“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৮

গোর্কি ঠাকুরের বাবা

(C)Image:ছবি

।। নীলদীপ চক্রবর্তী।।

('উজান' চতুর্দশ বর্ষ সংখ্যাতে প্রকাশিত)
     বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করে মাঝে মাঝে ব্যর্থ হন তিনি । পিঠের নিচে দুটো নিথর বালিশ কেউ গুঁজে দিলে আধশোয়া হয়ে প্রাচীন দুটি ঘোলাটে চোখ মেলে বিবর্ণ দেয়ালে দৃষ্টি স্থির রাখার চেষ্টা করেন। শরীর তার নিজস্ব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের প্রতি বীতরাগ হয়ে পড়লেও বৃদ্ধ মৌলিকের মনটি এখনো সজীব স্মৃতি ভারে অবনত । এই তো সব সেদিনের কথা । সেদিনও ওর প্রিয় কৃষ্ণচূড়ার ওপর লাল চাদরের মতো ঢেকে ছিল গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল। বাড়ির ঈশান কোণে ছিল সেই অহংকারী পলাশ । কিশোর সময় থেকেই বড় আক্ষেপ ছিল মৌলিকের, ওর দুটি প্রিয় ফুলের ফোটার সময় বিচ্ছেদ বেদনার মতো শীত আর গ্রীষ্মে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে । যেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ওর পেশা আর নেশা! আশির দশকের মৃত্যুপুরী অসমে শুধু ফুল ফুটবার অধিকার যেন দুটি লালফুলের গাছেরই ছিল। পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া ! কিন্তু মৌলিকের প্রিয় লাল তো আর হিংসা বিদীর্ণ মাটিতে মিশে যাওয়া প্রাণগুলোর লাল রঙ ছিল না! সে ছিল চে, কাস্ত্রোর যৌথ খামারের স্বপ্নের লাল!

     মৌলিক এই নোনাধরা বাড়ির দেয়ালে সারি সারি সাজানো অন্নপূর্ণা শিব, বিষ্ণুর অনন্ত শয্যা, চালচিত্রে আঁকা ধোয়াশাময় লক্ষ্মীর পট,ভাঙ্গা কাঠের ফ্রেমে আঁটা গণেশ এইসব ছবির দিকে নিঃস্পৃহ ভাবে দৃষ্টি ঘোরাতে লাগলেন। উজান থেকে যখন সেই আশির উত্তাল সময়ে পরিবারকে একটুকরো নিরাপদ আকাশ দেবার খোঁজে তিনি নামনির এই শহরে এলেন, তখনই এই বাড়ির বয়স বাইশ । কোন জন্মের ঋণ শোধ করে বঙ্গাইগাঁওর মিলন বসুমতারী এলুমিনিঅমের কারখানায় একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, তা ভেবে এখনো বৃদ্ধ মৌলিকের দুচোখ কৃতজ্ঞতার অশ্রু ঝরায় । দুপুরে কারখানার পেছনে পালপাড়ার পুকুরপাড়ে মোটা রুটি আর শসাভাজা চিবিয়ে, সাইদুল, লক্ষণ সিং, বীরেণ দাস, বিনয় সাহা, অচ্যুত হাজরিকার মতো আরও দুএকটি অস্থায়ী-কর্মীদের সাথে বসে বিড়ির ধোঁয়া ও  দারিদ্র্যতার অনাবিল আনন্দ যেন ভাগ করে নিতেন মৌলিক!    

    

     স্কুটি স্টার্ট করার কর্কশ আওয়াজে ঘোর ভাঙে মৌলিকের ! কোথায় যাচ্ছিস?’ ঘরঘরে গলার স্বর নিজের কাছেই কেমন তীক্ষ্ণ মনে হয় ওর।

-আজ শীতলা পুজো আছে, পাঁচটা কন্টাক্ট! দরজা ভেজানো রইল, খেয়াল রেখো!

-ফিরতে দেরি হবে তাহলে?’

-দূর,দেরি কেন হবে, সটাসট মেরে দেব ঘণ্টা দুয়েকে! আসছি!

পোড়া পেট্রোলের গন্ধ তুলে এ তল্লাটের হাই ডিমান্ড পুরোহিত গোবিন্দ ভট্টাচার্য ওরফে গোর্কি ঠাকুর নিজের পেশায় বেরিয়ে পড়ল । পাঁচটা কন্টাক্ট’, সটাসট মেরে দেব কতগুলো যেন বিষাক্ত কাঁটার মতো লাগে মৌলকের । যে বছর দিল্লির গাজিয়াবাদে হল্লাবোল পথ নাটিকার আসরে খুন হলেন সফদার হাসমি তখনই কল্যাণীর পেটে এসেছিল বাবু। লক্ষ্মীর আসন না দিয়ে না খাওয়া,  আর বিষ্যুদবারে একবেলা উপবাস করা কল্যাণীর একান্ত ইচ্ছেতেই ছেলের নাম গোবিন্দ রাখা হয়েছিল; আর যে আদর্শের প্রতি দুর্বার ভালোবাসায় রণিত হতো মৌলিকের দেহমন, যেই পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ার রঙ ওকে রাঙিয়ে দিয়েছিলো, সেই আদর্শের পথ ধরেই গোবিন্দের বাড়ির নাম রেখেছিল ওর বাবা, গোর্কি


বিশ্বাস অবিশ্বাসের একটি নিজস্ব পথ ছিল কল্যাণীর । সে পথে পাড়ার কয়েকটি নিরীহ গৃহবধূ ছাড়া আর কাউকে নিয়ে হাঁটেনি ও ! এমনকি নিজের সবচেয়ে ভালোলাগা মানুষ মৌলিককে নিয়েও নয়! পরে অবশ্য মৌলিকের পরিবর্তন দেখে কল্যাণী বাঁধভাঙ্গা আনন্দ পেয়েছিল। হঠাত্‍ আসা রাজনৈতিক উন্নাসিকতার জোয়ারে মৌলিক কারখানার অস্থায়ী কাজটি খুইয়ে উদ্ভ্রান্ত হয়ে একটা খড়কুটোর মতো অবলম্বন খুঁজছিলেন সেসময়ও আবার বিচক্ষণ ত্রাণকর্তার ভূমিকায় এলেন বৃদ্ধ মিলন বসুমতারী ।


-বুঝলে মালিক (তিনি ওই নামেই ডাকতেন, মৌলিক উচ্চারণ হতো না), তোমার তো নামের পেছনে একটা ভট্টাচার্য আছে, আর এই বঙ্গাইগাঁও শহরে তোমাদের জাতির মানুষও অনেক, এরা সব পুজো পালি করা নিরীহ লোক। তুমি পইতেটা ঝোলাও, আর বামুন ঠাকুরের পেশাটা শুরু কর, তোমার দিব্যি চলে যাবে


     শত সমস্যার ঘেরাটোপে থেকেও উচ্ছ্বাসিত হাসিতে ফেটে পড়তে গিয়েছিলেন মৌলিক। মার্ক্স লেনিনের লেখা, অস্ত্রভস্কির ইস্পাত পড়ে কাটানো যার যৌবন সে করবে পুরুতগিরি ! কী আশ্চর্য সমাপতন ! কালবৈশাখীর ঝড়ো রাতে দূরপাল্লার পথে যাত্রা করার মতই আর আর সব রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মৌলিকের। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অন্যান্য বিকল্প । মৌলিক সত্যি সত্যিই ভাতের ধোঁয়া গন্ধের খোঁজে ধুতি পড়েছিলেন, গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিলেন নামাবলি, কাঁধে এক দীর্ঘ ঝোলা, ওর ভেতর কুশ, কোষাকুশি আর সংক্ষিপ্ত পুরোহিত দর্পণ ! দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর রাত ওর কেটে যেতে লাগলো সম্পূর্ণ পুরোহিত দর্পণ এর  পড়াশুনায় । কল্যাণীর চোখে এ ছিল এক পরম বিস্ময় । ও হা করে দেখতো স্বামীর এই আমূল পরিবর্তন, আহ্লাদ ও আনন্দ থেকেও জটিল সমীকরণের মতো যেন সবকিছু লাগছিল ওর কাছে। পুজোআর্চ্চা থেকে শতহাত দূরে থাকা মানুষটা কেমন দুবেলা বেরিয়ে পড়ছে ধুতি, নামাবলি আর সাইকেল নিয়ে ! রাতে মোটা বই খুলে দেখে নিচ্ছে পুরুতগিরির সাত সতেরো 


    
  দুবেলা ভাত জোটানো আর ছেলেটিকে দাঁড় করানো, এইই মোটামুটি লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিবশ পরিবারটির । এরই মধ্যে কঠিন রোগ বাঁধানোর মতো বিলাসিতা করে ফেলেছিল কল্যাণী। হাড়ভাঙ্গা খাটুনির খেসারত দিতে দিতে কখন কীভাবে যে কল্যাণী নিজের কল্পিত বৈকুণ্ঠ লোকে ফিরে গেছে, মৌলিক এখনো ঠিক মতো ভেবে উঠতে পারেন না! শুধু ঘোর লাগা কোনো এক স্থাণু মুহূর্তে মাথায় আর বুকে বুলিয়ে চলা এক সংসারকর্মে খরখরে হাতের স্পর্শের অনুভূতিটুকু অনুপস্থিতি বড় নির্দয় ভাবে অনুভব করেন তিনি            


যাদের থেকে জীবনধারণের জন্য উপার্জন আসছে তাঁদেরকে ঠকাতে মন মানেনি মৌলিকের। রীতিমতো পড়াশুনা করে পূজার সমস্ত পাঠ আয়ত্ত করেছিলেন তিনি আচমন, সংকল্পশুক্ত, ঘটস্থাপন, ষোড়শোপচার, নিবেদন ইত্যাদি থেকে সমাপন ও যজ্ঞ সব কিছুই দারুণ নিপুণতায় সারতেন মৌলিক। যখন ছেলের সঙ্গে আজকাল কথা বলেন তিনি, তখন ওদের মধ্যে থাকা এক নিষ্ঠাহীনতা আর দায়সারা কথার ধরণ বার বার পীড়া দেয় তাঁকে। পাড়া-পড়শির বিড়বিড়ে মন্তব্যও কানে আসে তাঁর। খানদানি ব্যবসা তো! ধাপ্পাবাজি মেরে মেরে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছেন গোর্কি ঠাকুর। যাই বল, বাপটা কিন্তু দিব্যি ছিল


মৌলিক বুকটা চেপে ধরেন জংলা শুঁয়োপোকারা কামড়ে যায় বিষাক্ত হুল নিয়ে। ঠিক একই সময়ে দুপুরের অবচেতন পথ ধরে নামতে থাকে গাঢ় লাল রঙের পর্দা, মাটি ছোঁয়ার আগেই সেটি ধুসর হয়ে যেতে থাকে।


     ধুর শালা নিকুচি করেছে এই জীবনের! দুটি বাড়িতে ইতিমধ্যেই শেষ । তৃতীয়টা হচ্ছে হিন্দুশক্তি ঐক্য মঞ্চের পুজো  শালাদের ওখানে বাকিতে কাজ সারতে হয়। দক্ষিণা দিতে সময় লাগায় মাস খানেক। তাও মেরে কেটে সেটে 200 টাকা মাত্তর। যত্ত সব জোচ্চোরদের দল। আবার যা মস্তান আর বেহায়া ছেলেপুলে সব! পুজোটা না করে দিলে বেঁচে থাকাটাই মুশকিল করে তোলে হারামিগুলো । বিরক্তিতে বিড়বিড় করতে করতে স্কুটি চালায় গোবিন্দ ওরফে গোর্কি ঠাকুর। এমনিতে কামাই কম। তাছাড়া পড়াশুনাটা মন দিয়ে না করায় কোনও দিনই ভাল চাকরির সুবিধে করতে পারেনি গোর্কি । এদিকে আবার উপার্জনের উত্সাহটা ছিল যথেষ্ট বেশি। গোটা সমাজটাকেই ধূর্ত আর ফাঁকিবাজদের জায়গা বলে মনে হয় ওর। কী হবে মানুষের কথা ভেবে। মালকড়ি কামাও আর ফুর্তি করো । এদিকে বাবাটাকে নিয়ে হয়েছে আরেক ঝামেলা । আদর্শ আদর্শ করে নিজের ইহকালটা চিবিয়ে খেয়েছে। ভালোমানুষি দেখাতে গিয়ে সারা জীবন দারিদ্র্যতার ল্যাজে গোবরে অবস্থা। আজ পর্যন্ত দিনে দুটোর বেশি পুজো সারতে পারেনি। সিজনকালে এমন হলে চলে। যত্ত সব মন্তর পরবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। এভাবে কাজ হয়! ঠাকুর ঘোড়ার ডিম শোনে অত মন্ত্র । সেদিক থেকে অবশ্য গোর্কির গর্ব হয় নিজের ওপর। সরস্বতী, গণেশ আর বিশ্বকর্মা পুজোর সময় দিন রাত মিলিয়ে টারগেট থাকে বারো  আর একটু ঠিক মতো চেষ্টা করলে পনেরটি পর্যন্ত টেনে দেওয়া যায়। আর লক্ষ্মীপুজো হচ্ছে গিয়ে সুপার-সিজন-পিক অন্যদিকে বুড়ো হাবড়া গুলো আজকাল গেছে সংখ্যায় কমে বছরে চার পাঁচটার টেসে গেলে বেশ জম্পেশ ইনকাম  কিন্তু তা আজকাল হয় না ।  শ্রাদ্ধ শান্তির সংখ্যা খুব কম 


সুবিমল চকত্তির জন্য বহুদিনের একটা ইচ্ছে অবশ্য বুকে চাপা দিয়ে রাখতে হয় গোর্কিকে  স্থানীয় সর্বজনীন কালীবাড়ির পুরোহিতের পদ। সুবিমল ওটা বাগিয়ে বসে আছে  বাবার নাম টা এই কালীবাড়িতে  বেশ কাজে লাগে, ও জানে। সহকারী পুরোহিতের পদে কিছুদিন কাজ করেছিলেন মৌলিক। কিন্তু যত দিন যাচ্ছিল তিনি বুঝতে পারছিলেন একটা ক্ষমতার রাজনীতি গ্রাস করে রেখেছে কমিটিকে। সেক্রেটারির সঙ্গে আর দু-একজন প্রবীণ সদস্যের পদের ও  ক্ষমতার ঠান্ডালড়াই। অমাবস্যার পরদিনে সকালে ভোগের প্রসাদ আগে কার বাড়িতে যাচ্ছে, প্রতি অমাবস্যার পরদিন প্রণামী বাক্সের গণনা কার দায়িত্ব ইত্যাদি নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি দেখে নিজের স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে পুরোনো মৌলিক প্রতিবাদ করে উঠেছিলেন, গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন কালীবাড়ি কর্মীদের ছোটখাটো ইউনিয়ন এবং গণমত স্বাভাবিকভাবেই ওর পেছনে লেগে গেল ক্ষমতালোভী চক্রটি। নীরবে সংগ্রামী সত্তাটি সরে এলেন ওই পদ থেকে কল্যাণী চোখের জল ফেললেও স্বামীর জন্য কেমন গর্বিত যেন হয়েছিল সে শুধু গোর্কির একটুও ভালো লাগেনি বাবার এই ভূমিকা  একটু মানিয়ে না চললে কি হয় আজকাল! একটা পাক্কা কাজের বন্দোবস্ত  মাসের শেষে মাইনে  ডেইলি অং বং করে সময় কাটানো আর অমাবস্যার দিন একটু গায়ে গতরে খেটে দু-পেগ টেনে টেনে রাত্রিটা পার করা চুলোয় যাক আদর্শ সংগ্রাম আর সততা !


স্কুটি দাঁড় করিয়ে ক্লাব ঘরের পাশেই বাঁশের একচালা শীতলা মণ্ডপে ঢুকে পরে গোর্কি ঠাকুর! পাড়ার কয়েকজন মহিলা পুজো সামগ্রী সাজিয়ে রাখছেন আর ক্লাবের চার পাঁচটি ছেলে বাইরের টুকিটাকি কাজে ব্যস্ত  গোর্কি প্রথমেই পুষ্পপাত্রের দিকে নজর দেয় ফুল চন্দন ধান হরীতকী দুর্বার পাশেই রাখা দশটাকার নোট আর এক টাকার আধুলিটি দেখে গা জ্বলে ওঠে ওর  মা শীতলার অভিশাপ লাগুক তোদের দাঁতে দাঁত চেপে পুজোয় বসে পরে গোর্কি ঠাকুর চাপা গজগজ করতে করতে ক্ষীপ্রতার সঙ্গে শুরু করে আচমন ইত্যাদি কিন্তু মাঝে মধ্যে আজকাল গোর্কির কেমন যেন অস্বস্তি হয় পুজো চালিয়ে যাবার সময়  কোনো এক অদৃশ্য মহিলা যেন অন্যান্যদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ঠায় দেখতে থাকেন গোর্কির পুজো  ওর চোখে মুখে যেন ফুটে থাকে এক লুকোনো যন্ত্রণা, ভর্ৎসনা আর অতৃপ্তির অন্ধকার  পুরোপুরি তাকিয়ে দেখতে ভরসা হয় না গোর্কির থেকে থকে বুকটা যেন কেঁপে ওঠে ওর  আর সঙ্গে সঙ্গেই ওর সংস্কার, দৈন্য, অবিশ্বাস শিথিলতা যেন ওকে নিয়ে ডুবতে থাকে লাল জমাট রক্তের এক গভীর হ্রদে


হাতের লাঠিটার ওপর ভার দিয়ে আজ দিব্বি দাঁড়ালেন মৌলিক. উঠে দাঁড়ানোর এক অদম্য সাহস তিনি কৈশোরেই আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন সারি সারি দেবতাদের ছবি নোনা ধরা দেয়ালে নিশ্চল কল্যাণী আর ওর বিশ্বাসের পৃথিবী, মৌলিকের পেশার স্মারক, গোর্কির ছলে বলে রোজগারের বিজ্ঞাপন, সব কেমন একই প্রেক্ষাপটে আশ্চর্য চালাকির সঙ্গে ফুটে উঠেছে । একটা ছোট্ট কাঠের টেবিল ঘরের অন্ধকার কোনে দুই প্রজন্মের উপহাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টেবিলের ওপর দেয়ালে ঝুল কালিতে ঢেকে যাওয়া কার্ল মার্ক্সের ছোট্ট ছবি  সমস্ত ঠাকুরদের সাথে কল্যাণী এই ছবিও পরিষ্কার করত। ওই সরল মনটির কোন আদর্শগত বৈরিতা ছিল না! মৌলিক ভাবতে লাগলেন  হয়ত এও কোন দেশের দেবতা, স্বামীর কাছে জানতে চাইলে সুধু স্মিত হাসি দেখে কল্যাণীর ভাল লাগত। মৌলিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। গত জনমের স্মৃতি তাঁকে গ্রাস করে ফেলছে। এই আবহে, এই বাতাসে তিনি হাঁপিয়ে উঠলেন। আজ বহুদিন পর ঘর থেকে বেরিয়ে পরবার আর্তি অনুভব করছেন মৌলিক। পরম যতনে লাঠিটিকে নির্ভর করে পরিত্যক্ত খোলসের মতই নীড় থেকে মুক্তির খোঁজে বেরুল এক স্বাধীন বিহঙ্গ। বাইরে বেয়াড়া রকম চড়া রোদ  অথচ কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে মৌলিক যেন আবিষ্কার করলেন ওর হাঁটতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না আজ ওর বড় আক্ষেপ হলো এতদিন যেন বোকার মত নিজেকে ঘরে বন্দী করে স্মৃতি ভারে অবনত করে রাখছিলেন তিনি ফুরফুরে আমেজ নিয়ে আজ তিনি মৃদু পায়ে এগিয়ে চললেন। বাতাসে ধুপ ধুনার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে  শীতলা পূজার আয়োজন হয়েছে শহরের বহু জায়গায়। এ সম্ভবত তারই আভাস। শকুন্তলা কলোনি দিয়ে বেরিয়ে থানা পার হয়ে যাবার পর শহরের পূব দিকে যেতে থাকলে বাঘেশ্বরী পাহাড়। তারও কিছু পরে আপন খেয়ালে বয়ে চলেছে চিকরাঝরা নদী । একপাশে শ্মশান, ওপরে উজানমুখী রেলপথ আর ছোট্ট ব্রিজ। এদিকটা মৌলিকের খুব প্রিয় । কারখানায় চাকরির সময় সাইকেল নিয়ে প্রায় কয়েকজন বন্ধু নিয়ে এদিকটায় আসতেন তিনি  একটা অস্থায়ী পার্টি অফিসও হয়েছিল এই অঞ্চলে। চা বাগানের কিছু শ্রমিক নিয়মিত আসত এই অফিসে  মৌলিক জানে সেটি এখন নেই। রেল ব্রিজের নিচে নির্মল প্রকৃতির বুকে জীবন চিহ্ন হয়ে চিকরাঝরার জল বয়ে চলেছে। সুদূরে বাঘেশ্বরী পাহাড় জটিল একরোখা জিদের মতো দাঁড়ানো। মৌলিক একটা পাথরে বসে পড়লেন । তিনি জানেন আর হাঁটা ওর পক্ষে সম্ভব নয়   এই বৃদ্ধ অসুস্থ শরীরটিকে এতক্ষণ শুধু ওর ফেলে আসা উদ্দাম অতীত টেনে টেনে ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে এসেছে   এখান থেকে শহরের দিকে তাকালে এক অস্থায়ী শীতলা পুজোর মণ্ডপ দৃশ্য হয়। সেখান থেকে মাইকে অস্ফুট স্বরে দুর্বোধ্য সঙ্গীত ভেসে আসছে  মৌলিক ঘোলাটে জলভরা চোখে চিকরাঝরার দিকে তাকালেন  নদীর শান্ত বুকে শ্মশানযাত্রীরা ফুল, মালা, বিছানার চাদর ইত্যাদি ভাসিয়ে দিয়েছে  হঠাৎ সে সব যেন জল থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল  পরিবর্তে মৌলিক স্পষ্ট দেখলেন কিছু সদ্য ছেঁড়া পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ার ফুল বিভোর হয়ে ভেসে চলেছে উত্তরের দিকে । তাঁদের রক্তিম আভায় রাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে চিকরাঝরার জল । কিশোরে কালের সেই অপূর্ণ সাধ যেন আজ পূর্ণতা পেল  তবে কি ওর বিশ্বাস ও জ্ঞান ভুল ছিল? এই বিশেষ দুটি ফুল কি একই সময়ে ফোটে? একই সঙ্গে বিস্মিত ও আনন্দিত হলেন মৌলিক  সব ভাবনা চিন্তা ছেড়ে ওই ফুলগুলোর মতই নির্বিকার জলে ভাসার ইচ্ছে হলো ওর! দৃঢ়তার সঙ্গে লাঠি ছেড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছেন মৌলিক। আকাশ দিগন্তে ঝুঁকে পড়ছে উত্তরে।     


পুজো প্রায় শেষ  দুরের মণ্ডপে গোর্কি ঠাকুর তখন ঘট বিসর্জনের মন্ত্র পড়লেন!




কোন মন্তব্য নেই: