“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ৫ আগস্ট, ২০১৫

সুরমা গাঙর পানি-- ভাটি পর্ব ১১

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  একাদশ  অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)

এগারো


   গুরু কন্যা চামেলি, যার ডাক নাম চায়না , বৈতলকে চিমটি কেটে ডাকে । বলে,
--- খুব হাউশ অইছে নানি । বদরপুর যাইতায় । তারে তারে পাখির নাচ দেখতায় ।
--- অয় , অইছে তো ।
--- তে যাও একলা । আমি তো যাইয়ার না ।
--- হে ।
--- হে কিতা । ভকামি করিওনা । আমার ইবায়দি ছেরা ছুটের , তাইন যাইতা নাচ দেখাত ।
       ধর্মপ্রাণ করাতি পরিবারের বারুণি স্নানের পুণ্যার্জন বাধা দূর করতে দায়িত্ব দেওয়া হয় বৈতলকে। কনিষ্ঠা কন্যা থাকবে বাড়িতে । গুরু বলেন,
--- পেট যখন ছুটছে, ছোটজন থাকউকা । বাবাজিও তো আছইন দুকানো , দেখবানে ।
     ওঝার বিশ্বাস বৈতল তার পুত্রসম । তাই অগাধ ভরসা ।
     দুর্গা দুর্গা বলে সবাই তীর্থভ্রমণে বেরিয়ে যেতেই চামেলি সুস্থ । চায়না রেঁধে খাওয়ায় পিতার শিষ্যকে । বৈতলকে কেউ অনেকদিন পর আদর করে খেতে দেয় একা একা । মাও দেয়নি এমন, ইচ্ছে থাকলেও বাপের ভয়ে ছেলেকে আদর দিতে পারে নি । বড় মাছ বৈতল কখনও খায় নি , বাপকে না দিলে মার গায়ে ছুঁড়ে মারে থালা । খেতে খেতে বৈতল চায়নাকে বলে,
--- তুমি আমার মার লাখান ।
--- কেনে , তুমার মা তো কইছ খুব সুন্দরী । ধলা । আমার মতো কালা নায় ।
--- না না হে কতা নায় । ইরকম একলা বওয়াইয়া কেউ আমারে খাওয়ায় না ।
--- খাওয়াইব বিয়া কর । তখন উল্টি যাইব । তখন কইবায় ,
    ‘ মার রান্দা যেমন তেমন বইনর  রান্দা পানি
     আমার বাড়ির এইন যে রান্দইন খাইতে যেমন চিনি ।’
বৈতল হাসে । জুত হয়ে বসে পিঁড়িতে । বলে,
--- আইচ্ছা করমুনে , অখন একটু হাওয়া কর দেখি । বিচইন খান আনো ।
 একদিনের নবাবের কথা মতো কাজ হয় । খাওয়ার পর বলে,
--- পান দেও দেখি , একটু শাদার গুড়া দিও ।
--- ইস্‌ , আমি যেন তান বান্দি আরি । দিমুনে , কিন্তু গান শুনানি লাগব ।
--- হে কতা নি । তে হুন, বৈতলরে কইলেউ গান গায় ।
বলে মিষ্টি হাসি দিয়ে গান ধরে উচ্চকণ্ঠে ,
          ‘ উঠিল জয়ধ্বনি । মেদিনী সকম্পিতা
            হিন্দু মুসলমান এক মায়ের সন্তান ।’
চায়না থামিয়ে দেয় শুরুতেই । বৈতলের মুখে হাত দিয়ে বলে,
--- ইতা না ইতা না । বাবার লগে থাকিয়া থাকিয়া ইতা কিতা ভদ্রা ফদ্রা গান শিখছ । অন্যতা গাও ।
বৈতল যেন গুরুর বাধ্য ছাত্র । গায়,
--- ‘ ছিকালড়ে ছিকালড়ে
      ঝন্‌ঝনাইয়া টেকা পড়ে ।’
--- ইশ্‌ বাদ দেও, তে গাওন লাগত নায় ।
--- আইচ্ছা গো মাই, কান্দিও না, গাইয়ার গান,
মুচকি হাসি দিয়ে বৈতল এবার তার গানের গাড়ি ঘুরিয়ে দেয় । মনপ্রাণ ঢেলে গায়,
---  ‘ আইল রে বসন্তকাল
       দুঃখিনীর দুঃখের কপাল ,
       প্রাণকান্ত বিনে আর প্রাণ বাঁচে না’ 
শেষ লাইন বিভিন্ন মোচড়ে বারবার গাইল । চোখের ইশারায়ও স্বরগমের ওঠাপড়ায় , আবহ তৈরি হয় । গানের শেষে ঘোর নামে চামেলির মনে । বৈতলকে বলে,
--- অখন যাও , আমি ঘুমাইতাম ।
--- ঘুমাও না, কে না করছে ।
--- তুমি গেলে আমি দরজাত বেন্দা দিতাম ।
--- কই কও বেন্দা ।
      বৈতল দরজায় বেন্দা নামের হুড়কো দেয় । স্বপ্নের ঘোরে এতদিন যা খাবলাখুবলি করেছে, হাতের কাছে পেয়ে বৈতলের কেমন ‘বেভুতা’ লেগে যায় । বলে,
--- খুলো না, একটু দেখি ।
     খুলে দেয় বৈতলের কৃষ্ণ বিহঙ্গ । লেজঝোলা পাখি পেচকুন্দা । যাকে বারবার তারের উপর খেলতে দেখেছে দূর থেকে । তারের পাখি থেকে প্রাণের মানুষ । মানুষ আঠালি মাটির ঢেলাযেমন ইচ্ছে গড়ে নাও মূর্তি । মূর্তির বুকে দুটো সন্ধ্যাপ্রদীপ , কে জ্বালায় , বিধাতা না বৈতল । প্রদীপ দুটো এগিয়ে আসে বৈতলের কাছে । বৈতলের মুখে আগুনের পরশ লাগার আগেই এক বিকট শব্দ হয় গুরুর বাড়ির বাইরে । দরজা কেঁপে ওঠে, বেন্দা নড়ে । বৈতল বলে,
--- বাইরে তুফান উঠছে ।
অগ্নিকন্যা চায়না বলে,
--- ডেকা ঢুকছে বিচরাত ।
--- না না , তুফান আইছে , দেখ বেন্দা লড়ের ।
  বাঘিনীর দৃষ্টি নিয়ে নগ্নিকা মূর্তি বৈতলকে আক্রমণ করে ।
আধা সম্বিতের ঘোরে বৈতলের চোখে তখন দারিয়াপাড়ার এক গর্বিত কিশোরীর অসহায় মুখ । আর এক ফকিরকে দেওয়া কথার সত্য । যন্ত্রণাবিদ্ধ বৈতল কোনোক্রমে বাঁশের দরজার হুড়কো উঠিয়ে দেয় ওপরে । দরজা খুলে বেরিয়ে আসে সদ্যযুবক ।

চলবে
< ভাটি পর্ব ১০ পড়ুন                                                    ভাটি পর্ব ১২ পড়ুন > 


কোন মন্তব্য নেই: