“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২১ আগস্ট, ২০১৬

ব্যবহারিক


।। শিবানী দে ।।
 
(গল্পটি বছর পাঁচেক আগে করিমগঞ্জের 'দৈনিক নববার্তা প্রসঙ্গ'তে প্রকাশিত হয়েছিল ।)
(C)Image:ছবি

বরটা পড়ে আঁতকে উঠল শমিতা দেওয়াল ধসে মৃত দুই, গুরুতর আহত এক ।মৃত ও আহত সকলেই শিশু । গুরুতর আহত শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে । এইরকম খবর মাঝেমাঝেই খবরের কাগজে বের হয়, ঘটনাস্থল ও ঘটনাগ্রস্ত অপরিচিত হলে লোকে দার্শনিক ঔদাসীন্যে পাতা উলটে যায় । শমিতা চমকে উঠল, কারণ আহত  যে শিশুটি দেওয়াল চাপা পড়ে মৃত্যুর শিকার হতে হতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তার নাম পরিচয় ওর জানা, সে শমিতারই এক সময়ের ঝিয়ের মেয়ে টুসু ।
শমিতার মনে হল মৃত্যু যেন তার কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল । তার ঘরের আশেপাশেই ওত পেতে বসেছিল। আকস্মিক বিপদ থেকে সদ্যমুক্তির স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শমিতা, ভাগ্যিস তার নিজের সন্তান, স্বামী বা আপনজন  কেউ সেই চরম দুর্ভাগ্যের শিকার হয়নি । বিপদটা ঝিয়ের মেয়ের উপর দিয়ে কেটেছে ।
শমিতা আবার চমকে উঠল ।

এটা সে কঘ ভাবছে । এরকম ভাবনা তো অনুচিত । যেখানে আবেগের ঘাটতি পড়ে, সেখানে লোকে উচিত অনুচিত দিয়ে পুষিয়ে নিয়ে কর্তব্য করে । শমিতা গৃহবধূ হলেও কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়া শিক্ষিত মেয়েকলেজ ইউনিভার্সিটি জীবনে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক তত্ত্বের সঙ্গে পরিচিত, উচিত অনুচিত, কর্তব্য অকর্তব্য বিষয়ে অবহিত ।
আর এটাও তার মনে পড়ল যে বাচ্চা মেয়েটা  দেওয়াল চাপা পড়ে আজ হাসপাতালে, তাকে সে এইটুকু থেকে দেখেছে । তাদের বাড়িতে প্রায়ই আসত ওর মা শান্তির কোলে চেপে কিংবা হাত ধরে । শমিতারা তখন হাওড়ার যেখানে থাকত, তার কাছেই বোজাপুকুর বস্তি---- এলাকার সবরকম সস্তা শ্রমের জোগানদার ।
কালো কালো হলেও দেখতে বেশ মিষ্টি ছিল মেয়েটি । বেশির ভাগ সময়ই হাসিখুশি থাকত । তাই শমিতার খারাপ লাগত না, দু-একটা কথাও বলত । ওর মা ওকে বসিয়ে রেখে কাজ করত ।
তবে মাঝে মাঝে যখন কাঁদত, তখন বিরক্তি চেপে শমিতা ওকে একটা বিস্কুট ধরাত । নোংরা করলে গা ঘিন  ঘিন করত, দাঁতে দাঁত চেপে শান্তিকে বলত জায়গাটা পরিষ্কার করে দিতে । শমিতার উপায় ছিল না, ‘বাচ্চা নিয়ে কাজে এসো না  বলতে মুস্কিল ছিল । বউটার কাজ ভাল, কামাই বড় একটা করত না, হাতসাফাইয়ের দোষ ছিল না । তায় দরকারমত বাড়তি কাজও করে দিত, অজুহাত দিয়ে পালাত না । কাজে কখনো সখনো খুঁত থাকলে শমিতা বকত, শান্তি জবাব দিত না ।
আর শান্তি যে রোজ বাচ্চা নিয়ে কাজে আসত তা নয় । অনেক দিন বাচ্চাটিকে ঘুম পাড়িয়ে প্রতিবেশী কাউকে বলে আসত । এইসব কারণে অসুবিধাটুকু শমিতা মেনে নিত । বরং ভাল কাজের লোক কেউ ভাঙ্গিয়ে নিয়ে যাবে---- এই ভয়ে কুড়ি টাকা ও বাসি খাবার বাড়তি দিয়ে তাকে ধরে রেখেছিল । ওর বন্ধুরা, যারা পাড়ায় অন্য বাড়িতে কাজ করত, তাদের শান্তি বলত, ‘বউদির মত লোক হয় না । আমি কতদিন বাচ্চা নিয়ে কাজে যাই, তবু কিছু বলে না ।বন্ধুরা হিংসেয় জ্বলত । বলত, ‘দ্যাখ, অত ভাল দেখাচ্ছে যখন তখন নিশ্চয়ই ভেতরে ভেতরে কিছু মতলব আছে ।শান্তি বলত, ‘তোরা তো সবকিছুতেই মতলব দেখিস ।
টুসু একটু বড় হলে শমিতা ওকে স্কুলে ভর্তি করবার জন্য সাহায্য করেছিল । সে যখন তিন বছরের, তখন শান্তি একদিন এসে বলেছিল, ‘আমার মেয়েটাকে এবার আর ইস্কুলে ভর্তি করতে পারলাম না বৌদি ।
এখনি স্কুলে ভর্তি করার কী আছে ? ক্লাস ওয়ানে তো পাঁচ বছরের আগে নেবে না ।শমিতা জানত এখানে যে নার্সারি স্কুল আছে, তাতে শুধু মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরাই পড়ে। শমিতার নিজের মেয়েও সেখানে পড়ে । শান্তির মত খেটে খাওয়াদের ছেলেমেয়েরা সোজাই সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়, কারণ বেসরকারি নার্সারি স্কুলের বেতন দিয়ে পড়ানো ওদের পক্ষে সম্ভব নয় । বাচ্চারা পড়তে গিয়ে পারলে এগোয়, না পারলে পড়া ছেড়ে দেয়, এবং আশি শতাংশ পড়ুয়া শেষেরটাই করে ।
আমতলা পেরাইমারি ইস্কুলে  নাসারি কেলাস খুলেছে, বৌদি । আমাদের পাড়ার অনেক বাচ্চা ওখানে ভর্তি হয়েছে । ওতে ভরতি হলে কেলাস ওয়ানে এমনি এমনি উঠে যেত । ইংরিজিটাও একটুকুনি শিখতে পারত ।শান্তি বলেছিল।
তবে দিলে না কেন ?’
অনেক টাকা লাগবে, বৌদি । এই ধরগে ভর্তির জন্য তিনশ টাকা, মাসে মাসে একশ টাকা করে বেতন, বইখাতা, স্কুলের ডেরেস, সব মিলিয়ে পয়লা মাসে এক হাজার টাকার ধাক্কা । ওর বাবার কথা তো জানোই, রিশকা চালিয়ে যা পায় মাল খেয়েই উড়িয়ে দেয়।
শমিতা শুনেছিল ব্যাপারটা ।
বোজাপুকুর বস্তিতে কোনো স্কুল নেই, ছেলেমেয়েরা পড়তে চাইলে আমতলা প্রাইমারি স্কুলে যায় । স্কুলটা সরকারি, তাই অবৈতনিক, কাজেই পড়াশুনোর মান যেমনই হোক না কেন, গরিব মানুষ তাদের ছেলেমেয়েদের সেখানেই পাঠায় ।
ইদানীং সেখানে নার্সারি খুলেছে, কিন্তু সেটা বেসরকারি সেকশন, যদিও সরকারি স্কুলে বেসরকারি কোনো কার্যকলাপ চালানো বেআইনি। তাতে পড়াচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের পরিচালিত ক্লাবের সদস্য জনা দুয়েক বেকার দশ বারো ক্লাস পাশ । সরকারের দলের লোক, তাদের বেআইনি কাজও তাই সমাজসেবার তকমা পেয়েছে ।  পড়ুয়াদের ফিজ, বই এবং ইউনিফর্মের কমিশন, সবই প্রাইভেট স্কুল থেকে অনেক কম, ---- তবুও যা আসছে, সব মিলিয়ে ওদের পকেটমানিটা বেশ উঠে আসছে । আর ওখানে ভর্তি হলে  ক্লাবের দাদাদের দেওয়া সেই পরিচয়ের জোরে প্রাথমিক ক্লাসে ভর্তির জন্য মা-বাপের আর চিন্তা থাকবে না ।
ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করতে গেলে সিট নেই এই অজুহাতে ফিরিয়ে দেবার ভয়, আবার ইংরাজি শেখানোর লোভ----খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যেও  সন্তানকে নার্সারি স্কুলে ভর্তি করার হিড়িক পড়ে গেছে , যদিও বাংলা স্কুলে পরবর্তী বছরগুলোতে ইংরাজি না থাকায় এই  বড়জোর অক্ষরপরিচয় ও সামান্য শব্দার্থের ইংরাজি শিক্ষাটা কাজে আসবে না । এরপর প্রাণপণ খেটে স্কুল ও প্রাইভেট দিদিমণির মাইনে জোগাড় করার পালা ।
শমিতা বলল, ‘ঠিক আছে, হাজার টাকা দিয়ে দিচ্ছি, টুসুকে স্কুলে দিয়ে দাও । পরের তিন মাসে মাইনে থেকে কেটে নেব । আর টুসুকে বিকেল বেলা তোমার সঙ্গে নিয়ে আসবে, আমিই পড়িয়ে দেব ।কৃতজ্ঞ শান্তি কথা খুঁজে পায় না ।
সেই সময় শমিতার শাশুড়ি ওর সঙ্গে ছিলেন । শাশুড়ির কাজের জন্য আরো একজন লোকের দরকার হয়ে পড়ছিল । পরদিন থেকে সকালে বিকেলে দুবেলাই শান্তির কাজের সময় বেশ খানিকটা করে বেড়ে গেল । শমিতা আর বাড়তি লোক রাখল না । বরং টুসুর পড়ার জন্য ঘরের কাজে শান্তির উপস্থিতি একশো শতাংশ নিশ্চিত হল । পাড়ার লোকের কাছে  পরোপকারী মহিলা হিসেবে তার পরিচিতি হয়ে গেল । সুযোগের সদ্ব্যবহারের জন্য সে স্বামী ও শাশুড়ির কাছে বুদ্ধিমতী বলেও প্রশংসিত হল । টুসুর পড়াশুনো অবশ্য এগোচ্ছিল, সন্দেহ নেই ।
বছরখানেক পর শমিতারা হাওড়া ছেড়ে কলকাতা চলে আসে । সদ্য তৈরি হওয়া নতুন ফ্ল্যাটে ধুলোবালি ঝাড়া, মালপত্র সাজানো গোছানো ইত্যাদি কাজের জন্য শান্তিকে দুদিনের জন্য নিয়ে এসেছিল । এজন্য কিছু টাকা শান্তিকে দিতে চাইলে শান্তি বলেছিল, ‘থাক বৌদি, আর কত নেব তোমাদের কাছ থেকে । তোমরা আমার জন্য কত করেছ । আমার ভাই ভাইবউ যদি কোথাও যেত, তবে তাদের জন্যেও এটুকু কাজ করে দিতাম ।ফেরত যাবার বাসভাড়াটুকু শুধু নিয়েছিল ।
শমিতার হিসেব মিলে গিয়েছিল । বাড়তি পাওনা হল, নতুন জায়গায় লোক নিয়ে এসে কাজ করানোতে পড়শিরাও তাকে একেবারে উটকো ভাবল না, আর এখানকার স্থানীয় কাজের লোকেদের একটা বার্তা দেওয়া গেল, নতুন লোক দেখে যা তা রেট বলা চলবে না । আর  নতুন লোক নিলে সে কখনোই শান্তির মত পাকা হাতে ও বিশ্বস্তভাবে এত কাজ করত না ।
ফেরত যাবার সময় শান্তিকে শমিতা বলেছিল, ‘টুসুর পড়া ছাড়িও না । আমি ঠিক ওর খবর নেব । শান্তি ম্লান হেসে বলেছিল, ‘দেখি কতদিন পারি ।নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে শমিতার বেশ কয়েক মাস কেটে গেছে, ব্যস্ততায় আর খবর নেওয়া হয় নি । এতদিন পরে এই খবর পেল, তাও খবরের কাগজ পড়ে ।
ঠিকঠাক জানবার জন্য শমিতা ওখানকার ভূতপূর্ব প্রতিবেশিনীকে ফোন করল । প্রতিবেশিনীর বাড়িতে শান্তির পাড়ারই একটা মেয়ে কাজ করে, তাই উনি নিশ্চয় বলতে পারবেন ।
শুনেছেন তাহলে খবরটা,---- হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনাদের কাজের মেয়ের বাচ্চাটা---- শুনে অবধি আপনাদের কথা মনে হয়েছে-----জখম সাংঘাতিক, বাঁচবে কিনা সন্দেহ ----- নিয়ে গেছে মেডিক্যালে----আপনি আসছেন তো ?----- বড্ড ভালোবাসতেন কিনা ওকে আপনার তো খারাপ লাগবেই ।
শমিতা সাবধান হয়ে গেল, আবেগের বেশি প্রকাশ হয়ে গেল না তো ? বলল, ‘দেখি আসতে পারি কি না । পারলে শান্তিকে বলবেন ফোন করতে ।তারপর কুশল বিনিময় ও পূর্বতন পাড়ার খোঁজখবর নিয়ে ফোন ছেড়ে দিল । পড়শিনি যদি দায়িত্ব নিয়ে শান্তিকে খবর  দেন তাহলে দেখা যাবে । বেশি ভালবাসা দেখালে খরচা আছে ।
বিকেলে শান্তি ফোন করল পড়শিনির বাড়ি থেকে, ‘বউদি, আমার সব্বোনাশ হয়ে গেছে বউদি। আমার মেয়েটা কথা বলছে না । কী করব আমি। ডাক্তার বলছিল অনেক টাকা লাগবে । তুমি তো ওকে কত ভালবাসতে । যদি কিছু সাহায্য কর ।ফোনেই কাঁদছিল ।
শমিতা ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘কেঁদো না, দেখি কী করতে পারি । কাল পরশুর মধ্যে একবার আসার চেষ্টা করব ।ফোনটা কেটে দিল । খবর নিয়েছে বলেই পেয়ে বসেছে, সাহায্য চাইছে । এতক্ষণের সহানুভূতি তরল হয়ে বিরক্তির আভাস উঁকি মারছিল ।
ব্যাপারটা ভাল হল না । শান্তি পড়শিনির বাড়ি থেকে ফোন করায় এবারে ওকে যেতেই হবে । এতদিনের ভাবমূর্তির একটা ব্যাপার আছে । পড়শিনি আবার ভালবাসার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন । শমিতার রাগ হচ্ছিল । কাউকে কিছু দিতে হলে বা সাহায্য করতে হলে উনি তো চোখে সর্ষেফুল দেখেন । একটু খোঁজ নিতে না নিতেই একেবারে ধরে নিয়ে এসেছেন । শমিতা খালি হাতে শুকনো আশ্বাস দিলে এখন উনি মজা দেখবেন, ওকে ওঁর সমান স্তরের ভাববেন । এখন আবেগের খেসারত দিতেই হবে, উপায় নেই ।
শমিতা ওর স্বামীকে শান্তির কথা বলেছিল, কিন্তু সে কোনো উত্তাপ দেখাল না । উলটে জিগ্যেস করল, ‘কোন শান্তি ?’ মনে করিয়ে দিতে বলল, ‘কোন কালে সেই পাড়া ছেড়ে এসেছ, এখনো সেখানকার ঝিয়ের কী হল তার খবর নিতে হবে নাকি? তোমার যত আদিখ্যেতা । কী দরকার গায়ে পড়ে দরদ দেখাবার ? ওরকম বস্তিতে বস্তিতে কত অ্যাকসিডেন্ট হয় ।
এমনিতে ব্যাঙ্ক অফিসার স্বামী তাকে মোটা টাকাই হাত খরচ হিসেবে দেয়, তার বেশির ভাগই খরচ হয়না, মাসের শেষে সে ব্যাঙ্কে রেখে দেয় । বেশ কিছু জমলে দু এক পদ শখের গয়না কেনে । এবারে প্ল্যান ছিল পুজোর আগে একটা হিরের দুল কিনবে । এখানকার প্রতিবেশী অনেক মহিলারই কিছু কিছু হিরের অলঙ্কার আছে । তার নেই, সেজন্য নিজেকে ওদের কাছে খাটো মনে হয় । কিছু টাকা শান্তিকে দিতেই হবে । টাকাটা আবার কমে যাবে, এবারে পুজোয় আর হিরের দুল পরা হবে না । বউ বেশি দান দক্ষিণা করলে তার বরও মুঠি শক্ত করে । কি আর করা । তবে সে বেশি দিতে পারবে না । তার বাড়িতে কাজ করলেও নাহয় কথা ছিল । দেওয়া টাকাটা এবারে পুরোই জলে যাবে ।
 পরদিন বর অফিসে বেরিয়ে গেলে মেয়েকে শাশুড়ির কাছে রেখে শমিতা সেখানে গেল ।
ওর মত ভদ্রমহিলা খুব কমই ওইরকম জায়গাতে যায়, তাই লোকে তাকিয়ে দেখছিল । অনেকদিন ওদিকে থাকার দরুন অনেকেই মুখ চিনত, তাই ফিসফিসানি কানে আসছিল, শান্তির কাজের বাড়ির বৌদি শমিতা একজনকে শান্তির বাড়ির ঠিকানা  জিগ্যেস করায় উৎসাহী কয়েকজন তক্ষুনি তাকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেল । খোলা  দুফুট চওড়া নর্দমার পাশ ঘেঁষে সরু তিনফুট ইটের রাস্তা, রাস্তার একধারে কোথাও দরমা কোথাও টিন বা ইটের দেওয়াল, মাথায় পলিথিন নাহয় খাপরার টালির ছাদ, গায়ে গায়ে লাগানো ছোটো ছোটো ঝুপড়ি ঘর ।
দুপুর বেলা, তাই মেয়েরা বেশিরভাগই বাবুদের বাড়ি কাজ করে ফিরেছে । কেউ কেউ রান্না করছে, কেউকেউ বাচ্চা কোলে খাওয়াচ্ছে, কেউকেউ দরজায়  বসে  পরস্পরের উকুন বাছছে ।  ন্যাংটো অথবা নোংরা জামাকাপড় পরা ছোটছোট ছেলেমেয়ে রাস্তায় ছোটাছুটি করছে, খেলছে । ক্ষয়াটে চেহারার দুচার জন পুরুষও বসে আছে, হয়তো কাজে যায় নি, কিংবা কাজ থেকে ফিরে এসে বিশ্রাম নিচ্ছে ।
ইটের রাস্তা যেখানে শেষ হয়ে গেছে, সেখান থেকে মাটির রাস্তা ধরে এ ঝুপড়ির সামনে তো ও ঝুপড়ির পেছন দিয়ে ছাইয়ের গাদা, মাছি ভনভন করা নোংরার স্তূপের উপর দিয়ে খোলা নর্দমা সাবধানে ডিঙ্গিয়ে যখন শান্তির বাড়ি পৌঁছল, তখন শমিতা আশ্চর্য হয়ে দেখল, বস্তির বেশির ভাগ বাড়িই এইদিকে । এইরকম জায়গায় ও এতো লোক থাকে !
উৎসাহী লোকগুলো কোত্থেকে একটা চেয়ারও জোগাড় করে বসতে দিল, নিজেরা দাঁড়িয়ে রইল। শান্তি বাড়িতেই ছিল । কোলে আরেকটা বাচ্চা থাকাতে হাসপাতালে যেতে পারে নি।
শমিতা জিগ্যেস করল কী হয়েছিল ।
শান্তি কিছু বলবার আগেই লোকগুলো বলতে লাগল, বাচ্চাগুলো স্নান করে দশটায় স্কুলে যাবে, তাই পুকুরে গিয়েছিল । হঠাৎই পুকুরপাড়ে কারখানার দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ে । দুটো বাচ্চা সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়, টুসুর মাথায় চোট লাগে । আজকে সকালে জ্ঞান ফিরেছে, ডাক্তার বলেছে অপারেশন করতে হবে । ওর বাবা ও পাড়ার আরও দুজন হাসপাতালে রয়েছে ।
শান্তি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল । শমিতা ওর পিঠে হাত রাখল সান্ত্বনা দিতে । হাতটা ঘিনঘিন করছিল, কী নোংরা ! গুণে গুণে  তিনহাজার টাকা শান্তির হাতে দিল, সবাই দেখল, সে নিতান্ত কম দিচ্ছে না । এই বাজারে এত টাকা কেউ কাউকে মাগনা দেয় না । তার ব্যাগে  অবশ্য  আরো হাজার তিনেক টাকা ছিল, কিন্তু বাসে আসতে আসতে সে ভেবেছিল, এত টাকা দেওয়া যাবে না । এ টাকার কোনো রিটার্ন নেই ।  তিন হাজার টাকাই যথেষ্ট ।
শমিতা ভাবছিল, শরীর ঘিনঘিন করছে, কতক্ষণে বাড়ি গিয়ে স্নান করতে পারবে, কিন্তু লোকগুলো একজন সমব্যথী ভদ্রমহিলাকে পেয়ে এত তাড়াতাড়ি ছাড়ল না । চলুন, বৌদি, অ্যাকসিডেন্টের জায়গাটা দেখবেন ।  শমিতা নাচার হয়ে চলল, সহানুভূতি যখন দেখাতে এসেছে, তখন না গেলে তো চলে না ।
নোংরা নালাটির উপরে এক জায়গায় সিমেন্টের স্ল্যাব। সেটা নিশ্চয়ই কোনো ম্যানহোলের ঢাকনা ছিল, পাড়ার ছোঁড়ারা রাস্তা থেকে উঠিয়ে এনেছে । সেটাই এখন নালার পুল । সেটা পেরিয়ে ওধারে একটা জলা, তার ওধারে বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি,  একধারে একটা কারখানার দেওয়াল । ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর অন্যধারে রাস্তা থাকায় রাস্তা থেকে বস্তিটা প্রায় দেখাই যায়না ।
বিল্ডিং-গুলো তৈরি করার সময়ই জলার অনেকখানি বোজানো হয়েছিল, তাই তার নাম পড়েছিল বোজাপুকুর । এধারে কারখানাটাও জলা বুজিয়েই উঠেছিল । রাস্তার দিক থেকে নালাটা বোজাপুকুর বস্তির মাঝখান দিয়ে এসে এই পুকুরেই মিশেছে । কচুরিপানা ও সূর্যালোকে পরিশোধিত এই পুকুরের জলেই বস্তির লোকেদের স্নান কাপড়কাচা বাসন মাজা্র কাজ হয় । শমিতা এতদিন কাছাকাছি থেকেও কিছুই জানত না ।
কারখানার দেওয়ালের প্লাস্টার জায়গায় জায়গায় উঠে গিয়ে ইট বেরিয়ে গেছে । একজায়গায় পুকুরের উপর ইট ধসে পড়ে স্তূপ হয়ে  আছে -----লোকগুলো শমিতাকে দেখাল, অ্যাকসিডেন্টের জায়গা । শমিতা বলল, ‘তাইতো, এতখানি ইট পড়লে কেউ কি আর বাঁচে ? তায় সব বাচ্চা ।
কেমন করে ঘটনাটা ঘটেছিল লোকগুলো তার সবিস্তার বিবরণ দিচ্ছিল । আর শমিতা মনে মনে ভাবছিল, এরকম তো হবেই । যেখানে সেখানে তোমরা ঘর বাঁধবে, রাস্তাঘাট, নালা, পুকুরপাড়----কোনো কিছুই বাকি থাকবে না । তোমাদের রুজিরোজগার নেই, থাকবার জায়গা নেই, তবু পিল্‌পিল করে বংশবৃদ্ধি করবে । তবে মুখে সে বলছিল, ‘ভাংতে পার না এসব দেওয়াল ? ভাঙ্গা দেওয়াল রিপেয়ার হয় না, বছরের পর বছর পড়ে থাকে, গরিবের ছেলেমেয়ে মারা জখম হয়, মারা যায়, কেউ দেখতেও আসে না ।
নোংরা পরিবেশে গা ঘিনঘিন করলেও সে একধরণের আত্মপ্রসাদ অনুভব করছিল ।
সে এই বস্তিতে আসাতে, তার সঙ্গে কথা বলাতে, লোকগুলো নিজেদের ধন্য মনে করছে ।
ওদের চোখের দৃষ্টিতে তার প্রতি সমীহ অথচ আত্মীয়তা । এখানে নিজেকে বেশ উঁচু স্তরের জীব মনে হয় । ভেঙ্গে দাও গুঁড়িয়ে দাও বলা যায় কোনো দায়িত্ব না নিয়েই । সে অবশ্য জানত এই কারখানার মালিক এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার আত্মীয়ের । কাজেই এই ভাঙ্গা দেওয়ালেও ধাক্কা দেবার সাধ্য এদের নেই । তাই হয়তো নিরুত্তরে শুনছিল তার কথা ।
ফেরবার সময় শমিতা শান্তিকে বলেছিল, ‘চিন্তা করোনা, টুসু নিশ্চয়ই ভাল হয়ে যাবে । আমি আবার আসব, হাসপাতালেও খবর নেব সে কেমন আছে ।
মাসখানেক হাসপাতালে কাটিয়ে টুসু বাড়ি ফিরেছে বটে, ওর আরো চিকিৎসা বাকি, সঙ্গে ওষুধ পথ্য এবং তার জন্য চাই আরো অনেক টাকা । ওর বাপ-মা সেটা কী করে করছে, তা ওরাই জানে । কিন্তু শমিতা আর ওদিক মাড়ায়নি বা হাসপাতালের যায়নি । সবাই জানে কথা পাত্র বিশেষে রাখতে হয় এবং সব কথা রাখতে নেই । বস্তির লোকেদের সমাজসেবী ক্লাব দেখুক, সরকার দেখুক, ওরা তো সরকারের ভোট-ব্যাঙ্ক । সে অনেক করেছে, এখন অন্য লোকে করুক । ভূতপূর্ব প্রতিবেশিনীকে কখনো সখনো ফোন করলেও শান্তির প্রসঙ্গ কখনো তোলে না ।  পুজোয় না হলেও দেওয়ালিতে সে হিরের দুল পরতে পেরেছে ।


কোন মন্তব্য নেই: