“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

মঙ্গলবার, ২৩ অক্টোবর, ২০১৮

শেকড়ের টানে


(C)image:ছবি

।। নীলদীপ চক্রবর্তী ।।





       দিনের যেকোন সময় একছুটে ডিব্রুনদীর তীরে এসে দাঁড়ায় ওপিন। এই জায়গাটি তাঁর ভালোলাগা একটা জায়গা । আলি-আয়ে-লৃগাং এর উৎসবমুখর সময় আর ঐনিতামের সুরেলা গানের মতই ডিব্রুর জল ভেসে যায় কোনো অজানা ঠিকানায়, ওপিন বোঝে না। কেন যে গ্রামের সবাই ভয় আর হিংসা করে এই ডিব্রুর জলকে, কে জানে ! বিধ্বংসী রূপ নিয়ে ডিব্রু বছরের দুতিন মাসে অবশ্যই শেষ করে দিয়ে যায় ওদের গ্রামের ও পরিবারের শেষ ভরসাটুকুও, তবুও ওপিন গোপনে ভালবাসে লুইতের এই জাতককে ! এর জন্যই তো মাঝে মধ্যে ওপারে পৌছুতে পারে ওপিন। থাকতে পারে প্রায়ই তাঁর আকাঙ্ক্ষার জায়গা, শহরে। কেউ কি জানে, শহর ওপিনকে ডাকে ক্রমাগত ! স্বপ্নময় চোখে ওপিন নদীর ওপারে শহরের হাতছানি দেখে। আর ঠিক সেই সময়েই ওর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে ওই ওপরে থাকা দেবতার ওপর ! ওদের গ্রামের মৈরম খুড়ো, রেগমন খুড়ো জানিয়েছেন – ওই দেবতাই নাকি ঠিক করেন কে কোথায় জন্মাবে, কোথায় থাকবে, এমনকি কোথায় মরবে- তাঁর হাল হদিসটুকুও!
           একটুও ভালো লাগে না, ওপিনের এই গ্রামে থাকতে । এখানে শুধু কষ্ট, অভাব আর ভয়ংকর প্রকৃতির সাথে লড়াই বা আত্মসমর্পণের মধ্যে ধুঁকতে ধুঁকতে বাঁচা । অবাঞ্ছিত কয়েক মাস দুঃসহ জলের সাথে সহবাস । মানুষের আর্ত চিত্কার, বিপন্ন ফসল আর গোবাদি পশুদের ভেসে যাওয়া দেখেছে ওপিন । বন্যার তোড়ে যখন ওপিনদের চাংঘরটি জলের মতো ভেসে গেছিল সেবার, মৈরম খুড়ো তাঁর বরনৌকায় চল্লিশজন গ্রামবাসীকে ও ওপিনদের পরিবারকে নিয়ে লাইকা গ্রাম ছেড়ে এসে উঠেছিলেন গুইজান ঘাটে। ঠিক সেভাবে এবছরও তাঁদের নতুন তৈরি ঘরটি অর্ধেক জলের নিচে । গড়ালের শুয়োর চারটি কোথায় ভেসে গেছে কে জানে !
            ডিব্রুনদীর তীরে বিশাল লাইন । মিসিং জনজাতি ও বন্যার্তদের মধ্যে বিতরিত হচ্ছে ত্রাণসামগ্রী। শহর থেকে বিভিন্ন দল আসে এই সময়। তারা লাইনে দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করায় ওপিনদের। অপেক্ষার শেষ হয় ক্যামেরা হাতে শহরের সাংবাদিকরা এলে। ওদের ক্যামেরার চোখের সামনে বিতরণ করা হয় ত্রাণসামগ্রী। ওপিনের এসব ভালো লাগে না। তাঁকে লাইনে দাঁড়াতে হয় দিনে দু তিনবার। সে জানে তাঁর বয়সী শহরের চোদ্দ বা পনের বছরের ছেলেমেয়েরা এসময় স্কুলে যায়, মাঠে খেলে, বিহু নাচ বা বাজনার প্রশিক্ষণ নেয়। কম্পিউটার নামে একটা মেশিনে গেম খেলে। জেল মেখে চুল দাঁড় করিয়ে স্টাইল করে। ওপিনও স্কুলে যায়। কিন্তু সেখানে পড়াশুনা হয় না। মাঝে মধ্যে দুপুরে খিচুড়ি আর একটা অখাদ্য সবজি মেলে। পাতলা জলের মতো হলদে ঝুলে আধমরা সবজিগুলো ভাসে। জল এসে স্কুল ঘরও ডুবিয়ে দিয়ে যায়। ছমাস পড়াশুনা বন্ধ থাকে। ওপিনের বইপত্র এসব বালাই নেই। তাছাড়া পড়তে ওর ভালও লাগে না। ওর ভাল লাগে শহর। ওর ভালো লাগে শহরে এসে থাকা। বন্যাদুর্গতদের শহরের কোনো সরকারি স্কুলে এনে রাখা হয় মাসখানেক। গুইজানের একটি সরকারি বিদ্যালয়ে এবছর ওপিনরা আছে। গুইজান ছেড়ে ওপিনের মন পড়ে থাকে পাশের বড় শহর তিনসুকিয়াতে। ওপিন চার পাঁচবার এসেছে এই শহরে। বিহু অনুষ্ঠান, দুর্গাপূজা, আর সিনেমা দেখতে একবার আসা । খুশিতে ওর ছোট্ট চোখ দুটি ঝিকমিক করে ওঠে। ও যদি সব সময় এই শহরটাতেই থাকতে পারত !




         মনজিৎ শইকীয়ার ছেলে দুটোকে স্কুল বাসে তুলে দিয়েই ওপিনের ঝাড়া হাত পা হয় না । এরপর বাবুর সঙ্গে বাজারে যেতে হয় । শইকীয়া বাইক নিয়ে বাজারে যান, বাজার ভর্তি ব্যাগটা ওপিন পায়ে হেঁটে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে আসে । আশ্রয়শিবির স্কুলটাতে যখন মনজিৎ শইকীয়া পরিদর্শনে গিয়েছিলেন- তখন ওপিনকে দেখে আর ওর মায়ের দুর্দশার কথা শুনে তিনি ওপিনকে নিজের বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে নিয়ে আসতে চাইলেন। যদিও ওর মার দো-মনা ছিল, কিন্তু গ্রামের অন্যরা এক প্রকার জোর করেই ওকে পাঠিয়ে দেয়। ওর মাকে বোঝানো হয়, বাপ মরা ছেলেটার বোঝা তুই বইতে পারবি না। তাছাড়া ওপিনের মায়ের কোলে তখন দেড় বছরের একটা বাচ্চা । বুকের ওপর পাথর চেপেই এক প্রকার সায় দিয়েছিলেন ওপিনের মা ফের্মি । মাসের শেষে একদিন শইকীয়ার বাড়ি গিয়ে পাঁচটি কড়কড়ে ১০০ টাকার নোটের প্রয়োজনীয়তা ফের্মির কাছে তাঁর চোদ্দ বছরের ছেলেটার চেয়েও বেশি !
         বাড়ির কাজকর্মের ফাঁকে ফোকরে ওপিন বেরিয়ে পড়ে ওর প্রিয় শহরটা ঘুরতে। পর্বতিয়ায় শইকীয়ার ঘর ছেড়ে নার্সিংহোম পেরিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের অফিস। ডানহাতি পথটা গিয়েছে তিনসুকিয়া কলেজের দিকে। ওপিন কলেজের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীদের দেখে। নতুন নতুন বাইক, ঝলমলে গাড়ি আর হাল ফ্যাশনের ছেলে মেয়ে দেখে ওদের মতই হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে ওর। রুক্ষ চুলগুলোতে চাপাকলের জল মেখে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো গাড়ির জানালায় তাকিয়ে নিজের চুলকে ঠিক মতো দাঁড় করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে দেখে ও। ওপিনের আরেকটা প্রিয় জায়গা গোপীনাথ বরদলৈ পথের মুখেই বিশাল এটিসি মলটা। সুউচ্চ অট্টালিকার সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে ওপিন। শহরে ওর আসার স্বপ্ন যেন পূরণ হয় এখানে দাঁড়িয়ে থেকে। নামীদামী লোকেদের গাড়ি, সুগন্ধি পারফিউম, নিত্যনতুন সামগ্রীর কেনাকাটার মার্কেট, ফুচকা চাট ও আরো চটকদার খাবার-দাবার ! এসব দেখে ওর গভীর মনের পক্ষীরাজ কখন যে ডানা মেলে কল্পলোকে উড়তে থাকে ও নিজেও জানে না। এই মলের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে একদিন সিনেমার পোস্টার দেখছিল ওপিন।
-- ‘কীরে কী দেখছিস?’ একটা গলার স্বরে চমকে ওঠে ওপিন। গেটকিপার। সুন্দর আঁটোসাঁটো ইউনিফর্ম। কোমরে বেল্ট, মাথায় টুপি। ওপিন ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করতে থাকে।
-‘তোর বাড়ি কোথায়?’ আবার প্রশ্ন। -‘পর্বতিয়া..’ ওপিনের ভয়ার্ত উত্তর।
-‘কী নাম?’ ওপিনের নাম শুনে উর্দি পরা দ্বাররক্ষক শুধোয় ওর গ্রামের ঠিকানা। আর এভাবেই মৈরাম খুড়োর বড় ছেলে রেগনের সঙ্গে পরিচয় হয় ওপিনের। দধিয়া গ্রামের ছেলে চব্বিশ বছর বয়সে ওপিনের মতই প্রশ্ন নিয়ে চলে এসেছিল এই শহরটাতে। গাড়ি ধোয়া মোছার কাজ, রেস্টুরেন্টের বেয়াড়া, গ্যারেজে মোটর মেকানিকের অ্যাসিস্ট্যান্ট, বারো রকম কাজ করতে করতে এই বিশাল বাজারের দ্বাররক্ষক হয়েছে রেগন মৈরাম। রেগন দাদাকে ভালো লেগে যায় ওপিনের। দিনে একবার অন্তত ওর সাথে দেখা করে ওপিন। ও শুনেছিল রেগনের গ্রাম থেকে পালিয়ে আসার কথা। অবশ্য অভাবের গ্রামে পরিবারের আর কেউ থানা পুলিশ নিয়ে খোঁজখবর করেনি ছেলেটার। রেগন অবশ্য ওপিনের শহর আসার বৃত্তান্ত শুনে বড় একটা খুশি হয়নি। ও বলে এই শহরটার নাকি মায়া মমতা নেই। এখানে পদে পদে হিংসা লোভ আর স্বার্থপরতার গন্ধ। রেগন জিজ্ঞাসা করেছে ওপিনের বাবার কথা। বাবার কথা মনে হলেই ওপিন কেমন উদাস হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর চার পাঁচজন জোয়ান ভুট্টার ক্ষেতে ওর বাবাকে তাড়া করে নিয়ে গিয়ে অযথা কেন গুলি করে মারল, তা এখনো স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারেনি ছেলেটা। ওর বাবার রক্তাক্ত নিথর দেহটা নিয়ে গ্রামবাসীরা যখন বাড়ির দাওয়ায় এনে ফেলল তখন ওপিনের মা  ফের্মির আর্তচিৎকারে যেন ডিব্রু নদীর জলও ক্ষণিক থমকে দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ এসে শরীরটা নিয়ে যায়। ক্যামেরা ও নোটবই হাতে সাংবাদিকরা কয়েকদিন ওদের পরিবারটাকে প্রশ্নবাণে বিরক্ত করে তোলে। শহরে কারা যেন নিরপরাধকে উগ্রপন্থী সাজিয়ে হত্যা করার প্রতিবাদে বনধ্ ধর্না ইত্যাদি করে, কিন্তু কাটাছেঁড়া হিমশীতল মৃতদেহ ছাড়া আর বাবা ফিরে আসেনি ওপিনের।

                                                ৩

 প্রচণ্ড জ্বরে প্রলাপ বকছিল রনি, মনজিৎ শইকীয়ার বড় ছেলে। ক্লাস এইটের কোন স্কুল-প্রজেক্ট করতে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজেছিল ও। প্রায় দুদিন পরেও ঘরোয়া ওষুধে যখন রোগ সারে নি, তখন ডাক্তার মৃন্ময় শর্মাকে সন্ধেবেলা ঘরে নিয়ে আসেন শইকীয়া । রনির ছোট ভাই বনিরও একটু সর্দি জ্বর-জ্বর ভাব ধরেছে সন্ধ্যা থেকে। বিখ্যাত ডাক্তার শর্মা পরীক্ষা করে কয়েকটা ঔষধ লিখে দিলেন। ওপিনের হাতে প্রেসক্রিপশন আর টাকা দিয়ে শইকীয়ানি ফার্মেসি পাঠান ওকে। ড. শর্মার পকেটে দুটো পাঁচশ টাকার নোট গুঁজে দিতে দিতে আবার আসার জন্য আবদারী হাসি হাসেন শইকীয়া। বিপত্তিটা হলো আর চার পাঁচদিন পর। রনি বনির জ্বর ছেড়ে যাবার সাথে সাথেই ওপিনকে ধরল ঐ রোগে। বারান্দায় রাখা ওর বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভেতরের ঘরে শইকীয়ানির গজরানি শুনতে পাচ্ছিল ওপিন।  
        ---‘আধমরা হয়ে পড়ে আছে ছেলেটা। কোত্থেকে এই আপদটাকে জুটিয়ে এনেছো! এখন ওষুধের পেছনে খরচ কর।‘
      শইকীয়া নির্লিপ্তভাবে উত্তর করলেন, --- ‘বোকা বোকা কথা বলোনা। সারা সংসারের বেগার খাটার মতো এমন ফ্রি মাল আর পাবে? সব কাজই তো ঠেলে দিচ্ছ ওর দিকে। মাসে খরচ মাত্র পাঁচশ’।
       --- ‘হু ! বুঝেছি, মেলা ফ্যাচফ্যাচ করো না। এখন ওই রোগীটার দেখভাল করবে কে। আর ওষুধের, ডাক্তারের, এসব খরচ তো জানো’।
      --- ‘আরে এতে চিন্তার কী আছে, কাল সকাল বেলা পাঠিয়ে দিও সিভিলে। বিনা খরচায় কাজ হয়ে যাবে’।
     শইকীয়া দম্পতির কথাবার্তা শুনে কী জানি কেন ওপিনের মনে পড়ছিল ওর মায়ের কথা। আর সেই সাথে দরদর করে জল পড়ছিল ওর দুচোখ বেয়ে। পরদিন জ্বরক্লান্ত দেহটাকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে নিয়ে গেছিল টেনে, ওপিন নিজেই। একে ওকে জিজ্ঞেস করে ডাক্তার আর ওষুধ পেতে পেতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা খরচ হয়েছিল ওপিনের। খিদেয় আর জ্বরে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে ছিল ও। হাসপাতালের এক ওয়ার্ডবয় ওর অবস্থাটা ঠাহর করে একটু স্যালাইন ওয়াটার খাইয়ে দেয় ওকে। হাসপাতালের একটা বেঞ্চিতে ক্লান্তির ঘুমে ঢলে পড়ার সময় ওর কানে বাজে ওইনিতমের সুরেলা গুঞ্জন, “ও আইপিও মানাগ মা, না মাবং সুনা মা, কামবং কালো দ কয়া কাবদা দা…”
         বাড়ি ফেরার পর একরাশ অকথ্য ভাষার গালিগালাজ শুনতে থাকে পাথর হয়ে যাওয়া ওপিন।  ‘হাসপাতালের নামে বেড়াতে বেরিয়েছিল রাজার বেটা, সাতরাজত্ব ঘুরে ফিরলেন, ভাতের থালা তো সময় মত সামনে পড়বেই…ইত্যাদি ইত্যাদি! সেদিন রাতে শুয়ে শুয়ে শইকীয়া দম্পতির কথা কানে ভেসে আসছিলো ওপিনের ।
       --- ‘শোন, রনিদের পুরনো ছেঁড়া জামাকাপড় আর ঘরের অকেজো বাসনপত্র এক বস্তা ভরে রেখো। রিলিফের মাল করে পাঠাবো গুইজানে’।
      --- ‘কেন, আবার দরদ উঠলে পড়তে শুরু হলো যে…’
    -- ‘না মানে প্রফেসর ব্যানার্জির বাড়িতেও একটা কাজের ছেলে চাই। আমার কাছে বায়না ধরেছে যে আমার মতই যদি একটা ওকে ম্যানেজ করে দেওয়া যায়..’
     --- ‘ওই পরোপকারেই লেগে থাক। বলি লাভ টাভ কিছু হবে’?
     --- ‘আরে তুমি যা বোঝা না, তা নিয়ে কথা বলতে এসো না। আমার স্টার-পয়েন্টের ব্যানার্জি পুরনো কাস্টমার। আর একটা নতুন ছেলে জোগাড় করতে হাজার বিশেক টাকা লাগবে, বলে দিয়েছি’।
       ডিব্রু নদীর জলে চাঁদনী রাতে ওর বাবার সাথে নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়ার সুখস্মৃতি ভেসে আসা মনে, ক্লান্তির পাথর চাপে তখন বিমর্ষতায় কুঁকড়ে যেতে যেতে ঘুমিয়ে পড়ে ওপিন। ওর স্বপ্নগুলো শহরের অন্ধকারের চোরাগলিতে হোঁচট খেয়ে পড়ে।




            রনির বন্ধু সাহিলের বাড়িতে প্রায়ই রনির ফাইফরমাশ নিয়ে আসতে হয় ওপিনকে। ওর প্রজেক্টের কাগজপত্র পৌঁছে দেওয়া, সাহিলের ক্রিকেট ব্যাট এনে দেওয়া, এইসব। কম্প্যুটার গেম এর সিডি বা পেন ড্রাইভ দিয়ে বা নিয়ে আসা, এসবও। রনি কম্প্যুটারে গেম খেলে। ওপিন প্রায়ই দাঁড়িয়ে দ্যাখে ওই দৃশ্য। ওর উত্তেজনা হয়, আনন্দ হয়। হয়তো তখনি ঘরের কাজে ডাক পড়ে ওর। রনিও মাঝেমধ্যে গালাগাল দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেয় ওকে। ঘরমোছা কাপড় ধোয়া, বাসন মাজা, বাজার করা, বাগান পরিষ্কার করা, স্কুলের বাস পর্যন্ত রনি বনিকে দিয়ে আসা, এসব করতে করতে ওপিনের সময় যেন কোন দুরন্ত গতি রেলের সাথে পাল্লা দিয়ে ছোটে। সেদিন সন্ধ্যায় রনি বনির জন্য চাউমিন আর বার্গার প্যাক করে আনতে ওপিন চলে আসে এটিসি মলের সামনেই।  খাবারের প্যাকেট হাতে ফিরতি পথে দেখা হয় রেগনদাদার সঙ্গে। রেগন হাসি মুখে শুধোয়,

--- ‘এই যে খাবার নিয়ে নিয়ে যাস, কখনো নিজে চেখে দেখেছিস এসব?’
        ওপিন সত্যিই কখনো রেস্টুরেন্টের খাবার খেতে পায়নি। ও বোকার মত মাথা নাড়ে। রেগনের  বুকটায় একটা ব্যথা যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। ওপিনকে সঙ্গে করে ও একটা দক্ষিণী রেস্তোরায় ধোসা খাওয়ায় নিয়ে। নিজের গাঁয়ের ছেলেটার প্রতি একটা ভালোলাগা কেমন রেগনকে আচ্ছন্ন করে।
       একটা ছোট্ট মেশিন। এর নাম পেনড্রাইভ। ওপিন জেনেছে রনির কাছে। আজকাল প্রায়ই রনির দেওয়া পেনড্রাইভ নিয়ে ওকে যেতে হয় সাহিলের কাছে। সাহিল মিনিট দশেক ওটা নিয়ে ওর কম্পিউটারে কী সব করে । আবার ফিরিয়ে দেয় । এদিকে রনির নির্দেশে শইকীয়া দম্পতিকে এব্যাপারে কিছু বলা বারণ । রনি বা সাহিলের অনেক কথাই মার খাবার ভয়ে জানানোয় নিষেধাজ্ঞা আছে ওর ওপর। যেমন স্কুল বাসে চড়ার একটু আগেই শিখর গুটখার প্যাকেট কিনে দিতে হয় রনিকে । সেই প্যাকেট তারা সিটের নিচে লুকিয়ে রাখে। ক্রিকেটের কোচিন ক্লাসে বিকেলে যাবার সময় ওপিনকেই রনির ব্যাগ বয়ে নিয়ে যেতে হয়। সেখানে সাহিল আর রনির জন্য সিগারেটও কিনে দিয়েছে ওপিন। সপ্তাহে দু-একদিন ওরা স্টেডিয়ামের গ্যালারির নিচে লুকিয়ে সিগারেট খায়, ওপিনকে থাকতে হয় পাহারায়।ছুটির দিনে সাহিলের বাড়িতে হোম ওয়ার্কের নামে যেতে চেয়ে এটিসির সিনেমা হলে ঢোকে রনি আর সাহিল। ওপিনকে টিকিট কেটে দিতে হয় ।
         সন্ধ্যায় সাহিলের বাড়ি থেকে একটা পেন ড্রাইভ এনে দিয়েছে ওপিন। রনির হাতে ওটা দেবার পর নিজের রুমে দরজা ভেজিয়ে রনি কম্প্যুটার চালায়। আজ শইকীয়ানি বাড়ি নেই। মহিলা সঙ্ঘের এক সংবর্ধনা সভায় গেছেন তিনি। রনির জন্য ওপিন ফ্লাক্স থেকে কমপ্লান ঢেলে দিয়ে আসতে যায় । ওকে ঐ রুমে ঢুকতে দেখে খেঁকিয়ে ওঠে রনি । তাড়া খেয়ে বেরিয়ে আসে ওপিন। ওর কিশোর মনে গ্লানির সাথে সাথেই কৌতূহলেরও সঞ্চার হয়। কী করছে রনি এত গোপনে ! পাশের ঘরের জানালার উপর রয়েছে একটা ছোট্ট খড়খড়ি। একটা চেয়ারে মোড়া রেখে খুব সন্তর্পণে ওর ওপর দাঁড়িয়ে পড়ে ওপিন। উঁকি দিয়ে দেখে ওপাশে। কম্পিউটারের পর্দায় নিবিষ্ট মনে মনোযোগী রনি। ওপিনের পূর্ণ দৃষ্টি পরে পর্দায়। হঠাৎ দৃশ্যটি দেখে চমকে শিউরে ওঠে ওপিন ! কম্পিউটারের পর্দায় দেখা যায় কয়েকটি সম্পূর্ণ নগ্ন নরনারী এক আদিম খেলায় মত্ত! কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তাড়াতাড়ি ও নেমে আসে। যথাস্থানে রাখে আসবাবগুলো। ঘরের মূল দরজা খুলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পথে নামে ওপিন। হঠাৎ দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করে ও। ওর প্রিয় শহরটার যথেষ্ট নগ্নরূপ যেন ভুতুড়ে ভাবে তারা করে ওকে ! ওর চাই পরিত্রাণ, মুক্তি! ছুটতে ছুটতে ও এসে পড়ে রাঙাগড়া পথে। গুইজানের পথটা জানে ও। শহর পেরিয়ে বিধ্বস্ত দেহটাকে নিয়ে দৌড়ে চলে ওপিন। মন্থর গতি একটা বালির লরির শেকল ধরে ঝুলে পড়ে ও। লরির গতি যতই বাড়ে ততই জাদুকরী শক্তির মত ওর চেতনা থেকে মুছে যেতে থাকে শহরের দৃশ্যপট। হিংস্র সরীসৃপের মতো শহর যেন ওকে গ্রাস করতে ছুটছে ওরই পেছনে! ট্রাকের পাটাতনে গা এলিয়ে দেয় ওপিন।  ওর মাথার উপর নক্ষত্রখচিত আকাশ। সপ্তর্ষি আর কালপুরুষের সহাবস্থান। নদীর কাছাকাছি এসে ট্রাকটা থামার সাথে সাথেই লাফিয়ে নেমে পড়ে ওপিন, অন্ধকারে গা ঢাকা দেয় । পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় শান্ত সমাহিত বালুময় ডিব্রুনদীর দিকে। অর্ধেক চাঁদের ফালি একটা নড়বড়ে রূপোলি সেতু করেছে এপার ওপার। জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দক্ষ শিশু সাঁতারু ওপিনের মুখটা যেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। চাঁদের আলোকে ম্লান করে দিয়ে মুক্তির আলোয় অবগাহন করতে ওপিন ঝাঁপিয়ে পড়ে জলে। দ্রুত সাঁতার কাটতে থাকে, ওর শেকড়ের দিকে ! ডিব্রুর স্রোতস্বিনী জল শহরের নোংরা কদর্যময় বীভত্সতাকে পরম যত্নে ধুইয়ে দিতে থাকে ওপিনের শরীর থেকে, মন থেকে…





কোন মন্তব্য নেই: