“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৫

তীর্থভ্রমণ


।। শিবানী দে।।


( বল্লম হাতে মন্দিরের নিজস্ব রক্ষী  মাঝে মাঝে টহল দেয়)
ঠাৎ বেরিয়ে পড়া হল ----দিল্লি হয়ে অমৃতসর---ফিরবার পথে বারাণসী । তীর্থভ্রমণ আর কি । বেশ কিছু তীর্থ ঘুরলেও এই দুটো প্রধান  তীর্থতেই এ যাবৎ  যাওয়া হয়ে ওঠে নি, এদিকে আত্মীয়, প্রতিবেশী সবাই বলে একাধিকবার ঘুরে এসেছে । দিল্লি যাবার দরকার পড়েছে মেয়ের, সেই অজুহাতে মা-বাবার কপালে এল ভ্রমণযোগ । মেয়ে দিল্লির কাজ সেরে অন্য আরেকটা কাজে চলে গেল মাইসোর, মা-বাবার সেখানে যাবার দরকার নেই , তাই বাকি ছ'দিনের প্রোগ্রামে তীর্থটুকু ঘোরার সুযোগ নেওয়াই যায় । দিল্লি থেকে দিল্লি- অমৃতসর ইণ্টারসিটি এক্সপ্রেসে অমৃতসর পৌছলাম । ভেবেছিলাম সব ভাঙ্গাচোরা ট্রেন বুঝি পূর্ব ও পূর্বোত্তর ভারতে আছে । ধারণাটা ভুল প্রমাণিত হল । ইণ্টার সিটিতে যে চেয়ারকারে উঠেছিলাম, সেই কামরা এসি, কিন্তু মনে হল আশি শতাংশ চেয়ারই  কিছু না কিছু ভাঙ্গা । সাত ঘণ্টার জার্নি, একঘণ্টা লেট, অমৃতসর রাত দশটায় । স্টেশন চত্বরের অটোওলা রিক্সাওয়ালাদের চক্রব্যূহের থেকে একজন অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী  রিক্সাওয়ালা আমাদের নিয়ে চলল । দ্রষ্টব্য স্থান দেখার সুবিধার জন্য আমরা স্বর্ণমন্দিরের   কাছেই   একটা হোটেল বুক করে রেখেছিলাম । স্বর্ণমন্দিরের আশেপাশে দু-তিনবার চক্কর লাগিয়েও যখন আমাদের হোটেলের খোঁজ মিলল না, রিক্সাওয়ালার  অমৃতসরের  সব  অলিগলি চিনবার আত্মবিশ্বাস ফুটোপ্রায়, তখন হোটেলেই ফোন করে তাদের নির্দেশে একটি গলির সামান্য ভেতরে গন্তব্যে পৌঁছানো গেল । অনলাইনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ঠিকই আছে, তবে মন্দিরের আশেপাশে  সব রাস্তাই যে গলি একথা জানানো ছিল না ।     
           পরদিন সকালে দুমিনিট হেঁটেই পৌছে গেলাম স্বর্ণমন্দির । দর্শনী দেউড়ি গেট দিয়ে ঢিকতেই একেবারে সাদার সমারোহ---রোদ পিছলাচ্ছে  । শিখ ধর্মস্থানে মাথা ঢাকতে হয়, কর্তা গেরুয়া মস্তকাবরণ কিনে মাথায় বাঁধলেন, আমি মা ঠাকুমাদের ঘোমটা দেবার পদ্ধতিটা ঝালিয়ে নিলাম । হাতব্যাগ, মোবাইল ক্যামেরা জমা নেওয়া হয়না, মন্দিরের ভেতর কথা না বললে, ফোটো না তুললেই হল । সিকিওরটির বাড়াবাড়ি নেই । জুতো রাখবার জায়গায় জুতো খুলে দিলাম, হাসিমুখে যাঁরা জুতো রাখবার দায়িত্ব নিচ্ছেন, তাঁরা সকলেই দৃশ্যত অবস্থাপন্ন । মন্দিরের বাইরের গেটে ঢোকার মুখে জলপ্রণালী, তার মধ্য দিয়ে হেঁটে উঠতে হয়, পা ধোয়ার অনবদ্য ব্যবস্থা । তার পর থেকে  সমস্ত পায়ে চলার পথটুকু দরি বিছানো, ভিজে পা মার্বেলের মেঝেতে হড়কানোর ভয় নেই ।
            মন্দিরচত্বর চারপাশের থেকে নিচুতে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে সামনেই সরোবর, তার মাঝখানে স্বর্ণমন্দির । মন্দির থেকে পারে যাতায়াতের পুল আছে, সরোবরের পার মূলত শ্বেতপাথরে বাঁধানো নানা রঙের মধ্যে সোনালি ও কালো মর্মর ব্যবহার করে সুন্দর নকশা করা হয়েছে । পুণ্যার্থীরা স্নান করছেন, মেয়েদের ঘাট আলাদা । মন্দিরে যাবার জন্য সরোবরের বাঁদিক ধরে এগোতে হয় । তৃষ্ণার্ত তীর্থযাত্রীদের জন্য চত্বরের কোণে কোনে জলসত্র, বাটিতে বাটিতে জল ভরে রাখা । জল খেয়ে এঁটো বাটি নিচে রাখলেই সঙ্গে সঙ্গে  সেটা ধোয়া হয়ে আবার জল ভরা হয়ে যাচ্ছে । নিচে জল পড়লেই কিছু সেবক/সেবিকা সঙ্গে সঙ্গেই তা মুছে ফেলছেন । বিশেষ বিশেষ জায়গায় প্রসাদ বিতরণ হচ্ছে, ঘি জবজবে হালুয়া । কাছেই হাত ধোয়ার বন্দোবস্ত, সুচিন্তিত ব্যবস্থাপনা । প্রসাদ নিয়ে আবার লাইনে এলাম, কোন তাড়া হুড়ো নেই, কারো আগে যাবার তাড়া নেই ।
            মন্দিরটি অপূর্ব, ভেতরের গায়ে সোনা ও রঙ্গিন পাথরের সূক্ষ্ম কারুকার্য, সোনার পালকির উপর খোলা হাতে লেখা বিরাট গ্রন্থ সাহেব । গ্রন্থীরা বসে আছেন, কেউ কেউ পড়ছেন । কোন বিখ্যাত মন্দিরেই বেশিক্ষণ দাঁড়ানো সম্ভব নয়, পেছনে দর্শনার্থীদের ভিড় । একটু দাঁড়ালেই পুরোহিতশ্রেণির লোক বা স্বেচ্ছাসেবকদের রূঢ়বাক্য শুনতে হয় । কিন্তু এখানে তা শুনলাম না ।বরং মিষ্টিস্বরে কেউ একজন বলছেন, 'বেটা, আগে বঢ়ো, দুসরোঁকো ভী দেখনে দো ।' এতেই কাজ হচ্ছে, সন্তান- সম্বোধনকে অমান্য করবার মানসিকতা অতিবড় পাষণ্ডের ও বোধ হয় নেই । লাইন এগোচ্ছে মনে দর্শনের পরিতৃপ্তি নিয়ে ।
         উপরের তলায়  অনেক ভক্ত  নিরিবিলিতে বসে গুরুবাণী পাঠ করছেন, সেখানেও মাঝখানে আসনে বিশাল গ্রন্থসাহেব ,পাসে গ্রন্থীরা । আমরা নীরবে দর্শন সেরে এর উপরের তলায় গিয়ে মন্দিরের সোনার চুড়ো দেখে নেমে এলাম ।
         মূল ফটক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে জুতো আনতে যথাস্থানে যেতে সেবকেরা জিগ্যেস করলেন, লঙ্গরে গিয়েছি কিনা । আমরা 'না' বলাতে ওঁরা বললেন, লঙ্গর কা খানা চাখনি চাহিয়ে । এতদূর থেকে এলে, আর লঙ্গরের খানা খেয়ে দেখলে না ? তারপর দিকনির্দেশ দিলেন । ভেতরেই আবার ঢুকতে হল, কারণ মন্দিরচত্বরে ঢুকেই অন্য সিঁড়ি দিয়ে উঠে লঙ্গরে যেতে হয় । উঠে সে কি প্রচণ্ড শব্দ ।  না,মানুষের চিৎকার নয়,  বাসন পত্রের ঝন ঝন আওয়াজ । লাইন দিয়ে এগোতে প্রথমে দেওয়া হল খোপওলা থালা, তারপর চামচ, তারপর জল খাবার জন্য বাটি । মুখে কোন কথা নেই । দরিবিছানো লাইনে সকলের সঙ্গে বসে পড়লাম , সেবকেরা খাবার নিয়ে এলেন । রুটি, ঘিয়ে পেঁয়াজ দিয়ে ভাজা ভাত, রাজমা, কালোকলাইএর ডাল, পায়েস । রুটি নিতে হয় দুহাত পেতে । জল দেওয়া হয় একটা যন্ত্রের সাহায্যে, যাতে মেঝেয় না পড়ে । পেটভরা খাবার । এক ব্যাচের খাওয়া শেষ হলে ঝাট দিয়ে জল ছড়িয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলা হচ্ছে,, যার যার এঁটো বাসন নিয়ে আবার লাইনে এগোনো, সেবকেরা এগোনো লাইনের পাশেই আছেন, এঁটো থালা বাটি চামচ জমা নিয়ে নিচ্ছেন, ধোয়ার জন্য আবার আরেকদল সেবক । একজায়গায় দেখলাম মহিলা সেবকেরা পরবর্তী রান্নার জন্য পেয়াজ রসুন আদা কুটছেন ।
            বিকেলের দিকে সব দরি তুলে ফেলে সেবকেরা, তাদের মধ্যে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা আছে , বালতি বালতি জল তুলে পুরো মন্দির চত্বর ধুয়ে ফেলল। ধোয়া মোছার পর আবার দরি পেতে দেওয়া হল । কোনো ময়লা নেই, ধর্মস্থান যেমনটি হওয়া উচিত, তেমনই ।
                স্বর্ণ মন্দিরে দূর দূর থেকে ভক্তরা আসে, তারা প্রার্থনা ও লঙ্গরে খাবার পর বিশ্রাম নেয় ঢাকা চাতালে, বসে বসে গুরুবাণী পড়ে। আগের দিন রাত্রে দেখেছিলাম বাইরের চত্বরে রাত্রেও অনেকে শুয়ে থাকে । বল্লম হাতে মন্দিরের নিজস্ব রক্ষী  মাঝে মাঝে টহল দেয়, কারো পরনে হলুদ জামা সাদা পাজামা, নীল পাগড়ি নীল কোমরবন্ধ, আবার কারো নীল জামা, সাদা পাজামা, হলুদ পাগড়ি হলুদ কোমরবন্ধ ।
      





(  স্বর্ণমন্দিরে সঙ্গী)
বিকেলের দিকে  যখন বেরিয়ে এলাম
, তখন মনে হল একটা যথার্থ ধর্মস্থানে গিয়েছিলাম । ধর্মকে এরা পণ্য করেনি, সেবাকে এরা ধর্ম হিশেবে নিয়েছে । সমস্ত কাজই কাজ, জুতো রাখা,এঁটো পরিষ্কার করা, ধোয়া মোছা, সবই সেবা । সেবকদের দানেই সব খরচ উঠে আসছে । আশ্চর্যের কিছু নেই যে শিখরা ভারতবর্ষে কৃষিতে, শিল্পবাণিজ্যে, বিদ্যা মেধা্‌য়, শৌর্যে বীর্যে বিশিষ্ট, কারণ তারা কর্মযোগী ।
         ভাবতেও কষ্ট হয় যে এই স্থানে অপারেশন ব্লু-স্টার করার দরকার হয়েছিল ।
                                                                                                ***
         বিকেলের ট্রেনে উঠে পরদিন সন্ধ্যায় বারানসি । মূল দ্রষ্টব্য স্থানের কাছাকাছি থাকার জন্য হোটেল বুক করা হয়েছিল , সেটা হল বিশ্বনাথ মন্দিরের গলির ভেতর । আসন্ন স্বাধীনতা দিবসের জন্য ভীষণ পুলিশি তৎপরতা । মন্দিরের এক কিলোমিটার আগেই রিকশ অটো সব থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তারপর যাত্রীদের পায়ে হেঁটে মালপত্র কুলির মাথায় চাপিয়ে  গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। পৌছে দেখা গেল হোটেলটা একেবারে গঙ্গার ধারে, ব্যালকনি থেকে গঙ্গার অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাঁকটা পুরো দেখা যায় ।মন ভাল হয়ে গেল । হিন্দু তীর্থগুলোর এই বৈশিষ্ট্য, সাধুসন্ন্যাসী মনি ঋষিরা সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যসম্পন্ন স্থান, যেমন সাগর  বা নদীতীর, ঝর্ণা, প্রস্রবণ, পাহাড়ের চুড়ো, উপত্যকা, দেখে আরাধনার স্থল প্রতিষ্ঠা করতেন । সৌন্দর্যে ঐশ্বরিক শক্তির প্রকাশ---- এমন একটা ধারণা বোধ হয় তাঁদের ছিল ।
            প্রতিষ্ঠাতারা একরকম ভেবেছিলেন, পরবর্তীকালে ধর্মের ঠিকাদাররা অন্য রকম ভাবলেন । তারা ভাবলেন এত তীর্থযাত্রী যখন আসছে, ধর্মের পরিষেবা দেবার নামে কিছু কামিয়ে নেওয়া যেতেই পারে , সৌন্দর্য পরিচ্ছন্নতা চুলোয় যাক । মন্দিরের আশে পাশে গলিগুলোতে সেবায়েতরা দেবসেবার পাশাপাশি ব্যবসা চালাতে লাগলেন, বিশ্বনাথমন্দিরের আশেপাশের নোংরা ঘিঞ্জি গলিতে দোকান আর দোকান, বেশির ভাগই সেবায়েতদের । যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি তীর্থযাত্রীদের দেওয়া দানে মন্দির ও তার আশপাশ সাজানো যেতেই পারত, যদি সেরকম ভাবনা থাকত । পুজো দেবার সাজানো ডালা কমপক্ষে একশটাকা, মন্দিরে পুরোহিত সে ডালার বস্তুকটা বিগ্রহের গায়ে ঠেকিয়ে কপালে একটা টিকা পরালেই একশটাকা দেবার আদেশ, কম দিলেই দুর্ব্যবহার । মন্দিরে ঢুকে চারপাশে তাকানোর জো নেই, আধমিনিটেই কাজ সেরে বেরোতে হবে, না হলে পুজোর ঠিকাদাররা তো বটেই, দ্বাররক্ষকের (এখন পুলিশ) ও দুর্ব্যবহার । তীর্থযাত্রীরা সবাই যেন টেররিস্ট । মোবাইল ক্যামেরা সব রেখে আসতে হয়েছে, সঙ্গে রাখবার অনুমতি নেই । তার উপর গেটে স্ক্রীনিং । তবুও মন্দিরচত্বরে কাউকে একমিনিট দাঁড়াতে দেবেনা ।
দশাশ্বমেধ ঘাট, বারাণসী
                                           

কাঙ্গালিদের লাইনে কাঙ্গালি গরু
        এভাবেই রূপোর কারুকার্যখচিত বিশ্বনাথ মন্দির দর্শন করলাম, পুজোও দিলাম, কারণ হাতে পুজোর ডালা মন্দিরে ঢুকবার পারমিট । তারপর একএক করে পার্বতী মন্দির ও অল্প দূরে অন্নপূর্ণা মন্দির দর্শন করে গেলাম দশাশ্বমেধঘাটে । সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার কল্যাণে দশাশ্বমেধ ঘাটের সঙ্গে পরিচয় অনেকদিনের ।  কাছে নিচের দিকে তাকাতে নেই---দূরে তাকাও । মন ভাল হয়ে যাবে বর্ষার ভরা গঙ্গার দিকে তাকালে । মন ভালো হয়ে যাবে অসংখ্য ঘাটে বাঁধা নৌকো দেখলে, মন্দির ও অট্টালিকাগুলোকে দেখলে  । কাছে  তাকালে দেখবে--- কী নোংরা ! যে রাস্তা পেরিয়ে কাঙ্গালিদের লাইনে গরুও বসে এলে, সেখানে যত্র তত্র কফ, থুতু, গরুর (পবিত্র!) গোবর ও কুকুরের বিষ্ঠা, ময়লা ভরা পলিথিন, বাসি পচা খাবার জিনিষ,----কি নেই । ভিখারি ভবঘুরে, ষাঁড়, কুকুর, সাইকেল, ঠেলাগাড়ি, হকার, সব নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো বাইক--- বারানসীর রাস্তায় সে এক নরক গুলজার ।
         এই আমাদের শ্রেষ্ঠ তীর্থ , আমাদের পরম গন্তব্য !
                                                                                           ***

         দশাশ্বমেধঘাট থেকে অটো ধরে গেলাম বৌদ্ধধর্মের প্রথম প্রচারস্থল সারনাথে । বারানসীর বাকি দ্রষ্টব্য পরের দিনের জন্য তোলা রইল । রাস্তায় পড়ল ছোট নদী বরুণা, তার পারে মহানগরীর জঞ্জালের স্তূপ । কলকাতায় এইরকম জঞ্জালের স্তূপ ফেলে জলাশয় বুজিয়ে ফেলা হচ্ছে । এই নদীর ও কি সেই ভবিষ্যৎ ? কে জানে ।
           সারনাথে একজন নেপালি গাইড পেলাম, বলতে গেলে অটোওলা চাপিয়ে দিল । তবে বেশ নম্র ভদ্র ছেলেটি, আমরা বাঙালি শুনে বাংলায় কথা বলছিল । যদ্দূর জানে, পারে, ঘুরে ঘুরে দেখাল, ভাষ্য দিল মাত্র পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে । এত কম রেট শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলাম , একটু আগেই বিশ্বনাথচত্বর থেকে এসেছি কিনা !

 বৌদ্ধস্তূপ, সারনাথ
         সারনাথ অত্যন্ত শান্ত, নিরিবিলি স্থান ।      সারনাথের স্তূপ---- প্রাচীন কালের স্তূপ, আধুনিক কালে নির্মিত মন্দির । স্তূপের নিচের দিকটা বিধর্মী আক্রমণকারীদের দ্বারা বিধস্ত হয়েছিল, মেরামত করে গেট বন্ধ রাখা হয়েছে ।  মন্দিরপ্রাঙ্গণে রাখা বিশাল ঘণ্টাটি মনে হল প্রাচীন । একদল সাদা পোশাকপরিহিত শ্রীলঙ্কাবাসী তীর্থযাত্রী এসেছে, কোন হল্লা নেই । মন্দিরে ধ্যানরত সোনালি বুদ্ধমূর্তি । একজন সৌম্য গেরুয়াপরিহিত বৌদ্ধসন্ন্যাসীর সাক্ষাৎ পেলাম, আমাদের অনুরোধে তিনি ক্যামেরার সামনে পোজ দিলেন ।
            চারপাশ সবুজ, শান্ত, ধ্যানের পরিবেশ ।
           আমি ধর্মে হিন্দু । রামায়ণ মহাভারত গীতা উপনিষদ যা পড়ি, মনে হয় এই ধর্মের, এই সংস্কৃতির তুলনা নেই । কিন্তু যখন ধর্মাচরণের তুলনা করি, তখন মনে হয়, এই ধর্ম যারা আচরণ করে,  তাদের মহৎ করে তুলতে পারে  নি ।  
                                                                                                                
        শিখ ও বৌদ্ধ ধর্মস্থানের সঙ্গে হিন্দু ধর্মস্থানের  তুলনা হয়না । ধর্মের ঠিকাদাররা এই ধর্মকে অনাচরণীয়  করে তুলেছে ।

                                                                                                ***
           একবার আজমিরশরিফ গিয়েছিলাম । সেখানে আমাদের যাবার পরিকল্পনা আছে শুনে আমার গৃহকর্মে সাহায্যকারিণী বৃদ্ধা মুসলিম মহিলাটি অনুরোধ করেছিল সেখান থেকে জল নিয়ে আসতে । বিশ্বাসীদের কাছে সেই জল নাকি ওষুধের মত কাজ করে ।
           আজমির শরিফ  অনেকটা অমৃতসর বা বারাণসীর মতই অপরিষ্কার ঘিঞ্জি গলি পেরিয়ে যেতে হয় , দরগা চত্বরের আশেপাশে মাজারে ফুল চাদর আতর চড়াবার অসংখ্য দোকান, নানা রেটের ডালা সাজানো । লাইনে দাঁড়িয়ে মাজারে ফুল আতর চড়িয়ে নকুলদানার প্যাকেট ছুঁইয়ে মাথায় অনেক চামরের ছোঁয়া (অবশ্যই সেই চামর ছোয়ানো ফ্রি ছিল না) লাগিয়ে বাইরে এলাম । এখন জল কোথা থেকে নিতে হয়? দু-তিন জনকে জিগ্যেস করে ঠিক ঠাক  নির্দেশ পেলাম তো না-ই, কেমন যেন অসহযোগিতার, দ্বেষের দৃষ্টি, একজন তো  জিগ্যেস করার আগেই বলল,'হটো' । একটু এগিয়ে সম্পূর্ণ সাদা চুল দাড়ি সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধকে জিগ্যেস করলাম । তিনি 'বেটা' সম্বোধন করে যেভাবে কথা বললেন, যেভাবে জলের জায়গার সন্ধান দিলেন , আমার মনে হয়েছিল এই রকম মানুষই তো আমি তীর্থস্থানে খুঁজতে গিয়েছিলাম । মনটা আপনা থেকেই তাঁকে প্রণাম করেছিল ।
           বুঝলাম ,যে কোন স্থানে, তীর্থে, যে কোনো ধর্মে  মানুষদেবতা, অথবা মানুষের মধ্যে দেবতার গুণ লক্ষ্য করা যেতে পারে ।






কোন মন্তব্য নেই: