(দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন'- উপন্যাসের বাংলা অনুবাদের ৪র্থ অধ্যায়ের ৩য় ভাগ। এই সঙ্গে উপন্যাসটি এখানেই শেষ হলো : -- শিবানী দে)
(C)Image:ছবি |
*
* * * *
সময় প্রায় এসে
গেছে যখন খুব নিজস্ব কাজের জন্যেও আমাকে অন্যের উপর নির্ভর করতে হবে । এই
দুঃখকাহিনি সমাপ্ত করার ও তাহলে ও উপযুক্ত সময় । এটা নয় যে আমি সন্দেহ করি
ভারকুয়েইল সহায়তা করবে না । যখন শেষ সময়ের কথা হচ্ছে, তখন আমি তাকে
কোনোভাবেই সন্দেহ করি না । তার মধ্যে সব সময়েই আমার জন্য একটা উড়ুউড়ু ভাবের
অনির্ভরযোগ্য উদ্বেগ ছিল, তার সেই উদ্বেগ সে প্রকাশ করতেও জানে না
। আমি পড়ে গেছি, সে আমাকে ধরেছে । এখন আমি বুঝতে পারি যে
সে যখন প্রথম এসেছিল, তখন সে আমার হাতে দেখাশোনার জন্য পড়েনি, আমিও তার হাতে
দেখাশোনার জন্য পড়িনি । অথবা আমরা দুজন দুজনের হাতে পড়েছি, সেই পারস্পরিক
নির্বাচন অনেক হোঁচট খেয়েছে, কখনো উপরে উড়েছে, কখনো গোত্তা খেয়ে
মাটিতে নেমে এসেছে ।
তবুও সে কোন
শুশ্রূষাকারী বা পরিপোষক হতে পারে এ ভাবাই যায় না । সে হল শুষ্ক; তার পানীয় জল নয়, আগুন । সম্ভবত
এজন্যই আমি কখনো কল্পনা করতে পারিনা তার কোনো সন্তান থাকতে পারে । তার শুক্র হবে
শুকনো এবং বাদামি, রেণুর মত, এদেশের ধুলোর মত
।
তার উপস্থিতি, তার সাহায্য আমার
চাই, কিন্তু সেও আমার সাহায্য চায় । কোনো
নারী পুরুষকে যে সহায়তা দিতে পারে, সেরকম সাহায্য সে
চায় । কোনো মন ভুলিয়ে তুলে নেওয়া নয়, বরং মনোযোগ
দেওয়াতে সাহায্য। সে ভালবাসতেও জানে না । আমি কোনো মনের ওঠাপড়ার কথা বলছি না, সবল দৈহিক
ভালবাসার কথাই বলছি । সে একটা বাচ্চা ছেলের মত ভালবাসার ব্যাপারে আনাড়ি । জিপ, বোতাম বা
ক্লাস্পের কি ভূমিকা সে জানে না । কোন জিনিষ কোথায় যায় সে জানেনা । যা করতে হবে তা
কি করে করতে হয় তা সে জানেনা ।
আমার দিন যত
ঘনিয়ে আসছে, সে ততই বিশ্বস্ত হচ্ছে । তবুও আমাকে তার
হাত ধরে দেখাতে হচ্ছে ।
আমার মনে পড়ে সেই
দিনটা যখন আমরা গাড়িতে বসেছিলাম, সে দেশলাই ধরে
আমাকে বলেছিল, “ওটা কর ।” ক্রোধে বিস্ময়ে
আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম । কিন্তু আমি কি তাকে ঠিক বিচার করেছিলাম ? এখন আমার মনে হয়
মৃত্যু সম্পর্কে তার কোনোও ধারণা নেই, যেভাবে কোনো
কুমারীর যৌনতা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই । কিন্তু কৌতূহল একই রকম । যেমন একটা কুকুর
তার মনিবের দুপায়ের সন্ধিতে শুঁকে, ল্যাজ নাড়ায়, পুরুষাঙ্গের মত
লাল এবং বোকাবোকা তার জিভ বাইরে ঝোলে ।
গতকাল যখন সে
আমাকে চান করতে সাহায্য করছিল, আমার স্নানের
জামাটা খসে পড়েছিল, সে তাকিয়ে দেখছিল । যেন মিল স্ট্রিটের
ভবঘুরে বাচ্চা, যাদের মধ্যে শিষ্টাচারের লেশটুকুও নেই ।
শিষ্টাচার: ব্যাখ্যার অযোগ্য, সমস্ত
নীতিশিক্ষার ভিত্তি । আমরা কি কি করি না । যখন আত্মা শরীর ছেড়ে যায়, তখন আমরা তাকিয়ে
থাকি না, আমাদের চোখ জলে আবৃত হয়ে যায়, অথবা হাত দিয়ে
চোখ ঢাকি । আমরা আঘাত পাওয়া জায়গার দিকে তাকিয়ে থাকি না, কারণ সেইসব
জায়গায় আত্মা বেরিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করেছিল, তারপর জোর করে
রাখা হয়েছে, আঘাতটা বন্ধ করে, সেলাই করে জুড়ে
দেওয়া হয়েছে ।
আমি জিগ্যেস
করেছিলাম, সে বেড়ালগুলোকে খাওয়াচ্ছে কি না । সে
মিথ্যে করে বলল, “হ্যাঁ ।” কারণ বেড়ালগুলো
কুকুরের জন্য পালিয়েছে । আমি কি আর ভাবি ? না, আর নয় । আমি
তোমাকে দেখাশোনা করেছিলাম, তারপর ওকে, আমার হৃদয়ে আর
বিশেষ জায়গা নেই । বাকি যা কিছু আছে, ওই যে লোকে বলে
না, ‘ভাঁড় মে জায়ে’* ।
গতকাল রাতে ভীষণ
ঠাণ্ডা লাগছিল । আমি তোমাকে বিদায় জানাতে আহ্বান করতে
চেয়েছিলাম । কিন্তু তুমি এলে না । আমি তোমার নাম উচ্চারণ করলাম, ফিসফিস করে,
“আমার মেয়ে, আমার সন্তান,”
আমি অন্ধকারে বললাম, কিন্তু আমার সামনে যা এলো তা হল একটা
ফোটোগ্রাফ: তোমার একটা ছবি, তুমি নও । যখন আমি ঠাণ্ডা হয়ে যাই, হয়তো তখন শরীর
থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সাগরপারে যাবার জন্য আমি আহূত হই, জানি না ।
দেখছ তো, আমি এখনও তোমার
ভালবাসায় বিশ্বাস করি ।
আমি শিগ্গিরই এই
কথার রজ্জু থেকে তোমাকে মুক্ত করে দিচ্ছি । আমার জন্য দুঃখিত হবার কোনো প্রয়োজন
নেই । কিন্তু এই লোকটা, যাকে আমি রেখে যাচ্ছি, যে সাঁতার জানে না, যে এখনো উড়তেও
শেখেনি, তার জন্য তোমার চিন্তায় একটুখানি স্থান
রেখো ।
আমি ঘুমিয়ে যখন
জাগলাম, তখন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা : আমার পেট, হৃদ্পিণ্ড, শরীরের হাড় অবধি ঠাণ্ডা
। ব্যালকনির দিকের দরজাটা খোলা, বাতাসে পর্দা
উড়ছিল ।
ভারকুয়েইল
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সাগরের মত ঝরা পাতার আন্দোলন একদৃষ্টে দেখছিল
। আমি তার হাত, তার উঁচু খোঁচা খোঁচা কাঁধগুলো, হাড় বের করা
মেরুদণ্ড স্পর্শ করলাম । ঠকঠক করা দাঁতে জিগ্যেস করলাম,
“কি দেখছ ?”
সে উত্তর দিল না
। আমি আরো কাছে গেলাম । আমাদের নিচে ছায়ার সাগর, পাতার আচ্ছাদন
নড়ছে, মর্মর শব্দ করছে, যেন অন্ধকারের
শরীরের আঁশ ।
“সময় হয়েছে ?”
আমি বললাম ।
আমি বিছানায় ফিরে
গেলাম, দুটো শীতল চাদরের সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকলাম
। পর্দা বিভক্ত হল, সে আমার পাশে এলো । এই প্রথমবারের মত
আমি কোনও গন্ধ পেলাম না । সে আমাকে তার দুবাহুতে তুলে প্রচণ্ড জোরে চেপে ধরল, যাতে আমার শ্বাস
ঝটিতি নির্গত হয়ে যায় । তার সেই আলিঙ্গন থেকে কোনো উষ্ণতা পাবার ছিল না ।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------
তারাচিহ্নিত
শব্দগুলোর তাৎপর্য :
আফ্রোদিতি (Aphrodite): গ্রিক পুরাণের
অনুসারে প্রেম ও প্রমোদের দেবী । সাধারণত: দেবীমূর্তির শরীরের ঊর্ধ্বাংশ অনাবৃত
থাকে ।
ম্যান্ড্রাগোরা(mandragora) : বিষাক্ত গুল্ম
বিশেষ, এর থেকে ব্যথানাশক ও ঘুমপাড়ানোর ওষুধ
তৈরি হয় ।
শাফ্ল্(shaffle) : পা মেঝেয় ঘষটে
নাচবিশেষ ।
হ্যালুসিনেশন(hallucination) : দৃষ্টিবিভ্রম
(সাধারণত: শারীরিক অসুস্থতার কারণে বা বিশেষ ওষুধ বা মাদক সেবনের ফলে) ।
ট্রিস্টান(Tristan) : মধ্যযুগীয়
ইউরোপীয় সাহিত্যে অন্যতম জনপ্রিয় রোম্যাণ্টিক নায়ক ।
গাই ফক্স(Guy Fawkes) : (১৫৭০---১৬০৬)
ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসকে হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম । গাই-এর
উপর সিংহাসনের নিচে বারুদ রাখার দায়িত্ব ছিল ।কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা ধরা পড়ে ও
তাদের ফাঁসির সাজা হয় । গাই ফক্স্কে যখন ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য দড়ি পরানো হচ্ছিল, তখন দৈবাৎ পড়ে
গিয়ে তার ঘাড় ভেঙ্গে মৃত্যু হয় । সেই থেকে ৫ নভেম্বর ‘গাই ফক্সের রাত’ উৎসবে পরিণত
হয়েছে । পুরোনো কাপড় ও খবরের কাগজ ও মুখোস দিয়ে ফক্সের পুতুল বানিয়ে শোভাযাত্রা
করে নিয়ে এসে কোনো খোলা জায়গায় কাঠকুটো জড়ো করে সেই পুতুল পোড়ানো হয় । বিশেষ করে অল্পবয়সী
ছেলেমেয়েরাই এতে অংশ নেয় ।
ভার্জিল(Virgil) : রোমান মহাকবি, ইতালির মাতুয়া
শহরের কাছে ৭০খৃষ্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেন, মৃত্যু ১৯
খৃষ্টপূর্বাব্দে । এঁর রচিত ‘ইনিড’ প্রাচীনকাল থেকেই ইতালির
জাতীয় মহাকাব্য ।
Ossa : ল্যাটিন
শব্দটির অর্থ অস্থি । মিসেস কারেন বলছেন দিনলিপি, হয়তো এই কারণে যে
অস্থির মধ্যেই মানবশরীরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ থাকে ।
ভাঁড় মে জায়ে :
হিন্দি প্রবাদ । উপন্যাসে আছে go to the pot, এর জুতসই বাংলা
অনুবাদ করতে না পেরে হিন্দির সাহায্য নিলাম ।
--------------------------------------------------------------------------------------------
শেষ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন