(দেশভাগ
এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস
ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই
উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার
প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে
ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই
উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই
উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার দ্বাদশ অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
বারো
বারুনি মেলা থেকে ফিরে এসে গুরু সৃষ্টিধর বলেন,
--- পাহাড়ো যাইতায় নি বাবাজি । বহুত
টেকার কাম অইব ।
বৈতল জানে অকুলস্থল থেকে পলায়নেই অপরাধের
মুক্তি । হয়তো শাস্তিও । তাই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায় । চামেলিকে মুখ দেখানো নিয়ে
দ্বিধায় ছিল , গুরু তাকে মুক্তির পথ বাতলে দিলেন । দুম করে পালিয়ে যেতেও মন চাইছিল
না । আবার চায়নার সামনে কাপুরুষের মতো দাঁড়াতেও চায় না । তাই জলে স্থলে অন্তরীক্ষে
যে কোন জায়গায়, এমনকি পাহাড়ে যেতেও সে প্রস্তুত । পাহাড় একদম পছন্দ নয় বৈতলের ।
পাহাড় আর টিলা তো একই , একটা বড় একটা ছোট । পাহাড়ে গেলেই মার কথা মনে পড়ে ।
মিরতিঙ্গার টিলায় যে তার রাজ্যপাট , পাট পাথর । প্রাণের বন্ধু মার সঙ্গে বৈতল রাজা
বসে পাটে । শিশু বৈতল , কিশোর বৈতল , ঘিরে থাকে তার মা । টিলার উপর বাধাবন্ধহীন
পবিত্র বাতাস শুধু । মাতা পুত্র আর অরণ্যের প্রাণীদের সঙ্গে উপভোগ । চরিত্র দোষ
হয়নি বৈতলের । যুবক হওয়া , যৌবনের ধর্ম পালন করা কই দোষের । দোষের কোনও কাজ করে নি
বৈতল । চায়নাকে নিয়ে কী না করতে পারে সে । করে না । চামেলি ওকে ভালবাসে । বৈতল যে
নিজেকে জানে না , ঘরজামাই হয়ে থেকে যাওয়ার কথা ভাবেনি । ওঝাগুরুর ঘরটাকেও সে ভালবেসে
ফেলেছে । ওঝার মন্ত্রগুণেই হয়তো শরীর নিয়ে খেলায় তার আপত্তি । নাকি অন্য কারণ ।
বৈতল তল পায় না আপন শরীর মনের । চরম উত্তেজনার সময় কেন ঝিম মেরে যায় তার শরীর ।
বৈতল ওঠে পাহাড়ে আবার নেমেও আসে । গুরু তার অন্তর্যামী , কিছু একটা আঁচ
করেন। তাই তো কথায় কথায় বলেন ,
--- বুঝি, পানি না দেখলে তোমার পরান
ঠাণ্ডা হয় না ।
গুরুর বাড়ির পুকুরেই বৈতল হাওরের জলসুখ উপভোগ করে । যখন ইচ্ছে নেমে যায় জলে
। জলের প্রাণী খুব একটা বা থাকলেও অভ্যাসবশে লুকিয়ে মাছ ধরে বৈতল । দিয়ে আসে
পঞ্চকন্যার জননীর হাতে । ওঝার হাতে ধরা পড়লে রক্ষা নেই । শরিকানা পুকুরের অর্ধেক
মালিক বৃন্দাবন কামারের ভাগে যায় পুরো ।
জলে থাকলে হাত পা নাড়তে পারে বৈতল । জলে থাকলে তার সাহস বেড়ে যায় । জলে
থাকলে সে মহাবীর । তবে পাহাড় থেকে সে জলের টানে নামেনি । নামতে হবে বলে নেমেছে ।
না করতে হবে বলে নেমেছে । গুরু সৃষ্টিধরের পায়ে পড়ে কেঁদেছে বৈতল শুকনো চোখে ।
গুরু ভেবেছে বৈতলের চোখে ঘোর লেগেছে । নেশা হয়েছে । বৈতলের গুরু মানুষটা বড় খাঁটি
। সোনার মতো চকচকে , শুদ্ধ । ছেড়ে যেতে মন চায় না বলে শুকনো চোখের অনুনয় ,
ক্ষমাভিক্ষা করে । দিঘীর পারের মানুষ জন , বাসুদেববাড়ি , পঞ্চখণ্ড , অনিপণ্ডিত,
পণ্ডিতপাড়ার মানুষেরা তাঁকে সম্মান করে । সম্মানিত মানুষরা নিজের জন্য কিছুই চায়
না , বিলিয়ে দিয়েই আনন্দ । ছেলে নেই বলে যে একটা দুঃখ ও আছে মনের ভিতর , জানতেই
পারত না বৈতল জয়ন্তীয়ার পাহাড়ে না এলে । মনের দুঃখে পাঁচমেয়ের বাপ বৈতলকে বলেন,
--- বুঝলায় নি বাবা , নরম নরম মাইনষে
পুয়া জন্মাইতা পারইন না । খালি পুড়ি জন্মায় । আমার পঞ্চকন্যা । মা মনসা এক একজন ।
ওঝা পাহাড়ে ওঠে নেশা করার জন্য । পাহাড়ি
মানুষের ঘরের দুঃখহরণ মদ । থালার ভাতে সুখের ঘুম হয় , নেশার ভাত গেলাসে উঠলে দুঃখও
ওঠে উথলে । ছেলের বয়সী শিষ্য নিয়ে স্বপ্ন দেখে । বৈতলকেও দেয় এক পাত্র । গুরু
শিষ্যের নেশাচর্চায় অসুন্দরের দরজা থাকে বন্ধ । গুরু শিষ্যের নেশায় প্রতিক্রিয়া
দুরকম । গুরু সৃষ্টিধর পাত্র হাতে নিয়ে দ্রব হয়ে যায় , চোখ দিয়ে জল গড়ায় । আর বৈতল
, বৈতলের চোখের জল দেখে নি কেউ , নেশার পাত্র বৈতলকে বোবা করে , গুম মেরে যায় , থম
হয়ে যায় কালো পাথরের মূর্তি । গুরু নিজের জন্য কখনও যা চাইতে পারেন না , বৈতলের
কাছে চেয়ে বসেন । কান্না চোখে আবেদন জানান ,
--- তুমি নিবায় নি আমার একজন ।
পাথরের মূর্তি না হলে বৈতল কিছু
একটা বলতেই চাইত । নেশার সময় মেয়েমানুষ নিয়ে কথা শুনতে মন্দ লাগে না । আর সেই
মেয়েকে নিয়ে যদি কখনও স্বপ্ন সাজিয়ে থাকে কেউ । কিন্তু বৈতল শুধু স্বপ্ন নিয়ে
বাঁচে না । বৈতল শুধু ঈশানের খুঁটি হয়ে বাঁচতে চায় না , বৈতল পায়ের নিচে সর্ষে
নিয়ে বাঁচতে চায়, ডালার কুল হয়ে জীবন দেখতে চায় । বৈতল কোনও উচাটন নিয়ে থাকতে চায়
না । অনেকদিন তো হলো গুরুগৃহে , এবার তার ফেরা । এতদিন প্রাণে ছিলেন মা বিষহরি ।
গ্রামে গ্রামে গুরুর সঙ্গে পুঁথি পড়ে বেড়ানোর আনন্দে মশগুল ছিল । গুরুর জোগালি হয়ে
কাজের জন্য ওঝার কাছে মজুরি নেয়নি বৈতল । পেট চুক্তিতে থেকেছে । মাঝে মাঝে সিঁদ
কেটে অভ্যাস বজায় রেখেছে । বাপের বানানো শরীরকে তেলাল রাখতে পুকুরের এপার ওপার
ভুসভুসিয়ে বুক চিৎ ডুব সাঁতারে কসরৎ করেছে । তাহলে কেন । মার মৃত্যুসংবাদে কি
সত্যিই বিচলিত বৈতল । নাকি গুরুগৃহবাস সমাপ্ত বলে মনোব্যথা , এবার অন্য ঠিকানার
হালহদিশ । দেশের টানে আবার বইয়াখাউরি অভিমুখী । নাকি এক জটিল সময়ের পূর্বাভাস পেয়ে স্বভূমির
টানে প্রত্যাবর্তন । গুরু মহাশয় অনেক কিছু জানেন , রাজনীতির সর্বশেষ খবরও রাখেন
তিনি । বৈতলের কিশোর থেকে যুবক হওয়ার বয়সকালে রাজনীতির তেমন ডামাডোল দেখেনি ।
সিলেট দেশে শান্তির হাওয়া দেখেছে । এখন লীগ তেভাগা কংগ্রেস আর দেশভাগ নিয়ে গুরুর
ভাষ্যে বৈতল বিভ্রান্ত । বৈতল এখন আর নিজের জায়গা ছেড়ে থাকবে না । নিজের মাটি আর
জলের সুরক্ষায় এখন বৈতলের বইয়াখাউরি ফেরাই প্রধান ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন