( ১৯৮৩র , ১৮ ফেব্রুয়ারী সংঘটিত হয়েছিল স্বাধীনতা উত্তর কালের সবচে ভয়াবহ অথচ অধুনা বিস্মৃত 'নেলি' হত্যাকাণ্ড। প্রায় তিনহাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছিলেন। লাখো লোক হয়েছিলেন গৃহহারা। অসমে। গোটা দেশের বিবেক তখন কেঁপে উঠেছিল। বাংলা-অসমীয়া সহ ভারতের বিভিন্ন ভাষাতে কবিরা ব্যক্ত করেছিলেন তাঁদের ব্যথা। তেমনি এই কবিতা লিখেছিলেন আজকের বাংলা সাহিত্যের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি গৌতম চৌধুরী। পরে সেটি তাঁর কবিতার বই, 'অমর সার্কাসে' প্রকাশিত হয়েছিল। অসমের মাটিতে এখন যে হত্যালীলা চলছে তাতেও প্রচণ্ড বিব্রত কবি। ই-মেলে আলাপ হচ্ছিল গেল একমাস ধরেই এই নিয়ে। মনে পড়ল তাঁর সেই কবিতার কথা। প্রাসঙ্গিক ভেবে আবারো পড়ালেন, আমরাও সেই ভেবেই তুলে দিলাম এখানে।আশা করছি আপনাদের ভালো লাগবে)
কোথায় বুনেছ বীজ, এতদূরে জেগে ওঠে চারা-ঘন নীল মুখর উদ্দাম
কোথায় বুনেছ বীজ,এতোদূরে বেড়ে উঠে পাতা
আঠালো জিভের মতো বেগুনি জিভের মতো রাশি রাশি লক্ষ লক্ষ পাতা
ইঁদুরের চেয়ে আরও দ্রুত ছোটে শেকড়ের দাঁর , বোনে জাল শুষে নেয় রস
ফুটে ওঠে ফুল—আদিম জন্মান্ধ রঙ ছোঁড়ে হল্কা
ফেটে পড়ে ফল—মাদক নিষ্ঠুর তীব্র অখণ্ডমণ্ডল
বিষগাছ
পালাও আগুন লাগল, ঘিরে ফেলল টাঙি ও বল্লম
ওগো মধ্যরাত তুমি কতদূরে বিছিয়েছ ঘুম
সেতু ভাঙা, কিলবিলিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী
শুনতে পাচ্ছ চিৎকার, শুনতে পাচ্ছ?সেতু ভাঙা
কে ভেঙেছে সেতু? তুমি তুমি তুমি তুমি তুমি তুমি তুমি
নদীর দুর্বোধ্য জলে ফণা তোলে হাওয়ার বিদ্রূপ
আর শিশু ভেসে যায় ভাষাহীণতার রাত্রি জুড়ে
সুতোর মসৃণ টান বাঁধা আছে দূরে, হিমঘরে
প্রতি টানে গড়ে ওঠে ছন্দোহীন নাচের কঙ্কাল
হাড়ের সোপান বড় পিচ্ছিল হয়ে আছে রক্তিম শ্যাওলায়
রবু শীর্ষে ওঠা চাই
আশি কোটি সুড়ঙ্গের গর্ভ থেকে টেনে আন তেল
টেনে আন শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম বোধি সংবহ্ন
আশি কোটি সুড়ঙ্গের বুকের নিঃশ্বাসে দাও নিশাদল-ধোঁয়া
তারা ভেঙে টুকরো হোক, তারা ভুলে যাক পরিচয়
জাগো বিষগাছ জাগো
ষোড়শ শতক থেকে বিভক্তি স্বতন্ত্র হয়ে গেছে
আজ বোন, তোকে আর চিনতেই পারি না
আজ বোন, তুই এসে গিলে নিতে চাস
আমার পাহাড় নদি চর ডাঙা বন বনান্তর
তুই আর বোন নস, তুই ডাইনি—মর তুই মত
জাগো জাগো বিষগাছ জাগো
কোথায় বুনেছ বীজ, এতদূর বেজে ওঠে চারা
হাওয়ার সর্বাঙ্গ উঠল নীল হয়ে ফুসফুসে ঢুকেছে হলাহল
বনশুয়োরের দাঁত ছুটে আসছে কলিজা মাড়িয়ে
ভুট্টার ক্ষেতের ঘাড়ে উঠে এল রক্তমাখা চাঁদ
হেই বিষ আরও আয় ঢেকে ফেল মুখ চোখ গভীর জড়ুল
যেন ওরা কেউ কাউকে চিনতে না পারে কোনোওদিন
যেন ওরা ছিঁড়ে ফ্যালে মুখশ্রীর অফুরন্ত ডানা
যেন ওরা নিজেদের অভিশাপে প্রতি-অভিশাপে ঝলসে মরে নিজেরাই
হেই বিষ আরও দ্রুত ছড়িয়ে যা ধর্মাধর্মে ভাষা-বিভাষায়
ছিল দেশ
তাকে তুমি দেশান্তর বানিয়েছ প্রগাড় খেয়ালে
আজ প্রতি টুকরো থেকে শরীরের ছিন্ন রেখা উঠে আসে, যেন প্রেতযোনি
মাথার ওপরে ঘোরে গোল হয়ে প্রশান্ত শকুন নশ্বর নখের ধৈর্য দিগন্ত ছাড়িয়ে চলে গেছে
চড়ুই ভাতির চিতা জ্বলে ওঠে সারি সারি
সারি সারি কালো গর্ত মেলে ধরে বিপুল হামুখ
কত মাটি চাপা দেবে, কত ছাই করবে পুড়িয়ে
কাদামাখা ধানক্ষেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে আরও
ঝোপের ছায়ায় আছে, আছে মুগ্ধ নদীর খাঁড়িতে
সংখ্যা নেই, সেই ভালো
প্রখর শান্তির নখ বুঝে নেবে স্বাদের সমাস
কী ছিল মাংসের নিচে—সাদা হাড়?
তাতে কি প্রমাণ হয় দেশ?
তাতে কি গজায় আজও ক্লান্তিহীন স্বপ্ন—দূর্বাদাম?
জাগো জাগো জাগো বিষগাছ।
২টি মন্তব্য:
কবিতা 'বিষ গাছ'অসাধারণ - মর্মস্পর্শি এবং প্রাসঙ্গিক বলেই এমন কবিতা আরো বেশি পাঠকের কাছে পৌছে দেওয়া কর্তব্য বিবেচনা করে আমি আমার কবিতার ব্লগএ সংযুক্ত করছি । অন্য ব্লগে যুক্ত করার সম্মতিতো দিয়েই রেখেছেন সুশান্ত ।
ভালোই করেছেন, ফাল্গুনীদা!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন