“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ৫ নভেম্বর, ২০১৪

বিশ বছর পেরিয়ে...একটি কালো মেয়ের কথা

            
 ।। দেবাশিস ভট্টাচার্য।।

       
(C)Image: ছবি
  কালো মেয়ে।দেশ যে বছর স্বাধীন হল, তার পরের বছর পৃথিবীর আলো দেখা। ধর্মনগর তখন বর্ধিষ্ণু এক গ্রাম। স্মার্ট নয় খুব। কৈশোরে, প্রথম যৌবনে কিছু আবৃত্তি করত আবেগ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ-সুকান্তর কবিতা। মাঝারি গড়ন, একটু মোটার দিকেই, সত্যি বলতে।যাত্রাদলে কিছু অভিনয়ও করেছে, বছর আঠারোয় পা দেবার আগে। সাইকেল চালানো জানে, টাইপ ও শিখেছে। মা বাবা মারা গেলে বাড়িতে কখনো একদম একা। ছোট দাদা যাত্রাদলের নিয়মিত শিল্পী, পানাসক্তিও যথেষ্ট।ফলে রাত কাটাতে হয় পাশের বাড়িতে, বান্ধবীর ঘরে। দুজনের সংসারের গৃহিণীকে মাঝে মাঝেই ছুটতে হয় বড়দার কাছে, রেল কোয়ার্টার বদরপুরে, কিংবা মেজোদাদার সেন্ট্রাল গোটানগর কলোনি, মালিগাঁও'র কোয়ার্টার এ।হটাৎ বিয়ে, এক স্কুল শিক্ষক তরুণের সঙ্গে।শশীনগর নামের এক গন্ডগ্রামে।প্রতাপগড় পাহাড়ের কোল ঘেঁষা গ্রাম।রাস্তা নেই, উঁচু টিলায় বাড়ি, দেখলে বুক কাঁপে। বয়স সদ্য বিশ।সেও ১৯৬৮র এক মাঘ, প্রবল শীত, ঘুরঘুট্টি আঁধার, ঘন জঙ্গল ঢেকে রাখে আকাশের চাঁদ।অথচ মেয়েটির ভীষণ আকাশ-প্রীতি। আর গান।
            গান সে কোনোদিন শেখেনি। কিন্তু, মাথার চুল পয়তাল্লিশে সব সাদা হওয়ার আগে সে আসর দখল করা 'গীতুলি', ধামাইল গানের গোটাদুয়েক খাতার মালিক। এ ছাড়া রবীন্দ্র গান। যে তিনটি গান পাটকাঠির উপর গোবর আর ধানের খোসার মণ্ড মাখিয়ে ঘুঁটে (মুঠিয়া) দিতে দিতে আনমনে গায়, সেগুলি ১। দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না/ রইল না সে যে আমার নানা রঙ এর দিনগুলি, ২।গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ, ৩। তুমি মোর পাও নাই পাও নাই পরিচয়...
            গ্রাম্য ওই মেয়েটির ভীষণ এক নাগরিক সত্তার পরিচয়, সত্যি পায় নি কেউ। বাড়ির বাইরে বেরোনোর অবকাশ পায়ই বা কই! সকালে উঠে চা মুড়ির পর্ব শেষে রান্না করা, 'টায় ছেলেরা বেরিয়ে যাবে দু' কিলোমিটার দূরের স্কুলে, শ্বশুর যাবেন যজমানিতে, স্বামী-দেবর একটু পরই স্কুলে রওয়ানা হবে। সুতরাং মাটির উনোনে রান্না, এরই মাঝে নীচের পুকুর থেকে কলস কাঁখে বালতি হাতে জল আনা, জল সেদ্ধ দেওয়া, মুড়ির ধান সেদ্ধ করা, উঠোনে মেলে দেওয়া ধান নেড়ে দেওয়া। বারোটা নাগাদ, তিন দেবরের কেউ বাড়ি না থাকলে গোরুকে সরিয়ে বাঁধা, জল খাওয়ানো। একটা থেকে দুটো অব্দি ঘুঁটে দেওয়া। এত কাঠ বাড়িতে, তবু ঘুঁটে দেয় কেন, আজ তার একটা যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে।আশে পাশে সকল কৃষিমজুরের বাড়ি এত বড় টিলা জুড়ে নেই। নতুন আবাদ করা বাড়িতে গাছ ও নেই।তাই ঘুঁটে দেওয়া। কালো মেয়ে, ততদিনে পুরোনো গিন্নি, কারো কাছ থেকে কোনও কাজে পিছিয়ে থাকলে চলে? সব কাজ যে জানতে হবে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বলা বাহুল্য, তার নিজের স্বভাবের সঙ্গে।
                  বেলা দুটোয় দুপুরের খাওয়া। শিতলপাটি পেতে একটুখানি গড়িয়ে নেওয়া তার শখ, সে আধ ঘন্টার, মুখের পান শেষ হওয়ার আগেই উঠে পড়া, শশুর মেয়েদের দিবানিদ্রায় অলুক্ষুনেপনা দেখেন যে! এখানেই শেষ নয়, শ্বশুর, ব্যাকরণতীর্থ ভুবনমোহন জানেন, উঁচুতে গলা তুলে কথা বললে কী পাপ হয়। নিজে কথা বলেন যেন ঝড়ের হাওয়ার সঙ্গে লড়াই করার সুরে, “পেট খাল করে”। কিন্তু, তিনি তো পুরুষ। অপরপক্ষে, “মাইয়ালোকের কলকলিতে পোলাপানের শ্রীনষ্ট হয়”। তবে 'খালি ঘরের বৌ'কে দোর্দণ্ডপ্রতাপ শ্বশুরমশাই ভীষণ ভালোবাসেন। এত ভালোবাসা কোনো শ্বশুর বুঝি বাসতে পারে! বউমা নাইওর গেলে, নীরব গোছের বরের চাইতে সরব শ্বশুরমশাই মুশড়ে পড়েন বেশি। অবকাশ পেলে রান্নায় সাহায্য, শব্জি কাটা, ভাতের ফেন গালা...কালো মেয়ে্র এ নিয়ে নীরব অহংকার ও আছে।আর দুর্দান্ত দামাল কিশোর দুই দেবর—বউদি তাদের স্নেহের আশ্রয়স্থল।
           এ সংসারে বউ হয়ে থাকার তেমন আর সুযোগ ঘটল কই! বিয়েটাই অসম্পূর্ণ ছিল যে। বিয়ের কালরাতের দিন বরের ঠাকুমা মারা যান, বুড়ি নাতবউ এর মুখ দেখার জন্যে যেন যমের সঙ্গে চুক্তি করেই বেঁচে ছিল। শাশুড়ি তো ছোট দেবরের জন্মের অল্প দিন পরেই মারা গেছেন। আর, বিয়ের হলুদ ফিকে হওয়ার আগেই, গত সন্ধ্যায় এ অচেনা দেশ, অচেনা মানুষগুলির সংসারে আসা কালো মেয়ে একই সঙ্গে কর্ত্রী আর দাসীর ভুমিকায়।নির্দেশনায় বাজখাই গলার তামাক খাওয়া পিসিমা, শ্বশুরের সোনদিদি।ভাগ্য ভালো, এই মৃত্যুর জন্য কেউ তাকে অলুক্ষুনে বলে নি মুখের উপর। লোকের মনে কী ছিল, কে জানে!
           আবৃত্তি, অভিনয়, সব এক লহমায় স্মৃতিকথায় রূপ নিল।শুরু হল যুদ্ধ। ঢেঁকিতে ধান ভানায় সহায়ক দেবরেরা, কখনো শ্বশুরমশাই।দেশভাগের দু দশকেও উদ্বাস্তু জীবন থিতু হয়ে উঠতে পারেনি। বিয়ের পর সারা জীবন শুধু যজমানি লাল পেড়ে শাড়ি পরা। স্বামী-দেবর শ্বশুর সবার বাড়ির পোশাক গামছা কিংবা মার্কিন।কালো মেয়েকে এ জীবন কিছুই দেয়নি বুঝি? দিয়েছে অনেক।দোর্দণ্ডপ্রতাপ শ্বশুর যেন স্নেহার্থী বালক। দিনে কতবার বউমা ডাক, কারণে অকারণে। বিশেষ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আগের দু বছর পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী হওয়ার পর! মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে যায় কালো মেয়ে। বলে, “বারে বারে ডাকইন, মুড়ি ভাজাত বইছি...''। ভুবনমোহন বলতেন, 'মরবার সময় বউমা বউমা ডাকতে ডাকতে যেন মরি'। ১৯৮৭র অষ্টমীর সকাল থেকে গলা ঘড়ঘড়। আর শুধু বউমা বউমা ডাক...বাক ক্রমশ নিস্তেজ হয়। ভুবনমোহন কথা রেখেই মারা যান।
##
              গ্রামের গৃহবধূ, নিম্নবিত্ত পরিবারের। শ্বশুর বলতেন, “সঞ্চয়ী লোক সুখে থাকে সকল বাঞ্ছা সফল হয় না”। সঞ্চয় বলতে সীমাহীন ভালোবাসা। তার পক্ষ থেকে যা ফিরিয়ে দেবার, তা হল মুগ্ধ করা ব্যবহার, সরব হাসি। কোনো হাসি মনের শ্রমসাধ্য কসরত, কোনোটা আবার মনের আয়াসহীন স্নান। তার সান্নিধ্যে, এই স্নান সারা হয়ে যায় বলেই, বালক-কিশোর-প্রৌঢ়-বৃদ্ধ আর বালিকা-কিশোরী-প্রৌঢ়া-বৃদ্ধা সকলেরই সঙ্গে তার সমান বন্ধুতা।এই বন্ধুতায় তার প্রেম বিলানোর অলৌকিক সুখ, আর শ্রম ও সৃজনের শক্তিসঞ্চয়। হাঁস আর ছাগলের এক বড়সড়ো সংসার তার এই সৃজনসুখের ফসল। এর বৈষয়িক একটি দিক ও আছে। একান্নবর্তী বড়ো সংসারের ছোটখাটো দরকারি সামগ্রী, মাসের শেষের সুপুরি-চাপাতা এসব তো এখান থেকেই। তবে সামান্য পুঁজির বড়ো দায় হল আশ পাশের মানুষের বিপদে “ধার” দেওয়া। এই ধার যারা নেন, তারা সপ্তাহে তিন চারদিন আসেন, গল্প গাছা করেন, তবুও ধারটির কথা প্রায়ই ভুলে যান। মেয়েটিও মনে করিয়ে দেয় না।প্রয়োজনে একজনকেই দু তিনবার “ধার”। এ নিয়ে কখনো বকুনি খেলেও অদ্ভুত সেই সরব হাসি ছাড়া বিশেষ প্রতিক্রিয়া নেই। আর, এসবই জীবনের অর্জনের রূপ ধরে। নাম হয় জনপ্রিয়তা। গ্রামের বিয়ে বাড়িতে বরযাত্রীকে গেট এ আটকে রেখে কথা বলবে কে? এত মাধুরী তার কথকতায়...কর্মপুরুষ, বিপদনাশিনী, আশ্বিন সংক্রান্তির লক্ষীপূজার গল্প, সদ্য আবিষ্কৃত সন্তোষীমা, কিংবা সংকটা ব্রতের গল্প সে কী করে জেনে নেয়, আর সে কী স্নিগ্ধতা বিকিরণ করে ছেলেদের সে গল্প শোনানো। আবার শরৎচন্দ্রের উপন্যাস এর গল্প তার কাছে শোনার অভিজ্ঞতাও দারুণ। বিকালে গড়িয়ে নেবার সময় নানা জায়গা থেকে সংগ্রহ করা শারদ সাময়িকী--বাড়িতে আর একজন তার ভাগ নেয়। সে তার বড়ো ছেলে, কিশোর বয়সে খেলার মাঠ যাকে তেমন ডাকে না, বরং যাত্রার মহড়া আর নভেল পড়ার আনন্দ তাকে টানে। ভূগোলের খাতার তলায় মায়ের এ সব সংগ্রহ কখন গোগ্রাসে পড়া হচ্ছে, রান্নাঘর থেকে মহিলাটি ঠিক ধরতে পারে। আরো কত কী ই যে বুঝে নেয় সে। ছেলে কখন প্রেমে পড়ল কলেজ এ পড়তে গিয়ে ঠিক জেনে নিয়েছে আকাশের কাছে। জেরায় জেরায় জেনে নিয়ে শুধু মেয়েটিকে দেখবার জন্য ৫৫ কিলোমিটার দূরের শহর করিমগঞ্জ এ চলে যায়।উঠোনে ক্যাম্প খাট অথবা শিতলপাটিতে শুয়ে রাতের তারা, আকাশ দেখা, শ্যামাসঙ্গীতের সুর গুনগুন করতে করতে আকাশে হারিয়ে যাওয়া--তার শখ বল শখ, নেশা বল নেশা।লুব্ধক-কালপুরুষ সে জানত না, ধ্রুবতারা ছাড়া উপরের সংসারের কাউকেই তেমন চিনত না।কিন্তু, বড়ো আয়ত চোখে সে আকাশ দেখে।এই এখানে সে একা, ...কা...
                   আকাশ তাকে দেয় প্রবল প্রাণশক্তি, এই শক্তিতেই সব কাজ শেখা, সবারই বন্ধু হওয়া, ঘর সামলে ভোট এ দাঁড়ানো। এত কাজের সহায় গ্রামের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে মহিলারা। যারা ধান ভানতে আসে, তারাই কাঠ কুড়িয়ে এনে দেয়। এত বন্ধুতার শক্তি, সমস্ত অস্তিত্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্নিগ্ধ আলো ছড়ানো এক প্রসন্নতা। আর দারুণ অবজেক্টিভ পর্যবেক্ষণ, এক সর্বব্যাপী সহানুভুতি।
                    একদা আকাশ তাকে ডাক দিল। কয়েকমাসের ঠিকানা ঠাকুরপুকুর ক্যান্সার হাসপাতাল, খাদ্যনালী থেকে দ্রুত অন্য প্রত্যঙ্গে সংক্রমণ।চুল পেকে সাদা, ভারী শরীরে ক্ষয়ের চিহ্ন,কিছুতে হিমোগ্লোবিন আর বাড়ে না। তৃতীয়বা্রের সফরে লোহিতকণিকার বিশ্বাসভঙ্গ। হাসপাতালে শুয়ে ছেলের দেওয়া নির্বাচিত কলাম শেষ করে তসলিমার অন্য লেখা পড়বার আগ্রহ। এই মা কে ছেলে, ইতিমধ্যে কলেজ এর শিক্ষকতা শুরু করা ছেলেও চেনে না। ভাবে, কাকে উদ্দেশ্য করে মা গাইত, “ তুমি মোর পাও নাই পাও নাই পরিচয়”। একেবারেই কি ইঙ্গিত ছিল না কোথাও? বিয়ের আলাপ এ, গ্রামের নানা পরিবারের ঝগড়াঝাঁটি সম্পত্তি বিরোধ, মাটি-জমি-দলাদলি এ সব প্রসঙ্গে দারু্ণ সব সমাধানের সূত্র।তখন খুঁটিয়ে দেখলে ,মলিন লাল পেড়ে শাড়ির ভেতর পানে কালো হয়ে যাওয়া দাঁতের পাটি, অযত্নে উদাসীনতায় ফাটা পা, শনের মতো রুক্ষ চুলের নারী চল্লিশেই যাকে ষাটের ঘরের মনে হয়, তার ভেতর থেকে এক দিব্য রূপ, কলেজ এর শিক্ষয়িত্রীদের মতো পরিপাটি চিন্তার পরিশীলিত এক নাগরিক উপস্থাপনা। সে দিকে অভিনিবেশ, তার স্বীকৃতির কোনো অবকাশ ও প্রয়োজন, কিছুই ঘটেনি। খুবই সাধারণ, খুব খুব সাধারণ ছিল সে। কিন্তু, বছর সতেরোয় যাত্রাদলের কোনো তরুণের লেখা ছোট্ট একটি চিরকুটে একটি নিভৃত সংলাপের প্রার্থনাকে ৩০টি বছর সংরক্ষণের প্রসন্নতা ছিল তার, ছেলেকে ছোট্ট চিরকুটের হদিশ দেওয়া, কিংবা ছেলে অব্রাহ্মণ মেয়েকে বিয়ে করতে চাইলে বাধা না দেওয়ার জন্য, মেনে নেওয়ার জন্য স্বামীকে “শেষ অনুরোধ” টুকু --এসব সে বিস্মৃত হয় নি।তখন তার নাক বেয়ে চুলে ক্লিপ দিয়ে আঁটা রাইলস টিউব। সেটি খোলা হয়েছিল শবকে চান করানোর আগে। আজ থেকে ঠিক বিশ বছর আগে। ৪ নভেম্বর, ১৯৯৪।

##

                 এই সাধারণ মেয়েটি আমার মা। আমি রুদালি দেখিনি, ভূপেন হাজরিকার কন্ঠের গানটি না শুনলে রুদালিদের কথা অনেকেই জানত না, আমার মতো। তবে, আজও বিশ বছর পর, মা এর সমান বয়সের আর অসমবয়সের গুণগ্রাহী মহিলারা আমাদের বাড়িতে আসেন, যোগাযোগের যে সব বৈষয়িক প্রয়োজনের সূতো ছিল, সব ছিঁড়ে গেছে, তবুও। এরা কেউ রেকমানের মা, কেউ শুনুর বউ, কেউ পাতু, কেউ লাড়ুর বউ...কেউ কেউ মরেও গেছেন। যারা আছেন, তারা এখনো আসেন, বাড়িতে যখন যে বউ থাকেন, তার কাছে আশিসের মা'র স্নেহ-সাহায্য ইত্যাদির স্মৃতিকথার নানা এপিসোড তুলে ধরেন রুদালিদেরই মতো।বাড়ির বউদের কাছে শাশুড়ি এক স্নিগ্ধ-শুভঙ্কর মিথ।মিথ গ্রামে আসা অন্য বউ, নতুন পরিবারের কাছেও।
                         আমি মায়ের গন্ধ পাই, শশীনগরের বাড়িতে গেলে। শরতের উঠোনে শিউলি ফুলের গন্ধে, পৌষ পার্বণের পিঠে বানানোর দৃশ্যে, হটাৎ দৈবাৎ মুড়ি ভাজার দৃশ্যে, শ্রোতা পরিবৃত ব্রতকথা বলার লুপ্তপ্রায় দৃশ্যে,আমাদের বাড়ির নিজস্ব রুদালিদের কথকতায়, নির্দিষ্ট কয়েকটি গানে আর সর্বোপরি আকাশে। রাতের আকাশের গন্ধে আমার মায়ের গন্ধ, আমার সখীর গন্ধ মিশে আছে। আকাশ আমার আশ্রয়, মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া।মায়ের বড়ো স্নিগ্ধ একজোড়া চোখ ছিল, অনেকদিন পর এমন এক চোখ দেখেছিলাম ছাত্রীসম এক অধ্যাপিকার মধ্যে। কথাপ্রসঙ্গে তাকে বোধ হয় বলেও ছিলাম, মায়ের মতো চোখের কথা...কাজের কথার আকাজের কথার ভীড়ে এই আবেগের কথাটা হারিয়ে গেছে। মা এর কাছ থেকে পাওয়া অনিদ্রার উত্তরাধিকার দখল করলেও, প্রাত্যহিককে অসম্ভব সহিষ্ণুতা আর স্নিগ্ধতায় গ্লানিহীন করে রাখা, প্রাণের প্রসন্নতার প্রকাশক সে সরব হাসি--অধরাই রয়ে গেল। আমার মা খুব সাধারণ। কিন্তু অনন্যতা তার দুরন্ত প্রাণশক্তিতে, যে শক্তি কিছুই সরিয়ে দেয় না, হৃদয় দিয়ে সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে গোটা জীবনটাকে আষ্টেপৃষ্টে আলিঙ্গন করে। জীবনের বিষামৃতকে এমন সহজে পরিপাক যে করতে পারে, তার মধ্যেই এমন অফুরান ফূর্তি, এত অন্তহীন উদ্যম থাকতে পারে। এইখানে আমরা হেরে যাই বিষ আর অমৃতকে আলাদা করতে যাই।ব্যর্থতায় বিষন্নতা গ্রাস করে, আচ্ছন্ন করে। এই আচ্ছন্নতা আমার মায়ের মধ্যে ছিল না। মেজমামা যেমন বলতেন, “বেলার সবতাত হাসি”।বেলা, আমার মায়ের নাম।

                       বিশ বছর আজ। তার প্রয়াণের। তা্র গল্পে ক্রিয়ার অতীত রূপ এর আবশ্যক বোধ করি না। আকাশ সাক্ষী। সাক্ষী জীবনও। কাকতালীয় হলেও এটা তথ্য যে মায়ের মৃত্যুর ছয় বছর পর, আজকের দিনেই, ৪ঠা নভেম্বর, আমাদের ছেলের জন্ম। ঠাকুমার পুরো গল্প তাকেও বলা হয়নি। গল্পটি তার জন্যে, আর মুখবইর কিংবা ঈশানের ব্লগে ভ্রামণিক বন্ধুদের জন্যও।
০৪-১১-২০১৪

কোন মন্তব্য নেই: