(দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন'- উপন্যাসের বাংলা অনুবাদের ৪র্থ অধ্যায়ের ২য় ভাগ: -- শিবানী দে)
(C)Image:ছবি |
এতদিনে আমি তার
আঙ্গুলগুলো অকেজো হবার কাহিনি জানতে পেরেছি । এটা ছিল ওর সমুদ্রে থাকা কালীন একটা
দুর্ঘটনা । তাদের জাহাজটা পরিত্যাগ করতে হয়েছিল । তাড়াহুড়ো করে নামবার
সময় তার হাতটা একটা পুলিতে আটকে গিয়ে ভেঙ্গে যায় । সারারাত যন্ত্রণাকাতর সে সাতটি
আরও লোক এবং একটি বালকের সঙ্গে ভেলায় ভাসতে থাকে । পরের দিন একটি রাশিয়ান মাছধরা
জাহাজ তাদের দেখতে পেয়ে তুলে নেয় এবং তার হাতের চিকিৎসাও শুরু হয়। কিন্তু ততক্ষণে
অনেক দেরি হয়ে গেছে।
“তুমি কি রাশিয়ান
ভাষা শিখেছিলে ?” আমি জিগ্যেস করলাম ।
যতটুকু তার মনে
আছে, তা হল একটা শব্দ,
‘জরোশো’ ।
“কেউ কি বোরোদিনোর
কথা বলে নি ?”
“আমার মনে হয় না
শুনেছি বলে ।”
“রাশিয়ানদের সঙ্গে
থেকে যাবার কথা ভাব নি ?”
সে অদ্ভুতভাবে
আমার দিকে তাকাল ।
সে তখন থেকে আর
কখনো সমুদ্রে যায় নি ।
“তোমার কি সাগর
থেকে দূরে থাকতে খারাপ লাগে না ?”
সে প্রত্যয়ী
উত্তর করল, “আমি আর কোনোদিন নৌকোয় পা রাখব না ।”
“কেন ?”
“কারণ পরের বার
আমার ভাগ্য আর অত ভাল হবে না ।”
“কিভাবে জানলে ? তোমার যদি নিজের
উপর আস্থা থাকে, তবে তুমি জলের উপর হাঁটতেও পার । তুমি
কি আস্থার উপর কাজ করাতে বিশ্বাস কর না ?”
সে চুপচাপ ।
“অথবা হয়তো একটা
ঘূর্ণিঝড় তোমাকে জল থেকে তুলে নিয়ে শুকনো ডাঙ্গায় বসিয়ে দিল । তারপর ডলফিন তো আছেই
।
ডলফিনরা ডুবন্ত
নাবিকদের উদ্ধার করে, তাই না ? তুমি নাবিক হলে
না কেন ?”
“অতসব আগে থেকে
ভাবা হয় নি । জানতামও না ।”
আমি তার অনামিকাতে বেশ জোরে চিমটি
কাটলাম । তুমি কি অনুভব কর না ?”
“না, নার্ভগুলো মরে
গেছে ।”
আমি সব সময়েই
জানতাম তার একটা গল্প বলার আছে , এবং এখন সে সেটা
বলতে আরম্ভ করেছে এক হাতের আঙ্গুলগুলো দিয়ে । এক নাবিকের কাহিনি । আমি কি তা
বিশ্বাস করি ? আসলে আমি কিছু মনে করি না । এমন কোনো
মিথ্যা নেই যার মূলে কোনো সত্য থাকেনা । শুধুমাত্র শুনতে
জানতে হবে ।
সে অনেক ডকে কাজ
করেছে, মালপত্র উঠানো নামানো এইধরনের
কাজ। বলল, একদিন একটা কাঠের বাক্স উঠাতে গিয়ে তারা একটা কিছু
দুর্গন্ধ পেয়েছিল, খুলে দেখল একটা মানুষের মৃতদেহ , নিশ্চয়ই অবৈধ
যাত্রী, না খেতে পেয়ে লুকোনোর জায়গায়ই মরে গেছে
।
জিগ্যেস করলাম,
“সে কোত্থেকে আসছিল ?”
“চীন, অনেক দূরের
রাস্তা ।”
সে
পশুক্লেশনিবারণী সংস্থায় ও কাজ করেছে, তাদের কুকুর
রাখার জায়গায় ।
“তুমি কি সেখান
থেকেই কুকুর ভালবাসতে শুরু করেছ ?”
“আমি সবসময়েই
কুকুর পছন্দ করি ।”
“যখন তুমি ছোট
ছিলে, তখনো কি কুকুর পুষতে ?”
“ম্ম্,”
সে বলল, যার কিছু মানে হয় না । সে আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিল আমার কোনগুলো প্রশ্ন সে শুনবে, কোনগুলো সে শুনবে
না ।
তা সত্ত্বেও
অল্পে অল্পে এই পৃথিবীতে আরো অনেকের জীবনের মত তারও অখ্যাত জীবনের গল্প আমি একত্র
করলাম । এই বড় বাড়িতে বুড়ি মহিলার সঙ্গে জীবনের অধ্যায় শেষ হলে তার ভাগ্যে কি আছে ? একটা হাত অকেজো, দরকারমত সব কাজ
করতে পারে না । নাবিকের কাজে অবশ্য দরকারি দড়ির গিঁট বাঁধার কাজ সে আর করতে পারবে
না । সূক্ষ্মতা নেই, পরিশীলন নেই । জীবনের মাঝবয়স, পাশে স্ত্রী নেই । একা, ঠিক যেন শূন্যমাঠে একটা লাঠি খাড়া করে
রাখা, একাকী আত্মা । তাকে কে দেখবে ?
“আমি চলে গেলে
তুমি নিজেকে নিয়ে কি করবে ?”
“আমার চলে যাবে ।”
“সে তো নিশ্চিত, কিন্তু তোমার
জীবনে কে আসবে ? ”
সে সাবধানে হাসল
। “জীবনে কি কাউকে দরকার ?”
প্রত্যুত্তর নয়, আসলে প্রশ্ন । সে
জানেনা । সে, এই নিতান্তই অপরিণত লোকটি আমাকে জিগ্যেস
করছে!
“হ্যাঁ, কথাটা যদি পাগলামি
মনে না কর, তোমার স্ত্রী দরকার । এমন কি ঐ যে
স্ত্রীলোকটাকে এখানে নিয়ে এসেছিলে, যদি তার প্রতি
তোমার কোনো অনুভূতি থাকে, তাকেই নিতে পার ।”
সে মাথা নাড়ল ।
“অন্য কিছু ভেবো
না । আমি বিয়ের কথা বলছি না । অন্য কিছুর কথা বলছি । আমি তো ঠিক জানিনা মৃত্যুর
পরে কি সম্ভব হয় । জানলে কথা দিতাম তোমাকে দেখে রাখব । হয়তো কোনো দেখাটেকা হবে না, অথবা খুবই
সামান্য । সমস্ত জায়গারই নিয়ম আছে, এবং ইচ্ছেমত
চাইলেই সেটা না-ও হতে পারে । হয়তো কোনো গোপনীয়তা থাকবে না । গোপনে দেখাও হবে না ।
হৃদয়ে তোমার জন্য বা আর কারো জন্য কোনো সংরক্ষিত স্থানও রাখা যেতে না ও পারে। সব
কিছুই মুছে যেতে পারে । স-ব । এটা বড় ভয়ঙ্কর চিন্তা । বিদ্রোহ
করার পক্ষে, এটা বলার পক্ষে যথেষ্ট যে এরকমই যদি সব
কিছু হয়, তাহলে আমি চলি:
এই যে রইল তোমার টিকিট আমি ফিরিয়ে দিচ্ছি । কিন্তু আমার সন্দেহ আছে যে, যে কোনো কারণেই
হোক, এই ফিরিয়ে দেবার অনুমতিও হবেনা । কিন্তু
এজন্যই তুমি একা হয়ে থাকবেনা । কারণ আমি অনন্ত লোকে চলে যেতে পারি সম্পূর্ণভাবে ।”
সে আমার দিকে পিঠ দিয়ে
বিছানায় বসে ঝুঁকে দু হাঁটুর মধ্যে কুকুরটার মাথাটা নিয়ে আদর করতে লাগল ।
“আমার কথা বুঝেছ ?”
“ম্ম্,”
যার মানে হ্যাঁ –ও হতে পারে, না-ও হতে পারে , কিন্তু আসলে
কিছুই না ।
“না, তুমি বোঝ নি ।
তুমি মোটেই বোঝ নি । তোমার একা থাকার কথাটা আমাকে মোটেই আকর্ষণ করে নি । এটা আমার
নিজের কথা ।”
প্রতিদিন সে
দোকানে যায় । সন্ধেবেলা সে রান্না করে, তারপর আমার
আশেপাশে ঘুরঘুর করে, আমি খাই কিনা দেখে । আমার তো খিদেই পায়
না, কিন্তু তাকে বলতে আমার বাধে । “তুমি দেখতে থাকলে
আমি খেতে পারি না ,” আমি খুব নরম ভাবে বলি, তারপর খাবারটা
কুকুরকে খাওয়াই ।
তার প্রিয় রান্না
হল সাদা রুটি ডিমে ভেজে রুটির উপর টুনা মাছ ও টুনা মাছের উপর টমাটো সস দেওয়া । আমি
এখন ভাবি তাকে যদি অল্পস্বল্প রান্না শেখানোর দূরদৃষ্টি আমার থাকত ।
যদিও সারাটা বাড়ি
তার সামনেই ছড়ানো আছে, সে আসলে আমার সঙ্গে আমার ঘরেই বেশি থাকে
। সে খালি প্যাকেট, পুরোনো মোড়ক মেঝেয় ফেলে । যখন হাওয়া চলে, সেগুলো ঘরের
মধ্যে ভূতের নৃত্য করে । “আবর্জনাগুলো বাইরে নিয়ে ফেল,” আমি অনুরোধ করি ।
সে কথা দেয়, “হ্যাঁ, করব,”
এবং মাঝে মাঝে করেও, কিন্তু পরে ফেলে আরো বেশি ।
আমরা এক বিছানায়
ঘুমোই, একটা পাতা দুভাঁজ করলে যেমন, পাখির দুটো পাখা
যখন ভাঁজ হয়, তেমনি একসঙ্গে : পুরোনো সাথি, বাঙ্কে শোয়া
জাহাজি, একত্র শুয়ে থাকা যমজ, অথবা স্বামী-
স্ত্রী । নববিবাহিতদের বিছানায় যেমন, কখনো মুখোমুখি, কখনো বিপরীত দিকে
মুখ । যখন সে তার জুতো খোলে, তার পায়ের নখগুলো
হলুদ থেকে প্রায় বাদামি, শিং-এর মত । পড়ে যাবার ভয়ে সে পাগুলোকে
জল থেকে দূরে রাখে : গভীরে পড়ে গেলে সে আর শ্বাস নিতে পারবে না । শুকনো জীব, হাওয়ার জীব, শেক্সপিয়ারের
পঙ্গপালের পরীরা যেমন, হাতে ঝিঁঝিঁ পোকার হাড়ের হাতলওলা
মাকড়সার জালের চাবুক *। তাদের বিশাল ঝাঁক
যখন সাগর থেকে উঠে বাতাসে যায়, ভূমির সীমানা
অদৃশ্য হয়ে যায় । যখন ক্লান্ত হয়, তখন একজন
আরেকজনের উপর বসে, আরেক জন তার উপর যেন সঙ্কল্প করেছে
নিজেদের সংখ্যা দিয়ে আট্লাণ্টিককেই ডুবিয়ে দেবে । শেষপর্যন্ত আট্লাণ্টিকই তাদের
গিলে ফেলে । সাগরের উপর তাদের পাখনা বনের পাতার মত ভাসে । লক্ষ লক্ষ মরা মরা চোখ; আর কাঁকড়ারা তার
মধ্য দিয়ে চলে, ধরে, চিবোয় ।
সে নাক ডাকায় ।
তোমার মা তার
ছায়া-স্বামীর পাশ থেকে লিখছে । এই ছবি যদি তোমাকে আঘাত করে, ক্ষমা করো । যে
সব চাইতে কাছে, তাকেই ভালবাসতে হয় । যা হাতের কাছে আছে, তাকেই ভালবাসতে
হয়, যেমন করে কুকুর ভালবাসে ।
মিসেস ভি ।
সেপ্টেম্বর ২৩, বিষুব সংক্রান্তি
। পাহাড়ের গায়ে শক্ত এঁটে থাকা আকাশ থেকে অবিরাম বৃষ্টিপাত হচ্ছে, আকাশকে এত নিচু
মনে হচ্ছে যে একটা ঝাঁটার কাঠি দিয়ে ছোঁয়া যেতে পারে । একটা আরামদায়ক, সব কিছু ছাপানো
শান্ত শব্দ, যেন একটা বিশাল হাত, জলের হাত, বাড়িটাকে মুড়ে
দিচ্ছে ; ছাদের টালির উপরে জলের টুপটাপ, পয়ঃপ্রণালীতে
কলকল, আর কোনো একক আওয়াজ নয় ; বাতাসে মিশে গিয়ে
বাতাস ও ভারি এবং তরল হয়ে গেছে ।
ভারকুয়েইল
জিগ্যেস করল, “এটা কি ?”
তার হাতে একটা
ছোট কব্জাওলা রোজউডের কেস, আলোর দিকে একটু কোনাচে করে খুললে ভেসে
ওঠে একটা লম্বা চুলওলা পুরোনো ফ্যাশনের স্যুট পরা একজন যুবকের ছবি । কোন পাল্টালে, ছবিটা মিলিয়ে গিয়ে
কাচের নিচে কিছু রুপোলি দাগে পরিণত হয় ।
“এটা হল পুরোনো
দিনের একটা ফোটোগ্রাফ, আজকালকার ফোটোগ্রাফের আগের যুগের ।”
“এ কে ?”
“আমি ঠিক জানি না, হয়তো আমার ঠাকুরদার
ছোট ভাই ।”
“তোমার বাড়িটা তো
একটা মিউজিয়ম ।”
(সে সেই
ঘরগুলোতেও ঢুঁ মারছে যেখানে পুলিশ তালা ভেঙ্গে ঢুকেছিল ।)
“মিউজিয়ামে তো সব
জিনিষে লেবেল থাকে । এই মিউজিয়মে সব লেবেল খসে পড়েছে । এটা ধ্বংসের মিউজিয়ম । এটা
হল এমন মিউজিয়ম যার মিউজিয়ম হওয়া উচিত ছিল ।”
“তোমার দরকার না
থাকলে এগুলো বিক্রি করে দেওয়া উচিত ছিল ।”
“বিক্রি করে দাও
যদি তোমার ইচ্ছে করে । আমাকেও বিক্রি করতে পার ।”
“কিসের জন্য ?”
“হাড়ের জন্য ।
চুলের জন্য । আমার দাঁতও বিক্রি করতে পার । যতক্ষণ না মনে কর
আমার আর কোনো মূল্য নেই । গাইফক্স* উৎসবের দিনে গাইকে ঘোরাবার জন্য আগেকার দিনে
একটা ঠেলাগাড়ি নিত । আমার দুঃখ হচ্ছে যে আমাদের কোনো সেরকম
ঠেলাগাড়ি নেই । তাহলে তুমি আমাকে নিয়ে সামনে একটা চিঠি পিন দিয়ে আটকে অ্যাভিন্যু
দিয়ে ঘোরাতে পারতে, তারপর (আমার উপর)আগুন দিতে পারতে । আর
নাহলে তুমি কোনোও অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গিয়ে আবর্জনা ফেলার জায়গায় ফেলে দিয়ে আসতে
পারতে ।”
আগে সে ধূমপান
করার সময় ব্যাল্কনিতে গিয়ে করত । এখন সে
ল্যান্ডিং-এ গিয়ে করে, ফলে সেখান থেকে ধোঁয়া আমার ঘরে চলে আসে
। আমার সহ্য হয় না । কিন্তু এখন, আগে যা সহ্য হত
না, তা সহ্য করার সময় এসে গেছে ।
আমি যখন বেসিনে
আমার অন্তর্বাস কাচছিলাম, সে এল । নিচু হবার জন্য আমার অত্যন্ত
ব্যথা হচ্ছিল, নিঃসন্দেহে আমাকে অত্যন্ত খারাপ
দেখাচ্ছিল । “আমি তোমার এই কাজটা করে দিতে পারব,”
সে সহায়তার জন্য এগিয়ে এল । আমি অস্বীকার করলাম । কিন্তু তারপর আর তারে শুকোতে
দিতে পারছিলাম না । সে সেগুলো মেলে দিল : একজন বুড়ির অন্তর্বাস, ধূসর রঙ, মনোযোগের অযোগ্য
।
ব্যথা যখন খুবই
বেশি ওঠে, আমি কাঁপি, রক্তশূন্য হয়ে
যাই, ঠাণ্ডা ঘাম শরীরে ছুটে, সে আমাকে
মাঝেমাঝে ধরে । তার মুঠির মধ্যে আমি বড়শিবেঁধা মাছের মত ছটফট করি । আমি সচেতন যে
আমার চেহারা তখন আরো বিশ্রী হয়ে যায় । যেভাবে রতিক্রিয়ার চূড়ান্ত মুহূর্তে মানুষের
মুখ বিকৃত ভঙ্গিতে হাঁসফাঁস করে, তেমনি: জান্তব, শিকারীর ভঙ্গী । সে সেই চেহারা পছন্দ করে না । সে চোখ ফেরায় । আমি অন্যদিকে
ভাবতে থাকি, সে দেখুক, জানুক, ব্যাপারটা কিরকম
।
সে তার পকেটে
একটা ছুরি রাখে । সাধারণ ভাঁজকরা ছুরি নয়, বেশ ভয়পাওয়ানো বড়
ব্লেডওলা ছুরি, ধারের দিকটা কর্কের মধ্যে ঢোকানো । যখন
সে বিছানায় শোয়, ছুরিটা মেঝেয় নিজের পাশে রাখে, সেই সঙ্গে নিজের
টাকাও ।
তাই আমি এখন
ভালভাবেই সংরক্ষিত । মৃত্যুও বোধহয় এই
কুকুর ও মানুষকে পেরিয়ে আসতে দুবার ভাববে ।
সে জিগ্যেস করল,
“ল্যাটিন কি ?”
“একটা মৃত ভাষা,”
আমি উত্তর দিলাম, “মরা মানুষের ভাষা ।”
“সত্যি ?”
সে বলল । কথাটা মনে হল তাকে আগ্রহী করল ।
“হ্যাঁ, সত্যি,”
আমি বললাম । “আজকাল শুধুমাত্র ঔর্ধ্বদেহিক কাজেই ব্যবহার হয় ।
ঔর্ধ্বদেহিক কাজে আর পুরোনো মতের বিয়েতে ।”
“তুমি কি ভাষাটা
বলতে পার ?”
আমি ভার্জিল*
থেকে কিছুটা আবৃত্তি করলাম, অশান্ত মৃতদের সম্পর্কে ভার্জিলের
শ্লোক-----
“Nec ripas datur
horrendas et rauca fluenta
Transportare prius quam
sedibus ossa quierunt.
Centum errant annos
volitantque haec litora circum;
Tum demun admissi
stagna exoptata revisunt.”
(সেইসব তরঙ্গিণী
ভয়ঙ্করতমা, প্রচণ্ড কর্কশনাদকারী,
তটে তটে অশান্ত
আত্মারা
অন্ত্যেষ্টিবিহীন
যারা, মৃত অস্থি কবরেতে হয়নি শায়িত,
সেখানে তাদের
ঘোরাফেরা ।
শতবর্ষ ধরে
নদীতটে, নিজেদের দেহাবশেষের সম্মুখেতে
অবিশ্রাম অনর্থক
গতি ;
শতবর্ষ পার হলে
তাহাদের আকাঙ্ক্ষিত শান্তির সায়রে
প্রবেশের পায়
অনুমতি ।
----ভার্জিলের
মহাকাব্য ‘ঈনিড’ ষষ্ঠ সর্গ, বর্তমান
অনুবাদককৃত ভাবানুবাদ, ট্রান্সলেশন ডট কম-এর সাহায্যে ।)
“এর মানে কি ?”
সে বলল ।
“এর মানে হল, যদি তুমি এই
চিঠিটা আমার মেয়েকে না পাঠাও, তাহলে আমি শত
বৎসর দুঃখে কাটাব ।”
“ওটা মানে হবে না
।”
“হ্যাঁ, ওটা হবে । ossa* : ওটা হল
দিনলিপির প্রতিশব্দ ।এমন কিছু যার মধ্যে তোমার প্রতিদিনের জীবন উৎকীর্ণ থাকে ।”
পরে সে আবার এল ।
“আবার সেই ল্যাটিন বল,” সে বলল । আমি
আবার লাইনগুলো বললাম , এবং সে যখন শুনছিল, তার ঠোঁটের
নড়াচড়া লক্ষ্য করছিলাম । ভাবলাম, সে বুঝি মুখস্থ
করছে । কিন্তু তা নয় । ছন্দ তাকে আঘাত
করছিল, ছন্দের শক্তি তার নাড়িতে, স্বরযন্ত্রতে
প্রভাব বিস্তার করছিল ।
“তুমি এসবই পড়াতে ? এটাই তোমার কাজ
ছিল ?”
“হ্যাঁ, এটাই ছিল আমার
কাজ, আমি তা করেই জীবিকা নির্বাহ করতাম, মৃতদের স্বর
দিতাম ।”
“কে তোমাকে বেতন
দিত?”
“করদাতারা, দক্ষিণ আফ্রিকার
মানুষ, ছোট বড় সবাই ।”
“তুমি কি আমাকে
শেখাতে পার ?”
“আমি তোমাকে
শেখাতে পারতাম, আমি তোমাকে রোমান বেশির ভাগ জিনিষ
শেখাতে পারতাম । আমি এখনো তোমাকে শেখাতে পারি, কিন্তু সব কিছুর
জন্য যথেষ্ট সময় হবে না ।”
সে খুশি হল, দেখতে পেলাম ।
“ল্যাটিন তোমার
সহজ লাগবে । তুমি অনেক কিছুই স্মরণ করতে পারবে,” আমি বললাম ।
আমি একটা
চ্যালেঞ্জ নিলাম, ওকে জানালাম যে আমি জানি । আমি হলাম সেই
নারীর মত যার স্বামী লুকিয়ে অন্য প্রেমিকা রেখেছে, তাকে সেই নারী
তিরস্কার করছে, খোলাখুলি সব কথা বলবার জন্য চাপ দিচ্ছে
। কিন্তু আমার ইসারা ইঙ্গিতে কাজ দিল না । সে কোনো কিছু লুকোচ্ছে না । তার অজ্ঞতা
বাস্তব । তার অজ্ঞতা, তার সরলতা ।
আমি বললাম,
“তুমি কিছু মনে করতে পারছ না, এরকম কিছু নয় তো ? তুমি কিছু বলতে
থাক এবং দেখ, শব্দ তোমাকে কোথায় নিয়ে যায় ।”
কিন্ত সে চৌকাঠে
দাঁড়িয়ে আছে, পেরোতে পারছে না । সে দাঁড়াল, ইতস্তত করল, বাক্যহীন,সিগারেটের ধোঁয়ার
আড়ালে লুকিয়ে থেকে, চোখ সরু করে থাকল যাতে আমি তার ভেতরটা
দেখতে না পারি ।
কুকুরটা তার
চারপাশে ঘুরে আমার কাছে এল, অস্থিরভাবে আবার চলে গেল ।এটা কি সম্ভব
যে কুকুরটাই প্রেরিত, সে নয় ?
আমি ধরে নিচ্ছি
যে তুমি ওকে কখনো দেখতে পাবে না । আমি ওর একটা ছবি তোমাকে পাঠাতে পারলে খুশি হতাম, কিন্তু আমার
ক্যামেরা আগের বারে চুরির সময় চোরের হাতে গেছে । যাই হোক, তার ফোটো ভাল
আসার মত নয় । আমি পরিচয়পত্রে তার ছবি দেখেছি । তাকে
দেখতে মনে হয় কোনো অন্ধকার সেল থেকে পালানো বন্দি, যাকে উজ্জ্বল
আলোকিত কোনো ঘরে দেওয়ালে ঠেসে দাঁড় করানো হয়েছে এবং চুপ করে দাঁড়াতে বলা হচ্ছে
চিৎকার করে । তার ছবি তার অনিচ্ছাসহকারে জোর করে তোলা হচ্ছে, যেন বলাৎকার করা
হচ্ছে । সে হল একটা আধাপৌরাণিক জীবের মত, যা ছবিতে ঝাপসা
আসে, ঝোপঝাড়ের ভেতরে অন্তর্হিত হতে থাকা
মানুষ বা জন্তুও হতে পারে, ফোটো ফিল্মের উপরে একটা বিচ্ছিরি দাগ, যার উপস্থিতি
অপ্রমাণিত, সাক্ষ্যহীন । অথবা ফ্রেমের ধারে ক্রমশ
পালিয়ে যাওয়া, ছবি তোলার সময়ে ক্লিক করার সময় হয়তো
একটা হাত, একটা পা, কিংবা মাথার
পেছনের ছবি উঠে গেছে ।
আমি তাকে জিগ্যেস
করলাম, “তুমি আমেরিকা যেতে চাও?”
“কেন ?”
“আমার চিঠিটা নিয়ে
যেতে । ডাকঘরে না ফেলে, তুমি নিজের হাতে নিয়ে দিতে পার ।
আমেরিকা ঊড়ে যাবে, উড়ে আসবে । একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে ।
জাহাজে ঘোরার চাইতে ভাল । আমার মেয়ে তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, তোমাকে দেখাশোনা
করবে । আমি আগেই টিকিট কেটে রাখব । যাবে ?”
সে সাহসীমুখ করে
হাসল । কিন্তু আমার মজার কিছুটা একটা ঘায়ে আঘাত দিল, মনে হল ।
আমি বললাম,
“আমি মজা করছি না ।”
কিন্তু কথাটা হল, এটা সিরিয়াস প্রস্তাব
ছিল না । ভারকুয়েইল সুন্দরভাবে চুল কাটা, দোকানের পোষাক
পরা, তোমার অতিথি থাকার ঘরে বিছানায় শুয়ে মদ
খাবার জন্য অস্থির, কিন্তু লজ্জায় কিছু বলতে ও পারছে না :
আর তুমি পাশের ঘরে, তোমার ছেলেরা ঘুমিয়ে, তোমার স্বামী
ঘুমিয়ে, চিঠিটা, এই স্বীকারোক্তি, এই পাগলামি পড়ছ, এসব চিন্তাও করা
যায় না। তুমি দাঁত চেপে বলছ, আমার এসবের দরকার
নেই । তুমি দাঁত চেপে বলছ, আমার এসবের দরকার নেই । আমি এইসব থেকে
দূরে থাকার জন্য এখানে চলে এসেছি , এখনও কেন এসব
আমার পেছন পেছন আসছে ?
আমার হাতে এখন
প্রচুর সময়, তাই আমেরিকা থেকে তুমি যেসব ছবি পাঠাও
বছরের পর বছর, সেই সব দেখি, ছবি তোলার জন্য
যখন তুমি বোতাম টেপ, সেই মুহূর্তে ফ্রেমের পশ্চাৎপটে যেসব
ছোটোখাটো জিনিষ ধরা পড়ে, সেসবে মনোযোগ দিই । উদাহরণস্বরূপ, তোমার ছেলেদের
ক্যানোতে চড়া যে ফোটো পাঠিয়েছ, সেটাতে আমার চোখ
ওদের মুখ থেকে হ্রদের তরঙ্গের উপর, ফার গাছের ঘন
সবুজের উপর, তারপর আবার ফিরে আসে ওদের পরনের কমলা রঙয়ের লাইফজ্যাকেটের
উপর, ঠিক যেন পুরোনো দিনের জলপাখনা । এগুলোর
উপরিভাগের অনুজ্জ্বল মেটে রঙ আমাকে প্রায় মন্ত্রমুগ্ধ করে । রবার, প্লাস্টিক বা আরো
কিছু, যা স্পর্শ করলে কর্কশ, শক্ত লাগে, সেরকম কিছু
মাঝখানে আছে । এই যে বস্তুটা যা আমার অপরিচিত, হয়তো সব মানুষের
কাছেই অপরিচিত, তা মাপমত কেটে, বন্ধ করে ফুলিয়ে
তোমার ছেলেদের গায়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে, আমার কাছে তা কেন
তুমি এখন যে জগতে বাস করছ, তারই প্রতীক হিসেবে মনে হয়, এবং কেন তা আমার
মনকে হতাশায় ডুবিয়ে দেয় ? আমি জানি না । কিন্তু যেহেতু এই লেখা
আমাকে যখন তখন যেখানের সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই সেখান থেকে এমন জায়গায় নিয়ে
আসে যেখান থেকে আমার ধারণা পাওয়া শুরু হয়ে যায়, তখন সমস্ত
অনিশ্চয়তা মাথায় রেখেই বলি, যে তোমার ছেলেরা কখনো ডুববে না এই কথাটা
আমাকে নিরুৎসাহিত করে তোলে । ওই সব হ্রদগুলো, ওই সব জল : হ্রদ
ও জলের দেশ : তবুও ঘটনাক্রমে তারা যদি ক্যানো থেকে কখনো
পড়ে যায়, তারা নিরাপদে জলের উপরে ভাসবে তাদের
কমলা পাখার সাহায্যে, যতক্ষণ না একটা মোটর বোট এসে তাদের
উঠিয়ে নিয়ে যায়, এবং তারপর সব ঠিকঠাক ।
ফোটোগ্রাফটির
পেছনে তুমি লিখে দিয়েছ এটা একটা বিনোদনের জায়গা । হ্রদ, জঙ্গল, সব পোষ মানানো, নতুন নামকরণ করা
।
তুমি বলেছ তুমি
আর বাচ্চা নেবে না । তাহলে আমেরিকার বরফে পোঁতা বীজের থেকে হওয়া এই দুটো ছেলের
মধ্যে বংশধারা বইবে, যারা কখনো ডুববে না, যাদের সম্ভাব্য
গড় আয়ুষ্কাল পঁচাত্তর বৎসর এবং বেশি । এমন কি আমি, যে এমন দেশে
বসবাস করছি যেখানে জল একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষকেও গ্রাস করে ফেলে, যেখানে গড়
আয়ুষ্কাল বছরে বছরে কমে যায়, তেমন কোনো
অভিজ্ঞতার আলোক ছাড়াই মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছি । জীবনের উত্থানপতন দেখার সুযোগহীন ওই
দুটো ছেলে, যারা তাদের প্রমোদক্ষেত্রে নৌকো বাইছে, তারা কি আশা করতে
পারে । তারা পঁচাত্তর কিংবা পঁচাশি বছর বয়সেও যেরকম বোকা জন্মেছিল, সেইরকম বোকা
থেকেই মরে যাবে ।
আমি কি আমার
দৌহিত্রদের মৃত্যুকামনা করছি ? তুমি এই ক্ষণে
ঘৃণায় পাতা ছুঁড়ে ফেলেছ? “পাগল বুড়ি!” বলে চিৎকার করছ ?
ওরা আমার দৌহিত্র
নয় । সন্তান বা ওরকম কিছু হবার পক্ষে ওরা অনেক বেশি দূরত্বে । আমার পরিবারে বেশি
সদস্য নেই । একটি কন্যা; একজন সঙ্গী, এবং তার কুকুর ।
আমি কোনো ভাবেই
তাদের মৃত্যু চাই না । ছেলেদুটো, যাদের জীবনে কোনোরকমে
আমার জীবনে ঘেঁষে গেছে, তারা ইতিপূর্বেই মৃত । না, আমি তোমার
বাচ্চাদের জীবন চাই । কিন্তু যে পাখা তুমি তাদের বেঁধেছ, তা জীবনকে
বাঁচাতে পারবে না । জীবন হল পায়ের আঙ্গুলের ধুলো । জীবন হল দাঁতের মধ্যকার বালি ।
জীবন হল ধুলো কামড়ে থাকা ।
অথবা জীবন হল
ডুবতে থাকা । জলে পড়ে গিয়ে তলায় পৌছোনো ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন