“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৪

রবীন্দ্র গবেষকদের প্রতি


রবিঠাকুর, বিভিন্ন কবিতায় সাহিত্যে, তাঁর ভাববাদী মনষ্কতাকে প্রতিফলিত করেছেন বিভিন্ন সময়ে। তিনি প্ল্যানচেট নিয়ে চর্চা করেছেন, চর্চা করেছেন হোমিওপ্যাথি নিয়েও। কিন্তু রবিঠাকুর, আশ্চর্য রকমের চলিষ্ণু ছিলেন। সত্তর বছর বয়সে এসে তিনি তাঁর ভাববাদী ধ্যানধারণা থেকে সম্পুর্ণ মুক্ত হয়ে গেলেন।

 লিখেছেন  সুদীপ নাথ

দানীং অনেককেই দেখা যায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর গবেষণা করছেন ও অনেক প্রবন্ধ লিখছেন। তারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপর কোনও একটা সামগ্রিক আলোকপাত করতে অসমর্থ। তারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের অভিমত থেকে সরে আসার দিকে কোনও আলোকপাত করছেন না। তাই এই প্রবন্ধে আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের মত থেকেই নিষ্ক্রমণের একটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ দিক তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

একজন মানুষকে যদি বিচার করতে হয়, তিঁনি কেমন, তাহলে জীবিতকালে বিচার করতে হয় তার বর্তমান অবস্থান দেখে। আর যারা এখন নেই, তাদের বিচার করতে হবে, শেষ অবস্থান কেমন ছিল তাই দেখে। তাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনও তিনি অবস্থান পালটেছেন কিনা এবং সর্বোপরি তিনি শেষ পর্যন্ত কি অবস্থান নিয়েছিলেন, তা আবশ্যিক ভাবেই দেখতে হয়। এটাই এখন দেখা যাক।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩৩৪ বাঙলা ১৯২৭ সালে সাহিত্যধর্ম প্রবন্ধে লিখলেনঃ-

     “বিজ্ঞান পদার্থটা ব্যক্তিস্বভাববর্জিত; তার ধর্মই হচ্ছে সত্য সম্বন্ধে অপক্ষপাত কৌতূহল। এই কৌতূহলের বেড়াজাল এখনকার সাহিত্যকেও ক্রমে ক্রমে ঘিরে ধরছে। অথচ সাহিত্যের বিশেষত্বই হচ্ছে তার পক্ষপাতধর্ম; সাহিত্যের বাণী স্বয়ম্বরা। বিজ্ঞানের নির্বিচার কৌতূহল সাহিত্যের সেই বরণ করে নেবার স্বভাবকে পরাস্ত করতে উদ্যত”।......

     “বংশরক্ষাঘটিত পশুধর্ম মানুষের মনস্তত্ত্বে ব্যাপক ও গভীর, বৈজ্ঞানিক এমন কথা বলেন। কিন্তু সে হল বিজ্ঞানের কথা – মানুষের জ্ঞানে ও ব্যবহারে তার মূল্য আছে। কিন্তু রসবোধ নিয়ে যে সাহিত্য ও কলা, সেখানে এই সিদ্ধান্ত স্থান পায়না। ... আজকালকার য়ুরোপীয় সাহিত্যে যৌনমিলনের দৈহিকতা নিয়ে খুব যে একটা উপদ্রব চলছে সেটার প্রধান প্রেরণা বৈজ্ঞানিক কৌতূহল, রেস্‌টোরেশন-যুগে সেটা ছিল লালসা। কিন্তু, সেই যুগের লালসার উত্তেজনাও যেমন সাহিত্যের রাজটিকা চিরদিনের মত পায় নি, আজকালকার দিনের বৈজ্ঞানিক কৌতূহলের ঔৎসুক্যও সাহিত্যে চিরকাল টিঁকতে পারে না”।......

    আর বিশ্ববিশ্রুত ইতিহাসবিদ আর্নল্ড টইন্‌বিও প্রায় একই কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন- “বর্তমানে যে অরাজকতা প্রকট হয়ে উঠছে, বিশেষ করে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে, বৈজ্ঞানিক মনোভাব তার জন্যে অনেকখানি দায়ী”।

টইন্‌বি দেখেছিলেন বিজ্ঞানের কারণে সমগ্র সমাজটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে, আর রবিঠাকুর দেখেছিলেন শুধুমাত্র কাব্য-সাহিত্যকে কিভাবে বিজ্ঞান কলুষিত করছে।

            রবিঠাকুর, বিভিন্ন কবিতায় সাহিত্যে, তাঁর ভাববাদী মনষ্কতাকে প্রতিফলিত করেছেন বিভিন্ন সময়ে। তিনি প্ল্যানচেট নিয়ে চর্চা করেছেন, চর্চা করেছেন হোমিওপ্যাথি নিয়েও।

            কিন্তু রবিঠাকুর, আশ্চর্য রকমের চলিষ্ণু ছিলেন। সত্তর বছর বয়সে এসে তিনি তাঁর ভাববাদী ধ্যানধারণা থেকে সম্পুর্ণ মুক্ত হয়ে গেলেন। বাঙ্গালী মনীষীদের মধ্যে অন্যতম বিজ্ঞানমনষ্ক প্রতিভা মেঘনাদ সাহা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে, ওনার “কাব্য ও বিজ্ঞান” প্রবন্ধে লিখলেনঃ-

“...আমাদের কবি রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে আমাদের অপরূপ মাতৃভাষায় সত্য শিব ও সুন্দরের গান ধ্বনিত হইয়াছে। দীর্ঘ জীবন ধরিয়া (প্রার্থনা করি তাহার জীবন দীর্ঘতর হউক) তাঁহার কবি হৃদয়ে কালের  ঘটনাস্রোত তরঙ্গিত হইয়াছে। হোমারের মত কখনও বা তিনি প্রাচীন বীরগণের শৌর্য বর্ণনা করিয়াছেন, কখনও বা হিব্রু সত্যদর্শীদের মত ভক্তির গভীর রস সিঞ্চন করিয়াছেন। অ্যাচিলাসের মত ইঁহার হাতে পুরাতন কাহিনীগুলি নবকলেবর প্রাপ্ত হইয়াছে – আবার কখনও কখনও কবি অ্যারিস্টোফেনসের মত পুরাতন সংস্কারের প্রতি নির্মম আঘাত হানিতেও ইতস্তত করেন নাই। কবিশ্রেষ্ঠ কালিদাসের মত নিপুন হস্তে কখনও ইনি শব্দ চয়ন করিয়া অপূর্ব মণিমালা রচনা করেন, আবার কখনও লোকসঙ্গীতের সহজ সরল সুর তাঁহার বীণায় বাজিয়া উঠে। তাঁহার কবিজীবনের গতি ওডিসির সহিত তুলনীয় । পুরাতন হইয়াও ইনি চিরনবীন। ভাষা রবীন্দ্রনাথের হাতে উৎকর্ষের চরম শিখরে পৌঁছিয়াছে”।

    “কিন্তু বিজ্ঞানীদের পক্ষ হইতে কবির প্রতি আমাদের একটি অনুযোগ আছে। কবি তাঁহার অতুলনীয় শক্তি বিজ্ঞানের স্বরূপ প্রকাশে কখনও নিযুক্ত করেন নাই। এই দৃশ্যমান পৃথিবীর যে সামগ্রিক রূপ প্রাণীবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব এবং ভৌত বিজ্ঞান উন্মুক্ত করিয়াছে – তাহার সঙ্গীত তাঁহার কন্ঠে আজও বাজে নাই। আমরা আশা করি তাঁহার প্রতিভাধর পূর্বপুরুষ গ্যেটের মত রবীন্দ্রনাথও বিজ্ঞানের প্রতি মনোযোগী হইবেন এবং তাঁহার তুলনাহীন কাব্যে এই দ্বন্দ্বমুখর পৃথিবীর বর্তমান নৈরাশ্য ভেদ করিয়া মিলন, আশা ও আনন্দের বাণী সোচ্চার হইবে”।

রবিঠাকুর, আক্ষরিক অর্থেই আশ্চর্য রকমের চলিষ্ণু ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর মতের পরিবর্তন ঘটলো এবং তিঁনি বিজ্ঞান সম্পর্কে অবহিত থাকাটা আধুনিক সাংস্কৃতিক চেতনার অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবেই দেখলেন। তিঁনি হয়ে উঠলেন সাচ্চা বিজ্ঞান মনষ্ক মানুষ।

রবিঠাকুর, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভাববাদী ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের জয়গান গেয়ে গেলেন। তিঁনি “আধুনিক কাব্য ১৩৩৯” প্রবন্ধে লিখলেনঃ-

    “আমাকে যদি জিজ্ঞাসা কর বিশুদ্ধ আধুনিকতাটা কী, তাহলে আমি বলব, বিশ্বকে ব্যক্তিগত আসক্ত ভাবে না দেখে বিশ্বকে নির্বিকার তদগতভাবে দেখা। এই দেখাটাই বিশুদ্ধ ; এই মোহমুক্ত দেখাতেই খাঁটি আনন্দ। আধুনিক বিজ্ঞান যে নিরাসক্ত চিত্তে বাস্তবতাকে বিশ্লেষণ করে, আধুনিক কাব্য সেই নিরাসক্ত চিত্তে বিশ্বকে দেখবে, এইটেই শাশ্বতভাবে আধুনিক”।

    “কাব্য তা হলে আজ কোন্‌ লক্ষ্য ধরে কোন্‌ রাস্তায় বেরোবে। নিজের মনের মতো ক'রে পছন্দ করা, বাছাই করা, সাজাই করা, এ এখন আর চলবে না। বিজ্ঞান বাছাই করে না, যা-কিছু আছে, তাকে আছে ব'লেই মেনে নেয়, ব্যক্তিগত অভিরুচির মূল্যে তাকে যাচাই করে না, ব্যক্তিগত অনুরাগের আগ্রহে তাকে সাজিয়ে তোলে না। এই বৈজ্ঞানিক মনের প্রধান আনন্দ কৌতূহলে, আত্মীয়সম্বন্ধ-বন্ধনে নয়। আমি কী ইচ্ছে করি, সেটা তার কাছে বড়ো নয়। আমাকে বাদ দিয়ে জিনিসটা স্বয়ং ঠিকমত কী সেইটেই বিচার্য। আমাকে বাদ দিলে মোহের আয়োজন অনাবশ্যক”।

    তিঁনি আরও লিখলেন – “উচ্চ অঙ্গের গণিতের মধ্যে যে একটি গভীর সৌষম্য- যে একটি ঐক্যরূপ আছে, নিঃসন্দেহে গাণিতিকতার মধ্যে আপনাকে নিমগ্ন করে। তার সামঞ্জস্যের তথ্যটি শুধু জ্ঞানের নয়, তা নিবিড় অনুভুতির : তাতে বিশুদ্ধ আনন্দ। কারণ জ্ঞানের যে-উচ্চ শিখরে তার প্রকাশ, সেখানে সে সর্বপ্রকার প্রয়োজন নিরপেক্ষ, সেখানে জ্ঞানের মুক্তি”।

    “এ কেন কাব্য সাহিত্যের বিষয় হয়নি এ প্রশ্ন স্বভাবতই মনে জাগে। হয়নি যে, তার কারণ এইযে, এর অভিজ্ঞতা অতি অল্প লোকের মধ্যেই বদ্ধ, এ সর্বসাধারনের অগোচর”।।

       বাঙ্গালী মনীষীদের মধ্যে অন্যতম বিজ্ঞানমনষ্ক প্রতিভা মেঘনাদ সাহার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে 1931 সালে যে প্রত্যাশা ছিল, তিঁনি তা পূরণ করেছিলেন 1937 সালে, তাঁর অমর গ্রন্থ ‘বিশ্বপরিচয়’ লিখে।

           প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, বিজ্ঞানীদের শিল্পবোধের অভাবের তুলনায় শিল্পী-সাহিত্যিকদের বিজ্ঞানবোধের অভাবটা অনেক বেশি বলেই মনে হয়।

          বাঙ্গালী মনীষীদের মধ্যে অন্যতম বিজ্ঞানমনষ্ক প্রতিভা মেঘনাদ সাহাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে আহ্বান করেন ‘একটি নূতন জীবনদর্শন’ নামে বক্তৃতায় যোগ দিতে, যেখানে তিনি বিজ্ঞানভিত্তিক জীবনদর্শনকেই এ-যুগের জীবনদর্শন বলে প্রতিষ্ঠিত করেন।

          রবিঠাকুরের জীবনের শেষ দশ বছরের সমস্ত কাব্যে, সাহিত্যে তাঁর ভাববাদের বিরোধিতাই প্রকট হয়ে দেখা দেয় আর বিজ্ঞান মনস্কতার জয়গান ধ্বনিত হতে দেখা যায়।

 ***

 সূত্রঃ

     (১) রবীন্দ্র রচনাবলী

    (২) বিংশ শতাব্দীর নির্বাচিত বিজ্ঞান প্রবন্ধ সঙ্কলন

    (৩) বিশ্ব পরিচয়

    (৪) অন্য কোন সাধনার ফল

    (৫) মেঘনাদ সাহা ও বিজ্ঞানে যুগান্তর

কোন মন্তব্য নেই: