(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার উজান পর্বের ষষ্ঠ অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
ছয়
এরকম এক এক দিন এক এক রকম । এরকম
চলে দিনের পরে দিন । মেয়ের চান হয়ে গেলে বৈতল মুখে দেয় উনুন থেকে উঠিয়ে আনা কাঠ
কয়লা, আংড়া । চিবোতে চিবোতে মিহি হয়ে গেলে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে বত্রিশ দাঁতে
ঘসতে থাকে এদিক ওদিক, মধ্যমা তর্জনী মিলিয়ে উপর নিচ । নদীর জলে কুলকুচি করে ।
হেমন্তের নদী তেমন ভরভরাট নাহলেও ধীরে ধীরে নামে গভীরে । মেয়ের অনুরোধে দেখাতে হয়
জলের কসরৎ । ডুব সাঁতারে নদী পারাপার করা । রুপোলি রঙের পাহাড়ি কইমাছ তুলে আনে জল
থেকে, শিলের তলার কৈ মাছ নামেই কই, স্বাদ নেই । অন্য মাছও তুলে বৈতল । কোনোদিন
নিয়ে যায় বাড়ি, কোনোদিন দিয়ে যায়
মাস্টারবাড়ি, গুরুদক্ষিণা ।
যেদিন মেলে না কিছু, সেদিন পান্তাভাত আর
খেসারি ডালের বড়া । নয় সিদলপোড়া ভাত । সিলেট আর কাছাড়ে এই একটা জায়গায় খুব মিল ।
সিদলপোড়া খায় সবাই । হেডমাস্টার কী খায় । মনে যখন একবার প্রশ্ন জেগেছে, বৈতল বলবেই
মাস্টারকে । কিন্তু শেষ মুহূর্তে পাল্টে দেয় প্রশ্ন । মাস্টার রিক্সার পাদানিতে পা
রাখতেই বলে,
--- পুড়িরে কই দিতাম ছার । ইস্কুলোর সময় তো
অই গেল ।
--- কত অইছে বয়স ।
--- অউত্ত আট বছরো পড়ব । জয়কুমারো তৃতীয়মান ।
--- স্বদেশি ইস্কুলো দিলাও । আমি কই দিমুনে ।
--- আইচ্ছা । আপনার
ইস্কুলো অইত নায় ।
--- পুয়াইন্তোর ইস্কুলো কেমনে পড়বো ।
--- অ, তে আমারে ভর্তি নেইন গি ।
--- তুমি তো পুয়া নায় ।
--- তে কিতা ।
--- তুমি বৈতল ।
--- আমি নানি পরতি দিন ছানউন করিয়া আপনার
ইস্কুলর লাগি সাজি লাই । ঘণ্টি পড়লেই জেন বেঞ্চিত বইতাম ।
--- ইস্কুলর পড়া না পড়লেও হয় । মানুষ হওন
লাগে । দেশভাগ আমরারে অমানুষ বানাইছে । কও চাইন তুমি যে সিলেটো আছলায় কুনু কষ্ট
আছিল নি । মাছ মারতায়, খাইতায়, বাউটামি করতায় আর পুথি পড়তায় ।
--- আমার কষ্ট আছিল ছার, পুথি পড়তাম পারতাম
না । ভুষিমালর দুকান থাকি কিনা বর্ণপরিচয় পড়িয়ার অখন পুড়ির অউগদা । আমার নানি খুব
শখ আছিল পাঠশালাত পড়তাম । আমার মায় চাইতা । আমারে কত জাগাত পাঠাইছইন, মনসামঙ্গলর
উঝা বানাইবার লাগি । আমার এক বন্ধু আছিল লুলা, হে হিকাই দেয় থুড়া । হেও তো
অলাখানঅউ । হে আছিল বেজ, বাদিয়া আরি । রুল আমিন বেজ । সাপ ধরার কারবার আছিল তার
বাপর । হে অইগেল কবি । কবি গান লেখত আর গাইত গাউর বাজারো । খিত্তার বাঙাল আছিল, কী
গুসা কী গুসা তার । আমার লগে দেখা অইছিল মিরতিঙ্গার পাহাড়ো, ছোট আছলাম । আমার মা
মরার সময় হে আছিল । আমি তখন কৈ । তক্তাত রান্দা মারিয়ার, পেচকুন্দার নাচ দেখিয়ার
আর গুরুর কাছ থাকিয়া পুথি শিখিয়ার । কত গান যে শিখছি ।
--- অখন কই থাকে বন্ধু, পাকিস্তানোনি ।
--- না, উপরে ।
--- অ, কইছলায় একদিন ।
বৈতল আর কথা বাড়াতে চায় না লুলা বিষয়ে ।
বন্ধুত্বের সংজ্ঞা সে কাউকে বোঝাতে পারবে না । বোঝাতে পারবে না প্রাণ দিয়ে রক্ষা
করার বন্ধুত্ব কেন প্রাণঘাতী হয় । তাই লুলার মৃত্যু প্রসঙ্গ সরিয়ে রাখে
হেডমাস্টারের কাছ থেকে । বৈতল কথা সরিয়ে নেয় সিদল পেড়ার দিকে । বলে,
--- অউ আর এক জিনিস দেখলাম ইখানো সিলেটর
লাখান ।
--- কিতা বা ।
--- হিদল আর কি । হিদলর গন্ধে পাগল অই যায়
মানুষ । আপনারা খাইন নি । আপনারা তো ভদ্রলোক ।
--- খাওয়ার আবার ইতা কিতা । তে এও ঠিক কথা,
গাউর মাইনষে খাটইন খুব । খাটলে খাওন লাগে । কিতা খাইত । মেকুরে লাফ মারি যাইত পারত
নায় অলাখান উপুরতুপুর টিক্কইর মারা ভাতর থালোর এক কুনাত থাকে ছোট এক দলা হিদল পোড়া
। হালুচার আর কিতা লাগে । পুটকিপুড়া মরিচবাটা দেওয়া হিদলর দলা ইপার থাকি হিপারো
নেয়, আর এক গরাস ভাত দেয় গলাত । হাতো যেতা লাগল অতাউ । আবার আনল ইপারো । অউ করতে
করতে গন্ধেউ ভাত সাবাড় ।
মাস্টারের এই সিদলপোড়া ভাতের
বৃত্তান্ত বৈতলের আনন্দ হয় না । একবার প্যাডেল থামিয়ে মাস্টার আর তার দূরত্ব পরিমাপ
করে । এই গল্পটাই দুখু বললে তার নির্যাস অন্যরকম হয় । হাসির খোরাক হয় । ভদ্রলোকের
চোখ দিয়ে দরিদ্র চাষীর অন্নব্যঞ্জনের এই কটাক্ষ মানতে পারে না বৈতল । বলেই ফেলে
প্রিয় মানুষকে ।
--- আপনারা খাইলে কিতা হাত লাগাইন নানি ।
ইপার থাকি হিপারো নেইন নানি রউমাছর টুকরা ।
বৈতল কারো মন রেখে কথা বলতে শেখেনি । তাই কথাটা
বলেই বুঝতে পারে নতুন গুরুর মনে দুঃখ দেওয়া হয়েছে । তাই আবার বিষয় পাল্টায় । ভুগোল
সংক্রান্ত তার মূল প্রশ্নে যায় সরাসরি । বলে,
--- আইচ্ছা, ইতা ছাড়ইন । অখন কইন চাইন দেখি
একখান কথা ।
--- কও ।
--- অউ যে আপনার নদী ।
--- নদী তুমার নায়নি ।
--- অখন তো আমারও । তবে আমরার সুরমার লাখান
নায় । পিয়াইনর লাখান নায় ।
--- ওরেবা, সুরমা তো অইলা পরে । যার পরসাদে
রামর মা তারেউ তুমি চিন না । অউ যে দেখরায় নীল নীল বাতাসর রঙর পাহাড় ওখান থাকি বার
অইছইন বরাক, একটু আউগগাইয়া অইছইন কুশিয়ারা, সিলেটো গিয়া অইছইন সুরমা । এনে ইখানো
বন্ধ করি দেও, কও আর যাইতায় পারতায় নায়, দেখবায় তুমার গাউত পানি নাই । কিতা নাম
নানি তুমার গাউর ।
--- বইয়াখাউরি ।
--- তুমি তো সুনামগঞ্জ নানি । তুমার মাতে
বুঝা যায় । সিলেটি মাতর আছে তিন রকম । সুনামগঞ্জের মাইনষে একেবারে নদী আর মাটির
লগে মিলাইয়া মাতইন । করিমগঞ্জর মানুষও অলাখান । সদর সিলেটর মাইনষে ভাবইন তারাউ আসল
সিলেটি, মাতো মিঠা নাই । কিন্তু তারা আছইন দুনিয়ার হক্কলখানো । কত বড় বড় মানুষ । আর হবিগঞ্জ তারা কুনু সিলেটি নি । কি রকম
গুলগুল করিয়া মাতইন । যাইতাম নাতা, খাইতান নাতা । তারা আর বাইন্যাচঙি, সিলেটি
অইয়াও সিলেটির লাখান লাগে না । একটু বেশি মিঠা ।
--- আপনেও কিতা সুনামগঞ্জি নি ।
--- নারেবা, আমি কাছাড়ি । আমার নদী আলাদা,
তাইন ও পাহাড়ি, খুব গুসা তান । আমরার গাউর উপরেউ তান গুম্গুমি । কুনদিন নিশ্চিহ্ন
হই যাইব আমার বড়খলা জাটিঙ্গার যাতাত । জঙ্গল উঙ্গলো সাফ, কত হাত্তি আছিল, হাত্তির
খলা আছিল । অখন নাই ।
--- ও, এর লাগিউনি আপনে আইছইন মধুরামুখো ।
--- চাকরির লাগি আইছি রেবা ।
--- অউত্ত, একঅউ কথা । আপনেও রিফুজি, চাষবাস
নাই, চাকরি নাই দেশো । আমরার দেশ অই গেছে বিদেশ, আপনার দেশ নিছে পানিয়ে । আমরা
রাজনৈতিক উদ্বাস্তু, আপনে প্রাকৃতিক উদ্বাস্তু ।
--- ইতো দেখি গুরুমারা বিদ্যা তুমার । তে ভুল
শিখছ, আমরা কেনে রিফুজি অইতাম । আমরা কাছাড়র আদিবাসিন্দা । আমরা বড়লস্কর । যতীন্দ্র দেব লস্করর নাম
হুনছনি, আমরার গুষ্টির ।
--- না না, কাছাড়ি হকলও ভালা ।
--- আইচ্ছা আমারে আর ফুলানি লাগত নায় । আমি
মাছর ফুটকরা নি ।
--- আপনারে কিচ্ছু কইলেউ গুসা করি লাইন ।
কইলাম একখান কথা কইন, হুনইন অউ না ।
--- কও কও ।
--- এক আতান্তরো পড়ছি অউ নদী লইয়া আর নদীর
বান্দ লইয়া ।
--- কেনে, নদীয়ে তুমার কুন পাকনা ধানো মই
দিলা । এইন একটু নাচইন, একটু তেড়া ভেড়া । আদর করি মাইনষে ডাকইন বড়বেকা । দেখছো
নানি মধুরামুখো ।
--- আপনার বাড়ির সামনে দি ঘুরি গেছইন মধুরার
লগে মিলিয়া ।
--- ইখানরে কিতা কয় জানো নি । কাখো কলসি লইয়া যাইরা যেখানো ।
বৈতল জানে গুলতির কথা, বৈতল জানে বাটির কথা,
জানে চাঁদের কথা, কিন্তু কাঁখে কলসীর কথা জানে না, তাই চুপ করে থাকে । পণ্ডিত
মানুষের মুখে মুখে ওস্তাদি করতে নেই জানে । জানে নতুন কথা শিখতে হলে শ্রদ্ধায় নত
করতে হয় মাথা । কিন্তু মানুষটা দেখলে তো কেউ বলবে না তার মনের ভিতর এমন রসকুম্ভের
ছলছলাৎ । গাগরি রাখা নারী- কোমরের সঙ্গে নদীর বাঁক মেলানোর মানুষ কিছুতেই
অতিসাধারণ নয় । মনে মনে যোগেন্দ্রদ্দাকে দুয়ো দেয়, যোগেন্দ্রদ্দা বলেছে তিনি
হেডমাস্টার নন । চালকের আসনে বসে প্যাডেল না থামিয়েই বৈতল নম করে তার নবীন
শিক্ষককে ।
দুজন দুই মেরুর বাসিন্দার কল্পনার মিল দেখে বিস্মিত
হয় । দুর্গাবতী, তার স্ত্রীও নদীকে নারী কল্পনা করে, এই মানুষটিও করে । দুর্গাবতীর
নদীকে নারী ভাবায় সে কোনও অস্বাভাবিকতা দেখে না, কিন্তু এই মানুষ, তার হেডমাস্টার
। একজন পুরুষের এই বিভোর হয়ে নারী নয় বস্তুতে রমণীরূপ আরোপ করায় সন্দেহ হয় বৈতলের
। লোকটি কি তবে কবি, লক্ষণশ্রীর দেওয়ান যেমন, কবি ষষ্ঠীবর যেমন, সাধক রাধারমণ যেমন
। নাকি সুখের ঘরে কোনও চোর ঢুকেছে । মানুষটার ঘরেও তো নারী আছে । আভাসে জেনেছে
বৈতল, দেখেনি কোনোদিন । তবে কেন পরনারী কল্পনায় সুখী হয় । নাকি আরো খুঁড়তে চায় ।
চোরাবালি আর জলের হদিশ জানে না । জানবে কী করে, অসম্ভবকে কি কেউ জেনেছে কখনও ।
তাই, বৈতল কিছুক্ষণ আপনমনে রিক্সা চালায়
আর গুনগুন করে গায় সিনেমার গান, ‘তুফান মেল যায়’ ।
--- জয়কুমার এর বাঁক ঘুরতেই বৈতল গান থামায় ।
মনে পড়ে হেডমাস্টারের কিছু একটা বলা হয়নি, সাবধান করে দেওয়া হয়নি । বৈতল সরাসরি
সারথির আসন থেকে বলে,
--- গুরুদেব । বেটিমানুষ আর পানির নিন মাপিয়া
কিতা করতো । আম দি কাম আপনার, খামোক্খা কুডুলাতে পড়তা কেনে । কাখো কলসি লইয়া, কমর
বেকাইয়া, পানি ফালাই ফালাই যখন যাইন তখন কিতা তারা ঠিক অউ অত সুন্দর অই যাইন নি ।
না আমরা ভাবি । ভাবনা শেষ, আমরাও আবার কালা তস্লা ।
বৈতল নেশাগ্রস্তের মতো কথা বলে
যায় । রাশভারি মানুষটি একটু সময়ের জন্যও রাশ আলগা করেন না । বৈতলেরও কথা শেষ হয়
না, আরো অনেক প্রশ্ন তার মনে । সব কথা কি এখনই বলে ফেলবে । ননীদার দোকানের সামনে
এসে বলে,
--- চা খাইতা নি ।
--- না বা ।
--- আপনে সিনেমা দেখইন নি ।
--- দেখি, তুমার অউ তুফান মেইল দেখছি
গীতশ্রীত । আর ওরিয়েন্টেলো দেখছি মর্নিং শো, সব ইংলিশ সিনেমা ।
--- একলা দেখইন নি ।
--- কেনে দুকলা কার লগে দেখতাম, তুমি দেখতায়
নি ।
--- না না , আমার রিক্সার এক না রাখি দিবা নি
।
--- অখন তো সবে সিনেমার নামে রাখরা ।
--- তুফান মেইল পাচখান অই গেছে ।
--- তে কিতা রাখতায় । ইংলিশ নাম রাখতায় নি ।
রাখিদেও ‘বাইসাইকেল থিবস’ ।
--- অর্থ কিতা ।
--- সাইকেল চুর ।
--- ঢঙ নায়, হাচারির নাম কইন ।
বৈতলের বিস্ময় বাড়ে । মানুষটি
তার অতীত নিয়ে এত তথ্য কোথায় পায় । বৈতল জীবনের প্রথম বাঁক ঘুরেছিল সাইকেল চুরি
করতে গিয়ে । ধরা পরার পর সাজাও হয় । এর পরেও বন্দী থাকে বৈতল পেশকার বাড়িতে,
দাড়িয়াপাড়ায় । পেশকারের ফর্সা রঙের কিশোরী কন্যা বুড়ি তার মনে দুঃখ দেয়, গভীর ক্ষত
। আপন মর্জির মালিক বৈতলকে বলে চাকর । বৈতল মেয়েটার কান ছিঁড়ে মাকড়ি নিয়ে পালায় ।
আর যায় নি সিলেট শহরে । কৈশোরের মন্দ স্মৃতি থেকে বৈতল বেরোতে পারে নি আজ পর্যন্ত
। তাই রিক্সা নামের এক বিকল্প জানায় মাস্টারকে বলে,
--- দুখুয়ে কইছে বুরবক রাখার লাগি । হিন্দুস্থানী
হকলে কয় বুরবক আড়ুলরে । দুখু ইগু এক কীচক ।
--- না রেবা, বুরবক নায় । বুরবক, স্বর্গর
ঘোড়া । আমরার যেমন উচ্চৈঃশ্রবাঃ, ইন্দ্রর ঘোড়া, আকাশো উড়ে । রাখতায় পারো, ডাকতায়
পারবায় নি ।
--- আমার এইন ইস্কুলো পড়ছইন । কইছইন চৈতক
রাখি দিতাম ।
--- এইনও এক ঘোড়া, রাণা প্রতাপর ।
--- এর থাকি বালা কইন, আমরার মতো মাইনষে বুঝব
।
--- তে নাম রাখি দেও পঙ্খীরাজ ।
বৈতলের পছন্দ হয় নাম । ইটখোলার রাজকুমার পাটোয়ার
সঙ্গেও কথা হয়, লিখে দেবে নাম । মাস্টারকে তার পছন্দের কথা বলা হয় না তালেগোলে ।
বীরেশভট্টাচার্য হোমিওপ্যাথির ডাক্তারের ঔষুধ নিতেই দেরি হয়ে যায় মাস্টারের । খুব
ভিড় থাকে, এমন নামকরা ডাক্তার তো আর নেই শহরে । হেডমাস্টার ফিরে এসে দেন তাড়া,
বৈতলও জোরে পা চালায় প্যাডেলে । কাছাড় ফার্মেসির কম্পাউন্ডার ভোলা চক্রবর্তীর
বাড়ির সামনে এসে খোঁচা খেয়ে থামতে হয় বৈতলকে । মাস্টারের খোঁচা ইশারায় থামে বৈতলের
পঙ্খীরাজ ।
বৈশাখের
শেষ, সকাল থেকেই গরম । স্কুলের সামনে ছাত্রদের ভিড় গিজগিজ করছে । বইপত্র খুব কম,
সবার হাতেই ফুলের মালা নয় তোড়া, বিস্কুটের মালা, ছোট ছোট হাতের নানা উপহার । গরমের
ছুটি হয়ে যাবে স্কুলে । তাই স্যারদের জন্য শ্রদ্ধার্ঘ । এর মধ্যেই
সেই গরুর গাড়ি বঝাই বরুয়া বাঁশ আর তার গাড়োয়ান জগড়দেও । বড়াইল পাহাড় ঘেরা এই শহরে
গরমকাল খুব বিচ্ছিরি । প্যাঁচপ্যাঁচে অসহ্য গরম । বৈতল বোঝেনা, ওর ঠাণ্ডা গরম বোধ
একটু কম । দুখু এ নিয়ে বৈতলের বেতশরীরকে কটাক্ষ করে । বলে,
--- গরম লাগত কই । পাটাকাঠি তো হেলিয়া দুলিয়া
বিচইনর কাম করে ।
বৈতল
মানে না । তার ছিপছিপে শরীরের দোষে নয় তাপ উত্তাপ । বলে,
--- অত যে পানিত থাকি, গরম লাগত কই ।
ওদিকে জগড়দেও গাড়োয়ান আমকাঠের
লাঠি দিয়ে অনিচ্ছুক বলদকে পিটিয়ে যাচ্ছে, আর মুখে বলছে, হেই থি, থি থি, । অন্য
বলদের লেজ ধরে টানছে, মুচড়ে দিচ্ছে । গরমে গরুও যেমন, মোটা সোটা জগড়দেও গাড়োয়ানও
সমান কাতর । গামছা মাথায় দিচ্ছে, নামিয়ে আনছে, ঘাম মুচছে আবার মাথায় দিয়ে সূর্যের
তাপ বাঁচাচ্ছে । আর গরু পেটাচ্ছে । ষাঁড় দুটোর বেয়াদবিতে যার পর নাই বিরক্ত , গরু
এক পা এগোয়, আবার ঝিমিয়ে পড়ে । বৈতল দেখে, কষ্ট হয় বন্ধু গাড়োয়ানের জন্য । রিক্সায়
বসা মাস্টারের রাগও চড়চড়িয়ে বাড়ে । বৈতলকে বলে,
--- দেখরায় নি গরু ইগুর তাল । গরুর নি মাইনষে
ইলাখান মারে, মরি যাইব তো ।
--- পারের না নানি, উবাও দেখাইয়ার । হেই
বৈতল, থামো চাইন ।
--- হকচকিয়ে যায় বৈতল । এ তো তার পরিচিতি
নির্দেশ । বাপ বলে,
--- হেই বৈতল, পানিত লাম ।
বৈতল মাস্টারের কথায় প্যাডেল থামায়, ব্রেক লাগায়
। ধুতির কোঁচা পকেটে ঢুকিয়ে রিক্সা থেমে নামে বৈতলের হেডমাস্টার । জগড়দেও এর দিকে
হাত বাড়িয়ে দেয়, যুগেন্দ্রদ্দা যেমন বলেছে বেত মারার আগে হাত বাড়ায় । বলে,
--- দে লাঠি ।
জগড়দেও ও রাগী গরুর গাড়ির চালক । দেয় না । বলে,
--- কিতা অইছে ।
--- কিতা অইছে কছনি । লাঠি অগু দে । তরে মারি
অলা উবাথুবা । দেখ কেমন লাগে ।
--- ইতা মারণ লাগে । আপনে যাইন । রিক্সা থাকি
নামিয়া ইতা বাবুগিরি করলে আমার চলত নায় । পেট আছে ।
--- কিতা কইলে । দেখতে নি । বাজারি মাইর কারে
কয় দেখতে নি । একটাও মাটিত পড়ত নায় । অউ পিপড়ার পাল দেখরে নি । সব আমার ছাত্র । এক
ডাকেউ আইব । ভালা কথা কই হুন, গাড়ি ছাওয়াত লইয়া যা, গরু দুইটারে ছাড়ি দে । একটু
পানি খাওয়া । গরু বাচলে তোর পেটও বাচব ।
বৈতলের রিক্সায় আর চড়ে নি মাস্টার । বলেছে,
--- অউ নেও তুমার দুই আনা । ইস্কুলো তো আইছি
অউ, আর উঠিয়ার না । কাইল থাকি কয়েক দিনর লাগি বড়লাগি যাইমু । তুমারে কইমুনে পরে । আগুন
রঙের মাস্টার কড়া রোদকে উপেক্ষা করে পকেটের কোঁচা হাতে নিয়ে হনহনিয়ে ঢুকে যান
ইস্কুলের গলিতে । বৈতলও লুঙির খুটে দুআনি রাখতে গিয়ে হারিয়ে ফেলে পথে । খেয়ালও করে
না । বৈতল কিন্তু বোঝে হারিয়ে গেছে কিছু ।
< উজান পর্ব ৫পড়ুন উজান পর্ব ৭ পড়ুন >
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন