“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ৭ আগস্ট, ২০১২

প্রাণের খোঁজে ‘কিউরিওসিটি রোভার’র মঙ্গল গ্রহে অবতরণ


‘কিউরিওসিটি রোভার’
(লেখাটা দৈনিক যুগশঙ্খে বেরিয়েছে ৭ আগষ্ট, ২০১২)

         কিমাশ্চর্যম ! ‘কৌতূহল’কে নিয়ে কৌতূহল ! আর সেটা কিনা প্রশমিত হল এক ট্যুইট বার্তায়‘আমি মঙ্গল পৃষ্ঠের উপর নিরাপদে আছি । ‘গেইল ক্র্যাটার’ আমি আপনার মধ্যে আছি’
সোমবারের সবথেকে হিট ‘ট্যুইট’কে নিয়ে সারা বিশ্বে শোরগোল শুরু হয়েছে । ‘কিউরিওসিটি রোভার’ মঙ্গলগ্রহে অবতরণ করার পরই ঘটে ঘটনাটি । ট্যুইটারে কিউরিওসিটির নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকে উপরোক্ত বার্তাটি প্রেরণ করার পর সাইবার জগতে আলোড়ন সৃস্টি হয় অলিম্পিকের আপডেটসের খবরও যারা রাখছিলেন তাঁরাও কিছুক্ষণ পর পর নাসার সাইটটিতে চোখ রাখছিলেন । অলিম্পিক জ্বরে কাবু জনসাধারণের মধ্যে হাইটেক প্রযুক্তিতে তৈরি এই রোবটটির অবতরণের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার যে হাইটেক মুনশিয়ানা ‘নাসা’-র বিজ্ঞানীরা করিয়ে দেখিয়েছেন তা এককথায় অনবদ্য । সোমবার ভারতীয় সময় সকাল এগারোটা দুই-এ কিউরিওসিটি মঙ্গলে অবতরণ করার পরই ইতিহাস রচিত হয়ে যায়    পারমানবিক শক্তিতে চালিত এই রোবটটিই হচ্ছে নাসার প্রথম হাইটেক মিশন ।
পৃথিবীর পাশের গ্রহ মঙ্গলকে নিয়ে আমাদের কৌতূহলের অন্ত নেই । সেই প্রাচীন কাল থেকেই ‘লাল গ্রহ’ তাঁর রূপ আর রহস্য ভরা চরিত্র নিয়ে আমাদের মোহিত করে রেখেছে । বিজ্ঞানী থেকে লেখক সবাই মজে গিয়েছিলেন মঙ্গলের প্রেমে । ১৮৯৮ সালে এইচ জি ওয়েলস নামক কল্পবিজ্ঞানের এক বিখ্যাত লেখক যখন তাঁর ‘দ্য ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস’ উপন্যাসটি প্রকাশিত করলেন, তখন মঙ্গল গ্রহ নিয়ে এক নূতন আতঙ্কের সৃষ্টি হল । সেই উপন্যাসের বিষয়বস্তু ছিল সত্যিই লোমহর্ষক । কাহিনীতে উল্লেখ আছে মঙ্গল গ্রহ থেকে একদল কদাকার শুঁড়ওলা ভয়ঙ্কর প্রাণী পৃথিবীতে নেমে এসে ধ্বংস কার্য শুরু করেছে । মানুষ কিছুতেই মোকাবিলা করতে পারছেনা তাদের শক্তিমত্তা আর রণ চাতুর্যের সঙ্গে । শেষ পর্যন্ত নানা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে নানা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গল গ্রহের প্রাণীরা ধ্বংস হল । অবশেষে রক্ষা পেল মনুষ্যজাতি । এই কাহিনী মানুষের মনে সৃষ্টি করলো মঙ্গল গ্রহ নিয়ে এক দুশ্চিন্তা – মঙ্গলে অমঙ্গল নিশ্চয় সেখানে রয়েছে মানুষ থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী । মঙ্গল নিয়ে তেমন অসংখ্য কল্পবিজ্ঞানের কাহিনীর অভাব নেই । অবশেষে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ আবিষ্কার করলো মঙ্গল গ্রহে মানুষের মত কোনও উন্নত প্রাণী নেই । মানব সভ্যতা নিশ্চিন্ত হল । কিন্তু প্রাণের কোনও স্পন্দনই কি নেই সেই গ্রহে  ? এই প্রশ্নটি বিজ্ঞানীদের ভাবিত করেছে সবথেকে বেশী । এর উত্তর এখনো অজানা । আর এ নিয়ে শুরু হয়েছে বিস্তর গবেষণা । সেই রহস্য সন্ধানে নানা স্পেস ক্রাফট মঙ্গলের দিকে ধেয়ে গিয়েছিল নানা সময়ে । যার সাম্প্রতিক সংযোজন হল  ‘কিউরিওসিটি রোভার’ নামক রোবটটি । প্রায় ২৫ কোটি ডলারের এই প্রজেক্টের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মঙ্গল পৃষ্ঠে প্রাণের খোঁজ করা ।
২৬ নভেম্বর ২০১১ সালে ‘মার্স সায়েন্স ল্যাবরেটরি’ মহাকাশযানটিকে ‘নাসা’-র বিজ্ঞানীরা নাসার কেপ ক্যানাভেরাল উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে উৎক্ষেপণ করেন । এই মহাকাশযানেই পে লোড হিসেবে রয়েছে ছয় চাকা বিশিষ্ট একটি বিশেষ রোবট যার নাম হচ্ছে ‘কিউরিওসিটি রোভার’ অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এই রোভারটি পারমানবিক শক্তিতে নিয়ন্ত্রিত । কিউরিওসিটির নকশা বানানো আর সেটিকে তৈরি করার দায়িত্বে ছিলেন নাসার জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা । প্রায় সাড়ে আট মাসের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে গত ৬ আগস্ট ২০১২ সালে ভারতীয় সময় সকাল এগারোটা দুই-এ রোভারটি মঙ্গলের বুকে অবতরণ করে । সাধারণত: সৌরশক্তির সাহায্যে মহাকাশযান কিংবা মানবহীন রোবট গুলোকে চালানো হয়, কিন্তু কিউরিওসিটির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা পারমানবিক শক্তির সাহায্য নিয়েছেন, যা এক অত্যাধুনিক প্রযুক্তিপ্লুটোনিয়াম ব্যাটারির সাহায্যে তাপ এবং বিদ্যুৎ উভয়ই কিউরিওসিটি রোভারকে আগামী ১৪ বছর খুব ভাল ভাবেই সচল করে রাখতে পারবে । এই রোভারেই রয়েছে সতেরোটি অত্যাধুনিক ক্যামেরা । যার সাহায্যে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সম্ভব হবে ।  
এবার জেনে নেওয়া যাক  কিউরিওসিটি রোভার প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য । মঙ্গল গ্রহে প্রাণ আছে কিনা সেটি গবেষণা করাই এর মূল উদ্দেশ্য । মঙ্গলের বুকে নানা পাথর আর গভীর গর্তের মধ্যে কিউরিওসিটি রোবটটি সুড়ঙ্গ করে অনুসন্ধান করবে কোনও ব্যাকটেরিয়া জাতীয় প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা । এর জন্য ঐ রোবটের শরীরের ভেতরেই রয়েছে এক মিনি ল্যাবরেটরি । মঙ্গল পৃষ্ট থেকে পাওয়া নানা পদার্থ সেখানেই বিশ্লেষণ করে রোভারটি সেই তথ্য পৃথিবীতে বেতার তরঙ্গ মারফত প্রেরণ করবেএছাড়া মঙ্গলের আবহাওয়া সম্পর্কেও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করবে এই হাইটেক রোবট । মঙ্গলের ভূতত্ব গবেষণা করাও তার মিশনের একটি প্রধান অঙ্গ । এই মিশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য মঙ্গল গ্রহে  মানব মিশনের রূপরেখা তৈরী করতে বিজ্ঞানীদের আগামীতে নানাভাবে সাহায্য করবে ।  
নাসার চতুর্থ রোবোটিক মিশন কিউরিওসিটি তার পূর্বসুরিদের থেকে অনেক বেশী হাইটেক          সম্পন্ন । এর ভরও আগের রোভার মিশন থেকে বেশী । নাসার পূর্ববর্তী মিশন থেকে এটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে মঙ্গলের উত্তর গোলার্ধে রয়েছে বরফের স্তর । এই কঠিন বরফের নিচেই নাকি রয়েছে তরল জলের সমুদ্র । তাই নাসার বিজ্ঞানীরা উত্তর গোলার্ধের ‘গেল’ নামক ক্রেটারে কিউরিওসিটিকে অবতরণ করান । এই ক্রেটার বা গর্তেই রয়েছে ১৫৪ কিলোমিটার ব্যাস আর ৫.৫ কিলোমিটার উঁচু এক বিশাল পর্বত । ‘এয়েলো মন্‌স’ নামক ঐ পর্বতের বয়স হচ্ছে প্রায় ৩৫ থেকে ৩৮ কোটি বছর । বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে সেখানেই নাকি লুকিয়ে থাকতে পারে প্রাণের বীজ । আগামীতে কিউরিওসিটি সেই ‘গেল’ গর্তেই অক্লান্তভাবে খুঁজে বেড়াতে থাকবে প্রাণের বীজ ।      
নাসার এই সাফল্যে বিজ্ঞানী মহল খুব খুশি । এই হাইটেক মিশনের সাফল্যের উপরই নির্ভর করছে ভবিষ্যতের নানা রূপরেখা । আগামীতে মানব কলোনী গড়তেও এই মিশন যথেষ্ঠ সাহায্য করবে । কে জানে হয়তো ১০০ বছর পর  মঙ্গলগ্রহে হয়ে যাবে আমাদের আর এক ঠিকানাআর তখন গরম কিংবা শীতের ছুটিতে সেই গ্রহে ক’দিন ঘুরে আসাটাও মন্দ হবেনা । কি বলেন ?


( এই ভিডিও দেখবার আগে, 
              উপরে বায়ে ব্লগের 
                      মূল ভিডিও বন্ধ করে দিন) 

কোন মন্তব্য নেই: