(দেশভাগ এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার উজান পর্বের অধ্যায় দশ ---সুব্রতা মজুমদার।)
দশ
শুকনো ভুতুড়ে রাতের পর রাত কেটে যায় অনেকদিন ।
জমিদারের দেওয়া বাড়ির চৌকাঠ পেরোয় বৃষ্টির জল । অবিশ্রাম বৃষ্টির শব্দ বৈতলের
রক্তে দোলা দেয় । বৈতলের মাথার ঠিক থাকে না । বর্ষা এলে মানুষের কষ্ট হয়, দুর্দশা
বাড়ে, বৈতলের ধরে নেশা । ঘরে থাকতে পারে না । তবে যে যাই বলুক দুঃখ দুর্দশার
মধ্যেই গরিব মানুষ কিন্তু বর্ষা ঋতুকে রানি বানিয়ে রাখে । বাকি পাঁচ ঋতুর খবর
এখানে কেউ রাখে না । বর্ষাকে মন রাখে, এত সুখের কষ্ট তো কেউ দেয় না বর্ষার মতো ।
সারা বছর ধরে চলে শুধু প্রস্তুতি । উৎসবের মালাগাঁথা । সুখ সওয়া জলের সঙ্গে । ঘর
বাঁধা হয় শক্ত করে শন বাঁশ বেত দিয়ে ছাওয়া হয় চাল । জলের সঙ্গে লড়াই এ কোনও
প্রতিরোধ টেকে না । উঁচু করা হয় ভিটে । রূপসী বর্ষার ছলাকলার কাছে হার মানে সব ।
দুঃখী মানুষ হয় আরো দুঃখী । ঘাটিবাটি সব ভেসে যায় জলে, বেহায়া মানুষ যে জল শুকিয়ে
গেলেও সুখী হয় না পুরোপুরি । আর বছরে আবার এসো বলে আগাম আমন্ত্রণও জানিয়ে রাখে ।
সুখের সঙ্গে ভিজে সময়ের একটু মন খারাবিও আছে ।
একলা থাকলে হয় । মন ভাল করতে বৈতল তিন বন্ধুকে ডাকে বাঁধের উপর । ভেজা মনকে ওম
দিতে বন্যা জলের ছপ ছপাশ কাটিয়ে সবার আগে পৌঁছে যায় সংকেত স্থানে । আধভেজা তফন এর
খুঁট থেকে বের করে বিড়ির বান আর দিয়াশলাই । নাসিরউদ্দিন আর ঘোড়ার মাথা ।
ভেজা শলই খটশখটশ করে । একটার পর একটা কাঠি
থেকে বারুদ খসে । বৈতলেরও জেদ চাপে । দাঁতের চাপে বিড়ির ক্ষত গভীর হয় । নেশার ঘোরে
বৈতল জলবন্দি শিলঙ্গি মাছের মতো ঘাই মারে বাঁধের উপর । দাপিয়ে বেড়ায় ডাইনে বাঁয়ে ।
কোথায় যাবে আগুন আনতে । ভেজা মনকে চাঙা করতে গরিবের একমাত্র ওম বিড়ির ধোঁয়া । এক টানেই
রোদে ঝলমল করবে মনের আকাশ । দিয়াশলাই যদি না জ্বলে বিড়ির বান দিয়ে কী হবে । কী
আবার হবে, উপায় বের হবেই, দুঃখে থেমে থাকার মানুষ নয় বৈতল । জল ডিঙিয়ে যাবে
লোকালয়ে, নিয়ে আসবে ইন্ধন । আবার যাওয়া আসার ভাবনায় গতি আনতে এদিক ওদিক তাকায় বৈতল
। এমন সসাগরা সন্ধ্যা সে দেখেনি অনেকদিন । দুদিকেই অথৈ জল । একদিকে ঘোলাজলের
ভরভরাট বরাক নদী, ওপারে দুধপাতিল গ্রামের আভাস শুধু জলে ভাসা বাড়ির চাল আর সুপারি
গাছের বামন অস্তিত্বে । অন্য দিকে, যে-জল দিয়ে সে এল ছপছপিয়ে, সেদিকে বৃষ্টিজলে মগ্ন
শহুরে মানুষের সংসার । সংবৎসরের জল উৎসব ।
অতিবর্ষণের বিকেল বেতলা শলইর
মতোই মনমরা । কানি কাপড়ের মানুষ খাদ্য ও বাসস্থানের খোঁজে যাচ্ছে উঁচু জায়গায় ।
কিছু থাকল পড়ে, কিছু মাথায় নিয়ে হারাধনের দল চলে, কাছাড় হাইস্কুল, নর্মাল স্কুল,
গভর্নমেন্ট স্কুলের দিকে । সারাদিন বৈতল অনেক টিপ দিয়েছে । একবারও যাইতাম নায়
বলেনি । এমন কি ত্রাণ শিবিরের গরম খিচুড়ির গন্ধও বৈতলকে আকুল করেনি । বর্ষায়
টেলটেলে জলের মতো গরম খিচুড়ি বড় প্রিয় তার । মানুষের দুর্দশায় বৈতল ভুলেছে তার
প্রিয় । শরীরে এসেছে অমানুষিক শক্তি । সপসপসপ জলের ভিতর প্যাডেল ঘোরে আর বৈতলের
মনে পড়ে আর এক প্রলয়রাতের কথা, মালির ভিটা কালিবাড়িতে জড়ো হয়েছে হিন্দু মুসলমানের
সম্মিলিত এক মানুষ দল । ভাটির দেশের বন্যায় শহুরে বৈচিত্র্যে নেই । ডুবে গেলে
ত্রাণের কোনও ব্যবস্থা নেই । এর মধ্যেই বৈতল আর লুলা প্রলয় জলে ঝাঁপ দেয় । লুটপাট
করে, এক কথায় ডাকাতি করে রসদ সংগ্রহ করে । সর্বহারা মানুষের মুখের হাসি দেখে মনে
হয়েছে এরকম লুটপাট সে বারবার করতে পারে । ভুল ঠিক কিংবা পাপ পুণ্যের লড়াইএ থাকে না
বৈতল । বৈতলের মনে এক বিচারশালা আছে, যেখানে সওয়াল হয় না জবাব মেলে তৎক্ষণাৎ । লুলাকে
দন্ড দেওয়ার সিদ্ধান্ত বদল হয়নি তাই । এরকমই এক দুর্যোগের মাঝে উথালপাথাল পিয়াইনের
জলে লুলাকে সমর্পণ করে বলেছে বৈতল, পবিত্রোপবিত্রবা । যেমন করতেন দুর্গাবতীর বাবা
ভুড়ুৎ ঠাকুর । ঘাটব্রাহ্মণ মরা মানুষকে পবিত্র করে স্বর্গের দ্বার খুলে দিতেন ।
পিতার মৃত্যুর পর দুর্গাবতীও হতে চায় তিলকাঞ্চন করার অধিকারী । পাকিস্তান
হয়ে-যাওয়া দেশেও তাকে দেয়নি অধিকার । নারীর অধিকার বড় শক্ত মানুষ সমাজে । তবে বৈতল
তার বুদ্ধি দিয়ে দুর্গাকে দিয়েছে অধিকার । হরিৎবরণ ঠাকুরবাড়ির পূজারিণী হয়েছে বৈতল
পাটনির ঘরণী ।
বৈতলের বাপ বলে মাইমলের বুদ্ধি থাকে নৌকোয় ।
বলে,
--- ‘তেলির বুদ্ধি চুঙ্গাত আর পাটনির বুদ্ধি
ডিঙাত’ ।
তাই জল আর ডিঙা দেখ্লেই বৈতলের বুদ্ধি চড়চড়
করে । দুষ্টবুদ্ধিও খেলে । গৃহস্থ বাড়ির গরুর ‘ডিগরা’ খুলে নেওয়ার মতো অচেনা মাঝির
নৌকাও খুলে দেয় বৈতল । ভরা নদীর মাঝখানে গিয়ে বৈঠা উঠিয়ে রাখে গলুইএ । মনপবনের
নাওকে বলে, যথা ইচ্ছা তথা যাও । কুড়ুলাকে ডাকে । বলে,
--- আয় দেখি তোর কত শক্তি, বৈতলরে নে । দেখি
তোর কুড়ুলার ভিত্রে কত কুচক্কইর ।
মাঝনদীতে নৌকা ছেড়ে ঝাঁপ দেয় জলে । ঘাটে এসে ওঠে
আবার নদীর জলে থপথপায় । নদীকে সাবাশি দেয় । বৈতল জানে জল তার প্রতিদ্বন্দ্বী নয় ।
জল তার শক্তি । পুকুর হোক খাল হোক হাওর বিল নদীর জল সুন্দর হয় বর্ষার নতুন চাদর
গায়ে জড়ালে । জলভরা নদীতেও তাই বৈতল ফিরে পায় তার রাজ্যপাট । কৈশোরের মিরতিঙ্গা
যেমন, নতুন দেশের অসমাপ্ত পুলের চার নম্বর খুঁটি যেমন । যেমন এই বর্ষণ সন্ধ্যায়
বরাক নদীর মাটি বাঁধের দুপার গঙ্গা ।
বিপর্যস্ত মানুষের অসংখ্য নৌকা বাঁধা আছে
বাঁধের গায়ে । বৈতল একটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারে ডিঙা ভাসানে । একবার মুখোমুখি হওয়া
নদীজলের । থপথপিয়ে সাবাশি দেওয়া নয়, থাবড়া মেরে ধমক দেবে এবার । বলবে থামাও এবার ।
বলবে,
--- থামাও বেটি । তুমি বুলে মা, ইতা কিতা কর
। দুর্গাবতীয়ে তুমারে পুজা করে, তেল সিন্দুর দেয় । কত বৌ বেটি হকল আইন তুমার কাছে,
তুমার বর চাইন । মা বাপ জামাই পুয়া পুড়ি নাতি নাতন লইয়া সুখে থাকার আশীর্বাদ চাইন
তুমার কাছে । তুমি ইতা কিতা কর । মাইনষর ভালা দেখতায় পার না নি ।
বৈতল এককোষ ঘোলা জল হাতে নিয়ে ঢালে নদীর বুকে । ভক্তি ভরে প্রণাম করে নদীকে
। বলে আবার ।
--- থামাও বেটি ।
বৈতলের মন ভাল হয়ে যায় । দাঁতের
ফাঁকে ধরে রাখা বিক্ষত বিড়ি মুখ থেকে জলে ছুঁড়ে ফেলতেই আবার বিরক্ত হয় । বান খুলে
নতুন বিড়ি নেয় মুখে । শেষ চেষ্টা আবার । ফুসফাস করে সবকটা বারুদ ভাঙে কাঠের কাঠির
গা থেকে । আগুন যন্ত্রের প্রতারণায়, অসহায় আক্রোশে ঘোড়ার মাথা ছুঁড়ে ফেলে জলে ।
কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসে বৈতলের পায়ে । অগ্নিদৃষ্টিতে জলের কৌটোয় তাকায় বৈতল ।
জলে আগুন জ্বলে । বিদ্রূপের আগুন জ্বালিয়ে দেয় তাকে । ক্রুদ্ধ বৈতল বলে,
--- শালা বেইমান ।
পিটির পিটির বৃষ্টির সঙ্গে পুটুর
পুটুর বিড়ি ফুকতে ফুকতে এসে জড়ো হয় আরো দুই বন্ধু । একজনের মুখে জ্বলন্ত বিড়ি আর
একজনের মুখে হাড় জ্বালানো মুচকি হাসি । বছই আর দুখু ।
বৈতল জানে মুশকিল আসান এসে গেলে
আর চিন্তা নাই । দুখুর উপর বৈতলের ভরসা যেমন, লাগও বেশি । বৈতল যে-কোনও কারণেই
ভুবনের রাগ নামিয়ে দেয় দুখুর উপর । দুখুর কথায় মিষ্টতা নেই । কাঠ কাঠ কথায় যে-কোনও
সময়ই আগুন লাগতে পারে । তাই বৈতলও দুখুর সঙ্গে ব্যবহারে অকারণ নিষ্ঠুর । রেগে যায়
কথা না শুনেই । এতক্ষণের মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি আর বন্যার কল্যাণে রাগ বাড়ে । ঘোড়ার
মাথার আগুন নষ্ট হওয়ার ক্রোধ জ্বলে ওঠে বছইর মুখের বিড়ির আগুনে । বছইর উপর জমা
রাগও গিয়ে পড়ে দুখুর হিসিবে । রাগের সঙ্গে যোগ হয় বেঁটে মানুষটির ফিচেল হাসি ।
বৈতলের দুর্দশার খুশি । তার মানে, ওর বিড়ম্বনা লুকিয়ে দেখেছে দুজনে । দুখুর গায়ে অপরিসীম শক্তি, তাই পারতপক্ষে গায়ে হাত দেয় না বৈতল । মুখেই চলে
লড়াই । বলে,
--- শালা, এগুয়ে বিড়ি ফুকের আর ভাবের দুনিয়া
কিনি লাইছে । আর এগুয়ে ভাবের হে টানে না এর লাগি সাধু । ইগুয়ে খায় আরো বেশি । সবর ধুমা একলগে টানে । ডুব দিয়া জল খাছ বেটা ভাবছ একাদশীর বাপেও টের পাইন না ।
হালার হালা ।
এবার মুচকি হাসিতে বছইও যোগ দেয়
। আঙুল আর হাতের তালুর মধ্যে নিপুণ প্রক্রিয়ায় লুকিয়ে রাখে বেহেস্তের আগুন ।
বৈতলকে দেয় বিড়ির টুকরো । বলে,
--- নে ধরা ।
ধরে না তিতা ভিজা বিড়ি । বৈতলের
রাগ আবার ওঠার আগেই বছই নিয়ে নেয় বিড়ি । ভাঙা চেয়াল ফুকফুকিয়ে ধরিয়ে দেয় বৈতলকে ।
তিনজনের মুখ তৎক্ষণাৎ খুশিতে উজ্জ্বল হয় । দুখুটা অতি হারামজাদা । খুশির মধ্যেই মারে
চিমটি । বলে,
--- অখন ক । কারে কইলে বেইমান ।
--- কারে আবার কইলাম । তুই বেশি শুনছ ।
--- শেওরা গাছর তল থাকিনু আমরা দেখলাম তোর
ফালাফালি ।
--- দেখচছ তে কিতা অইছে । পয়সা কিতা গাঙে দি
ভাইয়া আয় নি । দুই পয়সার শলই ইগু গেল । এর থাকি শ্যাম কম্পানির সূর্যমার্কাউ ভালা
। আগুন ছাড়া বিড়ি ধরে নি ক । আর দেখলেউ যখন, তখন আর মুশন মারলে কেনে লুকাইয়া ।
--- দেখলাম কিলাখান ধুমাগান্ধ্রা বেটা তুই ।
ধুমার লাগি পাগল অই গেলে । কেনে খাচ । ছাড়ি দেছ না কেনে ।
বিড়ির ওম পেয়েও বৈতলের মাইমলি রাগ কমে না । দুখুর উপদেশ শুনে আবার
তেলেবেগুনে জ্বলে । বলে,
--- ছাড়তাম কেনে । তোর মতো নি ডুব দিয়া পানি
খাওরা । তোর মতো রাড়ি বেটির জীবন নায় আমার ।
দুখুর বৌ মরেছে অনেক কাল ।
দুখুকে নিয়ে সত্য মিথ্যা অনেক কথা । খুন ছিচকেমি গুণ্ডামি সব ক্রেছে । বৌকে মেরে
এখন আধা পির । আর বিয়ে করেনি । মামুর খেদমতি করে মনে প্রাণে । বন্ধুদের সঙ্গ দেয়
সব অপকর্মে । বৈতলের সঙ্গেও বাসনের ঝনঝনি চালায় । বৈতল কিংবা দুখু কেউই কড়া কথা
হজম করে না বলে কড়া কথাই বলে দুজন দুজনকে । দুখু প্রত্যুত্তরে বলে,
--- অই পুঙ্গির বাই । বৌ নাই তে কিতা অইছে ।
তোর তো হালার হালা থাকিয়াও নাই ।
--- কিতা কইলে হালা বাঙাল । আবার ক । কল্লা
লামাইলিমু কইলাম ।
বৈতল রাগলে তার শরীর থেকে মাছের
গন্ধ বেরোয় । মাছের তেলের আঁশটে গন্ধে ভরে যায় চারপাশ । বেঁটে মানুষ দুখুরও আঁতে
লাগে ঘা । বিষ ঝাড়ে কথায় । বলে,
--- আমি কইতাম কেনে । হক্কলেউ কয় ।
--- কিতা কয় ।
--- কয় তুই ধ্বজভঙ্গ । তর বউ তোর লগে হয় না ।
--- কার লগে হয় । তোর বাপর
লগে নি ।
--- বাপ তুলিয়া মাতিছ না বেটা রিফুজি । ভালা
অইত নায় কইলাম । আমার বাপ নায়, তোর বাপ অউ জমিদারর কুলো হয় । আর শুনতে নি । মাইনষে
কয় পুড়ি ইগুও তোর নায় । আর কিচ্ছু ।
--- আর সব কথা কইছ, পুড়ি লইয়া মাতিছ না দুখু
। আমার মাথা ঠিক থাকত নায় ।
ক্ষীণকায় বৈতলের রাগ দেখেনি দুখু
। আলদসাপের বিষ ঝড়ে টুপটাপ । তখন দুখুর গায়ের জোরের কথাও ভুলে যায় । শুধু গায়ের
জোরে কিছু হওয়ার নয় জানে বৈতল । শক্তিমান দুখুকে কাবু করতে জানে বৈতল । মনের জোরে
বৈতল সব পারে । কিন্তু দুখুর সঙ্গে তার লড়াই যে সমানে সমানে । কম সেয়ানা তো নয়
মামুপিরের খিদমতগার । লড়াই ঝগড়ায় ডাকাত মানুষটা মন দিয়ে প্যাঁচ কষে । অকারণে শরীরকে
বেগার খাটতে পাঠায় না । বিশ-মেশানো হাসিতে প্রতিপক্ষকে কাবু করে । লুলার সঙ্গে এই
অমিলটা কিছুতেই মেলাতে পারে না বৈতল । লুলাও হাসে, তবে লুলার হাসি যে অনাবিল ।
লড়তে লড়তে লুলা দান ছেড়ে দেয় । দুখুও তাই করে । তবু কেন যে দুখুকে বড় রুক্ষ মনে হয়
বৈতলের । মনে হয় রহস্যময় । দুখুর মনের নাগাল পায় না । আবার দুখু
কাছে থাকলে মনে হয় সে নিশ্চিন্ত । বন্ধু থেকে অভিবাবক বাশি । বড় বেশি মাতব্বর ।
লুলা বৈতলকেই ওস্তাদ মানে । দুখু দুখুর মতো, বৈতল বৈতলের মতো । দুজনেই রাজা,
দুজনেই নেতা, আর দুয়ে মিলে একও । বৈতলের কোনও পিছুটান নেই দুখুকে নিয়ে, যে যার মতো
চলে ওরা । লুলাকে নিয়ে সব আতান্তর বৈতলের, লুলা যে তার খেলার পুতুল । লুলার মনটা
বড় নরম । তাই হয়তো বৈতলের মায়ের পক্ষপাত বেশি লুলার প্রতি । লুলা বাড়িতে এলেই
মায়ের মন খুশি হয়ে যায় । ঝলমলানো খুশি নিয়ে মা বলে,
--- দুই ভাই মিলামিলি থাকিছ রে ।
বৈতলকে পাঠিয়ে দেয় মকবুলবাড়ি । লুলা যে মুরগি
খেতে ভালবাসে । ঝুঁটি ঝুলিয়ে বাচ্চা পাখি এনে ফেলে দেয় বৈতল মায়ের উঠোনে । কঁকর
কোঁ করতে করতে বাচ্চা মুরগি দৌড়য় আবার মকবুলের বাড়ি । দুই বন্ধু দৌড়ে গিয়ে ধরে আনে
। বৈতলের বোকামি দেখে মা রাগে না, হাসে শুধু । লুলাকে বলে,
--- নে বেটা বিসমিল্লা করিলা ।
বৈতল বিসমিল্লার অর্থ বুঝে না, লুলাও অবাক হয়ে
তাকিয়ে থাকে । মা বলে,
--- আমার সামনে কাটিছ না । লই যা গি হাওরর
পারো, বিন্না খেতর ধারো জবাই করি ধইয়া উইয়া লই আইছ ।
রান্না ঘরের মাচান থেকে মাটির হাঁড়ি বের করে
দেয় লুলার হাতে । লুলাও অতি উৎসাহে খুলে ফেলে তার লুঙির গাট্টি । গাট্টিতে থাকে
বিচিত্র সব সরঞ্জাম । লাল কালো সুতোয় বাঁধা ছোট ছোট সব গাছের জড়ি । কাচের শিশিতে
সাদা রঙের তেল । লুলা হাসে আর বলে,
--- ‘ঘরে ঘরে গিয়া বেজ নানা গীত গায় ।
পেটের কারণেতে রুল আমিন সারিন্দা বাজায় ।
মুর্দা দিলে জিন্দা করে কুদরতে রব্বানি ।
--- তুই সারিন্দা বাজাছ নি, গানও গাইতে পারছ
নি বে ।
--- না বে । ধান্দামি করলে কততা কওন লাগে ।
বাজানে বুলে আরো কিতা কিতি কইত আর জড়িবুটি বেচত । ইতা নানার কাছ থাকি শিখছি । সাপর
বিষ একরতি আট আনা ।
সাপের বিষের কথা শুনে বৈতলের মার মুখে হাসির উদ্ভাস দেখে ভয় পায় বৈতল । মা
লুলাকে বলে,
--- আমারে দিছ চাইন একটু রাখমু নে । কত নিবে
।
--- তুমারে মাগনাও দিতাম নায় । এমনেউ খাইলাও,
মরতায় নায় । ইতা মিঠা, নাইরকল তেলো তেতই বিচির গুড়া মিশাইয়া বিষ বানাইয়া মানুষ
ঠগামি । আমিও ঠগাই ।
--- তুই কেমনে ঠগাইবে । আমারেউও ঠগতে দিলে না
।
--- তুমারে কেনে ঠগাইতাম । তুমি আইলায় মা
বেটি ।
লুলার মা নেই, তাই বৈতলের মার
আদর আদায় করে । বৈতলকে বোকা মাও পটে যায় লুলার মিষ্টি কথায় । বৈতলের হিংসা হয় ।
লুলার গাট্টিতে আরো কত ধনরত্ন । তিন চারটে খাগের টুকরো কাগজের ‘তাও’ কয়েকটা,
সাদা এবং ছেরেং ভেরেং লেখায় । একটা কালির বড়ি, চিনামাটির সাদা দোয়াত । লুলার আছে
চটি চটি বই । একটায় আকাশের জিল্কি টুকরো করে সাজানো । লুলা বলে,
--- ইটা আমপারা । কুরাণ পড়ন লাগব নানি বেটা,
আল্লাপাকে নবিরে যে লাখান কইছইন সব লেখা আছে আরবি ভাষাত ।
ছোট বৈতল লেখা পড়া জানে না ।
কিন্তু বাংলা বই, বাংলা লেখা দেখেই বুঝতে পারে । লুলার অন্যান্য বই দেখে বলে,
--- তুই বাংলা জানছ নি ।
--- আমি কিচ্ছু জানি না বেটা । আমিও শিখতাম ।
--- আমারে শিখাই দিবে নি ।
--- দিমু নে ।
--- জানছ নি, আইর পুথি লেখা অইছে বাংলাত ।
করিমগইঞ্জ থাকি আয় । আমি শিখতাম । বাংলা শিখিয়া আমি একদিন মনসামঙ্গল গাইমু দেখিছ ।
মুরগি জবাইর অস্ত্রও আছে লুলার পেটিকায় । দুই ইঞ্চির এক ভাঁজ করা ছুরি । অতি উৎসাহে নখের টানে খোলে লুলা । চার ইঞ্চির ভোঁতা অস্ত্রে মুরগির গলা ঘষতে
ঘষতে বিড়বিড় করে লুলা । বৈতল বলে,
--- কিতা মাতরে বে ।
--- চুপ যা । ইতা মাতন লাগে । আল্লাপাকর নাম
নেওন লাগে ।
--- মন্ত্র পড়বে নি । জরৎকারুমুর্নিপত্নী
বাসুকি ভগিনীস্তথা মনসা দেৈব্য নমঃ ।
বৈতলের মায়ের যে কত রুপ । মাটির হাঁড়িতে মা রান্না করে দেয় লুলাকে । বৈতলকে
দেয় না । চান করে এসে বৈতলকে ভাত বেড়ে দেয় । বৈতলের জন্য মুরগি বরাদ্দ নয় । মিষ্টি
কুমড়ো আর ঘাঘটশুটকির ঝোলও বিস্বাদ লাগে । বৈতল রাগে । মার উপর রাগে থালা ছুঁড়ে দেয়
। বলে,
--- ইগুরে মুরগি খাওয়াও, আমারে কেনে দেও না ।
ইগুকুনু তুমার পুয়া নি ।
--- অয় হেও আমার পুয়া । খা রে বাবা খা । হারা
বছর যখন পাঠা খসি খাও, হাস কাঠুয়ার মাংস খাও, তারে দেওনি । তার নু মা নাই । হে আইছে দুই দিনর লাগি, আকতা যাইব গিয়া ।
--- ইগুয়ে কিতা খায় জানো নি । ইগুয়ে গরু খায়
।
--- খাউক, তার ভালা লাগলে খাউক ।
--- আমারে তুমি মুরগিউ দেও না । জাত যাইব গি
নানি । জাত কিতা ।
--- জাত উত কিচ্ছু নায়, খাইতে নি । তর ভালা
লাগলে সব খাইছ । শরীলো শক্তির লাগি খাইছ । মন চাইলে খাইছ বাপ । অউ কইয়া গেলাম ।
সেদিন আর কিছুই খায় নি বৈতল ।
মার উপর রাগ কমেনি । মা কেন বলে, ‘অউ কইয়া গেলাম’ । কোথায় যাবে মা । বৈতলের মা সব
উল্টোপাল্টা কথা বলে । লুলার কাছ থেকে সাপের বিষ কেন চায় । বৈতল সব জানে, মা মরে
যেতে চায় । বৈতলকে ছেড়ে যেতে চায় । মার মনে অনেক দুঃখ । বৈতল তো মাকে দুঃখ দেয় না
। বাদিয়ার বাচ্চা লুলাকে স্নেহ করে মা, মুরগির মাংস রেঁধে খাওয়ায় । মায়ের আদর
টুকরো হয়ে যায় । তাও তো মেনে নিয়েছে ছোট বৈতল । মায়ের মনে কখনও দুঃখ দিতে চায় না
বলেই সেদিন মুরগির মাংস খায়নি । মা তো মত অমত করে নি । অমত করে নি বলে লুলার দিকে
তাকাতে পারে গর্ব ভরে । বলে,
--- দেখ বেটা, আমার মা ।
লুলাও কী বুঝে কে জানে ।
মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকে বৈতলের মার দিকে । মার প্রশংসায় একই কথা বলে বারবার । বলে,
--- অয় বে, এক্কেবারে দেবী মার লাখান ।
এরপর দুই বন্ধুতে মিলে সব খেয়েছে
। মন্দিরের খিচুড়ি লাবড়া, মহাপ্রভুর বাড়িতে কচুর শাক খেয়েছে লুলা দাস । গরুর গোস্ত
খেয়েছে রুল আমিন বেজ এর বন্ধু বৈতল মিয়া । অবস্থা বুঝে জাত পাল্টেছে ।
মায়ের কথা মনে রেখেছে বৈতল ।
--- মন চাইলে খাইও বাপ । যেতা খাইলে শক্তি
বাড়ব, খাইও ।
বৈতল আর লুলা শরীর মনে বেড়ে উঠেছে । বাড়তে বাড়তে এমন যে বাড়বে লুলা, বৈতল
ভাবতেও পারে নি । লুলার শরীর ফালাফালি করে, তাই না লুলা অসময়ে মরে ।
দুখুর শরীরে লুলার মতো অকারণ ফালাফালি নেই । আর বৈতল, শরীর চাইলে বৈতল
দুর্গাবতীর কাছে যায় । দুর্গাবতীর কাছে পায় না বৈতল । মনটা পায় । শরীর চেয়ে
রাগারাগি করে বৈতল নাগাপট্টি যায় । বৈতলের বাঁধা মানুষ আছে মধুবালা । দিলীপ
কুমারের নায়িকার নামে ডাকে চার টাকার রমণীকে । বৈতলের একটা মনের মানুষও চাই । মনের
মানুষ দুর্গাবতী তো মেয়েমানুষ । মেয়েমানুষ মনের মানুষ হলে বেটাগিরি থাকে না ।
লুলার মৃত্যুর পর তাই শিথিল হয়ে থাকে বৈতল । মনের আঘাত সয়ে যেতে সময় লেগেছে ।
উদভ্রান্তের মতো দুর্গাবতীর কথা মতো চলেছে
। পুরুষ যা করে না বৈতল তাই করেছে । পত্নীর পদবি নিয়েছে । রিফ্যুজি ক্যাম্পে
সরকারের দয়ায় জীবনযাপন করেছে । স্ত্রীর প্ররোচনায় হরিৎবরণ জমিদারের আশ্রিত হয়েছে ।
বৈতল তার পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে । দুখু শারীরিক শক্তি আর মনের বলে বৈতলের মনের মানুষ
হয়েছে । বৈতল আবার জেগে উঠেছে । দুখু বৈতলকে তার রুক্ষতা দিয়ে ঘিরে রাখে । বৈতলের
পৌরুষকে সজাগ রাখে । বৈতলের প্রতিটি পদক্ষেপেই দুখু পথ কেটে দেয় । পথ পরিষ্কারও করে
।
বৈতলের চাই পরিপূরক শক্তি । ওকে
দুর্বল করে দিতে চাইলে মানবে কেন । দুখু বৈতলের দুর্বলতা নিয়েও খেলা করে । বৈতল
তার স্ত্রী দুর্গাবতী, মেয়ে মণিকে নিয়ে কোনও কথা শুনতে চায় না । তেলে জলে বৈতল
যেমন আছে ভালই আছে, তার জীবনকে তো গুছিয়ে রাখছে এই দুটি প্রাণী । এর মধ্যে যদি ব্যাথা থাকে তা শুধু বৈতলের । দুই দেশ আর দুই নদীর সংযোগকারী
জলমাটিও ওরা দুজন । বৈতল কখনও দুঃখ পুজো করে নি । বৈতল তার দুঃখের নিরাময় করে নিজে
। একান্তে । ওখানে দুখুর মতো চোর ডাকাতের মধ্যস্থতার দরকার নেই । বৈতলের দুঃখে
মধ্যস্থতাকারী আছে একজনা । আছে তার জল, তার পানি । বৃষ্টির ঝমঝমি । বন্যাজলের
ছলছলাৎ । জলের তড়পানি দেখলে বৈতলেরও তৎপরতা বাড়ে । হয়ে ওঠে সে মহাবীর । পাহাড় ভাঙা
জল আর ঝড় বৃষ্টির অপরিসীম শক্তির সঙ্গে লড়াই এখানে নেই । তবু জলকে মান্য করে বৈতল
। জলের কোনও জাত নেই ধর্ম নেই । জলের কোনও ছোট নেই, বড় নেই । জলের কাছে সব শক্তিই
নির্বল । বৈতল জল থেকেই শক্তি আহরণ করে । জলের সঙ্গে খেলতে খেলতে
জলের ধর্ম আয়ত্ত করতে হয় শিখিয়েছে বাপ । তাই তো বৈতল বাপ ডাকলেই নেমে যায় জলে ।
বাপের ডাকে থাকে অজানার ইশারা । বাপ ডাকে,
--- হেই বৈতল পানিত লাম ।
বৈতল নেমে যায় । জলের সঙ্গে খেলে । উত্তাল
জলে, ভরাবর্ষার হাওর আঁধারে নেমে যায় বাপ । অন্ধকারেও বৈতলকে প্রলুব্ধ করে বাপ ।
বলে,
--- পানি খেইড় খেলতে নি বৈতল, চল ।
বৈতলের বাপ বৈতল থেকে ভিন্ন প্রকৃতির । জলের
সঙ্গে লড়াই করতে করতে বাপ ভুলে যায় তার পরিচয় । ভুলে যায়
মৎস্যজীবীর জীবিকা । লড়াই করার মানসিকতা আছে । জয়ের উদ্যম নেই । বাপের কোন ‘তিক’
নাই । জলের সঙ্গে দাপাদাপি করে শূন্য হাতে উঠে এলেও লজ্জা নেই । খালি হাতে ডাঙায়
উঠে বৈতলের সামনে হাসে । বলে,
--- খেইড়ো হারনও লাগে বেটা ।
হেরো বাপের মুখে তখন খৈ ফোটে । জয়ের দিনের গল্প বলে পুষিয়ে নেয় হারের দুঃখ । বাপ বলে সেই মহাপ্লাবনের কথা
আবার । মহাসমুদ্রের মতো চরাচর, সব জলের তল । জলের উপর ডিঙি নৌকোর মতো এক গাছের
ডালে বসে আছে বাপ তিন দিন তিন রাত । সেই গাছের অন্য বাপের সঙ্গী আর এক পালোয়ান ।
বাপের বন্ধু বজরি দাস । মাছ ধরার কাজ না থাকলে লাঠি খেলে, জমিদার বাড়ি পাহারা দেয়
। জমিদারের চাকরকে দুচোখ দেখতে পারে না বাপ । বাপ বলে ‘গাছুয়া আলদ’ । বাপ তাকে
গাছের উপরই গলা টিপে মারে । ফেলে দেয় হাওরের গর্ভে । অসহায় আক্রোশে বাপ বিলাপ করে
বৈতলের কাছে । বলে,
--- অউ বেইমান বেটিরে দেখত বজরি হালার হালায়
। এর লাগি শাশি রগো টিপিয়া মারি ফালাই দিছি।
সেই বাপের ছেলে বৈতল । বৈতলের স্ত্রী কন্যা
নিয়ে কথা বললে বজরি দাসের হাল হয়ে যাবে । সে তুমি যতই লেঠেল পালোয়ান হও না কেন ।
বৈতল বেঁটে দুখুর হাট্টাগাট্টা শুকনো শরীরকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারে । সত্যি কি
পারে । দুখুর দশাসই চেহারায় কিল মেরে দেখেছে, পারবে না সহজে । কলের কাজ বলে হবে না
। তাই বলে,
--- দেখিছ রে বাট্টিবেটা তোরেও একদিন পানিত
ডুবাইয়া মারমু ।
বৈতল বেশি রাগলে দুখু শান্ত হয় । শান্তিবার্তা
দেয় । বলে,
--- আমারে মারিয়া কিতা করতে দোস্ত । আমরা
গরিব মানুষ এমনেউ মরি রইছি । মরার উফরা যে হালার হালা মরলে দুনিয়াত শান্তি আইব,
ইগুরে তো মারতে পারতে নায় ।
--- মারমু মারমু । সব বেটারেউ মারমু ।
--- অয়, হুলার গুমগুমি নালিয়া খেতো, খালি
দুখুরে দেখলেউ রিঙ্গো উঠি যাছ । দুখুর কথাও ঠিক । বৈতলের মনে একটা কাঁটা খচখচ করে
। একটা মানুষকে শাস্তি দিতে পারলেই তার শান্তি । কিন্তু বৈতলের দুঃখ আর তার
নিরাময়ও যে তার নিজের । ওখানে কেউ নেই আশেপাশে, দুখু নেই বছই নেই আপদ নেই, এমনকী
তার দুর্গাবতীও নেই । গায়ে কাঁটা ফুটলে সে নিজেই তা উপড়ে ফেলবে । কাউকে ডাকবে না
বৈতল । জলসমাধি দিতে হলে দুইমনি পাথরে বেঁধে ফেলে দেবে নসিবালি হাকিমের দিঘীর
গভীরে । কেউ জানবে না হদিশ । তারপর সে আবার ফিরে যাবে আপন দেশে । গ্রামে বইয়াখাউরি,
পরগনা ছাতক, মহকুমা সুনামগঞ্জ জিলা সিলেট । দেশ পাকিস্তান (পূর্ব) । লুলা খুনের
মামলা এতদিনে শেষ হয়ে গেছে । জেল পুলিশের ভয় নেই । নতুন করে মাছুয়া
মাছুয়ার মতো জীবন শুরু করবে । আর রিক্সা চালাতে হবে না জাতব্যবসা ভুলে । জলের পোকা
জলে নামবে বৈতল । রাতের পর রাত কাটাবে বিল হাওরের জলে । পেশির গুলি পাকাবে গাছপাকা
ফজলি আমের মতো । ভদ্রলোকের রান্নাঘরে মাছ যোগাবে বছরভর । নতুন বন্ধু হবে আবার ।
চুরি চামারি ছেড়ে দেবে । শ্রাবণ মাসের কটা দিন শুধু গুরু সৃষ্টিধরকে স্মরণ করবে ।
মনসা পুঁথি পড়বে, নাচবে গাইবে । ওদেশে তো আর কেউ নেই বৈতলকে শপথ ভাঙার কথা মনে
করিয়ে দিতে । বিষহরির কালনাগিনীর ছোবল মায়ের মৃত্যুর পর যে আড়ি করেছে বৈতল সে-কথা
এখন আর কেউ জানে না । ঢলানি জিয়ানির নেশার ঘোরে কাটিয়ে দেবে শ্রাবণী । গোঁসা
ভাঙিয়ে আইর গোঁসা সামাল দিলে আর কাকে ভয় বৈতলের ।
সাপিখুপির ভয়ডর নেই বৈতলের ।
বৈতলের জলকেও ভয় নেই । জলের সঙ্গে খেলায় বৈতলের সর্বসুখ । সেই জলের ঋতুতে মা মনসার
পুঁথি পড়তে, পুঁথি গাইতে, নাচতে নাচতে বিভোর হয়ে যেতে চায় বৈতল । বাপের বেটি বেটে
আই মনসা । যা চাই, তা চাই । যে – কোনও উপায়ে হাসিল করা চাই । নীতি নৈতিকতার কোনও
ইস্কুল খুলে বসে নি মা মনসা । দরকারে প্রতিপক্ষের দুনিয়া ছারখার করে দিতেও
পিছপা নয় বেটি । তেমন মাকে না ডেকে কি পারা যায় । বৈতলের
পুঁথি পড়ার ধুম দেখে দুখু আজাব বকে । বকে বকে বৈতলকে তাতায় । বলে,
--- তুইন বেটা সাপর ডরে পুঁথি পড়ছ ।
--- তুই ডরাছ নানি । ডরাছ, দেখছি আন্ধাইর
রাইতো ইশ আশ হুনলেউ দুই হাত এক করি লাছ । তুই কুনু কীর্তিনিয়া নি । ক না কারে ডাকছে ।
--- আল্লারে ।
--- জানি মনে মনে তুই আস্তিক মুনিরে ডাকছ ।
--- ডাকিতো ডাকি, সাপরে হক্কলেউ ডরায়, তোর
মতো গাট্টামি করি না ।
এই এক ভয় বৈতলের অন্য বন্ধু
বছইরও । তারও আছে অন্তর কাঁপুনি । বছইর খুব ডর সাপকে । নদীকে পারে ঘর । সারা বছর
জল আর জলের ভিতর লতা নিয়ে বাস । রাতে নাম করতে নেই । বৈতল দিনেও নাম নেয় না । গুরু
সৃষ্টিধর শিখিয়েছেন যে । বলেছেন,
--- এমনে যারারে দেখরায় তারারে না ডরাইলেও
চলব, কিন্তু বেরা পুঁথির নাগ অইলা দেপতা । তারারে মানিও ।
দেবদেবী নিয়ে বৈতলের কোনও স্পষ্ট
ধারণা নেই । তাই মান্যতার প্রশ্নও নেই । কিন্তু গুরুবাক্য যে অমান্য করে না বৈতল ।
বছই বাঙালের মতো দুখুর আর এক খাদিম আপদও মনসাপূজার সময় জমিদার বাড়িতে ভেটর চাউল
দিয়ে যায় । বলে,
--- অউ বেটির বড় গুসা ।
--- তুই নু কছ তোর মজবো ইতা নাই ।
--- মজবর তুই কিতা জানছ । কিচ্ছু জানছ না ।
সব অউ আল্লার ফরিস্তা । ইতা লইয়া বেশ মাতিছ না ।
--- মাততাম না কেনে । হুন, এক গপ হুনতেনি ।
--- বাদ দে অখন ই পানির মাঝে তর হুকনা গপ ।
--- হুকনা নায় বে, ভিজা তিতা, পেকর গপ ।
হিগুরে ডাক, ইমাম সাহেবের ডাক । তান নি পছন্দ হয় দেখি ।
বৈতলের কাছে গল্প শোনার প্রস্তাবে দুখু ভুলে যায়
গোসা । ইমাম সাহেব বলার বিদ্রূপও হজম করে । বৈতলের গল্প মানেই মজা, আর মজার ভিতর
কী একটা আছে । বেশ ভাল লাগে । গুরু সৃষ্টিধরের নাম নিয়ে বৈতল শুরু করে কথা,
--- দুই বন্ধু সনা আর মনার গপ, বুঝলে নি ।
দুইটায় অউ নাগাপট্টি থাকি খাইয়া বার অইছে, তখন রাইত বারোটা । আর খাইলেউ তারার
আল্লা আর ভগবানের কথা মনো পড়ে । কে বালা কে খারাপ ইতা লইয়া তর্কাতর্কি মারামারিও
অই যায় । তর অউ দামা ইগুর মতো, অউ যেন বে বেট্টি ইগু, কিচ্ছু বুঝে না বেটা তিন
কড়ার বালিগড়া, কিন্তু তান কথায় কথায় থুতা করন লাগব ।
কথার ভিতর এত দুখুকথা শুনেও দুখু
রাগে না, তাতে না । বরং হাড়জ্বালানি মুচকি হাসি দিয়ে বৈতলকে রাগায় । বৈতলের দু
লাইন কথা মাঠে মারা যাওয়ায় মূল গল্পে ফিরে যায় আবার । বলে,
--- তারপরে বুঝছস নি হিরাইত আক্তা দুইজনে কয়
আর তকরার ঝগড়া করত নায় । কয় ইবার চিৎপটাং অউক । যে চিৎ অইবা তাইন অউ ভালা । মানন
লাগব । অয় অয় ।আট আনি এগু বার করল সনায়, সনাউর । দিল মনারে, মনোরঞ্জন । কইল নে কর
চিৎ, আমার চিৎ । মনায় আটানি ইগু নিয়া রাখল নউখর উপরে, মারল ঠেলা । ঠুংঠাং করল না ।
পয়সা গিয়া পড়ল নালাত । আর আঠানি হারাইয়া ইগুয়ে হিগুর গলাত ধরিয়া নি অউ কান্দা ।
ইগুয়ে কান্দিয়া ডাকে পিসিমারে । আবার কয় আমার আপন পিসি নায়, তাইন পিওনহড়ি । ইগুর
দেখাদেখি হিগুয়ে ডাকে খালারে, কয় আমার আপন খালা । কান্দতে কান্দতে মনায় কয়, উবা তর
আটানি আমি বার করি দিমু । নালাত হাত দিয়া মদুয়ায় পয়সা খোঁজে, পায় না ।
সনায় কয়, তুই কান্দিছ না হর, আমি বার করমু । আর এক মদুয়ায় হাত দেয় পায় না । খালি
পেক উঠায় । তখন ইতা পেক উক দেখিয়া তারার আল্লা আর ভগবানর কথা মনো পড়ে । কয় এক কাম
করি হুন, আমরা তারার নাম লইয়া খুঁজি । সনাউরএ ভগবানর নাম লইয়া খোঁজে, মনোরঞ্জনে
আল্লার নাম লইয়া খোঁজে । খুঁজতে খুঁজতে তারা দেখে হারাইছিল এক আটানি পাই লিছে দুই
আটানি । কেমনে পাইল ক ।
ধর্মপ্রাণ দুখু ধর্মাধর্মের
বিভিদে নিজেকে জড়াতে চায় না । বলে,
--- উপর আলারে লইয়া তোর ইতা ফাত্রামি আমার
ভালা লাগে না । বাদ দে ।
--- কইতে পারলে না ।
--- কেনে পারতাম নায়, আল্লায় খুশি হইয়া দিছইন
। তোর তো খালি ইতা ভাইয়াপির গপ । রুন্দা যে খাইয়া আইচছ পাকিস্তান থাকি তেও পেট
ভরছে না ।
--- ইগু ভাইয়াপির গপ নায় বেটা পুঙ্গির ভাই ।
--- তে কিতা ।
--- উপরআলায় খুশি অইয়া দিছইন ঠিক অউ । ভাবছইন
কী ভালা মানুষ, উপরআলা বদলাবদলি করি আধলি খুঁজের এর লাগি দুইজনরে দিছইন দুই আধলি ।
উপর আলাও ঠগছইন, তারা কেউ নিজর ঈশ্বররে পেকো লামাইত না করি ইতা কইছে । বুঝচছনি
মানুষ কত শয়তান উপরআলা থাকি । অখন ক, তুইনি পেকো লড়াচড়া দেখিয়া আস্তিক মুনি ডাকছ ।
ওদিকে শুকনো নেশার টানে বছই
মিয়ার তর সয় না । বৈতলের সম্পর্কে আর দীর্ঘ হতে দেয় না । ইতি টানতে বলে,
--- ঠিক অউ কইচছ । আপনা থাকি
বেগ্না ভালা, পানি থাকি পেক ভালা । অখন ক আনচছ নি ।
--- কিতা আনতাম । মশল্লা তো । ইতা তো আনব আপদে ।
এবার
রাগে বছই । বলে,
--- অউত্ত মালাউন হকলর এক দুষ । কথার ঠিক নাই
হালার ভাইর ।
চার বন্ধুর একজন শুধু ভিন্ন
ধর্মের । সে বৈতল । তাকে নিয়ে, তার ধর্ম নিয়ে মস্করা করে বাকিরা । রিফ্যুজি
বাঙ্গাল মালাউন হালার হালা এসব যেমন তাদের গালাগালির ভাষা তেমনি ভাইয়াপির ভাষাও,
দোস্তির ভাষাও । হিন্দু বন্ধুকে যেমন ধর্ম নিয়ে গালাগালি দেয় আবার বন্ধুত্বের
প্রয়োজনে বৈতল মিয়া সাজিয়েও নিয়ে যায় বেরাদরিতে । গালাগালির আঠা দিয়ে ওরা
বন্ধুত্বের জোড় শক্ত রাখে ।
ইতিমধ্যেই চতুর্থজনের প্রবেশ ।
শ্রীমান আপদ আলি মোল্লা । চারবন্ধুর শারীরিক গঠনের কোনও মিল নেই কারো সঙ্গে । বৈতল
যেমন মাঝারি লম্বা টিঙটিঙে বাতাস দিলে উড়ে যায় । দুখু বেঁটে মোটা আম গাছের গাইল,
‘হাজার টেকার মরিচ খাইয়া আরো খাইত চায়’ । বছই লম্বা মোটা ‘আঠালি’ কলার গাছ আর আপদ
শুধু নামেই আপদ, রং কালো কিন্তু বৈতল থেকে লম্বা, এক থাবা বেশি । সবুজ লুঙির
অনেকটাই কোমরের উপর, তার উপর লাল গামছা । গামছায় বাঁধা পুটুলি । বৃষ্টির ছাট
বাঁচিয়ে, শরীরকে ধনুকের মতো বেঁকিয়ে দৌড়ে এসে আসরে ঢোকে । বেতের শরীরে কোন হাঁফ
নেই হাঁসফাঁস নেই । বলে,
--- কই বইতে চল ।
বছইও
লম্বা কম নয়, তবে বৈতল থেকে কম । শরীরে লম্বা কিন্তু মাথায় মোটা । বলে,
--- কেনে চল, হাকিম সাহেবের কব্বর সব থাকি
উচা ।
কবর বিশারদ দুখু মিয়া জানে জলের
হদিশ, হাল হকিকৎ । দুখু কয়েকটি বড়লোক পরিবার থেকে টাকা পয়সা পায় কবরের বেদি
পরিষ্কার রাখা দেখাশোনা করার জন্য, বিশেষ দিনে ধূপকাঠি জ্বালানোর জন্য । হাকিম
সাহেবের কবরও তার । তাই বলে,
--- কই তোর কবর, সব পানির তলে । অখন অউ
সরকারি বান্দা আর কালভার্ট । বইলে বও নাইলে উবাই উবাই মারি দেও ।
--- কেনে ছাতনি গাছোর আগা আছে নানি । চল উঠি
যাই ।
দুখু বাধা দেয় । বলে,
--- না, আমি ই পিছলা গাছো উঠতাম নায় ।
বৈতল দুখুকে মেজাজ দেখায় । বলে,
--- তোরে কে উঠত কইছে রে হালা, তুই বান্দর
উপরে থাকবে । পারা দিবে ।
দিশেহারা চার নেশাড়ু সমাধানের পথ পায় না ।
কোথাও একটু না বসলে মৌতাত হয় না । হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা কালভার্টের কিনারা পায়
ইট সিমেন্ট বাঁধানো । আশেপাশে কেউ কোথাও নেই । নিশ্চিন্তে হাওয়ায় ওড়া যাবে ।
কিন্তু ওরা পৌঁছনর আগেই একজন ঘাপটি মেরে বসে
থাকে জল আর স্থলের সীমানায় । দুখু আর বছইর দুজোড়া হাত ভয়ে জড়ো হয়ে যাচ্ছে ।
মাথামোটা আপদ কিছুই দেখেনি, এগিয়ে যাচ্ছে জায়গা নিতে । বৈতল লম্বা মানুষটিকে এক
ঝটকায় টেনে এনে ফেলে দেয় অন্য দুজনের গায়ে । মুখে আঙুল দিয়ে চুপ থাকতে বলে । বৈতল
এগিয়ে যায় জলের সীমানায় । দৃশ্যমান লেজের উপর কৃশ হাতের ছায়া পড়তেই লতাদেহ নড়ে ওঠে
। ক্ষিপ্রতায় অতুলনীয় বৈতল লেজ ধরে নেয় তার বজ্র আঁটুনির মুঠিতে । তারপর সেকি
ঘূর্ণন মহাদেবের তাণ্ডবও এমন ধীর স্থির নয় । নির্ভুল পদচারণা, নির্ভুল হাত ঘোরানোর
মুদ্রা । ঘোরাতে ঘোরাতে একসময় সাউৎ করে ছুঁড়ে দেয় ডান দিকে, মাঝনদী তাক করে ।
বৃষ্টির জল, না ঘামের জল বোঝা যায় না, তবে রাগে কাঁপে ভেজা বৈতল ।
আপৎকাল কেটে যাওয়ায় দুখু ফিরে
পায় তার স্থৈর্য । স্বভাবসিদ্ধ মন্তব্যে তাতিয়ে দেয় বৈতলকে । বলে,
--- কাজিমরা এগুরে খেদাইয়া অখন তড়পাইরে কেনে
।
--- তারা কুনুদিন কাজিমরা অয় না ।
দুখু জানে না বৈতলের ক্রোধের কারণ । লুলা বেজ
তাকে শিখিয়েছে সাপের বংশ নাশ করার কৌশল । দুখুকে বলে বোঝাতে পারবে না বৈতল
তার ক্রোধের কারণ । বৈতলের মাকে মেরেছে যে, তার প্রতি কোনও দয়ার সম্পর্ক নেই
বৈতলের । দুখু বুঝবে না, মেলাতে পারবে না মনসামঙ্গলের গায়ক সৃষ্টিধর শর্মা ওঝা
ওরফে বৈতল আর সাপের শত্রুতার পরস্পর-বিরোধিতা । তাই বৈতল দুখুর কথার চিমটি ঝেড়ে
বীরবিক্রমে আপদের দিকে তাকায় । বলে,
--- মরি গেলে নে বেটা যেলা আউগ্গাইছলে ।
--- ছাড়ি দিলে কেনে তে ।
--- না ছাড়লে তর অউ ইমামে কইত হালাল কর, এক
ছেদে মারিছ না । ইতা না হিতার ঝগড়ার মাঝে অলগর্দা ইগুয়ে আমরারেউ ডংশি লাইলনে ।
--- ঠিক অউ করচছ । আলদ ইগুও ডরাইছিল । আমরার
কিতা আমরা তো কুনুখানো জাগা পাইলিমু । পানি বাড়লে গরমেণ্ট ইস্কুল, টাউন মাদ্রাসা
নায় নর্মাল ইস্কুলো জাগা পাইমু । তারা কই যাইত । ঠিক অউ
অইছে মরারে মারিয়া লাভ নাই ।
--- অই মরা কিগুরে কছ । ইতা কুনু সময় মরে না
। খালি মারে ।
--- তে ছাড়ি দিলে কেনে ।
--- ইতা তুই বুঝতে নায় । দাত ভাঙ্গি দিছি ।
বিষদাত গেলে ইগু আর সাপ থাকল নি । ইগুর হালত পাকিস্তানোর হিন্দুর লাখান । লেংটি
খুলি গেছে, ইদিকে খালি বেটাগিরি । সুভাষ বোস আইয়া দুই বাংলা এক করবা ।
--- অই হালার হালা । সাপ মারচছ না বালা করচছ,
অখন ইতা কাবিলাতি ঝাড়রে কেনে । তর কথাত নি চলত দেশ । তুইন অইলে রিফুজি, তর কুনটা
হাচা কুনটা মিছা, কেমনে বুঝতাম । তুইন একবার কছ বাবন, একবার কছ মাইমল, অখন
কইরে তুই বেজ । বাদিয়ার লাখান সাপ নাচানি শিখলে কানো ।
--- তর বাপর কাছ থাকি । এক লাথ মারমু শুওরর
জনা ।
বৈতলের বিচারশালার জবাব যে এত
তড়িঘড়ি হবে কেউ ভাবেনি । মুখের কথা বেরোতে না বেরোতেই বৈতল সত্যি সত্যি লাথি মারে
দুখুর পেছনে । বৈতলের হঠাৎ ক্ষেপে যাওয়ার হতভম্ব বছই আর আপদ । অপ্রস্তুত দুখুও
আচমকা আক্রমণে লাট্টুর মতো গিয়ে ছিটকে পড়ে বাঁধের উল্টোদিকে । যেখানে বৃষ্টির জলের
শেষ সীমানা । দুখুও কম শক্তিধর নয় । জল আর স্থলসীমার এক বিপরীত কোণে দাঁড়িয়ে সে
বৈতলকে দেখে । চোখে তার আগুন । লুঙিতে গিঁট দেয় নতুন করে, দুপায়ের ভিতর ঢুকিয়ে কষে
দেয় টান । দেয় হায়দরি হাঁক । অশ্রাব্য গালাগালি দিতে দিতে উঠে আসে বৈতলের কাছে ।
বৈতলের চোখে চোখ রাখে । চোখ সরিয়ে নেয় । দুখুর ওঠানো হাত থেমে থাকে ।
কাকে মারবে দুখু । এ যেন ঘোর লাগা এক মানুষ । এক অচেনা মানুষ, কিন্তু মিথ্যে নয় । অতি পরিচিত । দুখু বৈতলের অজানা দুঃখ সহ্য করে । পাল্টা মারের ওঠানো হাত দিয়ে
এক ধাক্কা মারে সজোরে । সরে আসে । বৈতলও গিয়ে বসে নদীমুখে কালভার্টের উপর । নদীর দিকে তাকায়, নদীকে প্রশ্ন করে কিছু । নদী তো উপলক্ষ । আসলে বৈতল দুখুকে
চায় । দুখুর মধ্যে বৈতল লুলাকে খোঁজে । একা, আপনমনে পাশে এক কল্পনার দুখুকে বসিয়ে
তার কাঁধে হাত দেয় । বলে,
--- আইচ্ছা দোস্ত ক চাইন, তোরে কেনে মারলাম ।
তুই তো আমার প্রাণর বন্ধু । তোর দোস্ত নায় নি আমি । আমি কিতা বেটি পাগল অই গেছলাম
নি রে । দুর্গার লাগি নি । কী জানি কিতা ।
ভরা নদী আর তার অছল তছল জলের ডাকাডাকিতে
বৈতলের বিভ্রম হয় । মনে পড়ে কৈশোর সহচরকে । মনে পড়ে স্বদেশ । দুখুর উপর অভিমান হয়,
কেন তাকে অবিশ্বাস করে দুখু ।
দুখু বৈতলকে বুঝিয়ে দেয় শুধু
গায়ের জোরে শক্তিধর নয় । মনও আছে তার । দুখুই শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি সামাল দেয় । আপদকে তাড়া দেয় । বলে,
--- নে ইতা ছাড়, অখন বার কর তোর মাল । সাপ
ঘুরাইতে ঘুরাইতে তো হিগুয়ে হাইঞ্জা লামাই লিলো ।
সত্যি মেঘ বৃষ্টিতে অন্ধকার সন্ধ্যা নামে ।
তাড়াতাড়িই নামে । বৃষ্টিরও থামার নাম নেই, আকাশ কালো ও ঘুটঘুটে হয়ে আসে । চারপাশে
মুখ গোমড়া ঘোলাজলের মাঝখানে কালো রঙের চারজন লুঙিপরা মানুষকে ভূতের মতো লাগে ।
সিমেন্ট বেদির একদিকে নদীর সঙ্গে কথা বলে বৈতল । অন্যদিকে দুখুর নেতৃত্বে নেশার
প্রস্তুতি । ওরা কেউ কালভার্টে বসে না, বসে আপদ আলির লাল রঙের গামছা । গামছা বাঁধা
পুঁটুলি । বৃষ্টির ঝমঝমিতে পূঁটুলি ভেজে । আপদ আবার উঠিয়ে নেয় তার প্রাণের
ধন । আবার পেটের নিচে চালান দেয় । দুখু ধমক দেয় । বলে,
--- অই বেটা, কইলাম নু ধনুরাশি হইয়া থাক ।
ভিজত নায় ।
আপদ দুখুর কথামতো ধনুর মতো পিঠ
বেঁকিয়ে থাকে । বছই মিয়া বাঁকা জায়গার শূন্যস্থান পূর্ণ করে । আপদের পেটের নিচে
ঢুকে যায় । জলের হাত থেকে বাঁচে পেটিকা । কিন্তু বৈতলের মান তখনও ভাঙেনি । দুখু
আবার রাগে । বলে,
--- অই বচই । তুইতো লাম্পাও গাট্টাও ইগুর
পেটো থাকতে পারতে নায় । নেশাখোর হিগুরে ক আইয়া বানাইত । নাইলে ইবার
আমিউ লাথ মারি ফালাই দিমু গাঙ্গো ।
ধমক খেয়ে ওস্তাদ তখন সুরসুরিয়ে
নামে আসরে । দুখুকে সরিয়ে দেয় একপাশে । বলে,
--- সর সর রাড়ি বাটি । ইতা তোর কাম নায় ।
বৈতল ঢুকে যায় আপদের বাঁকানো শরীরের বাঁকে ।
নিপুণ প্রক্রিয়ায় আপদের গামছার গিঁট খোলে । বছই খোলে দ্বিতীয় গিঁট । তৃতীয় গিঁট
খুলতেই বেরোয় গুপ্তধন । ক্যাপস্টান সিগারেটের কৌটো । পরিচিত ঘটনার দৃশ্য চার জোড়া
চোখে । আপদের কোমরকশি থেকে বেরোয় গাঁজার চিলিম । বৈতল দুখুকে ডাকে,
--- নে ধর ।
দুখু ধরে পোড়ামাটির কল্কে, বছই
দেয় এক টুকরো ন্যাতা । কারো লুঙির ছেঁড়া টুকরো । দুখু চিলিমের নিচে জড়িয়ে দেয় ।
সিগারেটের টিন থেকে বেরোয় চিলিমের গুলি । বৈতল এবার আসল কাজের জন্য দুখুর হাত থেকে
কেড়ে নেয় চিলিম । দীর্ঘাঙ্গ আপদের নুয়ে পড়া পেটে থাবড়া মেরে বলে,
--- বাক্কাউতো বেটা ঘাসকাটা কাটিয়া আনচছ । জল
দেওন লাগত নায় । এমনেউ ভেতলা অই রইছে । শলই জ্বলব তো ।
--- জ্বলব জ্বলব । সব নিচে রাখছি শলই, ভিজাত
নায় । ঘোড়ার মাথা এমনেউ নষ্ট হয় না ।
--- আর কইছনা তোর ঘোড়ার মাথা । আপদ ভাই যদি
একটু আগে আইতে, দেখলে নে ঘোড়ার ফালাফালি । বিড়ি ধরাইত না পারিয়া হেশে শলইরে কয়
বেইমান ।
দুখুর তেড়া বেঁকা কথা উপেক্ষা করে বৈতল । এবার
তার পালা । সে এখন আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত । একবারেই কাঠি ফড়ফড়িয়ে উড়তে থাকে ফুলকি ।
জ্বলেছে, ফুটেছে গাঁজার ফুল । ঘুরছে এ হাত থেকে ওহাত । মৌতাতে মজে
যায় তিন বন্ধু । বৈতল গান ধরে শিবনাথের,
তাথৈয়া তাথৈয়া নাচে ভোলা
বম বম বাজে গাল ।
এক এক টানে শেষে তিনবন্ধু মিলে বৈতলের প্ররোচনায় দুখুর কানে গিয়ে হাঁক দেয়
‘শিবো হে’ ।
বন্ধুদের কাণ্ডকারখানা দেখে দেখে দুখুর মুচকি
হাসি বড় হয় । বৈতলও দুখুর থুতনি নেড়ে দেয় । বলে,
--- দেখো দেখো, শিব ঠাকুরে গাইঞ্জা খাইন আর
বলদবেটার নেশা হয় । বাট্টি বেটা ইগুয়ে উঙায় দেখো, হালার হালা শয়তানর লাট্টি । দে
না এক টান, এক টানে কিচ্ছু অইত নায় ।
এক অদৃশ্য ভেল্কিবাজিতে তখন চরাচর থেকে মেঘ
উধাও, বৃষ্টি উধাও, ছলছলাৎ জলও উধাও । চার বন্ধুর প্রাণে শুধু আনন্দ । বৈতলের
প্রাণে আনন্দ এলে গুরু সৃষ্টি ধরকে মনে পড়ে । জৈন্তিয়া পাহাড়ে গিয়ে নেশা করেন গুরু
। দেশি মদ খেয়ে বিভোর হয়ে তার পাঁচ কন্যাই দান করে দেন বৈতলকে । বৈতলেরও চোখ
ঢুলুঢুলু । খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে গুরু আনন্দের ব্যাখ্যা দেন । বলেন,
--- বুঝলায় নিবা, গরিবর আনন্দ উৎসবো কুনু
চান্দোয়া টাঙানি লাগে না । দুই পয়সার নেশা দিলাও হে এক বছরর লাগি খুশ । কাইল থাকি
আবার রান্দা টানমু । কিন্তু আইজ তো আনন্দ ।
গুরুবাক্য শিরোধার্য করে বৈতল দুখুকে বলে,
--- দে নাবে একটান । আইচ্ছা কাম নাই টানাটানি
করিয়া । তোর অউ হাসি খান অউ থাকউক । হাসিত অউ আনন্দ রে বেআক্কল । তুই খামোকা
খামোকা তিনবার বেআক্কলর হাসি হাসিয়া দেখাছ না । নে তোর অউ হাসির লাগিয়াউ ফরমান
উঠাই নিলাম । যা, আর তোরে জলো ডুবাইয়া মারতাম নায়রে হালা ।
ওরা শালা ছাড়া পরস্পরকে দেওয়ার মতো গালিও
খুঁজে পায় না । দুতিন বার চারবার দম দেওয়ার পর নেশাকে আটকে রাখতে ওরা ধোঁয়া বেরোতে
দেয় না একটুও । দমবন্ধ হয়ে থাকে যতক্ষণ পারে । এবং এক অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় হজম করে
ফেলা ধোঁয়া বেরোতে থাকে কান দিয়ে নাক দিয়ে কিছু চোখ দিয়ে । লাল হয়ে যায় চোখ ।
লাশছাড়া অবস্থা হতেই কাজ শুরু হয় দুখু মিয়ার । কলকে ন্যাকড়া ধুয়ে নেয় বন্যার জলে ।
সিগারেটের টিনে সব গুছিয়ে রাখে । কল্কে বেঁধে দেয় আপদের কশিতে । বৈতল সব দেখে ।
গোছগাছ হয়ে গেলে গতর ভাঙে । বলে,
--- এর লাগিউ তোরে লাগে । তুই বেটা পাক্কা
পিরর চেলা । তুই মজিদো থাকলেও ভালা ইমামতি করতে পারলে নে ।
দুখু মিয়ার হাসি চওড়া থেকে চওড়া হয় । বলে,
--- আমি ইমাম অইলে তরে পয়লা মুসলমান বানাইমু
।
--- আমি অই যাইমু, অই যাইমু মুসলমান । দেখিছ
তুই । আমার খালি একখান কাম বাকি রে দুখু । ই ধুড়া সাপ দুইটায় বুঝত নায় কিচ্ছু ।
তুই পারবে ।
--- কিতা পারমু । আমি কিচ্ছু পারতাম নায় ।
তুইনতো হালা আমারে পানিত মারতে । মার ।
--- না বেটা, তোরে নায় তোরে নায় । তুই তো
আমার দোস্ত । জান বাচাইচছ ।
--- অই তুই আমারে ধুড়া সাপ কইলে ।
--- কইলে ।
একযোগে প্রতিবাদে দুই নেশাখোর জেগে ওঠে জলের অতল থেকে । বলে আবার,
--- যা তোরে আর ইখান থাকি লইয়া যাইতাম নায় ।
আমরা তিনজনে তোরে পানিত ফালাইদিমু । আর অউ আলদ যেগুরে ফালাইচ্ছ, হিগুয়ে আইয়া খাইব
তোরে । তারা সব চিনি রাখে । ফুশ করি মারব এক কামড় । আর কইতে নি ধুড়া ।
--- অ বুঝছি, তিনজনে মিলিয়া বুদ্ধি করচছ ।
হিন্দু ইগুরে মারিলাইতে । মার ।
--- অয় মারমু । এগু অইলেও তো কমল ।
--- মারিছ না বেটা । কমত নায়, বাড়ব । আমিও
বাঙাল অই যাইয়ার ।
চার বন্ধুতে এবার হাসতে হাসতে একে অন্যের গায়ে লেপ্টে যায় । তিনজনের নেশায়
অন্যজনও গ্রস্ত হয় । শরীরের উত্তাপে বন্ধুত্ব গরম হয় ।