(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার উজান পর্বের নবম অধ্যায় --- সুব্রতা মজুমদার।)
নয়
গীতেশ বিশ্বাসকে বৈতল অন্য কথা জিজ্ঞেস করেছে । সেই তার
পুরনো কথা, দুখু যাকে বলে পাগলামি । নদীর আকৃতি নিয়ে প্রশ্ন । নদী কোথা থেকে আসে
দেখে নি বৈতল, তালগাছ চড়েও ঠাহর করতে পারেনি । তবে একটু জানে খুরাদিল এই বাটির
জন্য শহরের যত দুঃখ । বছর বছর বন্যা । এত উঁচু বাঁধ । জাহাজ ঘাট থেকে এঁকে বেঁকে
অন্নপূর্ণা ঘাটের অদূরে গিয়ে নদীর জল আর বৃষ্টির জলের একাকার । এর পরেই রেল গাড়ির
ঝমঝমি ।
মাছিমপুর শালচাপড়া কাটাখাল পাঁচগ্রাম বদরপুর । একদিকে পাহাড়
লাইন সোজাসুজি করিমগঞ্জ, মহিষাশন । হিন্দুস্থান পাকিস্তান ভাগাভাগি । দুর্গাবতীকে
নিয়ে এক জলের দুপুরে বসেছিল ইস্টিশনে । কখন ছাড়বে করিমগঞ্জের গাড়ি । করিমগঞ্জ থেকে
উল্টোপাকে বদরপুর হয়ে শিলচর । এর আগে বইয়াখাউরি থেকে কইমাছের মতো কানে হেঁটে, জল
সাঁতরে আর ভোরায় ভেসে ওদেশের জল থেকে এদেশের মাটিতে আশ্রয় ।
এদেশে বৈতলের কেউ নেই । কৈবর্তের পুত, ব্রাহ্মণের কন্যা
দুর্গাবতীকে সঙ্গে নিয়ে চলে এসেছে নতুন দেশে । দুর্গাবতী বৈতলকে দিয়েছে নতুন পরিচয়
। বলেছে,
---
তুমি পাটনি থাকলে কৈবর্ত থাকলে তুমার কিচ্ছু নায় । আমার কিতা অইব কও । আমারে তো
কেউ মাইমলের বেটি কইত নায় । একলা পুড়িরে পাইলে মাইনষে নি ছাড়ব কও, দেখছ অউত্ত ।
তুমি আমার কথা রাখো, তুমার বউ অইয়াই থাকমু । খালি তুমি একখান লগগুন লাগাইলাও । কইও
তুমি শর্মা বাবন ।
বেশ তবে তাই হোক ।
কেউ জানে না, হয়ে যায় বিয়ে । স্ত্রীর পদবি নিতে কোন দুঃখ হয়নি বৈতলের । দেশ
ছাড়া মানুষের নামই বা কী, পদবীই কী । তাই গুরুর নামে নাম লেখায় রিফুজি খাতায়,
সৃষ্টিধর শর্মা । একা একা শপথ নেয় । বৈতল আর কোথাও জড়াবে না, কাটিয়ে দেবে গরিব
মানুষের গৃহস্থ জীবন নিরুপদ্রবে । কিন্তু বৈতলের জীবন কখনও সোজা খাতে বয় না । কোনো
শপথ শেষ শপথ হয় না । জড়িয়ে যায় সামাজিক সম্পর্কে ।
বন্ধুতা থেকে শত্রুতার ধারাবাহিকতায় তার নতুন সংযোজন হয় হরিৎবরনের জমিদার যমুনা
প্রসাদ সিং । এছাড়া আসে তার খুশি, খুশির বন্যা, প্রাণের পুত্তলি তার কন্যা মনি ।
যম জমিদারের উপর রাগ করে বৈতল মেয়ের নাম রাখে মরনি । কী জানি কী সন্দেহের বশে
মেয়েকে কোলে নিতেও দ্বিধা বৈতলের । মনের মধ্যেও তাচ্ছিল্য । বৈতলের বাপও তার নাম নিয়ে তাচ্ছিল্য করেছে ।
মায়ের মতো এমন গৌরবর্ণা মেয়ে বৈতল কামনা করেনি । তার সন্তান তারই মতো হবে কালোবরনী
। জন্মের পর থেকেই বৈতল খুটে খুটে দেখে মেয়ের চোখ নাক কান হাতের পায়ের আঙুল, বৈতল
নিজেকে খুঁজে খুঁজে হতাশ হয় । বৈতলের তো সবই বিপরীত, হতাশা থেকেই হয় আনন্দের
সূত্রপাত । সেই মরনি কন্যার ‘র’ আর উচ্চারিত হয় না খুশিতে । সেই মনি মেয়েই এখন তার
হৃদয়ের মনি । জড়িয়ে যায় বৈতল আবার ।
আরো হয়, তিন বন্ধু হয়, হয় বাপের মতো এক বোবা সাধু । বয়সটাও
বাপের মতো, স্বভাবে গুরু সৃষ্টিধরের মতো অবিকল । আবার বিপরীতও অনেকটা । গুরু
সৃষ্টিধরের গলায় সর্বক্ষণ কথা আর গান । তিনি তো কথাই বলেন না, কিন্তু এক উজ্জ্বল
আলো বিচ্ছুরিত হয় তাঁর বিপুল শরীর থেকে । সেই সাধুমানুষকে ঘিরে জড়ো হয় তারা চার
বন্ধু । মামুপিরের খিদমত খাটে চারজন ।
গ্রামের ছেলে বৈতল শহরে এসে হাঁপায় । রিক্সার প্যাঁ পোঁর
যান্ত্রিকতায় বিরক্ত হয় । নিরিবিলি খোঁজে । সন্ধ্যের আঁধারে জাহাজঘাটের দিকে যায় ।
দেশভাগ হওয়ার পর জাহাজ কমে গেছে । মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে কয়লার জাহাজ আসে । বিহারী
দারোয়ান শামুদা বলে,
---
আভি তো কুছু নাহি, শুনশান । আগে জাহাজ কম্পানিতে কিতনা ভিড় ছিল ।
শামুদা নির্জন রাতে বৈতলকে জলের কাছে যেতে দেয় । বৈতল একা
বসে থাকে, বসে থেকে জীবন সাজায় । ফেলে- আসা নদীর সঙ্গে জুড়ে দেয় নিজেকে ।
ভরাবর্ষার উথাল পাথাল সুরমার সঙ্গে নিজেকে মেলায় শরতের এই বরাকপারে । বৈতল গান গায়
গুনগুনিয়ে । মন আনন্দের গানে ইদানীং আর পরিচিতি সুর কাজ করে না । বৈতল এখন নতুন
গান শিখেছে । সিনেমার গান গায় যখন রিক্সা নিয়ে তারাপুর রেল গেট পেরিয়ে যায় তখন
‘তুফান মেল যায়’ কেউ যেন তাঁর গলায় তুলে দেয় । নদীপারের একাকী সময়ে এক নতুন শেখা
গান গায় ‘ছিরু ভীরু পায় পল্লীর বালিকা বনপথে যায়’ । সুরের যাদুতে পাগল হয়ে যায়
বৈতল । একদিন দুখুও শোনে তার একা সময়ের গান । দুখুর কাজ তো শুধু বৈতলের খুঁত ধরা ।
বলে,
---
‘ছিরু ভীরু’ কিতা বে । ইতা কিতা গান ।
---
অইব কিচ্ছু, সুর ভালা লাগলে অত অর্থ খুজন লাগে না ।
---
তর পুথির গান থাকি একেবারে আলেদা । তুইন হিন্দু গান গাছ না কেনে । ‘পয়গাম’ আর
‘ইনসানিয়তো’ বউত ভালা ভালা গান আছে ।
---
অখন গাইমু । শ্রীমঙ্গল চা বাগানো শুনছি হিন্দি মাত আর অউ ইখানো আইয়া ইটখলাত ।
পুদুম, চেম, নুনুয়া কত কিছিমর নাম তারার । সিলেটর বাগানো অত নামর বাহার নাই । সাত
দিনর নামে নাম । শুক্কুরবারে জন্মাইলে নাম রাখি দেয় শঙ্কর ভোলা নায় রামচন্দ্র ।
এগুর নাম আছিল জানছনি মঙ্গালাল, তে তার বৌরে টিল্লাবাবু এ জিগাইছইন মরদর নাম কিতা
। হায়রে কপাল, বেটি ইগু মরি যায় শরমে, আবার টিল্লাবাবুরে নাম না কইলেও নায়, তখন
কছাইন দেখি কেমনে কইল জামাইর নাম ।
---
জানি জানি । ইশারা করি কই দিছে আরি ।
---
অয়, তর মগজ ইগু হইল নাগেশ্বরর ছিয়া, সব জানে, জানতে জানতে ছাতু করিলায়, অলাখান
ভুতা । কইল কিতা জানছ নি, কইল, তলব দিনে লাল লাগাইকে । অখন বুঝিলাও । মঙ্গলবাড়ে
তলব দিন । তেউ মঙ্গলের লগে লাল, মঙ্গালাল ।
দুখুর মত না নিয়ে বৈতল কোনো কাজ করে না, আবার দুখুর সঙ্গেই
লাগ সব থেকে বেশি । দুখুর ওস্তাদি বেশি, সব কিছুতেই শেষ কথা বলবে দুখু । বৈতল
মানবে কেন । তাই খটাখটি ।
বৈতলেরও এক রগ তেড়া । চুরি করবে ডাকাতি করবে তবু কারো দয়ার
দান নেবে না । হরিৎবরণ ইটখোলার জমিদারের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে ফিরিয়ে দেয় গোঁয়ার্তুমি
করে । দ্বিতীয়বার মেনে নেয় । মেহেরপুর রিফ্যুজি শিবির থেকে হরিৎবরণে চলে আসে
দুর্গাবতীকে নিয়ে । যম সিং বলেছে থাকতে দেবে, ঘর দেবে পুকুর পারে ঘরের দুয়ারে ।
দুর্গাবতীকে জমিদারের ঠাকুরঘরে ব্রাহ্মণীর কাজ করবে । আর বৈতল । বৈতলের
প্রতি কৃতজ্ঞতায় তখনও ঠিক করে নি উপযুক্ত কাজ । তাই নতুন বাড়িতে এসে এদিক ওদিক
ঘুরে, পুকুরে ডুব দেয় । হপ্তায় একদিন গিয়ে ডোল নিয়ে আসে মেহেরপুর থেকে । একেবারে
তো নাম কাটিয়ে আসেনি । বৈতলের মন মানে না বদ্ধ জীবনে । অফুরন্ত জল না থাকলে, গায়ে
মাছের গন্ধ না থাকলে কেন সে পাটনির পুত । বৈতল দুর্গাবতীকে বলে দেয় এখানে মন টিকবে
না । দুর্গাবতী মানে না । বলে,
---
আর ফিরতাম নায়, পানিত ভাসি থাকতাম নায় আর । আলাদা জীবন অখন ।
বৈতলের
আপত্তি নেই । কিন্তু কী হবে তার জীবিকা । তার পরিচয় কী । দুর্গাবতী ব্রাহ্মণীর পতি
হয়ে থাকা শুধু । কর্মহীন জীবিকাহীন, পত্নীর উপর নির্ভরশীল । বৈতল বিদ্রোহী হয়, জল
ছাড়ে না, চলে যায় চাতলার পারে । হাওরের পাশে গ্রাম রাজপুরে, রাজপুরের কৈবর্ত
রবিলাল বৈতলকে বলে সরকারি জমির কথা । মাছ মারবে, হাঁস পালবে ছাগল পালবে । ওখানে
পশুপালন করে অনেকেই সচ্ছল হয়েছে । বৈতলের মারও শখ ছিল হাঁস ছাগল পালনের । মা বলে,
‘হাসে উনা কইতরে দুনা, ছাগলে পিন্দায় কানো সুনা’ । সোনা পরেনি মা, চান্দকপালিকে
ঘরে এনেছে । মা মরে গেলে বাপ বেচে দিয়েছে সৌভাগ্যের গাভীটি । বেচে দিয়েছে না যৌতুক
দিয়েছে যুবতি বৌ –এর লোভে । সেই বাপও শখ পূরণ না করে মরে যায় এক দুর্যোগের রাতে,
গাছ মাচান এর উপর । বৈতল টঙএর উপর বসে বসে দেখেছে জলের দৈত্য বাপের জলে পড়ে
হাবুডুবু খেতে খেতে মরে যাওয়া । হিসেবি জীবনে অভ্যস্ত নয় বৈতল, জীবজন্তু নিয়ে আয়
দ্বিগুণ করা কিংবা কানের সোনা কল্পনাও করে না । বরং রবিলালের সঙ্গে হাওরের জলে মাছ
মারতেই তার আনন্দ । রবির সঙ্গে ভাগাভাগিতে ভার বয়ে নিয়ে যায় ফাটকবাজার । রবিলালের
পাশে বসে । দেখে দোকানদারি । ভাগা করে মাছ বিক্রি করে রবি, টুকরির ডালা উল্টে
মাছের ভাগা করার অনেক কেরামতি । গ্রাহক ঠকানোর অনেক কল জানে
রবিলাল । উল্টো ডালায় অল্প মাছে ভাগা বড় দেখায় । বৈতল বিরক্ত হয় রবির কার্যকলাপে ।
তবু শোনে রবির কথা । রবিলাল বলে,
---
ঝলঝলা তাজা মাছ দিবে উপরে, আর তলে জাবড়া জুবড়া পচামাছও দিতে পারছ ।
---
অয় গাউক তর মতো আড়ুয়া বেভুতা নি । লাড়াই চাড়াই কিনব । একদিন নি বেচতে, পররদিন নি
আইব কেউ ।
---
আইব, আমার কাছে আইব আমি নু লাগাই দেই । ফাউ দিলাই লে অউ খুশি অই যায় ।
---
বুঝছি ঠগাউরা অইচছ তুই । অখন তর বাং উং ভার ডালা ইতা দিলাইছ আমারে কয়দিনর লাগি ।
আমি দেখি বেচতাম পারিনি ।
---
তুই কিনিলাছ না কেনে । তরে দিলে আমি লিতা করমু ।
---
তুই মাছ মারবে, আমি বেচমু, পয়সা তোর ।
--- অয়
পয়সা তোর । তারপরে আমার ভার ভাগলে । রিফুজি হকল অখন খুব
ঠগঠগামি কররা ।
---
তুই আমারে ঠগ কইলে নি । ঠিক আছে, দেখিছ আইজ অউ দেখিছ । ভার লইয়া আর রাজপুর ফিরতে
না । ঠেং ভাঙি রাখি দিমু তোর ।
মাছুয়ার
সঙ্গে একটু মস্করা করার জন্যই বৈতলের কথা বলা । বলেই হেসেছে । ও হরি, এমন ভিতু
মানুষ বৈতল দেখে নি জীবনে, বৈতলের কথায় গাট্টা গোট্টা মানুষটা ভ্যাঁ করে কেঁদেই
দেয় । কিছু বলে না শুধু কাঁদে । এরকম ভিতু, ছইতে –মরা মানুষ বৈতলের পছন্দ নয়,
কোথায় প্রতিরোধ করবে, উল্টো বৈতলের ঠেং ভাঙার শাসানি দেবে তবে না জলের সৈনিক ।
বৈতলের বন্ধু । লড়াই লড়াই ভাব না থাকলে কিসের পাটনি কিসের কৈবর্ত । আর বৈতলকেও তো
জানতে হবে, বন্ধুর স্বভাব না জেনে শুধু কাঁদলে হবে । বৈতল জানে বন্ধুত্বের প্রথম
ধাপই হলো লাগালাগি । অকারণ ঝগড়া । গায়ে গা লাগিয়ে পায়ে পা লাগিয়ে শত্রুতা । লড়াই
করে টিকে থাকতে পারলে দোস্তি, ইয়ারি । লুলা পারে । প্রথম দিনই মিরতিঙ্গার পাহাড়
থেকে বৈতলের লাথি খেয়ে পড়েছে নিচে । খিত্তা গাঁও এর বাঙাল কিশোর উঠে দাঁড়িয়ে
বৈতলের বিরুদ্ধে ‘তাও’ নিয়েছে, তারপর হেসেছে । হয়েছে প্রাণের মানুষ । গুরু
সৃষ্টিধর মানেন বৈতলের বুদ্ধি । বলেন,
---
যারে ভালা লাগে তারে একটু বাজানি লাগে । খালি মিঠা কুনু ভালা নি । পেট মাতলাইব,
মধুমেহারি অই যাইব মনো । এর লাগি কিছু তিতাও খাওয়ানি লাগে । তিতাবাখরর ছাল জিবরা
দিয়া ঢুকলে নাড়িভুড়ি বারই যায় । কিন্তু
শরীর ঠিক রাখে । আমি তো আমার মনসা মাই হকলর লগে অতা করি ।
খালি লাগি । যারে ইচ্ছা কান্দাই দেই । ছোটজনরে কইলাম, তুমি যে অত কালা, তুমারে কেউ
ঘরো নিত নায় । মাইঝলা জনর চুল ধরি এমন টান দিলাম যে তিন দিন ধরি কান্দরা । হেসে
বুঝছি ইতা কান্দা নায় আমারে কান্দানির ফন্দি । আদর করতাম গিয়া । বাপ
আইছইন, বাপ আইছইন তানে ডরাও, ইলাখান কুনু ভালা নি কও ।
কান্নাকাটি ব্যাপারটাই পছন্দ নয় বৈতলের । রবিলাল যে তাকে
এমন অপ্রস্তুত করবে ভাবেনি বৈতল । বৈতল চেয়েছে রবির বন্ধুত্ব । নইলে ছোট ছোট এসব
কুয়ার সমষ্টি চাতলার হাওরে যাওয়ার কোনও ইচ্ছেই তার নেই । হাকালুকি আর বড় হাওরের
পরাণকাড়া হাওয়ার কাছে চাতলা কিছুই না । জল থেকে যদি মায়ের আদরের মতো হাওয়া না
বেরোয় তাহলে কী জলাশয় । ছোটমাছ ভাগা করে বিক্রি করার মানুষ যে নয় বৈতল, রবিলাল
বুঝতেই চায় না । অকারণ ভয় পেয়ে যায় । যাক, ভালই হয়, তৈরি হওয়ার আগেই খুলে বেরিয়ে
আসতে পারে বৈতল নতুন গ্রন্থি ।
বৈতলের মন এখন আর বিল হাওরে মজে না । এখন সে নদী আর তার
অবিরল জলধারার রহস্যে মশগুল । কোথা থেকে আসে নদী, তৈরি করে জনপদ । মানুষ কি নদীর
টানে আসে না নদী টানে মানুষকে । বৈতল জানে ভালবাসার কথায় শুধু জট লাগানো আর জট
ছাড়ানোর খেলা । মানুষ আগে না নদী আগে, এসব কথার জবাব হয় না, তবু মন কথা বলে । নদীর
সদাই চলা দেখে ভাবুক হয় মন । বৈতলের মন ও সদা চলমান । তাও তো বৈতল থামে, আবার চলে
। সিলেটের গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরেছে, থেমেও থেকেছে । আবার চলেছে, ফিরে এসেছে
বইয়াখাউরি । তার জন্মভূমি । একদিন জন্মভূমি জন্মজল ছেড়েও চলে এল বৈতল । দুর্গাবতীর
হাত ধরে মেহেরপুর রিফ্যুজি ক্যাম্প । ক্যাম্প ছেড়ে ইটখোলা, হরিৎবরণ জমিদার বাড়ি ।
নদী কিন্তু চলেছে অবিরাম । আর আশ্চর্য এক নদী, একই শহরে নদীর উজানভাটি । এদিকে
তাকাও উজান ওদিকে ভাটি । এদিক ওদিক নদী দিয়ে সুরক্ষিত শহর
কি আছে কোথাও । সুরমা গাঙকে বৈতল জেনেছে শুধু তার নিজের নদী, সিলেটের আপন নদী, তার
সুনামগঞ্জে সুরমা শুধু ভাটিতেই বয় । কিন্তু সুরমার উজানেও যে আছে অন্য এক নদী বৈতল
দেখেনি আগে । সুরমার ভাটির কথা বলেছেন শুধু গুরু সৃষ্টিধর । গুরুর কথায়,
---
সব নদী অউ সাগরো যায় । সব নদী অউ মানুষের মতো, খালি আউগ্গায় । থামে না, শেষে গিয়া
ঝপ করিয়া সাগরো পড়ে । অউ অইল মৃত্যু । মৃত্যু কিন্তু শেষ নায় রেবা, আবার এক আরম্ভর
লাগি সাজিয়া গুজিয়া বই থাকা ।
গুরু সৃষ্টিধর বড়াইল পাহাড়ের কথা বলেননি বইতলকে । গুরুর ভয়,
যদি উৎসবের টানে শিষ্য বেরিয়ে পড়ে । গুরুর ভয় শুধু ভালবাসার আঘাত । অগেরস্থ গুরু
ভরসা ভাবেন বৈতলকে । পঞ্চকন্যার একজনকে দান করার ইচ্ছা থেকে বৈতলকে ধরে রাখার টান
। সদা চলমান বৈতলকে ধরে রাখবে কে । গুরুর হাত ছেড়ে পালায় বৈতল । পালিয়ে চলে এল
জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে দেখা সুতোর নালীর মতো নদীর কাছে । নদীর উৎসেরও কাছাকাছি এখন ।
চোখ মেলে দেখে বড়াইল পাহাড়, পাহাড়ের কোন গুহা থেকে জানি বেরিয়েছে এই সুতার নালী,
হঠাৎ জলরাশি হয়ে জড়িয়ে ধরেছে বৈতলের নবীন শহরকে । বৈতল একদিন পৌছে যাবে নদীর
জন্মস্থানে । বরাকোত্তরীতে গিয়ে গুরুর পায়ে এক অঞ্জলি জল দেবে । বলবে,
---
খালি মৃত্যু নায়, জন্মও আসল ।
জন্ম ও মৃত্যুর মাঝামাঝি বসবাসের সময়কালে নদীর বিভঙ্গ
বৈতলকে আকৃষ্ট করে । নৃত্যপরা রূপ থেকে কত যে মুদ্রার বিচ্ছুরণ । সেই আকর্ষণেই
বন্ধু দুখুর সঙ্গে তার লড়াই । লড়াই করতে করতে কত রকম আকারে যে সাজায় শহরবাসী নদীকে
। গুলতির বাঁট, খুরাদিল বাটি এমন কি চাঁদের আকৃতিতে সাজাতে সাজাতে বন্ধুত্বকে দৃঢ়
করে । হেডমাস্টার বলে ঘোড়ার নাল, বৈতল জানে সব কল্পনারই এক সত্য থাকে । দেখার সত্য
আর কল্পনার সত্য মিলেই তো সৃষ্টি; নতুন দেখা । দুখু বছই আপদ যোগেন্দ্রদ্দা লাখুদা
হেডমাস্টার বৈতল সবার দেখা এক এক করে নতুন চোখের দেখা । একা মানুষের বুদ্ধিতে
কতটুকু আর সুন্দর থাকে, সবাই মিলে যে সুন্দর সাজায় সেই তো আসল । মানুষ একা থাকার
জন্য ঘরবাড়ি সাজায় না, একলা থাকার জন্য ধর্মকর্ম করে না, মানুষ একা থাকার জন্য
সমাজ সাজায় না । জন্ম থেকে মৃত্যুর মাঝামাঝি সময়টাকে সহনীয় করতে মানুষ সুন্দরকে
ডাকে । মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ সুগম করে । ভাটির পথে নামে । ভাটি মানে যদি
অবধারিত পরিণতি পথ হয় তাহলে কেন দুপার উর্বরা করার এই শ্রম । বৈতল গুরুর কাছ থেকে
জেনেছে নদীর শিক্ষা । মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ সাজায় নদী, খৈ ছিটিয়ে যায়
নিজেই । মৃত্যুকে জয় করার সব উপকরণ রেখে যায় উপত্যকায় । এক ছুতার মানুষের
সান্নিধ্য বৈতলকে অনেক কিছু শিখিয়েছে । গুরু সৃষ্টিধরও তাই হৈ চৈ করে বেঁচেছেন ।
আট আনা রোজগার করে এক টাকা খরচ করেছেন । বলেছেন,
---
তুমি দেখাত দেখরায় আট আনা । আমার মনর মাঝে নু কোটি টেকার সিন্দুক ।
মনের
সিন্দুক খুলে গুরু টাকা বের করেন একা একা । কেউ থাকে না সঙ্গে । মনসামঙ্গল গাওয়ার
জন্য সৃষ্টিধর ওঝা ঘোরেন সারা সিলেট । সাকরেদ বৈতলকেও থাকে সঙ্গে স্বাধীনতার মিটিং
মিছিল, তেভাগার আন্দোলনেও সবার সঙ্গে । নিয়ম করে কখনও দেবতাঘরে যেতে দেখেনি বৈতল
গুরুকে । কিন্তু তিনি একবার দিনের শেষে নিয়ম করে কোথায় যেন হারিয়ে যান । বৈতল ভাবে
গুরুর ভর হয় । বৈতল ভাবে সিন্দুক খুলে টাকা বের করেন । গুরু বলেন,
---
না রেবা খালি বার করলে অইব নি । সিন্দুকো না জমাইলে বার করমু কেমনে । দিনো একবার
একলা হওন লাগে । নাইলে তো আরি, রান্দা, বাইশর লাখান অস্তর অই যাইবায় । একটু
স্বার্থপর না অইলে আর মানুষ অইলাম কেনে । ঔ সময় দেখবায় মগজেদি জ্যোতি বার অইব ।
বৈতল জ্যোতির দেখা পায় নি । বৈতল চেষ্টা করেও একাকী থাকার
সুফল পায়নি । লুলার সঙ্গে, দুর্গাবতীর সঙ্গে, দুখু আপদের সঙ্গে, মামুপীর
হেডমাস্টার সবার সঙ্গে থাকতেই বৈতলের সুখ । নতুন বান্ধবহীন দেশে রবিলালের সখ্য না
পাওয়ায় একবার একাকী হয় বৈতল । মিরতিঙ্গার টিলায় যেমন তার পাথর, তেমন পাটপাথরের
খোঁজে অভয়াচরণ ভট্টাচার্য পাঠশালার মাঠে বসে থাকে একাকী । আর এস এন কোম্পানীর
জাহাজঘাটার সন্ধ্যায় ‘ছিরুভিরু পায়ে’র শব্দ শোনে । বরাক নদীর উপর নির্মীয়মান পুলের
উপরমুখী নির্জনতা থেকে হারিয়ে যায় আকাশনীলের কুলুকুলু ডাকে । সন্ধ্যার ঘনায়মান
অন্ধকারে আলো নেই কোথাও, কিন্তু আভাসে বোঝা যাচ্ছে পাথরের পুল উঠে যাচ্ছে গগনে,
নদীর উপর থেকে সোজা গিয়ে থেমেছে, আকাশের গায় । নাকি আকাশ থেকে নেমেছে আকাশগঙ্গা ।
বৈতল দেখে বাঁশের বেড়া পুলের উঠতি পথে, আগাছার জঙ্গলে পরিত্যক্ত নির্মাণ । ঝোপঝাড়
আর বেড়া পেরিয়ে পুলে ওঠা কঠিন কাজ নয় বৈতলের । তেলাল শরীরে গতি আনে বৈতল, বেড়া
জঙ্গল পেরিয়ে মেচি বাঘের ক্ষিপ্রতায় অসমাপ্ত পুলের উপর দৌড়য় বৈতল, পেরিয়ে যায় এক
নম্বর দুনম্বর খুঁটি । ভাবে এ কেমন পুল, শুধু উঠছেই উপরে । বাঁশের হাকম দেখেছে
গ্রামের ছড়ার উপর বইয়াখাউরির হাতলহীন হাক্ম দেখে অভ্যস্ত বৈতলের চোখ বিস্মিত হয়
সিলেটের লোহাপুল দেখে । সুরমা নদীর উপর এই বিশাল পুল দেখে বলেছে, বাপরে বাপ । বরাক
নদীর উপর পাথরের পুল এত লম্বা না হলেও চওড়ায় বড় । বৈতল শুধু উপরেই ওঠে । তিন চার
নম্বর খুঁটির নিচে বসে বলে, আঃ কী আরাম । এমন সুখের ঠাঁই কোথাও খুঁজে পায় নি শহরে
। কিন্তু কোথায় নদী, অন্ধকারে কিছুই বোঝা যায় না । ঐ দূর কালীবাড়ির দিকে নদীর
জলরেখা চিকচিক করে আলোর প্রতিফলনে । নদীর সুবাতাসে আকুল হয়ে মনে পড়ে তার ফেলে –আসা
একাকীর সাম্রাজ্যকথা । প্রথমেই মনে পড়ে মিরতিঙ্গার টিলা পাহাড়, তারপর একে একে সব
বিল হাওর চুনা পাথরের টিলা, পিয়াইন সুরমা কুশিয়ারা । বরাক নদীর পারের মানুষের বড়
ভূতের ভয় । জল আর জঙ্গলময় শহরে শেওড়াগাছের ঘন ছায়া অন্ধকারে কলাগাছের দীর্ঘ পাতাকে
ডাকে আয় আয়, পাতা বলে সরসর । দুখু এসব গাছভূতের কথা শোনায় বৈতলকে । বলে,
--- দেখছি কুনুবাড়ির ঘসামাজা থালবাটিত কিচ্ছু খাইছ না ।
---
কেনে বে ।
---
ইখানো মাইনষে ভূতর ভয়ে রাইত বার অইননা ।
---
তে কিতা করইন ।
---
অখন বুঝিলা । তেও যদি না বুঝছ খাওয়ার সময় বর্তনর গন্ধেউ বুঝি লাইবে ।
সন্ধ্যের
পর তাই আধখানি পুলের ধার ঘেঁষে না কেউ । খেয়াঘাটে তখন সাহেব ভূতের মোচ্ছব হয় ।
সাদা রঙের সাহেবরা এসে জড়ো হয় পুলের উপর । সাহেব ভূতের
জন্যই নাকি পুল সম্পূর্ণ হয় না । রাতের বেলা ভারিরা আসে হাজারে বিজারে । কত রকমের
খাবার আসে কেক পাউরুটির বাখরখানি রুটি গরু শূয়োর মুরগির মাংস আসে কাছাড় ক্লাব থেকে
। চিনামাটির বড় বড় বোতলে বিলাতি মদ আসে জন স্মীল থেকে । সদরঘাটে সারসার গাড়ি জমে
থাকে সারারাত । জুড়িন্দায় পারাপার হয় সাহেব মেমে ভর্তি গাড়ি । ঘোড়ায় চড়ে আসে
লাবকের ডাক্তার । বৈতল তাই ঘাপটি মেরে বসে থাকে বিলাতি ভূত দেখতে । দেখার হাওরে,
বড় হাওরেও ভূত আছে শুনেছে মায়ের কাছে । মা বলে,
---
দেওলা ।
বলে,
---
দেখিছ, একদিন আমারেও দেওলায় নিব ।
মাকে দেওলায় নেওয়ার ভয় নিয়ে বড় হয়েছে বৈতল । সন্ধ্যে হলেই
মাকে আগলে আগলে রাখে । হাওরমুখো হতে দেয় না । বাপের মুখ যেদিন ছোটে, সেরাতে বৈতল
মাকে ছাড়ে না এক মুহূর্তের জন্য । নৌকোর কাছি খুলে বাপ যে – রাতে ডাকে, বৈতল
প্রমাদ গোনে । একাকী মাকে রেখে যায় কী করে । বাপের কথাও অমান্য করে না বৈতল । বাপ
বলে,
---
হেই বৈতল, পানিত লাম ।
নেমে যায় বৈতল
বাপের সঙ্গে পানি খেইড় খেলতে । সারারাত ধরে মাছ ধরার খেলা । জল খেলার রাতে বৈতল
বাপের সঙ্গেও খেলে । বন্ধু লুলাকে ডেকে আনে । বলে,
---
মারে দেখিছ ।
বৈতল মাকে শেষ দেখা দেখতে পারেনি । লুলা দেখেছে । লুলা
করেছে সন্তানের কাজ । সর্পদংশনে মৃত মায়ের সৎকার । মাকে নিয়ে লুলার সঙ্গে হিংসার
সম্পর্ক বৈতলের । মা আবার তাদের জুড়েও রাখে । বলে,
---
রাম জন্মাইতে বেটা রইম । দেখিছ ছাড়াছাড়ি অইছ না ।
সেই
লুলার শ্বাসনালী টিপে মেরে ফেলে দিয়েছে বৈতল ক্রুদ্ধ পিয়াইন এর জলে । ছাড়াছাড়ি হয়
জীবনের মতো । লুলার যে বুদ্ধিনাশ হয় । লুলা কেন মরে, এখনও হিসাব মেলাতে পারে না
বৈতল । লোকে বলে লুলা বেছে বেছে হিন্দু মেয়ের
সর্বনাশ করে, ধর্মনাশ করে । বৈতল জানে লুলা ওরকম নয় । লুলার মনে মলিন রঙের সব দুঃখ
। লুলার মা নেই । বাপ নতুন মাকে নিয়ে চলে যায়, লুলা বড় হয় নানার কাছে । বৈতলের
মাকে মা পেয়ে লুলা হাসে । সেই মাও একদিন চলে যায় আচমকা । বৈতলও নেই বইয়াখাউরি,
মনসাপুঁথি শেখাতে রেখে এসেছে বিয়ানিবাজারের রইদপুয়ানি গ্রামে । কালো রঙের
পেচকুন্দা পাখির সঙ্গে জড়িয়ে যায় বৈতল গুরুগৃহে । গুরু সৃষ্টিধরের কনিষ্ঠা কন্যাকে
যখন ছেড়ে যায় তখন দেরি হয়ে গেছে । লুলা বইয়াখাউরি ছেড়ে চলে গেছে পাগলা । লুলা
কবিগান লিখতে শুরু করে । সুর করে পড়ে গ্রামের হাটে বাজারে । লুলা নাম পাল্টে হয়
দিলবাহার বাঙ্গাল । বৈতলকেও বলে নতুন নাম দেবে সুখবাহার । বৈতলের টানেই লুলা ফিরে
আসে এনায়েৎপুর কবরখানায় । সব হারিয়ে বরাকপুলের চারনম্বর খুঁটিতে বসে বৈতল বুক
চাপড়ায় একা একা । অশরীরী লুলাকে বলে,
---
কৈ দিলে বেটা । নাম দিলে না, সুখও দিলে না, গেলেগি । মার কথা রাখলে না, মায় কইছলা
ছাড়াছাড়ি অইছ না । এক বেটির লাগি মরি গেলে । দুর্গার উপরেউ তর চউখ পড়ল কেনে । দুর্গায় তো তোরে চাইত না । তে কেনে
হাত দিলে তাইর গাত । দুর্গা কথার অর্থ জানছনা বেটা । দুর্গার গাত যখন হাত দিচছ তর
বিনাশ তো অইবউ ।
নির্বান্ধব শহরে এতসব কথার মাঝে কি চোখ দিয়ে টপটপ জল ঝরে
বৈতলের । বৈতলের চোখ চুনাপাথরের থলা, জলের কোনও উৎস নেই । বৈতল কৃতকর্মের জন্য
অনুশোচনা করে না । কিন্তু বুক ফাটে মাঝে মাঝে । বুক খুলে দেখায় না বৈতল । তবু দেখে
তিনজন । অন্ধকারের অতিথি আরো তিনজন তখন চারের উল্টো খুঁটিতে । গাঁজার আসরে বসে তিন
ভূতশরীর । বেয়াদব দখলদারের উপর রাগে ওরা ।
তিনজনের মধ্যে বেঁটে লোকটাই দুখু । দুখুই ন্যাকড়া জড়ানো
চিলিম বাড়িয়ে দেয় বৈতলের দিকে । সন্দেহের চোখে দেখে, বৈতল জানে, বাট্টি হারামজাদার
লাট্টি । সাবধান হ্য় । শুকনো নেশার মৌতাতে না করতে নেই, তাই নেয় । কয়েকটানে পেটভরা
ধোঁয়া নিয়ে চুলু ঢুলু চোখে বলে,
---
ইতায় আমার কিচ্ছু হয় না । আমার লগে কানা পয়সাও নাই যে বেহুশ করিয়া লুটি লাইবায় ।
খাওইয়াইছ, বালা করছ । আমিও খাওইয়াইমু একদিন । কও কুনদিন খাইতায় ।
---
আমরা রুজঅউ খাই ।
---
আমিও খাই । তে ইতা নায় । আমি মালা খাই ।
---
মালা কিতা । পানি নি । শরাব ।
---
না, না । মউয়া চিনো নানি ।
---
মউয়া ।
---
অয় আমিও চিনতাম না । তে ইখানো আইয়া জমিদার বাড়ির উঠানো দেখলাম মস্তবড় এক গাছ ।
সাদা সাদা গুটার লাখান ফুল । খাইলে নিশা হয় । আমার বউএ গাছর তলে যেতা পড়ি থাকে
ইতার মালা করিয়া শুকাইয়া রাখি দেইন । আর আমি যখন রিক্সা লইয়া রাইতর টিপো যাই, তখন
মালা থাকিয়া ফুল ছিড়িয়া খাই । কী মজা লাগে । পেডেলর আগেউ গাড়ি ছুটে ।
---
ধুর বেটা পগার পগা । তর বাড়ি কই । কোন জমিদার বাড়ির কথা কইরে ।
---
বৈতলরে পগা উগা কইছ না । মারি ফালাই দিমু কইলাম, তিনটায় মিলিয়াও কিচ্ছু করতে পারতে
নায় । অখন গাইঞ্জা খাওয়াইচছ, কিচ্ছু কইতাম নায় । যদি লাগতে চাছ, কাইল আইছ, হরিৎবরণ
জমিদারিত । দেখাইমুনে মউইয়ার তাকত ।
---
বাক্কাউ দেখি শুক্কুর মামুদর পুত । তিন টানেউ বেটা হাতেমতাই ।
---
কইলাম যে ইতার আমার কিছহু হয় না । আমার আসল নিশা পানি ।
---
পানিও খাচ নি বেটা । অত পয়সা পাছ কই । জমিদারে দেয় নি
পেদারে ।
---
জমিদারে কেনে দিত । আমি কাম করি নানি । আমার রিক্সা আছে । আরো কাম আছে । রাইত টিপ
মারলে বহুত পয়সা ।
সব উল্টোপাল্টা হয় । নেশাড়ু তিনজনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন
খুলে দেয় বৈতল । ইশারায় জানায় তার সব কথা । বুঝলে বোঝ, কাছে এসো । দোস্তি করো ।
দেশ ছাড়ার পর তো বিশ্বাসের মানুষ পায়নি । অন্ধকারের তিন চুতরা পাতাই সই ।
বইয়াখাউরির একমাত্র বদমতলবি মানুষই হলো বৈতল । আর সব ভাল । বন্ধু লুলা ও সহজ সরল । বৈতলের
পাল্লায় পড়ে সিলেট জুড়ে ধূর্তামি করে বেড়িয়েছে । তখন তো একটাই দেশ, সবাই মিলে মিশে
থেকেছে নিজের নিজের ভিটেয় । এখানে স্থানীয় মানুষ আর ভিটে ছাড়া মানুষে হয়েছে
রেষারেষি । সব শয়তানি শিখেছে । খাদ্য আর বাসস্থান এখন সহজলভ্য
নয় । ভালমানুষিতেও কাজ হয় না । রিফ্যুজি না হয়েও অনেকে ক্যাম্পে নাম লেখাচ্ছে । চাল
ডাল নগদ টাকায় ডোলের সন্ধান পেয়েছে । তাই বৈতল একটু মেজাজ দেখায় ।
মারামারির ভয় দেখায় । মানে পুরোপুরি বিশ্বাস নেই এখনও । কিন্তু বৈতলের পছন্দ হয়েছে
একটাকে । যেটা খুব চ্যাটাংচ্যাটাং কথা বলেছে, বেটার নাম দুখু । গাঁজা খায় না
কিন্তু সঙ্গ দেয় । মানে, বৈতল ঠিকই ধরেছে, ঐ ব্যাটাই হারামজাদা । পঞ্চায়েতির
উস্তাদ । বাকি দুটো বছই আর আপদ । তিনটেই বাঙাল, মুসলমান । দুখুই ওদের দাবড়ে বেড়ায়
। বৈতলের সন্দেহ, লোকটা অনেক কুকর্ম করে । যদিও বলে মামুপিরের খিদমতগার ।
অন্ধকারের ভিতরই বৈতলকে জেরা করে । বলে,
---
তোর বাড়ি সুনামগইঞ্জ নি ।
---
তুই কেমনে বেটা, হক্কলতাত উস্তাদি মারছ দেখি ।
---
আউয়া দেখলেউ মারি । তোর পানি নিশা কইলে নানি ।
---
পানি তো হবিগঞ্জোও আছে ।
---
আউয়া নাই হবিগইঞ্জো । ছলাইরে নি ।
---
না বেটা, তোর খুব পানিতরাস । শরীল দেখিয়াউ বুঝিয়ার । পানিত নামতে নি । অউত্ত দেখ
আধখানি পুলর মাথা । মাথা থাকি মার এক ফাল, গিয়া পড়বে পানিত । পাইবে মাছ । ঘাঘট
বোয়াল গজার । ধরিয়া লইয়া আইতে পারলে কইমু বেটা ।
---
হাচানি । আমারে হাচারির আউয়া পাইচছ নি । নদীত গজার ধরতাম । জাল ছাড়া মাছ মারতাম ।
--- ঠিক
আছে, গজার নায় রউ অউ ধর চাইন দেখি ।
---
জাল লাগব ।
---
তে আর তুই বেটা কিওর পাটনি ।
একটু তো নেশা হয় বৈতলের । কিন্তু বৈতলের কাছে সব নেশার রাজা
হল জল । তাই নদীর জলের কথায় নড়ে চড়ে জলচর শরীর । বৈতল জানে জলকে তার ভয় নেই । জলের
নাগাল পেলে সে মহাবীর । যদি অর্ধেক পুল থেকে ঝাঁপ দিলে
নদী হয়, তাহলে কোনও ভয় নেই । সে নেবে যাবে ঝপাং । কিন্তু যদি জলের বদলে থাকে শুকনো
পাথর । বেঘোরে মারবে বৈতল । তবে বন্ধুহীন বেঁচে থাকাও কি বাঁচা । যদি ওরা ভুল বলে,
তবে ওরাই মরবে । একের বদলে তিন । দগ্ধে দগ্ধে মরবে । লুলা তাকে
যেমন মারছে, মারবে সারাজীবন । তাই নবীন বন্ধুদের বলে, আনবে । মাছ ধরে আনবে । একটা
কিছু বাহাদুরি না দেখালে ওরাই কেন মানবে বইয়াখাউরির মাইমলকে । বৈতল ভুলে যাওয়া
দেবীকে স্মরণ করে, গুরু সৃষ্টিধরের চরণে প্রণিপাত করে, পেছন ফিরে দেয় দৌড় । চারের
খুঁটি থেকে পিছিয়ে তিন দুই এক । বৈতল পালাতে জানে না, বেটাগিরি দেখাতে পেলে ছাড়ে
না । তেলাল শরীর থেকে নিমা খোলে, তফন খোলে, আন্ডার প্যান্টের ফিতে শক্ত করে বাঁধে
। অন্ধকার রাতের স্নগে মিশে যায় বাপের বেটা বৈতল । শরীরে পায় মাইমলি গন্ধ । বাপ
যেমন বলে,
---
মাছর লগে লড়তে অইলে, সাপর লগে লড়তে অইলে মাইমলি গন্ধ লাগে । কালা তেলাল শরীর লাগে
। শত্রুরে ডর দেখানি লাগে আইছলা গন্ধে ।
কে
কার শত্রু । কাকে বৈতল ভয় দেখাবে তার আঁশটে গন্ধে আর কালো শরীরে । বৈতল এখনও জানে
না পাগলার মেয়ে দুর্গাবতী তার কালো শরীরকে ভয় করে না ভালবাসে । দুর্গাবতীর কাছে সে
অবলম্বন না ভরসা, জানে না বৈতল । দুর্গাবতীর দুধের শরীরটায় লোভ আছে বৈতলের, তাই
দুর্গার পায়ের তলায় পড়ে থাকে । রহস্য করে বলে,
---
আমি অইলাম ভোলানাথ । তুমার পাওর তলে পড়ি থাকমু ।
বিয়ানিবাজার
রইদপুয়ানির চায়নার রঙ নিকষ কালো । বৈতলের রঙে রঙে মেলানো । মনটা যে
ধলা ফক্ফকা । মন দিয়ে বসে রয়েছে, শরীরও যে দিতে চায় । নেয় না বৈতল । কেন, কালো
বলে, গুরুকন্যা বলে । সৃষ্টিধর ওঝা কাঠমিস্ত্রি বৈতলকে শেখান পুঁথির মন্ত্র,
মনসামঙ্গল । শেখান জাতিধর্মের বিভেদ ভুলতে । বৈতল জানে চায়নার গায়ের রঙই বিভেদ করে
। আবার সেই গায়ের রঙই মনে পড়ে রেল গাড়ির কামরা । টেলিগ্রাফের তারের উপর দেখা
লেজঝোলা ফিঙে পাখি । চায়নার কাছে ফিরে আসে । বলে,
---
অউ পেচকুন্দির টানেউ আইলাম আবার ।
ফিরে আসে বৈতল চামেলির কাছে । থাকে কই ।
গুরুকে অমান্য করে চলে যায় বইয়াখাউরি আবার । ধলাবরণ
দুর্গাবতীর জন্য খুনখারাবিও হয় । দেশ ছাড়বে না বলে শপথ করেছিল । জেল ফাঁসির ভয়ে
পালিয়ে যায় ইন্ডিয়া ।
নতুন শহরের এমাথা
থেকে অমাথা রিক্সা চালায় বৈতল । ‘যাইতায় নিবা’ বললে সেও মাঝে মধ্যে বলে ‘যাইতাম
নায়’ । শহরের প্রতিটি গলিঘুঁজি বৈতল চেনে । দিনের বেলা, রিক্সা চালাতে চালাতে সে
দেখেছে পুলের অবস্থান । বৈতল জানে কোনখানে জল, কোনখানে চোরাপাথর । তবু সে দৌড়য় ।
সাহেব ভূতের মোচ্ছব দেখতে এসে তারও সাধ হয় ভূত হওয়ার । মহাবীরের মতো দৌড় শুরু করে
বৈতল । আত্মহত্যা করার মানুষ নয় সে, তবে কেন সে দৌড়ে পৌঁছে যায় শেষ সীমায় । বৈতল
জানে তার মনে কী আছে । বৈতল জানে বন্ধুরা জাপটে ধরবেই । নইলে যে মরণ । ভাঙাপুলের
শেষ সীমানা থেকে অনেক দূরে নদী । ঝাঁপ দিলেই পাথুরে পথের উপর থেঁতলে মরা । বেঁটে
লোকটা, যার উস্কানি সবচেয়ে বেশি, সেই আটকে দেয়, আপদ অন্ধকার জড়িয়ে ধরে কাঁদে । বছই
সাজায় আবার চিলিম । বৈতল হাসে রহস্যনয় । নাকি কাঁদে
ভিন্নধর্মী তিন বন্ধুর বুকে মুখ রেখে । বুক কাঁদে, বৈতলের চোখে দুষ্টুমি ছাড়া কোনও
ছাপ নেই ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন