।। লিখেছেনঃ প্রবুদ্ধ সুন্দর কর।।
এক.
"কোনও ফর্ম আমি কখনও অনুকরণ করিনি। আমার সমস্ত ভঙ্গিমাই আমার সহজাত। যা লিখেছি সবই দেয়ালে পিঠ দিয়ে। ফাঁকে যাতে কখনোই না পড়ি। হলে হবে, না হলে নেই। যা আমার তার সবটুকুই আমার। প্রকৃত সৃজিত বস্তুর কোনও দোসর থাকে না। এই আত্মবিশ্বাসই আমার যুদ্ধাস্ত্র--আমার শয্যা আমার জয় আমার পরাজয়--আমার পরিচয়।"
এক.
"কোনও ফর্ম আমি কখনও অনুকরণ করিনি। আমার সমস্ত ভঙ্গিমাই আমার সহজাত। যা লিখেছি সবই দেয়ালে পিঠ দিয়ে। ফাঁকে যাতে কখনোই না পড়ি। হলে হবে, না হলে নেই। যা আমার তার সবটুকুই আমার। প্রকৃত সৃজিত বস্তুর কোনও দোসর থাকে না। এই আত্মবিশ্বাসই আমার যুদ্ধাস্ত্র--আমার শয্যা আমার জয় আমার পরাজয়--আমার পরিচয়।"
দুই.
"যখনই লিখি, 'আধুনিক' অবস্থায়ই লিখি। নইলে লিখবই বা কেন? একই সত্য যদি জীবনে বার বার ঘুরে ফিরে আসে, সেটা সময়ের বিষয়, ইতিহাসের বিষয়--বা সমস্যা। আমার নয়। সমালোচক হিসেবে কেউ যদি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্ত দেয় যে সেলিম সারা জীবনে একই কথা বার বার লিখেছে, তাতে আমার হ্রাস বৃদ্ধি কিছুই ঘটে না।"
তিন.
"যেটুকু জানি, সেটুকু কখনও লিখি না আমি--যেটুকু জানি না সেটুকু থাবা দিয়ে ধরতে চাই। এর আগাগোড়া সবটাই আমার--আমার নিজের। আমি আর কারোর কথাই ভাবি না--ভাবলে আমার ধরা হয় না। হবে না।"
চার.
"কবি যেহেতু সমাজ সন্সকারক নয়, এসবে তাঁর দায়িত্ব [অর্থাৎ তাঁর লেখালেখির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার দায়, সমাজ শুদ্ধিকরণের দায়, ইজমের দায়] না থাকারই কথা। আমার এরকম স্টেনলেস স্টিলের মতো কোনও দায় নেই। আরে ভাই! হতে পারে আমি কবি-ই নই। 'ভালোবাসা' খুব বাজে একটা টার্ম। এটার প্রকৃতই কোনও সুগভীর অর্থবহতা নেই। আজকের দিনে,প্রাসঙ্গিকতাহীন মেরামতযোগ্যতাহীন ভাড়াবাড়ির মতো।"
বছর চারেক আগে গল্পকার সত্যজিৎ দত্তের সঙ্গে এক অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎকারে এভাবেই আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন কবি সেলিম মুস্তাফা। প্রায় তিন দশকেরও বেশি, বাংলা কবিতায়, সেলিমের শাহী উপস্থিতি। কখনও রাজধানীর কোলাহলে, কখনও বা নিরাপদ দূরত্বে নির্জন উপত্যকায় বাংলা কবিতার জুয়ার টেবিলে উল্টে দিয়েছেন তাস। বাহান্ন তাসের পর, ছোরার বদলে একদিন, ইতি জঙ্গল কাহিনি, দেবতার অনুরোধে--সেলিমের এই কবিতার বইগুলো নিশিডাকগ্রস্ত আমাদের টেনে নিয়ে গেছে রহস্যখচিত, রাত্রি ও অরণ্যসংকুল সেলিমের সাম্রাজ্যের দিকে। সমতল থেকে শুরু করে বিষ-খাওয়া যুবতির মতো নীল হয়ে থাকা জম্পুই পাহাড়, লঙ্গাই ও দেও নদীর অববাহিকা, শান্তিপুর মৌজা, কাঞ্চনপুর রিজার্ভ ফরেস্ট-- কোথায় বিস্তৃত নয় সেলিমের কবিতাসাম্রাজ্য! কবিতায় জঙ্গলের এক ভাষা পেয়ে গেছেন সেলিম; সত্যি, কোনও আতিশয্য নেই সেলিমের কবিতা সম্পর্কে সমরজিৎ সিংহের মন্তব্যে। ওতপ্রোত নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন 'অনার্য'-এর সঙ্গে। স্বভাবলাজুক, সঙ্গীতপ্রিয় সেলিম, বরাবরই নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন কোলাহল হলাহল থেকে। কয়েক বছর আগে ইতি জঙ্গল কাহিনি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। শ্রেষ্ঠ কবিতা-ও প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি।
এ বছরই প্রকাশিত, সেলিমের সাম্প্রতিক একটি কবিতার পাঠ আপনাদের জন্যে...
সেলিম মুস্তাফা
...................
অম্বিকাপট্টি
শিলচর অম্বিক্কাপট্টি। আমার মামার বাড়ি। চার পাঁচ বছর বয়সে একবারই দেখেছি। মামা আর কাঠের দোতলা বাড়ি। কাছেই কোথাও খ্রিস্টানদের গোরস্থানও যেন ছিল একটা।
মামা চার আনা দিলেন। সেটা দিয়ে হজমি খেলাম।চায়ের ভেজা পাতার মতো গুঁড়ো আর কালো। পাড়ার দোকান থেকে ফিরে এসে শুনলাম মামা ফিরে গেছেন কর্মস্থলে। যাবার আগে মামা সবাইকে আবারও পয়সা দিয়ে গেছেন--এবার আট আনা করে। খুব আপসোস হল। মামাকে এরপর আর কোনওদিন দেখিনি।
উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হজমি খাচ্ছিলাম।, আর তখনি দু-পাশের কাঠের দোতলা থেকে উড়ে উড়ে এসে ক-টা কাক আমার মাথায় ক্রমাগত ঠোকর দিতে লাগল। হয়তো হজমির জন্যেই। শেষতক কান্না শুনে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে মা উদ্ধার করেন।
মা-ই আমার চিরকালের ত্রাণকর্ত্রী। আজও সমস্যায় পড়লে মায়ের ছবির সামনে দারাই বা মনে মনে মায়ের অভয়হাসির মুখটা স্মরণ করি।
অম্বিকাপট্টি নামটা খুবই কৌতূহলজনক আমার কাছে। ঐ কাঠের দোতলা বাড়িতে আমাদের সকলের বড়ো দাদা কিছুকাল ছিলেন শুনেছি। পড়তে গিয়েছিলেন। তিনি আমাদের পরিবারের প্রথম ইন্ডিয়ান। গোষ্ঠীর বাদবাকি সকলেই আমরা তখন পূর্ব পাকিস্তানি। শৈশবে কত গেয়েছি 'পাকসার জমিন শাদবাদ...'।
কিন্তু ইন্ডিয়া শুনলেই গায়ে শিহরন হত।এখনও হয়। ত্রিপুরা থেকে ইন্ডিয়া এখনও অনেক দূর।
ইন্ডিয়ান মামি আমার দাদার ভাতের থালার একপাশে একটুখানি ছাই দিয়ে দিলেন। কী অদ্ভুত ! ঠাকুরমার ঝুলিতে হয়তো এরকম গল্প আছে। এরপরই দাদা পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ইন্ডিয়ান আর্মিতে চলে যান।
আজ মামা নেই, মামি নেই। আমাদের দাদাও নেই। হয়তো নেই অম্বিকাপট্টির সেই বারিও।কাঠের বাড়ি আর কতকাল থাকে?
কিন্তু অম্বিকাপট্টি আছে-- সব দেশে, সব শহরে।
কার নাম অম্বিকা?
মানুষ না দেবতা?
৩টি মন্তব্য:
কবি সেলিম মুস্তাফা ত্রিপুরার একজন ধীমান কবিতাপুরুষ। তার কাজে অন্যরকম মায়া থাকে। তরুণ কবিদের কতটা স্নেহ করে, বই এগিয়ে দিয়ে, আলোচনা করে যত্ন নিতে পারেন, তার সাক্ষী আমি। আমার গৃহত্যাগী জীবনে মাটির ঘরে কতবার তিনি এসেছেন, কত আড্ডা হয়েছে।
এঁদের সম্পর্কে যতই এখানে লেখা হয়, তততুকুই কম। আরো আরো লেখা উচিত। আমরা কত কম জানি। কম পড়তে পাই। আন্তর্জাল সুবিধে এনে দিল। সেই সুবিধে নেব না কেন?
পড়া তো দূর অস্ত, কবি সেলিম মুস্তাফার নামও শুনিও নি কখনো। আন্তর্জালকে এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে অজ্ঞতামোচনযন্ত্র ভাবি আমি। প্রবুদ্ধ সুন্দর করের ক্ষুদ্র এ উদ্ধার তাঁর প্রতি কৌতূহলী করে তুলল।
'ত্রিপুরা থেকে ইন্ডিয়া এখনও অনেক দূর।
ইন্ডিয়ান মামি আমার দাদার ভাতের থালার একপাশে একটুখানি ছাই দিয়ে দিলেন।'
রাষ্ট্র এবং মানবমনের কূটরাজনীতির এক অদ্ভুত বিশ্বস্ত প্রকাশ দেখলাম এ দু'লাইনে। এ দূরত্ব যে ভৌগোলিক দূরত্ব নয়, তা ইন্ডিয়ান মামির সাথে ত্রিপুরার ভাগ্নের মনোদূরত্বই মূর্ত করে দিচ্ছে। স্মৃতিচিহ্ন হাতড়ানোর মাঝখানে এহেন গুরুপ্রসঙ্গটি নীরবে মুখ লুকিয়ে আছে কবিতাটিতে। অথচ কেবলই এই কথাগুলো বলতে কলম ধরলে কবিতাটির কী বারোটাই না বাজতে পারত, ভাবি!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন