“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ১০ আগস্ট, ২০১৬

সুরমা গাঙর পানিঃ উজান পর্ব ৪

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  উজান  পর্বের চতুর্থ অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।) 






                  চার


ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করতে জন্ম হয় কাছাড় হাইস্কুলের । স্বদেশি আন্দোলনের দিন তখন । বন্দেমাতরম আর নেতাজি নিয়ে মানুষের উন্মাদনা । চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন আর মাস্টারদা তখন নয়নের মনি । ভগত সিং-এর ফাঁসি হয়ে গেছে । পাড়ায় পাড়ায় কলাপাতায় লবন বানানর ধুম শিলচরে । শিলচরের গান্ধি শ্যামাচরণবাবু অভয়াচরণ ভট্টাচার্য পাঠশালায় শুরু করেন কাছাড় হাইস্কুল । স্বদেশি স্কুলের জন্ম হয় । কোনও রাজনৈতিক কার্যকলাপে যোগদান কিংবা তৎসম্পর্কিত আলোচনায়ও যোগ দেবে না কোন ছাত্র এবং অভিভাবক । লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হবে সরকারি এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে । স্বাধীনতার কথা যেমন জানে, স্কুলের কথাও জানে যুগেন্দ্রদ্দা । কেউ শুনতে চাইলে তার কী আনন্দ । পাশে বসিয়ে, কাঁধে হাত রেখে শোনায় সোনালি সেসব দিনের কথা । বলে,
--- মাইনষে বানাইছে ই ইস্কুল । ইট কাঠ ইতা তো পরে অইছে । অভয়াচরণ থাকি আইল আর্যপট্টিত, বাশর বেড়া টিনর চাল কাচা মাটির ঘর ।
--- ঠিক অউত্ত আছে । সব ইস্কুল বাড়ি অউত মাইনষে বানায়, এর মাঝে আচানকি কিতা ।
--- ইতা তুই বুঝতে নায় । ইতা দেখন লাগে । ব্রিটিশর অত্যাচার তো দেখচছনা । আমি দেখছি তারারে । কত বড় বড় মানুষ ।
--- আর তুমরা কিতা করতায় ।
--- আমি তো ছোট । হেডমাস্টারর লগে লগে ঘুরতাম বেত হাতো লইয়া । ছাত্র হকল ও অত ভালা আছলা, মাস্টরর লাগি আম সফরি বাড়ির ফল পশারি আনতা, আমারেও দিতা । মনিপুরি পুয়া এগুয়ে পালটইও আনি দিছিল
--- হিতো আমরার দেশর মণিপুরি । বিষ্ণুপ্রিয়া, খাইয়া নায় । খাইয়ায় খায় ইরম্বা । খাইতায়নি হিদল লাড়া । আমি আনি দিমুনে তুমারে । খালি আমার একখান কাম করি দেও রেবা ।
--- তোর কাম পারতাম নায় ।
--- কেনে ।
--- তুই যেতা দিবে ইতা চুরির মাল । আমার চাকরি খান যাইব । তোরে সবেউ কয় চুর বৈতল । তুই ধাউড়ামি করছ ।
--- কিগুয়ে কয় ।
--- কিগুর কথা কইতাম ক চাইন । অউত্ত ভুলু মুচির গাছো উঠিয়া সব পাকনা আম পাড়ি লাইচছ হিদিন । শিলচরো মধুগুলগুলি আমর গাছ অউ একটাউ । তরে ডরাইয়া কেউ কিচ্ছু কয় না । সেন্ট্রেল রোডর মুর্তি শিলার শিক অ বুলে চুরি করচছ । সাপ নালার ধার থাকি বাইচাইন্তর দুলনা চুরি করচছ । সঙ্গীত বিদ্যালয় থাকি হারমনি চুরি করলে কেনে । তুই তো ইতা বাজাইয়া গান গাছ না । তর তো খালি মিরদঙ্গো আর করতাল ।
--- আর সোনাদানার কথা কয় নানি । জমিদার বাড়ির সব সোনা নিয়া নসিবালি হাকিমর পুকইরো ফালাই দিছি ।
--- কয় । তে অতবড় ডাকাইতি তুই করতে নায়, ইতাও কয় ।
--- কে কয় । আমি ছিচ্‌কা চুরনি । যেগুয়ে কয় ইগুর পুটকিত নানি...
--- নানি নানি কিতা কইরে । খুলিয়া ক ।
--- কিতা আর কইতাম তুমি আমার বড়ভাই তেও কই, অউ যে মুর্তি শিলার চুক্কা শিক কইলায় নানি, ইগুরে কানাই কামারর ভাটিত গরম করিয়া ঢুকাই দিমু ।
--- দিছ, দেখমুনে কেমন বেটা ।
--- না, এমনে ঢুকাইতাম নায়, ঠাণ্ডা বাজু ঢুকাইমু ।
---তেউ ।
--- অখন টানিয়া বার করঅউক বেটায় । ধরব কেমনে ।
 একথা সেকথায় সময় কাটায় বৈতল । বৈতল জানে গল্প করতে করতেই যোগেন্দ্রদ্দার মন পাওয়া যাবে । স্কুলের গল্পঅ হয়, দেশের গল্প হয়, বৈতলের কীর্তিকাহিনীও হয়, আর তবে বাকি রইল কীবৈতল স্কুল চৌকিদারের ঘরের দিকে তাকায় । বলে,
--- ই ভূতর বাড়িত থাকো কেমনে একলা একলা ।
  যোগেন্দ্রদ্দা হাসে । বলে,
--- আমি অউত্ত ভূত ।
স্কুল ছুটি হয়ে গেলে শুনশান । একামানুষ যোগেন্দ্রদ্দা ইস্কুল আর স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে কাটিয়ে দিয়েছে যৌবন । বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি । তাই একা, সৎমানুষের জীবন শুদ্ধতায় কাটিয়ে দিচ্ছে স্কুলের রক্ষণাবেক্ষণে সামনে বিশাল মাঠ, মাঠ পেরিয়ে বাঁধ । বাঁধের ওপারে বিসি গুপ্তর বাড়ি । এপাশে কিছু বিহারি রবিদাসের ঝুপড়িবাড়ি, ওপাশে চিনা মুচিদের বাড়ি । অমাবস্যার রাতে বৈতল আর তার বন্ধুরা কাজের ধান্দায় বেরোয়, তখন বৈতল দল ছুট হয়ে বিশ্রাম নেয় ইস্কুলে । যোগেন্দ্রদ্দার রান্নাঘর থেকে ডেগ কড়াই পরিষ্কার করে । শুদ্ধাচারী মানুষের খাবার সাবাড় করলে বৈতলের নিশিপালনে সিদ্ধি হয় । দিঘীর পাশে জমিদার বাগানে এনে নিরাপদে ফেলতে পারে ট্রাঙ্ক বাক্স পোটলা পুটলি, পিতলের জাফরি কাটা মনিপেটিকা । কাপড় চোপড় নিয়ে বছই ভোর ভোর বেরিয়ে পড়ে বাগরসঙ্গন পাথারকান্দি চুরাইবাড়ির বাজারে । সোনার বাক্স নিয়ে বৈতল নেমে যায় হাকিমবাড়ির দিঘীর অতলে । পেতলের বাক্স জলের নিচে মাটিতে ঢুকিয়ে বাশ পুঁতে চলে আসে ।
            দেওলা দিঘীর বদনাম বলে কেউ আর গভীরে যায় না । বৈতলের ভয়ডর নেই । বৈতলের কেরামতিতে দুখু অবাক হয় । বলে,
--- অত যে জমাইরে পানির নিচে, ইতা খাইত কে ।
---  হুন । সব চুরে খালি খানির লাগি চুরি করে না । খাইটে ধরলে আর ছাড়া যায় না ।
--- বুঝছি, আমরারে ঠগাইয়া ইতাদি পুড়ির বিয়া দিবে ।
--- চুরির মাল দি নি বৈতলে পুড়ি বিয়া দিতো । চিনচছ বালা ।
দুখু জানে বছই আর আপদের লোভ বেশি, গরিবানা হাহুতাশও বেশি । তাই প্রায়ই ওদের জলের সিন্দুকে টান পড়ে । এদিকে বৈতল দুখুকে, দুখুও বৈতলকে সন্দেহ করে আবার নিশ্চিন্তও থাকে । আর একজন যোগেন্দ্রদ্দা, যোগেন্দ্রদ্দার চোখকে ফাঁসি দেওয়া যায় না । যোগেন্দ্রদ্দা সব জানে, জেনে বুঝেও কোনোদিন বৈতলকে সরাসরি বলে না কিছু । কে কী বলে তা নিয়ে মজা করে । সরাসরি বলে না বলেই বৈতলের মনে উচাটন । যোগেন্দ্রদ্দাকে খোঁচায় । বলে,
--- তোমার হাতর রান্দা রেবা অমৃত ।
--- তুই কেমনে জানছ ।
--- খাইছি নানি ।
--- কেমনে খাইলে ।
--- ঘ্রাণে । মিঠালাউ আর এলেঙর শুটকি দিয়া ঝোল রান্দলায় নানি হিদিন ।
--- কুনদিন বে ।
--- অইব কুনুদিন, ঘ্রাণে কুনু অত দিন তারিখ লেখি রাখে নি । এর লাগিউ আধা খাওয়া অর । একদিন তো দাকিয়া খাওইয়াইলায় না । হেডমাস্টররে তো খুব খাওয়াও রান্দিয়া ।
--- ছি । স্যারে খাইবা নি চকিদারর বাড়িত ।
--- কেনে, তাইন ত কইছইন ইতা মানইন না ।
--- তাইন বাইরর কিচ্ছু খাইন না ।
--- খাইন খাইন । আমার লগে গেলে খাইন । আমি রিক্সা করিয়া কত জাগাত লই গেছি । কত গপ তানলগে ।
--- গপ মাররে বেটা । স্যারে রিক্সা চড়ইন না, অত কথাও মাতইন না স্যারর জানছ নি বেত রাখার চুঙা আছে একটা । কুনুটা ছোট, কুনুটা বড় । এক এক বেতর মাইর এক এক রকম । গল্লার বাড়ি ছিতরাইয়া পড়ে, জালি বেতে হাত ফালাফালা অই যায় । আর তানে বারিন্দাত দেখলেউ পুয়াইন্তর মুত বারঅই যায় । আমার দিকে না চাইয়া হাত বাড়াইলেউ আমার বুঝন লাগব, কোন বেত দিতাম । তার পরেউ, হাত পাত এক বাড়ি মারিয়া বেত বারিন্দাত, আর তাইন ঘরো । এইন যে তর লগে অত মাত মাতবা মনো লয় না ।
--- তোমার মন লইয়া তুমি থাকো ।  তে আমি যেতা জানি ইতা কইয়ার হুনো ।  তাইন কইন, অউ যে বেত মারিয়া ঘরো ঢুকলা, ঢুকিয়া বুলে খালি কান্দইন । তুমার হাতো এক আনি এগু ধরাই দেইন, পুয়া ইগুরে খাওয়াইবার লাগি । আর তুমি হি পয়সা মারি দেও । আর লাগিউ হিদিন ফাটক বাজারো দেখলাম তুমারে । আম কাঠলর ছন্তর থাকি ইয়া গাট্টা এক কাটল আর এক টুকরি পুকড়া আম লইয়া কালিবাড়ির সামনে উবাই রইছো । দেখছি নানি কও ।
--- আর তুই যে আমারে পৌছাই দিলে আম কাটল লইয়া, ভাড়া দিচছ কয় আনা ।
--- অউত্ত ভালা কথা মনো করছ রেবা যুগেন্দ্রহদ্দা, ভাড়া টাইন দিলাও অখন ।
--- আয় ভাড়া নিতে না কিল খাইতে । আমি জানি তুই কিতার লাগি আইচছ, কেনে আনদু ফানদু মাতরে । লাখুদায় কইছইন । শিববাড়ির ধারো আছইন বীরেনবাবু, অদরচান্দর মাস্টর । তাইন তরে কই দিবা নদী তেড়া, না নদী সোজা । আর একখান কথা কই দেই, আমরার সারে ছাত্ররে মারইন না । তানে এমনেউ ডরায় । কী সুন্দর তান কাপড় চুপড় দেখচছনি, ধপ্‌ধপা, ধুতির কড়া ইস্ত্রি সব সময় । বাজাবরিছড়ার মোটা গিলা দিয়া হাত বানাই দেয় বাদল শুক্লবৈদ্যয় এর লাগিউ সবে তানে কয় বগা ধর । তর রিক্সাতও তাইন চড়ইন না, তারাপুর থাকি হাটিহাটি আইন ।
--- ইতা কিতা কও বা । আমি ওত তানে চিনিতাইন আইন মধুরামুখ থাকি ।
--- মধুরামুখো কেউ থাকইন না । সব মাস্টরর বাড়ি আমি চিনি । শ্যামাদাসবাবু গুরু দাস বাবু থাকইন ইস্কুলর ধারো জ্যোৎস্নাবাবু প্রমোদবাবুও ধারোধারো থাকইন । হরেন্দ্রবাবু প্রেমতলা, তারাপদ বাবু বান্দর তলে, বিনোদ বিহারী কাব্যতীর্থ ও তারাপুরো । গিরিজাবাবু কি জানি কই থাকইন, তাইনও তারাপুর । রাজকুমার বাবু শিরিষবাবুও তারাপুরো ।
--- তে তাইন কে ।

চলবে

 < উজান পর্ব ৩ পড়ুন                                                    উজান পর্ব ৫ পড়ুন >

কোন মন্তব্য নেই: