।। সুপ্রদীপ দত্ত রায় ।।
(১)
যখন বিমল এসে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বললে, "স্যার আপনাকে ডাকছেন" , আমি চমকে উঠেছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম,"কোন স্যার রে ?"
-- "সিআরএম স্যার -"
-- "হঠাৎ -?"
-- "জানি না স্যার ।"
বললাম, " বেশ, যা -, বল্ আসছি ।"
স্যার সাধারণত এভাবে খুব কমই লোক পাঠিয়ে কাউকে ডেকে পাঠান। যা প্রয়োজন সরাসরি ফোনেই বলে থাকেন। তাছাড়া দিনে বেশ কয়েকবার আমাদের দেখা হয়। তাই এভাবে ডাকার কায়দাটা আমার খুব স্বাভাবিক লাগছিল না। এমনিতে অবশ্য আমাদের সিআরএম স্যার খুব অমায়িক ভদ্রলোক। নাম হরনাথ ঘোষাল , কোলকাতায় বাড়ি । আমার সাথে ওনার খুব ভালো সম্পর্ক। অফিসের বাইরেও আমাদের সম্পর্ক খুব আন্তরিক। আসলে আমার মতই ওনারও লেখালেখি, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ফটোগ্রাফী ইত্যাদিতে ভীষণ আগ্রহ। ভালো কিছু লেখা পড়লে সাথে সাথে আমাকে পড়ার জন্য পাঠিয়ে দেন। আমিও পাঠাই।
এইতো কিছুদিন আগেও আমরা হাফলং থেকে ১১৫ কিমি ভিতরে পানিমুরা ঘুরে এলাম। অদ্ভুত সুন্দর একটা জায়গা। আমরা আসামে থেকেও কোনদিন জানতে পারতাম না, যদি না উনি আমাদেরকে ডেকে বলতেন। পাহাড় জঙ্গলে দুষ্টু দামাল নদী 'কপিলি', যৌবনে টইটুম্বুর। চোখ জুড়িয়ে যায়, এত সুন্দর। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে দেখতে ইচ্ছে করে তার মন মাতানো রূপ। বিশাল আওয়াজ তুলে দুর্বার গতিতে সুন্দর এগিয়ে চলেছে নদী। জলও তার আশ্চর্য রকমের সুন্দর। কোথাও ধবধবে সাদা আবার কোথাও সবুজ কিংবা নীল। মধ্যে মধ্যে এদিকে ওদিকে ভেসে আছে নানা রঙের বিশাল বিশাল পাথর, কোনোটা কালো, কোনোটা লালচে আবার কোনোটা হলুদ। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন সময়টা শরৎকাল, ঠিক পুজোর পর। নদীর দুই তীর জুড়ে সাদা কাশের মেলা । যখন বাতাস বয়, মনে হয় যেন নদীর ছন্দে নৃত্যে আনন্দে মত্ত - পুরো কাশবন। ওখানে আমরা ঘন্টা দুয়েক ছিলাম। খাওয়া দাওয়া সেরে ঐদিনই ফিরে এসেছি। খুব আনন্দ হয়েছিল। সারাটা রাস্তা স্যার কি কেয়ারিং। কোথায় আমাদের উচিত ছিল ওনার সুবিধা অসুবিধা নজরে রাখা, উল্টো আমাদের নিয়েই উনি ভীষণ ব্যস্ত। আগের দিন রাত জেগে পছন্দের সব গান পেন ড্রাইভে লোড থেকে শুরু করে কি খাওয়া দাওয়া হবে প্রতিটি ছোট খাট বিষয়ে ওনার প্রচন্ড খেয়াল। ভাবটা যেন আমরা ওনার অতিথি। পুরো রাস্তায় নানা বিষয় নিয়ে গল্প করে গেলেন, কিন্তু একবারও অফিসের কাজ নিয়ে কথা বলেন নি। মানুষটাই ওইরকম।
এমনি একটা সম্পর্কের মধ্যে হঠাৎ যে উনি আমাকে এভাবে লোক পাঠিয়ে কেন ডাকলেন, আমি বুঝতে পারছিলাম না।
টেবিল গুছিয়ে সোজা চলে গেলাম চেম্বারে।
ওখানে তখন চিফ ম্যানেজার গুহস্যার সিআরএম স্যারের সামনেই বসে ল্যাপটপে কিছু একটা টাইপ করছেন। গুরুগম্ভীর পরিবেশ। গুহস্যার মুখ তুলে একবার তাকালেন, তারপর আবার মাথা নিচু করে টাইপ করতে লাগলেন। অন্য সময় হলে নির্ঘাত হেসে কিছু একটা বলতেন। কিন্তু আজ একেবারেই অন্য পরিবেশ।
আমাকে দেখে ঘোষাল স্যার ইশারায় বসতে বললেন। আমি গুরুগম্ভীর এই পরিবেশ দেখে সোজাসুজি সামনে না বসে একটু দুরে সরে গিয়ে বসলাম। অন্য সময় হলে আমাকে এতদুর কক্ষনো বসতে দিতেন না। কিন্তু আজ লক্ষ্য করছি উনি কিছুই বলছেন না। আমি অবাক, কি এমন অন্যায় হয়ে গেল যে স্যার এমন ব্যবহার করছেন । আমার কিছুই মনে পরছে না।
অডিট কোয়ারী যা ছিল, দেওয়া হয়ে গেছে -- তামেংলংএর ক্যাশ ট্যালী রিপোর্ট - ওটাও শেষ, আরবিআই রিপোর্ট - প্লেস করা, তাহলে ? কি হতে পারে ? আমার টেবিল তো সবসময়ই মোটামুটি ক্লীয়ার থাকে। তবু কোন কিছু বাকি রইলো কিনা মনে করার খুব চেষ্টা নিলাম, কিন্তু না, কিছুই মনে পড়ছে না।
গুহস্যার টাইপ করে চলেছেন, আর ঘোষাল স্যার একটি ইংরেজী পত্রিকাতে মগ্ন। আমি চুপচাপ পিছনে বসা। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। মধ্যে তাই একবার বলেই ফেললাম, "স্যার, আমি তাহলে একটু পরেই আসি ?"
উনি আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন, তারপর ইশারায় বসতে বলে আবার পত্রিকাতে মন দিলেন।
অগত্যা আমি বসে রইলাম, চুপচাপ। উপায় নেই। বসে আছি আর সাত পাঁচ ভাবছি।
প্রায় মিনিট পাঁচেক পর গুহস্যার ল্যাপটপ সিআরএমস্যারের দিকে বাড়িয়ে দিতেই স্যার একবার চোখ বুলিয়ে প্রিন্ট কপি চাইলেন। আমি তখনও চুপচাপ বসা।
প্রিন্ট এলো, স্যার সই করে এক কপি ফাইলে রাখতে বলতেই গুহস্যার একটা কপি হাতে চলে গেলেন। চেম্বারে তখন আমি আর ঘোষাল স্যার। উনি আমাকে ইশারায় ডাকতেই আমি সামনে গিয়ে বসলাম। উনি এইমাত্র সই করা একটা কাগজের কপি আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
আমি আলতো ভাবে কাগজটা নিয়ে চোখ বুলাতেই বুকের ধুকপুকুনি এক নিমেষে একশ গুণ বেড়ে গেল। আমি ভাবতে পারছিলাম না আমার সাথে এমন কিছু হতে পারে। একটা কষ্ট বুক ঠেলে গলায় এসে আটকে গেছে।
কাগজটা টেনে নিতেই আমার চক্ষু ছানাবড়া। আমার ট্রান্সফার ওর্ডার । যদিও টেম্পরারি তবু ট্রান্সফার তো ট্রান্সফার হয় । সেও খুব কাছে না, অনেক অনেক দুর। একসঙ্গেে কাজ করার পর আমাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে এভাবে অর্ডার ইসু করাটা মন থেকে মেনে নেয়া যায় না। সৌজন্যতা বলেও একটা শব্দ আছে। ভাবতে পারছিলাম না এত লোক থাকতে আমাকে কেন এতদুর পাঠানো হচ্ছে । একদমই বার্মা বর্ডার, চাম্পাই শাখায়। ওইসব শাখায় কর্মচারীদের সাধারণত অলিখিত ভাবে শায়েস্তা করার জন্যেই পাঠানো হয়ে থাকে। একেতো দুর, তার উপর দুর্গম রাস্তা। খুব কষ্ট। খাওয়া দাওয়ার চুড়ান্ত অব্যবস্থা। ওখানে শূকর, কুকুর, মোরগ সহ সবধরনের মাংস চলে। খাওয়া দাওয়া নিয়ে যারা আমার মত খুঁতখুঁতে তাদের জন্য সত্যি খুব কষ্টকর। কোলকাতার একটি ছেলে দেবাশীষ গাঙ্গুলী, বর্তমানে ওখানে আছে। দুদিন পর পরই টেলিফোনে কান্নাকাটি করে, ওখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। এক দুবার চাকরিই ছেড়ে দিতে চাইছিল। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে রাজি করিয়েছি। সেই চাম্পাইএ এখন নাকি আমাকেই বলির পাঁঠা বানিয়ে পাঠানো হচ্ছে। খুব অভিমান হলো। এই তাহলে এতদিনের সার্ভিসের ফল। চোখে জল এসে যায় প্রায়। মুখ থেকে কথা সরছিল না। একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল, এত লোক থাকতে আমি কেন ? একবার ভাবলাম একটু অনুরোধ করে দেখি না, হয়তো মত পাল্টাতেও পারে আবার মনে হলো কি প্রয়োজন। অর্ডার তৈরি করার সময়ে তো একবারও কেউ জিজ্ঞেস করে নি আমায়, তবে কেন শুধু শুধু মুখ বেচা। ইচ্ছে করছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল, অন্তত অর্ডার সই করার আগে একবার কি আমাকে মুখের কথায় জিজ্ঞেস করা যেত না, তাহলে এতদিনের কিসের সম্পর্ক।
চুপচাপ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, " ঠিক আছে স্যার , আমি এখন আসি।"
-- বসুন, রাগ করলেন ?
-- রাগ করার কি আছে স্যার, চাকরিতে আছি , যেখানে বদলি করবেন সেখানেই যেতে হবে বৈকি।
-- এটাতো পিওরলি টেম্পরারি পোস্টিং, খুব বেশি দিন না, দিন পনেরো আপনাকে ওখানে থাকতে হবে, তারপর আপনাকে আমিই ফিরিয়ে নিয়ে আসবো, নিশ্চিত থাকুন।
-- অর্ডার ইসু করার সময় ওভাবেই বলা হয় স্যার, তারপর ওটাই কন্টিনিউ হয়ে যায়। ওসব টেক্টিস আমার জানা স্যার। রাগে দুঃখে তখন আমার মাথায় কাজ করছিল না।
-- না আপনি জানেন না, ভুল বুঝছেন। ঠান্ডা মাথায় সব কথা শুনুন, তারপর আপনি চাইলে আমি অর্ডার পাল্টে দিতেও পারি।
অগত্যা আবারো বসলাম। স্যার বললেন, কথাটা যেন আপনার আর আমার মধ্যেই থাকে।
আমি কোন উত্তর দিলাম না।
--রিহ দিলের নাম শুনেছেন ?
-- না। আমি গম্ভীর হয়ে উত্তর দিলাম।
-- ওটা মিজোরামের একটি হ্রদ। যদিও হ্রদটির সাথে মিজোদের একটা আত্মিক যোগাযোগ আছে, কিন্তু এই হ্রদটি আসলে বার্মা মানে বর্তমানে মায়ানমারের সীমানায়।
আমি চুপচাপ শুনছি। বুঝতে পারছি না, এই রিহদিলের সাথে আমার ট্রান্সফার কি সম্পর্ক থাকতে পারে।
স্যার বললেন, চাম্পাইএর ম্যানেজার গাঙ্গুলী অনেক দিন থেকেই ছুটি চাইছিল। আমি ইচ্ছে করলেই আইজল ব্রাঞ্চ থেকে কাউকে পাঠাতে পারতাম। কিন্তু ইচ্ছে করেই পাঠাইনি। কারণ আমার আপনাকে চাই।
-- বুঝতে পারলাম না স্যার। আমি বললাম।
-- আগে পুরোটা শুনুন। ওখানে জোরাম থাঙ্গা হচ্ছে আমাদের ব্যাঙ্ক বিল্ডিংএর ল্যান্ডলর্ড। বিশাল ব্যবসায়ী, এক্সপোর্ট ইমপোর্ট এর ব্যবসা করেন। অনেক ক্ষমতা। আপনি ওখানে গিয়ে চাইলে ওর সাথেও যোগাযোগ করতে পারেন। রিহ দিলে আমাদের একরাত্রি থাকার ব্যবস্থা করতে হবে আপনাকে। অফিসিয়ালি চলবে না, কারণ হেড অফিস থেকে আপত্তি আসতে পারে। তাই পুরোটাই গোপনীয়তার সাথে।
-- কিন্তু স্যার, এই কাজের জন্য আমাকে ওখানে পোস্টিং দেবার কি দরকার ছিল ? কাজটা তো আমরা টেলিফোনেই সারতে পারতাম ।
-- না পারতাম না, পারলে নিশ্চয়ই আপনাকে ওখানে বদলী করতাম না। ওখানে কারো রাত্তিরে থাকার অনুমতি নেই। আপনাকে ওইটাই ম্যানেজ করতে হবে।
বুঝলাম অনেক ভাবনা চিন্তার ফসল এই বদলীর আদেশ। তাই আর প্রতিবাদ না করে উঠে দাঁড়ালাম।
-- আর একটা কথা, কাজটি এই মাসের মধ্যে আপনাকে শেষ করতে হবে । মানে আজ হচ্ছে আগস্ট মাসের তেইশ তারিখ, আপনার হাতে সময় মাত্র আট দিন।
বিষয়টি পরিষ্কার হলো না আমার কাছে। এত জায়গা থাকতে ওখানে রাত্তিরে থাকার কি প্রয়োজন, সেও আবার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে, বিষয়টা কি ? সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
চেম্বার থেকে বিদায় নিয়ে যখন বেরিয়ে আসছি, আমাকে একটা চিড়কুট ধরিয়ে বললেন, এই নম্বর থেকে ফোন আসতে পারে। উনি আমার অনেক দিনের বন্ধু। আপনাকে ফোন করতে পারেন।
কথায় আছে আগুনের এত দুরে যেও না, শীতে কুঁকড়ে যাবে, এত কাছে এসো না পুড়ে ঝলসে যাবে। আমার বর্তমান অবস্থা অনেকটা সেই রকমই। সাহেবের কাছে থাকার ফায়দা লুটেছি, এখন সুদে আসলে উসুলে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।
চুপচাপ নিজের টেবিলে চলে এলাম। বুঝতে পারছিলাম ডাবল এসাইনমেন্টে যাচ্ছি। অফিসিয়াল থেকে নন অফিসিয়াল কাজটি আরও কঠিন।
মনে মনে একটা প্রস্তুতি শুরু করে দিলাম। ব্রাঞ্চের বিজনেস পজিশন, পটেনশিয়াল কাস্টমার কারা, বার্নিং সমস্যা কি কি, খুঁটিনাটি বিষয়ে একটা নোট নেওয়া জরুরি। সবকিছুই জানতে হবে। গাঙ্গুলীকে ফোন করে রাস্তা ঘাট, থাকার কি ব্যবস্থা, সাথে কি কি নিতে হবে ইত্যাদি নিয়ে একটা ইনফরমেশন লিস্টও তৈরি করলাম। নতুন জায়গায় যেতে হলে, এইসব তথ্য খুব কাজে আসে। যুদ্ধ কালীন প্রস্তুতি চলছে। ঠিক এই সময়ে আমার মুঠোফোন বেজে উঠল।
-- হ্যালো, দত্তবাবু ?
-- হ্যাঁ, বলছি, আপনি --?
-- কেন আপনার ট্রুকলার কি আনইন্সটল করে দিয়েছেন ?
চমকে উঠলাম। আমার ট্রুকলার ইনস্টল কিনা সেই খবরও উনার কাছে আছে। বেশ অপ্রস্তুত হয়েই বললাম, না, মানে করিনি, তবে ---।
-- বুঝতে পারছি, ব্যাঙ্কের লোকতো ! ঠিক আছে, ঠিক আছে, নিজের পরিচয় দিয়ে দিচ্ছি। আমার নাম সুপ্রিয়া সরকার। চিনতে পারছেন ?
-- হ্যাঁ, না মানে মনে পড়েছ না। কোন ব্রাঞ্চ বলুন তো ?
-- কেন ঘোষাল আপনাকে বলেনি ?
এক মুহুর্তে একঝলক বিদ্যুৎ আমার মস্তিকের কোষ থেকে কোষে ছুটে গেল। শালা, ইংরেজি বানানের সত্যি কোন মাথা মুন্ডু নেই। বলে না দিলে বোঝার উপায় আছে কি পুরুষ না মহিলা। আমার কল্পনাতেও ছিল না নামটা সুপ্রিয় না হয়ে সুপ্রিয়াও হতে পারে কখনো। তক্ষুণি ম্যানেজ করে বললাম, এই অল্প আগেই বলেছিলেন, আপনার ফোন আসতে পারে।
রিহ দিল -
আত্মা যেখানে অতৃপ্ত (২)
আমাদের ঘোষাল স্যার মানে সিআরএম, কাগজে শুধু একটা ফোন নম্বর আর সাথে একটা নাম লিখে দিয়েছিলেন মাত্র। আমার ভাবনাতেই ছিল না এইটি একটি মহিলার ফোন নাম্বার হতে পারে । বললাম, হ্যাঁ ম্যাডাম, স্যার বলেছিলেন বটে, কিন্তু আমি বুঝতে পারি নি। তাছাড়া এত তাড়াতাড়ি ফোনটা এলো..... । কিছু মনে করবেন না প্লিজ ।
ভদ্রমহিলা ফোনে শব্দ করে হেসে উঠলেন। বললেন, সত্যি কথাটা বলছেন না কেন ? বলুন কোন মহিলা আপনাদের সঙ্গী হতে পারেন, এইটাই কল্পনা করতে পারছেন না ।
-- না না ঠিক তা নয় ....। আমি আমতা আমতা করে বললাম। ভদ্রমহিলা এত সোজাসুজি কথা বলেন, যে অপ্রস্তুত হয়ে যেতে হয়।
--- আপনি কবে নাগাদ চাম্পাই যাচ্ছেন।
--- স্যার তো আগামী কাল মুভ করতে বলছেন। আমি বললাম।
--- ঠিক আছে কালকের দিনটা আপনি আইজলেই থাকুন। পরশু আমি কোলকাতা থেকে প্লেনে আইজল আসছি। ওখান থেকে দুজনে একসাথে চাম্পাই যাওয়া যেতে পারে।
আমি ঢোক গিললাম। কি সাংঘাতিক কথা। বললাম, আপনি দু তিন দিন পর এলে ভালো ছিল নয় কি ম্যাডাম।
ভদ্রমহিলা সশব্দে হেসে উঠলেন। বললেন, আমার এখন যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। ছেলে মেয়েরাও বড় হয়ে গেছে, ভয় নেই। অবশ্য আপনার যদি আপত্তি থাকে .....।
--- না, না, আমার আপত্তি কিসের ম্যাডাম, আসলে আপনার অসুবিধা হতে পারে তাই ...।
মনে মনে বললাম, মাদার ইন্ডিয়া ! একবার যদি আমার বাড়িতে জানতে পারে তোমার সাথে আমি চাম্পাই যাচ্ছি, তাহলেই বুঝতে আপত্তি কাকে বলে। আমার সাথে তোমারও পা ভেঙ্গে বিছানায় শুয়ে রাখবে। জানো না তো কি নিয়ে সংসার করি। কথাগুলো অবশ্যই মনে মনে বললাম, মুখে বলার সাহস হলো না।
--- এক মিনিট দত্তবাবু, তখন থেকেই কি সব ম্যাডাম, ম্যাডাম শুরু করেছেন বলুন তো ?
কি মুস্কিলে পড়া গেল। কোথাকার কোন অপরিচিত ভদ্রমহিলাকে ম্যাডাম না বলে কি বলা উচিত, আমার মাথায় আসছিল না। কি উত্তর দিই। আমি নিরুত্তরই রইলাম ।
--- আমাকে আপনি মিসেস সরকার বা শুধু মাত্র সুপ্রিয়া বলতে পারেন।
--- ঠিক আছে ম্যাডাম, না মানে মিসেস সরকার , তাই হবে । কিন্তু আমার যে ওইদিনই চাম্পাই যাবার কথা। দেরি হয়ে গেলে কোন সুমো পাবো না। আমি যথাসম্ভব প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা নিলাম।
-- সুমো দিয়ে কি করবেন ? আইজল এয়ারপোর্ট থেকে আমি গাড়ি বুক করেছি তো।
মানতে হবে ভদ্রমহিলাকে। কোলকাতায় বসে সব ঠিক ঠাক করে বসে আছেন।
--- বললাম, বেশ তাহলে আমি কি আপনার জন্যে চান্দমারিতেই অপেক্ষা করি ?
--- না, না, তা কেন ? গাড়ি প্রথমে আপনাকে তুলে নিয়ে তারপরই এয়ারপোর্টে আসবে। ওখান থেকে আমরা সোজা চাম্পাই বেরিয়ে যাবো।আইজলের ট্রাফিক সমস্যা তো আপনার জানা। যাবার সময় শহরে ঢুকলে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে, তাই না ?
দেখলাম ভদ্রমহিলা অনেক বেশি হোম ওয়ার্ক করে নিয়েছেন। বললাম, ঠিকই বলেছেন। ওইটাই ভালো হবে।
--- আমার প্লেন নামবে আটটা পঁয়ত্রিশে, কাজ সেরে বেরিয়ে আসতে প্রায় নয়টা। লেংপুই এয়ারপোর্ট থেকে চাম্পাই ২১৫ কিলোমিটার, সময় লাগে অনুমানিক আট ঘণ্টা।
--- লেংপুই ?
--- আহা, আইজল এয়ারপোর্টকেই তো লেংপুই এয়ারপোর্ট বলে।
--- ওঃ তাই বলুন। আমি সত্যি জানতাম না।
--- সে ঠিক আছে। আমিও জানতাম না। এবার টিকিট কাটতে গিয়ে দেখলাম। আর শুনুন, কয়েকটি জিনিস সাথে নিতে হবে। এখনই বলবো নাকি রাত্তিরে ফোন করবো। কথাগুলো বলে নিজেই নিজের কথাতে হাসতে লাগলেন।
আমি আঁতকে উঠলাম। আবার রাত্তিরে কেন ?
বললাম, অসুবিধা না থাকলে এখনই বলতে পারেন, আমি টুকে নিচ্ছি।
ভদ্রমহিলা হাসছেন বুঝতে পারছিলাম। বললাম, আসলে কাল সকালে আমাকে বেরোতে হবে, বুঝতেই পারছেন সময় খুব সীমিত।
-- ঠিক, ঠিক। একটা রাইস কুকার ব্যবস্থা করতে পারবেন ?
--- পারবো ।
--- গুড। একটা রাইস কুকার, একটা ইলেকট্রিক কেটলি, একটা চার্জার লাইট। আপনার ক্যামেরা নিচ্ছেন তো ?
এবার আর অবাক হলাম না। বুঝতে পারছিলাম উনি আমার সম্পর্কে ইতিমধ্যেই অনেক খবরাখবর নিয়ে রেখেছেন। বললাম, নিচ্ছি।
-- কি ক্যামেরা ?
বললাম, কেনন ৩৬০ডি।
--- ভালো ক্যামেরা, চলবে।
আমি চূপ করে রইলাম। অনেকটা কাজ আমার কমে গেছে।
বললেন, নম্বরটা সেভ করে নিতে।
ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে যেতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। খুব আধুনিক মহিলা, বিনা নোটিশে একেবারে বিলো বেল্টে আঘাত করেন।
ফোন রেখে কিছুটা সময় চুপচাপ বসে রইলাম।
তারপর চটপট আইজল ব্রাঞ্চে ফোন করে আমার আসার খবরটা জানিয়ে দিলাম। আইজল গেলে আমি সাধারণত হোটেলে উঠি না। ব্রাঞ্চের সাথেই ম্যানেজারের বিশাল থাকার ব্যবস্থা। আমি ওখানেই উঠি। ট্রেভেল এজেন্টকে বলে সুমোর সামনের দুটো সীট রিজার্ভ করলাম। মাঝের সারি বা পেছনের সারিতে গাদাগাদি করে বসতে আমার প্রচন্ড অপছন্দ। সামনের সীটেও দু'জন বসা খুব কষ্টকর।
আমি এইসব রাস্তায় একটুখানি আয়েশ করে চলতে খুব ভালবাসি। সিআরএম স্যার আমার টেবিলের সামনে দিয়ে যাবার পথে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমাকে হেসে জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে কাল সকালেই আপনি রওয়ানা দিচ্ছেন, তাইতো ?
বাড়িতে খবরটা শোনার পর থেকেই বাড়িতে যথারীতি অশান্তি শুরু, ক্রমেই জমছে দুশ্চিন্তার মেঘ। নানাজনের নানা উপদেশ । ভুক্তভোগী মাত্রই বুঝতে পারছেন আমার অবস্থা। তারই ফাঁকে একবার ফোন করে আমার এক মারোয়ারী বন্ধুর কাছ থেকে ওদের ফ্ল্যাটের চাবিটা চেয়ে নিলাম।
মারোয়ারী বড় ব্যবসায়ী যারা সাধারণত শিলচরে থেকে, মিজোরামের সাথে ব্যবসা করেন তাদের অনেকেরই মিজোরামের বিভিন্ন জায়গাতে ঘর ভাড়া করা থাকে। খবরটা আমার জানা ছিল। আমি একমাসের জন্য চাম্পাই যাচ্ছি শুনে ওরা নিজেরাই প্রস্তাবটা দিলেন। আমিও লুফে নিলাম। আপত্তি করলাম না। মিজোরামে হোটেলে থাকা নিয়ে অনেক হ্যাপা আছে। আইজলের কথা আলাদা। ওখানে ভালো ভালো হোটেল রেস্তোরাঁর অভাব নেই, কিন্তু একটু বাইরে গেলেই সমস্যা। বিশেষ করে চাম্পাই, সারচিপ, লুংথ্লাই, সাইয়া তে বেশ অস্বস্তি হয়। খোঁজাখুঁজি করলে হয়তো বাঙালি মুসলমান কুক পাওয়া যায় বটে। কিন্তু ওখানে থাকতে থাকতে ওরাও অনেকটাই ওদের মতো হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া নিয়ে তেমন বাছবিচার নেই। চাবিটা হাতে দিয়ে মুললচাঁদজী হাতটা চেপে ধরলেন। বললেন, এক রিকোয়েস্ট থা দত্তবাবু ---।
বললাম, বলুন।
--- সমজ রহে না, মারোয়ারী আদমী ---।
বললাম, বুঝতে পারছি আমি, নিশ্চিত থাকুন, পিঁয়াজ বসুন চলতে পারে কিন্তু মাছ মাংস কোন অবস্থাতেই চলবে না তাইতো ?
মুলচাঁদজী হেসে উঠলেন। বললেন, আপকো তো সবকুছ মালুম হ্যায়।
আইজল আমি অনেকবার এসেছি। একা , অফিসের অন্য কারো সাথে এমনকি এই সিআরএম ঘোষাল স্যারের সাথেও আমি অনেকবার এসেছি। একবার তো ওনার সাথে আইজল থেকে ফেরার পথেই সেকি কান্ড। মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলাম। আইজলের পথ আমার চেনা। আঁকা বাঁকা পথ, একদিকে খাঁড়া পাহাড়, অন্যদিকে গভীর খাদ। পুরো মিজোরামের এই এক গল্প। মধ্যে মধ্যেই হাট বাজার গ্রাম। মনে হয় যেন কারো বাড়ির উঠোন দিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে। বাড়িগুলো সব রাস্তা ঘেঁষা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো রাস্তার যেই পাশটাতে খাদ ওরা সেই পাশটাতেই ওদের ঘর তৈরি করে । আমার তো প্রথম প্রথম খুব ভয় হতো। পুরোনো পুরোনো রাস্তা সমান উঁচু কাঠের মাচার ঘর । তার মধ্যেই হোটেল কাম বসত বাড়ি । নিচে গভীর খাদ। এখন আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। নতুন করে কিছু দেখার নেই। তাই সুমো চলতে শুরু করলে আজকাল আমি চোখ বন্ধ করে বসে বসে ঘুমাই।
আইজলে যখন পৌঁছেছি তখন ঘড়িতে প্রায় সাড়ে তিনটা বাজে। রাস্তার অবস্থা খুবই শোচনীয়। এত সময় লাগার কথা নয়। জারকোয়াট মানে আইজল সুমো স্ট্যান্ড থেকে চান্দমারী আমাদের অফিস খুব একটা দুরে নয়। পায়ে হেঁটে যাওয়া যায়, যদি হালকা লাগেজ থাকে। আমার জন্যে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার কুন্দন কুমারের পাঠানো একটি ছেলে বাইক নিয়ে অপেক্ষা করছিল। কুন্দন যদিও পদবীতে আমার অনেক উপরে কিন্তু আমাকে বড়েভাই ডাকে, খুব ভালবাসে, সম্মান করে।
আইজল ব্রাঞ্চ তো অফিস নয়, আমার জন্যে বাড়ি। প্রত্যেকটি স্টাফ, অফিসারের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচিতি আছে।
হাত মুখ ধোয়ার আগেই এক চোট আড্ডা। চা এলো, চায়ের সাথে গরম গরম হালকা রুটি, ঘুগনী আর ডাবল ডিমের ওমলেট।
শিলচরের একটি ছেলে দীপু , আইজলে এলাইসিতে কাজ করে। আমি এসেছি খবর পেয়েই একটা মুরগি হাতে এসে উপস্থিত। বললাম, এসবের কি প্রয়োজন ছিল ?
কিন্তু কে কার কথা শোনে। আজ আমি আসায় স্পেশাল পার্টি। ওরাই ব্যবস্থা করছে। আমি অতিথি মাত্র।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসছে। আইজলে সন্ধ্যা আমার খুব প্রিয়। ব্রাঞ্চের পিছন দিকটায় শহরের একটি বিশাল অংশ দেখা যায়। একে একে বাড়ি, চার্চ হোটেল, মল, রেস্তোরাঁ, অফিস দোকানে আলো জ্বলে উঠছে, যেন এক একটা আলাদা উজ্জ্বল তারা, জ্বলজ্বল করছে পাহাড়ের বুকে। উপরে আকাশে তখনও সূর্যের অন্তিম রেশ কাটেনি, ফটোগ্রাফীর জন্যে আদর্শ সময় এবং অবশ্যই আদর্শ লোকেশন। আমি প্রত্যেকবার এলে এখানে কিছুটা সময় কাটাই। প্রতিবার ফটো তুলি তবু আশ মিটে না। আসলে সন্ধ্যার আকাশ আর প্রেয়সীর মন, রসিকজনেই তার মর্ম জানেন শুধু ।
রুমে ফিরে আসতেই আরো এক প্রস্ত চা হলো। আড্ডা চলছে। দীপু অনেক দিন থেকেই আইজলে থাকায় ওর নেটওয়ার্ক ভীষণ ভালো। বললাম, ভাই আমাকে একটা হেল্প করতে পারবি।
-- হেল্প না বড়েভাই আদেশ বলো --। দীপুটা চিরকালই নাটুকে।
বললাম, আদেশ টাদেশ কিছু না রে, যেহেতু চাম্পাই যাচ্ছি প্রথমবার, যদি সম্ভব হয়, আমাকে ওইদিকটা ঘুরে দেখার ব্যবস্থা করতে পারিস কিনা বল।
--- চাম্পাই তুমি কি দেখতে চাও ?
--- তাজমহল । বড়েভাইকো তাজমহল দিখা দে।
বলে নিজের কৌতুকে নিজেই হেসে উঠলো কুন্দন।
আমি বললাম, আছে কি দেখার, সেটা তো বলবি।
কুন্দন আমাকে থামিয়ে বললো, ওধার কুছ নেহি হ্যায় দাদা, স্রীফ ইমপোর্ট এক্সপোর্ট ।
পুঁ থাং পাশেই বসে ছিল। পুঁ হচ্ছে শ্রী বা মিস্টার বা । পুরো নাম থাংএংজোয়েলা, সংক্ষেপে পুঁ থাং। আমাকে বললেন, হ্যায় না স্যার এক জায়গা, লেকিন থোরা দুর হোগা।
--- কিতনা ?
-- উও হোগা বিস পঁচিস কিলোমিটার।মায়ানমার কা অন্দর।
-- আচ্ছা, ক্যায়া হ্যায় উহা ।
-- এক তালাব স্যার, রিহ দিল --। হামলোগকা লাভ সাইন হোতা হ্যায় না স্যার, ওইসেহি লাভ সাইন যেইসা, হার্ট সেইপ।
--- আচ্ছা !
--- ইসমে খাস বাত ক্যায়া হ্যায় মালুম হ্যায় স্যার ? ইয়ে মরে হুয়ে আত্মাও কা তালাব। মরনে কে বাদ সব আত্মা কুছ সময় কে লিয়ে উহা যাতা হ্যায়।
--- আচ্ছা ! ইন্টারেস্টিং ।
আমি দীপুকে বললাম, দেখ না, কোন ব্যবস্থা হয় কিনা। এত দুর এলাম, বাড়িতে গল্প বলার মত কিছু একটা খোরাক তো চাই না কি ?
--- স্যার আপনি চাম্পাইতে কোথায় থাকবেন, কিছু বন্দবস্ত হয়েছে কি।
আমি আমার মারোয়ারী বন্ধুর কথা বললাম।
দীপু শুনলো। তারপর বললে, দাদা একটা কাজ করতে পারো কিন্তু, মিজোরামের অধিকাংশ ডাক বাংলোগুলোর সিনিক বিউটি কিন্তু অপূর্ব। তুমি চাইলে আমি ওখানেই ব্যবস্থা করে দিতে পারি। অনেক দিন থাকতে হবে যখন বলছো, তখন ডাকবাংলোটাই তোমার জন্য ভালো হবে। এতদিন তুমি নিরামিষ খেয়ে থাকতে পারবে না।
কথাটা মন্দ বলেনি । বললাম, দেখ চেষ্টা করে। আমি যতদুর জানি ডাকবাংলোতে তিনদিনের বেশি থাকতে দেয় না।
-- ঐসব তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও দাদা । ছোটভাইকে একবার সেবা করার সুযোগ তো দিয়ে দেখো।
-- তাই বুঝি ? তাহলে রিহ দিলের একটা ব্যবস্থা করে দে না। তখনই বুঝবো তোর বাহাদুরি কতটুকু।
-- ওধার জানে মে তকলিফ নেহি হ্যায় স্যার, গেট মে বলনে সে হো জাতা হ্যায় । লেকিন ---। কখাটা অসমাপ্ত রেখেই পুঁ থাং কি ভেবে চুপ হয়ে গেল।
আমি বুঝতে পারছি সে একটা কিছু বলতে কিন্তু ভরসা পাচ্ছে না। জিজ্ঞেস করলাম, লেকিন ? লেকিন ক্যায়া ?
-- নেহি স্যার, ছোড় দিজিয়ে । আপলোগ তো বিসোয়াস নেহি করেঙ্গে না।
-- ওখানে রাতে থাকার চেষ্টা নেবেন না স্যার। দীপু পুঁ থাং এর সমর্থনে এগিয়ে এলো।
আমি সশব্দে হেসে বললাম, তোরা এমন ভাবে বলছিস যে আমার কৌতুহলটাই বাড়িয়ে দিলি।
---প্লিজ স্যার, জান কা খতরা মত লিঁজিয়ে, প্লিজ। কথাটা মনের গভীর বিশ্বাস থেকে এমনভাবে বললো পুঁ থাং যে আমার বুকে মুহুর্তে একটা অদ্ভুত সিরসির করে উঠলো যেন। অজানা আতঙ্কে আমার সাহসের ভিতটা নাড়িয়ে দিল পুঁ থাং ।
রিহ দিল -
আত্মা যেখানে অতৃপ্ত (৩)
ঘড়ির কাঁটাতে তখন কাটায় কাটায় সকাল সাতটা। আমার মুঠোফোনে অজানা নম্বর থেকে একটা ফোন। আমি ততক্ষণে তৈরি হয়ে বসা। গোছগাছের তেমন কিছু নেই। এক রাত্তিতে ব্যাগ থেকে এমন কিছুই বের করা হয়নি। ফোনটা তুলে হ্যালো বলতেই, ওপাশ থেকে আওয়াজ এললো, গুড মর্নিং স্যার, ইটস্ জিমি হিয়ার। ইওর কার ইজ রেডি পর ডিপারচার। মানে আমার গাড়ি এসে গেছে। এবার বেড়িয়ে পড়তে হবে। প্রথম দিন ওর সময় জ্ঞান দেখে ভালোই লাগলো। হাতে হাতে জিনিস কয়েকটি গাড়িতে তুলে কুন্দনের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
গাড়ি ছাড়বে এমন সময় বাইক নিয়ে দীপু এসে হাজির। হাতে একটা প্যাকেট। বললাম, এগুলো আবার কেন ?
--- কিছুই না স্যার, একটু ফ্রাইড রাইস আর চিলি চিকেন, আমার নিজের হাতে তৈরি। রাস্তায় লাগবে।
তাকিয়ে দেখি দুটো লাঞ্চ প্যাকেট। বললাম, সাত সকালে উঠে তুই এইসব করেছিস ? আমাকে আর কত ঋণী করবি তোরা ? তোদের এই ঋণ আমি কি করে শোধ করি বলতো ?
-- টেনশন নিও না দাদা, শুধু আশীর্বাদ করে যাও। তোমার আশীর্বাদ পেলেই আমাদের আর কিছু চাই না।
বললাম, একদিক থেকে ভালই করেছিস, আমার একজন গেস্ট আসছেন কোলকাতা থেকে, রাস্তায় ওর তাহলে খাওয়া নিয়ে কোন সমস্যা রইলো না।
--- এই দেখো, আগে বলবে তো ? আমি তাহলে তিন প্যাকেটই নিয়ে আসতাম। এখন কি হবে। দীপু অস্থির হয়ে উঠলো।
আমি ওকে আস্বস্ত করলাম। বললাম, চিন্তা করিস নাতো , এগুলোই ভাগ করে খেয়ে নেবো। তেমন হলে ড্রাইভারকে কোন হোটেলে খাইয়ে দেবো । এতো ভাবার কি আছে ?
দীপু চাম্পাই ডাকবাংলোর ম্যানেজারের ফোন নম্বর আমার ফোনে পাঠিয়ে দিল। সাথে আমার জন্যে ও একটা রুম বুকিং করেছিল, এখন আরো একটা করে দিল।
অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি স্টার্ট দিল জিমি। আমি পিছন ফিরে দেখতে পেলাম ওদের মুখগুলো শুকিয়ে পাংশু হয়ে গেছে। ঘর বাড়ি ছাড়া এই সব ছেলেরা নিজের মানুষ কাউকে পেলে কি যে করবে ভেবে পায়না। আবার কবে দেখা হবে কোনোকিছুর নিশ্চয়তা নেই। সকাল সকালেই মনটা খারাপ হয়ে গেল।
লেংপুই বিমানবন্দর আয়তনে ছোট হলেও বেশ গোছানো । খুব ছিমছাম, পরিষ্কার। বিশাল অংশ জুড়ে ফুলের টব দিয়ে সাজানো। মিজোরামে এই একটি জিনিস আমার খুব ভালো লাগে। এখানে খুব সাধারণ থেকে বিত্তশালী পরিবারেরা প্রত্যেকেই অল্প বেশি ফুলের চর্চা করেন। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই ফুলের টব আছে এবং সেটাও খুব যত্নের সাথে রাখা। গাছগুলোতে সুস্পষ্ট ভালবাসার ছোঁয়া । ঘুরে ফিরে তাই দেখছিলাম আমি। আকাশে মেঘ থাকার দরুন প্লেন আধঘন্টা দেরিতে নামবে।
এদিক ওদিক পায়চারি করছি, চারপাশটা দেখছিলাম। একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে দুবোতল ফ্রুটি কিনে একটা জিমিকে দিলাম আর একটা নিজে। আর ঠিক তখনই একটা মজার ব্যাপার ঘটলো। পকেট থেকে দোকানীকে কুড়ি টাকা দিতেই দোকানী মিজো মেয়েটি ছুটে এসে আমার হাত থেকে একটানে ফ্রুটিটি কেড়ে নিয়ে মিজো ভাষায় বারবার সোম্লি সোম্লি বলতে লাগলে। আমি হতভম্ব। মিজো মেয়েটিও নাছোড়বান্দা। আমাকে সে বুঝিয়ে ছাড়বে।হাসিহাসি মুখে দুই হাতে দুটো ফ্রুটি নিয়ে একবার ডান হাতেরটা একবার বা হাতের ফ্রুটিটা দেখিয়ে আমাকে সোম্নি সোম্নি বলতে লাগলো। আমি অবাক হঠাৎই কি হলো। দামতো আমি ঠিকই দিয়েছিলাম তাহলে আবার কিসের সমস্যা। কিছুই বুঝতে পারছি না।
জিমি এগিয়ে এসে বলল, টুয়েন্টি রুপিস পার স্যার।
--- বাট এমআরপি ইজ টেন ওনলি।
একটা বাঙালি মুসলমান ড্রাইভার অল্প দুরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। আমার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো, দাদা, ইগু ভারতবর্ষের আচানক দেশ। এমআরপি ভালা করিয়া দেখইন, দেখবা কাটিয়া বিশ টাকা লেখা আছে। ইন এরা যেতা কইব ওতাউ শেষ কথা, দিলাইন।
সত্যি তো ! আমি আবার হাতে নিয়ে দেখলাম, সত্যি সত্যিই মুল দাম একটানে কেটে কলম দিয়ে কুড়ি টাকা লেখা। মুল দাম দশ টাকা লেখাটা পাশেই জ্বলজ্বল করে জ্বলছে । আমি হেসে আরো কুড়ি টাকা বাড়িয়ে দিতেই মিজো মেয়েটি হেসে বললে, ক্লোমে, ক্লোমে।
এবার আর আমার ভুল হলো না। আমি ওর অঙ্গভঙ্গীতেই বুঝে গেছি ধন্যবাদ জানাচ্ছে । আমিও ক্লোমে ক্লোমে বলে সরে গেলাম।
প্রায় নয়টা ত্রিশে ইন্ডিগো সিক্স ই ১৩৯ লেংপুই বিমানবন্দরের মাটি ছুঁতেই আমাদের প্রতীক্ষার ইতি। অল্পক্ষণের মধ্যেই একে একে যাত্রীরা বেড়িয়ে আসছে, অধিকাংশই মিজো। অমিজো যে কয়েকজন বেড়িয়ে এলেন, দেখেই বোঝা যায় ওরা সেইলসের লোক। আমার সন্ধানী চোখ তখন খুঁজে চলেছে মিসেস সুপ্রিয়া সরকারকে। খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। একটা নীল টাইট জিন্স, ওপরে কালো সার্ট। চোখে হালকা সোনালী ফ্রেমের চশমা। খোলা চুল, কোঁকড়ানো, আলতো করে একটা ক্লীপে আটকানো। গায়ের রং টকটকে ফর্সা। মেদহীন শরীরে র প্রত্যেকটা অঙ্গে যত্নের ছাপ, অপূর্ব সুন্দরী। আমি একটা বিকট বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম এই আগুনের গোলার দিকে।
ইন্ডিগো ৬ই ১৩৯ বিমান থেকে যিনি নেমে এসেছেন তাকে দেখেতো আমার চোখ ছানাবড়া। মনে মনে ভাবছিলাম একেই বোধহয় বলে ঈশ্বরের রসিকতা। যাকে সো-কেইসে অনায়াসে সাজিয়ে রাখা যেতো, সে কিনা এসেছে এই জঙ্গলে । সেও আমারই অতিথি হয়ে। মনে মনে বললাম, ঠাকুর তোমার লীলা বোঝা সত্যি মুশকিল।
ওদিকে মিসেস সরকার এরাইভেল থেকে বেরিয়ে সোজা আমারই দিকে এগিয়ে এলেন। সরাসরি হাত বাড়িয়ে বললেন, গুড মর্নিং দত্তবাবু। আমি তখনও অবাক বিস্ময়ে আগুনের গোলাটিকে দেখছিলাম।
যতক্ষণে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে প্রত্যুত্তরে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি ততক্ষণে উনি হাত গুটিয়ে নিয়েছেন।
হেসে হাত জোড় করে বললেন, নমষ্কার।
আমি অপ্রস্তুত, তাড়তাড়ি হাত জোড় করে প্রতি নমষ্কার করলাম। বললাম, রাস্তায় কোন অসুবিধা হয়নি তো ?
-- কিসের অসুবিধা ? ওখানে প্লেনে চেপেছি আর এখানে এসে নেমে গেলাম। কষ্ট কোথায় ?
সত্যিই তো, প্রশ্নটা বোকার মত করে ফেলেছি। প্লেনে আসতে আবার কষ্ট কিসের। বললাম, না, আসলে প্লেনটা লেট ছিল তো, তাই বলছিলাম।
জিমি এসে ল্যাগেজগুলো নিয়ে গেল গাড়িতে। বললাম, সকালবেলা কি খেয়েছেন ?
-- তেমন কিছু না । আপনি ?
হাসলাম। বললাম, চলুন, এখানেই খেয়ে নিতে পারি অথবা আপনি চাইলে একঘন্টা পর যখন আইজল ক্রস করবো, তখনও হতে পারে। এজ ইউ উইশ।
--- এত লম্বা জার্নি, হেভি কিছু তো লাগবেই --।
আমি দীপুর দেওয়া ফ্রাইড রাইসের কথা বলতেই বললেন, তাহলে আর কি, চলুন একটু চা খেয়ে স্টার্ট করা যাক।
আমাদের দেখে সেই মিজো মেয়েটি হেসে এগিয়ে এলো। একটা জিনিস আমি এখানে এসে লক্ষ্য করেছি, শুধু এখানে নয়, পুরো মিজোরামেই দেখেছি মেয়েরাই এখানে দোকান পাট চালায়। এমনকি আমি অনেক মিজো মেয়ে মুটেও দেখেছি মাল পত্তর বয়ে নিয়ে যেতে। অদ্ভুত দেশ, ভারতবর্ষের সমতলে কোথাও এমন দেখেছি বলে মনে করতে পারি না। আরো একটা জিনিসও লক্ষ্য করার মতো, সবসময়ই ওদের মুখে হাসি লেগে আছে।
আমরা গরম গরম চা সাথে ব্রিটেনিয়া ফ্রুটকেক নিলাম। মিসেস সরকারের খুব ইচ্ছে ছিল সামোসা খাওয়ার, কিন্তু আমার আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত খাওয়া হল না।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই জিমি গাড়িতে স্টার্ট দিল। মিসেস সরকার স্বভাবতই পেছনের সিটে বসেছেন।
আমি সামনের দরজা খুলতেই, পিছন থেকে বললেন, ওদিকে কোথায় যাচ্ছেন, পেছনে আসুন।
সৌজন্যতা দেখিয়ে আমারও উচিত ছিল, ঠিক আছে, হবে বা কিছু একটা বলে সামনেতেই বসা। উনি তো সৌজন্যতা দেখাবেনই, আমার নিজের একটা বিচার থাকা উচিত ছিল। কিন্তু মনে থাকলেও মুখে কিছুই বলতে পারিনি। বাধ্য ছেলের মত সুড়সুড় করে ওনারই পাশে এসে বসলাম।
চুপচাপ বসে আছি। কারো মুখেই কোন কথা নেই। সময় কেটে যাচ্ছে। মনে মনে অনেক কথাই আসছিল। কি বলব ভাবতে ভাবতেই সময় কাটছে। পাহাড়ের আঁকা বাঁকা পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। নিজেকে ব্যস্ত দেখাতে আমি জানালা দিয়ে বাইরে গাছ পালা দেখছি। আসলে কিন্তু কিছুই দেখছি না, দেখার বাহানা করছি শুধু। বুঝতে পারছি মিসেস সরকার আমাকেই আড়চোখে দেখছেন। তার সারা মুখ জুড়ে একটা দুষ্টুমি বা কৌতুক। কতটা সময় কেটে গেছে ঠিক মনে নেই, হঠাৎই উনি প্রশ্ন করলেন, এর আগে কি আপনি কোন অচেনা মহিলার সাথে এরকম জার্নি করেছেন কখনো ?
হেসে বললাম, না, তেমন সুযোগ হয়নি।
--- তাই ? বাড়িতে কে কে আছেন?
বললাম।
-- বাঃ, আপনার ভাগ্য তো মশাই হিংসে করার মতো। বাড়িতে মিসেস দত্ত, গাড়িতে মিসেস সরকার। কি ? সত্যি কি-না বলুন ?
আমি কি উত্তর দিই। বোকার মত শুধু শুধু হাসলাম।
-- বাড়িতে মিসেস কি খুব কড়া ?
-- না, না তা কেন হবে ?
-- তাহলে এই যে আমার সাথে কয়েকটা দিন থাকছেন, বাড়িতে বলে এসেছেন নিশ্চয়ই ?
এই রে। একদমই সঠিক জায়গাতে ধরেছেন। ভদ্রমহিলাটি সত্যি রীতিমতো ডাকাত। যখন তখন এমন ভাবে বিলো বেল্টে কথা বলেন যে কোন উত্তর দেওয়ার থাকে না। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল।
-- আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি, আপনার কি কোন মহিলা বন্ধু আছেন ?
কি সব আছেবাজে প্রশ্ন। শশব্যস্ত হয়ে বললাম, না না ঐসব কিছু নেই।
-- আপনার স্ত্রী ?
-- হ্যাঁ, না মানে উনিতো আমার স্ত্রী ।
-- তাই ? কোন দিনই কোন মেয়ে বন্ধু ছিল না ?
-- না। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম।
-- বিয়ের আগেও ?
-- না --। এবারো স্পষ্ট উত্তর।
-- তাই ! আহারে বেচারা ! একটা মেয়েও পটাতে পারলেন না !
বিপদেই পড়া গেছে। ইচ্ছে করছিল জিমিকে বলে এখানেই নেমে যাই । তারপর যা হবার হবে। আগে জানা থাকলে হাতে পায়ে ধরে অর্ডারটা বাতিল করিয়েই ছাড়তাম।
ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছেন। আমি সোজাসুজি তাকাতে পারছিলাম না।
একটু পরে সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, একটা কথা বলি, মনে কিছু নেবেন না নিশ্চয়ই ?
আমি নীরবে ওনার দিকে তাকালাম।
বললেন, একটা কথা কি জানেন আমাদের মনে যতক্ষণ পাপ থাকে, ততক্ষণ আমরা সহজ হতে পারি না। আমিও তো আরেকজনের স্ত্রী, একটা বাচ্চার মা। আমার তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না। আপনার কেন হচ্ছে ? আমাকে আপনার একজন বন্ধু ভাবতে পারছেন না কেন ? চেষ্টা করুন। ভুলে যান আমি একটি মেয়ে। সহজ হোন। নইলে আমাদের পুরো মিশনটাই তো নষ্ট হয়ে যাবে যে।
রিহ দিল -
আত্মা যেখানে অতৃপ্ত (৪)
মিজোরামের রাস্তাগুলি অদ্ভুত সুন্দর । না ঠিক রাস্তা নয়, রাস্তার চারপাশের কথা বলছিলাম । আমি তাওয়াংএর রুক্ষ পাহাড় দেখেছি, ঘাস, গাছ, সবুজ নেই তবু অদ্ভুত সুন্দর, পাগল করা রূপ। আবার মেঘালয়ে দেখেছি পাইনের বন ।তারও সৌন্দর্য আলাদা । মনিপুরে দেখেছি, পাহাড়ের রঙ যেন কচি ধানের শীষ, অদ্ভুত মাদকতা । আমি শুধু সেই পাহাড় দেখার জন্য শুধু কতবার যে ভাঙা দুর্গম রাস্তায় কষ্ট করে ছুটে গেছি শিলচর থেকে ইম্ফল তার কোন ইয়ত্তা নেই । অনেক অনেক বার গেছি । আবার মিজোরামে আসা আমার তার আলাদা সৌন্দর্যের টানে। একদিকে উঁচু পাহাড় অন্য দিকে বিশাল খাদ। কয়েকটা নামী শহর বাদ দিলে পুরো মিজোরাম রাজ্যটাই তো ঘন জঙ্গল । তারই মাঝে মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোট্ট ছোট্ট বসতি । রাস্তাগুলোতে ঘনঘন বাঁক, অনেক অনেক জায়গাতেই ভি টার্ন। চড়াই উৎরাই তো লেগেই আছে । খুব সাবধানে এগোতে হয়। অভিজ্ঞ ড্রাইভার ছাড়া মিজোরামের রাস্তায় গাড়ি চালানো সত্যিই খুব কঠিন । তবু যখন নীচে পাহাড়ের খাদ জুড়ে নদীর মত মেঘগুলো ভেসে যায় , ইচ্ছে করে অনন্তকাল ধরে এই স্বর্গের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকি, এমনই তার সৌন্দর্য ।
মিসেস সরকার নিজেও মগ্ন হয়ে উপভোগ করছিলেন মিজো পাহাড়ের এই মন মাতানো রূপ ।
বললাম, আগে কখনো মিজোরামে এসেছেন ?
-- না । আপনি ?
-- অনেকবার, তবে চাম্পাই যাওয়া হয়নি । আপনার জন্যে এটাও হয়ে গেল ।
--- তাহলে আপনার উচিত কিন্তু আমাকে একটা ট্রিট দেওয়া ।
বললাম, অবশ্যই, আমার সৌভাগ্য।
মিসেস সরকার আমার কথায় ছোট্ট করে হাসলেন । বললাম, একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল --।
-- নিসংকোচে বলুন, আমি আপনার আশ্রিত, উত্তর দিতে বাধ্য।
-- ওভাবে বলবেন না প্লিজ। আমি জানতে চাইছিলাম, এত জায়গা থাকতে আপনার এই চাম্পাইকে বেছে নেওয়ার কারণটা কি ? কোন বিশেষ কিছু?
-- আপনার ঘাড়ে চাপবো তাই। বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলেন। তারপর নিজেই বললেন, মিজোরাম সম্বন্ধে আপনি কতটুকু জানেন ?
-- খুব বেশি না। এই অল্প স্বল্প।
-- বেশ তাই শুনি।
বিপদে পড়া গেল । মিজোরাম আমি অনেক বার এসেছি কিন্তু মিজোরাম নিয়ে ভাবিনি কখনো। বললাম, শুনছি চিংলাং নামের একটি বড় শিলা থেকেই নাকি মিজোরামের সৃষ্টি। পার্বত্য জাতিগুলির হট্টগোলে মিজো দেবতা পাখিয়ান খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন,রেগে গিয়ে তিনি যাতে বেশি লোক এখানে আসতে না পারে তার জন্য একটি পাথর দিয়ে যাতায়াতের দরজাটাই বন্ধ করে দেন। সেই থেকেই মিজোরামের সৃষ্টি।
মিসেস সরকার সবটাই শুনলেন। বললেন, ঠিক কথা, এই রকম একটা গল্প আছে বটে কিন্তু মিজোরাম শব্দটি কোথা থেকে এসেছে সেটা তো বললেন না। জানেন কি ?
-- জানি তবু আপনি বলুন, আমি আবারও শুনি। আমি বললাম।
-- শুনেছি মি অর্থ জাতি, জো মানে পাহাড়। আর রাম হচ্ছে ভুমি। তাহলে সব মিলিয়ে দাঁড়াচ্ছে --।
-- পাহাড়ি জাতির ভুমি। আমি বললাম।
-- ঠিক তাই, মিজোরাম হচ্ছে পাহাড়িদের ভুমি। তারা মুলত মঙ্গোলিয়ান জাতির অংশ। মায়ানমারের সঙ্গে তাদের আত্মিক সম্পর্ক।
আমি বললাম, আমিও শুনেছি পশ্চিম মায়ানমার জুড়ে নাকি তাদের হাজার বছরের ইতিহাস।
--আপনাদের তো অবশ্যই জানার কথা। মিজোরাম যে অনেকদিন আসামের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল।
আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি। মিসেস সরকার বললেন, ওরা আসলে যাযাবর জাতি বুঝলেন। ইতিহাস বলে, পনেরো শতকের শেষ ভাগে ওদের সামাজিক উন্নয়নের জন্য ওরা একজন গোত্র প্রধান নির্বাচন করেছিল, ওদের ভাষায়, ঈযরবভঃধরহংযরঢ়।
-- কি বললেন ? আমি চমকে উঠলাম ।
-- ঈযরবভঃধরহংযরঢ়। শব্দটা একটু কটমটে, তাইতো ?
-- একটু ? বাঃবা, আপনি মনে রাখেন কি করে ? দাঁত ভেঙ্গে যায়। আমি তো উচ্চারণই করতে পারছি না। আমি বললাম।
মিসেস সরকার খুব হাসলেন। বললেন, এমন কোন কঠিন কাজ নয়। চেষ্টা করে দেখুন আপনিও পারবেন। যাক যে কথা বলছিলাম, অষ্টাদশ শতাব্দীতেই মিজোরা মায়ানমার ছেড়ে বেরিয়ে আসে। সে এক বিশাল মহাকাব্যিক ব্যাপার। সময় পেলে অন্য কোন দিন বলবো।
তারপর এলো ব্রিটিশ শাসনকাল। একদিকে ব্রিটিশদের কড়া শাসন অন্যদিকে পাদ্রীদের ধর্মান্তরকরণ। মিজোদের জীবনে এলো বিশাল পরিবর্তন। তবুও ১৯৪৭ এর পরেও কিন্তু তারা নিজেদের ভারতবর্ষের অংশ হিসেবে মেনে নিতে পারছিল না। আপনি তো জানেন। তারপরই এলো ১৯৬৬ সালে এমএনএফ। মনে আছে নিশ্চয়ই।
--- মনে নেই মানে খুব মনে আছে। ওদের আন্দোলনের সবচেয়ে বেশি যদি কোথাও প্রভাব পড়ে থাকে সেই হচ্ছে বরাক উপত্যকা। আমরা তখন স্কুলে পড়ি। এখানে এমএনএফ বাঙালি মারছে, সাথে সাথেই শিলচরে খুঁজে খুঁজে নিরীহ মিজো ধরে ধরে পেটানো হচ্ছে। কত লোকের প্রাণ গেছে এভাবে তার কোন হিসেব নেই। এখনও চোখের সামনে ভাসে সেইসব বিভৎস দৃশ্যগুলো । শিলচর শহরের বহু ব্যবসায়ী তখন শুধু মিজোরামের সাথে ব্যবসা করেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন, সবটাই আমার চোখে দেখা। আমি বললাম।
মিসেস সরকার একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, অথচ দেখুন যে জোরামথাঙ্গার আন্দলনে মিজোরাম জ্বললো দীর্ঘ কুড়ি বছর, সেই জোরামথাঙ্গাই পরবর্তী সময়ে মিজোরামের সফল মুখ্যমন্ত্রী।
কথা বলতে বলতে আমরা অনেকটাই পথ পেরিয়ে এসেছি।
জিমি জানাল এখন আমরা সেলিংএ এসে পৌঁছেছি। গাড়ি পার্ক করে জিমি একটা বাড়ির ভেতরে চলে গেল। যাবার আগে বলে গেল, এখানেই লাঞ্চ সেরে নিতে। এরপর লাঞ্চ পাওয়া মুশকিল।
আমাদের সাথে দীপুর দেওয়া দুপ্যাকেট খাবার ছিল, জিমিকেও বললাম ভাগ নিতে কিন্তু ও কিছুতেই নিতে রাজি হলো না। অগত্যা আমরা গাড়িতে বসেই লাঞ্চটুকু সারলাম।
খেতে খেতে টুকটাক কথা হচ্ছিল আমাদের। মিসেস সরকার তার প্যাকেট থেকে অল্প খাবার বাটিটির ঢাকনাতে তুলে রেখে চোখ বন্ধ করে রইলেন। বললাম, কি হলো ?
-- এত খাবার খাওয়া যায় ? নিন শুরু করুন।
খাওয়া শেষে নিজে বাটির খাবারটা একটা গাছের নিচে রেখে এলেন।
খাওয়া শেষে আবারও আমরা গাড়িতে উঠেছি। জিমির খাওয়া তখনও শেষ হয়নি। গাড়িতেই রিলাক্স করছি আমরা। আমি মনে করিয়ে দিয়ে বললাম, আমার কৌতুহলটা কিন্তু এখনো মিটলো না।
-- কোনটা ?
--- ওই যে আপনি এত জায়গা থাকতে চাম্পাইতেই কেন যেতে চাইছেন।
মিসেস সরকার হাসলেন। বললেন, আপনি এত ভাবছেন কেন ? আমিতো বেশ কয়েক দিন আপনার সাথেই আছি। ভরসা রাখুন আপনার সব কৌতুহল মিটলে তবেই আমি মিজোরাম ছাড়বো।
বললাম, ভরসা কোথায় বলুন, কথায় বলে জানেন তো নারীর মতি নাকি -----।
--- বাঃ, এই তো দেখছি বেশ কথা ফুটছে।
মিসেস সরকার এমন ভাবে বলেন যে আমি কি বলবো ভেবে পাই না। উনি তারপর নিজে থেকেই বললেন, তাহলে শুনেই ফেলুন আমি কেন আপনার ঘাড়ে চেপেছি ।
-- না না আপনার অসুবিধা থাকলে থাক না হয়।
আমি বাঁধা দিলাম। সত্যিই তো উনি কেন এখানে এসেছেন আমার জেনে কি হবে। আমাকে সিআরএম স্যার যে দায়িত্ব দিয়েছেন আমার কাজ সেইটা ঠিক ঠাক করা।
-- আহা রাগ করছেন কেন ? আমি তো ঠাট্টা করছিলাম শুধু। চাম্পাই থেকে পঁচিশ কিলোমিটার ভেতরে মায়ানমার সীমানায় একটি হ্রদ আছে আপনি জানেন ?
বললাম, শুনেছি। হার্টের মত দেখতে। ভারত মায়ানমার সীমানা থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ভেতরে। জায়গাটা আসলে মায়ানমারের ভিতর। মিজোদের বিশ্বাস মৃত্যুর পর মৃত আত্মারা সেই হ্রদে গিয়ে স্নান করেন। তারপর সেখান থেকে চলে যায় মৃতদের গ্রামে।
বললাম, এইটুকুই আমি জানি, কিন্তু তার সাথে আপনার আসার কারণটা কি আমি জানি না ।
--- সেটাই তো বলছি আপনাকে। মিসেস সরকার বললেন। আসলে লুসাইরা বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর মৃত আত্মারা রিহ দিলে স্নান করে আবার তাদের গ্রামে ফিরে আসে। তারপর "থি টিন থ্লা" তে মানে আগস্ট মাসে তারা হ্রদ পেরিয়ে মিথিখুয়াতে যায়। মিথিখুয়া হচ্ছে মৃত্যূপুরী যেখানে তাদের কর্মফলের বিচার হয়। সেই মিথিখুয়াতে যাবার সময় আত্মা বারবার পিছন ফিরে গ্রামের দিকে তাকিয়ে কাঁদে। পরে সেখান থেকে তারা লিংলু নদী তারপর পিয়াল নদীর পেড়িয়ে পিয়ালরাল মানে শান্তির দেশ, স্বর্গ ফিরে যায়। এইজন্যই দেখবেন আগষ্ট মাসে মিজোদের কোন শুভ অনুষ্ঠান হয় না। এই সময়েই মৃত আত্মার স্মরণে মীমতূত উৎসব হয়।
এতক্ষণে অনেকটা পরিষ্কার হলো মিসেস সরকারের আসার উদ্দেশ্য। বললাম, কিন্তু রিহ দিলে কি করতে চান আপনি ?
-- লোকে বিশ্বাস করে ওখানে প্রায়শই আত্মার দেখা পাওয়া যায়। সেই জন্যই রাত্রিবাস নিষিদ্ধ। আপনাকে ওখানে আমার এক রাত থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
কি সাংঘাতিক মেয়ে বাবা ! ভুতের সঙ্গে রাত্রিবাস।
নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আমরা চাম্পাই পৌঁছে গেছি। ঘড়িতে তখন পাঁচটা কুড়ি। জিমি খুব ভালো চালিয়েছে গাড়ি। সাড়ে সাত ঘন্টারও কম সময় লেগেছে। রাস্তা মোটেই ভালো নয় তবু ক্রেডিট গোজ টু জিমি, বুঝতে দেয়নি আমাদের।
গাড়ি চাম্পাই ডাকবাংলোর পার্কিং এ দাঁড় করিয়ে জিমি মালপত্র নামিয়ে দিতে ব্যস্ত । আমরা দুজন রিসেপশন কাউন্টারের দিকে এগিয়ে চলেছি। দু'পা এগিয়েছি, পিছন থেকে মিসেস সরকার আস্তে করে ডাকলেন, দত্তবাবু ।
আমি দাঁড়িয়ে যেতেই ফিসফিস করে বললেন, একটা কথা মনে রাখবেন, এই মুহূর্তে আমরা কিন্তু কেউই কারো অতিথি নই। আমাদের আগে থেকে কোন যোগাযোগ ছিল না। পরিচয় হয়েছে আইজলের রাস্তায়। আপনি চাম্পাই আসার জন্য লিফট চেয়েছেন, তাই একসাথে আসা। নইলে কেউই কিন্তু কাউকে চিনি না।
আমি অবাক, বললাম হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত ?
মিসেস সরকার হেসে বললেন, নিজের বৌকে ঘরে রেখে পরের বৌকে নিয়ে জঙ্গলে এসেছেন , খবরটা একবার প্রচার পেয়ে গেলে বাড়িতে ঢুকতে পারবেন তো ?
সত্যিই তো ভাবতে গেলে যে ব্যপারটি দৃষ্টিনন্দন নয় মোটেই। এখানে লোকেরাই বা কি ভাববে। কিন্তু আমি যে আইজলে বলে এসেছি আমার সাথে আরও একজন আছেন। এখানেও তো সেই ভাবেই বুকিং করা। কথাটা মিসেস সরকারকে বলতেই উনি বললেন, তাতে কি ? বলুন যিনি আপনার সাথে আসার কথা ছিল, কোন এক কারণে তিনি আসতে পারেন নি। আপনার একটি রুম হলেই চলবে। আমার জন্যে ভাববেন না, আমার আলাদা বুকিং আছে এখানে।
দুটো পাশাপাশি ভিআইপি রুমই পাওয়া গেছে। আমাদের মুখ ফুটে বলতেই হয়নি। নিজে থেকেই দিয়েছে। আসলে এইসব ব্যাপারে ওদের কোন মাথা ব্যাথা খুব কম। পিছন দিকটায় কমন ব্যালকোনী তারপরেই গভীর খাদ। মালপত্তর যার যার রুমে পৌঁছে গেছে। মিসেস সরকার বললেন, একটু চা খাবেন তো ?
বললাম, অমৃতে আমার কোনকালেই অরুচি নেই।
-- তাহলে চটপট ফ্রেশ হয়ে আমার রুমে চলে আসুন। বেয়ারাকে দুকাপ স্পেশাল চা সাথে ব্রান্ডেড বিস্কুট আনতে বলা হলো।
ফ্রেশ হতে কতক্ষণ আর সময় লাগে। আমি চটপট তৈরি হয়েও কি মনে হতে, রুমেই থেকে গেলাম। আমি জানি চা এলে নিশ্চয়ই ডাক আসবে।
পাঁচ মিনিট যায়, দশ মিনিট যায়, ডাক আর আসে না। আশ্চর্য, দুকাপ চা তৈরি করতে এত সময় ? দরজায় তালা ঝুলিয়ে মিসেস সরকারের দরজাতে নক করলাম। ভেতর থেকে উনি বললেন, দরজা খোলা আছে, ভেতরে চলে আসুন।
বেশ বড় রুম, আমারটির চেয়েও বড়, বিছানায় খোলা সুটকেস। সারাদিনের জিন্সটা অবহেলায় এককোণে পরে আছে। একটা চুল শুকানোর মেশিন বিছানায় রাখা। মিসেস সরকার স্নান সেরে একটা ঢিলেঢালা লাল হাতকাটা ম্যাক্সি পরা, একটা টুলের উপর দাঁড়িয়ে রুমের বাল্ব চেঞ্জ করছেন। বললেন, রাত্তিরে ভায়োলেট আলো না থাকলে বুঝলেন ভালো ঘুম আসে না। বুঝলাম বাল্বগুলো তার সঙ্গে করে আনা।
সামনেই চেয়ার ছিল। শরীরটাকে এলিয়ে মিসেস সরকারকে লক্ষ্য করছিলাম। স্নান করে এলে এমনিতেই সবাইকে খুব ফ্রেশ লাগে। তার উপর ফর্সা রঙে লাল ড্রেস, যেন সারা শরীর জুড়ে আলাদা আকর্ষণ বেড়ে গেছে। চোখ সরানো যাচ্ছে না। ঠাট্টা করে বললাম, সব কাজ যদি আপনি নিজে নিজেই করে ফেলবেন, আমরা তাহলে সেবা করার সুযোগ কি করে পাই বলুন তো ?
-- আজকাল সেবা যত্নে খুব মন দিয়েছেন দেখছি !
-- আমাকে যে স্যার সেই জন্যেই এখানে পাঠিয়েছেন।
-- তাই ? বাড়িতে ফোন করেছেন ?
এই যাঃ, সত্যিই তো, একদমই মনে ছিল না। বললাম, এক মিনিট এখনই আসছি।
মিসেস সরকার হাসতে হাসতে বললেন, তাড়াতাড়ি, নইলে চা ঠান্ডা হয়ে যাবে কিন্তু।
প্রথমেই বাড়িতে ফোন করলাম। টুকিটাকি অনেক কথাই হলো শুধু মিসেস সরকারের প্রসঙ্গটা বাদ দিয়ে। তারপর ঘোষাল স্যারকে ফোনে পৌঁছা সংবাদ দিলাম । উনিও একটা সুসংবাদ দিলেন আমাকে, ওনার নাকি বদলী অর্ডারে সই হয়ে গেছে , কোলকাতায়, বাড়িতে। সাতদিনের মধ্যেই রিলিজ। আমাকে বললেন, আপনাকে ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি জানি, তবু আপনি ছাড়া কারো উপর আমি ভরসা করতে পারছিলাম না। কষ্ট হচ্ছে জানি, তা স্বত্বেও বলছি, অফিসের কোন সম্পর্কে নয়, একজন বন্ধু হিসেবে অনুরোধ, একটু খেয়াল রাখবেন ওর।
আমি ওনাকে আশ্বস্ত করলাম, বললাম যথা সম্ভব করবো।
উনি বললেন, আপনার অর্ডারটা আপনি প্লেস করবেন না যেন, আমি গাঙ্গুলীকে পরে ছুটি নিতে বলেছি। ওর বোধহয় এরই মধ্যে বদলী হয়ে যাবে। আপনি শুধু একদিন ব্রাঞ্চে ইন্সপেকশন করবেন, তারপর যে কাজে আপনি ওখানে গেছেন, সেটা শেষ করে ফিরে আসুন।
আমি ধন্যবাদ জানিয়ে ফোনটা কাটতেই মনটা খুশিতে ভরে গেল। তারমানে আমাকে এখানে খুব বেশি দিন থাকতে হচ্ছে না।
মিসেস সরকারের রুমে ফিরে ভাবছিলাম খুশির খবরটা উনাকেই প্রথমে দিই, কিন্তু তার আগেই উনি চা ঢালতে ঢালতে বললেন, কি ঘোষালের সাথে কথা হয়েছে ?
বললাম, হ্যাঁ, এই মাত্তর।
-- তাহলে আর কি , সুখবর তো পেয়ে গেছেন, এখন তাহলে সেবা করার সুযোগ আরো বেড়ে গেল, তাই না ?
আমি আর উত্তর দিলাম না, শুধু হাসলাম। একটা জিনিস পরিষ্কার বুঝতে পারছি, ভদ্রমহিলার সাথে সিআরএম স্যারের প্রচন্ড হট চ্যানেল। এখন থেকে হিসাব করে কথা বলা উচিত।
আমরা দুজন মুখোমুখি বসা, একটু একটু করে চা খাচ্ছি, কারো মুখেই কথা নেই। কিছু মুহূর্ত আসে যখন কথা খুঁজতে হয়। অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে কথা খুঁজে কথার মালা তৈরি করতে হয়। নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগছিল। হঠাৎই বললাম, আপনার চুল থেকে এখনো জল পড়ছে। ড্রায়ার দিয়ে শুকিয়ে নিন, ঠান্ডা লাগতে পারে যে।
-- হ্যাঁ, দেখছি, আসলে ড্রায়ারটা যে কোথায় রাখলাম --।
-- ওইতো বিছানায়। আমি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম।
-- কোনটা ? ওইটি তো এক্সটার্নাল থার্মোমিটার।
-- কি ?
-- এক্সাটার্নাল থার্মোমিটার, ওইটে দিয়ে আশেপাশে কোনো অশরীরী আত্মা আছে কিনা বোঝা যায়।
-- আপনি সত্যি সত্যিই ওসব বিশ্বাস করেন ?
-- করি বৈকি ।
আমি হাসলাম। কথাটা ঠিক ঠিক বিশ্বাস হলো না।
-- সত্যি, সুযোগ পেলে দেখিয়ে দেব। মিসেস সরকার আমাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করলেন।
এমন অদ্ভুত কথার পর কথা বাড়ানো যায় না।আমি চুপ করে গেলাম । লক্ষ্য করলাম, মিসেস সরকার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন। বললাম, আপনি কিছু বলতে চান ?
-- না কিছু না।
-- কিছু তো নিশ্চয়ই আছে, আপনি হয়তো বলতে চাইছেন না। আমি এমনিতেই কথার পিঠে কথা বললাম।
-- বললাম তো তেমন কিছু না । মিসেস সরকার কেমন যেন আনমনে বললেন। তারপর একটু থেমে কি ভেবে আবার বললেন, এই যেমন ধরুন আমি আপনার সাথে আছি, অথচ আপনি বাড়িতে বলতে পারছেন না আমার কথা, এমনি কিছু একটা আর কি ।
যাঃ বাবা এসব কি কথা। আমি সত্যি কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
তখনও মিসেস সরকারের রুমে বসেই গল্প চলছিল, বেয়ারা এসে জানালো চাম্পাই ব্রাঞ্চে ম্যানেজার এসেছেন দেখা করতে। চাম্পাই ব্রাঞ্চের ম্যানেজার মানে গাঙ্গুলী। বললাম, ওকে বসতে বলো। আমি আসছি ।
মিসেস সরকারকে বললাম, আপনি আসছেন তো ?
-- আপনার অফিসের লোক, আপনার কাছে এসেছে ।আমার আবার যাওয়া কেন? তবে তেমন প্রয়োজন হলে ফোন করবেন, অবশ্যই আসব।
গাঙ্গুলীর সাথে আমার ফোনে প্রায়শই কথা হয়। এবার সামনাসামনি পরিচয় হলো। অল্প বয়েস, চাকরির বেশি দিন হয়নি। দু চারটি এলোমেলো কথার পর বললে, স্যার, সিআরএম স্যার ফোন করেছিলেন, বললেন ওনার এক পরিচিত ভদ্রমহিলা নাকি এখানে এসেছেন। আজই বিকেলে এসে পৌঁছানোর কথা, আপনার সাথে পরিচয় আছে কি ?
-- হ্যাঁ, এই আজকেই হলো। বলছিলেন সিআরএম স্যারের সাথে নাকি পরিচয় আছে।
-- একবার যাবেন স্যার, দেখা করে আসি ।
-- যাওয়া তো অবশ্যই যেতে পারে, তবে আগে একবার ওনার পারমিশন নিয়ে নেওয়া উচিত নয় কি ?
বেয়ারা গিয়ে খবর দিতেই অল্পক্ষণের মধ্যে মিসেস সরকার নিজেই রিসেপশনে চলে এলেন।
আমি পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললাম, উনি সুদুর কোলকাতা থেকে এসেছেন শুধু চম্পাই শহরটি ঘুরে দেখতে চান আর যদি সম্ভব হয় তাহলে রিহ দিলও দেখার খুব ইচ্ছে।
-- না না যদি টদি নয় দত্তবাবু, রিহ দিল যাওয়ার একটা ব্যবস্থা আপনাকে করতেই হবে। প্লিজ।
আমি হেসে বললাম, অবশ্যই, এতদুর থেকে এসে না দেখে ফিরে গেলে এত কষ্টের কি অর্থ ?
-- ওখানে যাওয়া নিয়ে কোন সমস্যা নেই স্যার। কোন পাসপোর্ট, ভিসা কিচ্ছু চাই না। শুধু ভোটার আইডি, আধার কার্ড বা ওই জাতীয় কিছু একটা জমা দিয়েই ঘুরে আসা যায়। তবে সকালে গিয়ে বিকেলের মধ্যেই ফিরে আসতে হবে। রাত্তিরে থাকা চলবে না। গাঙ্গুলী বলল।
-- কিন্তু উনি যে একটি রাত্রি হলেও ওখানে রাত্রিবাস করতে চান, গাঙ্গুলী। আমি মিসেস সরকারের পক্ষে বললাম।
-- ওটা অসম্ভব স্যার। সিআরএম স্যার আমাকে আগেও অনেকবার বলেছেন, কিন্তু সম্ভব না । গাঙ্গুলী এক জায়গাতে আটকে আছে।
বললাম, তোমাদের ল্যান্ডলর্ডের সাথে একবার কথা বলে দেখো না, কিছু একটা করা যায় কিনা।
-- অসম্ভব স্যার। এই সব ব্যাপারে ওরা প্রচন্ড গোঁড়া।
-- কিন্তু ওরা তো খ্রীশ্টান --
-- তাতে কি স্যার, এসব ক্ষেত্রে ওদের পুরোনো ভাব ভাবনা এখনো এতটুকুও পাল্টায় নি। দেখেননি এখনো ওদের বিয়ে শুরু হয় "পালাই" এর বাড়ি থেকে।
-- পালাই এর বাড়ি মানে ? বুঝলাম না। আমি বললাম। আসলে শব্দটি আমার কাছে নতুন।
-- ওটা আপনাকে বুঝতে হবে না। মিসেস সরকার হেসে আমাকে বললেন। পালাই হচ্ছে অনেকটা ঘটকের মত। মিজো মেয়েদের বিয়ে মোটামুটি ঠিক হয়ে গেলে কনে জিনিসপত্র নিয়ে পালাই এর বাড়ি চলে যায়। পালাই তখন শূকর কেটে ভোজ আয়োজন করে বরপক্ষকে আমন্ত্রণ করে। এভাবেই শুরু হয় বিয়ের অনুষ্ঠান।
-- ঠিক বলেছেন ম্যাডাম। আর ঠিক সেই জন্যেই বলছি রিহ দিলে রাত্তিরে থাকার প্লেনটা আপনাকে বাদ দিতে হবে, প্লিজ।
বুঝলাম ওকে দিয়ে এর বেশি কিছু হবার নয়। বললাম, ঠিক আছে ভাই, দেখো চেষ্টা করে, বাকিটা উনার ভাগ্য।
আসলে সেই মুহূর্তেই আমার অন্য একজন ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে গেছে, খানসাহেব।গাঙ্গুলীকে বিদায় দিয়েই আমি সেই ভদ্রলোককে ফোন করলাম। খানসাহেব আসলে একজন এক্সপোর্ট ইমপোর্ট এর ব্যবসায়ী। প্রায় ত্রিশ বছর মিজোরামে আছেন। কখনো চাম্পাই কখনো সাইয়া আবার কখনো আইজলে থাকেন । আমার কপাল ভালো বলতে হবে, উনি এই মুহূর্তে চাম্পাই তেই আছেন। ফোন পেয়ে বিরাট খুশি। বললেন, মাংস ভাত খাওয়াচ্ছেন তো ?
বললাম, অবশ্যই।
গাঙ্গুলী চলে গেছে। ওর ট্যান্সফার হয়ে যাবে খবরটা পেয়ে মনে হলো খুব খুশি। মিসেস সরকারকে খান সাহেবের একটা ইন্ট্রডাকশন দিয়ে রাখলাম । ডাকবাংলোর ম্যানেজারকে বললাম রাতের খাবারে তিন প্লেট মাংস ভাত চাই।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই খানসাহেব এসে হাজির। মিসেস সরকারকে দেখে প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। হাতের ব্যাগটা কোথায় রাখবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। আমি সামনে থাকায় অবশ্য কোন অসুবিধা হলো না। পরিবেশটা সহজেই সহজ হয়ে গেল। জমে উঠলো আড্ডা। খুবই প্রাণবন্ত মানুষ খানসাহেব। বললাম, আমি জানতাম, আপনি মাঝে মাঝেই চাম্পাই আসেন কিন্তু আজকে যে আপনাকে এখানে পেয়ে যেতে পারি আমার ভাবনায়ই ছিল না।
খানসাহেব ব্যাগে করে আসর জমাবার বস্তু নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু মিসেস সরকারকে দেখে আর সাহস করেন নি। এরই মধ্যে আমাদের দু প্রস্ত চা আর পকোরা খাওয়া হয়ে গেছে। নানা প্রসঙ্গে আলোচনা হলো, একেবারে মোদী থেকে মিজোরাম। খানসাহেবও খুব আড্ডাবাজ লোক। তাই দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। বেয়ারা এসে ডিনার রেডি করবে কিনা জানতে চাইলে, বললাম, অসুবিধা নেই, কর। ঘড়িতে তখন সাড়ে আটটা। এত তাড়াতাড়ি আমরা রাতের খাবার খাই না। কিন্তু পাহাড়ের দেশে নিয়ম আলাদা। তাছাড়া খান সাহেবকে আবার ফিরে যেতে হবে।
ডিনার টেবিলে তিনজন খেতে বসেছি। সেল্ফ হেল্প সার্ভিস। মিসেস সরকার চার প্লেট খাবার বাড়লেন । বেয়ারা আস্তে করে বলল, ম্যাডাম, আপলোগকা ড্রাইবার তো খানা লে লিয়া।
মিসেস সরকার যেন শুনেও শুনলেন না। খান সাহেব চুপচাপ সব কিছু দেখছেন। ডাল, ডিমবড়া, একটা শব্জী আর অবশ্যই বনমোরগ। ভালোই ব্যবস্থা, বিশেষ করে বহুদিন পর বনমোরগ। খাওয়া জমে গেছে। খানসাহেব নানা
কথা প্রসঙ্গে এখানে আসার কারণটা জানতে চাইলেন, বললাম। বললেন হয়ে যাবে। আমরা দুজন অবাক। বললাম, বলেন কি মশাই যে কাজটা সবাই বলছে হবে না, আপনি এত সহজে বলে দিলেন হয়ে যাবে।
খানসাহেব খুব সহজেই বললেন, বললাম তো হয়ে যাবে।
আমি আবার ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বললাম, যে ওখানে আমাদের রাত্তিরে থাকার ব্যবস্থা করা চাই। বললেন, একবারই তো বললাম হয়ে যাবে। তবে একদিন সময় চাই হাতে।
বললাম, আমরা দুজন কিন্তু।
-- না না দুজন নয়, শুধু আমি একা। মিসেস সরকার সঙ্গে সঙ্গেই শুধরে দিলেন।
আমি বললাম, অসম্ভব, আপনাকে আমি কিছুতেই একা থাকতে দিতে পারি না।
ততক্ষণে আমাদের খাওয়া শেষ। আমি লক্ষ্য করলাম, সেই একস্ট্রা ডিশের খাবার সবটুকু মিসেস সরকার পেছনের খাদে নিয়ে ফেলে দিলেন।
খানসাহেব সবটুকু দেখে আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন, উনার স্বামী কি মিজো ছিলেন? সম্প্রিতি মারা গেছেন ?
-- নাঃ, আমি তো তেমন কিছু জানিনা। কথা হয়তো আরো কিছুদুর এগোতে পারতো, কিন্তু
এই প্রসঙ্গে আর কথা বলা গেল না। মিসেস সরকার আবার ফিরে এসেছেন টেবিলে।
উনি কিছুতেই কাউকে নিয়ে যেতে রাজি নন।
আমিই বা কি করে একা ছেড়ে দিই। ঘোষাল স্যার বারবার আমাকে বলেছেন, খেয়াল রাখতে। কিছু হয়ে গেলে আমার আর উপায় থাকবে না।
এই হ্যাঁ আর না এর মধ্যেই খানসাহেব মধ্যস্ততা করে জানতে চাইলেন, প্লেনটা কার।
বললাম, ম্যাডামের।
-- তাহলে ম্যাডামের কথাই শেষ কথা।
আমি বললাম, অসম্ভব
-- এইটাই সম্ভব। আমরা তিন জন যাবো, সারাদিন থেকে আমরা দুজন ফিরে আসব, শুধু ম্যাডাম থাকবেন ওখানে একা, তাই তো ম্যাডাম। পরদিন সকালবেলা আমরা আপনাকে গিয়ে নিয়ে আসবো। রাজি ?
মিসেস সরকার বললেন, ডান ।
আমি বললাম, মানতে পারছি না।
-- আপনি মানেন আর না মানেন, তাতে কিছু আসে যায় না। ডিসিশন ফাইনাল হয়ে গেছে, তবে কাল নয় পরশু, কারণ আমার একদিন হাতে সময় চাই। খানসাহেব শেষ কথা বলে দিলেন। আমি চুপচাপ।
উনি বিদায় নেবার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আগামী কাল আপনাদের প্রোগ্রাম কি ?
মিসেস সরকার বললেন, কিছুই না।
আমার ব্যাপারটা পছন্দ হয়নি, তাই নিরুত্তর রইলাম। খানসাহেব আমাকে লক্ষ্য করলেন, কিন্তু না দেখার ভান করে গেলেন। বললেন, কাল সকাল আটটায় আমার গাড়ি চলে আসবে। এখান থেকে প্রায় ৫২ কিলোমিটার দূরে ভেংচিয়া বলে একটা জায়গা আছে, খুব সুন্দর জায়গা। মিজোরামের প্রথম আরকিওলজিকেল সাইট। ভালো লাগবে, ঘুরে আসুন। গাড়িতে খাওয়া দিয়ে দেব কোন অসুবিধা হবে না। রাত্তিরে আমার ওখানে নিমন্ত্রণ। আর পরশু রিহ দিল। ঠিক আছে।
বিদায় নেবার সময় শুধু আমার হাতে প্যাকেটটা দিয়ে হাত ধরে বললেন, দত্তবাবু, মন ছোট করবেন না, আপনার জন্য আমার জান হাজির।
এত সহজে সবকিছু সমাধান হয়ে যাবে আমি নিজেও ভাবি নি। খান সাহেব চলে যাবার পর মিসেস সরকারকে গুড নাইট জানিয়ে আমি আমার দরজায় খিল দিলাম। খানসাহেবের গিফ্টটা একটু হলেও টেস্ট করতে হবে। বস্তুর গুণ নাকি সারাদিনের ক্লান্তি, কখন ঘুমিয়ে গেছি নিজেই বলতে পারি না।
রাতে বেশ কয়েকবার ঘুম ভেঙ্গেছে, মনে হয়েছে পাশের ঘরে কিছু শব্দ হচ্ছে। তারপর আর কিছুই বলতে পারি না।
ফটো #নিজস্ব#
রিহ দিল -
আত্মা যেখানে অতৃপ্ত (৫)
ঘুম ভেঙ্গে গেছে সেই ভোরবেলা। পাহাড়ের এই একটা নিয়ম। সূর্য ওঠার সাথে সাথেই জনজীবন ব্যস্ত হয়ে যায়। আমার যেহেতু প্রাতঃভ্রমনের একটা বদ অভ্যাস আছে, তাই সবসময়ই ভোরবেলা ঘুম ভাঙ্গে। আজও যথারীতি পাঁচটাতেই ঘুম ভেঙ্গে গেছে। ট্রেকসুট লাগিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম শহর দেখতে। পাহাড় কেটে থাক থাক রাস্তা। তারই একপাশে কখনোবা দুইপাশেই সুন্দর সুন্দর বাড়ি। সামনে সারি সারি ফুলের টবে রঙ বেরঙের ফুল। চোখ জুড়িয়ে যায়। এমনিতে চাম্পাই খুব বড় শহর নয়, তবে সুন্দর আর পরিষ্কার আমাদের মতো ওরা রাতের অন্ধকারে পাশের বাড়ির গেটে কখনো আবর্জনা জমায় না। প্রত্যেকের বাড়ির সামনে আলাদা আলাদা ঝুড়ি রাখা আছে, তাতেই সব আবর্জনা জমানো থাকে। ভোরবেলাতে পরিষ্কার হয়ে যায়।
খুব বেশি ঘোরাঘুরি করা সম্ভব হলোনা আমার পক্ষে, ক্লান্ত লাগছিল। আসলে আমাদের ওখানকার মত সমতল রাস্তা তো নয়, কিছুটা ঢালু তারপর আবার চড়াই, অভ্যাস নাই যে। একপাক ঘুরে ফিরে এলাম ডাকবাংলোতে। ততক্ষণে সকালের চা তৈরি। নামে বেড টি, তবে বেডে শুয়ে নয়, বারান্দায় বসে চায়ের স্বাদ নিচ্ছিলাম সাথে মন ভালো করা মিষ্টি সকাল।
বেয়ারা নক করায় হয়তো ঘুম ভেঙ্গে গেছে মিসেস সরকারের। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়েই আমাকে দেখে বললেন, গুড মর্নিং।
-- ভেরি গুড মর্নিং ম্যাডাম, ঘুম হয়েছে ?
-- হ্যাঁ, খুব ভালো, কোনও অসুবিধা হয়নি।
-- আমি কিন্তু রাতে কিছু একটা শব্দ শুনতে পেয়েছি। আপনার ঘর থেকে আসছিল।
-- ও কিছু না। বলেই প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, আজ যেন কখন বেরোতে হবে আমাদের ?
আমি বললাম, ঠিক আটটায়।
খানসাহেব তার কথা মতই ঠিক আটটাতে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাঙালি ড্রাইভার, আহমেদ। আমি তাকে মনে হয় শেষবারের মতো লুংথ্লেলাই-তেই দেখেছিলাম, সেও পাঁচ বছর আগেকার কথা। মনে থাকার কথা নয়, যদি না সে মনে করিয়ে দিতে। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করল, স্যার, কতদিন থাকছেন এখানে ?
বললাম, জানি না রে, বোধহয় তিন চার দিন, বেশিও হতে পারে।
-- রিহি দিল যাচ্ছেন তো ?
বললাম, এখন পর্যন্ত যাওয়া ঠিক, পরে কি হবে জানি না।
-- যদি যান, তাহলে সাবধানে থাকবেন স্যার, জায়গাটা ভালো না।
আমি হেসে মাথা নাড়লাম, তর্ক করে কি লাভ।
প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ আমরা গাড়িতে চেপে বসলাম, ভেংছিয়া যাচ্ছি। খাবার দাবার খানসাহেব গাড়িতেই দিয়ে দিয়েছেন। এমনকি খাবার জল পর্যন্ত গাড়িতে রাখা। আমরা মুল রাস্তায় এসে ডান দিকে জোথলাং রোড ধরে এগিয়ে চলেছি।
শহর থেকে বেরিয়েই একটা জায়গাতে অনেকগুলো গাড়ি পার্ক করা। যে যার মতো ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছে। খোলা আকাশের নিচে হাফ ওয়াল দিয়ে পাবলিক টয়লেট বানানো। আহমেদ আমাদের গাড়িটাকেও একপাশে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর স্টিয়ারিং ধরে চুপচাপ বসে আছে।
মিসেস সরকার ইশারায় থেমে যাওয়ার কারণটা বুঝতে চাইছিলেন।
আমিও ইশারায় বললাম, প্রেয়ার হচ্ছে, প্রার্থনা।
অল্প পরেই গাড়ি আবার স্টার্ট হলো। আহমেদকে বললাম, কি রে, এই কালচারটা তো মিজোদের নিজস্ব, তুই কবে থেকে এই অভ্যাস শুরু করেছিস ?
আহমেদ হাসলো, বলল, প্রার্থনা তো প্রার্থনাই হয় স্যার, এতে যে সবার অধিকার সমান।
কথাটা তো সত্যি। বললাম, ঠিক বলেছিস, এই দুর্গম রাস্তায় যাচ্ছি, প্রার্থনা তো আমাদের সবারই করা উচিত।
চাম্পাই থেকে ভেংছিয়ার দুরত্ব বাহান্ন কিলোমিটার, সময় লাগে দুই ঘণ্টা।
জোথলাং স্টেডিয়াম পেরিয়ে রাস্তা ইন্দো - মায়ানমার বর্ডার রোডে এসে মিশেছে। তারপর অনেকটা পথ ওই রাস্তা ধরে এগিয়ে জিরো পয়েন্টে এসে ডানদিকে খাওবাং রোডে এগোতে হয়। পথে কেলকং, ডিলকোয়ান, খুংলেং হয়ে ভেংছিয়া। রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। এমনকি ইন্দো মায়ানমার বর্ডার রোডেরও জঘন্য অবস্থা। অবশ্য তখনও ওই রাস্তা তৈরি হয়নি, সবে কাজ শুরু হয়েছে।
গাড়ি চালাতে চালাতে আহমেদ বলল, স্যার আমরা যেখানে যাচ্ছি, ওই জায়গাটার নাম ভেংছিয়া কেন হলো জানেন কিছু ?
আমি মিসেস সরকারের মুখের দিকে তাকালাম, বোঝা গেল উনিও কিছুই জানেন না। বললাম, তুই কিছু জানিস ?
খুব বেশি কিছু না, তবে গল্পটা জানি।
আমরা দুজনেই চুপচাপ । আহমেদ বলল, এই যে ভেংছিয়া, ওটা তো আসলে একটা উপজাতিদের নাম স্যার। মিজোদের মধ্যে অনেক অনেক উপজাতি আছে। এই যেমন ধরুন, খাওলরিং, পাউতে, সাইভাতে, ঠিক তেমনি ভেংছিয়াও একটা উপজাতি। ওরা নিজেদেরকে চুংথাংএর বংশধর বলে দাবি করে। চুংথাং ছিলেন একজন সৎ এবং ভালো মনের মানুষ। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করতো, ভালবাসতো। তার এই ভালো মানুষির জন্য একসময়ে তিনি রাজকুমারী লালজালির নজরে আসেন। রাজকুমারী লালজালির চুংখাংকে দেখে, তার গল্প শুনে উনার প্রেমে পড়ে যান। ক্রমে ক্রমে জমে উঠে ভালবাসা। একদিন লালজালি চুংখাংকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। স্বয়ং রাজকুমারী পছন্দ করে বিয়ে করতে চাইছেন, সেখানে কারো আপত্তি থাকার কোন কারণই থাকতে পারে না। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায় রাজকুমারীর সাথে চুংখাংএর। চুংখাংএর জীবনে আসে খুশি আর খুশি। কিন্তু সমস্যার শুরু হয় তার কিছু দিন পর থেকেই। চুংখাংএর সুখের সংসারে লালজলি স্বাভাবিক ভাবেই একদিন গর্ভবতী হোন। সন্তান আসছে, সুখের খবর, সমস্ত বাড়ি জুড়ে একটা উৎসব উৎসব ভাব আর তখনই রাজকুমারীর হঠাৎই গর্ভপাত হয়ে যায়। সমস্ত আনন্দ মাটি। সবাই মর্মাহত, একটা শোকের পরিবেশ, চুংখাং স্বান্তনা দেন, ভরসা দেন রাজকুমারীকে, বলেন দেখো, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। রাজকুমারীও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন এখন থেকে আরো আরো সাবধান থাকবেন। শুরু হয় প্রতীক্ষা। তারপর একদিন আবারও রাজকুমারী গর্ভবতী হন, আবার ফিরে আসে খুশির মহল, শুরু হয়ে যায় দিন গোনার পালা। এবারো আবার সেই শেষ সময়ে রাজকুমারীর গর্ভপাত হয়ে যায়। আবারো সেই একই অবস্থা। বারবার একই ঘটনা ঘটে চলেছে, পরিবারে অশান্তি, কেউ কারো সাথে কথা বলেন না, মুখ দেখাদেখি প্রায় বন্ধ। এমনি সময়ে একদিন চুংখাং স্বপ্নে দেখলেন, কেউ তাকে বলছেন, তুমি যদি তোমার সন্তানের জন্ম দিতে চাও তাহলে সেইসময়ে গর্ভবতীকে অন্য কোন গ্রামে নিয়ে যেও। সেখানেই তোমার সুস্থ সন্তান জন্ম নেবে। চুংখাং খুব হতাশায় ভুগছেন। ভাবলেন, দেখাই যাক চেষ্টা নিয়ে। এমনিতেও প্রতিবার গর্ভপাত হয়ে, একবার স্বপ্নাদেশ শুনতে ক্ষতি কি। গ্রামের যারা শুভাকাঙ্ক্ষী সবাই বললেন, দেখাই যাক না একবার চেষ্টা নিয়ে।
সেই মত আবার যখন লালজালি গর্ভবতী হলেন তখন সন্তান প্রসবের অল্প কয়েকদিন আগেই রাজকুমারীকে নিয়ে চুংখাং চলে গেলেন পাশেই থিয়াকদের গ্রামে। এবার কিন্তু লালজলি সত্যি সত্যিই জন্ম দিলেন একটা সুস্থ স্বাস্থবান সন্তান। সবাই খুশি। চুংখাংএর স্বপ্ন সত্যি হলো। ধীরে ধীরে ছেলে বড় হচ্ছে লালজলি তার নাম রাখলেন খুয়ালহিং। আবার ফিরে এলো খুশি গ্রামে। দিন যায় মাস যায়, একদিন আবারও লালজলি গর্ভবতী হলেন। আবার উৎকণ্ঠা শুরু। এবার ওরা দুজনেই সতর্ক, অপেক্ষা করছেন যদি স্বপ্নে কোন আদেশ হয়। একদিন ওরা স্বপ্নে দেখলেন কেউ তাদের বলছেন, যদি তোমরা সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে চাও তবে বাড়ির পাশেই একটা ভেং বা ওয়াং গাছ আছে, তার তলাতেই রাজকুমারীর প্রসবের ব্যবস্থা করতে হবে। এখন তো স্বপ্নাদেশেও তাদের প্রচন্ড বিশ্বাস, সেই মতোই ব্যবস্থা হলো। এবং সত্য সত্যিই এবারও লালজলি একটি সুস্থ সন্তানের জন্ম দিলেন। ছেলের নাম রাখা হলো ভেংছিয়া। ভেং গাছের নিচে জন্ম তো তাই ভ্যাঙ্গসি বা ভেংছিয়া। চুংখাংএর এই দুই ছেলে খুয়ালহিং আর ভেংছিয়া থেকেই দুই উপজাতির সৃষ্টি, খাওলরিং আর ভেংছিয়া।
বললাম, বাঃ, খুব সুন্দর গল্প বললি তো।
--- গল্প নয় স্যার সব সত্যি। আসলে ভেংছিয়ারা তো জানতই না এই জায়গার মর্ম। তাইতো কেউ মারা গেলে তারা পাহাড় থেকে স্থপতিগুলো ভেঙ্গে পাথর নিয়ে আসত কবরের জন্য। কত কত জিনিস নষ্ট করে ফেলেছে তারা, তার কোন হিসেব নেই। এখনও চল্লিশটিরও বেশি কবর দেখতে পারবেন খোলা পরে আছে, ওরা পাথর তুলে নিয়ে গেছে। ওসবের মর্মই বুঝতো না। এখন অবশ্য ২০১০সনের পর থেকে তারা বুঝে গেছে আর নষ্ট করে না। নিজেরা দেখে শুনে রাখে।
কথা বলতে বলতে আমরা চলে এসেছি ভেংছিয়া গ্রামে। একটা ছোট্ট শহর, গ্রামও বলা চলে। জনসংখ্যা দেড়শো পরিবারে মেরেকেটে একহাজার লোক হবে। লোকগুলো খুবই সাধারণ। সবাই খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী। লোক চলাচল খুবই কম। তাও ২০১২ সালে পুরাতত্ত্ব বিভাগের অনুসন্ধানের পর আমাদের মতো পাগল দুচার জনের আসা শুরু হয়েছে।
গাড়ি পার্ক করে আহমেদ আমাদেরকে একটা গেট দেখিয়ে বলল, স্যার আমার কাজ শেষ, গাড়ি এখানেই থাকবে। ভেতরে যাবার পারমিশন নেই। আপনারা ভেতরে যান, একটু কষ্ট করে পায়ে হেঁটে ঘুরতে হবে কিন্তু। দেখলাম গেটের উপর লিখা, কাউছূহা রপুই (Kawtchhuah Ropui) দি গ্রেট গেটওয়ে।
আমি আর মিসেস সরকার আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছু কিছু জায়গা পরিস্কার করে রাখা আবার কিছু জায়গাতে জঙ্গল। তারই মধ্য দিয়ে পায়ে হাঁটা রাস্তা এগিয়ে গেছে চাম্পাই ফারকান পর্বতশ্রেণীর গা বেয়ে।
গেট পেরিয়ে অল্প এগোতেই অপার বিষ্ময়। বিস্তর্ন জায়গা জুড়ে সারি সারি মনোলিথ আর মেগালিথিক স্টোন। সারি সারি একপাথরের কবর, মধ্যে সেই সময়কার পাথরে বাঁধানো পথ। কোথাও একাধিক পাথরের ব্যবহার । প্রতিটি পাথরে খোদাই করা প্রাচীন সব চিত্রকলা, মানুষ, পাখি, বাইসনের মাথা, এমনি আরো কত কি। মিসেস সরকার শিশুর মতো একটা থেকে আরেকটাতে ছুটে যাচ্ছেন, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন আবার ডেকে দেখাচ্ছেন। শিলং জোয়াইএর পথে একটা গ্রামে অনেকগুলো মনোলিথ আছে, আমি দেখেছি, কিন্তু সেগুলোতে কোন খোদাই কাজ নেই। এখানে প্রত্যেকটি পাথর যেন একটা হাড়িয়ে যাওয়া সভ্যতার নিদর্শন। কি সুন্দর খোদাই কাজ।
দুরে একটা সরকারি বোর্ড লাগানো, দেখলাম তাতে জায়গাটাকে হাড়িয়ে যাওয়া ইন্দোমিজো সভ্যতার নিদর্শন বলে দাবি করা হয়েছে। লিখা খাওউচুআহ রোপুই বা দি গ্রেট গেটওয়ে। পাশেই এখানে প্রাপ্ত সেইসময়কার হাড়,অলংকার ইত্যাদির নানা বিবরণ দিয়ে অনুমানিক সময় লিখা ৬০০ বিসিই।
মিসেস সরকার বললেন, ভাবতে পারেন খ্রীস্টের জন্মের ছয়শো বছর আগে ঠিক এখানেই ছিল একটা সভ্যতা যা হিন্দু সভ্যতার বেষ্টনীতে থেকেও একটা সম্পূর্ণ সতন্ত্র সভ্যতা, যার মধ্যে হিন্দু সভ্যতার কোন ছাপ নেই । সত্যি অবাক লাগে না ?
আমরা হাঁটতে হাঁটতে সেই পাথরে খোদাই করা ওয়াটার পেভিলিওনটাও দেখলাম, সেই সময়কার মানুষের কাজ, অনেকটাই আমাদের ইদানিং কালে মোগল যুগে তৈরি ওয়াটার পেভিলিয়নের মতো। যত দেখি ততই অবাক হই। মুগ্ধতা আর শুধুই মুগ্ধতা। অনেকগুলো ফটো নিলাম। স্মৃতি হয়ে থাকবে।
মিসেস সরকার বললেন, শিলচর যাবার আগে ফটোগুলো ডিলিট করে দেবেন কিন্তু। বাড়িতে দেখতে পেল, আপনার রক্ষা থাকবে না।
আমি হাসলাম। বললাম ভয় নেই, সে ব্যবস্থা আমি করে নিয়েছি।
আসলে মিসেস সরকারকে বাদ দিয়েই আমি কিছু ফটো তুলে নিয়েছিলাম। বলা যায় না, কেউ দেখতে চাইলে তখন হয়তো কাজে লাগবে।
দুর্গম রাস্তা, পাহাড়ি পথ, আমরা দুই জন শুধু পর্যটক । সাবধানে চলতে হচ্ছে। প্রথম প্রথম একটু সঙ্কোচ ছিল, কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের সব সঙ্কোচ কাটিয়ে দিয়েছে। কখন যে হাত ধরে একসাথে হাঁটতে শুরু করেছি নিজেদেরই খেয়াল নেই। যখন খেয়াল হলো তখন সত্যি সত্যিই হাতটা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। মিসেস সরকারের তরফ থেকেও এই হাত ধরা নিয়ে আপত্তি আছে বলে মনে হলো না। আসলে এখানে যে দেখারও কেউ নেই, বলারও কেউ নেই, আছি শুধু আমি আর সুপ্রিয়া সরকার।
হাঁটতে হাঁটতে একসময়ে সত্যি ক্লান্ত হয়ে গেছি। বললাম, আসুন একটু বসা যাক।
একটা পরিষ্কার দেখে চৌকোনা পাথরের উপর দুইজন ভাগ করে বসলাম।
দুইটা মানুষ পাশাপাশি বসে আছি, দুদিন আগেও কেউ কাউকে চিনতাম না। আর এখন পাশাপাশি গায়ে গা ঘেঁষে হাত ধরে বসা। দুজনেই চুপচাপ । কথা হাড়িয়ে গেছে। মিসেস সরকার আমার হাতে চাপ দিয়ে বললেন, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আপনার জন্যই আজ আমার এই সব দেখার সৌভাগ্য হলো।
আমি হেসে বললাম, উল্টোটাও তো হতে পারে। আপনি আসতে না চাইলে আমিই কি আসতে পারতাম এখানে।
দেখতে দেখতে অনেক বেলা হয়ে গেছে। মিসেস সরকার বললেন, চলুন এবার ফেরা যাক।
এত তাড়াতাড়ি সময়টা শেষ হয়ে যাচ্ছে, বললাম, আরো একটু বসা যায় না।
মিসেস সরকার হেসে বললেন, একটা কথা আছে জানেন তো, লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
আমিও হাসলাম। মনে মনে বললাম, এই মৃত্যু আমাকে গ্রাস করুক, আমি যে মনে প্রাণে তাই চাই। মুখে কিছুই বললাম না। শুধু মনে হলো মিসেস সরকার আমার হাতটা আরো বেশি শক্ত করে ধরলেন।
রিহ দিল
আত্মা যেখানে অতৃপ্ত - ৬
ভেংছিয়া থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক বেলা হয়ে গিয়েছিল । রাস্তা খুবই খারাপ, তাই কষ্ট একটু বেশিই হয়েছে । পরিশ্রান্ত লাগছিল নিজেকে। এদিকে রাতে খানসাহেবের বাড়িতে নিমন্ত্রণ । উনার জন্যেই আজ এতো ভালো একটা ট্রিপ হলো ।আগামীকাল রিহ দিল যাবার ব্যবস্থাও উনিই করে দিচ্ছেন ।শরীর না চাইলেও একটা কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে যাওয়াটা খুব জরুরী ।
ভেংছিয়া থেকে এসে একটু গড়িয়ে নিয়েছিলাম বিছানাতে । সন্ধ্যায় মিসেস সরকার নিজে এসে বললেন, তিনি আর আজ নিমন্ত্রণ রাখতে যাচ্ছেন না । মনের মধ্য থেকে তখনও দুপুরের ভালো লাগা রেশটা কাটেনি। বললাম, চলুন না, কাছেই তো , আপনি সাথে থাকলে আমার খুব ভালো লাগবে।
-- প্লিজ, আজকের দিনটা শুধু, আমার ভালো লাগছে না । একটু ম্যানেজ করুন না প্লিজ । আমি জানি আমার জন্যে আপনি এইটুকু করবেনই ।
কেউ যেতে না চাইলে, আমার কি করার আছে । বললাম, বেশ যদি শরীর বেশি খারাপ লাগে, বলবেন অবশ্যই ।
রাত সাতটা নাগাদ আহমেদ আবার এসে হাজির । আমি তৈরিই ছিলাম, বললাম, চল।
-- স্যার, ম্যাডাম যাবেন না ?
বললাম, নারে শরীর ভালো নেই।
খানসাহেবের বাড়ি খুব বেশি দুরে নয়। গাড়ি বাড়ির সীমানাতে ঢুকতেই খানসাহেব শশব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন। বললাম, একাই এসেছি, মিসেস সরকারের শরীরটা ভালো নেই ।
-- ভালোই হয়েছে স্যার । খুব ভালো, শাপে বর হয়েছে ।
খানসাহেবের কথাটা কেমন যেন আমার কানে লাগলো। কাউকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে কেউ এধরনের কথা বলতে পারে কি করে?
খারাপ লাগলো। হয়তো আমি না এলে উনি আরো বেশি খুশি হতেন। এক কথায় রাজি হয়ে যাওয়াটা বোধহয় আমাদের ঠিক হয়নি ।কিন্তু অন্য উপায়ও ছিল না যে। আমার যে কারণে এখানে আসা, তার অনেকটাই এই মুহূর্তে এই লোকটার উপর নির্ভর করে । আমি কোন উত্তর দিলাম না । খানসাহেবের পিছনে পিছনে এসে বারান্দাতেই বসেছি । পূর্ণিমার বোধহয় বেশি দিন বাকি নেই ।আকাশে ফুটফুটে জ্যোৎস্না ।ভালোই লাগছিল বাইরে বসতে। আমরা মুখোমুখি বসলাম ।
সোফাটিতে পুরো শরীরটাকে ডুবিয়ে দিয়ে খানসাহেব বললেন, কেমন হলো আজকের ট্রিপ ?
-- ভালো খুবই ভালো । আপনি না পাঠালে জানতেই পারতাম না এত সুন্দর একটা জায়গা আমাদের আশেপাশেই আছে। খুব ভালো লেগেছে ।আমি বললাম ।
-- আগামী কালও ভালো লাগবে আপনার ।তবে কাল রাতটা আপনার জন্য ভালো গেলেই হয় স্যার ।
-- মানে ?
-- মানে আর কি স্যার, যা বললাম, তাই । কালকের রাতটা আপনার জন্য খুবই বিপদজনক । খানসাহেব খুব সহজ গলায় বললেন ।
-- বুঝলাম না ।
ততক্ষণে একটা মিজো মেয়ে ট্রেতে চা দিয়ে গেছে । মিজোরা একটা অন্য ধরনের চা খায় । এক কাপ চায়ের সাথে প্লেটে কিছু গুড়। মিজোরা বলে থিমপুই লে কুরতেই । থিমপুই হচ্ছে চা আর কুরতেই মানে গুড়। এক চুমুক চায়ের সাথে এক কামড় গুড় খেতে হয় । আমি আগেও খেয়েছি ।
খানসাহেব নিজের হাতে চায়ের কাপটা তুলে দিয়ে বললেন, বুঝবেন স্যার, সব বুঝবেন, তার আগে বলুনতো , এই মিসেস সরকারের সাথে আপনার কতদিনের পরিচয়?
-- কেন বলুন তো ?
-- আহা বলুনই না স্যার ।
খানসাহেব জোরাজুরি করায় বললাম, এই গতকাল সকাল থেকে ।
-- তাই ! তার আগে ?
-- প্রশ্নই ওঠে না ।
-- কোথায় থাকেন, কিছু জানেন ?
বললাম, কোলকাতায় ।
-- কোলকাতা সেতো জানি , কিন্তু কোলকাতা কোথায় ?
-- আশ্চর্য, আমি কি সব জেনে বসে আছি মশাই? এই জন্যেই বুঝি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন ?
আমার কথায় হয়তো খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ পেয়েছে তাই খানসাহেব সঙ্গে সঙ্গেই সুর পাল্টে বললেন, স্যার অন্যভাবে নেবেন না। আপনার সাথে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। আপনি যদি সেদিন আমার পিছনে না দাঁড়াতেন তাহলে আমি শেষ হয়ে যেতাম স্যার । এই আপনার সামনে এসে বসতেই পারতাম না । আজ আমি যা হয়েছি সবটাইতো স্যার আপনার জন্যে। আপনার ভালোর জন্যই আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। প্লিজ একটু আমাকে কোপারেট করুন ।
বললাম, বিশ্বাস করুন আপনি, উনি কে, কোথায় থাকেন, কে তার স্বামী, আমি কিছুই জানিনা ।আমার বসের বন্ধু, তাই আমার আসা। কিন্তু এত কথা আপনি কেন জিজ্ঞেস করছেন বলুন তো ? তারপর একটু থেমে আবার বললাম, মিসেস সরকারের সাথে আমার মাত্র দুদিনের পরিচয় সত্যি, কিন্তু এই দুদিনে মানুষটার মধ্যে কোন কপটতা আছে বলে আমার কখন মনে হয়নি কখনো । একটু হয়তো গায়ে পরা ভাব আছে, তাই বলে উনি স্মাগলার, উগ্রপন্থী বা কোন খারাপ মনের মানুষ মোটেই নন এইটা আমি হলফ করে বলতে পারি।
খানসাহেব আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসলেন । বললেন, চেনেন না, জানেন না তবু এক ভদ্রমহিলার সাথে দুদিন এক রাত্রি বেশ কাটিয়ে দিলেন তাইতো ?
খানসাহেবের কথাগুলো খুব বিশ্রী ইঙ্গিত করে, অস্বস্তিকর । অথচ কথাগুলো তো মিথ্যে নয় । বললাম, আচ্ছা উনার ব্যক্তিগত বিষয় জেনে আমার কি লাভ বলুন তো ? আমার এসব ব্যাপারে এমনিতেই খুব একটা উৎসাহ নেই , মানে ঠিক সাচ্ছন্দ বোধ করি না ।
-- জানাটা যে খুব জরুরী স্যার , খুব প্রয়োজন । কারণ ওনার সাথে আপনার জীবনটাও যে জড়িয়ে গেছে ।আজ যদি ওনার কিছু হয়ে যায়, আপনি ছাড়া পেয়ে যাবেন ভাবছেন ?
-- মানে ? আপনি কি বলতে চাইছেন ? এবার আমি অল্প অল্প ভয় পাচ্ছি ।
-- হ্যাঁ, মনে করুন কাল রিহ দিলে থাকতে গিয়ে ওনার কিছু একটা হয়ে গেল, পুলিশ কি আপনাকে ছেড়ে দেবে ভাবছেন ? নাকি আপনার ব্যাঙ্ক আপনাকে ছেড়ে দেবে ? এই যে গাঙ্গুলি ছেলেটি ব্রাঞ্চ ম্যানেজার, আপনি কি ভাবেন ছেলেটি খুব বোকা ? কিংবা অপদার্থ ? খানসাহেব আমাকে কি বলতে চাইছেন ? এক মুহূর্তে আমার পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেল । আমতা আমতা করে বললাম, এভাবে তো কখনো ভাবিনি খানসাহেব, বিশ্বাস করুন আমি খুব সহজ ভাবে নিয়েছিলাম বিষয়টাকে । কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আরো একটু ভাবনা চিন্তার প্রয়োজন ছিল। তারপর নিজে থেকেই আবার বললাম , আগামী কালের প্রোগ্রাম তাহলে বাতিল করে দিই কি বলেন ?
-- বাতিল করে দিলে আপনার বস, সিআরএম স্যার আপনাকে ছেড়ে দেবেন তো ? পানিশমেন্ট ট্রান্সফারের জন্যে আপনি নিশ্চয়ই প্রস্তুত ?
আমি তখন আক্ষরিক অর্থে শর্ষে ফুল দেখছি।বুঝতে পারছি আমি ফেঁসে গেছি। বেরিয়ে আসার কোন পথ খোলা নেই ।
আমার এই অসহায় অবস্থায় খানসাহেবের কোন হেলদোল নেই, অন্তত আমার তাই মনে হচ্ছিল । বললেন, আচ্ছা আমরা একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই । খানসাহেব যেন আমাকে নিয়ে খেলছেন ।বললেন, আপনি তো স্যার এই ভদ্রমহিলার সাথে দুদিন থেকে আছেন, আপনার চোখে কোন অস্বাভাবিক কিছু নজরে এসেছে কি?
বললাম, নাঃ তেমন কিছু তো দেখলাম না খানসাহেব । আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে বলতে পারি, সত্যি খুব সাধারণ মহিলা, কথাবার্তাও খুব স্বাভাবিক , আর মিষ্টি ।
আমার কথায় খানসাহেব হেসে উঠলেন । বললেন, স্যার আমি এসব জানতে চাইনি । কোন অস্বাভাবিক আচরণ ?
বললাম, না --।
আমি কিন্তু একবার দেখেই বুঝে গেলাম আর আপনার নজরে এলো না ! খানসাহেব বললেন।
আমি বললাম, কি ?
-- কেন খেতে বসে আপনি লক্ষ্য করেননি, উনি একটা আলাদা খাবারের থালা সাজিয়ে রাখছেন, লক্ষ্য করেন নি ? তারপর সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে, ওই থালার পুরো খাবারটা নিজের হাতেই বাইরে ফেলে দিলেন, লক্ষ্য করেছন ?
এবারে আমার সত্যি হাসি পেলো । বললাম, এই ব্যাপার ? এর জন্য আপনি এতগুলো কথা বলছেন ? এই কাজটা তো উনি প্রত্যেক বেলাতেই করে আসছেন । আজ দুপুরেও একথালা খাবার গাছের নিচে রেখেছেন । আমি জিজ্ঞেস করতে বললেন, ওটা নাকি ওনার রোজকার অভ্যেস ।
-- ব্যাস আপনিও মেনে নিলেন। খানসাহেব আমার কথার প্রত্যুত্তরে বললেন । বললেন, আচ্ছা, বলুনতো এর আগে কাউকে কখনো এভাবে খাবার নষ্ট করতে দেখেছেন আপনি ?
সত্যি তো, কথা তো ঠিক। এভাবে তো আমি কখনো ভেবে দেখিনি । কি উত্তর দিই। চুপ করে গেলাম । ভুল তো আমারই হচ্ছে ।
খানসাহেব আবার আমাকে প্রশ্ন করলেন, আর কিছু ?
ঠান্ডা মাথায় আরো একবার ভাবলাম পুরো এপিসোডটা , সেই আমাদের প্রথম দেখা থেকে সন্ধ্যায় শেষ দেখা অবধি। না তেমন কিছু মনে পড়ছে না। হঠাৎই মনে হলো গতকাল রাতে নাইট বাল্ব পাল্টানোর কথা। বললাম উনি যে বলেছিলেন ওই লাইট ছাড়া ওনার রাতে ঘুমের অসুবিধা হয়।
-- বাঃ মিলে যাচ্ছে । মিলতে বাধ্য । খানসাহেব আপন মনে বললেন ।
আমার ততক্ষণে ধৈর্যচূতী ঘটেছে । বললাম, ধুর মশাই, তখন থেকেই হেয়ালি করে যাচ্ছেন, বলবেন তো কি হয়েছে ?
বলবো স্যার, সব বলবো, তার আগে আপনাকে আমার আরো একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে ।
বললাম, বলুন --।
-- আপনি কি ভুতে বিশ্বাস করেন ? মানে আত্মার?
এবার আমার রীতিমতো রাগ হলো । বাড়িতে ডেকে এনে কি সব হয়রানি চলছে। নিজেকে কন্ট্রোলে রাখা খুব কষ্ট , তবু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে একটা একটা শব্দ স্পষ্ট করে বললাম, খানসাহেব একটা কথা বলি, প্রত্যেক কিছুরই একটা সীমা থাকে । আপনি জানেন নিশ্চয়ই । অপরাধ নেবেন না আমার, আপনার সাথে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয় । বোধহয় কুড়ি বছরেরও বেশি ।যদিও ইদানিংকালে আমাদের যোগাযোগ খুবই ক্ষীণ তবু আমাদের এই সম্পর্কের একটা গভীরতা আছে বলে আমার বিশ্বাস । আর সেই দাবিতেই আমি আপনার সাহায্য চেয়েছিলাম, আপনি করছেনও। আমি স্বীকার করি । আজ দিনেরবেলাতেও আমাদের একটা খুব ভালো জায়গা দেখিয়ে এনেছেন । এইজন্য আমি সত্যিই আপনার কাছে কৃতজ্ঞ । কিন্তু তার পরিবর্তে আপনি যদি ভেবে থাকেন বাড়িতে ডেকে এনে এমনিসব ব্যবহার করবেন তাহলে আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে নিশ্চয়ই । যাক, আপনার অনেক সময় নষ্ট করেছি , ধন্যবাদ । বলেই আমি উঠে দাঁড়ালাম । মাথাটা হঠাৎ করে আগুনের মতো গরম হয়ে গেছে । নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি ।
আমার কথাগুলো এতই কাটা কাটা ছিল যে একদম মোক্ষম ঔষধের মতো কাজ করেছে। খানসাহেব তার চেয়ার ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে আমার হাত দুটো চেপে ধরলেন । বললেন, আপনি আমার বড়ভাই স্যার । আমাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ, বসুন। আমার জীবনে আপনি যে কি তা আপনি নিজেও হয়তো জানেন না । আজ আমি যা কিছু সব আপনার জন্যে । আপনাকে যদি আমি দুঃখ দিয়ে থাকি , আল্লাহ আমাকে মাফ করবেন না স্যার । আপনার কোন ক্ষতি আমি হতে দেব না ।
খানসাহেব এমন আকুতি মিনতি শুরু করলেন, যে আমি বিব্রত বোধ করতে লাগলাম । মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল সত্যি , কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি কোথাও ভুল করছি নাতো? সহজ হতে পারছিলাম না । চুপচাপ বসে রইলাম । খানসাহেব কিছুক্ষণ আমার দিকে করুন ভাবে তাকিয়ে রইলেন । বুঝতে পারছেন আমার রাগ কিছুতেই কমছে না ।
একসময়ে কি মনে হতেই উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, স্যার, আমার সাথে একবার ভিতরে আসুন প্লিজ ।
এই মুহূর্তে আমি ওনার অতিথি । উপায় নেই গেলাম পিছনে পিছনে । একটার পর একটা ঘর পেরিয়ে সোজা শোবার ঘরে। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল, এভাবে হুট করে কারো শোবার ঘরে যাওয়াটা আমার পছন্দ নয়। কিন্তু উপায় নেই, গেলাম । খানসাহেব তার শয্যার পাশ থেকে একটা ফটো হাতে নিয়ে বললেন, আমার মেয়ে নাসরিন ।
একটা খুব মিষ্টি ফুটফুটে মেয়ের ছবি । বছর চারেক বয়স হবে ছবিতে ।
বললাম, বাঃ খুব মিষ্টি তো !
খানসাহেব উত্তর দিলেন না । ফটোটাকে যত্ন করে মুছে একটুখানি আদর করলেন, তারপর জায়গাতেই রেখে দিলেন । আমার দিকে ফিরে বললেন, আজ বারো বছর হতে চললো, আমার একমাত্র মেয়েটি নেই ।
-- নেই মানে ? আমি চমকে উঠলাম ।
নেই মানে নেই স্যার, আল্লাহ র কাছে চলে গেছে ।
-- ইশ্ --। মুখ ফস্কেই শব্দটা বেরিয়ে গেল । পিন পড়লে শব্দ শোনা যায়, এমনি নিস্তব্ধতা।
খানসাহেব আবার ফিরে এলাম আগের জায়গাতে । বললেন, বসুন।
একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে । একটু আগে ছিল একরকম এখন সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমার সামনে বসা এক অন্য খানসাহেব। আমার এতদিনের পরিচিত লোকটার সাথে এই লোকটিকে কিছুতেই যেন মিলাতে পারছিলাম না । খানসাহেব তার নিজের জায়গাতে বসে আপন মনেই বলতে লাগলেন, খুব মিষ্টি ছিল স্যার মেয়েটি, খুব । সবসময়ই আমার বুকের মধ্যে লেগে থাকতো। এমনকরে আব্বু ডাকতে ----। কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলেন না খানসাহেব রুমাল দিয়ে একবার চোখ জোড়া মুছে নিলেন । বললেন, মাত্র চারদিনের জ্বরেই সব শেষ। যখন আমার মেয়েটা আমাদের ছেড়ে চলে গেল তখন জানেন কিছুতেই মানতে পারছিলাম না ওর চলে যাওয়াটা । আপনাদের দয়াতে তখন আমি জাঁকিয়ে ব্যবসা করছি। ঘরে কোন অভাব নেই ।বেশিরভাগ সময়ই আইজলে থাকতাম । কাজ কারবার সব ওখান থেকেই চলে। আসলে আইজল ছাড়তে চাইতাম না মেয়েটার জন্য। মেয়েটি সবসময়ই আমার বুকে লেগে থাকতো। ওর জন্যেই আমি কোথাও যেতে চাইতাম না । এত মিষ্টি করে আব্বু ডাকতো যেন মনে হতো বেহেস্তের হুর আমার গলা জড়িয়ে আছে ।
সামান্য একটু জ্বর হয়েছিল স্যার, তেমন কিছুই না, বলেছিল আব্বু তুমি যেও না, কিন্তু একদিনের জন্য আমাকে লুংলে না গেলেই নয় ।অনেক বুঝিয়ে মেয়েটাকে রাজি করিয়েছিলাম।যখন রওয়ানা দিলাম, মেয়েটার চোখ ছলছল করছে ।আমি আদর করে বেরিয়ে পড়েছি।অর্ধেক রাস্তা সবে পেরিয়েছি স্যার খবর এলো মেয়ের শরীর হঠাৎই বেশ খারাপ । ভাবলাম এতটা পথ যখন এসে গেছি, কাজটা সেরেই নাহয় যাই। কাজ শেষ হয়েছিল স্যার, কিন্তু মেয়েটাও শেষ হয়ে গেল । যখন বাড়ি পৌঁছেছি ততক্ষণে সব শেষ। আমাকে নাকি খুব খুঁজছিল আমার মেয়েটা ---। কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলেন না খানসাহেব । বুঝতে পারছিলাম ভেতরটা তার কষ্টে ফেটে যাচ্ছে ।
একটু সময় নিলেন নিজেকে সামলে নিতে। তারপর চোখ মুছে নিজে থেকেই বলতে শুরু করলেন । বললেন, মেয়েটা চলে যাবার পর আমার আর কিছুতেই কিছুতে মন বসছিল না। কাউকে সহ্য করতে পারতাম না ।মনে হতো একটা বেলা যারা আমার মেয়েকে দেখে রাখতে পারেনি তারা আবার আমার কিসের আত্মীয়। পারিবারিক অশান্তি চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে । বাড়িতে কিছুতেই মন লাগতো না। ঘুরে ফিরে মেয়েটার কথাই মনে পড়তো। একসময়ে মিসেস রইলেন বাড়িতে ব্যবসা বানিজ্য নিয়ে, আমি সব ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে । পাগলের মতো ঘুরছি এখানে ওখানে । আমি বুঝতাম, যে ও আছে আমার পাশেই। ওর একটা পুতুল সবসময় আমার সাথে রাখতাম। নানা জায়গাতে খুঁজে খুঁজে সেসব লোককে দিয়ে আমার মেয়েটার আত্মার সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করতাম । সবসময় যে যোগাযোগ হতো তা নয়, কখনো কখনো বাজে আত্মাও চলে আসতো , আবার অনেক সময় মেয়ের সাথেও যোগাযোগ হয়ে যেত । বুঝতাম, মেয়েটা আমার পাশেই আছে, আমার সাথে কথা বলতে চায়। আমার কাছে বায়নাক্কা করতো। আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম ।
মেয়ের কথা বলতে বলতে খানসাহেব বারবার ভেঙ্গে পড়ছিলেন ।আমি খানসাহেব স্বান্তনা দিয়ে বললাম, থাক খানসাহেব, ওসব কথা এখন থাক। যত ভাববেন ততই মন খারাপ লাগবে। আজ না হয় এইটুকুই থাক।
-- না না আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার, আমাকে বলতে দিন। বলতে পারলেই হালকা লাগবে।
আমি আর কি করি , আপত্তি করলাম না।
খানসাহেব আবার বলতে লাগলেন, আমি তখন পাগল হয়ে গেছি বুঝলেন। পাগলের মতো মন্দির, মসজিদ, দরগাহ ঘুরছি। আমি যেখানে যাই মেয়েটাও আমার সাথে সাথে সেখানে যায়। সব সময় আমার সাথে থাকে। কিন্তু একটা করুণ মুখ। আমি জিজ্ঞেস করতাম, তোর কি কোনো কষ্ট হচ্ছেরে মা। মেয়েটা উত্তর দিত না। আমার মনে হতো মেয়েটা আমাকে তার কষ্টের কথা খুলে বলতে পারছে না। আমি মেয়েটাকে বলতাম, তুই ছাড়া আমার আর কেউ নেই রে মা। তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না, তুই কক্ষনো আমাকে ছেড়ে যাস না মা। মেয়েটা শুনতো, উত্তর দিত না। আপনিতো আমাদের দেশকে ভালো করেই জানেন, ধর্মের ব্যাপারে কতটা স্পর্শকাতর । কিন্তু বিশ্বাস করুন, কোন মন্দির, মসজিদ, দরগাহতে আমার সাথে কেউই খারাপ ব্যবহার করেন নি। এতদিনে আমিও অনেক কিছু শিখে নিয়েছি। কি করে আত্মর সাথে যোগাযোগ করতে হয়, বাজে আত্মা থেকে কি কি করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, সব আমি শিখেছি ।তারপর ঘুরতে ঘুরতে একদিন হরিদ্বারের নির্জন পথে হাঁটছি , এমন সময় একটা পনেরো ষোল বছরের মেয়ে, ভীষণ হালকা পাতলা, মুখটা করুন, দুঃখী দুঃখী ভাব, আমার হাতটা টেনে বলল, সাধুবাবা আপনাকে ডাকছেন। একটা মুসলমান পাগলকে একজন সাধুবাবা ডাকছেন, আমার কাছে খুব আশ্চর্য লাগল । আমার তো কোন পিছুটান নেই, হারাবারও কিছু নেই। ভাবলাম , দেখাই যাক । গেলাম মেয়েটার পিছনে পিছনে। পাহাড়ি দুর্গম রাস্তা, জঙ্গলের অনেক ভিতর । মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি করে বুঝলে মা, যে উনি আমাকেই ডাকছেন ?
মেয়েটি মুখে কোন উত্তর দিল না, শুধু মিষ্টি করে অল্প হাসলো । আমি মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম । কেন যেন মনে হলো এই হাসিটা আমার খুবই পরিচিত ।
জঙ্গলের ভিতরে একটা ধূনি জ্বালিয়ে একজন সাধুবাবা চোখ বন্ধ করে বসা , মেয়েটি আমাকে উনার সামনেই একটা আসন পেতে বসতে দিলে। আমি বসলাম । পাঁচ মিনিট যায়, দশ মিনিট যায়, সাধুবাবা ধ্যানস্থ। যতবারই ভাবি ধুরছাই আমি কেন এখানে বসে আছি, চলে গেলেই হয়, তখনই মেয়েটি এসে সামনে দাঁড়ায়, বসতে বলে। মেয়েটির চেহারাটা আমার খুব চেনা চেনা লাগছিল । আমার মেয়েটাও বেঁচে থাকলে হয়তো এই বয়সেরই হতো। প্রায় আধঘন্টা পর সাধুবাবা চোখ খুললেন । আমার দিকে তাকিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বললেন , কেমন আছিস খান ?
আমি রীতিমতো চমকে উঠলাম, উনি আমার নাম জানলেন কি করে ? নমস্কার করলাম ।
-- মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছিস কেন?
এবার আমার অবাক হবার পালা । একা থাকি, ছেলে মেয়ে নেই, অথচ সাধুবাবা বলছেন, আমি নাকি কোন মেয়েকে কষ্ট দিচ্ছি । বললাম, বুঝলাম না সাধুবাবা, আমার তো কোন মেয়ে নেই।
-- কেন ? নাসরিন ?
-- নাসরিন ? সেতো বেঁচে নেই সাধুবাবা !
-- সেটাই যদি বুঝতে পারছিস, তাহলে তার আত্মাকে কেন আটকে রেখেছিস ?
আমি হতবাক । আমি কষ্ট দিচ্ছি আমার মেয়েকে ? আমার পরীকে ? হায় আল্লাহ !
সাধুবাবা আবার নিজের থেকেই বললেন, লক্ষ্য করিস নি , তোর মেয়েটা কেমন শুকিয়ে গেছে ? চোখ দুটো সবসময়ই ছলছল করছে, বাবা হয়ে বুঝতে পারিস না ?
আমি তখন পুরো ভেঙে পড়েছি । সব খুলে বললাম । সাধুবাবা আমাকে অনেকক্ষণ ধরে বোঝালেন। তারপর একসময় ওখানে বসেই আমার মেয়ের যে পুতুলটা আমার সঙ্গে সবসময়ই থাকতো, যে পুতুলটাকে ভিক্তি করে আমি ওর আত্মাকে ডেকে আনতাম, সেই পুতুলটাকে মন্ত্র উচ্চারণ করে হোমকুন্ডে দিয়ে দিলেন । আমি লক্ষ্য করলাম, যে মেয়েটা আমাকে পথ দেখিয়ে এখানে নিয়ে এসেছিল, সেই মেয়েটির মুখটা মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো খুশিতে। একটা প্রচন্ড খুশি। যেন আমার নাসরিন হাসছে আমার সামনে দাঁড়িয়ে । আমি দেখতে দেখতে আমার চোখের সামনে আমার মেয়েটা মিলিয়ে গেল বাতাসের সাথে । আমি দেখেও চিনতে পারিনি মেয়েটাকে । কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছি । সাধুবাবা আমাকে অনেক বোঝালেন, বললেন, তোর মেয়ে এবার মুক্তি পেয়ে বেহেশতে চলে যাবে রে বোকা । এখানে ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল, তোকে ছেড়ে যেতে পারছিল না ।
তারপর নিজে থেকেই আমাকে একটা বোতল জল দিয়ে বলেছিলেন, রেখে দিতে, কাজে লাগবে । যদি কোনদিন কোন ভালো, খারাপ, যে কোন ধরনের আত্মা কারো উপর আশ্রয় নেয় তাহলে এই জল ছিটিয়ে দিলেই সে মুক্তি পাবে । তুইতো আত্মা নিয়ে অল্প বিস্তর কাজ শিখেছিস, তোর প্রয়োজন পড়বে এই জলের , মিলিয়ে নিস আমার কথা।
সত্য সত্যিই এই জল আমার অনেকের উপকারে এসেছে । খুব ক্ষমতা ছিল সাধুবাবার। তিনদিন থাকতে দিয়েছিলেন আমাকে, তারপর বলেছিলেন, যা, বাড়ি যা, তোর মন এখন ঠান্ডা হয়ে গেছে, এখন তুই উন্নতি করবি, বাড়ি ফিরে যা । সত্যি সত্যিই আমার মন তারপর থেকে অনেক শান্ত হয়ে গেছে। আমি আবার ব্যবসা শুরু করেছি । এখন নিজেকে সত্যিই খুব হালকা মনে হয়।
একসাথে এতগুলো কথা বলে খানসাহেব এবার থামলেন । আত্মা বা ভুত আমি কখনো দেখিনি । বিশ্বাস নেই এই কথা বলবো না তবে আদিখ্যেতা কোনকালেই ছিল না । খানসাহেবের গল্পটা কতটা সত্যি আমি তাও জানি না, তবু মনটা খারাপ হয়ে গেল । সবকিছুর পরেও তিনি একজন মেয়ের বাবা আর সেই মেয়েটার বাবা , যে মেয়েটা আজ আর বেঁচে নেই ।
মিজো মেয়েটি এসে জিজ্ঞেস করলে খাবার টেবিলে দেবে কিনা । খানসাহেব তাকে আরো আধঘন্টা পরে আসতে বলে বিদায় দিয়ে আমার খুব কাছে এসে বসলেন । বললেন, স্যার, আপনার খারাপ লাগতে পারে তবু বলছি আপনাদের মিসেস সরকারকে দেখে আমার প্রথমেই কিছু একটা সন্দেহ হয়েছিল । আমার অভিজ্ঞতা, আমার এইসব ব্যাপারে যে জ্ঞান আছে তার থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এখানে কিছু একটা সমস্যা আছে । আপনাকে না জানিয়ে, আজই আমি ডাকবাংলো থেকে মিসেস সরকারের বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে সব খোঁজ খবর নিয়েছি স্যার। আমার কাছে যে খবর আছে, তাতে আমার মনে হয় উনি একজন উইডো, বিধবা । মেয়ে ব্যাঙ্গালোরে থাকে । কোলকাতায় একা ফ্ল্যাটে থাকেন । বছর দুয়েক আগে একটি মিজো ছেলে ওদের কমপ্লেক্সে ভাড়া আসে আর ওই ছেলেটির সাথে আপনাদের মিসেস সরকারের যেভাবেই হোক একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় । আমাকে বিশ্বাস না হলে আপনি নিজেও খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন । দুর্ভাগ্য বশতঃ ওই ছেলেটাও মাস ছয়েক আগে মারা গেছে ।
আমি শুনছিলাম শুধু , বিশ্বাস হচ্ছিল না । আবার অস্বীকার করি তেমন যুক্তিও মনের মধ্যে আসছে না । খানসাহেব আমাকে সিরিয়াসলি বোঝানোর চেষ্টা করছেন । বললেন, মিজোদের মধ্যে যদি কেউ মারা যান তবে ওরা বিশ্বাস করে, মৃতের আত্মা রিহ ডিলে স্নান সেরে আবার তাদের পরিবারে ফিরে আসেন। সেইজন্যই আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন, কারো বাড়িতে যদি কেউ মারা যান, তবে তার পরিবারের লোকেরা খাবার সময়ে মৃতের উদ্দেশ্যে একটা আলাদা থালা সাজিয়ে দেন । আর সেই থালা সাজানো চলতে থাকবে থিটিনথ্লা তে মীমতূত ফেস্টিবেল না হওয়া পর্যন্ত । থিটিনথ্লা হচ্ছে আগস্ট মাস আর মীমতূত হলো মৃত আত্মাদের স্মরণে উৎসব। এই থিটিনথ্লাতে মানে এই আগস্ট মাসেই আত্মা আবার রিহ দিলে স্নান করে চলে যায় মিথিখুয়ার উদ্দেশ্যে। মিথিখুয়া হচ্ছে আপনাদের হিন্দুদের যেমন যমপুরী তেমনি একটি জায়গা । ওখানে তার কর্মফলের বিচার হবে তারপর আত্মা এগিয়ে যাবে লুংলো নদীর দিকে । তখনও তার মায়া কাটেনি । বারবার ফিরে ফিরে তার পরিবার গ্রামকে দেখবে আর কাঁদবে। তারপর একসময়ে তৃষ্ণার্ত হয়ে সে লুংলো নদীর জল পান করবে। ওই নদীর জল খুব মিষ্টি আর সুস্বাদু ।এই জল পান করার সাথে সাথেই আত্মার অনেক কষ্ট লাঘব হয়ে যায়। নদীর তীরে একধরনের ফুল পাওয়া যায় , যার নাম হাওইলোপার । একমাত্র লুংলো নদীর তীরেই ফোঁটে এই ফুল । আত্মা যখনই সেই ফুল তুলে চুলে বা কানে গুঁজে দেবে তখনি তার পুরোনো সব স্মৃতি হারিয়ে যাবে। তখন সে মুক্ত আত্মা । সামনেই পিয়াল নদী, ওই নদীর ওপারেই পিয়ালরাল, মানে শান্তির দেশ, স্বর্গ । এখন এই আত্মাকে যদি রিহ দিলে আটকে দেওয়া যায় তাহলে তবেই কেল্লা ফতে।
কথাগুলো একশ্বাসে বলে খানসাহেব একটূ থামলেন ।
আমি তাকে বললাম, আমি জানি, এত ডিটেলে না হলেও কিছুটা আমার জানা। মিসেস সরকার গতকালই আমাকে বলেছেন ।
-- তাহলে ? খানসাহেব বললেন, তাহলে ? এবার আপনিই তাহলে মিলিয়ে নিন, কেন উনি রিহ দিল যেতে চাইছেন, কেন উনি এই আগস্ট মাসেই যেতে চাইছেন, কেন সেই রিহ দিলে তিনি একা যেতে চাইছেন , কেন উনি খাবারের সময়ে একটা আলাদা থালা সাজিয়ে রাখেন, কেন রুমের মধ্যে ----। কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে খানসাহেব ভেতরে চলে গেলেন। বললেন, এক মিনিট, আমি আসছি।
একটু পরে ফিরে এলেন হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে । টুকটাক অনেক জিনিস। তারমধ্যেই একটা মিসেস সরকারের মতো এক্সট্রার্নাল থার্মোমিটার আছে দেখলাম । খানসাহেবকে বলতেই বললেন, দেখলেন তো, এইটি দিয়েই উনি বুঝতে পারেন তার মিজো বন্ধুটি পাশে আছেন কিনা ।
খানসাহেবের কথাটা পরিষ্কার হলো না । বললাম, বুঝলাম না খানসাহেব ।
খানসাহেব হাসলেন । বললেন, এই যেমন আমরা বসে আছি আমার পাশেই একজন আত্মা বসে আছেন কিনা আপনিও জানেন না , আমিও জানি না । ঠিক তো ?
বললাম, হ্যাঁ ঠিক আবার নাও। আসলে আমি এইসব জিনিস মন থেকে মানতে পারি না ।
-- না মানার কি আছে ? যদি আপনি আত্মা আছে মানেন, আর যদি তাকে দেখতে না পান তবে আপনি কি করে নিশ্চিত হচ্ছেন এখানে আত্মা আছেন বা ওখানে আত্মা নেই , যদি না সে আপনাকে জানতে দেয়। আপনার জানার তো উপায় নেই । এটা মানেন তো ?
-- বললাম, হ্যাঁ, তা ঠিক ।
-- কিন্তু এই এক্সটার্নাল থার্মোমিটারে আপনি লক্ষ্য করবেন যদি আপনার আশে পাশে কোন আত্মা থাকে তখন তার পারদ প্রচন্ড ফ্লাকচুয়েট করবে। এই ধরুন, এই রুমের তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্রি । এখন যদি আপনার পাশে কোন আত্মা থাকে তবে তার সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাবে নয়তো কমে যাবে । কিংবা খুব দ্রুত উঠানামাও করতে পারে । আপনি ঠিক বুঝে যাবেন কেউ আছে আপনার পাশে । যারা এইসব নিয়ে চর্চা করেন, তারা এমনিতেই বুঝতে পারেন । দেখবেন হাত দিয়েই বুঝে গেছেন জায়গাটা আলাদা ভাবে ঠান্ডা বা গরম । তারা দুরে সরে গিয়ে বসবেন ।
আমার মাথা তখন পুরো ধোলাই হয়ে গেছে ।আমি শুধু কথাগুলো শুনেই চলেছি।খানসাহেব একতরফা ভাবে আমাকে বলে যাচ্ছেন ।একটা ক্যামেরা দেখিয়ে বললেন, এটাকে বলে ডিজিটাল ইনফ্রারেড ক্যামেরা বা থার্মাল ইমেজার । অন্ধকারের মধ্যেও আপনি কোন অশরীরী আত্মাকে এই ক্যামেরার মধ্যে দিয়ে দেখতে পারবেন । এটা আগামীকাল আমি আপনাকে দেব । রিহ ডিলে রাত্তিরে আপনার কাজে আসতে পারে ।
আমার মনে হলো খানসাহেবের নিশ্চয়ই ভুল হচ্ছে। তক্ষুণি শুধরে দিয়ে বললাম, আমিতো ওখানে থাকতে যাচ্ছি না খানসাহেব । আপনিই তো কাল ফাইনাল করে এলেন ।
খানসাহেব হেসে বললেন, ওটা তো মিসেস সরকারকে শোনাবার জন্য বলেছি । আগামী কাল চতুর্দশী , পরশু পূর্ণিমা । এখনই মীমতূত উৎসবের সময় । আমি ওখানে দুটো রুম বুক করেছি। একটা মিসেস সরকারের জন্য, অন্যটা একটু দুরে মুখোমুখি, আমাদের জন্য। যেখান থেকে আমরা ওনাকে লক্ষ্য করতে পারবো অথচ উনি বুঝতে পারবেন না । তাছাড়া মিসেস সরকারের রুমে আমি তিনটি সিসি ক্যামেরাও বসিয়ে দিয়েছি যাতে আমরা আমাদের নিজেদের রুম থেকে ল্যাপটপে মনিটর করতে পারি। কিন্তু মনে রাখবেন পুরো ব্যপারটা যেন জানাজানি না হয়। এমনকি মিসেস সরকার বা আপনাদের ডাকবাংলোতেও বলবেন না ।
আমার মধ্যে একটা কিন্তু কিন্তু ভাব কাজ করছে । একজন ভদ্রমহিলার অজান্তে তার রুমে ক্যামেরা বসানোটা ঠিক নয়, অন্যায়। কিন্তু কিছু করার নেই । বললাম, সে না হয় বুঝলাম কিন্তু বর্ডার গেইট ?
--ওটা আমার ব্যাপার, এই দুদিন উৎসবের সময়, গেইট এমনিতেই বন্ধই থাকে ।তাই লোক জানাজানির ভয় খুব কম ।
আমি রীতিমতো লজ্জিত, একটা লোক আমার জন্যে এত কিছু করছেন আর আমি কিনা তাকেই ভুল বুঝে চলেছি। অকপটে বললাম সেই কথা। খানসাহেব হেসে উড়িয়ে দিলেন । বললেন, প্রার্থনা করুন কাল রাতটা যেন ভালোয় ভালোয় কেটে যায় ।
রাত্রি অনেক হয়ে গিয়েছিল ।খানসাহেব গাড়িতেই পৌঁছে দিলেন । একটা দুশ্চিন্তা, সংশয় আবার একটা উত্তেজনা, কৌতুহল সব মিলিয়ে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে । এতক্ষণে মিসেস সরকার নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছেন। তবু আমার রুমে ঢুকতে গিয়ে হঠাৎই মনে হলো পাশের রুম থেকে কিরকম একটা গোঙানির আওয়াজ আসছে। ভাবলাম একবার ডেকে জিজ্ঞেস করি কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা । তারপর দরজাতে নক করতে গিয়েও কি মনে হতেই চাবি লাগানোর ফোকর দিয়ে ভিতরে চোখ রাখতেই আমি হতবাক ।বুকের ভেতরটা মুচরে উঠলো । কেমন একটা উত্তেজনা, আবার ঘৃণা সব মিলিয়ে অদ্ভুত মানসিক পরিস্থিতি । মনে হচ্ছিল আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। বেগুনি আলোয় ঘরের ভিতরে দেখলাম মিসেস সরকার একটা ফর্সা লোকের সাথে শরীরী খেলায় ব্যস্ত । ছিঃ, মনটা বিষাক্ত হয়ে গেল । মুখ দেখা যাচ্ছে না । হয়তো এই ডাকবাংলোরই কোন বেয়ারা জাতীয় কেউ হবে। নিঃশব্দে আমি আমার রুমে চলে গেলাম । মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে ।ঘুম আসছিল না চোখে ।
রিহ ডিল
আত্মা যেখানে অতৃপ্ত -৭ (অন্তিম পর্ব)
সকাল থেকেই তৈরি হয়ে বসা ।খানসাহেব এলে তবেই আমরা রওয়ানা হব। মিসেস সরকার বেশ খুশ মেজাজই আছেন । নাইট বাল্বগুলো আবার পাল্টানো হয়ে গেছে । একবার নিজে থেকেই এসে আমাকে বলে গেছেন যে উনি তৈরি । খানসাহেব এলেই উনি বেরিয়ে যেতে পারবেন ।
আমি বারান্দাতে বসে খানসাহেবের অপেক্ষা করছি। গতকাল রাতের দৃশ্যটা মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে না । অথচ এমন একটা দৃশ্য দেখলাম যা কারো সাথেই শেয়ার করা যাবে না ।অনেক চেষ্টা করেও ভুলতে পারছি না কিছুতেই । মিসেস সরকারকে খুবই স্বাভাবিক মনে হলো । অন্যদিনের মতোই সহজ সরল ব্যবহার । আমাকে শরীর ঠিক আছে কিনা। কেন গম্ভীর মুখে বসে আছি , এমনি সব নানা কথা জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু কি উত্তর দিই উনাকে। কি করে বলি যে আমি সব জানি। অথচ সকালের এই মহিলাটিকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে গতকাল রাতে তিনি এমন একটা কান্ড ঘটিয়েছেন ।
প্রায় দশটা নাগাদ খানসাহেব এলেন । নিজেই এসেছেন গাড়ি চালিয়ে । জিজ্ঞেস করলাম, আহমেদ যাচ্ছে না?
-- না না, ওকে নিলে চলবে কি করে ? আমরা তিনজনই শুধু যাচ্ছি, আর কেউ না ।
তারপর আমাকেই বললেন, একটা নাইট স্যুট চটপট প্যাক করে গাড়িতে রেখে দিন, রাতে লাগবে।
আমি মিসেস সরকার রুম থেকে বেরিয়ে আসার আগেই একটা চাদর আর রাতে পরার জন্য একটা ট্রাউজার আর টিসার্ট প্যাকেটে পুরে গাড়িতে রেখে দিলাম । মিসেস সরকার রুম থেকে বেরিয়ে এলেন একটা সুটকেস সাথে । বললাম, এত কিছু ?
-- বুঝতেই পারছেন, মেয়েদের ব্যাপার, রাত্তিরে থাকবো তো, অনেক কিছুই লাগে।
আমি আর তর্ক করলাম না ।আসলে কাল রাতের পর থেকে উনার উপর আমার ইম্প্রেশনটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে । ভালো করে কথা বলতে ইচ্ছে করে না । যতটুকু না বললেই নয় ততটুকুই বলছিলাম ।
গাড়িতে সামনের সীটে খানসাহেবের পাশে মিসেস সরকার বসলেন । আমাকে বলেছিলেন, রাজি হইনি । আমি পিছনের সীটেই বসেছি । খানসাহেব নিজে গাড়ি চালাচ্ছেন ।
গাড়ি স্টার্ট দিয়েই উনি মনে মনে প্রার্থনা করলেন কিছুক্ষণ । আজ আমিও উনার সাথে প্রার্থনা করলাম । গাড়ি চলতে শুরু করলো । রাস্তা সেই গতকালের ভেংছিয়ার পথ। অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়ে জিরো পয়েন্টে এসে গতকাল আমরা ইন্দো মায়ানমার বর্ডার রোড ছেড়ে দিয়েছিলাম । আজ আমরা ভেংছিয়ার পথে না গিয়ে সোজা এগিয়ে চলেছি । প্রাকৃতিক দৃশ্য অপূর্ব । চোখ জুড়িয়ে যায় । তবে রাস্তা ভীষণ খারাপ ।খুব সাবধানে চালাতে হচ্ছে । একদিকে পাহাড় অন্যদিকে গভীর খাদ। অনেক দুর অবধি দেখা যায়। কিছু ফটো নেবার চেষ্টা করলাম চলন্ত গাড়ি থেকে , কিন্তু লাভ নেই ।রাস্তা এত খারাপ যে ঝাঁকুনিতে ক্যামেরা ঠিক রাখা মুশকিল ।খানসাহেব দুএকটা জায়গাতে গাড়ি থামালেন বটে, কিন্তু এভাবে তো এগোনো যায় না । তাই ল্যান্স থেকে চোখ সরিয়ে খালি চোখেই উপভোগ করতে লাগলাম প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য ।
হঠাৎই রাস্তার পাশে বেশ কিছু দুরত্ব রেখে, কখনোবা জঙ্গলের ভেতর দোকানীহীন কিছু দোকান সাজানো । নানা ধরনের ফল শাকসবজি আচার থরে থরে সাজানো রয়েছে , কিন্তু আশ্চর্য কোন দোকানী নেই। খানসাহেব একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একটা পাকা পেঁপে নিলেন । দেখলাম সবগুলো জিনিসেই কলম দিয়ে দাম লেখা । খানসাহেব বললেন, এইসব দোকানকে নাকি মিজোরা এংগালো দোয়ার (Nghah low dowr) বলে । একটা হরলিক্সের বোতলে কিছু খুচরো টাকা রাখা । খানসাহেব পেঁপের দামটা ওই হরলিক্সের বোতলে রেখে দিলেন । আমাকে বললেন, একে বলে, মিজো ভাষায় পাওইসা বোমা (pawisa bawm) বা পাওইসা ধনা (pawisa dahna)।আমরা সমতলের মানুষ এই সততাটুকু কল্পনাতেও আনতে পারি না । এত এত সিসিটিভি থাকা স্বত্বেও মল, দোকান থেকে জিনিস হরদম চুরি হয়ে যায়।
রাস্তার সত্যিই হরিবল অবস্থা । আসলে কাজ চলছে । এই দুর্দশা আগামীতে হয়তো থাকবে না । প্রায় একঘন্টা কুড়ি মিনিটের লড়াইয়ের পরে গাড়ি জোখাওথার এসে থামলো।জোখাওথার হচ্ছে ইন্দো মায়ানমার বর্ডার ।ভারতীয় দিকে শেষ শহর। শহর না বলে গ্রাম বলাই ভালো । ওপাশে রিখাওদার মধ্যে তুয়াই নদী।এই নদী দিয়েই দু’দেশের সীমানা পৃথক করা। একটা লোহার ব্রীজ নদীর ওপরে দুদেশকে জুড়ে রেখেছে।
আমরা ভারতীয় বর্ডারে রিপোর্ট করে গাড়ি নিয়েই ওপাশে চলে গেলাম । মায়ানমারে সাধারণত ভারতীয় গাড়ির অনুমতি নেই, কিন্তু খানসাহেবের দৌলতে কেউই কিছু বললেন না। আমরা দিব্যি গাড়ি নিয়ে ভেতরে চলে গেলাম। আসলে নিশ্চয়ই উনি কথা বলে রেখেছিলেন তাই কোন ঝামেলা হয়নি । দেখলাম বর্ডারের দুপাশেই উনার সমান পরিচিতি। খানসাহেব মিসেস সরকারকে বললেন, ম্যাডাম, মায়ানমার কিন্তু ভারতীয় সময় থেকে একঘন্টা আগে চলে।
--তার মানে এখন আমাদের ঘড়িতে এগারোটা কুড়ি হচ্ছে ওদের হিসেবে বারোটা কুড়ি, তাই তো ? আমি কনফার্ম হওয়ার জন্যে বললাম।
-- একদমই ঠিক স্যার।
মায়ানমারে ঢুকেও আমরা মুল শহরে না গিয়ে সোজা রিহ দিলের দিকেই যাচ্ছি । ওখানে যাবার জন্যেই তো আমাদের আসা। এখানেও রাস্তা তথৈবচ। যাকে বলে উনিশ কুড়ি। আসলে হ্রদটি শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। অনেকটাই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মাঝে মাঝে জনবসতি চোখে পড়ে অবশ্যই তবে লোক চলাচল খুবই কম। প্রায় দশ মিনিট চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সামনে বিশাল খোলা মাঠ। দুরে দেখা যায় সুন্দর লকেটের মতো একটা হ্রদ, যেন সোহাগ করে পাশের পাহাড়টা তার গলায় সাজিয়ে রেখেছে। দুর থেকে দেখতে অবিকল একটা লাভ সিম্বল বা হার্ট। তার পাড়েই পাহাড়ের চূড়াতে হ্রিং লেং ত্লাঃ। ওখানেই পিয়ালরাল বা স্বর্গ। অপূর্ব, এক কথায় অপূর্ব দৃশ্য।
সোজাসুজি এগিয়ে গেলে সারি সারি বাংলো বাড়িগুলো দেখতে পাওয়া যাবে। খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো। বিয়ের মরসুমে প্রিওয়েডিং, পোস্ট ওয়েডিং সুটিংএ ব্যবহার হয়। তবে সবটাই দিনের বেলা, রাত্তিতে সব বন্ধ। পর্যটন বিভাগ থেকে অনেক ভাবে চেষ্টা নেওয়া হয়েছিল যাতে মরসুমের সময় রাত্রি বাস করা যায় কিন্তু নানা ঘটনার পর সরকার থেকেই কড়াকড়ি ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন আর রাত্তিরে থাকে না কেউ। আমি দুর থেকে পুরো লেকটার বেশ কিছু ফটো নিলাম।
খানসাহেব আমাদের সরাসরি লেকের পাড়ে নিয়ে এলেন। খুব সুন্দর জায়গা। পরিষ্কার জল। টলটল করছে। মধ্য আকাশে সূর্যের আলোতে ঢেউ গুলোতে ঝিকমিক করছে। আমরা লেকের পাড়ে ছায়ায় একটি ব্রেঞ্চে বসেছি। কাছেই রেস্তোরাঁ, বেশ বড়সড়। দুটো স্পীডবোট কিছু লোককে নিয়ে রাউন্ড দ্য লেক ট্রিপে যাচ্ছে। জনপ্রতি একশো বর্মী ক্যত। ভারতীয় এক টাকায় ১৮.৩৪ বর্মী ক্যত, কাজেই সেই হিসেবে সস্তাই বলতে হয়। অবশ্য যারা জানেন শুধু তাদের জন্যেই নইলে আপনার ভাগ্য।
খানসাহেব দেখলাম এরই মধ্যেই বেয়ারা ধরে পেঁপেটা কেটে এনেছেন। সাথে অল্প বিট নুন। লোকটা করিৎকর্মা বটে। খুব মিষ্টি পেঁপেটা। বললাম বিচিগুলো কি করলেন ? ফেলে দিলেন নাকি ?
--- বাড়িতে নিয়ে যেতে চান ? হয়ে যাবে।
আশ্চর্য মানুষ, না শব্দটি খানসাহেবের ডিকশনারিতে নেই।
খেতে খেতে আমাকে বললেন, স্যার একটা মজার ব্যাপার কি জানেন, এই জায়গাটার নাম আমরাতো সবাই জানি -- রিহ দিল, তাইতো ? অর্থ জিজ্ঞেস করলেও অনেকেই বলে দেবেন, কিন্তু এবারে যদি শব্দ দুটোর আলাদা আলাদা অর্থ জিজ্ঞেস করেন, অনেকেই দেখবেন পারবেন না।
-- কেন ? না পারার কি আছে ?
-- আছে স্যার, আছে। আমরাতো জানি দিল হচ্ছে হার্ট বা হৃদয় আর রিহ অর্থ লেক তাইতো ?
বললাম, হ্যাঁ তাইতো ।
-- কিন্তু না স্যার, মিজো ভাষায় ঠিক তার উল্টোটা। রিহ অর্থ হচ্ছে হার্ট আর দিল হচ্ছে লেক। কেমন মজার ব্যাপার বলুন ?
বললাম, বাহ সত্যিই তো বেশ মজার !
সময় কেটে যাচ্ছে অলস গল্পে। মিসেস সরকার এরই মধ্যে এক সময় উঠে একা একাই রোদের মধ্যে লেকের পাড়ে এদিক ওদিক ঘুরতে চলে গেছেন। আমিও যাব ভেবে উঠতে যাচ্ছিলাম, খানসাহেব ইশারায় আমাকে নিষেধ করলেন। বললেন, উনাকে একটু একা থাকতে দিন। প্রায় সাথে সাথেই আবার বললেন, লক্ষ্য করে দেখুন যত সময় যাচ্ছে, উনি কেমন যেন উদাস হয়ে যাচ্ছেন।
-- আমার কিন্তু রীতিমতো টেনশন হচ্ছে। আমি বললাম।
--- টেনশন হওয়া খারাপ না স্যার, কিন্তু ভয় পাবেন না যেন, মনে সাহস রাখতে হবে। ভয় পেলেই সব শেষ।
বললাম, ভয় কি কেউ ইচ্ছে করে পায় খানসাহেব, পরিস্থিতি বাধ্য করে ভয় পেতে।
--- না স্যার, ভয় সম্পূর্ণ মনের ব্যাপার, আপনি যত প্রশ্রয় দেবেন ততই ভয় মনে জাঁকিয়ে বসবে। তাই একদমই পাত্তা দেবেন না ভয়কে। মনে সাহস রাখবেন, আর বিশ্বাস রাখবেন আপনি জেনে শুনে কারো ক্ষতি করেননি, তাই আপনার সুকর্মের ফল আপনার কোন ক্ষতি হতে দেবে না।
বললাম, এত শত ভারী কথা আমি বুঝিনা বাপু, আজকের রাতটা যদি ভালো ভাবে কেটে যায় তাহলেই মুক্তি।
প্রায় আধ ঘন্টা এদিক ওদিক ঘুরে মিসেস সরকার ফিরতেই খানসাহেব উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চলুন রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসি।
বেশ জায়গা জুড়ে রেস্তোরাঁ। আমাদের ওদিকে এটাকেই ধাবা বলে। তিন দিক খোলা একটা শেড, ফুট তিনেক উঁচু বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। তার মধ্যেই চেয়ার টেবিল পাতা। গাছ গাছালির ছায়া আছে আবার পুরো লেকটা এখানে বসেই দেখা যায়।
খানসাহেব আমার ক্যামেরাটা নিয়ে টাইম পাসের জন্য ছবিগুলো দেখছিলেন, বাঃ ভালো ফটো তুলেছেন স্যার। তারপর একটু থেমে বললেন, বাড়িতে গিয়ে দেখবেন ফটোগুলো কেমন যেন ধোঁয়াটে হয়ে গেছে।
বললাম, হবে না, এটা ডিজিটেল ক্যামেরা।
-- বেশ বাড়িতে গিয়ে ফোন করবেন।
রেস্তোরাঁর বেয়ারাটা আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল। আসলে খাবারের ওর্ডার নিতে চায়। ওর্ডার দিয়ে দিতেই খুশি হয়ে চলে গেল । আমরা খাবারের অপেক্ষায় বসা।
মিসেস সরকার বললেন, এটা সত্যি স্বর্গে যাবার পথ। এতো সুন্দর এতো নিখুঁত ইচ্ছে করে এখানেই থেকে যাই।
-- পৃথিবীর সবকিছুই সুন্দর ম্যাডাম যদি আপনি দুর থেকে দেখেন, কাছে থেকে দেখলে তখন আর নিখুঁত থাকে না। দুদিনেই ভালো লাগা হাওয়ায় ভেসে যাবে।
-- উল্টোটাও হতে পারে খানসাহেব। বাইরে থেকে দেখবেন অনেক কিছুই বোঝা যায় না। তাকে বুঝতে হলে সেই দৃষ্টি দিয়ে দেখতে হয়।
খানসাহেব একটুখানি হাসলেন। বললেন, খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, চলুন শুরু করা যাক।
কারো মুখেই কোন কথা নেই।
মিসেস সরকার আবার নিজে থেকেই বললেন, এই রিহ দিল সৃষ্টির পিছনেও কিন্তু একটা গল্প আছে আপনারা জানেন নিশ্চয়ই ? খানসাহেব তো অবশ্যই জানেন, দত্তবাবু আপনি ?
বললাম, না --।
খানসাহেব সঙ্গে সঙ্গে শুধরে দিলেন। বললেন, শুধু গল্প না ম্যাডাম, বলুন করুণ একটা গল্প ।
-- ঠিক কথা, আসলে এই লোকগাঁথাগুলো কি জানেন আমার মনে হয়, এই গল্পগুলোই বারবার প্রমাণ করে যে পৃথিবীতে যে কোনো জায়গার কথা আপনি বলুন, সে যে কোন জাতির মানুষই হোক না কেন, আসলে তারা সবাই একটা জায়গাতে এসে এক। তাদের মৌলিক মান, যেমন তাদের দুঃখ কষ্ট ভালবাসা, তাদের রাগ ঘৃণা স্নেহ প্রতিহিংসা সব এক। তাদের চরিত্র নাম পাল্টে দিলেই আপনার আমার ঘরেরই আশেপাশে দেখবেন দিব্যি এই চরিত্র গুলো হেসে খেলে বেঁচে আছে। আর এখানেই লোকগাঁথাগুলোর সার্থকতা। এইজন্যই লোকগাঁথাগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী বেঁচে থাকবে আপনার আমার মনে।
বললাম, সবই বুঝলাম মিসেস সরকার, কিন্তু গল্পটা আসলে কি ?
খানসাহেব আমার কথাটা প্রায় মুখ থেকে লুফে নিয়ে বললেন, গল্পটা এমন কিছু না স্যার তবে খুব কষ্টের। আমি আপনাকে বলছি শুনুন, বলে নিজেই বলতে শুরু করলেন। বললেন, দুই বোন ছিল, খুব ছোট্ট আর মিষ্টি। কিন্তু তাদের কপালটা খুব ভালো ছিল না। অল্প বয়েসেই তাদের মা মারা যান। বাবার পক্ষেতো একা দুটো বাচ্চা মানুষ করা সম্ভব না। তখন তাদের লালনপালন করতে তাদের বাবা বাড়িতে ওদের জন্যে একটা সৎমা নিয়ে আসে। সৎমাটা খুব ভালো ছিল না। এই বাচ্চা দুটোকে খুব কষ্ট দিত, কঠিন কঠিন কাজ করতে দিত আর না পারলেই মারধর করতো। কিন্তু তাতেও সৎমায়ের রাগ কমতো না। একদিন সৎমাটা তার বরটাকে বললো, হয় তুমি আমাকে বাড়িতে রাখো নয়তো ওদের। ওই বাচ্চা দুটো থাকলে আমি আর এই বাড়িতে থাকছি না। বাবাটা তখন ভাবলো, যদি তাড়িয়ে দিই তাহলে লোকে বলবে কি ? মন্দও বলতে পারে, তারচেয়ে যদি মেরে ফেলা যায় তাহলে ওরাও মুক্তি পায় , বাড়িতেও শান্তি ফিরে আসে। সেইমতো বাবাটা একদিন ছোট মেয়েকে নিয়ে ক্ষেতে যাওয়ার বাহানায় জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে গলা কেটে মেরে ফেললো। ছোট বোন সন্ধ্যা অবধি বাড়ি না ফেরায় বড়বোনটা বুঝে গেছে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। সে একা একা ছোট বোনকে খুঁজতে খুঁজতে একসময়ে বোনের লাশটা জঙ্গলের মধ্যে দেখতে পেল। ছোটবোনের মরা শরীর কোলে নিয়ে বড় বোনটা তখন খুব কাঁদতে থাকে। আপনজন বলে তো তার আর কেউ রইলো না। ওই সময় একটা পরী ওইদিক দিয়ে যাচ্ছিল। বাচ্চাটাকে দেখে তার খুব মায়া হলো। সে তখন বড় বোনটাকে বললো, তুমি এককাজ করো, এই জঙ্গলেই একটা গাছ আছে তার একটাই শুধু পাতা, তুমি পাতাটা তোমার বোনকে ছুঁইয়ে দিলেই ও বেঁচে উঠবে।বড়বোনটা তখন জঙ্গল খুঁজে খুঁজে সেই পাতা এনে পরীর কথা মত ছুঁইয়ে দিতেই বোনটা বেঁচে উঠলো। কিন্তু বেঁচে উঠতেই তার প্রচন্ড তৃষ্ণা। বড়বোনটা তখন কি করে। আশেপাশে কোথাও জল নেই। তখন সে সেই পাতা ছুঁইয়ে নিজেকে একটা জলাশয় বানিয়ে ফেলে। ছোট বোন তৃষ্ণা পেলে এই জলাশয় থেকে জল খায় আর জঙ্গলের ফল মুল খেয়ে বড় হতে লাগলো। ওখানেই দুরে একটা নদীর মধ্যে একটা দৈত্য থাকতো । সে সবসময় ছোট বোনটাকে যন্ত্রণা দিত। আর ভয় দেখাতো যে সে যদি দৈত্যের কথা না শুনে তবে দৈত্যটা জলাশয়টাই শুষে নেবে। বড়বোনটা তখন কি করে, এখান থেকে ওখানে যায়, ওখান থেকে এখানে , নতুন করে জলাশয় হয় কিন্তু কোথাও শান্তি নেই । শেষে মিজোরাম ছেড়ে মায়ানমারের এই জায়গাতে এসে শেষমেষ স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করে। সেই থেকেই বড়বোনটার নাম অনুসারে এই হ্রদটার নাম হয় রিহ দিল। মিজোরা বিশ্বাস করে মিজোরামে যে কয়েকটি জলাশয় আছে সবকটাই এই বড়বোনের সৃষ্টি। এই হ্রদটার আরো একটা মজা কি জানেন প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা, ছয়শো মিটার চওড়া, যার গভীরতা ষাট ফুটেরও বেশি সেই বিশাল হ্রদটার সাথে কোন নদী বা ঝর্নার কোন সংযোগ নেই। বাইরে থেকে জল ঢোকারও কোন রাস্তা নেই আবার ওভার ফ্লো হয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার জন্যেও কোন নদী নেই। অথচ শীত গ্রীষ্মে একই অবস্থা। সব সময় জলে টইটুম্বুর। অবাক কথা না।
প্রায় আড়ইটে নাগাদ আস্তে আস্তে যারা এখানে বেড়াতে এসেছিলেন তারা একে একে ফিরতে শুরু করেছেন। দুই একজন অতিউৎসাহী মিজো ছেলে মেয়ে ছাড়া প্রায় সবাই চলে গেছে বা যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে । রেস্তোরাঁর মালিক নিজেও ক্যাশ গোনা শুরু করে দিয়েছেন। অল্প সময়ের মধ্যেই দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। তাকেও তো ফিরতে হবে তার গ্রামে। প্রত্যেকের মধ্যেই শেষ বেলার ব্যস্ততা। খানসাহেব বললেন, চলুন ম্যাডাম, আপনাকে আপনার রুম দেখিয়ে দিই।
আমরা উঠে দাঁড়াতেই খানসাহেব আবারও মিসেস সরকারকে বললেন, ম্যাডাম, আমি জানি না আপনি কেন এখানে রাত্তিরে থাকার জেদ করছেন, আমরা কিছুই জানিনা। তবে এটুকু বলতে পারি, এই জেদের জন্য আপনাকে কিন্তু অনেক মুল্য দিতে হতে পারে ম্যাডাম।
খানসাহেব কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারেন নি, তার আগেই মিসেস সরকার বললেন, আমি জানি খানসাহেব, আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সব জেনেই এখানে এসেছি।
-- খুব ভালো কথা। তবু বলছি, যদি আপনি ফিরে যেতে চান, আমরা সত্যিই খুব খুশি হব। আর যদি একান্তই যেতে না চান তাহলে আপনি চাইলে আমরাও আপনার সাথে থাকতে রাজি আছি। কোন বিপদ এলে অন্তত আমাদের দুজনকে আপনি পাশে পেতে পারেন।
মিসেস সরকার যেন অনেকটাই গাঙ্গুলীর মতো, যা বুঝেছেন, তার থেকে কোন নড়ন চরণ নেই। এক জায়গাতেই আটকে আছেন।
খানসাহেব এক টানে গাড়ি নিয়ে সোজা বাংলোবাড়ির বারান্দায়। সারি সারি বাংলোবাড়ি। খুব সুন্দর পরিপাটি । আলাদা আলাদা কটেজ টাইপের । প্রত্যেকটা বাড়ি ঝারপোছ করে রাখা। সামনে সাজানো সারি সারি ফুল আর পাতাবাহারের টব। অবাক লাগলো আমার। যে বাড়িগুলোতে কেউ থাকে না, রাত্রিবাস করে না তার জন্য এত যত্ন। কথাটা শুনে খানসাহেব হাসলেন। বললেন, এখানে রাত্তিরে থাকা নিষেধ স্যার, দিনে তো নয়। কত জোড়া ছেলেমেয়ে শুধু এই রুমগুলোতেই চার পাঁচ ঘণ্টা একসাথে থাকার জন্যে ছুটে ছুটে আসে, আপনার ধারণা নেই স্যার। আপনি তো জানেন মিজোরামে সেক্স একেবারে জলভাত। চাই শুধু একটা নির্জন জায়গা আর মন মত পরিবেশ।
এবারে বুঝলাম কেন এত যাগ যজ্ঞ। বললাম, তাহলে তো ভালো রোজগারও আছে।
-- আছে বৈকি ।
আমরা কথা বলতে বলতেই একজোড়া মিজো ছেলেমেয়ে একটা বাংলো বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা বাইকে চড়ে চলে গেল। খানসাহেব আমাকে দেখিয়ে বললেন, দেখলেন তো ?
যে রুমটাতে মিসেস সরকারের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে, দেখলাম অনেকটাই বড় রুম। একটা কুড়ি বাই ত্রিশ হলঘর। রুমে ঢুকেই ডানপাশে কিচেন, তার পাশেই ছোট্ট করে ডাইনিং এরেন্জমেন্ট। বাঁদিকে সোফা রাখা বসার জন্য। বড় একটা এলসিডি টিভিও আছে দেখলাম। কোনে একটা সুন্দর পরিপাটি করে বিছানা পাতা। দুটো স্ক্রীন দুপাশে ওয়ালের সাথে গুটিয়ে রাখা। টেনে দিলেই একটা বেডরুম হয়ে যায়।বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। ঘরের দেওয়াল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দুচারটে ওয়াল ফ্রেমে রিহ দিলের ছবি বাঁধানো। একটা চামরী গরুর সিং সহ মাথা দরজার সোজাসুজি পেছনের দেওয়ালে টাঙানো। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। একসাথে বেশি সময় তাকানো যায় না। পিছনেই টয়লেট এটাচ্ড। ভালো লাগলো। মিসেস সরকার নিজেও খুব খুশি। বারান্দাতে বসলে পুরো লেকটাকে দেখা যায়। বসার জন্য বেতের সুন্দর সুন্দর চেয়ার রাখা।
খানসাহেব মিসেস সরকারের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাতে কি খেতে চান ম্যাডাম ?
-- কোন কিছুরই প্রয়োজন নেই। আমার সাথে বিস্কুট, চিপস আছে। ওতেই একটা রাত কেটে যাবে। খানসাহেব গাড়ি থেকে কিছু ফল আর গোটা তিন বোতল জল এনে দিলেন। বললেন, রাতে লাগবে।
তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, চলুন এবার যাওয়া যাক, ওনাকে একটু রেস্ট নিতে দিন।
মিসেস সরকারকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়ে আমরা রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। পিছন ফিরে দেখছি, মিসেস সরকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের চলে যাওয়া লক্ষ্য করছেন।
খানসাহেবকে বললাম, কাজটা কিন্তু খুব রিস্কি হয়ে গেল।
-- তা ঠিক।
বললাম, এখনো সময় আছে, আমরা চাইলেই কিন্তু সব কিছু বাতিল করে ওনাকে নিয়ে ফিরে যেতে পারি।
-- আপনি বললেও উনি কিছুতেই রাজি হবেন না। দেখতে পারেন চেষ্টা করে ।
-- কিন্তু যদি কিছু হয়ে যায়, তখন আমাদের কি হবে ?
-- কি হবে ? আমরা যে এখানে এসেছি তার কোন প্রমাণ আছে নাকি ? কোথাও কোন এন্ট্রি করেছি ? খানসাহেব কত সহজে কথাগুলো বলে ফেললেন।
বললাম, তা না হয় নাইবা করলাম, তা বলে আপনাকে যারা এখানে সাহায্য করেছেন, তারা কি সহজে আপনাকে ছেড়ে দেবে ভেবেছেন ?
খানসাহেব হাসলেন, বললেন, ওরাতো জেনে শুনেই এন্ট্রি করে নি। ওরা জানে আজকে একটা কিছু ঘটতেই পারে।
আমি চমকে উঠলাম। কি কথাবার্তা বলছেন খানসাহেব। বললাম, কি বলছেন আপনি ? ওরা জানে তবুও পারমিশন দিল !
-- তার জন্যে খরচ করতে হয়েছে স্যার ।
বললাম, কত ?
খানসাহেব বললেন, সেটা নাহয় এখন থাক স্যার। আগে চলুন আমরা আমাদের রুমে যাই। আমরা তো চেষ্টা করছি যাতে ওনাকে ভালোয় ভালোয় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি, বাকিটা কপাল।
খানসাহেবকে যত দেখি তত অবাক লাগে। জেনেশুনে এতবড় একটা রিক্স নিলেন, অথচ মাথাটা কত ঠান্ডা। মনটা খারাপ হয়ে গেল। শুধু শুধু ঝামেলায় জড়িয়ে গেছি। খানসাহেব যতই বলুন, ঝামেলা হলে পুলিশ আমাকেও রেহাই দেবে না। মনটা অস্থির হয়ে আছে।
মিসেস সরকারের জন্য খুব খারাপ লাগছে। ভদ্রমহিলা হয়তো বুঝতে পারছেন না কতটা ঝুঁকি উনি নিয়ে নিলেন। খানসাহেব আমাকে দেখে বললেন, মন খারাপ লাগছে ?
বললাম, আপনি বুঝবেন না, আপনার সাথে তো তেমন পরিচয় নেই ----।
--- আপনার সাথে বুঝি অনেকদিনের পরিচয় ?
সত্যি তো আমারও তো দুদিনেরই পরিচয়। বললাম, তা নয়, আসলে ঝামেলা কিছু হলে আমাকেই তো বেশি জড়াবে, তাই না।
-- দেখুন স্যার, আপনাকে আগেও বলেছি একদমই ভয় পাবেন না। কি হতে পারে সেটা কল্পনা না করে, বাস্তবে কি হচ্ছে সেটা লক্ষ্য করুন। তার থেকে কি করে বেড়িয়ে আসা যায়, সেইটা না হয় ভাবুন।
কথা বলতে বলতেই আমরা ঘুরপথে আবার সেই বাংলো কমপাউন্ডে ফিরে এসেছি। খানসাহেব চটপট গাড়িটা গ্যারেজে ঢুকিয়ে দিলেন যাতে কেউ দেখতে না পায়। তারপর পিছনের দরজা দিয়ে একটা রুমের ভিতরে নিয়ে এলেন। এই রুমটাও সুন্দর। মিসেস সরকারের রুমে থেকে বেশ খানিকটা দুরে তবে সরাসরি লক্ষ্য রাখা যায়। আমাদের রুমটা আসলে মেইন গেটের পাশেই। মিসেস সরকারের মত এত ভিতরে নয়। এই কম্পাউন্ড থেকে কাউকে বেরিয়ে যেতে হলে আমাদের সামনা দিয়েই যেতে হবে।
দুজনে হাতে হাতে গাড়ি থেকে সব জিনিস পত্তর নামিয়ে রুমে এনে রাখলাম । বিকেলের চা থেকে রাতের খাবার সব কিছুই আনা হয়েছে। বললাম, এত গুছিয়ে কাজ করেন কি করে।
খানসাহেব হাসলেন। বললেন, আপনি চটপট ফ্রেস হয়ে আসুন, এখন আমাদের অনেক কাজ।
আমি মুখ হাত ধুয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে আসতে আসতেই দেখলাম ল্যাপটপে সিসি টিভি কানেকশন হয়ে গেছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মিসেস সরকার তার রুমে চেয়ারে দাঁড়িয়ে নিজে নিজেই বাল্বগুলো পাল্টাচ্ছেন। তখনও বাইরের কাপড় পাল্টানো হয়নি। ডাইনিং টেবিলটা দেওয়ালের দিকে ঠেলে দেওয়ায় হলের মধ্যিখানে খালি জায়গাটা অনেকটা বড় হয়ে গেছে।
খানসাহেব আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছেন। বললেন, এখন অবধি সব কিছুই মোটামুটি ভালো ভাবেই কাজ করছে, কিন্তু রাতে কি হবে বলা মুশকিল। তারপর আমাকে সামনে বসিয়ে সব কিছু একটা একটা করে দেখিয়ে কি করে কি করতে হয় বুঝিয়ে দিলেন। বললেন, একটা জিনিস মাথার মধ্যে গেঁথে নিন, যত বিপদই আসুক ভয় পাবেন না একদমই। এইসব ক্ষেত্রে আপনি অনেক কিছু দেখবেন মন হবে যেন সব সত্যি আসলে সবটাই চোখের ভ্রম। আপনাকে সাহস করে এগিয়ে যেতে হবে, দেখবেন কিচ্ছু হবে না। আর আমিতো আছি আপনার সাথে। আমি থাকতে আপনার কিছু হতে দেব না, এই বিশ্বাস রাখতে পারেন।
ইচ্ছে হচ্ছিল একটু বাইরে গিয়ে বসি। কিন্তু খানসাহেব একবাক্যে নাকচ করে দিলেন। বললেন, রুম থেকে একদমই বেরোবেন না । কেউ দেখে ফেললে কমপ্লেন করে দিতে পারে। দেখলাম রুমের সবকটা বাল্বই খোলা। চাইলেও আলো জ্বালানো যাবে না।
বললাম, যদি রাতে আলোর প্রয়োজন হয় ?
-- কেন মোবাইল টর্চ সবইতো আছে ।
বুঝলাম, সাবধানের মার নেই। খানসাহেবকে কি করে বোঝাই ভয়টা অন্ধকারেই বেশি করে জাঁকিয়ে বসে, আলোতে ভয় থাকে না।
মোবাইলটা চার্জে বসিয়ে দিলাম।
খানসাহেব বললেন, একটু বিশ্রাম নিন স্যার রাতে জাগতে হবে।
খানসাহেব নিজেও দেখলাম সটান হয়ে শুয়ে পড়েছেন বিছানায়।
রাস্তার ক্লান্তি, মনে অশান্তি আর নরম বিছানা, এই ত্রয়স্পর্শে জম্পেশ একটা ঘুম হয়েছে। খানসাহেব না ডাকলে হয়তো আরো কিছুক্ষণ ঘুমের সাথে মৌতান চলতো। চোখ খুলে আমি অবাক। সূর্য অস্ত চলে গেছে, তবু তার রেশটা এখনো কাটেনি। দিনের শেষ আলোয় সমস্ত আকাশটা অদ্ভুত রকমের গোলাপী লাল আর নিচে জলাশয়টা টকটকে লাল এক থালা রক্ত। বিছানা থেকে নেমে ছুটে গেলাম জানালায়। এমন অপূর্ব দৃশ্য বহুদিন দেখিনি। খানসাহেব এসে চুপচাপ আমার পাশেই দাঁড়ালেন। দুজনেই অবাক হয়ে দেখছি শেষ বিকেলের সাজ। ধীরে ধীরে আকাশটা চোখের সামনে গোলাপী থেকে হালকা নীল হয়ে ঘন কালো হতে লাগলো। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জলেরও রঙ ক্রমান্বয়ে পাল্টে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছিল ছুটে গিয়ে বাইরে মনের আনন্দে ফটো তুলি। কিন্তু আজকের দিনে সেটা সম্ভব হবে না। ক্যামেরা দুপুর বেলাতেই ব্যাগের মধ্যে তুলে রেখেছি । খুব আফসোস হচ্ছিল। খানসাহেব বললেন, এত সুন্দর সন্ধ্যা বহুদিন দেখিনি।
বললাম, আমিও।
ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে। খানসাহেব ডিসপোজেল কাপে দু কাপ চা নিয়ে এলেন, সাথে বিস্কুট। ঠিক এই মুহূর্তে মনে মনে এইটাই চাইছিলাম। যদিও লিকার চা তবুও অমৃত।
দুজনেই মুখোমুখি বসা। ঘরে অন্ধকার, বাইরেও অন্ধকার । প্রথম প্রথম অসুবিধা হলেও ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে এলো । চুপচাপ বসে আছি । ল্যাপটপে ক্যামেরা অন। খানসাহেব খুব মনোযোগ সহকারে সব লক্ষ্য রাখছেন । আমার এতটা ধৈর্য নেই, তবু বসে আছি । স্ক্রিনে শুধু ঘরের ভেতরটুকু দেখা যাচ্ছে । খালি ঘর , মিসেস সরকার ঘরে নেই, হয়তো বারান্দাতে গিয়ে বসেছেন । ক্যামেরাতে বোঝার উপায় নেই । বললাম, খালি ঘর এত কি দেখছেন ?
-- কিছুই না, শুধু একটা জিনিস বোঝার চেষ্টা করছি।
আমি কোন শব্দ করলাম না, একটু পরে নিজে থেকেই বললেন, একটা বিষয় আমার কাছে খুব অস্পষ্ট , এখনো পরিষ্কার না ----।
বললাম, কি ?
-- মিসেস সরকার এখানে কি করতে এসেছেন ?
বললাম, এটাতো আমারও প্রথম থেকেই প্রশ্ন । উনি কেন এসেছেন এখানে ? কি উদ্দেশ্য নিয়ে ?
খানসাহেব একটুখানি চুপচাপ থেকে নিজেই উত্তর দিলেন। বললেন, দেখা যাক, সময়ে বোঝা যাবে ।
আবারো চুপচাপ । আমাকে কিছু চিপসের প্যাকেট দিয়ে বললেন, টাইম পাস করুন ।
বললাম, এধরনের পরিস্থিতি আগে কখনো পেয়েছেন ?
খানসাহেব বললেন, বেশ কয়েকবার ।
-- এখানে ?
-- না --।
--তবে ?
-- অন্য জায়গাতে । কথাগুলোর উত্তর দিচ্ছিলেন যেন ঠিক যতটা প্রয়োজন ততটাই। মনে হচ্ছিল খানসাহেব এখানে যদিও বসা তার মনটা এখানে নেই।
বুঝলাম পুরোনো প্রসঙ্গে খানসাহেব এই মুহূর্তে বেশি কথা বলতে চাইছেন না। তবু মরিয়া হয়ে আমি শেষ বারের মতো খানসাহেবকে প্রশ্ন করলাম। বললাম, মিজোরা যে বিশ্বাস করে এখানে আত্মারা আসা যাওয়া করে , কথাটা কি সত্যি ?
প্রশ্নটা আমি খুব হালকা ভাবেই করেছি ।জাস্ট সময় কাটানোর জন্য ।
আর ঠিক তখনই খানসাহেব আমার উড়ুতে চাপ দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, চুপ একদম কথা না ।
আমি অবাক । হঠাৎই কি হলো ? ল্যাপটপের স্ক্রিনে নতুন কিছুইতো দেখা যাচ্ছেনা --, মিসেস সরকারের ঘরটা তখনও জনশূন্য। কারো আসা যাওয়ার চিহ্ন নেই। চোখে পড়ার মত অস্বাভাবিক কোন কিছুই তো ঘটলো না তবু খানসাহেব আমাকে কথা বলতে নিষেধ করলেন । আমি চুপ করে গেলাম । আর ঠিক তখনই খানসাহেব আবারও ফিসফিস করে বললেন, একটা জিনিস দেখতে চান ?
বললাম, কি?
-- যে জিনিসটা দেখতে এসেছেন এখানে --। কিন্তু তার আগে মন শক্ত করতে হবে, একদম ভয় পেলে চলবে না । চিৎকার করতে পারবেন না ।
বললাম, বেশ ঠিক আছে । আমার ধারণা ছিল খানসাহেব আমাকে ল্যাপটপের মধ্যে মিসেস সরকারের রুমের কিছু একটা দেখাতে চাইছেন। তাই রাজি হয়ে গেলাম। একটা প্রচন্ড কৌতুহল আমার মধ্যে কাজ করছে।
খানসাহেব একটুখানি ভাবলেন, তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি কিছু অনুভব করছেন ?
বললাম, নাঃ --।
-- গরম, ঠান্ডা, শীত, কোন কিছু ?
বললাম, হ্যাঁ একটু গরম লাগছে ।
-- একদম ঠিক, তার মানেই বুঝতে হবে আমাদের আশেপাশে কেউ আছে ।
বললাম, কে ?
-- কে আবার ? ওরা ! আবারো ফিসফিসিয়ে বললেন ।
আমি হতভম্ব, কি বলছেন খানসাহেব ।
খানসাহেব ততক্ষণে তার ব্যাগ থেকে এক্সটার্নাল থার্মোমিটার নিয়ে এসেছেন । তারপর ওটাকে অন্ধকারের মধ্যেই এদিকে ওদিকে নিয়ে গিয়ে কি একটা যেন খুঁজে বেড়াতে লাগলেন । তারপর আমার পাশে এসেই একঝটকায় টেনে নিয়ে চাপা স্বরে বললেন, পেয়ে গেছি ।
বললাম, কি ?
-- চুপ আস্তে, তারপর থার্মোমিটার দেখিয়ে বললেন, দেখতে পাচ্ছেন , এখানটায় দেখুন টেম্পারেচার কি অস্বাভাবিক ভাবে ফ্লাকচুয়েট করছে , দেখতে পাচ্ছেন ?
বললাম, পাচ্ছি ।
-- তার মানেই বুঝে নিন।
আমার তখন গলা শুকিয়ে কাঠ । কি সব কথাবার্তা বলছেন খানসাহেব। একটা অজানা আতংকে বুক কাঁপছে । খানসাহেব ততক্ষণে আমার ঘাড়ের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন, দেখতে চান ?
বললাম, না ---।
--আপনাকে দেখতে হবে ।
বললাম, না আমি দেখবো না, আমার ভয় করছে ।
--আমি বলছি আপনাকে দেখতেই হবে । খানসাহেবের গলায় সাপের হিসহিস শব্দ । আমি আশ্চর্য, হতবাক, ভয় পেয়ে গেলাম ।খানসাহেব কখনো আমার সাথে এমন ব্যবহার করতে পারেন আমি স্বপ্নেও ভাবিনি । এই খানসাহেবটিকে আমি চিনি না । উনি আমাকে চোখ বন্ধ করতে বললেন। আমি আপত্তি করতেই ধমক দিলেন আমাকে। আমি অনেকটাই বাধ্য হয়ে ওনার কথা মত চোখ বন্ধ করলাম। প্রচন্ড ভয় করছিল। উনি আমার চোখে একটা থার্মাল ইমেজার মানে ডিজিটাল ইনফ্রারেড ক্যামেরা ফিট করে বললেন এবার তাকান।
ঘরটা অন্ধকার, তার মধ্যেও দেখলাম ঘরের প্রত্যেকটা জিনিস পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ।
খানসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কিছু দেখতে পারছেন ?
ভয়ে ভয়ে বললাম, হ্যাঁ পাচ্ছি -।
-- কি ?
বললাম, সব ।
-- এবারে আস্তে আস্তে ঘুরে ঘুরে পুরো ঘরটা দেখুন ।
আমি সেইমত ধীরে ধীরে ঘুরে ঘুরে দেখছি ।
খানসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কি দেখতে পাচ্ছেন ?
বললাম, বিছানা, চেয়ার --।
-- তারপর ?
--- ল্যাপটপ --।
---তারপর ?
-- এবারে আপনাকে ।
--- বেশ, আরো একটু ওপাশে তাকান --। কিছু দেখতে পাচ্ছেন ?
--- না ---।
আর ঠিক তখনই আমার ক্যামেরায় আমি দেখতে পেলাম একটা লোক ঠিক আমাদের পাশে দাঁড়ানো, একদম আমার গায়ে ঘেঁষে । আমি চিৎকার করে ছিটকে সরে যাচ্ছিলাম, তার আগেই খানসাহেব জোরে আমার মুখটা চেপে ধরলেন যাতে শব্দ না বেরোতে পারে । ভাগ্যিস ক্যামেরাটা ব্যাল্ট দিয়ে মাথার সাথে বাঁধা ছিল, নইলে তক্ষুণি পড়ে ভেঙ্গে যেত। আমার ভয় পেয়ে কাপড় চোপড় নষ্ট হবার অবস্থা । মুখ দিয়ে তখন শুধু একটা গোঙানির মত আওয়াজ বের হচ্ছে । চোখ স্থির হয়ে গেছে সেই লোকটার উপর। একটা লোক যার শরীরটা ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না, চেহারাটা অস্পষ্ট, অথচ তার উপস্থিতিটা সুস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি । শুধুমাত্র খানসাহেব ধরে থাকায় আমি মাটিতে পড়ে যাইনি। স্পষ্ট দেখলাম লোকটা আমার পাশ থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে সোফাতে গিয়ে বসছে। তারপর কিছুক্ষণ ওখানে বসে থেকে আবার ধীরে ধীরে ঘরে থেকে বেরিয়ে গেল । আমি শ্বাস বন্ধ করে সবটাই দেখছি।
শরীরটা অবশ হয়ে গেছে, ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি। গলা দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না। একদমই শক্তি পাচ্ছি না। খানসাহেব আমাকে জোর করে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি এক কাপ লিকার চা এনে দিলেন। বললেন, নিন, এইটা খেলে ভালো লাগবে। আমার তখন প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই। ধীরে ধীরে শরীরটা একটু ঠিক হতেই বললাম, চলুন, এখানে আর এক মুহূর্তও থাকতে চাই না।
খানসাহেব হাসলেন। বললেন, কোথায় যেতে চান ?
-- যেখানে খুশি, কিন্তু এখানে আর এক মুহূর্তও থাকবো না।
-- কিন্তু আপনি যেতে চাইলেও যে যেতে পারবেন না স্যার। আজকের রাতটা আমাদের এখানেই থাকতে হবে।
-- আপনি যেতে না চাইলে আমি একা চলে যেতে বাধ্য হব।
-- বেশ তো চেষ্টা করে দেখুন। খানসাহেবের গলায় নিরুত্তাপ।
মুখে বললাম বটে, কিন্তু একা যাবার সাহস আমার বিন্দুমাত্র নেই। অগত্যা চুপচাপ বসে আছি।
একটু পরে খানসাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, শরীর কেমন লাগছে ?
বললাম, ভালো
-- ভয় কাটলো ?
-- জানি না। আমি বললাম।
--- একটা জিনিস বোঝার চেষ্টা করুন, এই যে আপনি দেখতে পেলেন, আপনাকে কি আত্মাটা একটিবারের জন্যও ভয় দেখিয়েছে ?
বললাম, না।
--- আপনি ওকে বিরক্ত না করলে আপনাকেও তারা বিরক্ত করবে না।
তারপর একটু থেমে বললেন, আসলে ওরা সত্যি সত্যিই একটু শান্তিপ্রিয়। একটু নির্জনে নিরিবিলিতে থাকতে ভালবাসে। আপনি যতক্ষন না ওকে যন্ত্রণা দিচ্ছেন, ওকে ক্ষেপিয়ে তুলছেন, ততক্ষণ অবধি সেও আপনাকে বিরক্ত করবে না। তবে কিছু খারাপ আত্মা আছে, তারা মানুষ জন্মেও প্রচন্ড বদ ছিল , একমাত্র তারাই শুধু আপনাকে বিনা কারণে বিরক্ত করতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে এইসব আত্মাদের সংখ্যা জানবেন খুবই কম।
বললাম, এত কিছু বুঝতে চাই না বাপু। আমার একটাই কথা এখানে আর আমার একদমই ভালো লাগছে না।
খানসাহেব আমার মাথা থেকে ক্যামেরাটা খুলে রেখে দিলেন। বললেন, আপনাকে আমি না দেখালেও পারতাম। কিন্তু দেখিয়েছি ইচ্ছে করে , কেন জানেন ?
বললাম, না।
-- আপনার যাতে ভয়টা কেটে যায়। আপনি কি ভাবেন, মৃত্যু ভয় শুধু আপনার আছে, আমার নেই ? আপনাকে তো তবু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমার কি ? আমি তো শুধু আপনার জন্য এখানে এসেছি । কিন্তু আপনি যে এতটা ছেলে মানুষি করবেন আমার ধারণা ছিল না।
খানসাহেব কথাগুলো এমন কাঁটা কাঁটা বললেন, মনে লাগতে বাধ্য। লজ্জা পেলাম। সত্যি তো শুধু শুধু আমার জন্যে আজ এই লোকটাও এখানে ফেঁসে গেছে।
কাছে গিয়ে বললাম, স্যরি ।
খানসাহেব হাসলেন। বললেন, মনটাকে শক্ত রাখুন স্যার, কিচ্ছু হবে না আমাদের।
বললাম, সারারাত কি আমাকে এই নিয়েই কাটাতে হবে ?
-- এখন অবধি তো তাই মনে হচ্ছে।
বললাম, কিন্তু ওই আত্মাটা তো চলে গেছে। এখন তো আর কেউ নেই।
-- আছে । আমাদের আসে পাশে সামনের ওই মাঠে, যে কোন জায়গাতেই থাকতেই পারে ।
-- আমি আবার দেখতে চাই ।
খানসাহেব হাসলেন। তারপর আবার থার্মাল ইমেজারটা আমার চোখে বেঁধে দিলেন। আমি আস্তে আস্তে পুরো ঘরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। না, এখন আর আমাদের ঘরের মধ্যে কিচ্ছু নেই। তারপর ধীরে ধীরে মাঠের দিকে তাকাতেই আমি অবাক। অনেকগুলো জোনাকি পোকার মতো বেশ কিছু অশরীরী আত্মা এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষের মতোই উচ্চতা, মাথাটা শুধু জোনাকির মতো জ্বলজ্বল করছে। শরীরটা হালকা তূলার মত পাতলা ধোঁয়াটে। গঠন দেখে বোঝা যায় ছেলে নাকি মেয়ে। পোষাক আষাকের বালাই নেই, থাকলে নিশ্চয়ই বোঝা যেত, কিন্তু তাই নিয়ে ওদের কোন মাথাব্যথা নেই। দিব্যি এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি অবাক হয়ে দেখছি। এখন আমার অনেকটাই ভয় কেটে গেছে। একটা অশরীরী আত্মাকে দেখালাম ঠিক আমার দিকে এগিয়ে আসছে । আমি সতর্ক হয়ে গেলাম। কিন্তু শেষ অবধি এসে আমার পাশের ঘরেই ঢুকে গেল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
খানসাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি ? আছে ?
আমি বললাম, অনেক ।
এখন আমার অনেকটাই সাহস এসে গেছে। খানসাহেবর পাশে গিয়ে বসলাম। ল্যাপটপে দেখলাম মিসেস সরকার রাতের খাবার টেবিলে সাজাচ্ছেন। বললাম, কটা বাজে। খানসাহেব বললেন, ন'টা চল্লিশ।
দেখতে দেখতে অনেক রাত হয়ে গেছে। বাইরে তখন ফুটফুটে জ্যোৎস্না। লেকটাকে একটা মায়াবী জলাশয় লাগছে। শান্ত, স্থির আবার একটা প্রবল আকর্ষণ। বেশিক্ষণ তাকালে মনে হয় সেই লেক থেকে কেউ যেন আমাকে বারবার ডাকছে। বলছে আয়, আমার বুকে আয়, একবার দেখে যা কত শান্তি লুকিয়ে রেখেছি আমার সারা বুকটা জুড়ে, আয় তোকেও দেবো। দেখবি সব কষ্ট দুর হয়ে যাবে। একবার শুধু আয়।
খানসাহেব বললেন, আমরাও কিন্তু এইবার খেয়ে নিতে পারি।
দুজনে দুটো আপেল আর কিছু বিস্কুট নিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসে আছি। দেখলাম মিসেস সরকার একসেট কাপড় নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন। একটু পরেই যখন ফিরে এলেন, বুঝলাম স্নান হয়ে গেছে। চুল থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। একটা বাক্স থেকে রঙিন গুড়া জাতীয় কিছু দিয়ে ঘরের ঠিক মধ্যেখানে একটা বিশাল বৃত্ত আঁকলেন। তারপর সেই বৃত্তের পরিধিতে ছয়টা বিন্দু নিয়ে দুটো ত্রিভুজ আঁকলেন। একটা ঠিক অন্যটির উপর আড়াআড়ি করে আঁকা।
আমি আর খানসাহেব খাওয়া ভুলে টানটান হয়ে দেখছি।
খানসাহেব আপন মনেই বললেন, ম্যাডামের দেখছি প্রেতশাস্ত্রে অল্প হলেও চর্চা আছে। কি সাংঘাতিক।
আমি বাকরুদ্ধ।
ওদিকে মিসেস সরকার তখন ওই ছয়টা বিন্দুতে ছয়টা বড় মোমবাতি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। ঠিক মধ্যেখানে দুটো আসন মুখোমুখি পাতা। মিসেস সরকার দুই প্লেট খাবার দুটো আসনের ঠিক সামনে এনে রাখলেন সাথে জল। একটা ছোট লাঠির একপ্রান্তে একটা হাতার মতো বানানো। লাঠিটা টেনে টেনে অনেকটাই লম্বা করা যায়। এবারে সেই লাঠিটাকে এমনভাবে রাখলেন যাতে আসনে বসে দরজা ছোঁয়া যায়। আমরা অবাক হয়ে কান্ড কারখানা দেখছি।
মিসেস সরকারকে দেখলাম সেই গুড়োর প্যাকেট হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ঘরের বাইরের দিকটা সিসি টিভি কভারেজে আসে না। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম।
অল্প পরেই মিসেস সরকার ফিরে এলেন। মনে হলো তিনি সারাঘর ঘিরে গুড়ো পাউডারটা ছড়িয়ে এসেছেন, শুধু দরজাটা খোলা। এবারে দরজার দিকে সেই লাঠির মাথায় যে হাতার মতো অংশটা তাতেও কিছু পাউডার রেখে দিলেন।
দরজা খোলা। মিসেস সরকার একটা পুরনো বই সাথে আরো কিছু টুকিটাকি জিনিস, যা ক্যামেরায় স্পষ্ট বোঝা যায় না আর একটা এক্সটার্নাল থার্মোমিটার এনে আসনের পাশে রেখে ঘরের সমস্ত আলো নিভিয়ে দিলেন।
আমাদের ল্যাপটপ ডার্ক হয়ে গেছে। কিছুই দেখতে পারছি না।
খানসাহেব কে বললাম, এবার ? এবার কি হবে ?
খানসাহেবকেও খুব চিন্তিত মনে হলো। বললেন, দাঁড়ান দেখা যাক, নইলে যেতে হবে।
একটা অজানা ভয় আর উত্তেজনায় শরীর মন একদমই টগবগ হয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে একটা প্রচন্ড অস্থিরতা। কি হয় কি হয় ভাব।
একটু পরেই লক্ষ্য করলাম একটা একটা করে মোমবাতি জ্বলে উঠছে। মিসেস সরকার তার আসনে বসা, শরীরে একটা সুতোও নেই । একঝলক দেখেই আমার শরীরটা শিরশির করে উঠলো। তাকানো যাচ্ছিল না। একজন মহিলাকে না জানিয়ে তার নগ্ন শরীর এভাবে দেখা অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ , অমার্জনীয়। পাশে খানসাহেব থাকায় আরো বেশি অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। উঠে যাচ্ছিলাম, খানসাহেব হাত ধরে টেনে বললেন, কি করছেন ? চুপ করে বসুন।
বললাম, আমার এসব ভালো লাগছে না।
খানসাহেব একদৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,স্যার, মনটাকে পরিষ্কার রাখুন, ওখানে তন্ত্র সাধনা চলছে, কোন ঠাট্টা তামাশা নয়। বুঝতে চেষ্টা করুন। মনে পাপ থাকলে এইসব দেখাও উচিত না। মন থেকে পাপ সরিয়ে ফেলুন।
বললাম, আমি তো মানুষ, সাধক নই ।
-- তাতে কি ? এখানে আপনি এসেছেন উনাকে সুস্থভাবে জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তার জন্যে আপনাকে যা করতে হয়, তাই করতে হবে।
চুপচাপ নিজের জায়গাতে বসে পড়লাম। উপায় নেই।
ওদিকে মিসেস সরকার আসনে বসা । সামনের আসনটা তখনো খালি। একটা ছোট্ট ফোল্ডিং টুলে সেই পুরনো পুঁথিটা খোলা। ঠিক তার পাশেই আরো একটা মোমবাতি জ্বালানো। একটা জেন্টস রুমাল দিয়ে মোমবাতিটিকে পেঁচানো।পাশেই একটা ধারালো ছুরি চকচক করছে। মিসেস সরকার ছুরিটা হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে কি সব পুঁথি থেকে পড়ছেন। হঠাৎই আমাদেরকে চমকে দিয়ে ওই ছুরিটা দিয়ে নিজের আঙ্গুলটা কেটে দিলেন। ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে। মিসেস সরকার তার কাটা আঙ্গুলটা এমনভাবে মোমবাতির উপর রাখলেন যাতে প্রত্যেকটা ফোঁটা রক্ত মোমবাতির ঠিক আগুনের মধ্যেই গিয়ে পড়ে। প্রত্যেক ফোঁটা রক্ত পড়ার সাথে সাথেই মোমবাতির আলো যেন আরো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। আমি শ্বাস বন্ধ করে পলক হীন চোখে দেখছি। আস্তে আস্তে মিসেস সরকারের ঘরে পরিবেশ অস্বাভাবিক হতে শুরু করলো। হঠাৎই বন্ধ জানালগুলো নিজে থেকেই জোরে জোরে খুলে গেল। সমস্ত ঘরের মধ্যে তুফানের মতো বাতাস বইছে। আমি শক্ত করে খানসাহেবের হাতটা চেপে ধরলাম। খানসাহেবের মুখেও কোন শব্দ নেই। থমথমে পরিবেশ। মিসেস সরকারের রুমের দরজা জানালাগুলো প্রচন্ড জোরে জোরে খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে। যেন যে কোন মুহুর্তে ভেঙ্গে যেতে পারে। আমার সমস্ত হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ওদিকে মিসেস সরকার নির্বিকার। স্থির হয়ে মন্ত্র পড়ে যাচ্ছেন আর বারবার হাত কেটে রক্তের ফোঁটা আগুনে ফেলছেন।
দমবন্ধ করা পরিবেশ । হঠাৎই সমস্ত তুফানী বাতাস মুহূর্তে থেমে গেল। দরজা জানালা গুলো স্থির, আর কাঁপছে না। মোট সাতটি মোমবাতির মধ্যে ছয়টা মোমবাতি বিনা বাতাসে একসাথে নিভে গেল। মিসেস সরকার সঙ্গে সঙ্গে আসন ছেড়ে উঠে এক্সটার্নাল থার্মোমিটার দিয়ে সমস্ত ঘরময় পায়চারী করতে লাগলেন। তারপরে হঠাৎ ছুটে গিয়ে ঘরের বেগুনী আলোগুলো জ্বালিয়ে দিলেন। আবছা আলোয় আমরা দুজনেই স্পষ্ট দেখলাম ঘরের মধ্যে একটা লোক। একটা পুরুষের আকৃতি। মিসেস সরকার তাকে যত্ন করে হাতে ধরে এনে বসালেন সামনের খালি আসনটাতে। তারপর একটা একটা করে খাবার খাইয়ে দিতে লাগলেন সেই আত্মাটাকে। আমরা অবাক হয়ে দেখছি। সময় কেটে যাচ্ছে। খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে কাজগুলো। একসময়ে খাওয়া শেষ হলো । মিসেস সরকার সামনের থেকে থালাদুটো সরিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে আত্মাটাকে নিজের বুকে টেনে নিলেন। তারপর ধীরে ধীরে ওর ঘাড়ে মুখে ঠোঁটে ক্রমাগত আদর করতে লাগলেন। পিন পড়া নীরবতা। আর তারই এক ফাঁকে মিসেস সরকার সেই আত্মাটাকে লুকিয়ে লাঠি দিয়ে সমস্ত দরজায় মন্ত্র পড়া পাউডার গুড়া ছিটিয়ে দিলেন।
খানসাহেব সমস্ত নীরবতা ভেঙ্গে লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেছে।
আঁতকে উঠে বললাম, কি ?
--- দেখলেন না মিসেস সরকার আত্মাটাকে বন্দী করে ফেলেছন ।
বললাম, তার মানে ?
--- মানে আবার কি ? আজকের দিনটি ছিল মিথিখুয়াতে যাবার শেষ দিন। আজকেই তো চলছে মীমতূত উৎসব তাই না ? এখন যদি সে যেতে না পারে তাহলে ভেবে দেখুন তার কত ব্যাপক সর্বনাশ হয়ে গেল । যতদিন না মিসেস সরকারের মৃত্যু হয় ততদিন যে তার আর মুক্তি নেই।
-- তাহলে এখন কি হবে ?
-- কি হতে পারে আমিও জানি না। তবে এইটুকু বলতে পারি এই ভদ্রমহিলা কিন্তু খুব একটা সাধারণ মহিলা নন।
মিসেস সরকারের রুমে তখন অন্য পরিবেশ । মিসেস সরকার তখন ধীরে ধীরে একটু একটু করে সেই অশরীরী আত্মাকে আদর করতে করতে উত্যক্ত করছেন। ক্রমে ক্রমে সেই আত্মা মিসেস সরকারের সঙ্গে আদিম ক্রীড়ায় লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। রীতিমতো পর্নোগ্রাফি। একসাথে বসে দেখা যায় না। অন্তত আমি পারছিলাম না। ছিটকে উঠে পড়লাম চেয়ার ছেড়ে। বললাম, ছিঃ মানুষ এত নীচে নামতে পারে কখনো ভাবিনি।
-- ভুল ভাবছেন । একদমই ভুল।
-- কিসের ভুল মশাই ? চোখের সামনে নোংরামি দেখছি তারপরও আপনি সাফাই গাইছেন ?
-- কোনটা নোঃরামি ? কোনটাকে আপনি নোংরামি বলতে চাইছেন ? একজন মহিলা একজন পুরুষকে ভালবাসে তার মৃত্যুর পরও তাকে ছাড়তে চাইছে না , আপনি তার মধ্যে নোংরামি দেখছেন ? তার ভালবাসাটা আপনার নজরে পড়েছ না ? খানসাহেব রীতিমতো রেগে উঠেছেন।
বললাম, স্বামী মারা যাওয়ার পর একটা পরপুরুষের সাথে এতদিন চলছিল কেচ্ছা আর তার আত্মাকে নিয়ে চলছে লীলা খেলা, আপনি বলছেন নোংরামি নয়, ছিঃ ।
খানসাহেব আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর কেটে বললেন, আগে কি হয়েছে আমি সেই প্রসঙ্গে যেতে চাই না স্যার, শুধু এইটুকু বোঝার চেষ্টা করুন, যে এখন যা চলছে সেটা নোংরামি না। যদি শরীর না থাকে তবে কিসের শরীরী খেলা । এখানে কিসের নোংরামি ? এইটা তো কোন শরীরী খেলা নয়, আত্মার সাথে আত্মার মিলন চলেছে। ভালো করে বোঝার চেষ্টা করুন, তাহলে আর খারাপ লাগবে না আপনার।
আমরা ল্যাপটপ ছেড়ে নিজেদের মধ্যে তর্কে মেতে উঠেছিলাম। হঠাৎই স্ক্রীনের দিকে নজর পরতেই খানসাহেব স্থির হয়ে গেলেন। বললেন, একদম কথা না, প্লিজ।
মিসেস সরকারের রুমে তখন সেই অশরীরী আত্মাটা ধীরে ধীরে মিসেস সরকারকে ছেড়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । মিসেস সরকার মাটিতে শোয়া, মুখে তৃপ্তির হাসি।
আত্মাটাও মনের তৃপ্তিতে এগিয়ে এসে দরজার চৌকাঠে পা দিতেই সমস্ত চৌকাঠ জুড়ে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। আত্মাটা চমকে উঠে ঘরের মধ্যে ছিটকে গিয়ে পড়ল। নিমেষে বুঝে গেছে সে বন্দী হয়ে গেছে। তার আর মুক্তি নেই। একটা যন্ত্রণায় ছটফট করছে আত্মাটা। নানা ভাবে আকুতি মিনতি করছে, জনলা, দরজা যে দিকেই বেরোতে চায় সেই দিকেই আগুন। একসময়ে আত্মাটা ক্ষেপে ওঠে । ঘরের মধ্যে জিনিসপত্র ছুড়তে থাকে। আর তখনই একটা অঘটন ঘটে যায়। একটা ফটোফ্রেম উড়ে এসে মোমবাতিতে পড়তেই মোমবাতিটা পুরোনো পুঁথিটার উপরে পড়ে গিয়ে আগুন লেগে যায়। আসল অঘটন ঠিক তখনই ঘটে। পুঁথিটা জ্বলে যাওয়ার সাথে সাথেই মিসেস সরকারের ক্ষমতা শেষ। আত্মাটা নিমেষে ছুটে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। এবার আর আগুন জ্বলছে না দরজাতে । মুক্ত হয়ে গেছে আত্মাটা।
মিসেস সরকার অনেক চেষ্টা করেও পুঁথিটা বাঁচাতে পারলেন না। চুপচাপ বসে আছেন। দুই চোখ বেয়ে জল পড়ছে।
আমরা স্থবির হয়ে দেখছি।
হঠাৎই সেই আত্মাটা আবার ফিরে এলো। এবার তার রুদ্রমূর্তি। তুফানের মতো ঘরে ঢুকেই মিসেস সরকারকে লক্ষ্য করে চেয়ার টেবিল ছুড়ে ছুড়ে মারছে। মিসেস সরকার নিজেকে বাঁচাতে খাটের নিচে আশ্রয় নিচ্ছেন কিন্তু তাতেও রক্ষা নাই।
খানসাহেব এক লাফে উঠে দাঁড়ালেন। চটপট চোখে ডিজিটাল ইমেজার লাগিয়ে চার পাঁচ বোতল জল একটা ব্যাগের মধ্যে নিয়ে প্রত্যেকটা বোতলের ভিতর দু-তিন ফোঁটা করে সেই সাধুবাবার জল মিশিয়ে দিলেন। বললেন, চলুন। মনে রাখবেন আত্মা আপনাকে ভয় দেখাবে। আপনি কিন্তু ভয় পাবেন না। শুধু আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকুন। আমার বেভকভারটা ছিড়ে দুজনের কোমর বেঁধে নিলাম যাতে কেউ ছিটকে যেতে না পারি।
ঘর থেকে সবে বেরিয়েছি শুরু হলো তুফান আর বালির ঝড়। খানসাহেব আমাকে চিৎকার করে বললেন, ভয় পাবেন না স্যার, এগুলো সব মায়া।
, ভয় দেখাচ্ছে। আর ঠিক তখনই একটা বিশাল গাছ চোখের নিমেষে আমাদের সামনে ভেঙ্গে পড়লো। একটু হলেই খানসাহেব গাছের তলায় চাপা পড়তেন। আমি হ্যাচকা টান দিতেই উনি ছিটকে গিয়ে পড়লেন। মনে মনে ভাবছি জোর বেঁচে গেলাম। আর তক্ষুণি গালে বিরাশি দশ আনার চড়। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছি। পাশের থেকে খানসাহেব রাগে গজগজ করে বলতে লাগলেন, একশো বার বলেছি এগুলো সব মায়া, ভয় দেখাচ্ছে, কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না।
বুঝলাম চড়টা উনিই মেরেছেন। ততক্ষণে দুজনেই উঠে দাঁড়িয়েছি।
একটা প্রচন্ড জোরে বাতাস আমাদের এগুতে দিচ্ছে না। আমরা চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই এগুতে পারছি না। আমি খানসাহেবকে চিৎকার করে বললাম, একটু জল ছিটিয়ে দিন।
খানসাহেব বললেন, অসম্ভব । এটা ওদের নিজস্ব চলাচলের জায়গা । আমরা ওদের পথ আটকে দিতে পারি না।
আমি বললাম, তাহলে আমাদের গায়ে ছিটিয়ে দিন ।
খানসাহেব সঙ্গে সঙ্গে তাই করলেন । মন্ত্রের মতো কাজ হলো। আমরা দুজন এগিয়ে চলেছি । তুফান তখনও চলছে কিন্তু আমাদের এগিয়ে যেতে অসুবিধা হচ্ছে না । এবারে শুরু হলো পাথরের বৃষ্টি । শিলের মতো আকাশ থেকে এলোপাথাড়ি পাথর বৃষ্টি হচ্ছে, প্রচন্ড শব্দ । কানে তালা লেগে যাওয়ার মতন। এতক্ষণে আমিও বুঝে গেছি।আমাদের আশেপাশেই ছিটকে পড়ছে পাথর কিন্তু একটাও গায়ে এসে লাগছে না । আমি ভয়কে জয় করে নিয়েছি। দুজনে এগিয়ে চলেছি মিসেস সরকারের রুমের দিকে।
এদিকে মিসেস সরকারের অবস্থা ততক্ষণে করুণ। আত্মাটা ওনাকে এই দেওয়াল থেকে ওই দেওয়ালে ছুড়ে ছুড়ে থেঁতলে দিচ্ছে । মিসেস সরকার যন্ত্রণাতে চিৎকার করছেন । আত্মাটা তার শরীরটাকে একটা জায়গাতে স্থির হতে দিচ্ছে না । খানসাহেব দরজাতে দাঁড়িয়ে নানাভাবে জল ছিটানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু কাজ হচ্ছে না । পাঁচ বোতলের মধ্যে তিন বোতল ইতিমধ্যেই শেষ । আর মাত্র দুই বোতল বাকি। আমি খানসাহেবকে বললাম, এভাবে হবে না আমাকে দিন।
খানসাহেব এবারে ভয় পেয়ে গেছেন । দেখছেন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না । বললেন, কি করতে চান ?
বললাম, দেখি কি করা যায়, আপনি আমাকে এক বোতল জল দিন ।
খানসাহেব রাজি হয়ে গেলেন । আমাকে একবোতল জল দিয়ে বললেন, একটা বোতল আমার কাছে থাক । আমি বরং আরো কয়েক বোতল জল নিয়ে আসছি, ততক্ষণ আপনি একটু লক্ষ্য রাখুন ।
খানসাহেব চলে গেলেন । আমি একা। কিছু একটা করতে হবে এই দরজাতে দাঁড়িয়ে জল ছিটালে কিছুই হবে না । আমি বোতলটার মুখ আঙ্গুল দিয়ে চেপে ফোঁটা ফোঁটা ছিটিয়ে ঘরের ভিতর চলে গেলাম । মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত শক্তি কাজ করেছে, আমাকে পারতে হবে । ভয় পেলে চলবে না । পা টিপে টিপে মিসেস সরকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি । নিজের চারদিকে সেই মন্ত্র পড়া জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে এগোতে হচ্ছে । মনে মনে ইষ্ট স্মরণ করছি । হে ঈশ্বর আমাকে শক্তি দাও।আমাকে পারতে হবে ।
আমি ক্রমে ক্রমে মিসেস সরকারের খুবই কাছে চলে এসেছি । এখান থেকেই আমি ইচ্ছে করলে মিসেস সরকারের গায়ে জল ছিটিয়ে দিতে পারি কিন্তু তার শরীরটা যে একটা মুহূর্তের জন্য স্থির হচ্ছে না । জল মাটিতে পড়ে নষ্টও হতে পারে । আমি তাই সোজাসুজি শরীরে না দিয়ে ধীরে ধীরে চারপাশটা তে জল ছিটিয়ে জায়গাটাকে ছোট করে আনতে থাকি । যত আমি কাছে এগিয়ে যাচ্ছি, মিসেস সরকারের কি বিকট চিৎকার । হাত পা জমে আসে। বুকের রক্ত শুকিয়ে হিম হয়ে যাওয়ার অবস্থা । একসময়ে হঠাৎই মিসেস সরকারের আওয়াজটা পাল্টে যায় । একটা পুরুষ কন্ঠ আমাকে অদ্ভুত সব শব্দে চিৎকার করে কিছু বলতে থাকে। আমি একদমই কাছে চলে এসেছি । হাতে এককোষ মন্ত্র পড়া জল নিয়ে ছিটিয়ে দিলাম মিসেস সরকারের গায়ে । আর নিমেষে প্রচন্ড জোরে একটা আওয়াজ করে ধোঁয়াটে একটা কিছু জানলার গ্রীল ভেঙ্গে বাইরের আকাশে মিলিয়ে গেল । আমি আরো কয়েক ফোঁটা জল মিসেস সরকার আর আমার নিজের গায়েও ছিটিয়ে নিলাম । সাবধানের মার নেই। মিসেস সরকার অচেতন হয়ে পড়ে আছেন মাটিতে । শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে । আমি ছুটে গিয়ে চাদর দিয়ে শরীরটাঢেকে দিলাম ।
খানসাহেব ফিরে এসেছেন, উনি অবাক । বললেন, কি করলেন ?
বললাম ।
হঠাৎই আমার হাত দুটো ধরে খানসাহেব গায়ে হাত তোলার জন্য নানাভাবে মাফ চাইতে লাগলেন। বললাম, ওসব কথা মন থেকে মুছে ফেলুন । যা করেছেন, ঠিকই করেছেন । আপনার জায়গাতে আমি হলেও তাই করতাম । ওসব ভুলে এখন আমাদের কি করতে হবে সেটা ভাবুন ।
ঘড়িতে তখন তিনটে বেজে কয়েক মিনিট ।
খানসাহেব একটু সময় ভেবে নিয়ে বললেন, চারটা কুড়ির আগে ভোর হচ্ছে না । তার আগে বেরোনো উচিত না । তারপর আমাকেই নির্দিষ্ট করে বললেন, আপনি একটা কাজ করুন স্যার, এই অবসরে ঘরের সব জিনিস পত্তর গুছিয়ে নিন । ভোর হবার সাথে সাথেই আমরা তাহলে বেরিয়ে পরতে পারবো।
দুজনে মিলে পাঁজাকোলা করে চাদরসহ মিসেস সরকারকে বিছানাতে শুইয়ে দিলাম । বললাম, রক্ত কি বন্ধ করবেন ?
খানসাহেব বাইরে থেকে একটা জঙ্গলী পাতা এনে বললেন, এইপাতাটা হাতের তালুতে ঘষে লাগিয়ে দিন, বন্ধ হয়ে যাবে ।
খানসাহেব ছুটলেন গাড়ি আনতে ।
আমি যত্ন করে একটু একটু করে লাগিয়ে দিলাম দেখলাম কাজ হচ্ছে ।
আস্তে আস্তে মিসেস সরকারের জ্ঞান ফিরে এলো । চোখ খুলেই থাকতেই জিজ্ঞেস করলাম, কেমন লাগছে?
মিসেস সরকার অনেক কষ্টে হাসলেন । তার দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে । ধীরে ধীরে আবার চোখ বন্ধ হয়ে এলো ।
ঠিক চারটে কুড়িতেই আমরা রওয়ানা দিলাম ।রিখাওদারে রিহ দিলের পাশেই একজন বার্মিজ বৈদ্য থাকেন , খানসাহেবের পরিচিত । গাড়ি নিয়ে প্রথমেই তার কাছে যাওয়া হলো। সব দেখেশুনে তার মেয়েকে দিয়ে একটা প্রলেপ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন ।বললেন তিনদিন লাগবে , তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে । একটা তেল দিলেন । বললেন, রোজই তিনবার করে লাগাতে হবে সাতদিন ।
আমদের বললেন, জোর বেঁচে গেছেন ।আমার বাহাত্তর বছরের জীবনে এভাবে কাউকে ফিরে আসতে দেখিনি । আপনাদের উপর ঈশ্বরের অপার করুনা ।
খানসাহেব বললেন, এই অবস্থায় ডাকবাংলো নিয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না ।
বললাম, আমার এক বন্ধুর বাড়ি ভাড়া নেওয়া আছে এখানে ।আমরা ইচ্ছে করলে ওখানেও উঠতে পারি । ঠিক হলো তাই হবে। আমি আর মিসেস সরকার আমার বন্ধুর বাড়িতে এসে উঠলাম ।
দুটোদিন ঝড়ের বেগে কেটে গেল । চব্বিশ ঘণ্টা শুশ্রূষাতে দ্বিতীয়দিন বিকেল থেকেই মিসেস সরকার অনেকটা সুস্থ । খানসাহেব রোজ এসে খবরাখবর নিয়ে যান । গল্প হয়, আড্ডাও হয় ।
মিসেস সরকার সুস্থ হয়ে যাওয়ায় তৃতীয়দিন আমি আমার অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ঠিক হয় বিকেলের দিকে আমরা আবার ডাকবাংলোতে ফিরে যাব, কারণ ওখানেই আমাদের সমস্ত জিনিস পত্তর থেকে গেছে । পরদিন ফিরে আসার কথা ।
সারাদিন থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে । খানসাহেবের গাড়িতে মিসেস সরকার অনেক আগেই ডাকবাংলোয় চলে গেছেন । আমিও সরাসরি অফিস থেকে ডাকবাংলোতে ফিরে গেলাম । খানসাহেবকে সাথে নিয়ে একটা জম্পেশ আড্ডা হলো , সাথে ডিনার ।
রাতে শুয়ে আছি। ঘুম আসছে না কিছুতেই । বাইরে অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে । ভেতরে ভেতরে একটা কষ্ট, আগামীকাল আমরা দুজনেই ফিরে যাচ্ছি ।হয়তো যোগাযোগ থাকবে হয়তো থাকবে না । মনটা খারাপ লাগছে ।বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি , হঠাৎ পাশের ঘরে খট করে দরজা খোলার শব্দ । আর কোন শব্দ নেই । আমি অপেক্ষা করতে থাকি আর কোন শব্দ আসে কিনা, কিন্তু না আর কোন শব্দ নেই । বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা হাওয়া । একটা চাদর গায়ে দিয়ে ধীরে ধীরে ঘরে থেকে বেরিয়ে আসি । বাইরে বেরিয়ে আমি অবাক । এই ঠান্ডায় মিসেস সরকার রেলিং এ ভর দিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন একা। খারাপ লাগছে । হয়তো মন খারাপ । যে আশা নিয়ে এখানে এসেছিলেন সেটা তো হলো না ।খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে।
আমি গায়ের চাদরটা ওনার গায়ে চাপিয়ে আলতো করে কাঁধে চাপ দিয়ে বললাম, মন খারাপ লাগছে কি ?
মিসেস সরকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার হাতটা ধরে ফেললেন ।
আমার দিকে ফিরে তাঁকাতেই লক্ষ্য করলাম উনি কাঁদছেন । বললাম, বিশ্বাস রাখুন, যা হয়েছে আপনার ভালোর জন্যই হয়েছে ।
-- আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম ।
বললাম , কষ্ট কিসের ? একজন বন্ধু হিসেবে যা করার আমি তো শুধু তাই করেছি মাত্র , এর বেশি তো কিছু না ।
-- আপনি না থাকলে আমি হয়তো মরে যেতাম ।
বললাম, ভুল কথা । কারো মরা বাঁচা কি আমার নিয়ন্ত্রণে আছে বলুন ।
মিসেস সরকার একটু সময় নিলেন, তারপর হঠাৎই আমার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, বিশ্বাস করুন আমি অনেক অনেক চেষ্টা করেছি ওকে আটকে রাখতে, কিন্তু পারলাম না ।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। হাত দুটো দিয়ে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও ধরলাম না । আলতো করে মাথায় হাতটা রেখে বললাম, শান্ত হও সুপ্রিয়া, শান্ত হও, শক্ত হও, এখনো অনেক দিন তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে ।
মেঘলা আকাশে বৃষ্টি তখন আবার নতুন করে ঝরতে শুরু করেছে ।
সমাপ্ত
গল্পটা ধৈর্য্য সহকারে পড়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। আমার মুল উদ্দেশ্য ছিল আমাদের প্রতিবেশী এই অজানা রাজ্যটাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এখানে উল্লেখিত সমস্ত তথ্য সত্য। ছবি অধিকাংশই আমার নিজের তোলা। আপনারা ইচ্ছে করলেই যাচাই করতে পারেন শুধু শেষ অংশটুকু কল্পনা। এবং অবশ্যই সেই কল্পনাটুকুও স্থানীয় লোকজনের গভীর বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে লিখেছি, হয়তো সত্যি হয়তো নয়। ধন্যবাদ।