“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ২ আগস্ট, ২০১২

বডোল্যান্ডের জনগোষ্ঠীগত সংঘাত সম্পর্কে

       গেল বারো বছরে অসমে সরকারী হিসেবে ৪২৪ জন লোক মারা গেছেন, ৫০,৭০০০ লোক গৃহহারা হয়েছেন। গোষ্ঠীগত সংঘর্ষে। এদের সিংহভাগ মুসলমান। মুসলমান মরলেই বলা হয়, এসব অনুপ্রবেশকারীর কাণ্ড। তাই যদি হয় তবে কি এটা ভালো নয়, তারা আসুন দলে দলে বাংলাদেশ থেকে আর স্বধর্মীয়-স্বজাতীয়দের মেরে কেটে তাড়িয়ে দিন, সংখ্যা কমে যাবে অনুপ্রবেশকারীর? এক কালে অসমের সমস্ত উগ্রপন্থী দলগুলো সম্পর্কে জনপ্রিয় অভিযোগ ছিল এরা আই এস আই-র সহযোগী। এখন যখন এরা আত্মসমর্পণ করে আলোচনার টেবিলে এসছেন, সব্বাই হিন্দুত্ববাদীদের বন্ধু হয়ে গেছেন। একজন গান ধরলে অন্যজন দোহার দিচ্ছেন। আর সেই সব মুসলমান উগ্রপন্থীর দল গেল কোথায়! যাদের কথা, এই সেদিনও ঘন ঘন শোনা যেত? তারা যে কেউ আত্মসমর্পণ করল না, ধরাও পড়ল না আলোচনার টেবিলেও এলেন না। অথচ , কৈ বিএলটি, এন ডি এফ বি, আলফা কেউতো বলে না আমাদের ধরে এনেছো, মুসলমান উগ্রপন্থীদের ছেড়ে দিলে যে! বাংলাদেশ সরকার এদের ধরিয়ে দিলে বলে কাগজে কাগজে কত প্রশংসা প্রশস্তি! কিন্তু কেউতো জিজ্ঞেস করেনা, ও মেডাম হাসিনা, আপনি দেখি মুসলমান উগ্রপন্থীদের বেশ লুকিয়ে রেখেছেন! বলবে কি, বলবার মুরোদ থাকলে তবে তো! ঝুলির বেড়াল যে বেরিয়ে যাচ্ছে। এবারে তাই কেউ মুসলমান উগ্রপন্থীর নাম না নেয়াটাই নিরাপদ ভাবছেন। পারেও বটে হিন্দুত্ববাদীরা। এমনি হয়, এদের আখ্যান নির্মাণ!

             লেখার শুরুতেই একটা কথা স্পষ্ট করে দিতে চাই। অসমের বডোল্যান্ডের বর্তমান সংঘাতটা মোটেও হিন্দু মুসলমান লড়াই নয়। বডো পক্ষে হিন্দু-খৃষ্টান দুইই আছেন। কিন্তু গোটা পূর্বোত্তরেই জনজাতিআধিপত্যের রাজনীতি যারা করেন তাদের অন্য অনেক লক্ষ্য থাকলেও মুসলমান এক প্রিয় টার্গেট। বন্ধুদের মনে থাকবে বছর কয় আগে অরুণাচল থেকে প্রবল বাংলাদেশীবিতাড়ন শুরু হয়েছিল। পরে অসম সরকার-ই বলেছে, এরা সবাই ভাটি অসমের মুসলমানশ্রমিক। বডোল্যান্ডে আপাতত দৃশ্যত এটা বডো-মুসলমান এই দুই পরিচিতির সংঘাত। এতে কোনো পক্ষেই ধর্মবিশ্বাসের কিছু করবার নেই। এটা হয়তো অনেকেই জানেন নাযে প্রাক্তন বি এল টি হচ্ছে হিন্দু (ব্রহ্ম) পক্ষ, আর এন ডি এফ বি হচ্ছে মোটা দাগে খৃষ্টান পক্ষ। ২০০৮এর উদালগুড়ি দাঙ্গাতেও দেখা গেছিল, একদিকে মুসলমান-অন্যদিকে সমস্ত হিন্দু। যদিও অন্তর্বস্তুতে সেটিও ছিল বডো শাসকের তরফে নির্জাতিকরণের কৌশল। কিন্তু তখন বিটিএডি হয়েছে মাত্র । রাজ্য দাবির লড়াই থাকলেও আজকের মতো জোরালো হয় নি। ওদিকে কিছুদিন আগেই উজান অসমে আরেকবার ‘অনুপ্রবেশ’-এর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অসম আন্দোলন শুরু করেছিল কিছু জাতীয় ছাত্র সংগঠন। সুতরাং এক তরফা মুসলমান বিরোধী (এভাবে অবশ্য এরা বলেন না, বলেন ‘অনুপ্রবেশকারী মুসলমান’) একটা আবেগ তৈরির প্রয়াস রাজ্য জুড়েই সফল হয়েছিল। তাতে বাঙালি হিন্দু পক্ষও যোগ দিয়েছিলেন।

                  কিন্তু এখন পরিস্থিতি পুরো আলাদা। এখন বাকি সমস্ত হিন্দু নীরব। বিজেপি ছাড়া।  হ্যা, তাঁরা শান্তি শান্তি করছেন। এটাতো করতেই হবে। কিন্তু সেগুলো আমসুর (মুসলমান) মতো সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে। বাদ দিয়ে নয়।উদালগুড়ি দাঙ্গার সময় আমসু বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল। এখন আবসুর মতো সংগঠনও আমসুকেই বেশি কাছে টানছে। এই দাঙ্গার উত্তেজনা মোটেও বাকি অসমে ছড়ায় নি।শিবসাগরে মানুষ উত্তেজিত রেকিবুদ্দীন হত্যা এবং সেনার হাতে দুই ছাত্রীর অপমান নিয়ে। সেখানে হিন্দু মুসলমান একজোট হয়ে বিশাল লড়াই লড়ছেন। এটা কেন হচ্ছে? সোজা কথা হচ্ছে, এখন বাকি হিন্দুরা দেখছেন এই মুসলমানেরাই বডোল্যান্ড আটকাবেন। বাঙালি হিন্দু সংগঠনগুলোও। আমসুর সঙ্গে এরাও আছেন অনাবডো মঞ্চে। অসমিয়ারাও। আর ঠিক তাই তরুণ গগৈ যখন বলছেন এই দাঙ্গাতে বাংলাদেশীদের মদত নেই তখন মূল স্রোতের অসমীয়া কাগজ সমালোচনা করছে, এটা তেমন দেখিনি। এই সব কথা যদি কারো তাত্ত্বিক মনে হয় আমার কিছু করবার নেই।

               মুসলমান তবে মার খাচ্ছে কেন?  বা কারো কারো যেমন দাবি মুসলমানেরাও পালটা মারছেন, এটা হচ্ছে কেন? আমি মনে করিয়ে দিই, ৯০ দশকে সাঁওতালেরাও মার খেয়েছিলেন। খেয়ে কোবরা মিলিটেণ্ট ইত্যাদি সংগঠন গড়ে পালটা জবাব দিয়েছিলেন। তাই ওদের গায়ে সরাসরি হাত তোলবার সাহস আর হয় না। কোচেরাও মার খেতে পারতেন, কিন্তু তাঁরাও পৃথক কামতাপুরের দাবিতে পশ্চিম বাংলা অব্দিসংগঠন গড়ে তোলেছেন। তৃতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠীটি হচ্ছেন মুসলমান যারা সোজা অসমের অখণ্ডতার পক্ষে দাঁড়িয়ে অনাবডো আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। মুসলমানের এইভূমিকা যদি একবার ঐতিহাসিক ভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় তবে যে রাজ্যদাবীর লড়াই দুর্বল হবে তাই নয়, অসম তথা পূর্বোত্তরের রাজনীতির অনেক কিছুই পাল্টেযাবে। তাই এদেরকে শিক্ষা দেবার আয়োজন। মুসলমান জনতার মনে ভীতি ঢুকিয়ে দেওয়া।ভাবা গেছিল এতে আগের মতোই দেশজোড়া হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিক এবং প্রচারমাধ্যমের সমর্থন পাওয়া যাবে। তা গেছেও,অনেকটা। কিন্তু খেলা বিগড়ে গেছেঅসমেই। আপাতত, এই সংঘাত থেমে যাবে। কিন্তু মনে হয় না, অসমের রাজনীতি আরআগের মতো থাকবে। এবারে সেণ্টার স্টেজে মুসলমান! হয় মেনে নাও, নতুবাবডোল্যান্ড হারিয়ে বসো। যা হবে অসমীয়াদের পক্ষে এক মরণ আঘাত।

                 এবারে এই বডো, কোচ, সাঁওতাল, বাঙালি হিন্দু ( সাধারণভাবে বর্ণহিন্দু বাদ, কেননা তারা কলকাতায় ফ্লাট কিনে রেখেছেন অনেকেই) সবাই নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর লোক।তবে তারা এই মারামারি করছেন এটা কি ভালো হচ্ছে? নিশ্চয়ই হচ্ছে না। কিন্তু তাই বলে বডোল্যান্ড লড়াইকে সমর্থন দেবেন না অন্যেরা, এটাওতো স্পষ্ট।কামতাপুরে্র পক্ষেও দাঁড়ানো মুস্কিল। কারণ জায়গা প্রায় একই। ওদিকে বাকিদের ভোটের রাজনীতিতে সামান্য প্রভাব থাকলেও, বডোদের আকাঙ্খাকে অনেকটাই স্বীকৃতি দিয়ে যে শাসক শ্রেণির ছোট সহযোগী করে ফেলা হয়েছে এটাতো স্পষ্ট। তবে বাকিদের তুষ্ট করবার উপায় কী? না করলেতো লড়াই চলবেই। হিন্দু বাঙালিরাও যতটা নিরাপদে গুয়াহাটি থাকতে পারেন তত নিরাপদে নেই বডোল্যান্ডে। নিশ্চয় সেগুলো দীর্ঘদিনের বডোদের প্রতি বাঙালি বর্ণহিন্দুদের করা অবজ্ঞার প্রতিক্রিয়া।কিন্তু সে প্রতিক্রিয়া বড়ো সুখের নয়। নিত্যদিন দাবী ধমকি হুমকির মুখে থাকতে হচ্ছে। যদিও বাঙালি হিন্দু ছোট জনগোষ্ঠী বলে এখনই সম্প্রদায় হিসেবে আক্রান্ত নন। তেমনি অবস্থা অসমিয়া মধ্যবিত্তদের-ও। অসমিয়া ভাষা আক্রান্ত হচ্ছে । অসম সাহিত্য সভা নীরব থাকছে। শান্তি শান্তি আর মিলন মিলন বলে কোনো স্থায়ী সমাধান বেরুবে না। বডোল্যান্ড মেঘালয় নয়। মেঘালয়ে গারো খাসি সংখ্যাগুরু ছিলেন। বডোল্যান্ডে অবস্থা অন্যরকম। এখানে অনাবডোরাই সংখ্যাতে বেশি। সুতরাং সংঘাত রাজ্য হলেও থামবে এটা অনাবডোরা মেনে নিতে পারছেন না।তাই গড়ে উঠেছে অনাবডো সুরক্ষা মঞ্চ। রাজ্য দাবীর একতরফা বিরোধিতার মধ্যেও এর সমাধান নেই। সমাধান করতে গেলে সব জনগোষ্ঠীকে একটা সমঝোতাতে আসতে হবে, সেই সমঝোতা হলো মুখের কথাতে নয়, সাংবিধানিক ব্যবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব সহ সমস্ত কিছুতে ছোট বড় সমস্ত জনগোষ্ঠীর অধিকার এবং আকাঙ্খাকেমর্যাদা দিতে হবে। তার জন্যে গ্রাম অব্দি আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন, সংরক্ষণ, কোচেদের আর আদিবাসীদের জনজাতির মর্যাদাকে স্বীকার করে নিতে হবে। আর সেটিযদি সত্যি করাই যায় তবে আর অসম থেকে বেরিয়ে যাবারো দরকার থাকবে না কারো।হ্যাঁ, অনুপ্রবেশ সমস্যারও চিরদিনের জন্যে সমাধানের জন্যে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে, একে বাহানাবাজির জন্যে ব্যবহার চিরতরে বন্ধ করতে হবে। আজই দেখলাম, বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার স্বার্থে বাংলাদেশও এই নিয়ে ভারতের সঙ্গে কথা বলতে রাজী হয়ে গেছে। এখনি সবার মুখোশ খসে পড়বে এই নিয়ে।

               অনেকেই বলছেন, অনুপ্রবেশ একটা সমস্যা।কিন্তু ১৯৮৫তে অসম চুক্তির পরেও এতো বছরে এইসমস্যাটা টিকে আছে কেন জবাব দিলে পারেন। মাঝে কিন্তু ক্ষমতাতে অগপ-বিজেপি ছিল। কংগ্রেস নিজেই সেই চুক্তি করেছিল। আসলে ওটা এক বাহানা, টিকিয়ে রেখে বাহানাবাজি করতে সব্বাই ভালোবাসে। মুসলমানেরাই এখন দাবী করেন বাংলাদেশ সীমান্ত সিল করো, নাগরিক পঞ্জী চালু করো, কে শোনে কার কথা।

                 গেল কয়েক সপ্তাহের অসমের যেকোন কাগজ খুললেই দেখা যেত বডোল্যান্ডে রাজ্যদাবি এবং তার বিরোধীদের মধ্যে ছোট খাটো সংঘাত হয়েই চলেছে। এগুলো এরই ধারাবাহিকতা। এবারে,  অনেকে বলছেন , এহচ্ছে জি এস রোড কাণ্ড থেকে চোখ ঘুরিয়ে দেবার ফন্দি। যদি মেনেও নেই, তাহলেও প্রশ্ন এতো বড়ো সংঘাতকে অসমিয়া মধ্যবিত্ত যে এই ঘুরিয়ে দেবার ফন্দি হিসেবে দেখছেন বা তরুণ গগৈ আর হেমন্ত বিশ্বের রাজনৈতিক সংঘাত হিসেবে এই আশ্চর্য ঘটনাও গেল কয়েক দশকের অসমের রাজনীতিতে ঘটে নি। মুসলমান তথা বাংলাদেশি গালি দেবার এতো সুবর্ণ সুযোগ প্রচার মাধ্যম বা হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি এর আগেএভাবে ছেড়ে দেয় নি! এমনকি ৩০ অক্টোবর, ২০০৮ এ যখন রঞ্জন দৈমারীর এন ডি এফবি তিন শহরে বোমা ফাটিয়ে প্রচুর লোক মেরেছিল তখনও গোটা অসমে প্রতিবাদের ঢেউউঠেছিল প্রথমে এই বিশ্বাস থেকে যে কাজগুলো বাংলাদেশি সন্ত্রাসবাদীদের কাজ।পরে যখন ধরা পড়ল যে এটা এন ডি এফ বির কাজ তখন সবাই চুপ। হ্যাঁ, রঞ্জনদৈমারিকে তাই আত্মসমপর্ণের পর এখনো সরকার অরবিন্দ রাজখোয়াদের মতো খোলা হাওয়াতে ঘুরে বেড়াবার অনুমতি দেয় নি। কারণ দিলে অসমিয়া মধ্যবিত্ত এটা মেনেনেবে না।

                        যদি কারো কারো এই দাবি মেনেও নিই  যে মুসলমানেরাও সমানে মারছেন, তারপরেও তর্ক আছে, প্রশাসনিক নীরবতা, যার কথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবও বলেছেন সেই নীরবতা বা ব্যর্থতা কার পক্ষে কাজ করেছে? কার হাতে আছে? মুসলমান পক্ষে? বিটিএডিপ্রশাসনের ভূমিকা কী? তারা কি প্রশাসনে প্রভাব খাটাতে ব্যর্থ? প্রাক্তন বিএলটি আর এনডি এফ বি কি অস্ত্রগুলো জমা দিয়ে দিয়েছে? তাহলে সমানে সমানে লড়াই হলো কী করে? আপনাদের কি মনে হচ্ছে আমি এক পেশে কথা বলছি? না , নানা দিক থেকে সত্যকে বের করে আনবার প্রয়াস করছি? হ্যাঁ, মুসলমানেরা প্রতিরোধ করেছেন, এটা সত্য। সাম্প্রতিক ছোট খুনোখুনি নিয়ে আমসুর অসম বন্ধের ডাক আগুনে ঘি দিয়েছিল। কিন্তু পালিয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। যত শরণার্থী শিবির হয়েছে তার অধিকাংশই মুসলমান।

                          আরেকটি মজার তথ্য দিই, পূর্বোত্তরে যেহেতু সামন্তীয় সমাজ জাঁকিয়ে বসবার আগেই আধুনিকপুঁজিবাদী সমাজ চেপে বসেছে, জনজাতিরা  কৃষি জমি থেকে বেরুলেই আরকায়িক শ্রম করতে চান না। এদের মধ্যে ধোপা,নাপিত, মুটে, মিস্ত্রি এগুলো নেই।এই কাজগুলো করেন হয় এই সব মুসলমান, নতুবা ঝাড়খণ্ডী আদিবাসি, নতুবা বিহারি হরিজন। আর এই প্রত্যেকটা জনগোষ্ঠীই অত্যন্ত সস্তা দরে শ্রম দেন। শ্রমের জন্যে এদের ডাক পড়ে, আবার সময় হলে মেরেকেটে তাড়িয়েও দেয়া হয়।কেন তাড়ানো হয় কেন? দুটো কারণ, তাতে এইসব শ্রমিকদের দর কষাকষির ক্ষমতা কমে যায়। এতো ভয়ে ভয়ে থাকে যে ৫০০ টাকার কাজ করিয়ে আপনি ১০০ টাকাও কখনো বা ধরিয়ে দিতে পারেন। রিক্সাওয়ালাকে, 'যা বেটা! বাংলাদেশী!' বলে আপনি টাকা না দিয়েও চলে যেতে পারেন। আর দুই হলো, এঁরা স্থায়ী হয়ে গেলে স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে দেবেন এবং আধিপত্যকামী জনগোষ্ঠীর স্বার্থব্যহত করবেন এই ভয় লেগেই থাকে। এহলো অর্থনীতি আর রাজনীতির সংঘাত। বিশ্বহিন্দু পরিষদের মন্দিরগুলো তৈরি করতেও তথাকথিত বাংলাদেশী শ্রমিকেরই ডাক পড়ে - এই হলো মজা! বডোল্যান্ড থেকে প্রচুর মুসলমান আগকার দাঙ্গাগুলোর সময়ে চলে গেছিলেন। অসমের অন্যত্র। কয়েক হাজার এখনো শরণার্থী শিবিরে রয়েছেন।কিন্তু বডোল্যান্ড টেরিটরিয়েল এরিয়া হবার পর অনেক পরিকাঠামোর কাজ হচ্ছে।তাতে বডো যুবকেরা মাঠ ছেড়ে ঠিকাদারিতে হাত দিচ্ছেন। শ্রমিক হিসেবে মুসলমানফিরে আসছেন।মুসলমান আরো আসছেন এদের ফাঁকা ধানের মাঠে চাষাবাদ করতে। সঞ্জীব বরুয়ার একটা বই পড়েছিলাম অনেক আগে। তিনি লিখেছিলেন এই 'অনুপ্রবেশকারী' চাষারা গোটা পূর্বোত্তরে এক নতুন কৃষি বিপ্লব নিয়ে এসছেন। পাহাড়েও ঝুমচাষের জায়গাতে এরাই গিয়ে ভূমি শ্রমিক হয়ে স্থায়ী চাষাবাদের প্রচলন করছেন।সুতরাং একাংশ বডো রাজনীতিবিদ এই মুসলমানকেতাড়ালেন বটে, অন্য অংশ দু'দিন পরেই আবার এদের ডেকেও আনবেন। মুসলমানের হাতথেকে অসমের গ্রামীণ অর্থনীতির, এমনকি, আধুনিক উন্নয়ন কামী অর্থনীতিরও কোনো সহজ মুক্তি নেই। কারণ শ্রমের এরাই মূলত মালিক। কোনো ভট্টাচার্য, চক্রবর্তী, কর, ধর, বরঠাকুর, গগৈ, ব্রহ্ম, বসুমাতারি কায়িক শ্রম করে না তেমন!হ্যাঁ, করতেন, ধান চাষ ছাড়াও কিছু কিছু তাঁত শিল্পের কাজতো ছিলই । কিন্তু সেগুলোও এখন কলের কাপড় নিয়ে গেছে। আর ছিল পুরোনো ধরণের ঘর বানাবার শ্রম।আজকাল আর সি সি-র যুগে আসাম টাইপ ঘর-ই উড়ে গেছে, অন্য জনজাতীয় ঘরবাড়ির আর কি বা কথা! আর সি সি পাকা ঘর? মুসলমান ছাড়া কে বানাবে? আমি জানি না।

                ২৭ জুলাইর আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়তে পড়লাম প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র সচিব ‎"পিল্লাইয়ের কথায়, “স্বশাসিত পরিষদে বড়ো-রাই বিশেষ সুবিধা, রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করে। তবে ওঁরা সকলকে নিয়েই চলার চেষ্টা করেন। কারণ ওঁরা জানেন যে, ওঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নন। মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪০% বড়ো জনগোষ্ঠীভুক্ত।বড়ো-রা ছাড়া ওখানে বাঙালি, নেপালি, সাঁওতাল, ছোট ছোট আদিবাসী গোষ্ঠীও রয়েছে।”

"পিল্লাইএর এই বক্তব্যের মধ্যে সত্যও আছে ফাঁকিও আছে।( আনন্দবাজার সম্পাদকীয়ঃ) ৪০%বডো এটা সত্য, এই অর্থে সত্য যে এরাই সংখ্যালঘু। শতাংশের হিসেব তার চে'ও কম হবে। এরা রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করেন এটাও সত্য। 'তবে ওরা সকলকে নিয়ে চলার চেষ্টা করেন' এটা মিথ্যে। মিলিয়ে চলা মানে -ধমকে ঠাণ্ডা রেখে। আর নতুবা এরকম নৃতাত্ত্বিক সাফাই অভিযান চালিয়ে।

              বাংলাদেশে যে বাঙালি মুসলমান শাসনে আছেন তাদেরই সবচে’ দরিদ্র অংশটি এক কালে অসমে এসছিলেন ময়মনসিংহ থেকে চাষাবাদের জন্যে। তখন অবশ্যি গোটা বাংলাদেশেই মুসলমান মূলত কৃষক ছিলেন। সেই থেকেই এরা এখানে কেবল কৃষকই থেকে যান নি, এদের বিরুদ্ধে মায়ানমারের রোহিঙিয়ার মতো প্রচার দিয়ে সবচে অস্পৃশ্য এক শ্রেণি করে রাখা হয়েছে।দেশভাগের আগে থেকেই একাংশ প্রচার চালাচ্ছিলেন এরা থাকতে অসমীয়ার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। ৭৯ থেকে ৮৫ অসম আন্দোলনেরও মূল বিষয় ছিল এই। বলা হয়, এরাপ্রতিনিয়ত বাংলাদেশ থেকে আসছেন। এরা ইসলামীস্তান বানাবেন ইত্যাদি হাজারো অপপ্রচার আছে। আজ অব্দি যত বাংলাদেশি আইনত বের করা গেছে তার সংখ্যা ১০০০ ছাড়াবে না। খরচ কিন্তু কয়েক হাজার কোটি টাকা।মোদ্দা কথা এই সব প্রচার দিয়ে এদের সস্তা শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার খুব সহজ হয়। আইনত এদের ভোটাধিকার থাকলেও সামাজিক অধিকার এদের প্রায় শূন্য। বাংলাদেশের আদিবাসিদের মতোই। কেবল রাষ্ট্র নয় বর্ণহিন্দু অপপ্রচার এবং সেই প্রচারে প্রভাবিত জনজাতিদেরকেও ভয় করে বাস করতে হয় এদের।

            জনজাতিদের অবস্থাও যে খুব ভালো তা নয়। এরাও অতিদরিদ্র। ইতিহাসের দীর্ঘ পর্যায় জুড়ে এরা যেমন বাংলাদেশে, উত্তরবাংলাতে তেমনি অসমে বা পূর্বোত্তরেও নানা ভাবে বঞ্চিত। কিন্তু এখানে ‘কিন্তু’ আছে। এখানে হাজার রকমের জনজাতি বাস করেন। এদেরই মধ্যে আপাত সংখ্যাতেবেশি যারা তাদের সঙ্গে আপোস করে শাসনের সহযোগী করে নেবার চাল চিরদিনই চালিয়ে গেছে ভারতীয় বা স্থানীয় বর্ণহিন্দু শাসক শ্রেণি। তাই ইতিমধ্যে গড়েউঠা বহু জনজাতীয় রাজ্যেই ছোট জনজাতীয়দের দাবিয়ে রাখার কাজ বড়ো জনজাতীয়রাই করেন। যেমন কোচেদের জনজাতি বলে কোনো স্বীকৃতি নেই। এই দাবী জানালে বডোরাই এর বিরোধিতা করেন। বডোদের স্বশাসন দিয়ে তাদের শাসনের সহযোগী করে ফেলা হয়েছে। যেমন গোর্খাল্যাণ্ডে গোর্খাদের সহযোগী করে লেপচা ভুটিয়াদের দাবিয়ে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সমস্ত জনজাতীয় এবং সংখ্যালঘু ঐক্য যাতে না গড়ে উঠে এটা ভারতীয় শাসক শ্রেণি সুকৌশলে সুনিশ্চিত করে। বাঙালি-বিহারি-মারাঠি-গুজরাটি-অসমিয়া বর্ণহিন্দু শ্রেণিটি এই সুকৌশল খুবপছন্দ করেন। গোটা পূর্বোত্তরে প্রায় সমস্ত জাতি জনজাতিদের উগ্রপন্থী গোষ্ঠী ছিল বা আছে। ব্যতিক্রম কেবল বাঙালি হিন্দু-মুসলমান। কিন্তু মুসলমানের বিরুদ্ধে টানা প্রচার আছে এরা আই এস আই-এর হয়ে কাজ করে, উগ্রপন্থীদের মদত দেয় ইত্যাদি। এগুলো মিথ্যাচারীদের প্রচার মাত্র। মাঝে মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থাও এই সব প্রচারে তথ্য যোগায়। কিন্তু আজ অব্দি এদের বডো ডিমাছা মণিপুরি নাগা উগ্রপন্থীদের মতো সংগঠিত রূপে দেখা যায় নি। গেলে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে অন্য অনেক সংগঠনকে যখন ভারত সরকার আলোচনার টেবিলে নিয়ে এলো তাদেরও আনতে পারত। আর পারে নি বলে বাংলাদশ সরকারের বিরুদ্ধে ভারত সরকার কোনো অভিযোগ জানিয়েছে বলেও জানা যায় নি। অথচ ওদিকে ওদেশের সঙ্গে ঘনঘনই তো ভারত এবং অসম সরকারের কথা হচ্ছে।  মুসলমানেরা যাদের থেকে মার খান তাদের কেন মদত দিতে যাবেন? কিন্তু কেবল বিজেপি নয়, বহু বামেরাও এই প্রচারে সিদ্ধহস্ত। প্রচার মাধ্যমের কথা তো বলেই লাভ নেই। অসমেআলফা এন ডি এফ বি- যখন গোলাগুলি ইত্যাদি করত তখন বহু হিন্দু বাঙালি 'ভদ্রলোক'ও বলে বেড়াতো এগুলো মুসলমানের কাজ। অথচ এই সব অমুসলমান উগ্রপন্থীদের হাতেকিছু বাঙালি হিন্দু কেন অসমিয়া সহ সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর অনেকেও মারা গেছেন বাযান। এন ডি এফ বি আর বি এল টি নিজেদের মধ্যেও প্রচুর মারামারি করেছে। তবুআমাদের কিছু বন্ধু শেষ অব্দি মুসলমানের দোষ দেখবেন ই! এতে তো বোঝাযায় এরা সমস্যার গভীরে যেতে মোটেও আগ্রহী নয়। মুসলমান এদের প্রচারকে পুষ্টকরে গেলেই এরা তাত্ত্বিক সন্তুষ্টি লাভ করেন। এই ভাবেই দৃশ্যত সংঘাত থেমে গেলেও সংঘাতের কারকগুলো টিকেই থাকে। শান্তির আলাপ যখন চলে আড়ালে তখন পরবর্তী সংঘাতের মশাল তখন তৈরি হতেই থাকে।

                     অসমীয়াদের মধ্যেও অনেক বিবেকবান বুদ্ধিজীবি আছেন, যারা সত্য উচ্চারণ করছেন। আনন্দবাজার উপরের সম্পাদকীয়তে তেমনি এক প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে, “সেন্টার ফর নর্থ-ইস্ট স্টাডিজ অ্যান্ড পলিসি রিসার্চ-এর প্রধানসঞ্জয়হাজরিকার যুক্তি, “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে যাঁদের দিকে আঙুল তোলাহচ্ছে, তাঁরা অনেক দিন ধরেই ওখানে বসবাস করছেন।তাঁদের এখন অনুপ্রবেশকারী বলে দেওয়াটা আসলে বিষয়টাকে বিপথে চালিত করার চেষ্টা।” এটাই সত্য কথা।

            কিছু অতি বুদ্ধিমান বাঙালি হিন্দু, যারা স্বপ্ন দেখেন,  দ্বিজাতিতত্ত্বের আধারে দেশ ভাগ হয়েছে তাই কোনো মুসলমানের অধিকার নেই ভারতে থাকবার। বিজেপির অনুপ্রবেশকারী বিরোধী আওয়াজে সঙ্গ দিলেই এরা চলে যাবেন অসম ছেড়ে আর হিন্দু বাঙালিরা সুখে  স্বর্গবাস করবেন তাদের সে স্বপ্ন দিবাস্বপ্ন মাত্র। অসমিয়ারা কোনদিনই চাইবেন না, সমস্ত পূর্ববঙ্গমূলের মুসলমান অসম ছেড়ে চলে যান। কারণ, তারা নিজেদের মাতৃভাষা অসমিয়া বলে সেই ষাটের দশকে লিখিয়ে অসমিয়াকে সংখ্যাতে অনেকটাই এগিয়ে রেখেছেন। কোনো বুদ্ধিমান অসমিয়া চাইবেন না, তাঁরা চলে গিয়ে অসমিয়া সংখ্যাটা কমিয়ে আনুন। তাই আসুর মতো সংগঠন যারা লড়াইটা শুরু করেছিল, ১৯৫১কে ভিত্তি বর্ষ করে অসম থেকে বিদেশি তাড়াতে হবে, তারাও চুক্তি করবার সময় ১৯৭১এর ১৬ মার্চ যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় সেই দিনটিকে ভিত্তি বর্ষ হিসেবে মেনে নেয়। তার আগেকার মুসলমানদের আসুও স্বদেশী বলে আইনত স্বীকার করে নিয়েছে। তার পরের অনুপ্রবেশকারীরা অসম ছেড়ে চলে যাক এটা আজ সব্বাই দাবি করে, বাংলাদেশ সীমান্ত সীল করবার দাবিও পুরোনো কিছু নয়।  কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় নি এর পরের ২৫ বছরেও। কেন হয় নি জিজ্ঞেস করলে এরা বলবে, কেন , কংগ্রেসের মুসলমান তোষণ নীতির জন্যে। ভোটব্যাঙ্করাজনীতির জন্যে। অথচ দু’বার অগপ, এবং কেন্দ্রে বিজেপি একবার সরকারে ছিল কিন্তু। কিচ্ছুটি করতে পারে নি।

             কেন? এতোদিন এরা বলতেন, আই এম ডি টি আইন আছে বলে। সেই আইন বাতিলও হলো আজ অনেক বছর হলো। তার পরেও যে কাজের কাজ কিছু হয় নি। হবে বলেও মনে হয় না। কারণ হলে রাজনীতির এই রং চিরদিনের জন্যে বিদায় নেবে। অনেকেই আছেন, অসমের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবেন। তাই মাঝে মধ্যে সন্দেহ হয়, অসমের মাটিতে অনুপ্রবেশকারী সত্যি সত্যি আছেন তো?

* কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংযোগঃ
১) Don’t blame the immigrant
২)assam-violence-wake-up-call


(c) সৌজন্যঃ গুরুচন্ডালী

কোন মন্তব্য নেই: