“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

এক নজরে ত্রিপুরার মেয়ে কবিরা


Bishal Garh Boimela


এক নজরে ত্রিপুরার মেয়ে কবিরা
(বিশালগড় বইমেলা স্মরণিকাতে প্রকাশিত)
।।  চিরশ্রী দেবনাথ ।।
মেয়ে কবি কথাটি, আমার মোটেই পছন্দের নয়, কিন্তু যারা সংখ্যালঘু, তাদের কথাই বিশেষ করে বলতে হয়, এটাই চলে আসছে, তাই এর ওপর ক্ষীণ আলোকপাত  করার একটি  অক্ষম চেষ্টা হবে এ লেখাটি।   প্রচুর ত্রুটি থাকবে ,পাঠকেরা নিঃসংকোচে সুযোগ পেলে এর সমালোচনা করতে পারেন।  বহুলাংশে ব্যক্তিগত আবেগতাড়িত তথ্য যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। ত্রিপুরার প্রথম মহিলা কবি হিসেবে যে নামটি উঠে আসে, তিনি হলেন মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের প্রথমা  কন্যা, অনঙ্গমোহিনী দেবী।জন্ম আঠারশো চৌষট্টিতে।  তার তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, প্রথম কাব্য 'কণিকা ', দ্বিতীয় কাব্য'শোকগাথা 'তৃতীয় কাব্য 'প্রীতি '।প্রকৃতির সঙ্গে আপন অনুভবের সংমিশ্রণের কাব্যময় প্রকাশ ঘটে তার লেখায়।  মূলত প্রাসাদকেন্দ্রিক জীবনধারায় অভ্যস্ত এই নারী ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সাহিত্যচর্চা, শিল্প, সঙ্গীত ইত্যাদির সঙ্গে থাকতে থাকতে তার মানসিকতার সমৃদ্ধি ও প্রসারতা ঘটিয়েছিলেন, তবে রাজপরিবারের বাইরে মৃন্ময়ী ত্রিপুরার খুব বিশদ কোন বিবরণ তার লেখায় পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে মহারাণী তুলসীবতী, মহারাণী প্রভাবতী, রাজকুমারী কমলপ্রভা ..এরা সকলেই কিছু কিছু গান ও কবিতা রচনা করেছেন, তবে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত না হওয়ায় সেগুলোর সঙ্গে পাঠক তত পরিচিত নন। তবে এগুলো সবই বৈষ্ণব ভাবধারার কবিতা ও গান। রবীন্দ্র স্নেহ এবং প্রশংসাধন্য কবি অনঙ্গমোহিনী দেবী মাত্র পঞ্চান্ন বছর বেঁচেছিলেন এবং ত্রিপুরার বাংলা কবিতায় সর্বপ্রথম নারী প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তিনি সেই সময়ের লেখিকা যখন ত্রিপুরার রাজবংশের ছেলেরা উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে যাবার সুযোগ পেলেও মেয়েরা শুধু মেয়ে বলেই গৃহশিক্ষায় আবদ্ধ থাকতেন, তবুও কবি অনঙ্গমোহিনী দেবী নিজস্ব অনুভূতির স্বাধীন প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন, পৃথিবীকে নিজের চোখ দিয়ে দেখেছিলেন। অনঙ্গমোহিনী দেবীর পর ত্রিপুরার ইতিহাসে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে এবং সেই পথ ধরেই এসেছেন কবি করবী দেববর্মণ।জন্ম উনিশশো বত্রিশে।  যতদূর আমি জানি, তাঁর কবিতার ছয়টি কবিতা গ্রন্থ  প্রকাশিত হয়েছে ..লুণ্ঠিত সময় সীতা, কবিতা আমার সময় অসময়, মেরুদণ্ড দাও, কিছু স্বগোতক্তি :কিছু ব্যক্তিগত সংলাপ, সৃজনে উৎসবে। তার কবিতায় নারী কখনো সাহসী ভূমিকায়, কখনোও তার অন্তরের করুন, নরম আর্তি প্রকাশিত হয়েছে। পাঞ্চালী দেববর্মন, করবী দেববর্মনের কন্যা,জন্ম উনিশশো ছাপ্পান্নসময়ের হিসাবে তিনি ত্রিপুরার আধুনিক কবিতার ইতিহাসের যাত্রী।  প্রথম কবিতার বই 'এ আমার জন্য নয়  '।তারপর আবার অনেক বছর পেরিয়ে তাঁর দ্বিতীয় কবিতা গ্রন্থ 'একান্তে সহবাস আমি ও আমাতে 'প্রকাশিত হয়েছে। তার কবিতাতেও নারীর নিজস্ব অনুভব, বোধ, স্বাধীনতার তৃষ্ণা ইত্যাদি ফুটে উঠেছে। শ্রীমতী শক্তি দত্ত রায়, ত্রিপুরার অন্যতম মহিলা কবি। অনুভবের গভীরে সন্তরণ তার, জন্ম স্বাধীনতার বছরে, উনিশশো সাতচল্লিশবালিকা বয়স থেকেই তিনি লেখালেখি করছেন, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, তবে প্রথম এবং একমাত্র  কবিতার বই নিরানব্বই সালে 'অনিরুদ্ধ সংলাপ ', তার কবিতার ভাষা খুব শক্তিশালী এবং সোচ্চার, তবুও তার বই প্রকাশিত হতে দীর্ঘ সময় কেটে গেছে, এটাই বোধহয় মেয়েদের পিছিয়ে থাকার অন্যতম প্রমাণ। মণিকা বরুয়া, খুব জোরালো এবং সাহসী উচ্চারণ। জন্ম উনিশশো আটান্ন। আমি যতটুকু জানি তার মোট সাতখানা কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এখনও লিখে চলেছেন। তার কয়েকটি বই 'প্রতিরোধ ','রক্তে দাও অমৃত ও আগুন ',গর্ভের তপোবনে চঞ্চল শিশু, ..'ল্যাপটপ মধু 'ইত্যাদি। তার কবিতায় নারীবাদী চিন্তার  প্রতিফলন ঘটেছে, বেশ স্পষ্ট ভাবেই। কবি সুনীতি দেবনাথ, জন্ম উনিশশো পঁয়তাল্লিশ সালে।   মূলত বামপন্থী মতবাদে বিশ্বাসী কবি, সত্তরের দশক বা তারও বহু আগে থেকে কবিতা লিখছেন ত্রিপুরার বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে, যৌথভাবে একটি কবিতার বই প্রকাশিত হলেও, এককভাবে একটি বই প্রকাশিত হবে দুহাজার ষোলতে, 'ঋদ্ধ সত্য অনুভবে আসে '
             তাঁর কবিতায় মেয়েদের কথা বলা হয়েছেবলা হয়েছে সংগ্রামের কথা,কখনো কখনো দার্শনিকতার চিত্রায়ন ঘটেছে ভাষার শুদ্ধ ব্যঞ্জনায়।    অরুন্ধতী রায়, ত্রিপুরার পত্র পত্রিকায় কবিতা লিখেছেন এবং এখনও লিখছেন। তার দুটি কাব্যগ্রন্থ 'শব্দ ও বর্ণেরা ' এবং 'চিলে কোঠার জানলায় ফেরা পাখি '। নারী জীবনের বঞ্চনা, বেদনা তার কবিতায় ফুটে উঠেছে। শেফালী দেববর্মা  ককবরক ভাষী কবি। এ পর্যন্ত দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম বই 'হরদিণর রৗচাপমুঙ '(রাত দুপুরে গান),দ্বিতীয়টি 'ইমাংনি য়াখরাই নিনাংগ '(কাঁপে স্বপ্ন সেতু )দ্বিতীয় বইটির জন্য তিনি দুই হাজার চার সালে সলিলকৃষ্ণ স্মৃতি পুরস্কার পান। তার কবিতাতেও মেয়েদের কথাই বিশেষ করে লেখা হয়েছে। সম্প্রদায় আলাদা হলেও সব মেয়েদের অন্তর্নিহিত বেদনার সুর একটি ই, এটাই মনে হয়, কবিতাগুলো পড়লে। আধুনিক সময়ের আরেকজন কবি সুস্মিতা চৌধুরী, একটি কবিতার বই 'গোপন স্তব 'প্রকাশিত হয়েছে। অল্প কথায় অনেক কথা বলে যান তিনি, এটা তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কবি স্বাতী ইন্দু ত্রিপুরার অন্যতম নারী কবি। তার কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ 'বিপদ সঙ্কুল মুগ্ধতা', 'জীবনী কাঠ ',মেডুলার মাথা ' ...।তার কবিতা ত্রিপুরার কাব্যজগতে একটি বিশিষ্ট সংযোজন, কবিতায় গভীর অনুভব, প্রতিবাদ ইত্যাদি ফুটে ওঠে দারুণ মুন্সিয়ানায়। কবি  রত্না মজুমদার, নাট্যচর্চা এবং আবৃত্তির সঙ্গেও যুক্ত। তার প্রকাশিত গ্রন্থ 'আমি হেরে যাই, তার কাছে হেরে যাই '। কবি পারমিতা ভট্টাচার্য, দক্ষিণ ত্রিপুরায় জন্ম। তার প্রথম প্রকাশিত বই 'জম্পুই চুম্বনে পূর্ণিমা ', এরপর দ্বিতীয় বই 'তিতা মিঠা '। কবি পদ্মশ্রী মজুমদার, উত্তর ত্রিপুরায় জন্ম, ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখেন। তার লেখা কাব্যগ্রন্থ 'আত্মস্তব ', 'বৃষ্টিকণা ','দেও '।কবি বিধাত্রী দাম, আবৃত্তিকার ও কবি, ত্রিপুরার কাব্যজগতে মহিলাদের মধ্যে একটি সুপরিচিত নাম, তবে তার কোন কাব্যগ্রন্থ এখন পর্যন্ত দেখিনি। কবি শান্তশ্রী মজুমদার উত্তর ত্রিপুরার একজন মহিলা কবি, প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'গহন মনের আকাশ '।তন্দ্রা মজুমদার, আরেকটি সুপরিচিত নাম, ছোট ছোট কবিতায় বহু কথা বলে যান, তার লেখা কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্ন রোদ্দুর ছুঁয়ে '। কবি সুতপা রায় ,বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে তার কবিতা পড়ি, লিখছেন, আরোও লিখুন।  তার লেখা দুটি কবিতার বই 'দহনের দিনলিপি ',নদীর নাম বেহুলা  '। কবি মণিকা চক্রবর্তী অনেকদিন আগে থেকে কবিতা লিখছেন, সম্পাদনা করেছেন লিটিল ম্যাগাজিন। এখনও লিখছেন নিয়মিত। তার লেখা কবিতার বই 'পরাগের কামনা '। আরো কয়েকজন মহিলা কবি সন্ধ্যা দেবনাথ, কবিতার বই ' সমুদ্র সৈকতে ঢেউয়ের মেলা ', 'বিহ্বল'। সুমিতা পাল ধর,বইয়ের নাম ,' অচিনপাখি'। সুপ্রিয়া দাস, বইয়ের নাম জলথেইথে। উমা মজুমদার, বই 'স্বর্ণালি পংক্তিমালা '। সম্পা বণিক বই 'আনন্দমেঘ'। তাছাড়া যে সব মহিলা কবিদের কবিতা বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিন  পাচ্ছি, তাদের সবার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় নেই, ওনারা বই বের করেছেন কিনা সেসব তথ্যও আমার কাছে নেই, এ হলো আমার নিতান্তই অক্ষমতা, তবে তাদের প্রতি আমার শুভকামনা রেখে সেই সব নামগুলো বলছি,মৌসুমি মণ্ডল, পর্শীয়া রায়, নিয়তি দাস, মণিকা দাস, জাহানারা পারভিন, মলিনা দেবনাথ,রুমা সাহা,আলপনা দেবনাথ,সংগিতা দেওয়ানজি,সুমিতা ধর বসু ঠাকুর,বৃন্দা নাগ।
             নিশ্চয়ই আরো অনেক মহিলা কবি আছেন, যারা দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে কবিতাকে মিশিয়ে রাখছেন, মায়াবী মমতায়। মেয়েদের কবিতা এভাবেই বেঁচে থাকে ঘাত প্রতিঘাতে, মায়া মমতায়, আবেগেপ্রেমে, বিদ্রোহে, বিচ্ছেদে, ভালোবাসায়, নিতান্তই হয়তো মেয়েদের কবিতা হয়ে। কিন্তু সত্যিই  তাই কি? নারী, পুরুষের প্রতি যখন তার বিরূপতা, তার বিক্ষোভ প্রকাশ করেন, তখন তা নারীবাদী কবিতা হয়ে ওঠে, বেশীর ভাগ মহিলা কবিই কবিতা লেখার শুরুতে এ পথেই হাঁটেন, এটা আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত মত। ত্রিপুরার মহিলা কবিরাও তার ব্যতিক্রম নন। তবে পুরুষরা তাদের মত করে জীবনকে দেখেন, আমরা মেয়েরা, আমরার মতো করে, সেই সত্যটাই আমাদের কবিতায় ছাপ ফেলে যায়, তাই এটাই আমার স্বাভাবিক মনে হয়।  নিজেদের কথা  বলার জন্য  কবিতা অবশ্যই একটি  জোড়ালো মাধ্যম।  তবে মহিলা কবিরা যারা লিখছেন ত্রিপুরায় তারা যেন আন্তর্জাল এ আসেন। কোনভাবেই একে অস্বীকার করার উপায় নেই। এভাবেই আমরা এখনের এই সময়ে জানতে পারবো কে কোথায় বসে কি লিখছেন, কি ভাবছেন, তার নতুন সৃষ্টিটি বা নতুন বইটির নাম সম্বন্ধে। আন্তর্জাল সেই অপ্রতিরোধ্য মাধ্যম যাকে আর এড়ানো যাবে না। অবশেষে, বলছিএই অতি ক্ষুদ্র আলোচনায়, আমার অজ্ঞানতার জন্য  ত্রিপুরার বহু উল্লেখযোগ্য, প্রতিভাময়ী নারী কবি নিঃসন্দেহে বাদ গেলেন, তাদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

কোন মন্তব্য নেই: