থেকে বোঝা যায় যে ঐ দেশটিতে চিকিৎসা গ্রহণে আমজনতা কতটা সুযোগ সুবিধা পান।
এব্যাপারে ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এদেশের চাইতে এগিয়ে আছে। চীনের প্রত্যাশিত
গড় আয়ু ৭৫.৩ বছর, শ্রীলঙ্কায় ৭৪.৩ বছর, ইন্দোনেশিয়ায় ৭০.৮, বাংলাদেশে ৭০.৭, নেপালে ৬৮.৪, ভুটানে ৬৮.৩, পাকিস্তানে ৬৬.৬ ও ভারতে ৬৬.৪ বছর। তাই শুধুমাত্র
প্রত্যাশিত গড় আয়ুর বিচারে ভারত অবশ্যই এর মধ্যে সবচাইতে পিছিয়ে পড়া দেশ। কারণ
এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এই দেশে মোট ঘরোয়া উৎপাদনের মাত্র ৩.৪ শতাংশ খরচ
করা হয় জনস্বাস্থ্য খাতে যা খুবই কম, যেখানে বাংলাদেশের মতো একটি গরিব দেশও এই খাতে ৪.৬ শতাংশ
খরচ করে। পশ্চিমী দেশগুলোতে এই হার অনেক বেশি। কানাডার সরকার মোট ঘরোয়া উৎপাদনের
১৭.৯ শতাংশ খরচ করে স্বাস্থ্য খাতে, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯.৩ শতাংশ, মেক্সিকো ১১.৪, আর্জেন্টিনা ১৪.২, সুইডেন ১৩.৮, ব্রিটেন ১৬.৩ ও জার্মানি ১৭.৩ শতাংশ খরচ
করে স্বাস্থ্য খাতে। আসলে জনস্বাস্থ্যের মতো বিষয় এযাবৎ দেশের রাজনৈতিক ইস্যু না
হওয়ার ফলে কোন সরকারই এই খাতে অর্থব্যয় করাকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গণ্য করে নি।
আগামী দিনে যদি বিষয়টি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় তাহলে এই খাতে আরো বেশি করে
বাজেটে অর্থ বরাদ্দ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ২০১৪ সালের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে ৩০,৬৪৫ কোটি টাকা
বরাদ্দ হয়েছিল যা এবারের বাজেটে বাড়িয়ে ৩৩,১৫০ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধির নিরিখে এই বৃদ্ধিতে
বিশেষ কিছু উন্নতি হবার নয়। তবে এই অর্থের বড় অংশই গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্পের
আওতায় খরচ করা হবে বলে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন। এতে গরিবদের স্বাস্থ্য পরিসেবা
বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে যদিও, তবে ভারতে এখনও স্বাস্থ্য প্রকল্পের কোন সুপরিকল্পিত
রোডম্যাপ তৈরি হয় নি। তাই অপরিকল্পিত স্বাস্থ্যসেবার দরুন অতীতে যেমন জনগণের মধ্যে
দুর্ভোগ ছিল তার খুব একটা কিছু বেশি সুরাহা হবে বলে আশা করা যায় না। তবে ভারতে
শিক্ষা খাতে ব্যয় মোট ঘরোয়া উৎপাদনের ১২.৭ শতাংশ যা উন্নত দেশগুলোর কাছাকাছি।
অর্থাৎ শিক্ষার ক্ষেত্রে ভারত সরকার যতটা জোর দিয়ে আসছেন, স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে তার সিকি ভাগও দেন
নি।
জনস্বাস্থ্যের পরিকাঠামোগত উন্নয়নে ভারত সরকার এযাবৎ কাল
ধরে যে অবহেলা দেখিয়ে আসছে তার ফলভোগ করতে হচ্ছে দেশের হত-দরিদ্র জনগণকে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে বর্তমানে অন্তত ১ লক্ষ ৬৩ হাজার কোটি টাকার পুঁজি নিবেশের
প্রয়োজন বলে জানানো হয়েছে। এর বড় অংশটি হবে বেসরকারি পুঁজি নিবেশ। এই বেসরকারি
পুঁজি নিবেশের ফলে হাসপাতালের বিছানার সংখ্যা পর্যাপ্ত হতে পারে কিন্তু দেশের
দরিদ্র জনসাধারণ এই চিকিৎসা লাভ করবেন কি ভাবে তা ভেবে দেখার বিষয়। কারণ গরিবদের
জন্য সরকারি হাসপাতাল ছাড়া আর তো কোন গতি নেই। এদিকে মধ্যবিত্তরা যাতে আরো বেশি
করে স্বাস্থ্য-বীমা করেন তার জন্য স্বাস্থ্য-বীমায় কর ছাড় বাড়ানো হয়েছে। ২০১৪-১৫
অর্থবছরে এর হার ছিল ১৫০০০ টাকা যা বর্তমান অর্থবছরে বাড়িয়ে ২৫০০০ টাকা করা হয়েছে।
তবে এর ফলে খুব একটা কিছু হবার নয় কারণ এখন ভারতে জনপ্রতি হাসপাতালের বিছানার
সংখ্যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। ২০০৫ সালে ভারতে প্রতি ১০০০ জনে ০.৯টি বিছানা ছিল
যা বেড়ে ২০১৩ সালে ১.৩টি বিছানা হয়েছে। কিন্তু তাও পর্যাপ্ত নয়, তাই ২০১৩ সালে যখন
ড০ মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন দ্বাদশ পরিকল্পনায় ২০১৭ সালের মধ্যে ৬,৫০,০০০টি নতুন বিছানা
বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর জন্য পর্যাপ্ত রাশি জোগাড় করা সম্ভব নয়, তাই সরকার
বেসরকারি পুঁজি লগ্নির দিকেই তাকিয়ে আছে।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে ১৯৯০-৯১ অর্থবছর থেকে ২০১৩-১৪
অর্থবছর পর্যন্ত স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় লাগাতার বাড়ানো হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এর
পরিমাণ দাঁড়ায় মোট বাজেটের ৪.৬ শতাংশ। যার ফলে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে দেশটি ভারতের
চাইতে এগিয়ে আছে। আসলে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে বৈরিতার কারণে ভারতকে বাজেটের মোট
১৮.৬ শতাংশ খরচ করতে হয় নিরাপত্তা ও সামরিক খাতে। তাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে
ব্যয় বরাদ্দ বাড়াতে গেলে বাজেটে টান পড়ে। প্রতিবেশী দেশগুলো যেহেতু এই খাতে বিপুল
অর্থ ব্যয় করে থাকে তাই ভারতকেও নিরাপত্তার কারণে একই পন্থা অবলম্বন করতে হয়। তাই
যেখানে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সদ্ভাব নেই সেখানে অনেক দেশই মানব সম্পদ উন্নয়নে
পিছিয়ে আছে। সামরিক খাতে ব্যয়ের নিরিখে চীন, ভারত ও পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য
দেশগুলোর চাইতে যথেষ্ট এগিয়ে থাকায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়বরাদ্দে অনেকটাই
পিছিয়ে আছে। বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে মোট জাতীয় উৎপাদনের ৬
শতাংশ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। তা স্বত্বেও স্বাস্থ্য পরিসেবায় ভারত বিশ্বের
সর্বনিম্ন পাঁচটি দেশের মধ্যে একটি হয়েই থাকবে। সমস্যাটা হলো স্বাধীনতার পর থেকে
ভারতে স্বাস্থ্য খাতে যে পরিমাণ অর্থলগ্নি করা হয়েছে তার প্রায় ৭০ শতাংশই এসেছে
বেসরকারি পুঁজি লগ্নির মাধ্যমে। তাই গরিবদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার যে সুযোগ তা
এতই কম যে বিশ্বের মোট স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা পরিসেবায় বঞ্চিত জনগণের মধ্যে ২১ শতাংশই
থাকেন ভারতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে প্রতি ৬০০ জন নাগরিকের জন্য ১ জন
ডাক্তারের, যেখানে ভারতে বর্তমানে প্রতি ১৮০০ নাগরিকের জন্য আছেন ১জন ডাক্তার। তাই এদেশে
ডাক্তার দেখাতে গেলে ভিড়ের মধ্যে অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয়। আমার জানা মতে এই দীর্ঘ
প্রতীক্ষা এড়াতে অনেকেই এ পথ মাড়াতে চান না।
ভারতে বর্তমানে প্রয়োজন অতিরিক্ত ১৫ লক্ষ ডাক্তার এবং ২৫
লক্ষ নার্স ও প্যারা-মেডিক্যাল স্টাফ। তাই আরো ৬০০টি মেডিক্যাল কলেজ এবং ১৫০০টি
নার্সিং ও প্যারা-মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন করতে হবে। আগামী কুড়ি বছরেও যদি এই
লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হয় তাহলে প্রথমে যে কাজটি করতে হবে তা হলো সামরিক খাতে
ব্যয়কে কমিয়ে এনে এই অর্থ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা। কিন্তু যখনই এটা করার
উদ্যোগ নেওয়া হবে তখনই কার্গিলের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হবে কার স্বার্থে তা
বোঝতে পারার ক্ষমতা আমার নেই।
চীন সামরিক খাতে ব্যয় করে বাজেটের মোট ১৮.২ শতাংশ, যেখানে পাকিস্তান
আরো এগিয়ে গিয়ে ব্যয় করে মোট ২৩.১ শতাংশ। পাকিস্তানকে বেশি শতাংশ ব্যয় করতে হয়
কারণ ভারতের মোট বাজেটের পরিমাণ যেহেতু অনেক বেশি তাই টেক্কা দিতে গিয়ে এই ব্যয়
বৃদ্ধি করতে হয় দেশটিকে। তা স্বত্বেও যুদ্ধ করতে গিয়ে হেরে যায় বারবার। তবে এই
যুদ্ধাকাঙ্খার দরুন মানব সম্পদে পিছিয়ে আছে দেশটি। বাংলাদেশে এই ব্যয় বাজেটের
১২-১৩ শতাংশের কাছাকাছি। তাই স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তান
তুলনায় বেশি শতাংশ ব্যয় করতে পারে। যার ফলে মানব সম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের মতো একটি
গরিব দেশ মাঝারি হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও পাকিস্তান কিন্তু নিম্ন উন্নয়নের দেশ হয়েই
আছে। সামরিক খাতে এত বিশাল ব্যয় পাকিস্তানকে কোন গাড্ডায় নিয়ে ফেলবে সে বিষয়ে
দেশটিতে এখনও কোন গণ সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। এ ব্যাপারে ভারতেও যে খুব একটা সচেতনতা
আছে তা কিন্তু নয়।
প্রতি বছর যুদ্ধ না হোক কিন্তু বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ
প্রস্তুতির জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তার ফলে ভারত ও পাকিস্তানে
চিকিৎসা পরিসেবায় পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয় করতে সরকারের তহবিলে টান পড়ে। তাই প্রতি বছর
লক্ষ লক্ষ মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যান। এ যাবত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে যত সৈনিক
মারা গেছেন তার চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি মানুষ মরেছেন বিনা চিকিৎসায়। শুধু মাত্র
পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও বৈরিতাপূর্ণ মনোভাব বজায় রাখতে গিয়ে দুটো দেশেরই এক
হাল। ‘রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল’, এই অতি সাধারণ কথাটা বোঝতে গেলে কতটা
ধর্মীয় উন্মাদনা ও বেবকুফির প্রয়োজন তা আমার জানা নেই। তবে ধর্মীয় ভাবাবেগ যে দুটো
দেশের জন্যই কাল হয়েছে এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এর জন্য উভয় দেশেরই গণসচেতনতা
প্রয়োজন। একদিকে কাশ্মীর, অন্যদিকে রাম মন্দির কিংবা বাবরি মসজিদের মতো বিষয় নিয়ে
উন্মাদনার চাইতে যে জনশিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গণ্য করতে হবে
তা রাজনীতিবিদদের বুঝিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় সরকারেরও টনক নড়বে না। কোন
ক্ষেত্রে গণসচেতনতা গড়ে না উঠলে সরকারও ওই ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে চিন্তা
করে না। তাই ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে ভারত সরকার তাই এই দুটো ক্ষেত্রেই কোন ধরণের
প্রাথমিকতা দেয় নি। বরং সর্বশিক্ষা খাতে এনডিএ সরকার বাজেট বরাদ্দ কমিয়ে অর্ধেক
করে দিয়েছে কারণ তারা জানেন যে এতে করে ভোট হারানোর ভয় নেই। বরং ভোটের আগে ধর্মীয়
উন্মাদনা সৃষ্টি করতে পারলেই কাজ হাসিল হয়ে যাবে।
২০১৩ সালের তুলনায় মানব উন্নয়নর ক্ষেত্রে ২০১৪ সালে ভারতসহ
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের অবস্থানে উন্নতি ঘটেছে। শ্রীলঙ্কা দু’ধাপ এগোলেও বাংলাদেশও এগিয়েছে এক ধাপ।
বাকি দেশগুলো একই জায়গায় রয়েছে।
পাকিস্তান এ
ব্যাপারে চিরকালই উদাসীন, তবে ভারতও এগোতে পারে নি। ২০১৪ সালের জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন
সংস্থার মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের স্থান হয়েছে ১৪২ নম্বরে। ২০১৩ সালে তা ছিল
১৪৩ নম্বরে। মানব উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার অবস্থান
সবচেয়ে ভালো। বাংলাদেশ সার্বিকভাবে ভারতের পেছনে থাকলে ও পাকিস্তানের আগে রয়েছে।
এছাড়া নারী-পুরুষ সমতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় ভালো।
এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান যেখানে ১০৭তম, যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান
যথাক্রমে ১৩৫ ও ১৪৬। গত পনেরো বছরে ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশি নারীরা
নিজ দেশের পুরুষদের তুলনায় বেশি হারে উন্নতি করেছেন। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন মনে
করেন যে বাংলাদেশের এই মানব উন্নয়নে এগিয়ে যাওয়া এবং নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য
কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে দেশটির বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনজিও)ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
ভারত ও পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে আরো সচেতন হতে হবে। বিশেষত নারী পুরুষের মধ্যে
সমতার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অবস্থান খুবই খারাপ। তবে ভারতের অবস্থাও যে ভাল নয়,
এটা লজ্জার কথা।
মানব উন্নয়ন সূচকের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিতে বাংলাদেশ ছিল
২০১৩ সালে বিশ্বের ১৮টি দেশের মধ্যে একটি। ২০১৪ সালেও বাংলাদেশ উন্নতির এই ধারা
বজায় রেখেছে। সার্বিক উন্নয়ন সূচকেও বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান ও
নেপালের চেয়ে বেশি উন্নতি করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকেও বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় ভালো
করেছে। তাই এটা অনুমান করা যায় যে বাংলাদেশ যদি এ ধারা বজায় রাখে তাহলে আগামী এক
দশকের মধ্যে দেশটি ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি জায়গা করে
নিতে পারে। তবে এটাও ঠিক যে মানব উন্নয়নে শ্রীলঙ্কাও বাংলাদেশের মতোই এগিয়ে চলেছে
ধাপে ধাপে। তাই এদেশের প্রধানমন্ত্রীর উচিত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গুরুর আসনে না
বসে বরং ছাত্রের আসনে বসা। কারণ শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের কাছ থেকে এদেশের এখনও অনেক
কিছুই শিক্ষণীয় আছে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে ভারতের বাজেট বরাদ্দ ঠিকই আছে যদিও,
তবে আগামী দিনে
ভারত জনশিক্ষাতেও পিছিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা আছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে
শিক্ষা খাতে ব্যয় ২ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৭০,৫০৫ কোটি টাকা যা
এ বছরের বাজেটে কমিয়ে ৬৯০৭৪ কোটি টাকা করা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছরে যদি মোট
বাজেটের পরিমাণের নিরিখে বিচার করতে হয় তাহলে দেখা যাবে যে শিক্ষা খাতে ব্যয় ১৬.৫৪
শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে একটা জিনিস স্পষ্ট ভাবে বোঝা গেছে যে এই সরকার
শিক্ষাকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে চিন্তা করতে নারাজ। তা নরেন্দ্র মোদি যখন
প্রধানমন্ত্রী তা এরকম তো হতেই পারে। কারণ তিনি দীর্ঘদিন ধরে গুজরাটের
মুখ্যমন্ত্রী থাকা স্বত্বেও ২০১৪ সালের প্রাথমিক শিক্ষার রাজ্যভিত্তিক প্রতিবেদনে
দেখা গেছে যে ভারতের ৩৫টি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলের মধ্যে গুজরাটের স্থান
হয়েছে ৩৪ নম্বরে, যেখানে মেঘালয় পেয়েছে এক নম্বর স্থান। এই প্রতিবেদন পেশ করেছেন মোদির স্নেহধন্যা
কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী শ্রীমতী স্মৃতি ইরানি। তাই এ ব্যাপারে অন্তত
মোদির কিছুই বলার নেই। তাই নরেন্দ্র মোদির শাসনকালে জনশিক্ষাতে এই দেশ যে আরো
পিছিয়ে পড়বে এতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ গুজরাট অনেক দিক দিয়েই পিছিয়ে থাকা স্বত্বেও
তিনি এই রাজ্যের মডেল দেখিয়ে নির্বাচনের বৈতরণী পার হয়েছেন। তাই গুজরাট মডেল আসলে
কি তা আমরা কিছু পরিসংখ্যান থেকে দেখে নেবো।
২০১২ সালে দিল্লিতে অমর্ত্য সেন প্রদত্ত একটি ভাষণ থেকে
জানা যায় যে পরিকাঠামোগত দিক থেকে গুজরাত উন্নতি করলেও মানব উন্নয়নে আশাপ্রদ ফল
দেখাতে পারে নি। তাই ২০১২ সালে গুজরাটের মাথাপিছু আয় যেখানে ছিল ৬৩০০ টাকা,
সেখানে
তামিলনাড়ুতে ছিল ৭০০০ টাকা, হিমাচল প্রদেশে ৯৯৬২ টাকা ও কেরালায় ছিল ৯৯৮৭ টাকা। এছাড়াও
ঐ সময়ে গুজরাটের ৩১.৬ শতাংশ মানুষ ছিলেন দারিদ্রসীমার নীচে। যেখানে তামিলনাড়ুতে
ছিলেন ২৯.৪ শতাংশ, হিমাচল প্রদেশে ২২.৯ শতাংশ ও কেরালায় ১৯.৬ শতাংশ। এছাড়াও নারী সাক্ষরতার হার
২০১২ সালে গুজরাটে ছিল ৬৩.৮ শতাংশ, তামিলনাড়ুতে ৬৯.৪ শতাংশ, হিমাচল প্রদেশে ৬৯.৫ শতাংশ এবং কেরালায়
৯৩ শতাংশ।
শিশু অপুষ্টির ক্ষেত্রেও যে মোদির গুজরাট উল্লেখযোগ্য কিছু
করতে পারে নি তার কারণ ৫ বছরের কম বয়সের শিশুমৃত্যুর হারেও গুজরাটের অবস্থা ছিল
লজ্জাজনক। সেখানে এর হার ছিল ৬০.৯ শতাংশ, যেখানে তামিলনাড়ুতে এই হার ৩৫.৫ শতাংশ, হিমাচল প্রদেশে
৪১.৫ শতাংশ ও কেরালায় ১৬.৩ শতাংশ। শিশুদের টিকাকরনেও মোদির শাসনে ২০১২ সালে
গুজরাটে ৪২.৫ শতাংশ শিশুর টিকাকরন হয়েছিল, যেখানে তামিলনাড়ুতে হয়েছিল ৮০.৯ শতাংশের, হিমাচল প্রদেশে
৭৮.৩ শতাংশ ও কেরালায় ৭৫.৩ শতাংশ শিশুর টিকাকরন হয়েছে। তাই গুজরাট মডেলে যে মানব
উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া হবে না তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।
এখন দেখা যাক ভারতের রাজ্যভিত্তিক মানব উন্নয়ন কোন স্তরে
আছে। কারণ মানব উন্নয়নে রাজ্য সরকারেরও ভূমিকা আছে। ২০০৮ সালের মানব উন্নয়নের
নিরিখে ভারতের রাজ্যগুলোকে উন্নয়নের ক্রমানুসারে সাজালে তা হবে এরকম - কেরালা,
দিল্লি, হিমাচল প্রদেশ,
গোয়া, পাঞ্জাব, উত্তর-পূর্বাঞ্চল
(অসম বাদে), মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, হরিয়ানা, জম্মু ও কাশ্মীর, গুজরাট, কর্নাটক, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরাখণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ, অসম, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, মধ্য প্রদেশ, বিহার, ওড়িশা ও ছত্তিসগড়। দেখা যাচ্ছে যে অসমকে বাদ দিলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অবস্থা
এতটা খারাপ নয়। আবার নরেন্দ্র মোদির গুজরাটের স্থান ১১ নম্বরে। অসমের স্থান হয়েছে
১৬ নম্বরে, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের কাছাকাছি। ২০০৮ সাল পর্যন্ত অসমে দশ বছর বাদ দিয়ে কংগ্রেস
সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী সরকারের রাজত্ব ছিল ৩০ বছরেরও বেশি। তা বামপন্থী
সরকারের আমলেও পশ্চিমবঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রায় তেমন উন্নতি সাধন যে হয় নি তা পরিসংখ্যান
থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়।
মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, বিহার, ছত্তিসগড়, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও উত্তরাখণ্ডে মানব উন্নয়নে পিছিয়ে থাকার একটা বড়
কারণ হলো এই রাজ্যগুলোতে প্রায় ৭৫ শতাংশ পরিবারেই শৌচালয় নেই। তাই যাঁহা সোচ ওঁহা
শৌচালয়ের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে টিভিতে। এই শৌচালয় না থাকার দরুন গ্রামবাসীরা
ধানক্ষেতে গিয়েই শৌচকর্ম সারেন। যার ফলে রোগ জীবাণুর হাত থেকে উদ্ধার পান না এই
গ্রামবাসীরা। এছাড়া গ্রামের স্কুলগুলোতে শৌচালয় না থাকায় অধিকাংশ মেয়েরা স্কুলে
ভর্তি হয়েও শেষ পর্যন্ত পড়াশুনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। দেখা গেছে যে সব গ্রামগুলো
নির্মল গ্রাম পুরষ্কার পেয়েছে সেখানেও এই শৌচালয়গুলো ব্যবহৃত হয় মূলত গুদাম
হিসেবেই। কারণ ক্ষেতে গিয়ে শৌচকর্ম করা নাকি আমাদের সভ্যতার এক রীতি ও পরম্পরা। তাই গ্রামের অর্থবান ব্যক্তিরাও বিশাল
বাড়ি বানিয়ে সেখানে শৌচালয় রাখেন না এই রীতি মেনে। ফলে মহিলারা তেষ্টা পেলেও জল
পান করেন না, কারণ দিনের বেলা প্রস্রাব পেলে রাতের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। প্রথা অনুযায়ী
মহিলারা রাতের অন্ধকারে ক্ষেতে গিয়ে শৌচকর্ম সারেন। দিনের বেলা এই কর্ম করার কোন
সুযোগ নেই। তাই এই মহিলারা একদিকে যেমন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে আছেন, তেমনি নানা ধরণের
রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন এই ‘সোচ’ না থাকার জন্য। রাতের অন্ধকারে ক্ষেতের মধ্যে শৌচকর্ম করতে
গিয়ে ধর্ষিতাও হয়েছে অনেকে। তা স্বত্বেও পুরুষদের কোন হেলদোল নেই। তবে এই সমস্ত
রাজ্যে শৌচালয়ের অভাব বেশি হলেও অন্যান্য রাজ্যেও এই চিন্তাধারার প্রবণতা আছে। তাই
সর্ব ভারতীয় স্তরে এদেশের ৪৮ শতাংশ পরিবারেই শৌচালয় নেই। পরিসংখ্যান থেকে দেখা
গেছে যে ভারতের গ্রামাঞ্চলে ২০০৩ সালে ৩৬ শতাংশ পরিবার পাকা বাড়িতে থাকতেন সেখানে
২০০৯ সালে তা বেড়ে ৫৫ শতাংশ হয়েছে। ২০০৯ সালে শহর ও গ্রামাঞ্চল মিলিয়ে ভারতের মোট
৬৬ শতাংশ পরিবার পাকা বাড়িতে থাকেন বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু এই বৃদ্ধির সঙ্গে ‘সোচ’ বদলায় নি, তাই অধিকাংশ এই সব
পাকা বাড়িতে দেবালয় থাকলেও শৌচালয় নেই। তবে দেবতাদের শৌচালয়ের প্রয়োজন না হলেও
মানুষের তো হয়। বিশেষত এই শৌচালয় না থাকার জন্য এদেশের গ্রামাঞ্চলের নারীরা
শিক্ষাদীক্ষা ও স্বাস্থ্য, এই উভয় দিক দিয়েই পিছিয়ে পড়েছেন। দেখা গেছে যে এই
রাজ্যগুলোতে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বেশি। তাই প্রতিটি
স্কুল ও প্রতিটি পরিবারে শৌচালয় নির্মাণকে প্রাথমিকতার ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে।
এর ব্যাপক প্রচারের সাথে সাথে সরকারি অনুদান বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তবে এতটা
হতাশার মধ্যেও আশার আলো যদি বা কিছুটা দেখা যায় তা হলো যে এই গোবলয়ের রাজ্যগুলোতে
ইদানীংকালে শিক্ষা ক্ষেত্রে বেশ উন্নতি ঘটেছে। স্কুল শিক্ষার পাঠ্যক্রমে যদি
শৌচালয় নির্মাণের প্রসঙ্গটি স্থান পায় তাহলে শিক্ষা প্রসারের ফলে যদি ‘সোচ’ বদলায় তাহলে আগামী
দিনে হয়ত মহিলারা এই ভয়ঙ্কর দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা থাকে উদ্ধার পাবেন।
পরিশেষে এটুকুই বলব যে কোন দেশের আর্থিক বিকাশের সঙ্গে সে
দেশের মানব উন্নয়ন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত হয়ে থাকে। ভারতে আশির দশক পর্যন্ত অতিরিক্ত
সরকারি হস্তক্ষেপের ফলে আর্থিক বিকাশের পথ কিছুটা রুদ্ধ হয়েই ছিল। নব্বইয়ের দশকের
শুরু থেকেই সরকারি নীতির উদারীকরণের ফলে আর্থিক বিকাশের পথ অনেকটাই মুক্ত হয়েছে।
১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মোট জাতীয় উৎপাদন ৫.৫৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭.৫৯ শতাংশ
হয়েছে যদিও, তবে এই উন্নয়নের ফসল তাৎক্ষণিকভাবে সমাজের নিম্ন স্তর পর্যন্ত পৌছায় নি। তাই
নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ভারত মানব উন্নয়নে নিম্ন স্থান দখল করে ছিল। তবে ২০০২ সালের
পর থেকে এই উন্নয়নের ফসল নিম্ন স্তরে গিয়ে পৌছতে শুরু করায় ধীরে ধীরে ভারত মাঝারি
উন্নয়নের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। চীন এই আর্থিক উদারীকরণের নীতি গ্রহণ
করেছিল ১৯৭৮ সালেই। তবে ১৯৮০’র দশক থেকেই চীনে নব্য আর্থিক নীতি চালু করা হয় এবং
নব্বইয়ের দশক থেকে চীনের অর্থনীতিতে তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ব্যাংকিং ও
পেট্রোলিয়াম বাদে বাকি প্রায় সব সেক্টরেই বেসরকারিকরণ, বিদেশি পুঁজিনিবেশ, ব্যবসাবাণিজ্যের
ক্ষেত্রে সরকারি অনুপ্রেরণা ও সাহায্য ইত্যাদির ফলে বিশেষত নব্বইয়ের দশক থেকেই ঐ
দেশে মোট জাতীয় উৎপাদন গড়ে প্রতি বছর ৯.৫ শতাংশ হারে বাড়তে থাকে। ২০০৫ সালের
রিপোর্ট অনুযায়ী চীনের জাতীয় উৎপাদনের ৭০ শতাংশই ছিল বেসরকারি স্তরে। তাই ভারত ও
চীন একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে নিম্ন উন্নয়নের দেশ থেকে মাঝারি উন্নয়নের দেশে
উন্নীত হয়েছে এটা আশার কথা। গত কয়েক বছরে চীন মাঝারি থেকে উন্নত মানব উন্নয়নের দেশ
হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। তাই ক্রম উন্নয়নের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা, চীন ও বাংলাদেশ যে
সব নীতি গ্রহণ করেছে তা আমাদের অনুধাবন করতে হবে। কারণ ভারতে উন্নয়নের হার এই সব
দেশ থেকে অনেকটাই কম। নেহেরুর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি যে দেশের অর্থব্যবস্থার
বিকাশের পথকে রূদ্ধ করে রেখে দিয়েছিল তা থেকে আমরা অনেক আগেই বেরিয়ে এসেছি। এখনও
যে সমস্ত বাধাবিপত্তি আছে তার অবসান ঘটানো প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের চিন্তাভাবনার
মধ্যেও পরিবর্তন আনতে হবে। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
দেশি কিংবা বিদেশি পুঁজি নিবেশ যাতে বাড়ে তার জন্য উপযুক্ত মানব প্রশিক্ষণ ও
পরিকাঠামোগত উন্নয়নকে প্রথমিকতার ভিত্তিতে চিন্তা করতে হবে। কারণ দীর্ঘ দিনের
পরিসংখ্যান থেকে আজ অর্থনীতিবিদরা একটা কথা উপলব্ধি করেছেন যে মোট জাতীয় উৎপাদন
বাড়াতে না পারলে মানব উন্নয়নের বিকাশ সম্ভব হয় না। তাই আশায় বুক বেঁধে উন্নয়নের
প্রকৃত রূপরেখা নির্ণয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। গণসচেতনতা বাড়লে
সরকারও এ ব্যাপারে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কাজ করতে বাধ্য হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন