।। অমলেন্দু গুহ।।
আমার জন্যে মায়ের মতন মাটির মমতা ছোঁয়া
সাদা হয়ে দুধ এসেছে মাঠের মানিকীমাধুরী ধানে,
আমার জন্যে মধুতে ভরেছে কমলালেবুর কোয়া,
প্রতিবেশী মেয়ে মায়াবী আঙুলে ফুল তুলে বিহুয়ানে
আমাকে দিয়েছে প্রীতি উপহার লজ্জায় কুচিমুচি।
মেজি-জ্বলা সাঁঝে কখনও কখনও মনমরা হয়ে তবু
দিঘলিদিঘির কোণটায় বসে সজল দুচোখ মুছি...
আমি নাকি এক বিদেশি, এ-মাটি স্তন্য দেয় নি কভু।
লুইতের পার সাদা ধবধবে কাছিমেরা বুঝি ডিম
লুকোয় সেখানে, শিশুকালে তাই দুই হাতে বালু খুঁড়ে
বেঁধেছি বালুর বাঁধ তাই দিয়ে, তৃপ্তি অপরিসীম
পেয়েছি, আজ তো সেসব স্মৃতিই মন খায় কুরে কুরে।
চাকরির খোঁজে প্রাগজ্যোতিষের আপিসে আপিসে গেলে
আমার মাতৃভাষাকে হয়েছে দাঁড়াতে কাঠগড়ায়
“ এ কোন ভাষায় কথা বলো, খাঁটি লুইতপারের ছেলে
তুমি নও’—মন মুচড়ে উঠেছে অপমানে, বেদনায়।
আমাকে যখন উপহার দেয় লজ্জায় কুচিমুচি
তাঁতশালশোভা বিহুবতী মেয়ে, যখন রাতের রানি
আমারই উঠানে জোছনা-হাসিতে ছড়ায় হিরার কুচি,
ওরা তো চায় না ডোমিসাইলের পরিচয়লিপিখানি।
কিন্তু যখন ছোট ভাইটিকে কলেজে পড়াতে চাই
প্রাণভোমরা যে ভায়ের অ্যান্টিকে ছাপা বই,
সব ঠাঁই থেকে বাঁধা গতে শুধু একটি জবাব পাই—
‘তুমি যে স্থানীয়, জেলা হাকিমের পরিচয়লিপি কই?’
হাতে তুলে দেওয়া জমির দলিল খাজনার চিঠি দেখে
আইনের এক নতুন অর্থ ঝলসিয়ে চাহনিতে
মাথা নেড়ে কন হাকিম সাহেব কড়িকাঠে চোখ রেখে,
‘তোমাকে চিনি না, অপারগ আমি পরিচয় লিপি দিতে।’
এমনি করেই অভিমানাহত লুইতপারের ছেলে
পাথরে পাথরে মাথা কুটে চলি, তবুও হৃদয়ে জ্বেলে
ও মোর অসম দেশ সুচিকণ! আ মরি বাংলা ভাষা।
মুহূর্তে যেন পাথরের ভার মন থেকে যায় সরে
এ-মাটি আমারও এজমালি ঘরে শরিক কত না ভাই,
নানান ভাষায় কথা কই তবু আমাদের মন ভরে
একটি কথাই—মাথা উঁচু করে বাঁচতে, হাসতে চাই।
এক আকাশ তারা চেয়ে চেয়ে দেখে শান্তির ঘর খুঁজি
মিকিরের চাঙে, অসমিয়া গাঁয়ে, ভগনিয়া বস্তিতে
লুইতের বানে ঘর ভাঙে তবু বেহুলার মতো যুঝি,
পিঁইয়ের মাচায় ভরে যায় মন ভরে যায় স্বস্তিতে।
সাদা ধবধবে লুইতের পার কাছিমেরা ডিম পাড়ে
আমার ভায়ের মুখে চমকায় মিতালির ভালোবাসা,
দিঘলিদিঘির কোণটায় বসে গান গায় বারে বারে,
ও মোর অসম দেশ মরমিয়া, আ মরি বাংলা ভাষা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন