“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ৬ আগস্ট, ২০১৬

যত কাণ্ড গণিত নিয়ে (প্রথম পর্ব)

।। রজত কান্তি দাস।।

      
(C)Image:ছবি
       যে বিষয় নিয়ে বাঙালী লেখকরা খুব কম জনপ্রিয় লেখা
লিখেন সেই বিষয় নিয়েই একটি মনোগ্রাহী লেখা লিখতে চেষ্টা করব যেখানে গণিতের জটিলতা থাকবে না, কিন্তু থাকবে এর মজার মজার দিক। যারা মনে করেন গণিত একটি কাটখোট্টা বিষয় তাদের ভুল ভাঙানোর জন্যই এই লেখা।
 
            আসলে গণিত এমন এক বিষয় যাকে বলা হয় ১০০ শতাংশ পারফেক্ট। তবে একজন গণিতজ্ঞ আছেন যিনি প্রমাণ করেছেন গণিতের যুক্তিতেও কিছুটা ভুল আছে। এ বিষয় নিয়ে নাহয় পরে আলোচনা হবে। আপাতত আমরা এটাই জানি গণিতজ্ঞরা যেটুকু যুক্তির নিরিখে প্রমাণিত তার এক চুল বাইরে যে যেতে রাজি নন। এই নিয়ে যে একটি মজাদার গল্প চালু আছে তা প্রথমে বলে নিই। 

           স্কটল্যান্ডের রেলপথ দিয়ে যাচ্ছিল একটি ট্রেন। এর কোন এক কামরায় এক কবি, এক দার্শনিক ও একজন গণিতজ্ঞ সফর করছিলেন। ট্রেনটি একটি মাঠের পাশ দিয়ে যাবার সময় তারা দেখলেন একটি কালো রঙের ভেড়া মাঠের মধ্যে চরে ঘাস খাচ্ছে। কবি বললেন, “আহ, স্কটল্যান্ডে কি সুন্দর সুন্দর কালো রঙের ভেড়া আছে যা সচরাচর দেখা যায় না।এই কথা শুনে দার্শনিক বললেন, "আমি এটুকুই বলতে পারি যে স্কটল্যান্ডে একটি মাঠ আছে যেখানে একটি কালো রঙের ভেড়া আছে।" এরপর তারা গণিতজ্ঞের কাছে জানতে চাইলেন তিনি এ ব্যাপারে কি বলতে চান। গণিতজ্ঞ বললেন, “আমি এটুকুই বলতে পারি স্কটল্যান্ডে একটি মাঠ আছে যেখানে একটি ভেড়া আছে যার একটা দিক কালো আসলে ট্রেন থেকে ভেড়াটি একটা দিকই দেখা যাচ্ছিল, তাই এই ভেড়াটির অন্য দিকটাও যে কালো সেটা গণিতজ্ঞ বিশ্বাস করতে রাজি নন যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি অন্য দিকটা দেখতে পাচ্ছেন। অনেকে হয়ত বলবেন এটা বাড়াবাড়ি, কিন্তু এই বাড়াবাড়ি থেকেই অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়েছে যার মধ্যে আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি থিওরি, ছাড়াও অনেক কিছুই আছে। সে প্রসঙ্গে পরে আসব।

            এই ধারাবাহিক রচনার উদ্দেশ্য একটাই যে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মন থেকে গণিতভীতি দূর করা। কারণ ইউরোপ যখন জ্ঞানে বিজ্ঞানে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছিল তখন অন্য অনেক বিষয়ের সঙ্গে গণিতকেও প্রবল নিষ্ঠা নিয়ে চর্চা করেছিলেন ইউরোপীয়রা। আমার বিশ্বাস যে জাতি গণিতকে ভালবাসতে শেখেনি সেই জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। আজ সারা বিশ্বের আর্থিক ও বৈজ্ঞানিক উন্নতির ক্ষেত্রে প্রতিটি পদক্ষেপে গণিত এক অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বিজ্ঞানের অগ্রগতি তখনই সম্ভব যখন আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা গণিতের প্রতি আকৃষ্ট হবে।
 
           ২০১২ সালটিকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং জাতীয় গণিতবর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। আমাদের টিআরপি প্রেমী টিভি চ্যালেনগুলোর দৌলতে এই কথাটি সেরকম ভাবে প্রচারিত হয় নি। এমন কি স্কুল কলেজগুলোতেও এই বর্ষ সেরকম ভাবে পালিত হয় নি যাতে গণিতের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আকর্ষণ বাড়িয়ে তোলা যায়।
 
            ১৮৮৭ সালের ২২ ডিসেম্বর ভারতে এক অবিস্মরণীয় গণিত প্রতিভার জন্ম হয়েছিল যিনি হলেন শ্রীনিবাস রামানুজন। তাই ২০১২ সালটি ছিল তাঁর ১২৫তম জন্মবর্ষ। ভারত সরকার তাই প্রতি ২২ ডিসেম্বর তারিখটিকে জাতীয় গণিতদিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিলেও স্কুল কলেজগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের গণিতের প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর জন্য এই দিনটিকে সেরকম ভাবে পালন করা হয় না। অথচ দেশের দারিদ্র দূরীকরণের জন্য গণিত শিক্ষাকে যে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, জীবনবীমা, ব্যাংকিং, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে এদেশকে প্রগতির পথে নিয়ে যেতে হলে ছেলেমেয়েদের গণিতের প্রতি আকৃষ্ট করা অত্যন্ত জরুরি ও অপরিহার্য। এই কথা মাথায় রেখেই এই ধারাবাহিকের সূত্রপাত। আপনাদের ভাল লাগলে আমার শ্রম সার্থক হবে।
 
মহান গণিতজ্ঞ শ্রীনিবাস রামানুজন
          ১৯১৩ সালে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ জি এইচ হার্ডি মাদ্রাজের এক কেরানির কাছ থেকে একটি অদ্ভুত চিঠি পান। তবে খ্যাতিমান অধ্যাপকরা আধ-পাগলাদের কাছ থেকে এ ধরণের চিঠি সাধারণত পেয়েই থাকেন। ১৯০৫ সালে কোয়ান্টামতত্ত্বের জনক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক যখন আন্নালেন দার ফিজিকনামের বিখ্যাত জার্মান ম্যাগাজিনের সম্পাদক, তিনিও সুইজারল্যান্ডের বার্ন শহরের এক তৃতীয় শ্রেণীর টেকনিশিয়ানের কাছ থেকে এরকম একটি চিঠি পেয়েছিলেন যাতে লেখা ছিল যে নিউটনীয় বলবিজ্ঞানের মূল ভিতটাই গড়বড়ে। যে ম্যাগাজিনে ইউরোপের বিখ্যাত সব পদার্থবিজ্ঞানীরা লেখা পাঠান সেখানে কি না পেটেন্ট অফিসের এক থার্ড গ্রেড টেকনিশিয়ানের এই অদ্ভুত দাবি। ভাগ্যিস ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক নিজে নিউটনীয় বলবিজ্ঞানের উপর পুরো আস্তা রাখতেন না এবং তিনি এর কিছু ফাঁকফোকর বের করেন পাঁচ বছর আগেই। নইলে অন্য কারো হাতে এই চিঠিটি পড়লে হয়ত এর গতি ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটেই হতো। বলাবাহুল্য এই টেকনিশিয়ান হলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এবং এই চিটির মধ্যে যে প্রবন্ধটি ছিল তা ছাপা হয় যা আজ ইতিহাস।
 
             ইংল্যান্ডের খ্যাতিমান গণিতজ্ঞ জি এইচ হার্ডি মাদ্রাজের পোর্ট ট্রাস্টের যে কেরানির কাছ থেকে গণিতের উপর লেখাটি পেয়েছিলেন, এই কেরানির নাম শ্রীনিবাস রামানুজন। ওই দীর্ঘ চিঠিতে তিনি অসীম সংখ্যার উপর ১২০টি গাণিতিক সিদ্ধান্তের কথা লিখেন। হার্ডি প্রথমে ভেবেছিলেন এরকম চিঠিতো আসতেই থাকে। হাজার হোক খ্যাতিরও তো বিড়ম্বনা আছে। রবীন্দ্রনাথও ছিটগ্রস্তদের কাছ থেকে এরকম চিঠি পেতেন হামেশা যা তিনি পাগলা ফাইলনামে একটি ফাইলে জমা করে রাখতেন। কিন্তু রামানুজনের চিঠি পড়ার পর হার্ডি এটাকে গুরুত্ব না দিয়ে পারেন নি। তিনি তাঁর সহকর্মী লিটলউডকে চিঠিটি দেখান এবং দুজনে মিলে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে রামানুজন যা লিখেছেন তা সত্যি হতে বাধ্য। কারণ গাণিতিক প্রক্রিয়া ছাড়া কারো পক্ষে এ ধরণের সিদ্ধান্ত কল্পনা করা সম্ভব নয়। এরপরই রামানুজনের জীবনে অভাবনীয় মোড় চলে আসে। হার্ডি তাঁকে নিয়ে যান ইংল্যান্ডে যেখানে তিনি হার্ডির সঙ্গে পাঁচ বছর কাজ করেন।
 
           ইংল্যান্ডে থাকাকালীন রামানুজনের খ্যাতি সেখানকার গণিতজ্ঞদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষত সংখ্যাতত্ত্বের উপর তাঁর নিত্য নতুন আবিষ্কারে গণিতের জগতে নতুন পথের সন্ধান পাওয়া যায়। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে স্নাতক ডিগ্রি দেওয়ার পর তাঁর গবেষণামূলক কাজের জন্য তাঁকে ১৯১৮ সালে রয়্যাল সোসাইটির সদস্য করা হয়। এই সম্মানিত সদস্যপদ লাভে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় ভারতীয়। এর আগে ১৮৪১ সালে অর্ধশির কুর্সেতজী নামে এক ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার তথা জাহাজ নির্মাতা এই পদ লাভ করেছিলেন।

            শ্রীনিবাস আয়াঙ্গার রামানুজন তৎকালীন মাদ্রাজ প্রভিন্সে জন্ম গ্রহণ করেন যা বর্তমানে তামিলনাড়ু। তাঁর বাবা কাজ করতেন শাড়ির দোকানে। শ্রীনিবাসের জন্ম হয় মাতুলালয়ে। খানজাভুর গ্রামে তাদের বসবাস ছিল যদিও পরে তাদের পরিবার মাদ্রাজের কাঞ্চিপুরমে চলে আসে। রামানুজনের পরিবার আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল তো ছিলই না বরং তাদের গরিবই বলা যায়। দরিদ্র পরিবারে জন্মেও রামানুজনের ধ্যান-জ্ঞান গণিতের প্রতি এতটাই নিবিষ্ট ছিল যে মাত্র ১০-১১ বছর বয়স থেকেই তাঁর মধ্যে গণিত প্রতিভার স্ফুরণ হতে থাকে। পরবর্তীকালে যে প্রতিভা এক মহীরুহ-রূপ ধারণ করে। ইউরোপ ও আমেরিকার গণিতজ্ঞদের মতে রামানুজনের কাজের প্রভাব ছড়িয়ে থাকবে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত। আজ ব্ল্যাকহোল নিয়ে যে গবেষণা হচ্ছে তার সূত্রও পাওয়া যায় রামানুজনের গবেষণার মধ্যে।
            দুর্ভাগ্য অনেক সময়ই মানুষের অজান্তে তাদের তাড়া করে বেড়ায়। রামানুজনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ইংল্যান্ডের শীতল আবহাওয়া, জলবায়ু ও অনভ্যস্ত খাদ্যাভ্যাসে রামানুজনের শরীর ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ে। স্বাস্থ্য পরিবর্তনের জন্য তিনি ১৯১৯ সালে ভারতে চলে আসেন। দেশে ফেরার পর তাঁর স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হয়েছিল ঠিকই তবে শেষ রক্ষা হয় নি। ১৯২০ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই অসুস্থ অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। এমন কি মৃত্যু শয্যায় থেকেও তিনি যে সব নতুন নতুন গাণিতিক চিন্তাভাবনা করে গেছেন তা প্রায় ৯০ বছর পর সত্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। আজও যারা ব্ল্যাকহোল নিয়ে গবেষণা করছেন তারা এর কার্যকারিতা অনুধাবন করতে পারেন রামানুজনের দেওয়া পদ্ধতি থেকে। মনে হয় আরো কয়েক শতাব্দী ধরে রামানুজনের কাজ ও তাঁর দেওয়া পদ্ধতির উপর গবেষণা চলতে থাকবে। এই অনন্য সাধারণ গণিত প্রতিভার অকাল মৃত্যুতে সারা বিশ্ব যা হারালো তার হিসেব পাওয়া যাবে না। তবে এত অল্প বয়সেই তিনি গণিতের জগতে যে অবদান রেখে গেছেন তা আজ বিশ্বের সম্পদ ভারতের গর্ব।


কোন মন্তব্য নেই: