কবি শঙ্খপল্লব আদিত্য। ৬-এর দশক থেকে বাংলা কবিতায় তাঁর সন্ত্রাসের শুরুয়াৎ। প্রায় ৫০ বছর আগে, পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে, আগরতলায় চলে এসেছিলেন সপরিবারে। জন্মস্থান ময়মনসিংহ, অজস্র সংকেত, ছেদ, স্মৃতি বিস্মৃতির চেয়ে কিছু বেশি ছোপছাপসহ আলোকিত আর ছায়াছন্ন হয়ে আছে শঙ্খপল্লবের কবিতায়। উদ্বাস্তু যন্ত্রণা, অস্থিরতা, নৈরাজ্য, ভোগবাদ, নগরসভ্যতার প্রতি বিবমিষা, শ্লেষ, তীব্র ভালোবাসা; এতসব বিস্ফোরক আর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে অ্যাম্বুশের ফাঁকে ফাঁকে ছেনি চালিয়ে, অভূতপূর্ব কারুকাজ আর নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে প্রায় ভাস্কর্যের পর্যায়ে উন্নীত করেছেন তাঁর কবিতাকে। কখনও বা তন্ত্রের পরমতায় খুঁজে নিয়েছেন নির্জন আশ্রয়। কবিদের আড্ডা, সভা ও সমিতি, তৎপরতা, উল্লম্ফন থেকে বরাবরই থেকেছেন স্বেচ্ছানির্বাসিত। জীবিকার পাশাপাশি দীর্ঘদিন চালিয়ে গেছেন পাণ্ডুলিপি প্রেস আর তাঁর নিজস্ব পিলাক প্রকাশন। সম্পাদনা করেছেন 'জঠর' কবিতাপত্র। নিজের সম্পর্কে যুগপৎ উদাসীন, উন্নাসিক শঙ্খপলব আদিত্য একে একে বের করেছেন বন্ধুদের বই। গত শতাব্দীর শেষদিকে এসে আমাদের নিরবচ্ছিন্ন উৎপাত সইতে না পেরে বের করতে বাধ্য হন 'ভালোবাসার মনাক্কা ও খাসা কিসমিস'। ১ ফর্মায় শানানো এই চটি কবিতার বইটি-ই সম্ভবত শেষ বই হত, যদি না পল্লব ভট্টাচার্য আর পৌণমী প্রকাশনের নিলীপ পোদ্দার এগিয়ে এসে কয়েক বছর আগে 'শঙ্খপল্লব আদিত্যের কবিতা' প্রকাশ না করতেন।
শঙ্খপল্লবের গুহায় কেটেছে আমাদের তারুণ্যের অধিকাংশ দিনগুলি। দর্শন, কবিতা, তন্ত্র, যৌনতা, অধ্যাত্মবাদ, রাজনীতি-আলোচনা, ছন্ন বারুণীর লঘু আড্ডায়, সম্রাট শঙ্খপল্লবকে সন্তের মতোই মনে হত আমাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি ঢাকাতেই 'সংবাদ' কাগজে শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতার নেশা, ত্রিপুরায় এসেও যা থেকে আর মুক্ত হতে পারেননি। শঙ্খদার দীর্ঘসূত্রিতায়, মাঝে মাঝে আমরাও যারপরনাই বিরক্ত হয়েছি। কম্পিউটার প্রবর্তনের আগেই 'বিন্দুর চংক্রমণ ও নামহীন কবিতা' শীর্ষক এক পোয়েটিক্স ছকে ছকে আজ অব্দি লিখে উঠতে পারেননি। বহুবার তাৎক্ষণিক সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে, প্রায় এক দশকেরও আগে, নিয়মিত আড্ডা দিয়ে লিখিত সাক্ষাৎকারের প্রশ্নগুলো আজও থমকেই রয়েছে। আমার ধারণা, এই সাক্ষাৎকার, ব্যক্তি ও কবি সমগ্র শঙ্খপল্লব আদিত্যকে বাংলা কবিতায় উন্মোচিত করতে পারত। তাঁর কবিকৃতি নিয়ে লেখালেখি খুব বেশি নেই। হয় CONSPIRACY OF SILENCE, নয়তো শব্দের দ্যোতনানির্ভর তাঁর বাল্মীকিপ্রতিভা নিয়ে অদীক্ষিতদের অক্ষমতা। কবি কল্যাণব্রত চক্রবর্তী আর অমিতাভ দেব চৌধুরী ব্যতীত তাঁকে নিয়ে আর কেউ লিখেছেন বলে মনে পড়ছে না। একদা কবির নিত্য সহচর পল্লব ভট্টাচার্যের পথ চেয়ে দীর্ঘদিন অপেক্ষায় আছি। একমাত্র তিনিই পারেন বাংলা কবিতার আদিত্যদ্যুতিকে অজস্র স্তরের মধ্য দিয়ে বিচ্ছুরিত করতে।
তাঁর সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করে, একটি কবিতা আবারও পাঠ করা যাক।
মুক্তাগাছার মহারাজা ব্রজেন্দ্রকিশোর
..............................................
আজকাল নববিবাহিত যুবকেরাও পূর্ণিমার জ্যোৎস্না লুঠ করে কোনও রমণীর
কাছে বেশি দামে বিক্রি করে না, চনমনে ঘোড়াগুলিরও নেই সেরকম জিন ও সহিস
জ্যোৎস্না লুঠের পয়সায় নেশা করে হাওড়ার পাণ্ডুর চাঁদ ও চাঁদপুরের ইলিশ
কিনে অযথা বউকে জাগায় কজন উজ্জ্বল যুবক?
গভীর রাতে মৌরির গজলবাগানেও নেই কিশোরগঞ্জের পোড়ো বুকে সাপের হিসহিস
মানচিত্রের ছকের একচুল বাইরেও কোনও পা নেই, এরই মাঝে কেউ ধার্মিক কেউ বক
নীলব্রহ্মমণি প্রহরীর কমলদরিয়ায় গহরপাটা নিয়ে কেউ হাঁটাহাঁটিও করে না আজ
নিজেই নিজের সীমাবদ্ধ মুক্তাগাছায় স্বঘোষিত ব্রজেন্দ্রকিশোর মহারাজ
মানুষের সাহস কেবল কমে আসছে, ছোটো হয়ে আসছে ইড়া ও পিঙ্গলা এবং রক্তকোষ
কিন্তু কিছুতেই অহংকারী বোতলের ফেনার নির্বিষ 'ফোঁস' কমছে না।
৩টি মন্তব্য:
"দ্বাদশ অশ্বারোহীর একজন " জীবনসংগ্রামী কবি শঙ্খপল্লব আদিত্য-কে আমার স্যালুট।
উনি জীবনকে দেখেছেন জীবনের মতো করেই, আমরা দেখেছি সাজঘরের কমনীয়তা থেকে। ওঁর কাছে তাই আমাদের অনেক পাওয়া রয়েছে। কাছ থেকে দেখা,আস্বাদ গ্রহন, জিয়নকাঠির ছোঁয়া লাগুক আমাদের এ-প্রজন্মের আত্মায়।
"মুক্তাগাছার মহারাজা ব্রজেন্দ্রকিশোর" কবিতাটি অনেকক্ষণ ভাবালো। নিয়ে গেল ইতিহাসের বুকে মাস-লেন্থ-টাইম ডিমেনশনের ওপারে...বহুদূর।
কবির সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
শ্নঙ্খদাকে নিয়ে কাজ হল না তেমন। তার কারণও তিনি নিজে। লেখক সেটা বলেছেন। এই সত্য বড় মনে বাজে। কেউ ইচ্ছে করলে নিজের থেকে করতে পারতেন। সেটা যে কেন হল না।
সত্যি, শঙ্খপল্লব নিয়ে এইটুকুনি যে প্রবুদ্ধ লিখল, আমি সেটুকুই তুলে রাখলাম এরই জন্যে। তাতে করে যদি বাইরের লোকের সামান্য আগ্রহও জন্মায়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন