।। রজতকান্তি দাস।।
এপোস্তোলস দক্সিয়াদিসের মাথায় গণিত নিয়ে
উপন্যাস লেখার প্লট কি করে আসে এই নিয়ে আমার মনে হয়েছে বাস্তব জীবন থেকেই এই ধারণা
তার মধ্যে এসেছিল। গণিতের জটিলতা যে সাহিত্যের বিষয় হতে পারে এ রকম ধারণা তো আগে
কেউ করেন নি। তবে কি দক্সিয়াদিস কোন বাস্তব জীবন থেকেই তাঁর উপন্যাসের মূল থিমটি
নিয়েছিলেন। সম্ভবত তাই। কারণ উপন্যাসে যেভাবে আঙ্কল পেত্রোস গণিতের এক জটিল সমস্যা
সমাধানের পেছনে ছুটতে গিয়ে তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে নষ্ট করে দিয়েছেন, বাস্তবেও গণিতের কোন কোন জটিল রহস্যের পেছনে ছুটতে গিয়ে
অনেক গণিতজ্ঞই তাঁদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে নষ্ট করে ফেলেছিলেন। তারা তাঁদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা, মান-সম্মান ইত্যাদি খুইয়ে একাকী, নির্বান্ধব ও অসামাজিক জীবন কাটিয়ে গেছেন।
গণিতের এমন কিছু রহস্য আছে যা অসামান্য
প্রতিভাবানদের আত্মবিশ্বাসকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডেকে নেয়। সেই সঙ্গে তাদেরকে পরিবার-পরিজন
ও সমাজ থেকে বহু দূর টেনে নিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত রহস্য সমাধানের হদিশ তো দেয়ই না, উপরন্তু পরিণত বয়সে তাদের অসাফল্যের বেদনা ও অবসাদগ্রস্থ
করে তোলে। ঊনবিংশ শতকে কিছু গণিতজ্ঞদের ভাগ্যেও এমনটাই ঘটেছিল যার ভিত্তিতে ‘আঙ্কল পেত্রোস এন্ড গোল্ডবাক কনজেকচারে’র প্লট তৈরি হয়েছিল বলে আমার ধারণা। তবে ঐ সময়ে গণিতের
সমস্যাটি ছিল ভিন্ন। তখনকার গণিতজ্ঞরা তাঁদের অসামান্য প্রতিভা ও অক্লান্ত পরিশ্রম
দিয়ে এর সমাধানও করে ফেলেছিলেন। এর ফলে গণিতের এক নতুন শাখারও জন্ম নিয়েছিল যাকে
বলা হয় ‘Non-Euclidean
Geometry’ । বাংলায় বললে ‘অইউক্লিডিয়
জ্যামিতি’। রবীন্দ্রনাথের পরিবারের এক সদস্যও এই নন-ইউক্লিডিয়ান
জিওমেট্রি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। এই নন-ইউক্লিডিয়ান জিওমেট্রির উপর নির্ভর করেই পরবর্তীকালে
আইনস্টাইনের ‘থিওরি অব
রিলেটিভিটি’র আবিষ্কার হয়।
যে রহস্যটি ভিত্তিতে নন-ইউক্লিডিয়ান
জিওমেট্রির আবিষ্কার হয়েছিল তার নাম ‘Euclid’s Fifth Postulate’ বা ইউক্লিডের পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধ। জ্যামিতিতে Postulate বা স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল এমন
কিছু ধারণাকে যা আমরা সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে মনে করি এগুলো সত্য। যিশুখ্রিস্টের
জন্মের প্রায় ৩০০ বছর আগে গ্রিসদেশের আলেকজান্দ্রিয়ায় এক গণিতজ্ঞ বাস করতেন যার
নাম ছিল ‘ইউক্লিড’,
যাকে জ্যামিতির
পিতা বলে সম্মান জানানো হয়। তিনি তাঁর জ্যামিতি বিষয়ক অসাধারণ গ্রন্থ ‘Element’-এ প্রথমে কিছু ধারণাকে সত্য বলে ধরে নেন।
যেগুলোকে ‘Axiom’ ও ‘Postulate’ এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এই দুই ধরণের অনুমানকে
সত্য বলে ধরে নেওয়া হয় কোন প্রমাণ ছাড়াই। কারণ আমাদের সাধারণ বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা
দিয়ে মনে হয় যে এগুলো সত্য অর্থাৎ ‘স্বতঃসিদ্ধ’।
ইউক্লিডের গ্রন্থে সমস্ত সিদ্ধান্তগুলোকে
প্রমাণ করা হয় এই স্বতঃসিদ্ধগুলোকে মাথায় রেখে। কিন্তু পরবর্তী কালে গণিতজ্ঞরা এই স্বতঃসিদ্ধগুলিকেও
যুক্তির নিরিখে প্রমাণ করেন যাতে গণিতের পূর্ণতা নিয়ে কোন ধরণের সংশয় না থাকে।
কিন্তু পাকা ধানে মই দিতে গিয়ে বাঁধ সাধল ইউক্লিডের পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধ। এটিকে
প্রমাণ করতে গিয়ে কাল ঘাম ছুটে যায় গণিতজ্ঞদের। এই স্বতঃসিদ্ধকে কিছুতেই প্রমাণ
করা যায় না। অনেক গণিতজ্ঞরাই এটাকে সমাধান করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পরিণত বয়সে মনে
করেন যেন তারা এক মরীচিকার পিছনে ধাওয়া করে জীবন বরবাদ করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত
সাফল্য আসে। কিন্তু যারা সফল হয়েছিলেন তাদের জীবদ্দশায় কোন সম্মান জোটে নি। কারণ সেই
সময়ে এই আবিষ্কারকে কেউ বিশ্বাস করে নি। আবিষ্কারের কোন স্বীকৃতি পাওয়া তো দূর, এমন নি কারো কারো ভাগ্যে লাঞ্ছনা ও গঞ্জনাও জুটেছিল বিস্তর।
অথচ তাদের এই আবিষ্কৃত জ্যামিতির উপর ভিত্তি করে আইনস্টাইন যা আবিষ্কার করলেন তার জন্য
তিনি পেলেন বিশ্বব্যাপী সম্মান। একেই বলে এক যাত্রায় পৃথক ফল।
ইউক্লিদের পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধটি হলো যদি
একটি সরল রেখা অন্য দুটি সরলরেখাকে ছেদ করে তাহলে যে দুটি অন্তর্বর্তী কোন উৎপন্ন
হবে তাদের কোন এক জোড়ার সমষ্টি যদি দুই সমকোণের কম হয় তা হলে সরলরেখা দুটিকে উভয়
দিকে ক্রমাগত বর্ধিত করলে কোন এক জায়গায় তাদের মিলন ঘটবে সেই দিকে যেদিকে
অন্তর্বর্তী কোনগুলোর সমষ্টি দুই সমকোণের কম। এটা যে একেবারে স্বতঃসিদ্ধ তাও
সাধারণ বুদ্ধির গোচর। বরং কেউ যদি এটাকে সন্দেহ করে তাহলে তাকে পাগল বলে ধরে নেওয়া
স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে যা সত্য বলে মনে হয় গণিত ও বিজ্ঞানে তাও
প্রমাণ সাপেক্ষ। আপনারা শুনলে অবাক হবেন যা সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে সত্য বলে মনে হয়
তার অনেক কিছুই ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে এই পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধটিও আছে।
ইউক্লিডের পঞ্চম
স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণে হতাশা
গণিতে যখন সবকিছুই প্রমাণ নির্ভর সেখানে
স্বতঃসিদ্ধ বলে কিছু থাকতে পারে না। তাই ইউক্লিডের অন্যান্য স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণ
করার পর গণিতজ্ঞরা যখন পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধটি প্রমাণ করতে বসেন তখনই তাদের সব
জারিজুরি শেষ হয়ে যায়। বহু চেষ্টার পরও হালে পান নি অনেকেই। তাই ‘Parallel line Postulate’ নামে খ্যাত এই
স্বতঃসিদ্ধটি গণিতজ্ঞদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ এটিকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে
ধরে নিয়ে অন্য অনেক সিদ্ধান্তের জন্ম হয়েছে যা আমাদের ব্যবহারিক জীবনে ফলপ্রসূ।
যেমন ‘একটি সরলরেখা দুটি সমান্তরাল রেখাকে ছেদ করলে
তাদের অন্তর্বর্তী কোণগুলোর সমষ্টি দুই সমকোণের সমান’, ‘একটি ত্রিভুজের তিনটি কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের সমান’ ইত্যাদি। তাই এই স্বতঃসিদ্ধটিকে খারিজ করে দেওয়ার সাহস
অধিকাংশ গণিতজ্ঞদেরই ছিল না। আবার এই স্বতঃসিদ্ধটিকে প্রমাণ করতে না পেরেও তারা
হতাশায় ভুগতে থাকেন।
এখানে বলে রাখি এই পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধ থেকে
যেসব সিদ্ধান্তের জন্ম নিয়েছে তা কিন্তু এখনও স্কুলে পড়ানো হয়। বড় বড়
ইঞ্জিনিয়ারিঙের কন্সট্রাকশন হচ্ছে এই সিদ্ধান্তগুলোকে মাথায় রেখে। তাহলে এই
স্বতঃসিদ্ধকে ভুল বলা হচ্ছে কেন?
তাহলে বলব ‘ম্যান সাইজ ওয়ার্ল্ড’ বলতে আমরা যা বুঝি সেখানে এটা ঠিকই আছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মাথায় রেখে যদি
বিশাল স্পেস নিয়ে চিন্তা করতে যান তাহলে দেখা যাবে এই সিদ্ধান্তগুলো কোন কাজে আসছে
না। আইনস্টাইনের বয়স যখন মাত্র ষোল বছর তখন তাঁর মাথায় প্রথম যে চিন্তাটি এসেছিল
তা হলো বিশাল স্পেসে একটি ত্রিভুজ কল্পনা করলে তার তিনটি কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের
সমান হয় না কেন? এই নন-ইউক্লিডিয়ান
জ্যামিতির চিন্তা থেকেই তাঁর মাথায় এক সময়ে স্পেস কারভেচারের জন্ম দিয়েছিল যার
সঙ্গে সময় ও গতিকে জুড়ে দিয়ে তিনি বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্ম দেন এবং পরে
নিউটনের মাধ্যাকর্ষণতত্ত্বের অপূর্ণতাকে পূর্ণ করেন।
আমরা ফিরে যাই পঞ্চম সিদ্ধান্ত প্রমাণের চেষ্টার
বিফলতা ও সাফল্যের ইতিহাসে। এই স্বতঃসিদ্ধকে প্রমাণের প্রথম প্রচেষ্টার যে ইতিহাস
পাওয়া যায় তা পঞ্চম শতাব্দীতে। যতটুকু জানা যায় এর সূত্রপাত করেছিলেন প্রক্লাস (Proclus) যিনি ৪১০ খ্রিস্টাব্দে গ্রিসেই জন্মেছিলেন।
প্রখ্যাত এই লেখক ব্রহ্মবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করেন যদিও পরে যখন তিনি গ্রিক
জ্যামিতির ইতিহাস লিখতে শুরু করেন তখনই ইউক্লিডের ‘এলিমেন্ট’ গ্রন্থের পঞ্চম
সিদ্ধান্তটি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শেষ পর্যন্ত এর একটি প্রমাণও তিনি দাখিল করেন
বটে যা পরবর্তীকালে খারিজ হয়ে যায়।
প্রক্লাসের পর বহু শতাব্দী পার হয়ে যায়
যে সময়ে কেউই আর এ নিয়ে মাথা ঘামাননি। ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস ও জাতিকলহ ইউরোপের
জ্ঞানচর্চাকে গ্রাস করে রেখেছিল বহু শতাব্দী ধরে। তাই প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার পর
চতুর্দশ শতক পর্যন্ত ইউরোপে সেরকম জ্ঞান চর্চা হয় নি। তবে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি
সময়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন ওয়াসিম এই স্বতঃসিদ্ধকে প্রমাণের চেষ্টা
করেন। তিনি এই স্বতঃসিদ্ধকে প্রমাণ করতে গিয়ে নিজের একটি অনুমানকে স্বতঃসিদ্ধ
হিসেবে ধরে নেওয়ায় গণিতের জগতে তার এই প্রমাণ গ্রাহ্য হয় নি। এরপর দেড়শ বছরেরও
বেশি সময় ধরে অনেকেই এই স্বতঃসিদ্ধকে প্রমাণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হোন।
যারা ব্যর্থ হয়েছিলেন তাদের এই ব্যর্থতা
যে কতটা মর্মান্তিক ছিল তা ফুটে উঠেছে ফারকাস বলিয়াই (Farkas Bolyai) নামে এক হাঙেরিয় গণিতজ্ঞের তাঁর ছেলেকে
লেখা একটি চিঠিতে। এই চিঠিতে তিনি তাঁর ছেলে জেনসকে সমান্তরাল-রেখার এই সমস্যাটি
নিয়ে মাথা ঘামাতে বারণ করছেন। এই মায়ামৃগের পেছনে ছুটতে ছুটতে তিনি নিজে সব
খুইয়েছেন। অন্ধকার এক অন্তহীন গলির মধ্য দিয়ে ছুটতে ছুটতে তাঁর জীবন শুকনো
মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। জীবনের সব সাধ আহ্লাদকে বিসর্জন দিয়ে শেষ পর্যন্ত
ব্যর্থতার গ্লানি তাঁকে গ্রাস করে ফেলেছিল। পরিণত বয়সে তাঁর মনে হয়েছে স্বয়ং
ঈশ্বরই চান না মানুষ এই রহস্যের জাল থেকে বেরিয়ে আসুক। এ কথা তিনি তাঁর চিঠিতে
লিখেছেন। তিনি জানতেন তাঁরই মতো কত গণিতজ্ঞের জীবন ব্যর্থতায় ভরে গেছে এই মরীচিকার
পেছনে ছুটতে ছুটতে। ফারকাস যখন দেখলেন তাঁর ছেলে জেনসও এই মরীচিকার পেছনে ছুটে চলেছে
তখন তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ১৮২০ সালে তিনি যে চিঠিটি লিখে তাঁর ছেলেকে সাবধান করে
দিয়েছিলেন তার কিছুটা অংশ বাংলায় অনুবাদ করে এখানে তুলে দিচ্ছি।
“...তুমি সমান্তরাল রেখার রহস্য নিয়ে মাথা ঘামিও না। এই পথ পরিহার
কর। আমি এই পথকে চিনি এবং এর পরিণতি জানি। এই পথে চলতে গিয়ে আমার জীবন এক
তমসাচ্ছন্ন রাত্রিতে পরিণত হয়েছে। আমার জীবনের সমস্ত আলো ও সমস্ত আনন্দ নিভে গেছে।
আমি তোমাকে ঈশ্বরের নামে একান্ত অনুরোধ করছি তুমি সমান্তরাল রেখার রহস্যকে একাকী
থাকতে দাও। এর কাছ থেকে তোমার ততটাই দূরে থাকা উচিৎ যতটা উচিৎ ভোগবিলাস ও মদমত্ততা
থেকে দূরে থাকা। এই রহস্য তোমার জীবনের সমস্ত অবসর, তোমার স্বাস্থ্য, মনের শান্তি, বেঁচে থাকার সমস্ত আনন্দ, সব কিছু কেড়ে নেবে। ...”।
মনে রাখতে হবে ফারকাস কিন্তু তাঁর ছেলেকে
মদ খেতে বা জুয়া খেলতে বারণ করছেন না যা বাবারা সব সময়েই করে থাকেন। তিনি বারণ
করছেন গণিতের এক রহস্যের সমাধান থেকে বিরত থাকতে। কারণ ফারকাস জানতেন যে শুধু তিনি
নন, আরো অনেক গণিতজ্ঞের জীবনে নেমে এসেছিল তাঁরই
মত অন্ধকার। এই মোহজাল যে কত ভয়ানক তার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই এই চিঠিটি লিখেছিলেন
তিনি। যাই হোক জেনস (Janos Bolyai)
কিন্তু বাবার কথা শোনেন
নি। বাবার অসমাপ্ত কাজ তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন। এখন প্রশ্ন জেনস কি সফল
হয়েছিলেন? জানতে হলে পরবর্তী
পর্ব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন