“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট, ২০১৬

সুরমা গাঙর পানিঃ উজান পর্ব ৫

(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই  উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার  উজান  পর্বের  পঞ্চম  অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।                                                                 পাঁচ


তিনি কে তবে। যোগেন্দ্রদ্দা বলেছে মধুরামুখে কোনও শিক্ষক নেই । যোগেন্দ্রদ্দা বললেই সে মানবে কেন । বৈতল তাকে রোজ স্কুলের সামনে ছেড়ে দিয়ে যায় , যতক্ষণ রিক্সায় থাকেন, দুজনে কথা বলে বকমবকম । যোগেন্দ্রদ্দা মানুষ ভাল হলেও বৈতলের সঙ্গে মস্করা করে খুব । সত্যিমিথ্যে মিশিয়ে কথা বলে হেডমাস্টারকে বলে হেডমাস্টার নয় । আর বৈতলও কোন ধাঁধায় থাকার মানুষ নয় । যতক্ষণ না নিরসন হচ্চে, তার শান্তি নেই । তাই মাস্টারকে রিক্সায় উঠতে দেয় না । বলে,
--- আগে কইন আপনে কে । হেডমাস্টর নানি ।
--- তার আগে কও তুমারে না কইল কে । যুগেন্দ্রয় তো । তুমার লগে রসিক করছে । তুমি তার ভাত তরকারি খাও চুরি করি, কিচ্ছু কয় নি ।
--- না, কয় না ।
--- তে তুমার লগে লাগলেও কিচ্ছু কইও না । হেউ তো কইল তুমি ভুগল শিখতায় ।
--- অয় শিখতাম । উঠইন ।
--- তুমি অইলায় রেবা আমার সারথি শ্রীকৃষ্ণ । তুমি হা করলেউ ভুগল । বিশ্ব ব্রহ্মান্ড । অখন কও কুন ভুগল শিখতায় । ভুগল দুইরকম, সব তুমার ‘হা’ ভিতরে আছে । যখন তুমি মাছ ধরো বড় হাওরো, একলা একলা ঘুরিয়া বেড়াও মিরতিঙ্গার পাহাড়ো তখন অইল প্রাকৃতিক ভুগল, আর যখন তুমি কও ‘বোম বোম বম্বালে’ কও ‘নারায়ে তকবির’, যখন রামদা লইয়া দৌড়াও ইটখলা থাকি ঘনিয়ালাবস্তিত, তখন অইল রাজনৈতিক ভুগল । বুজছ নি । অউ যে তুমি রিফুজি অইয়া ইপারো আইছো, ইতা ভুগল নায় । ইতা বানাইল ভুগল । ইতা ভুল ভুগল । ইতা না মানলেউ সুখ ।
 বৈতলের প্যাডেল ঘোরে ধীরে । জোরে ঘোরালেই তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে গন্তব্যে । স্কুলের সামনে রিক্সার চাকা থামলেই বৈতলের পাঠশালা ছুটির ঘণ্টা বাজবে । বৈতল জানে হেডমাস্টার এক বিশাল হাওর । হাকালুকি থেকেও বড় । আর তার ভিতর কত কিসিমের মাছ । দক্ষ মাছুয়া বৈতল বিশাল এই জলরাশির সামনে অসহায় হয়ে যায় । ভাবে, ছিপ দিয়ে সে কী মাছ ধরবে । অবাক বিস্ময়ে সে প্রশ্ন করে,
--- আপনে অততা জানইন কেমনে ।
--- বুঝলায় নিবা, শিখার কুনু শেষ নাই । কিচ্ছু জানি না । শিখার কুনু বয়সও নাই । যতদিন বাচমু ততদিন শিখমু ।
            বৈতল ও তার বন্ধুদের সঙ্গে শেখা ভাগ করে নেয় । জানার ইচ্ছেকে পোক্ত করে । বৈতল মেয়েকেও দেয় তার অভিজ্ঞতার ধন । গর্ব হলে বৈতলের বাপ বলে, ‘ বাপে বানায় পুত’ । বৈতলের ছেলে নেই তো কী হয়েছে । বিয়ানিবাজারের গুরু সৃষ্টিধর তাঁর পাঁচ কন্যাকে মানুষ করতে পারেননি বলে দুঃখ করেছেন । বলেছেন,
--- গার্গী আর খনার মতো সব অইন নি বা । আমি নিজে শিখতাম করি তারারে কিচ্ছু শিখাইলাম না । অখন কারে দিয়া যাইতাম কও আমার ত্রিভুবন ।
না বৈতল ভুল করেনি । সে সব দিয়ে যাবে মেয়েকে । মুদিখানার দোকান বিনোদা ভাণ্ডার থেকে কেনা এক পয়সার বর্ণপরিচয় আর দুই পয়সার শেলেট পেন্সিল দিয়ে পড়াশুনা শুরু করে মেয়ের । ধাপে ধাপে অনেক বইখাতা হয়েছে । ছোট মেয়ে এখন বই দেখে বাপকে শাসনও করে । বলে,
--- কখনও মিছা কথা কহিও না ।
--- আমি কইনি কুনু ।
--- কাহারো সহিত ঝগড়া করিও না ।
--- আমি করি নি ।
--- কাহাকেও গালি দিওনা
 --- আমি গাইল্লাই নি
 --- ঘরে গিয়া উৎপাত করিও না ।
--- জিগা তোর মারে ।
প্রথম প্রথম সন্দেহ হত মেয়ের মা শিখিয়ে দিচ্ছে না তো । তারপর মেয়ে পুরো বইটাই পড়ে শুনিয়েছে । বৈতলও হেডমাস্টার কম নয় । মেয়েকে বলে,
--- আইচ্ছা গো মাই । পুড়িন্তর কথা কিচ্ছু নাই কেনে তোমার বইত । তাইন তো বিদ্যাসাগর । বিধবা বেটিন্তর বিয়া দেওয়াইছইন । তোমার মতো ভালা সোনামনির কথা লেখতা পারতা । ই খালি রাম নবীন তারক ঈশান কৈলাশ গিরিশ আর গোপাল রাখালর কথা ।
    মেয়ের বাপের কথা বোঝার বয়স হয়নি । তাই খুশি খুশি বৈতলকে বলে,
--- আমার লগে অপেনটি বায়স্কোপ খেলতায়নি । অউ দেখ পাচটা গুট্টি ।          
একটা গুটি ছেড়ে দেয়, মাটিতে তালি দেয়, আবার গুটি ধরে । এক এক করে সব গুটি হয়ে গেলে খেলার ছড়াও শেষ হয় । ছড়ার কথায় সুর দেয় মেয়ে দুলে দুলে,

‘ অপেনটি বায়স্কোপ
টাইটাই টায়স্কোপ
চুলটানা বিবিয়ানা
লাটসাহেবের বৈঠকখানা
লাটে কইছে যাইতে
পান সুপারি খাইতে
পানের আগাত মরিচ বাটা
ইস্কাপনের চাবি আঁটা
আমার নাম রেবুবালা
গলাত দিছি মুক্তার মালা ।’
হেডমাস্টরকে বৈতল শোনায় তাঁর মেয়ের বিদ্যাশিক্ষার কথা । ছড়ার খেলার কথা । মাস্টার বলে,
--- একদিন লইয়া আইও আমার বাড়িত । শিখাই দিমুনে বউত ছড়া । বৈতল মেয়েকে শোনায় সমাচার । বলে,
--- আর পুকইরো নায় মাই, অখন নদীতে যাইতাম চলো । মস্তো বড় নদী ।
   মেয়েকে নিয়ে যায় মধুরামুখের চরে । তেলের শিশি থেকে তেল মেখে মেয়েকে দৌড় করায় চরের বিস্তীর্ণ বালিয়াড়িতে । বলে,
--- বুঝছনি মাই, আমার বাপে কইতা তেলে জলে বাইচ্চা বাড়ে । সাতার দিতায় নি নদীত ।
    মেয়েকে নিয়ে বৈতল নেমে যায় জলে । পেটে হাত রেখে বলে,
--- হাত পা চালাও দেখি ।
মেয়ে একবারও বাপকে জড়িয়ে ধরে না । খাবি খেয়েও ভেসে থাকে । বাপের হাতের ছোঁয়া নিয়ে ভেসে থাকে নদীর জলে । সিনান শেষে যায় মাস্টারবাড়ি । জানায় মেয়ের জলে ভেসে থাকার কথা হেডমাস্টার বলেন,
--- তুমি অইলায় পানির পুক । তাই অইল পুকর পুড়ি পুকি । অইবউ । নানি গো । এই দেখি ছড়া লইয়া ঘুরবায় তুমি । অউ তেলর শিশি ভাঙতায় পারবায় নি ।
--- কেনে ভাঙতাম ।
--- ভাঙলে একটা ছড়া শিখাইমু ।
--- না ভাঙতাম নায় ।
      তাও হেডমাস্টার শেখায় ছড়া ;
‘তেলের শিশি ভাঙলে পরে খুকুর পরে রাগ করো ?
তোমরা যে সব ধেড়ে খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো ? তার বেলা?’
বৈতলের মেয়ের পছন্দ হয় না ছড়া । কিন্তু বৈতলের মনে ধরে যায় কথা খানসাহেব রশিদ আলির দক্ষতায়, একলব্যর মেধায় শিখে নেয় গানের ছন্দে । হেডমাস্টারকে বলে,
--- কে লেখছইন ইগান ।
--- বালা লাগছে নি কও । কবির নাম অন্নদাশঙ্কর রায় ।
--- আপনার দেওয়ালো অত ছবি ইতা কার ।
--- তুমি চিনবায় নি । অউ যে লাম্বা দাড়ি আলা, তাইন রবি ঠাকুর, বিশ্বকবি । আর অউ যে লাম্বা চুল আলা তাইন কাজি নজরুল, তাইনও কবি । রবি ঠাকুরর ভাই ।
--- ঠিক নি ।
--- ঠিক নাতে বৈঠিক নি, তুমার যুগেন্দ্রদ্দারে জিগাইও ।
--- বুঝছি, আমার ভাই আছিল লুলা । রুল আমিন বেজ । হেও কবি আছিল । আমি মারি ফালাইছি । আপনে খোদা মানইন নি, আল্লা ।
--- এরাউ আমার খোদা, এরাউ আল্লা ভগবান । আর অউ যে হাসিমুখো একজন মানুষ দেখবায় তানে দেখলে মন ভালা অই যায়, বাবায় কইছইন তাইন আমার গুরু ।
--- তানে আমি চিনি, তাই সুঙু গোসাই ।
--- মানুষরে তাইন আদর করইন । বালা রাস্তাত চলার কথা কইন ।
--- আপনে গোসাইরে মানইন । তে নু কইলা আপনি লস্কর । আপনে কুনু হিন্দু নি ।
--- মাইনষে কিতা কয় কও । হিন্দু না মুসলমান ।
--- মানুষ দিয়া কিতা করতাম । আপনারে লইয়া আমার অউ আতান্তর । আপনে কিতা আমি জানি না । লেখাপড়া জানলে ইতা অইল নানে ।
--- লস্কর অইল উপাধি । আমরা লস্কর, বড়খলা বাড়ি । অউ যে তুমি আমারে কও হেডমাস্টার । হেডমাস্টর কুনু হিন্দু নি, মুসলমান নি । তুমারে যে ইতা কে কয় । তুমারে যে কইছলাম ভুগলর কথা, মিলাই লাও । ধর্মও দুই রকম । প্রাকৃতিক ধর্মত হাগা মুতা খাওয়া ঝগড়া না করা মারামারি না করা অইল আসল ধর্ম । আর রাজনৈতিক ধর্ম অইল ঢাক ঢোল পিটানি । মন্দির মসজিদ বানানি । ইতা অইল বানাইল ধর্ম, আসল নায় । তুমি কুনটা যানতায় কও । কওন লাগব । ছোট সময় হুনছ নানি ঠাকুরমার পরস্তাব । কিচ্ছা । কিচ্ছা শেষ অইলে কইতা, দুধ হালো যাইতায় না মুতহালো যাইতায় । কও কই যাইতায় ।
--- আমি কুনুখানো যাইতাম নায় । আমার ঠাকুমা কেউ আছলা না । থাকলে নি আমার নাম বৈতল হয় ।
--- আইচ্ছা, যে দেখছে না, তারও আছিল, হেও মনে মনে হুনছে কিচ্ছা, পরস্তাব । ঠাকুরমার পাওর উপরে ঝুলিয়া ঝুলিয়া কত জাগাত গেছি । সাত সাগর তের নদী পার করছি পঙ্খীরাজো চড়িয়া । ঠাকুমায় কইতা,
--- ‘বাড়ইরে বাড়ই
       যাইতায় কই ?’
কইয়াউ পঙ্খীরাজো উঠাইতা । কত নদী পাহাড় পর্বত রামধনু মেঘ বৃষ্টি রাজপুত্র রাজকন্যা সোনার কাঠি, রাইক্ষস, সব বেড়াইয়া উড়াইয়া আবার দুধ আর মুতর কথা । কইয়াই ফালাইতা ধপাস । ধর্মও অইল অলাখান, ঠাকুরমার ধপাস ।

চলবে

 < উজান পর্ব ৪ পড়ুন                                                    উজান পর্ব ৬ পড়ুন >

কোন মন্তব্য নেই: