।। শিবানী দে।।
(C)Imageঃছবি |
কলকাতা বইমেলা
কদিন হল শেষ হয়েছে । মফঃস্বলের বইমেলাগুলোও শেষ প্রায় । সাধারণ পাঠকের বছরকার মত
বইএর ফসল উঠানোর পালাও একরকম সাঙ্গ ।এবারে বিকিকিনির লাভক্ষতির হিসেবের পালা ।
প্রত্যেক বছরের মত এবারও এখানে ওখানে ক্ষোভ শোনা যাচ্ছে---- বাংলা বইয়ের তুলনায়
ইংরাজি বইয়ের বিক্রি বেশি হয়েছে, কাজেই বাংলা বই
বিক্রেতাদের লাভ ইংরাজি বই বিক্রেতাদের তুলনায় কম থেকেছে । অনেক প্রকাশক, লেখক, কিছু পাঠকেরও
ক্ষোভ----বাংলার বুকে হওয়া বইমেলায় কেন বাংলা বইয়ের বিক্রি ইংরাজির চাইতে বেশি হবে
না । ভাষাভাষিক আবেগও খুঁচিয়ে তোলার প্রচেষ্টা চোখে পড়ে ।
কেন বাংলা বইয়ের
বিক্রি কম আর ইংরাজি বইয়ের বেশি ?
ইংরাজি বই মানে
ইংরাজি ভাষায় লিখিত বই, সেগুলো ইংরাজিভাষী দেশগুলো যেমন
ইংল্যান্ড, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বা
অস্ট্রেলিয়ার লেখকদের লিখিত হতে পারে, আবার নাও হতে
পারে । অনেক দেশের লেখক তাঁর মাতৃভাষা ইংরাজি না হলেও ইংরাজিতেই লেখেন । আফ্রিকার
নাইজিরিয়া, কেনিয়া, ঘানা ইত্যাদি
দেশের অনেক লেখক এই গোত্রের । কিছু ভারতীয় লেখকও এই পথের পথিক, যদিও ভারতীয় অনেক
ভাষাই যথেষ্ট সমৃদ্ধ, ঐতিহ্যশালী সাহিত্যসম্পন্ন । হয়তো লেখক ইংরাজিতেই বক্তব্য
প্রকাশ করতে বেশি সুবিধা বোধ করেন, এবং নিজের
বক্তব্য নিজের ভাষার ছোট গণ্ডীর বাইরে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে চান । আজকাল অনেক চিনা, জাপানি লেখকও
ইংরাজিতে লিখছেন ।
পৃথিবীর বিভিন্ন
ভাষায় লিখিত বিখ্যাত সব বই প্রকাশিত হবার অল্পদিনের মধ্যেই ইংরাজিতে অনূদিত হয়ে
প্রকাশিত হয়ে বাজারে আসে, পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে । বেশির ভাগ তর্জমাই
সুখপাঠ্য; উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার অভিবাসী
সংস্কৃতি মূলত ইউরোপভিত্তিক হওয়ায় ইউরোপের সঙ্গে কমবেশি মিল আছে, তাই ভাল
অনুবাদকারীর হাতে মূল বইয়ের স্বাদ গন্ধ খুব একটা বিকৃত হয় না । দুটো ভাষা
সংস্কৃতিতে মিল না থাকলে অনুবাদকালে যথার্থ
প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য । বাংলা মৌলিক রচনাতে সমৃদ্ধ থাকলেও এতে অন্যান্য
ভাষার অনুবাদ খুবই কম, এবং যা কিছু আছে, তাদের অনেকগুলোই
সুখপাঠ্য নয় ।
আমরা সাধারণ
পাঠকরা যারা ইংরাজি ছাড়া অন্য কোনো বিদেশি ভাষা জানি না, অথচ বিদেশি
সাহিত্য সংস্কৃতির খোঁজ নিতে চাই, তাদের ইংরাজির
শরণাপন্ন না হয়ে গত্যন্তর নেই । ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ, পর্তুগিজ, আরবি, তুর্কি, জাপানি চিনা সব
ভাষার সাহিত্যই আসে ইংরাজি অনুবাদে । মায়ের হেঁসেলের রান্না খেয়ে খেয়ে কখনো সকনো
অন্য বাড়ির খাবার চাখতে ইচ্ছে হতেই পারে । কিন্তু অন্যরা যখন অনেক দূর, তাদের সঙ্গে
যোগাযোগ করব কি করে ? ইংরাজি রেস্তোঁরা আমাদের সে স্বাদ গন্ধ
কিছুটা হলেও দেয়, ততটা খাঁটি নাহলেও । আরবি ফারসি তুর্কির ভারি পর্দাদেওয়া
ঘরের ভেতর ও অনূদিত সাহিত্যের জানালা দিয়ে দেখা যায়, জার্মান রাশিয়ান
স্প্যানিশের তো কথাই নেই ।
আমি নিজে এবারে
কিনেছি ইংরাজি মৌলিক রচনা নাইজিরীয় লেখকের, ইংরাজি অনুবাদ
কিনেছি পর্তুগিজ ও আরবি(মিশরীয়) লেখকের, বাংলা কিনেছি
বাংলাদেশি লেখকের । কলকাতা থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন কিনেছি, কিন্তু এছাড়া
বাংলা মৌলিক রচনা আর কিছু কেনা হয়নি । যে ধরণের বই কিনেছি, সেসব বইয়ের
বিজ্ঞাপন থাকে না, বইমেলা ছাড়া এসব বই নেড়েচেড়ে দেখার
সুযোগ পাওয়া যায় না, তাই এসময়েই কিনে নিই । লিটল ম্যাগাজিন
সম্পর্কেও ওই একই কথা । এখানে প্রকাশিত বাংলা মৌলিক বই ও পত্রপত্রিকা স্থানীয়
লাইব্রেরিতে পড়তে পাই, তাই সেগুলো কম কেনা হয় ।
আমাদের মত সাধারণ
পাঠকদের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত, কিন্তু অন্যভাষাভাষীদের হাঁড়ির খবর
জানতে সমুৎসুক হলেই বইপত্রের সম্মুখীন হই। অন্য কোথাও গিয়ে বা অন্য বুলি শিখে ফেলে
সে দেশীয় সংস্কৃতির খোঁজ খবর নেবার মত পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপারে আমাদের ক্ষমতা ও
প্রশ্নযোগ্য । অতএব দেশি লেখক প্রকাশকরা মার্জনা করবেন, তাঁদের ছোট করতে
বা বাংলাভাষাকে যথেষ্ট ভাল না বাসার জন্য ইংরাজির দ্বারে যাওয়া হয় না ।
বাংলাভাষায় বিশ্বসাহিত্যের ভাল অনুবাদ---- শুধু মূলানুগ না, সুখপাঠ্যও----
যদি যথেষ্ট পাওয়া যেত, তাহলে মনে হয় বইমেলায় ইংরাজি বই বিক্রি
কমুক আর না কমুক বাংলা বইয়ের বিক্রি স্বাভাবিকভাবেই বাড়ত ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন