“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ১২ আগস্ট, ২০১২

প্রযুক্তি-চর্চা, সমস্যা জর্জরিত বরাক উপত্যকা ও বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা


(বেশ কিছুদিন আগে 'দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গে' এই লেখকের একটি চিঠি বেরিয়েছিল – সেই চিঠির বিষয়বস্তুকে নিয়েই 'অরুণোদয়' কাগজের  জন্য এই পুনর্লিখন – অরূপা মহাজন।)
           ঙ্গল গ্রহে ইসরোর উপগ্রহ অভিযানের জন্য ভারত সরকারের কেবিনেট ৪৫০ কোটি টাকা মঞ্জুর করেছে। এই উপগ্রহটি নাকি লাল-গ্রহের বায়ুমণ্ডল যাচাই করবে। অর্থমূল্যের হিসেবে বিচার করলে এই অভিযানকে ভারতের মত দরিদ্র দেশের অর্থের অপচয় হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কিন্তু এই অভিযানকে ফলাও করে প্রচার করার মধ্যে বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে আমাদের দিশাহীন কিংবা একদেশদর্শী পরিকল্পনার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই অভিযানকে কেন এতো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? তার দুটি মুখ্য কারণ রয়েছে। প্রথমত এতে আমাদের এলিট শ্রেণির এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষিত ও প্রভাবান্বিত মধ্যশ্রেণির সুপার-পাওয়ার হওয়ার সুপ্ত অলীক বাসনাকে আরেকটু উস্কে দেওয়া যায় – বিশ্ব এলিট ক্লাবের সাথে  গা-ঘেঁষাঘেষি করে তাদের ‘অল্টার-ইগোকে’ ফুলে-ফেঁপে উঠতে দেওয়া যায়। সুপার-পাওয়ার হওয়ার এই বহিরঙ্গের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত একটা অন্তরঙ্গও রয়েছে যা আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের এমনকি মানব সভ্যতার জন্য বিপদজনক। কী সেই বিপদ? বহিরঙ্গে সুপার-পাওয়ার হওয়ার প্রয়াস অন্তরঙ্গে সুপার হওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেই করতে হয় অর্থাৎ আমাদের এলিট শ্রেণি ও তাদের পোঁ-ধরারা যখন ইউরোপ-আমেরিকার সমকক্ষ সঙ্গী হওয়ার চেষ্টায় ব্রতী, তখন কোটি কোটি নিরন্ন দরিদ্র মানুষ যারা খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের জন্য সরকারী ব্যয় বৃদ্ধি করার ব্যাপারে উদগ্রীব হয়ে এলিট-শ্রেণির উপরে উঠার প্রক্রিয়ায় অন্তরায় হতে চায় – তখন এই নিরন্ন-হাঘরেদের পদদলিত করেই তাদের বাসনাকে কায়েম করা যায় এবং এরজন্যই উন্নত প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়া করা হচ্ছে – তা সে নিউক্লিয়ার এনার্জির জন্যই হোক বা বিগড্যাম। প্রযুক্তির এই চর্চার সাথে সৃজনশীলতার বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই –এটা একধরণের স্কিলের চর্চা। অথচ আমজনতার সমস্যা সমাধানের সাথে যদি প্রযুক্তি চর্চার বিষয়কে জুড়ে দেওয়া যেত তাহলে প্রযুক্তিচর্চার সাথে যুক্ত সবাই সৃজনশীল গবেষণার এক বিশাল কর্মযজ্ঞের সাথে সামিল হয়ে দেশ গঠনে ব্রতী হওয়ার সুযোগ পেত। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে যাতে বৌদ্ধিক সমাজ প্রভাবিত না          হয় – সেটাই মঙ্গল-অভিযানকে ফলাও করে প্রচার করার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্নিহিত কারণ। অথচ আধুনিক ইউরোপ যে এই পথ পরিক্রমা করেই এসেছে সে ব্যাপারে আমাদের এলিটরা অবগত হলেও ন্যস্তস্বার্থে ও ওলিগোপলিস্টদের (একচেটিয়া কর্পোরেটদের গ্রুপ) সেবাদাসত্বের দাসখতে সই করে জ্ঞানচর্চার এক ভ্রান্ত পথের দিকে দেশ-জাতিকে পরিচালিত করছেন।  উন্নত প্রযুক্তির ঢোল বাজিয়ে কর্পোরেট প্রভুদের নির্দেশে ২০০৫ সালে বিদ্যুৎ ক্ষেত্র সংস্কারের আইন পাশ করা হল। দীর্ঘ সাত বছর পর উন্নত প্রযুক্তির দেশজোড়া নমুনা দেখল দেশবাসী। বিদ্যুত ঘাটতিজনিত যন্ত্রণার স্থানিক অনুভূতিকে দীর্ঘ তথাকথিত উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিশাল পরিমাণ মৃত-পুঁজির সৃষ্টি করে এবং সাধারণ মানুষের উপর বিশাল বিদেশি ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে জাতীয় অনুভূতিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। বিশ্বায়িত প্রযুক্তির বাজারে অনুভূতির বিশ্বায়নের দিকে যাত্রা। বিশ্বায়নের এই যাত্রার বিপরীতে একটা স্থানিক যাত্রার হিসাব আমরা এবার করে দেখতে পারি। কারণ যখন প্রযুক্তি শিক্ষার নামে মঙ্গল গ্রহে যান পাঠাচ্ছে আমাদের সরকার, তখন বরাকের মানুষরা নিজের অঞ্চলের বাইরে বেরোতে নিজের প্রাণটাকেই অজানা ভিন-গ্রহে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
                 বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার বিভিন্ন শাখায় আমাদের এঅঞ্চলে কৃতবিদ্যদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু কৃষি-শিল্প-নাগরিক সুযোগ সুবিধা-পরিবেশ ইত্যাদি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানকল্পে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও তার বাস্তবায়ন আমাদের খুব একটা চোখে পড়ে না। ভাষা-সংস্কৃতি-উৎপাদন পদ্ধতি-জলবায়ু ইত্যাদি সবদিক থেকে আমাদের মত বৈচিত্রময় দেশে যে কোন সমস্যার একটা স্থানিক মাত্রা থাকে। কিন্তু বাস্তব পৃষ্ঠভূমি থেকে সমস্যা সমাধানের বাস্তব কোন পদ্ধতি আবিষ্কারের কষ্টসাধ্য ও সৃজনশীল পথ পরিহার করে আমরা অনুকরণের মাধ্যমে দক্ষ বিশেষজ্ঞ তকমা পেতে বেশি আগ্রহী। জ্ঞানার্জনকে বাজারের চাহিদার দ্বারা পরিচালিত দক্ষতার (Skill) স্তরে নামিয়ে আনার পরও আমাদের সমাজ নামী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অত্যন্ত সম্ভ্রমের সাথে দেখে, কারণ সমাজ ধরে নেয় যে এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান এতো বিশাল যে তার থেকে সমাজ উপকৃত হবে। কিন্তু বাস্তবে এই  দক্ষ লোকদের সংখ্যাবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে আর্থ-সামাজিক সমস্যা ও সামাজিক অবনতির মাত্রা কেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে? এর উত্তর আমাদের সার্বিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সাথে সাথে সম্ভবত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও নিহিত রয়েছে। সম্প্রতি এক টিভি-চ্যানেলের বিতর্ক প্রোগ্রামে একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ চিকিৎসক মন্তব্য করেন যে আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি ক্রমাগত অনুভূমিক (Horizontal) থেকে উলম্ব (Vertical) হয়ে যাচ্ছে এবং ফলে সামগ্রিক জ্ঞানের মাধ্যমে সৃজনীক্ষমতা বিকাশের বদলে এটা একধরনের ট্রেনিং-এ রূপান্তরিত হচ্ছে – সবকিছুই এখন উন্নত  থেকে উন্নততর ওয়ার্কশপ যেখানে পুঁজির সেবা করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ লোক তৈরি করা হচ্ছে এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা বিকাশের বদলে শিক্ষার মানে হয়ে যাচ্ছে পুনঃপুনঃ পাঠের মাধ্যমে একধরনের মুখস্ত বিদ্যা (Learning by rote)। এরমধ্যেই ব্যতিক্রমী কাজ যে হচ্ছে না তা নয় –  কিন্তু তা সাধারণত মিডিয়াকে, বাজারের নিয়মকে ও নীতি নির্ধারণকে প্রভাবিত করতে পারে না। এভাবে বেশিদিন চলতে পারে না – কারণ গোটা সমাজ গুটি গুটি পায়ে অতি সত্বর এক ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে পা বাড়াচ্ছে। যদি আমরা মনে করি যে সব বিজ্ঞানই শেষ বিচারে মানব সভ্যতার জন্যই, যে সভ্যতা আজ অস্তিত্ব সংকটের    সামনে দাঁড়িয়ে গেছে – তাহলে আমাদেরকে বিকল্প পথ অনুসন্ধান করতেই হবে।
               অত্যন্ত ছোট মাপের কাজের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। সারা পৃথিবী জল সংকটে ভুগছে – জল নিয়ে প্রায় যুদ্ধ বাধার উপক্রম। দক্ষিN ভারতের কোন এক শহরের পুরসভা ছাদের জল সংগ্রহ করা বাধ্যতামূলক করে দিয়ে উপকৃত হয়েছে। চেরাপুঞ্জিতে যখন জল সংকট, তখন থর মরুভূমির এক বসতি অঞ্চল কোন ব্যয়বহুল পদ্ধতি অবলম্বন না করেই জল সমস্যার সমাধান করে নিয়েছে। আমাদের শিলচরের কোন বিশেষজ্ঞ ছাদের জল নিয়ে একটা হিসাব করতেই পারেন এবং তাতে যদি দেখা যায় আমাদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাহলে পুরসভা ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তা বাধ্যতামূলক করে দিতে পারে। জল নিষ্কাশনী সমস্যার  সমাধানেও কোন উদ্ভাবনী প্রয়াস নজরে পড়ে না – জল নিষ্কাশন ও জল সংরক্ষণকে সম্পৃক্ত করে ভাবলে কোন সমাধানসূত্র বেরতেও পারে। বরাকের কৃষির অবস্থা খুবই শোচনীয় এবং তারজন্য বিভিন্ন ফ্যাক্টর দায়ি। কিন্তু বরাকের কৃষকদের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে সার-সংকলিত করে কোন বিকল্প পন্থা-পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টা কেউ করছেন বলে শোনা যায়নি। মাত্র ১০০/১১০ মেগাওয়াট চাহিদা থাকা একটা অঞ্চলে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য কোন এক বৃহৎ কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। সামাজিকভাবে উপযোগী-স্থায়ী ও সস্তায় এই নগণ্য পরিমাণ  বিদ্যুৎ উৎপাদন ও যোগানের বন্দোবস্ত এখানেই করা যায় বলে আমাদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের এঅঞ্চলের কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলো কোন কাজ করছে কি? মনে হয় – না। অথচ প্রতিবারই সমস্যা সমাধানের নতুন নতুন মন্ত্র আমাদের শোনানো হয় – এবারের নতুন মন্ত্র হচ্ছে পালাটনা, ভাবখানা এরকম যে এই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বরাকের চাহিদা মেটানোর জন্যই তৈরি হচ্ছে, আর বরাক ড্যাম – সে তো আরেক মিথ্যার বেসাতি।  সব পরিকল্পনা তৈরি করা হয় বিদেশি ঋণ ও প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে, তাতে সম্পদের বহির্গমণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটে প্রকৃত অর্থনীতি পঙ্গু হলেও নীতি নির্ধারকদের কোন মাথাব্যথা নেই। 
              এখন আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ভূমিকম্পের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করা হচ্ছে। ব্যয়বহুল সব পদ্ধতির কথা আমাদেরকে শোনানো হচ্ছে যা আমাদের মত দেশে বাস্তবে গণহারে কার্যকরী হওয়া সম্ভব নয়। ভূমিকম্প রোধ ও ভূমিকম্প থেকে বাঁচানোর কার্যকরী কোন পদ্ধতি যদি বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে এই ব্যয়বহুল মচ্ছবের কী অর্থ? সব বিষয়ের উপর আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে ওয়ার্কশপ হয়। ভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত কার্যকরী ও সৃজনশীল আবিষ্কারের ট্যাকনিক্যাল তথ্য এই ওয়ার্কশপগুলোতে দেওয়া হয়। প্রথমত এই বিষয়গুলি ট্রেনিরা ট্রেনিং-লিটার্যা চার থেকে নিজেরাই আয়ত্ব করে নিতে পারে, দ্বিতীয়ত আমাদের বাস্তব পরিস্থিতিতে এগুলোর বিশেষ কোন বাস্তব কার্যকারিতা নেই। সুতরাং এই ওয়ার্কশপগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বোঝাগুলো মাথায় বয়ে নিয়ে বেড়ানো কি অর্থহীন হয়ে পড়ে না?

কোন মন্তব্য নেই: