“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ১৪ জুলাই, ২০২০

ভাষা, গল্প, কবিতা, উপন্যাসের ভবিষ্যৎ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এ-আই)

 ।। দেবব্রত দেব ।।


         বাংলা বানান শুদ্ধি, ব্যাকরণ, বাক্য গঠন, ইত্যাদি নিয়ে অনেক সময়ই বোদ্ধাগণের মধ্যে বেশ গম্ভীর আলোচনা হয়, বিতর্ক হয়। এবার বানান শুদ্ধির পক্ষে যারা (এবং যারা নন অনেক সময় কিছু ব্যবহারিক কারণে) তাদের জন্যে আমি এই বিতর্কের একটা অন্য দিক তুলে ধরব।

'স্পেল চেকার' - বানান পরীক্ষক

কম্পিউটারে টাইপ করার সময় যে স্বয়ংক্রিয় 'স্পেল চেক' সুবিধাটা উপভোগ আমরা করি তার পেছনে একটা সফটওয়ার কাজ করে। এই সফটওয়ার যে যুক্তি নিয়ে কাজ করে তা শুধু অভিধান আর ব্যাকরণ থেকে আসে না। সফটওয়ারকে প্রথমে বানান ভুলটা ধরতে হয় তার পর সেই ভুল বানানের শুদ্ধটা দেখাতে হয়। এবার বানানে ভুল ধরা খুবই সহজ, টাইপ করা কোনো শব্দকে শুধু একটা স্বীকৃত অভিধানের সাথে তুলনা করলেই হল। এরপর স্পেল চেক সফটওয়ার কে সম্ভাব্য সঠিক বিকল্প লেখককে দেখাতে হয়। এই কাজটা তুলনা মূলক ভাবে মুশকিল। কারণ এখানে, টাইপ করা শব্দটিতে ভুলের পরিমাণের উপরে নির্ভর করে একাধিক সঠিক বিকল্প থাকতে পারে। যেমন যেমন ধরুন আমি লিখব "অমর", ভুল করে লিখলাম "অমির"। তাহলে স্পেল চেকার "অমির" এর সঠিক বিকল্প হিসাবে "আমার", "আমির" "আমীর", "আমিন", "অমর" ইত্যাদি অনেক শব্দই দেখতে পারে এবং সেই বিকল্প শব্দের তালিকা থেকে আমি আমার পছন্দের শব্দ নিয়ে নিতে পারি।

এবার আরও উন্নত স্পেল চেকার কিন্তু শুধু অভিধানের সাথে তুলনা করে সব ধরণের বিকল্প শব্দ না দেখিয়ে, বরং সেই ভুল শব্দ যে লাইনে আছে সেই লাইনের 'সম্ভাব্য অর্থ বোঝে' সবচেয়ে উপযোগী একটা শব্দ সঠিক বিকল্প হিসাবে দেখাতে পারে। এরকম করে আরও উন্নত স্পেল চেকার এক সময় শুধু অভিধান নির্ভর না থেকে ব্যাকরণ সহায়ক সফটওয়্যার হিসাবে উন্নীত হয়। ইংরেজি ভাষার জন্যে এরকম সফটওয়্যার এর উদাহরণ হচ্ছে "Language Tool" এবং "Grammarly"। বাংলা ভাষার এরকম কোনো সফটওয়ার আছে কি না জানা নেই। তবে নিশ্চয়ই পৃথিবীর কোনও এক কোনায় এক বাঙালি "বাংলা ব্যাকরণি" সফটওয়ারের জন্যে কাজ করছে। এতক্ষণ "ধান ভানতে শিবের গান" করলাম, গান মনেহয় বেশ লম্বা'ই হয়ে গেল। তবে এবার ধান ভানা যাক।

এ-আই সফ্টওয়্যার

উপরের গানটাতে এটা বোঝাতে চাইছি যে বাজারে ইতিমধ্যেই এরকম সফটওয়্যার আছে যা শুধু বানান শুদ্ধ করে দেয় না, বরং বাক্যের ব্যাকরণ, গঠন, লেখার ভঙ্গি, একেকটা অনুচ্ছেদের সাথে কোনো শব্দ খাপ খাচ্ছে কি না ইত্যাদিও দেখিয়ে দেয়। এরকম ক্ষমতা থাক সফটওয়ার কে বলা হয় কৃত্রিমভাবে বুদ্ধিমান (Artificially Intelligent) সফ্টওয়্যার অথবা সংক্ষেপে এ-আই সফ্টওয়্যার। লেখা লেখির ক্ষেত্রে এরকম এ-আই সফ্টওয়্যার ইংরেজি ভাষা ছাড়াও জার্মান, ফরাসি, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান ইত্যাদি ভাষায় সহজ লভ্য। আর বাংলা ভাষায়ও আশাকরি এরকম সফটওয়্যার আগামীতে আসবে যদি আমরা এরকম করে বাংলা ভাষায় চর্চা জারি রাখি।

কৃত্রিম উপন্যাস ও কবিতা

এ-আই সফ্টওয়্যার ইতিমধ্যে ইংরেজি ভাষায় উপন্যাস, কবিতা লিখেছে যা তর্কসাপেক্ষ ভালো মানের। ইচ্ছুকরা গুগল করলেই অনেক তথ্য পেয়ে যাবেন। তাহলে বর্তমানে আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে কৃত্রিম সফ্টওয়্যার কবিতা, উপন্যাস লিখছে, লেখকের লেখার ভুল শুদ্ধ সবকিছুই বলে দিচ্ছে। একটু এগিয়ে ভেবে বলা যায় যে এরকম ভবিষ্যও খুব দূর নয় যেখানে, শুধু সফটওয়্যার নয়, হার্ডওয়্যারও বেরোবে, যেমন একটা ছোট্ট কম্পিউটার চিপ (chip) যা আমাদের গলায়, মাথায়, অথবা মস্তিষ্কের ভেতরে কোনো এক জায়গায় লাগানো থাকবে, আর আমাদের কথা বলা বা চিন্তনকে পরিচালনা করবে যাতে আমরা প্রত্যেকেই একেকজন সুনীল গাঙ্গুলি অথবা কবি সুকান্ত হয়ে উঠবো। তখন সৃজনশীল কাজের সংজ্ঞাটাই কি হবে কে জানে।

অজানা ভবিষ্যৎ

এরকম একটা ভভিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে যখন বানানের শুদ্ধা-শুদ্ধি আর বাক্যের ব্যাকরণ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে দেখি, তখন কেমন জানি নিরুপায় লাগে। নাতিসুদূর ভবিষ্যতে এ-আই প্রযুক্তি আমাদের ভাষা, চিন্তন, আত্ম প্রকাশের উপায়, জ্ঞানের আদানপ্রদান, ইত্যাদিকে এমন ভাবে দুমড়ে-মুছড়ে, উল্টে-পাল্টে বদলে দেবে যা আমরা হয়তো এখন কল্পনাই করতে পারবো না। আর হ্যাঁ, এ-আই প্রযুক্তির জন্যে শুধু ভাষা না, বৌদ্ধিক যা কিছু আছে সবই বদলে যাবে। তাই আমাদেরকে এখন থেকেই ভাবা উচিৎ কি ভাবে ভবিষ্যতের অবশ্যম্ভাবী এ-আই পরিচালিত বৌদ্ধিক জগৎকে আমরা গ্রহণ করবো।


তথ্যসূত্র



কোন মন্তব্য নেই: