।। রজতকান্তি দাস।।
পশুদের বুদ্ধিবৃত্তি ও পশু নির্যাতনের
বিরুদ্ধে আন্দোলন
(C)Imageঃছবি |
অতীত যুগের অনেক ইউরোপীয় দার্শনিকরা মানুষ ভিন্ন অন্যান্য প্রাণীদের
প্রতি ততটা সহানুভূতিশীল ছিলেন না। যেমন আধুনিক দর্শনের জনক দেকার্তে মন ও বস্তুর মধ্যে সমন্বয়
সাধন করতে পারেন নি। তাঁর মতে মন ও বস্তুর মধ্যে আছে সমান্তরাল অবস্থান। তবে এটুকু বলেই তিনি যে
ক্ষান্ত হয়েছিলেন
তা নয়। তিনি আরো বলেন যে মানুষ ও প্রাণীদের মধ্যে তফাৎটা হলো
মানুষের দেহ ও মন দুটোই আছে যেখানে
অন্যান্য প্রাণীদের শুধু দেহই আছে মন নেই। তাই নিষ্প্রাণ বস্তুর প্রতি আমাদের মমত্ব যেমন অর্থহীন,
তেমনি অন্যান্য প্রাণীদের প্রতি মমত্বও তাই।
দেকার্তে সহ আরো কিছু দার্শনিকদের এইরূপ চিন্তাধারা ইউরোপে পশুপ্রেমী সংগঠনের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে
অন্তরায় হয়ে পড়েছিল।
এই বাঁধা দূর করতে ডারউইনের বিবর্তনবাদ বিশাল ভূমিকা পালন করেছে। পশুদের সঙ্গে
আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠায় পশুশ্রম কিংবা পশুনির্যাতনের প্রতি মানুষের সংবেদনশীলতা বাড়তে থাকে
যার ফলে গড়ে উঠে বিভিন্ন পশুপ্রেমী সংগঠন।
বিজ্ঞানীরা একটি মাছের উপর গবেষণা করে দেখেছেন যে মাছেরও স্মৃতিশক্তি আছে এবং
চার সংখ্যা পর্যন্ত গুণতেও পারে। মাছ তো হলো মেরুদণ্ডী প্রাণী যা বিবর্তনের ধারায় অনেকটা এগিয়ে
গিয়েই এসেছে এই পৃথিবীতে। ফলমূলের উপর বেড়ায় এক ধরণের ফলভুক কীট যাদের বলা হয় ‘ফ্রুট ফ্লাই’। গ্রিনস্প্যান নামে একজন বিজ্ঞানী প্রমাণ করেছেন যে এই ফ্রুট ফ্লাইরাও ঘুমোয়।
শুধু তাই নয় এককোষী
জীব প্রটোজোয়ারাও ঘুমোয়।
একদল চিন্তাবিদের ধারণা ছিল যে ‘ভাষা’ জিনিসটা
কেবল মানুষেরই আছে, অন্য প্রাণীদের নেই।
তাদের ধারণাকে নস্যাৎ
করে দিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে অন্য প্রাণীরাও অঙ্গভঙ্গি, স্বরনিক্ষেপণ ইত্যাদি দিয়ে মনের ভাব
প্রকাশ করতে পারে। ডলফিন তো নিজেদের একটা করে নামও দেয় এবং সে নিজে ঐ নামেই পরিচিত হয় ডলফিন সমাজে।
মার্কিন বিজ্ঞানী
হারবার্ট টেরেস এক শিম্পাঞ্জির উপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন যে
শিম্পাঞ্জির শাবককে মানুষের পরিবারে বড়
করলে সে মানুষের মতো অনেক কিছুই করতে পারে। ‘নিম
চিমপস্কি’ নামের শিম্পাঞ্জিটি
১২৪টি শব্দের অর্থ বুঝতে পারতো।
পশুদের গবেট ও অনুভূতিহীন ভাবলে আখেরে আমাদের সুবিধে অনেক। সেক্ষেত্রে তাদের
দাসত্বে নিয়োজিত করে অত্যাচার করলে আমাদের অপরাধবোধের দংশন সহ্য করতে হয় না। কিন্তু বিজ্ঞান
যেভাবে পশু-পাখিদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার
তথ্য তুলে ধরছে তাতে মনুষ্য সমাজেও দেখা গেছে বিভাজন। ডারউইন
তাঁর ‘দ্য এক্সপ্রেশন অব ইমোশনস ইন ম্যান এন্ড অ্যানিমেলস’ বইটিতে যেসব তথ্য তুলে ধরেছেন তারই ফলস্বরূপ গজিয়ে
উঠতে শুরু করেছিল পশুপ্রেমী সংগঠনগুলো। ডারউইনের জীবদ্দশাতেই ইউরোপের পশুপ্রেমী সংগঠনগুলো
বৈজ্ঞানিক গবেষণার
কাজে পশুদের ব্যবহার বন্ধ করার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেছিল।
বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে ‘পশু অধিকার রক্ষা’ আন্দোলন শুরু হয় মার্কিন
মুলুকে। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ‘অ্যানিমেলস,
ম্যান এন্ড মরেলস’ বইটিতে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পশুদের উপর অত্যাচারের তথ্য তুলে ধরা
হয়। ১৯৭৫
সালে পিটার সিংগার পশুমুক্তি আন্দোলন গড়ে তোলেন মার্কিন মুলুকে। এই আন্দোলনের ফলে নতুন
শব্দের সংযোজন ঘটে যা হলো ‘Specicism’ অর্থাৎ
‘প্রজাতি বৈষম্য’। ‘ধর্ম
বৈষম্য’, ‘বর্ণবৈষম্য’,
‘লিঙ্গ বৈষম্য’, ‘জাতি বৈষম্য’ কিংবা
‘শ্রেণী বৈষম্যে’র মতো প্রজাতি বৈষম্য যে একধরণের বৈষম্য, যার অবসান প্রয়োজন, এটা বুঝতে মানব সভ্যতাকে অতিক্রম করতে হয়েছে দীর্ঘ পথ। শুনেছি কানাডায় সরকারি
চাকুরীর ক্ষেত্রে কোন সর্বোচ্চ বয়স সীমা নেই কারণ এটাকে তারা বয়স বৈষম্য হিসেবে গণ্য করেন।
এদেশে বৃদ্ধ বয়সে প্রেম ও বিয়ে করা নিয়ে যে নিন্দা করা হয় তাও বয়স বৈষম্যেরই
ফলশ্রুতি। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক ধরণের বৈষম্যের কথাই শোনা যাবে।
বিশ্বজুড়ে গড়ে ওঠা এইসব পশুপ্রেমী সংগঠনগুলো খেত-খামারে পশুদের অস্বাস্থ্যকর
পরিবেশে সংরক্ষণসহ
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পশুদের উপর অত্যাচার নিয়ে যথেষ্ট সোচ্চার।
পশ্চিমী দেশগুলোতে এই আন্দোলন এখন এতটাই
বেড়ে উঠেছে যে কিছু কিছু সংস্থা পশুদের উপর অত্যাচার রুখতে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। তারা
রীতিমত উগ্রপন্থী।
যেসব বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটারিতে পশুদের উপর নানা ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান তারা এই সব
উগ্রপন্থী সংগঠন নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কারণ তাদের উপর আসছে হত্যার হুমকি। তাদের ল্যাবরেটরি
বোমা মেরে গুড়িয়ে
দিতে চাইছে এইসব সংগঠনগুলো। আমেরিকায় ‘অ্যানিম্যাল
লিবারেশন ফ্রন্ট’-এর নেতা টিম ডালি পশুস্বার্থ রক্ষার
ব্যাপারে সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী। ভবিষ্যতে পশুদের উপর অত্যাচার রুখতে অত্যাচারী
বিজ্ঞানীদের হত্যা করতে
তার সংগঠন পেছ-পা হবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। এইসব উগ্রপন্থী সংগঠনকে
সমর্থন করা যায় না। এই ধরণের অত্যাচার রুখতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনই কাম্য। তথাপি সত্তরের দশকে
প্রায় ১৪০০ বানরকে আমাদের দেশ থেকে পাচার করা হয়েছিল আমেরিকায় পরমাণু অস্ত্রের ক্ষমতা পরীক্ষা
করার জন্য। মারণাস্ত্র
তৈরির জন্য এইসব বানরের উপর তেজস্ক্রিয় পদার্থ প্রয়োগ করে যে
নির্মমভাবে তাদের হত্যা করা হয়েছিল তার
বিশদ বর্ণনা দিতে চাই না। তবে ১৯৭৮ সালে ইন্দিরা সরকারের পতনের পর যখন মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে
জনতা পার্টির সরকার
আসে তখনই পশুপ্রেমী সংস্থাগুলো এই বানর রফতানি বন্ধ করতে সক্ষম হয়।
চার্লস ডারউইন এক বন্ধুকে লিখেছিলেন যে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য
পশুদের উপর অত্যাচার
দেখলে তাঁর গা গুলোয়, বমি বমি ভাব আসে ও
অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডারউইন যখন ঘোড়ায় চালিত গাড়িতে উঠতেন তখন চালকের অবস্থা কাহিল হয়ে
যেত। কারণ ঘোড়াটি
যদি দাঁড়িয়ে থাকে তাহলেও তার পিঠে বেত্রাঘাত করলে ডারউইন গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে সহিসকে
বকাঝকা করতেন। ডারউইন তবু এতটা দেখে যেতে পারেন নি। ডারউইন পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক গবেষণা
যেমন বেড়েছে তেমনি পশুদের উপর অত্যাচার বেড়েছে বৈ কমেনি। তবে পশুপ্রেমী সংগঠনগুলোর আন্দোলনও
বেড়েছে ততোধিক
হারে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যেখানে পশুদের ব্যবহার করা হয় সেখানে বিজ্ঞানের উন্নতির
ফসলেও পশুদের ভাগ আছে বলে বিশ্বাস করে অনেক সংগঠন। ওরাং-ওটাং, গরিলা ও শিম্পাঞ্জিদের মানুষের সমান আইনি অধিকার দেওয়ার জন্যও আন্দোলন করছেন কেউ
কেউ। ওদের দাবি হলো যে এই প্রাণিগুলোর সঙ্গে মানুষের ডিএনএ’র যেহেতু ৯৮ শতাংশই মিল আছে তাই সামান্য দুই শতাংশ অমিলের জন্য ওদেরকে আইনি অধিকার
থেকে বঞ্চিত করা হবে কেন। কথাটা বিবেচনার বিষয় বটে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন