“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ৩১ আগস্ট, ২০১২

সাফিনা বিবিকে চিঠি


পাবেনঃ সাফিনা বিবি, করাচী, পাকিস্তান

প্রিয়,

         সাফিনাবিবি,
কেমন আছো! তুমি কি আরও সুন্দর হয়েছো। তোমার আব্বাজান আজও কি রহমত করেননি তোমার উপর! ডান হাতের পোড়া লাকড়ির দাগের ক্ষতটা কি সেরেছে অনেকটাই! এখনও কি আছে সেই সাদা মখমলি চাদরটা! মনে আছে এই সাদা চাদরটাই প্রমাণ করেছিল তোমার কুমারিত্ব!
ভয় পেয়োনা আমি তিহারের জেলে বসে কুরান শরিফ পড়ি দু'ওক্ত। ইনসানের জন্মের যেমন একটা ফর্য থাকে, মৃত্যুরও একটা কারণ থাকে।

সাফিনাবিবি, আমার মৃত্যু খোঁদার মর্জিতে এবং পূর্ব পরিকল্পিত। জেহাদি কোন আকাশ দেখার ইচ্ছে ছিল না। বুঝতাম না, এটাই পথ নয় বেঁচে থাকার। একটা মুক্ত আসমান চেয়েছিলাম। বেঁচে হয়তো থাকলাম না সেই আকাশে, জানি মৃত্যুটা আমার মুক্ত আকাশেই হবে। তাই ভয় পেয়োনা। তবে মাটিটা আমার দেশের হলে ভালো হত। তুমিই বলেছিলে, ঈশ্বর সব মাটিতেই আছেন।
আমার মৃত্যুর প্রহর গুনছে পৃথিবী। আমি জেহাদি কিনা তাই।
আমি নাহয় কিছুদিন আগেই এবং অসময়ে গেলাম সেই নিরুদ্দেশে। আমার জন্য তৈরি হচ্ছে সরকারি নির্দেশে ফাঁসির দড়ি। এই মৃত্যুটাই আমার কাম্য ছিল। শহীদের মৃত্যু। তবে জানি আমায় ভুল বোঝানো হয়েছিল, কোন মৃত্যুই ঈশ্বরের কাছাকাছি থাকার পথ দেখায় না।
আমায় মেরে ফেলা যেতেই পারত ২৬/১১'র দিন। এতগুলি মানুষের মৃত্যুর পর আমিও সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলাম।
গুলি করেও আমাকে বাচিয়ে রাখা হয়েছে ঈশ্বরের নির্দেশেই হয়তো! আমাকে যারা গুলিবিদ্ধ করেছিল তাদেরও তো বিচার হওয়া উচিত ছিল। কোন ইনসানকে গুলি করার কোন নির্দেশ ভারতের মতো রাষ্ট্র দিতে পারেনা। এটাই আমার বিশ্বাস ছিল। আমার জেহাদি দল আর এই দেশের পুলিশে কোন ফারাক নেই।
যে লোকটি আমায় ফাসি দেবে, সেই জল্লাদ এসে দেখে গেছে আমায়। আমার গলার মাপ নিয়ে গেছে চামড়ার ফিতে দিয়ে। বলেছে আমি নাকি সুন্দর পুরুষ। আর সুন্দর পুরুষের মৃত্যু তার কাছে উপভোগ্য! রাষ্ট্র অর্থ দিয়ে জল্লাদ পোষে!
প্রাণ ভিক্ষা দেয়নি আমায় এই দেশ, তাহলে বাঁচিয়েই বা রাখল কেন বলোত! আমায় নিয়ে চলছে ট্রপিজের খেলা দুই দেশের। মিডিয়া আজও আমার আব্বাজান, আম্মাজানের খোঁজ পায়নি। ভালোই হয়েছে, কোন মানুষ আমায় জন্ম দেয়নি কাগজে কলমে অথবা কোন আম্মাজানের শরীরে। আমার জন্ম হয়েছিল দুই মাটির সংসর্গে।

তুমি আমায় কোনদিন ভালোবাসনি, আমি জানতাম। আমার ফাঁসির আদেশ শুনেই আমায় ভালবাসতে শুরু করেছ। আমার মৃত্যু, আমার কাছে এনে দিয়েছে তোমায় সাফিনা বিবি। তাই আমি সুখি পুরুষ। আমি জানি যে মৃত্যু ভালোবাসাকে কাছে এনে দিতে পারে সেই মৃত্যু সুখের।
আমি জানি এখন শুধু আমাকেই ভালবাসবে তুমি, এবং শেষ দিন পর্যন্ত তাই হবে। এরপর এক আকাশের নীচে আবার কোনদিন দেখা হবে, অথবা মৃত্যু হবে। এই দেশ আমায় মেরে ফেলুক, কিন্তু আমার ভালবাসার কোন মৃত্যুদণ্ড দেয়ার সাহস নেই কোন বিচারকের। বাতাশ, আল্লাহ্‌ আর তোমায় আমি ভালবাসি। এই দেশের পানি, অন্ন আর আমার দেশের পানি আর মানুষে কোন বিভেদ নেই।
তাই ভুল ছিল আমারই। তাই মেনে নিলাম আমার মৃত্যু, কিন্তু মেনে নিলাম না আমার ভালবাসার মৃত্যুকে। আমার আত্মার মৃত্যুকে।
যদি ভালবাসতে আমায়, হয়তো আজ আমি এই কুঠুরিতে বসে প্রহর গুনতাম না মৃত্যু সকালের। সাফিনা, এবার তোমার প্রহর গোনা শুরু। 'এ টাইম টু লাভ এন্ড এ টাইম টু ডাই'।
ভালবাসার সাথে মরণের খেলা যে খেলতে পারে, বাঁচার আনন্দ তারই থাকে। তোমার প্রত্যাখান থেকেই আমার বিপ্লব, আর ভালবাসা থেকেই আজকের মৃত্যু। মনে হয় আমি আজ বেঁচে আছি, ভবিষ্যতেও বেঁচে থাকব, কিভাবে বেঁচে থাকবো তা নির্দেশ করবে তুমি। আমার ভালবাসা।
আমি মৃত্যুর কাছেই চাইব তোমাকে। জানি আমায় দেবেন তোমার বুকে থাকার অনুমতি, এবং আমি তাই থাকবো। তাই মৃত্যুই আমার প্রিয়, বেঁচে থাকার চেয়েও অনেক অনেক বেশী সুখের।

ইতি,
কাসভ,
তিহার জেল, নিউদিল্লী, ভারতবর্ষ।

1 টি মন্তব্য:

Biplob Rahman বলেছেন...

মানুষের পুনর্নবায়ন হয় না। মৃত্যুদণ্ডে অপরাধীর সংশোধনের/শাস্তি গ্রহণের সুযোগও শেষ হয়ে যায়। এই যন্ত্রযুগে ফাঁসিকাষ্ঠ বা মৃত্যুদণ্ডের ভয় দেখিয়ে অপরাধ প্রবণতা কমানোর যুক্তি নিতান্তই ঠুনকো। মানব-বোমায় সজ্জিত জঙ্গীর কাছে আইনের ফাঁসিকাষ্ঠ নিতান্তই একটি কমেডি। অন্য কথায়, যে জঙ্গি আত্নাহুতি দেওয়ার জন্য তৈরি [বাঁচলে গাজি, মরলে শহীদ; দুদিকেই সোয়াব/পূণ্য], তার কাছে ফাঁসি একটি প্রহসন। কারণ, অস্ত্র নির্ভর রাজনীতিতে মিশনটিই প্রধান; অস্ত্রবাজের জীবন নয়।

প্রথম বিশ্বের অনেক দেশেই এখন আর মৃত্যুদণ্ড নেই। দীর্ঘ মেয়াদী কারাবাস আছে। হয়তো খুব শিগগিরই সম্ভব নয়, তবে একদিন না একদিন নিশ্চিতভাবেই এই উপমহাদেশের রাষ্ট্রবিদদের প্রাচীন এই "শাস্তি" দান প্রথা নিয়ে ভাবতেই হবে।

কাসাভের মৃত্যুদণ্ড প্রক্রিয়া নিয়ে গণমাধ্যম এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছে। আইনের স্বচ্ছতা আইনের অপব্যবহার রোধ করার জন্যই জরুরি।

ভাবনাটিকে উস্কে দেওয়ার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। চলুক।