(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের
প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো
লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি
শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ
উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয়
দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে
আসছে। আজ তার উজান পর্বের তৃতীয় অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
তিন
বৈতলের নতুন
শিকড় যত বাড়ে দুর্গাবতীকেও তত আঁকড়ে ধরে । দুর্গার সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে তার অতীত ।
তার জন্মভূমি, জন্মজল আর
জন্মবাতাসের অভিজ্ঞান । সুখের সময় সে অতীত রোমন্থন করে দুর্গার সঙ্গে নীরব থেকে ।
চৌকির উপর
গল্লাবেতের চাটাই, আর একদিকে গোল করে রাখা ঘুমের সরঞ্জাম । তিনজনের বিছানা ।
প্রধান ঘুমের জন্য গুটিয়ে রাখা । গোটানো বিছানায় পিঠ দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বৈতল
দুর্গাবতীকে বলে,
--- একটা
পান দেও । একটু সাদার গুড়া দিও ।
মনেপড়ে যায়
রইদপুয়ানি গ্রাম । আর এক ফিঙ্গে পাখির কথা । একদিনের রাজা বৈতলকে একা বাড়িতে
খাওয়ায় বিয়ানিবাজারের পেচকুন্দা । বৈতলের গুরুকন্যা চামেলি । সেদিনও বৈতল চায়নাকে
বলে,
--- একটা
পান দিও । একটু সাদার গুড়া দিও ।
সাদার গুড়ো
দিয়ে পান দেয় চায়না । সব কিছু দিতে চায় । বৈতল নিতে পারে না । পালায় গুরুর বাড়ি
থেকে । দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, কত বছর যে পার হয়ে যায় পালাতে পালাতে ।
দুর্গার
বিছানায় কাত বৈতলের কপালে আর পান জোটে না । দুর্গা বলে,
--- পান
আনছনি । খালি সাদার গুড়া খাও । নাইলে যাও, ভোলার দোকান থাকি কিনিয়া আনো ।
--- অখন অত
রাইত যাইতাম নি । কুনু কামর ভাগ নাই বেটি । একটু পানও রাখছ না বাড়িত ।
--- রাইতর
টিপ মারাত যাইবায় তো জানি । লইয়া আইবায় পানপট্টি থাকি ।
--- না আইজ
সব হল বন্দ ।
--- কেনে ।
---
গোলদিঘীত বুলে পানি নাই । বিজলি দিত পারত নায় । তিনদিন থাকি ভটভটি চালাইয়া সিনেমা
দেকার । আর পারত নায় ।
--- তে, তুমি পান
খাইতায় অউ, নানি
---
খাওইয়াইবায় নি ।
--- দেখি, হি বাড়ি
থাকি আনি দিমু ।
--- না ।
মরাবাঘের
মুখ দেখে বৈতল আবার । মৃত জন্তুর মুখেও হিংস্রতা দেখে । হিংসা, নাকি
মানুষজাতির প্রতি ক্রোধ । ওরকমই এক ক্রোধের প্রতিফলন হয় বৈতলের মুখে । জমিদারের
প্রতি আক্রোশ থেকেই হয় প্রতিবাদ । দুর্গাবতীও বুঝতে পারে অসাবধানতা । কথা ঘুরিয়ে
নিয়ে যায় বৈতলের স্বপ্নে । বলে,
--- বাদ দেও
তে । আইচ্ছা কও চাইন তুমি ঠিক কুনখানো দেখছ মাটি ।
এবার সত্যি
কথাই বলে বৈতল ।
---
মধুরামুখো । তুমি তো গেছ ।
--- গেছি
নানি । বারুণির মেলাত গেছি ।
মনের সুখে
গোটানো বিছানায় শুয়ে পা দোলায় বৈতল । চাটাইএ গল্লাবেতের চোখ খুঁটতে খুঁটতে
দুর্গাকে প্রশ্ন করে আচমকা । বলে,
--- আইচ্ছা
কও চাইন, আমার অউ হাটুর লাখান নায় নি নদী হিখানো ।
--- কুনখানো
। নদীর আর হাটু কিতা । নদী কুনু তোমার মতো লেংটা বেটানি । তফন সামলাইয়া পরতায় পার
না । পুড়িয়ে নু দেখব ।
--- অ, আমার লগে
মশকরা কররায় বেটি । আইচ্ছা বাদ দেও, হাটুউটু সবে বুঝত নায় । দুখু ইগুরে আমার বুজানি লাগব । খুব
বরফুটাঙ্গি হালার হালার । সব বেশি বুঝে ।
পরদিনই বৈতল
বন্ধুমহলে ঘোষণা করে বরাক নদীর বাঁধের আকৃতি গুলতির মতো । বলে,
--- আমার
গুলাইলর কনইর মতো ।
দুখু ছাড়া
বাকি দুজন, আপদ ও বছই, হাত চুলকে পা চুলকে মাথা চুলকে ভাবে । কুচকিতে লুঙ্গি ঘষতে
ঘষতে মেনেও নেয় । দুখু মানে না । দুখু দেখে অন্যরকম । দুখুর পছন্দ নয় সবকিছুতে
বৈতলের ওস্তাদি । তাই উল্টো কথা বলে,
--- গুলাইল
দেখলে কই । গুলাইল অইলে খালি বাট থাকে নি, গুল্লি ইগু যাইত কই ।
--- গুল্লি
নু আমি । বেশি মাতলে নাক বরাবর লামব গিয়া । তখন কইছ না বৈতলে মারে ।
--- তুইন
আমারে বছই পাইচছ নি । খালি মারতে । গালি ফালাই দিমু তর ইও । তে হুন, গুলাইল
উলাইল কিছু নায় । বান্দ অইল খুরাদিল বাটির লাখান, ঘুরিঘুরি
আইছে । মালগুদামো গিয়া মিলাই গেছে ।
--- অই বেটা
আউয়া । বাটি অইল গুল, নদী কুনু গুল নি । নদী কুনু পুকুইর নি ।
--- অ
পুঙ্গির ভাই । বান্দর কথা কইরে, ইখানো নদী আর পুকইর ঢুকাইয়া পেক কররে কেনে । আর গুল না অইলে
কিতা অইছে, কথার কথাত অতো পেছ ধরণ লাগে না । মনর মিল থাকলেউ অইল ।
--- তোর লগে
আমার কিতা মনর মিল । তুই কাছাড়ি বাঙাল, আমি হিন্দু, আমি রিফুজি । তরে আমি দেখতাম পারি না, যা । তোর তো
পছন নায় আমার গুলাইল, যা , তোর বাটিরও কালাই উঠি গেছে, আমার পছন
নায় । অউত্ত মাত শেষ ।
--- শেষ অইত
কেনে, বুঝাইয়া ক ।
--- তুই
অইলে শিবর ষাড়, করমচান্দে ছাড়ছে যেগুরে জানিগইঞ্জো, তুই কিচ্ছু
বুঝতে নায় ।
--- কছ না, কইলে বুঝতাম
না কেনে ।
--- কইতাম
নি ।
--- কছনা বে
হালার হালা ।
--- কওয়াইলে
তো কইতাম ।
--- ও তরে
কওয়ানি লাগব । গাইঞ্জা খাইতে । ইতা তো আমি পারতাম নায় ।
--- তুই
বেটা হারামজাদা, তোরে আমি চিনি । ডুব দিয়া পানি খাছ, হারাদিন
রোজা রছ । খাছ না ঠিক আছে, আনাইবে নি ।
--- আইচ্ছা, অইব নে বে
পেরত । অখন ক কিতা কইরে ।
--- না, কইয়ার ‘ শিবো হে’ কইয়া
গাইঞ্জার চিলিমো টান দেয় দেখচছনি বছই আর আপদে ।
--- না ।
ইতা তুইন কছ । মুসলমানে কুনুদিন শিবরে ডাকে না ।
--- কেনে
ডাকলে কিতা অইব । কাটা ইগু জুড়ি যাইব নি । ঠিক আছে যা, আমি অউ কই ।
আমি অউ ভালা ডাকি শিবরে । শিবর মাথাত দেখচছ নি এক তেড়া চান্দ ।
--- দেখছি ।
অন্নপূর্ণা মন্দিরো চুনকাম করছিলাম একবার । তখন দেখছি সাদা পাথরর মূর্তি । মাথাত
চান্দর টুকরা ।
---
পাকিস্তানের ঝান্ডা দেখচছনি ।
--- চান্দ
তেরা ।
---
বাক্কাউতো, পাকিস্তানর নাম হুনিয়াউ ফালাইরে ।
--- হুনছি
তো । তুইন কইচছ । তুইন অতো পাকিস্তান তনে আইচছ ।
--- আইছিতে
কিতা, আমি অখন পাকিস্তানি নি । তুইতো হালার হালা গদ্দার । তোর
বাড়িত আছে ঝাণ্ডা, আমি জানি । মাইনষে কয়, তুই উঠাছ চান্দতেরা ।
--- মাইনষে
কইলে আমার ইও নি । পাকিস্তান অইলে মাইনষর ভালা অইল নে । শরিয়তি মতে চলল নে সব ।
মালাউন হকলরে কলমা পড়াইলাম নে । তোর লাখান রিফুজিয়ে লাম্বা মাত মাত্ত পারল না নে
। দেখছি, ঝাণ্ডা আমি গাড়মউ একদিন । অখন ক, শেষ কর কথা
।
--- না, আর কিচ্ছু
না ।
--- অউত্ত
গুসা অই গেলে হালার হালা । মাইনষর মাত হুনিয়া নাচচ কেনে । তুইন দেখচছ নি আমারে ।
--- দেখছি
না । সবে কয় । তুইও চুপ মারি থাকছ ।
--- তে চুপ
যা । জানছ নানি বোবার শত্রু নাই । চুপ করি থাকা উ ভালা । আর সাফ
কথা হুনিলা, আমার নদী, আমার বান্দ যে লাখান অলাখান অউ । সুন্দর অইলে সুন্দর, বান্দর অইলে
বান্দর, তোর কিতা । তুইন বেটা রিফুজি, যতদিন থাকতে
চাইবে দিমু, থাকবে । তুইন অইলে কুলির বাদাত কাউয়ার ছাও । থাকলে থাক, নাইলে ভাগ ।
দুখু ইচ্ছে
করে বেতলকে রাগিয়ে দেয় । বৈতলেরও নাকের ডগায় গোফ । তৎক্ষণাৎ রাগে সব ভস্ম করে ।
বৈতলের সেই গুলতি ছোঁড়া রাগের সময় চুপ করে থাকে দুখু । শুধু মুচকি হাসি দিয়ে
তাতিয়ে দেয় বন্ধুকে । দুখু কম কথার মানুষ । বেশিক্ষণ বকতে পারে না । নাগাড়ে কথা
বলে চপু মেরে যায় । কিন্তু যতটুকু বলে তাতেই হাড় জ্বলে বৈতলের । মহাশূন্যে আগুন
লাগার পর যখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে তখন বৈতলও হাসে । বন্ধুত্বের মজা উপভোগ করে ।
বুঝতে পারে বন্ধুত্ব শুধু হ্যাঁতে হ্যাঁ মেলানো নয় । রাখঢাক না রেখে মনের কথা বলাও
দোস্তি ।
দুখু বছই
আপদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বন্ধুত্বের সংজ্ঞা নতুন করে শিখেছে বৈতল । বুঝেছে
বইয়াখাউরি যা পারে নি, মিরতিঙ্গা পারে নি, খিত্তাগাউ বা রইদপুয়ানিও যা দিতে পারে নি তাকে, তাই দিয়েছে
তেড়া বেড়া এক নদীর পার । সুরমা থেকে ভেসে আসা ভোরার অস্তিত্ব এখন আর কোথাও নেই ।
কিন্তু সেই উজান ডিঙায় বয়ে আনা বিশ্বাস ছড়িয়ে গেছে নতুন দেশে । লুলার মৃত্যুর পর
উদ্ভ্রান্ত বৈতল অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছে কিছুকাল । দুর্গাবতী পারেনি তার ক্ষতে
নিরাময় দিতে । আগলখোলা বন্ধুত্বের হাওয়ায় শুধু বাড়তে থাকে বৈতলের নতুন শিকর ।
ফনফনিয়ে বাড়ে মিতালির চারাগাছ ।
মিত্রতার
কড়ামিঠে সম্পর্কেই পরিমিতি বোধ তৈরি হয় । তাই ওদের এত
টান । কেউ কাউকে বলে দেয় না সংকেত স্থান, তবু মিলিত হয় । বৈতল ছাড়া তিনজনেরই স্বদেশ কাছাড় জেলা ।
নতুন দেশে, নতুন জেলায় বৈতলের পরিচয় উদ্বাস্তু, রিফ্যুজি ।
ওদের তিনজন মুসলমান আর বৈতল একজন হিন্দু । তবু ওদের অস্তিত্ব নিয়ে কোনও সংশয় নেই ।
তাই বন্ধুত্ব ছাড়া ওদের দেশ নাই । নদী ছাড়া প্রিয়জন নেই । এক বস্তনি ছাড়া ওরা
কোথাও কিছু লুকিয়ে রাখে না । বস্তুনিতে থাকে নেশার সামগ্রী । দুখুমিয়ার কোনও নেশা
নেই, আবার দুখুরই তত্ত্বাবধানে সংগঠিত হয় ওদের ধোঁয়ার মজলিশ । আর বৈতলও
নতুন নদীর পারে, নবীন বন্ধুত্বের পরশে পরম সুখে তার শেখড়ে দেয় নেশাধুমের ওম
। আর তাই, জীবনের এই অধ্যায়কে উপভোগ্য করতে বৈতল সন্ধি করে দুখুর
সঙ্গে । বলে,
--- দেখ
দুখু, তুই চুরি করতে, ধাউড়ামি করতে যখন, মাইনষে গাইল্লাইত । অখন মামুর খেদমতগিরি করবে, মাইনষে ভালা
কর । এর লাগি ভাবছি না তুই ভগবান অই গেচছ । মানি লা আমার কথা ।
--- কী কথা
।
--- ব্যাঙর
মাথা ।
--- অ বুঝছি, তুই অউ
গুলাইলর কথা কইরে আবার । বান্দর মাত, নানি ।
--- না না , খালি বান্দ
কেনে, নদীর কথাও কইয়ার । নদী না থাকলে বান্দ আইত কই থাকি । কইছলাম
নানি, চান্দর টুকরার লাখান । মানি লা ।
দুখু মিয়া
হেরে গিয়েও হার মানতে চায় না । বলে,
--- অই বেটা, নদী আর
বান্দ দিয়া কিতা করতে তুইন । কবিতা লেখতে নি । আমরার নদীর পারর মানুষ নিয়া কিচ্ছু
মাতিছ না । খালি তেড়া আর বেকা । আমরার লাখান ইলা সোজা মানুষ পাইবে নি তোর
পাকিস্তানো ।
--- আবার
পাকিস্তানি কইবে । আমি পাকিস্তানি নায়, আমি ছিলেটি । তোর মতো কাছাড়ি ভূত নায় । আছে নি তোর
হাকালুকির মতো হাওর, ভাটির দেশর লাখান বিল । হাকালুকি ইখান অইল সাগর, মাইনষে কয় ‘হাওরর মাঝে
হাকালুকি, আর সব কূয়া ।’ কূয়া বে কূয়া ।
--- আবার
তুইন পানি লইয়া মাতরে । মানুষ লইয়া মাততে পারছ না ।
--- মাতিয়ার
তো, আধা হুনিয়াউ কান্দায় কুন্দায় বাইড়াইরে কেনে ।
--- ক ।
--- মাইনষে
কইন ‘হাওরর মাঝে
হাকালুকি বাকি সব কূয়া
বাবুর মাঝে
মুরারি চান্দ বাকি সব পূয়া ।’
--- তাইন
আবার কে ।
--- তান
নামে কলেজ আছে । তান নাম নেয় সদর ছিলেটো । আর এমনে গাউআলা হকলে কয়, ‘ বেটা অইল
মামুদ মনছুর বাকি সব পুয়া ’
--- ইতা
আমারাও আছইন, নসিবালি হাকিম আছলা, গফুর খান আছলা, কামিনি চন্দ আছলা, ছবির খান আছলা । অখন সতিদেব আছইন, হুরমত আলি
আছইন, কামিনি সেন আছইন বিধুভূষণ চধরি আছইন পরেশ চধরি আছইন, রনেণ দাস
আছইন, বিছি গুপ্ত আছইন, উপেন দত্ত আছইন । আরো আছইন, কত হুনতে ।
--- এরা সব
বড় বড় মানুষ । ভালা অইবাউ । গরীব মানুষও সব দেশো ভালা । গরিব ভালা অইলে, নেতা ভালা ।
মানুষ ভালা অইলে নদী ভালা হওন লাগে । তরে পালত কে । নদী ছাড়া কুনু মা আছে নি বেটা
। তুই থাম ।
বৈতলের
মাথায় কেড়া নড়ে চড়ে । দুখুর বকবকানি বন্ধ করতে হবে । উপায় একটা ওকেই বের করতে হবে
। পুঁথিপত্র থেকে তুলে আনতে হবে প্রমাণ । দুখু জানে অশিক্ষিত মানুষের কথা কখনও
প্রামাণ্য হয় না । সব কথায় তর্কের সূত্র থেকে যায় । ঝগড়া বাঁধিয়ে দেওয়া যায় । বৈতল
জানে গুলতির উপমা যদি সে হরেন্দ্র মাস্টারের নাম করে চালিয়ে দেয়, দুখু মেনে
নেবে । ফণা নামিয়ে ফেলবে । বৈতলকে এবার পড়াশুনা শিখতে হবে নতুন করে । বইয়াখাউরির
জীবন ছিল অন্যরকম । পড়াশুনার পরিবেশ তৈরি হতে দেয় নি গ্রাম্যতা । বরাক নদীর পারে
জীবন অন্যরকম । শুধু চাষী পাটনি কামার কুমোর আর করাতি মানুষ নিয়ে নয় সমাজ । এখানে
ইস্কুল পাঠশালা আছে, আছে কলেজও । অফিস কাছারি জজ ম্যাজিস্ট্রেট উকিল সাহেব বাবু
পুলিশ সবই আছে । আর আছে শহরের এমাথা থেকে অমাথা যাওয়ার রিক্সা আর সওয়ারির সঙ্গে
বকম বকম করার রিক্সাওয়ালা । বৈতল বলে,
--- আমার
রিক্সাত চড়লে মাত পাইবা মাগ্না ।
মাগনা মাত
শোনানোর একজন ভিন্ন মানুষও খুঁজে পায় বৈতল । বৈতলের রিক্সায় কোনোদিন পা দেন নি ।
শুধু রিক্সা কেন অন্য কোনও যানবাহনেই চড়েন না তিনি । বৈতল যায় তাঁর কাছে, সে নিশ্চিত
জানে তার সমস্যার সমাধান হবে । তিনি লাখুদা । মধুরামখেই এক ভাঙা ঘরের বাসিন্দা ।
স্থাবর সম্পত্তি বলতে শুধু কাপড়ের ঝুলি । সব খদ্দরের, নিপাট
গান্ধীবাদি । ঝুলির ভিতর শুধু কাগজ আর কাগজ । বাপ কাকার
মতো মুরব্বি মুরব্বি মনে হলেও বৈতলের থেকে বেশি বয়স নয় । আপন জনের মতো কথা বলেন ।
সিলেটের অনন্ত সাধুর কথায় যেমন আগুন ঝরত তেমন নয় । তিনি গুরু সৃষ্টিধরও নন, আবেগের
বন্যায় ভেসে যাওয়ার মানুষ নন । এ মানুষকে দেখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই । পথে ঘাটে
আত্মীয়বাড়িতে দেখা যায় এমন মানুষ । সবার কথা মন দিয়ে শোনেন, সবাই
সমস্যার কথা বলে । সমাধানের উপায় বাতলে দেন । বৈতল রিক্সায় ব্রেক দিয়ে থামে তাঁর
সামনে । বলে,
--- চলইন ।
--- কই চলইন
। তুমি কইলেউ যাইতাম নি । তুমি কুন লাটসাহেব ।
--- আপনে
যেখানো কইবা লই যাইব বৈতলে ।
--- তুমার
নাম বৈতল নি ।
--- অয় ।
বাপে গাইল্লাইয়া গাইল্লাইয়া রাখি দিছিল । আপনার নাম লাখুদা কে রাখছে । লাখটেকার
মালিক নি আপনে ।
--- আমার অউ
থলিয়াত আছে লাখ টেকা, নিতায় নি ।
--- নিতাম
নায় । বৈতলে সবতা নেয় না । আপনে সুনামগঞ্জি নি ।
--- অয় ।
তারপরে কইবায় মধুরামুখি নি । তারপরে কইবায় আপনে হিন্দু নি । গান্ধীজিয়ে কইছইন
মানুষরে অত টুকরা কড়া ঠিক নায় ।
---
রিক্সাআলা মানুষ, অত ভাবিয়া কইছিনা আইজ্ঞা । কইলাম আরি । ভালামানুষ দেখলেউ
মনো অয় সুনামগঞ্জি । তে চলইন ।
--- আমি তো
রিক্সাত চড়ি না । পুন্দো নাই চাম, রাধাকৃষ্ণ নাম । খাওয়ার পয়সা নাই রিক্সা চড়তাম কেমনে ।
--- আমি
কুনু ভাড়া চাইছি নি ।
--- না রেবা
আমিও গাড়ি ছাড়া চড়ি না । তুমার তিন চাক্কায় অইত নায় ।
--- আমি
জানি, খামোকা মাতরা । শহরো তো মাতর তিন খান আর চাইর খান গাড়ি ।
ভুতু চধরি, নলিনাক্ষ ডাকতর, অমূল্য হালদার, গাভরু মিয়া আর নছিব আলির । আর আছে নি ।সতিদেবর আছে
। আপনার নাই ।
--- কিচ্ছু
জানছ না বেটা আড়ুয়া । হাজার হাজার গাড়ি আছে । আমার পাওগাড়ি যতদিন আছে কুনু চিন্তা
নাই ।
--- আপনে
হাটিয়া হাটিয়া অত কাম করইন কেমনে ।
--- কাম আর
কিতা করি । খালি গপ । অউত্ত দ্বিজেন চধরির বাড়িত গিয়া চা খাইমু, আজারি গপ
মারমু । আবার যাইমু কেউর বাড়ি । এর কথা হেরে কই, হের কথা এরে, যদি কুনুকাম
অয় । অতা করিউ কাটি যায় সময় ।
--- আইচ্ছা, বুঝছি, আপনে আমার
লগে যাইতা নায় । তে আমার একখান কাম করি দিবানি ।
--- কইলে
বুঝমু মহারাজর আদেশ কিতা ।
--- আদেশ
উদেশ নায় । আমি পড়তাম । আপনার বুলে এক ইস্কুল আছে ।
---
বাল্যকাল শিক্ষার সময় । তখন কিতা করছো । মাছ মারছো আর মাইরে খাওইয়াইছ নানি,
--- অয় ।
মাইমলর পুতে আর করত কিতা । দেশ ভাঙাভাঙি না অইলে আপনারে কইলাম নানে । পড়ার কুনু
বাল্যকাল বুড়াকাল নাই । আমার বন্ধু দুখুয়ে কইছে, খান সাহেব
রশিদ আলি এ গরুরে থি থি হৈ হৈ করতে করতে ইশকুলর পড়া হুনতা । তাইনো বড় পণ্ডিত
অইগেলা ।
--- আরো
আছইন । মহাভারতর একলব্য আছলা জংলি পুয়া, বাবনও নায়, রাজার পুয়াও নায় । সব শিখিলাছলা গুরুর কাছ থাকি লুকাই লুকাই
। গুরুইয়েনু তার ধনুক চালানির বুড়া আঙ্গুল নিলাগি গুরুদক্ষিণা । তুমি কিতা দিবায় ।
--- যেতা
চাইন দিলাইমু । জিবরা দিতাম নায় ।
--- তে আর
যেতা চাইন অইল কেমনে । না বা অখনও ইস্কুল অইছে না । অইলে গুরুদক্ষিণা ছাড়াউ পড়বায়
।
--- অইব পুত
ডাকব বাপ । আমি তখন বুড়া । আর কুনু ইস্কুল নাইনি ।
--- নাই, আবার আছেও ।
বগা মাস্টরর ইস্কুলো ভালা ভালা মাস্টর আছইন, তারা পড়াইন । তুমি কিতা পড়তায় ।
--- সব সব
পড়তাম । কিচ্ছু জানি না আমি । আমি পুথি পড়তাম আন্তাজে, গুরুয়ে
শিখাই দিছলা, অখন পড়ি না গুসা করিয়া ।
--- কেনে ।
কিওর গুসা ।
--- মায়
ভাবছিলা পুথি পড়িয়া পুত লাটসাহেব অইব । শ্রাবনীত
পুজা দিতা । আমি তখন গুরুর বাড়ি বিয়ানিবাজার, আস্তিক মুনিরে দি উঠাইলাইলা মারে । এর লাগি ছাড়ি দিছি ।
--- ছি বা ।
তুমার নি নাকর আগাত গুসা । মারে সাপে কাটছে এর লাগি মনসার কিতা দুষ । আর তুমার মায়
যে চাইতা তুমি উঝা অইতায় । মার মার খুশির কথা ভুলি গেলায় ।
--- না
ভুলছি না । ইদেশো আইয়া আবার আরম্ভ করছি । ইতা আর এক গপ । অখন কইন কেমনে শিখতাম ।
আমি খালি পানিকিতাব জানি । পানিত জন্ম পানিত কর্ম, আমরা তো
পাটনি । কইয়া দেখইন, অউ মধুরা থাকি আপনার লাগি ধরিয়া আনমু দেড়মনি বোয়াল । হাওরর
ইপাতা থাকি হিপাতা পড়ি ফালাইমু মুখস্ত । হাওর দেখছি কত সুন্দর সুন্দর । শল্লা
গেছইন নি, দেখার হাওর, দেকার হাওর। ডেকার হাওর, বড় হাওর, জামাইকাটা, টেঙ্গুয়া
লঙ্গুয়া, মাটিআইল, হাকালুকি কত যে পানির টেঙ্কি । আর কত কিছিমর মাছ, ঘনিয়া গজার
শউল পাবিয়া বাচা মাগুর কই চেঙ রানি টেংরা পুটিমকা কাংলা মহাশউল আর বাঘমাছ তো
আপনারার ইখানো দেখিউ না । সুরমা পিয়াইনর লাখান নদী আছিল আমরার দেশো, সুনামগইঞ্জো
। আর ইবেটিরেও দেখছিলাম জৈন্তিয়ার পাহাড় থাকি, সুতার নালর
লাখান । আমার গুরুয়ে কইছলা এন দিকে চাইতাম না , এইন বুলে
তেড়া ভেড়া নদী, এইন আসল মা নায়, সৎ-মা । গুরুয়ে চাইছলা না আমি ছিলট ছাড়িয়া যাই । আর অখন অউ
তেড়া নদী দেখিয়া পাগল, এক বন্ধুর লগে ঝগড়া করছি । আমি কই নদী ইলাখান, হেকয়
হিলাখান । আপনে নি পারবা তারে বুঝাইতা ।
--- নারে বা
কথার টেংকি । আমারো অ কইতে মার্গো ফাটে । বিদ্যা শিক্ষা কিচ্ছু নাই । কাছাড়
ইস্কুলর ভুগোলর মাস্টররে ধরো, বুঝাই দিবা ।
--- আমি
আবার ধরতাম কেমনে ।
--- এক কাম
করো । হেডমাস্টর ব্রজেন ধরর বাড়িত যাও গিয়া তারাপুর । আর গিয়া কও চলইন । আমারে
যেমনে কইছো । না, তানো আমার লাখান গাড়ি আছে ।
--- বুঝছি, আপনারে দি
অইত নায় আমার কাম । ইস্কুলর চকিদার যুগেন্দ্রদ্দায় পারব ।
--- অউত্ত
অই গেছে । যুগেন্দ্র বড় ভালা মানুষ । যাও তার লগে টক্কর দেও গিয়া । দেখিও খালি টেক্কর খাইও না ।
--- অয়, খাইছি তো, তাইন খালি
মারইন ।
--- তুমি নি
মাইর খাওয়ার বেটা ।
--- না, ভালা মাইনষর
খাই । ইস্কুলর বাগান থাকি আমি নু রুজ সকালে ফুল চুরি করি । কিন্তু তাইন ধরতা পারইন
না ।
--- ফুলচুরি তো
ভালা । এর লাগি মারত কেনে ।
যুগেন্দ্রদ্দায় কইন আমি বুলে রাইত ডাকাতিও করি । আমারে দেখলে লাগেনি অলা, কইন ।
--- চকিদার
অইলে কিতা অইব যুগেন্দ্রর চউখরে ফাকি দেওন যায় না । তুমারে দেখলে লাগে না ঠিক অউ ।
কিন্তু যুগেন্দ্রর কথা ফালাই কেমনে কও ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন