“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ১৯ জুলাই, ২০২০

অংক দৌড়

।। দেবব্রত দেব  ।।

আমার মাস্টার কাকুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, পাটিয়ালা, ১৯ জুলাই , ২০২০


















আজ থেকে প্রায় চার দশক আগেকার কথা। আমি তখন আমাদের গ্রামের স্কুল ১০৭ নং তেষুয়া নিম্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়’, সংক্ষেপে তেষুয়া স্কুলে পড়ি। মায়ের কথা অনুযায়ী প্রচুর দুষ্টু ছিলাম। স্কুল ছাড়া দিনের অর্ধেক সময় কাটাতাম বাড়ির সামনের বাগানে। কাজ প্রচুর করতাম, যেমন পেয়ারা গাছের ডালে ঝুলতাম, না হয় হাতে খুন্তি নিয়ে কোনো ফুল গাছের বারোটা বাজাতাম। অথবা বাড়ির নীচে ক্ষেতের জমি খুঁড়ে এঁটেল মাটি নিয়ে আসতাম আর তাই দিয়ে গরু, ঘোড়া, কলসি ইত্যাদি বানাতাম। তবে মা সঙ্গে এটাও বলত, সারাদিন গাছের ডালে ঝুললেও সকাল-সন্ধেতে নিয়ম করে পড়াশোনা করতাম। তখন ঘাড়ের উপরের বাঁদর নেমে বিছানার তলায় ঘুমোতে যেত। তবে এখন মনে হয়, সেসময় পড়াশোনা করার স্বদিচ্ছা আমার যত ছিল, তার থেকে বেশি ছিল ভয় মেশানো এক শ্রদ্ধা। পাশের বাড়ির মাস্টার কাকুর প্রতি। সন্ধে হলেই আমাদের বাড়ি আসতেন। চা-বিস্কুট খেয়েই আমাদেরকে নিয়ে বসতেন। বারান্দায় একটা খালি খাট ছিল, তার উপরে। এখানে আমরা বলতে আমি আর আমার দিদি। বাংলা বানান আর অংকের নামতা মুখস্থ করাই ছিল প্রধান কাজ। এই মাস্টার কাকুর ভয়েই গ্রামের রাস্তায় বেরোতে ভয় লাগতো। কখন জানি কোন দিক থেকে এসে পথ আগলে বলবেন, “এই থাম, দৌড়াস কই!সাতর কোঠার নামতা ক।নাহলে কোনো একটা বাংলা শব্দের বানান জিজ্ঞেস করবেন, “! পৃথিবী বানান করিয়া ক।

 

স্কুলে যেতাম দিদির সাথে। দিদি ফ্রক পরে। আমি হাফ পেন্ট আর সেন্ডো গেঞ্জি পরে। দুজনেই খালি পায়ে। গ্রামের ভেতরেই স্কুল, আমাদের বাড়ি থেকে দেখা যায়। জল তেষ্টা পেলে বা এমনিতে খিদে পেলে এক দৌড়ে বাড়ি থেকেই কিছু খেয়ে যেতে পারতাম। স্কুলে মাস্টার মশাই ছিলেন দুজন। বড় মাস্টার, ছোট মাস্টার। এখানে বড়-ছোট মানে বয়েসেই বড়-ছোট। বড় মাস্টার সবাই কে আদরই করতেন। তবে মাঝে মাঝে প্রচণ্ড ভয় পেতাম। একবার উনাকে কি একটা লিখে দেখাচ্ছি। কালো স্লেটে লেখা। স্লেটটা উনার হাতে দিয়ে, কী জানি কী ভেবে, উনার চেয়ারের হাতল ধরে ঝুলতে লাগলাম! স্লেটের লেখা চেক করে নিয়ে, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “লেখা ঠিক অইসে।তখনই উনার খেয়াল হলো যে আমি চেয়ারের হাতল ধরে ঝুলছি। এত্ত জোরে একটা ধমক দিলেন, আমি ত ভয়েই কাচু মাচু। সেদিন নিশ্চয়ই চেয়ারের হাতল আর পেয়ারা গাছের ডালের মধ্যে তফাত বুঝতে পেরেছিলাম। যাইহোক, এই গল্পের বাকি অংশটা বড় মাস্টার কে নিয়ে নয়, বরং ছোট মাস্টার কে নিয়ে।

 

স্কুলে একদিন ছোট মাস্টার গুণ অংক করতে দিয়েছিলেন। আমি কিছুক্ষণ পর গুণফল বের করে স্লেটে করা অংকটা মাস্টার কে চেক করতে দিয়েছি। না, এবার চেয়ারের হাতল ধরে ঝুলে পড়িনি। উনার চেয়ারের সামনে টেবিল, সেই টেবিলের এক পাশেই দাড়িয়ে আছি। মাস্টার মশাই অংক আমার ভাল করে দেখলেন। তারপর গুরুগম্ভীর মুখ করে পুরো অংকটাই কেটে দিয়ে শূন্য বসিয়ে দিলেন। শূন্য দেখে আমার মাথাটা গেল বিগড়ে। মনে ভাবনা এলো, আমার গুণ অংক ভুল হয়নি। মাস্টার মশাই নিশ্চয়ই কোনো ভুল করছেন। এবার কি করা। টেবিলের একপাশে রাখা লম্বা ছড়ি দেখে সাহস যোগাতে পারিনি যে বলব, “আমার অংক ভুল হইসে না, বরং মাস্টার মশাই, আফনেই কিছু ভুল করছইন!মাস্টার মশাইকে কিছু বলার সাহস না যোগাতে পারলেও, নিজের মনের সংশয়টা ত মেটাতেই হয়, এই ভেবে ভেবে মাথা নিচু করে গুটি গুটি পায়ে নিজের বেঞ্চে এসে বসলাম। কিছুক্ষণ পর একটা বুদ্ধি মাথায় এলো।

 

এবার একটু উদ্বিগ্ন চেহারা বানিয়ে হটাত দৌড়ে গেলাম ছোট মাস্টারের কাছেই, বললাম, “হাগু পাইসে, বাইরে যাইতে লাগবো।প্রসঙ্গক্রমে, এখানে বাইরেমানে বাড়ি যেতে হবে। আর সেইসময় কেউ বাইরে যেতে গেলে হাতে একটা তালা ধরিয়ে দেওয়া হতো। ফিরে এসে সেই তালা আবার ঠিক জায়গায় রাখতে হতো। এরকম স্কুলে দুটো দরজার দুটো তালা। তারমানে একটা সময়ে শুধু দুজনই বাইরে থাকতে পারবে আর ঐ দুজনের একজন ফিরে এলেই অন্য কেউ বাইরে যেতে পারবে। যাইহোক, আমার বাইরে যাইতে লাগবোর অনুরোধ মাস্টার মশাই মেনে নিলেন। বললেন, “বাড়িত গিয়া সময় কাটাইস্ না, পটকরি ফিরিয়া আইস!আমি হাতে একটা তালা নিয়েই দিলাম এক দৌড়। তার আগে যদিও আমি কেটে দেওয়া অংকের স্লেটটা সাথে নিয়ে নেই। স্কুল থেকে আমাদের বাড়ি যাই নাই, গিয়েছিলাম মাস্টার কাকুর বাড়ি। উঠোন থেকে চিল্লি-চিৎকার করে বললাম, “মাস্টার কাকু কই, একটা অংক দেখাইতাম, শুদ্ধ অইসে কি না। ছোট মাস্টরে কাটি দিছইন!ঘরের ভেতর থেকে কেউ একজন জবাব দিল, “তোর মাস্টর কাকু ত ঘরো নাই। ক্ষেতে গেসইন। ওখানে গিয়া খুজ!ক্ষেত-মানে, মাস্টার কাকুর বাড়ির পেছন দিকে খোলা মাঠ, ওখানে ধান ক্ষেত হয়। অগত্যা, আবার দৌড়, উঠোন থেকে ধান ক্ষেতের দিকে। মাঠ জল-কাদাময়। কিছুদূরেই দেখতে পেলাম মাস্টার কাকু কাজ করছেন। হাতে, পায়ে, গায়ে কাদা আর  কাদা, চেনাই যাচ্ছে না। আমি তখন রীতিমতো হাঁপাচ্ছি। আমাকে এরকম দেখে বললেন, “কিতা রে, স্কুল ছাড়িয়া, এই সময় ইখানো কেনে? আর এক হাতো তালা আর আরেক হাতো স্লেট কেনে? এই পেকো  উলটিয়া পড়ি গেলে ত হাতোর তালাও যাইবো, স্লেটও যাইবো! যাইঅউক, , কিতা অইসে?” কাঁদো কাঁদো চোখে স্লেট দেখিয়ে বললাম, “ছোট মাস্টর আমার অংক কাটি দিছইন! তুমি দেখোসাইন, শুদ্ধ কি না?” মাস্টার কাকু ত আমার কাণ্ড দেখে হতভম্ব। বললেন, “স্লেটটা ভালা করি ধর, দেখি তোর অংক ঠিক অইসে কি না।

 

মাস্টার কাকু সেদিন আমার অংক সঠিক হয়েছিল জানিয়ে ছিলেন। আর কী কী বলেছিলেন এখন আর মনে নাই। তবে সেদিন স্কুলে ফেরত যাই নাই। মাঠ থেকেই মাস্টার কাকু আমাকে বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন। তালাটা নিশ্চয়ই ফেরত দিয়ে দিয়েছিলেন অন্য কারুর হাতে করে। আমার সেই মাস্টার কাকু এখনও বেঁচে আছেন, ক্ষেত-কৃষি নিয়েই।

 

কোন মন্তব্য নেই: