“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শনিবার, ১৮ জুলাই, ২০২০

ইআইএ-২০২০: উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য একটি দুর্যোগবাহি খসড়া বিল

।। দেবব্রত দেব ।।

           সম্প্রতি ভারত সরকার পরিবেশ বিষয়ক মূল্যায়ন বিজ্ঞপ্তি, ২০২০ (সংক্ষেপে ইআইএ-২০২০) এর একটি খসড়া সংস্করণ প্রকাশ করেছে যা পূর্ববর্তী 'ইআইএ বিজ্ঞপ্তি-২০০৬'কে প্রতিস্থাপন করবে। এই নতুন খসড়া বিলটি আইন হিসাবে কার্যকর হওয়ার পর, এরই ভিত্তিতে শিল্প, কৃষি বা অন্য কোনও "কৌশলগত' প্রকল্পের পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া হবে। যখন নতুন কোনো প্রকল্প শুরু হয় বা বিদ্যমান প্রকল্পের সম্প্রসারণ হয়, তখন অনেক সময়েই তার কিছু প্রতিকূল প্রভাব পড়ে সংশ্লিষ্ট জমি, বন এবং পরিবেশের উপর। খসড়া ইআইএ-২০২০ বিলে এমন কয়েকটি বিধান রয়েছে যার কারণে পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষ কোনো প্রকল্পের প্রতিকূল প্রভাব থেকে তাদের জমি, বন এবং পরিবেশকে রক্ষা করার সব অধিকার হারাবেন। নীচে, আমি কেবল এই বিশেষ বিধানগুলোর প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করব।

১১ই আগস্ট, ২০২০-র আগে পদক্ষেপ নিন

আইন হিসাবে কার্যকর হওয়ার আগে এই খসড়া বিলে সংশোধন করার এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষের অধিকার অটুট থাকবে তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের ১১ই আগস্ট, ২০২০ পর্যন্ত পরিবেশ মন্ত্রকের কাছে পরামর্শ পাঠানোর সময় রয়েছে।
খসড়া বিজ্ঞপ্তিতে প্রস্তাবিত বিষয়ে আপত্তি বা পরামর্শ দিতে আগ্রহী যে কোনও ব্যক্তি কেন্দ্রীয় সরকারের বিবেচনার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে এই ঠিকানায়: Secretary, Ministry of Environment, Forest and Climate Change, Indira Paryavaran Bhawan, Jor Bagh Road, Aliganj, New Delhi-110 003, চিঠি লিখতে পারেন, অথবা এটি ই-মেইল ঠিকানা eia2020-moefcc@gov.in এও পাঠাতে পারেন।

জনগণের বক্তব্য এবং পরিবেশগত ছাড়পত্র

             বর্তমানে যখন শিল্প, কৃষি বা অন্যকিছু সম্পর্কিত কোনও প্রকল্প প্রস্তাবিত হয়, তখন যে সব  সাধারণ মানুষ এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে তারা "জনগণের পরামর্শ' (পাবলিক কন্সালটেশন) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকারী কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের উদ্বেগ জানাতে পারে। সরকারকে কোনও প্রকল্পে চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেওয়ার আগে জনগণের এই জাতীয় উদ্বেগগুলিরও  বিবেচনা করে দেখতে হয়। তবে এই নতুন খসড়া ইআইএ-২০২০এর অনুসারে আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষ কোনো প্রকল্প নিয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত পারবে না। প্রকল্প নিয়ে কোনো উদ্বেগ দেখা দিলেও, তা প্রকাশ্যে জানাতে পারবে না।


উত্তর-পূর্ব ভারত এবং "সীমান্ত অঞ্চল' সংজ্ঞা

              পয়েন্ট নম্বর 19 এর 2 নং পৃষ্ঠার খসড়া বিলে বলা হয়েছে যে "… জনগণের পরামর্শের জন্য নিম্নলিখিতগুলির জন্য ছাড় দেওয়া হয়েছে:" এবং এর মধ্যে একটি হ'ল "সীমান্ত অঞ্চলে 31 এবং 38 আইটেমের অধীনে সমস্ত লিনিয়ার প্রকল্প'। ৩ নং পৃষ্ঠায় দলিলটি সীমান্ত অঞ্চলকে "ভারতের সীমান্তবর্তী দেশগুলির সাথে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণের লাইন থেকে ১০০ কিলোমিটার আকাশপথে দূরত্বের মধ্যে পড়া অঞ্চল' হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। উত্তর-পূর্ব ভারত চারটি পৃথক দেশ দ্বারা একটা স্থলবেষ্টিত জায়গা। এবার এই নীচের ম্যাপ থেকে স্পষ্টতঃই দেখতে পারেন যে উত্তর-পূর্ব ভারতের কোনো জায়গাই আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে ১০০ কিলোমিটার থেকে বেশী দূরত্বে নয়। এর কারণেই উত্তর-পূর্বের যে কোন জায়গাতেই নতুন বা পুরোনো কোনো শিল্প, স্থানীয় জল-স্থল-আকাশ-বায়ুর কোন ক্ষতি করলে ইআইএ-২০২০ আওতায় নাগরিকগণ কোনও প্রতিবাদ করতে পারবে না (১৯-নং পৃষ্টার (f) পয়েন্টের জন্যে - উপরের ছবি দেখুন)।

ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের মানচিত্র (গুগল ম্যাপ )। ১০০ কিলোমিটার স্কেল চিহ্নটি ইঙ্গিত দেয় যে উত্তর-পূর্ব ভারতের কোনো জায়গাই আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে ১০০ কিলোমিটার থেকে বেশী দূরত্বে নয়।


কৌশলগত বিবেচনার নামে

উত্তর-পূর্ব জনগণের জন্য আর একটি সম্ভাব্য উদ্বেগের কারণ হ'ল, ইআইএ-২০২০ এর  আরেকটি বিশেষ বিধান যার মাধ্যমে 'কৌশলগত বিবেচনার' নামে সরকার যে কোন প্রকল্পের তথ্য প্রকাশ্যে আসা রোধ করতে পারবে।

9 নং পৃষ্ঠার ৭ নম্বর পয়েন্ট অনুযায়ী, সরকার যদি কোনও প্রকল্পকে জাতীয় কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ কারণে হিসাবে নথিভূত করে, তাহলে "এই জাতীয় প্রকল্পগুলির সাথে সম্পর্কিত কোনও তথ্য জনসমক্ষে রাখা হবে না"। এমনকি নাগরিকগণ যদি কোনও প্রকল্প সম্পর্কে কিছু তথ্যের জন্য অনুরোধ করেন তাহলেও সরকার "কৌশলগত বিবেচনার" ধারাটি উদ্ধৃত করে কোনও তথ্য দিতে অস্বীকার করতে পারে। উত্তর-পূর্বের জন্য, এই বিধানটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হতে চলেছে কারণ নানাবিধ কারণে সরকার ইতিমধ্যে এই অঞ্চলটিকে জাতীয় সুরক্ষার ক্ষেত্রে সংবেদনশীল বলে বিবেচনা করে এবং বিশেষত আমাদের ড্রাগন প্রতিবেশী, চীনের দ্বারা বেড়ে যাওয়া হুমকির কারণেও আমাদের সরকার যেকোন সময় তথ্য গোপন করতে পারে। তথ্যের সহজ প্রাপ্যতাই স্বাস্থ্যকর গণতন্ত্রের মূল, এবং এখানে সরকার এমন একটি আইন প্রস্তাব করছে যা অবশ্যই সরকারের কাছ থেকে তথ্য জানার  জনগণের অধিকারকে আরও সীমিত করবে।

খসড়া ইআইএ-২০২০এর 9 নং পৃষ্ঠার ৭  নম্বর পয়েন্ট অনুযায়ী, সরকার যদি কোনও প্রকল্পকে জাতীয় কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে নথিভূত করে, তাহলে "এই জাতীয় প্রকল্পগুলির সাথে সম্পর্কিত কোনও তথ্য জনসমক্ষে রাখা হবে না"।


শীঘ্রই সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া বিশেষ জরুরী

ভবিষ্যতে যে কোনও পরিবেশ ও সুরক্ষা বিপর্যয় এড়াতে উত্তর-পূর্বের জনগণকে খুব বেশি দেরী হওয়ার আগেই সরকারের সামনে এই খসড়া ইআইএ-২০২০এর বিভিন্ন উদ্বেগকারি বিধানের বিরুদ্ধে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে মুখর হতে হবে! বিলটি এখনও জনসাধারণের মন্তব্যের জন্য উন্মুক্ত। আগামী ১১ই আগস্ট অবধি eia2020-moefcc@gov.in এ ইমেল পাঠিয়ে জনগণ নিজের পরামর্শ সরকারকে জানতে পারেন। এই নতুন ‘ইআইএ-২০২০’ সম্পর্কে আরও বেশি জনসচেতনতা তৈরি করতে সমস্ত গণতান্ত্রিক মঞ্চ, পাবলিক ফোরাম, এনজিওগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে। এই মুহূর্তে কোভিড-১৯ এখনও ছড়িয়ে রয়েছে সমাজে, তবে আমরা যদি এই নতুন খসড়া বিলের অযাচিত বিধানগুলির বিরুদ্ধে দাড়ানোকে উপেক্ষা করি তবে খুব শীঘ্রই আমাদের সবুজ, স্বচ্ছ এবং প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর উত্তর-পূর্ব ভারত দায়িত্বজ্ঞানহীন সম্পদ-ক্ষুধার্তের অনিয়ন্ত্রিত টার্গেটে পরিণত হবে।

কোন মন্তব্য নেই: