“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৫

আয়স কাল ০৯

(দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন'- উপন্যাসের  বাংলা অনুবাদের নবম  ভাগঃ -- শিবানী দে

(C)Image:ছবি
বছর বর্ষা তাড়াতাড়ি শুরু হয়েছে । এখন বর্ষার চতুর্থ মাস চলছে । দেওয়াল ধরলেই ভিজে ছোপ ভেসে ওঠে । জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা ফুলে উঠে ফেটে যাচ্ছে । আমার কাপড়চোপড়ে একটা তেতো তেতো শ্যাওলা শ্যাওলা গন্ধ । কতই না ইচ্ছে করছে সূর্যের আলোতে মুচমুচে কাপড় পরতে । আমাকে মঞ্জুর কর আরো একটিমাত্র বারের গ্রীষ্মদিনের বৈকালিক ভ্রমণ সেই তরুবীথিশোভিত পথের মধ্য দিয়ে, যে পথে হাসতে হাসতে, কলরব করতে করতে, নির্মল ঘামের গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে বাড়ি ফিরছে বাদাম রঙের শরীরের স্কুলের বাচ্চারা, আর প্রতিবছর সুন্দরতর ও ভরন্ত হতে থাকা মেয়েরা । আর তাও যদি সম্ভব না হয়, তবে এই আশ্চর্যময় পৃথিবীতে শেষ অবধি হোক একটা অলৌকিক কিছু, যার জন্য রইবে আমার অসীম কৃতজ্ঞতা, হৃদয় উজাড় করা কৃতজ্ঞতা ।

আমি বিছানায় বসে আগস্ট মাসের ঠাণ্ডায় হাঁটুদুটো জড়ো করে এই কথাগুলো লিখছি । গ্র্যাটিট্যুড (কৃতজ্ঞতা ) শব্দটা আমি আবার লিখলাম, আবার পড়লাম । এর কি অর্থ ? আমার চোখের সামনে শব্দটা হয়ে ওঠে ঘন, ছায়াচ্ছন্ন, রহস্যময় । তারপর কিছু একটা ঘটে গেল । ধীরে ধীরে আমার হৃদয় কৃতজ্ঞতায় একটা ডালিমের মত ফেটে গেল; যেন একটা ফল, নিজেকে ভিন্ন করে ভেতর থেকে ভালোবাসার বীজগুলোকে প্রকাশ করছে । গ্র্যাটিট্যুড, পমেগ্রেনেট (ডালিম) দুটো ভগিনীশব্দ !


আজকে সকালে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙ্গল । বৃষ্টির চাদরের পর চাদর আকাশ থেকে নেমে নেমে আসছিল, বুজে যাওয়া নালার উপর জলের স্রোত বইছিল, ছাদের ফাটা টালির মধ্য দিয়ে চুইয়ে জল পড়ছিল । আমি নিচের ঘরে নেমে এককাপ চা বানালাম, গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে সারামাসের জমাখরচের হিসেব কষতে বসলাম ।

গেট খোলার আওয়াজ হল এবং গাড়িবারান্দার দিকে এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ শোনা গেল । কালো প্লাস্টিক ব্যাগের নিচে মাথা বাঁচিয়ে কেউ একজন জানালার নিচ দিয়ে গুটিসুটি মেরে চলে গেল ।

আমি বারান্দায় বেরিয়ে বৃষ্টির শব্দের মধ্যে ডাকলাম, 'মি ভারকুয়েইল ! ' কোন সাড়া মিলল না । কাঁধ ঝুঁকিয়ে গাউন উঁচু করে আমি বাইরে পা বাড়ালাম । সঙ্গে সঙ্গেই আমার পলকা ভেড়ার লোমের ফিতে দেওয়া চটিজোড়া ভিজে সপ্‌সপে হয়ে গেল । জলস্রোতের মধ্য দিয়ে আমি উঠোন পেরোলাম । ছাউনিঘরটার দরজায় কার গায়ে ঠোক্কর লাগল---- ভারকুয়েইল তার পিঠ আমার দিকে করে দাঁড়িয়েছিল, আচমকা গালি দিয়ে উঠল ।

আমি বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে জোরে বলে উঠলাম, 'ভেতরে এসো । বাড়ির ভেতরে এসো । ওখানে ঘুমোতে পারবে না ।"

কালো ব্যাগটাকে ছাতার মত মাথার উপর ধরে সে আমার পেছন পেছন রান্নাঘরের আলোয় চলে এলো । আমি বললাম, 'ওই ভেজা জিনিষটাকে বাইরে রেখে এসো ।' তারপর চমকে দেখলাম, তার পেছন পেছন আরো একজন কেউ এসে গেছে । একজন স্ত্রীলোক, বড়জোর আমার কাঁধ অবধি উচ্চতার, বয়স্ক, বরং বলা যেতে পারে কম বয়সের নয়, ফোলা ফোলা মুখ এবং বিবর্ণ চামড়া ।

'এটা কে ?' জিগ্যেস করলাম ।

ভারকুয়েইল হলুদ চোখে উদ্ধতভাবে আমার দিকে তাকাল । 'কুকুর-মানুষ,' আমি ভাবলাম ।

আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, 'তোমরা বৃষ্টি ধরে যাওয়া অবধি এখানে অপেক্ষা করতে পার, তারপর চলে যাবে ।' বলে পেছন ফিরে চলে এলাম ।

শোবার ঘরে এসে জামাকাপড় পালটে কিছু পড়বার চেষ্টা করলাম । কিন্তু শব্দগুলো আমার সামনে ঝরা পাতার মত উড়তে থাকল । চোখ জুড়িয়ে আসতে থাকল, বই খসে খসে বারবার পড়তে লাগল দেখে নিজেই একটু আশ্চর্যবোধ করলাম ।

কিছুক্ষণ পর যখন জাগলাম, তখন মনে প্রথম চিন্তাটাই এল---- লোকদুটোকে বাড়ি থেকে তাড়াতে হবে । স্ত্রীলোকটার দেখা পাওয়া গেল না । বসবার ঘরের সোফায় দু হাঁটুর মাঝখানে হাতদুটো রেখে, মাথায় টুপিটাও যাহোক করে রয়েছে, ভারকুয়েইল ধনুকের মত শুয়ে ঘুমোচ্ছিল । আমি তাকে আস্তে আস্তে ধাক্কা দিলাম । সে নড়ে উঠল, জিভ দিয়ে ঠোট ভিজাল, ঘুমন্তভাবে অনিচ্ছার বিড়বিড় করল । আমার মনে পড়ল ----এতো সেই বিড়বিড় শব্দ যা তুমি করতে যখন আমি তোমাকে স্কুলের জন্য জাগাতাম । 'উঠবার সময় হয়ে গেছে '-----আমি পর্দা সরাতে সরাতে বলতাম, আর আলোর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তুমি ওইরকম বিড়বিড় করতে । 'সোনা আমার, ওঠো, উঠবার সময় হয়ে গেছে",---আমি তোমার কানে কানে বলতাম, তাড়া দিয়ে নয়, অনুনয় করে, কারণ সেই সময়টুকু ছিল আমার প্রার্থিত সময় , যখন তোমার বিছানায় বসে তোমার চুলে বিলি কাটতাম, বিলির পর বিলি, আমার ভরা আঙ্গুলের ডগা দিয়ে, যতক্ষণ না তুমি ঘুমের শেষ রেশটুকু কাটিয়ে ওঠ । এমনি করেই কাটুক না সব সময়, আমি ভাবতাম, আমার হাত তোমার মাথায়, ভালবাসার ধারা তার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ।

আর এখন তোমার সেই ঘুমজড়ানো আরামের অস্ফুট ধ্বনি এই লোকটার গলায় যেন নতুন জন্ম পেয়েছে । আমি কি তার কাছেও বসব, টুপিটা তুলে দিয়ে তার চিটচিটে চুলে বিলি কাটব ? বিতৃষ্ণায় আমার শরীর সঙ্কুচিত হয়ে যায় । একটা শিশুকে ভালবাসা কত সহজ, শিশুটা যখন পালটে যায়,  তখন তাকে ভালবাসা কত কঠিন ।  একদা সহজাত জীবনের আনন্দে এই জীবটাও কোন নারীর গর্ভে নাড়ী থেকে নাড়ীতে রক্ত সঞ্চালনের দ্বারা পুষ্টিলাভ করে, হাতদুটো কানের কাছে মুঠি করে, চোখদুটো শক্ত করে বন্ধ করে ভাসছিল । মাতৃশরীরের অস্থিগঠিত দ্বার দিয়ে সে বাইরের উজ্জ্বল আলোয় এসেছিল, মায়ের ভালবাসা জানবার সুযোগ পেয়েছিল । তারপর কোনো এক সময় তার থেকে দূরে যেতে থাকল, একা দাঁড়াতে হল তাকে, হতে থাকল রসহীন, খর্ব, কুটিল । বঞ্চিত জীবন অনেকেরই আছে  । কিন্তু এই ক্ষেত্রে, সে অনেকের তুলনায়ই অপুষ্ট । মধ্যবয়স তার, কিন্তু এখনও যেন বোতল চুষছে, যেন মাতৃস্তন্যের শান্তির আকাঙ্ক্ষা করছে, ঘুমের মধ্যেই তার সে আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হচ্ছে ।

আমি যখন তার সম্পর্কে এইসব ভাবছিলাম, তার স্ত্রীলোকটি ঢুকল । আমাকে অগ্রাহ্য করে সে মেঝেয় কতকগুলো কুশনের মধ্যে শুয়ে পড়ল । তার শরীর থেকে কোলনের গন্ধ বেরোচ্ছিল । পেছন পেছন রাগী মুখে ফ্লোরেন্স ঢুকল ।

'আমাকে কিছু কৈফিয়ত দিতে বলো না , ফ্লোরেন্স ।' আমি বললাম, 'ওদের ছেড়ে দাও, ওরা যখন
ঘুমোচ্ছেই ।'

ফ্লোরেন্সের চশমা জ্বলজ্বল করে উঠল, ও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল । আমি ওকে থামিয়ে বললাম, 'প্লীজ । ওরা এখানে থাকবে না ।'

আমি টয়লেট অনেকবার ফ্লাশ করলাম, তবুও হালকা মিষ্টি নোংরা দুর্গন্ধ থেকেই গেল । বাথরুমের ম্যাটটা বৃষ্টিতে ছুঁড়ে ফেললাম ।

কিছুসময় পরে বাচ্চারা যখন ফ্লোরেন্সের সঙ্গে রান্নাঘরে ব্রেকফাস্ট করছিল, আমি নিচে এলাম । কোনো  ভূমিকা ছাড়াই আমি ভেকিকে বললাম, 'শুনলাম, তুমি ও তোমার বন্ধু আমার গাড়িতে ঘুমোচ্ছে । তোমরা আমার অনুমতি নাওনি কেন ?'

ঘরে স্তব্ধতা । ভেকি মুখ তুলে তাকাল না । ফ্লোরেন্স নিঃশব্দে রুটি কাটতে থাকল ।

'কেন আমার অনুমতি নাও নি ? জবাব দাও ।'

বাচ্চা মেয়েগুলো চিবোনো বন্ধ করে আমার দিকে তাকাল ।

আমি কেন এই রকম অদ্ভুত ব্যবহার করছিলাম ? কারণ আমার বিরক্তি ধরছিল । আমাকে ব্যবহার করা হচ্ছে দেখে ক্লান্তি লাগছিল । আমার গাড়িতে ওরা শুচ্ছিল । আমার গাড়ি, আমার বাড়ি : আমার। আমি এখনো দুনিয়া ছেড়ে চলে যাইনি ।

সৌভাগ্যক্রমে, ভারকুয়েইল দেখা দিল, আর কি হয় কি হয় ভাবটা কাটল। সে রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে ডাইনে বাঁইয়ে না তাকিয়ে বারান্দায় বেরোল । আমি পেছন পেছন গেলাম । কুকুরটা আনন্দে লাফিয়ে ওর উপর উঠছিল । সে আমার স্কার্টে ভেজা থাবার ছোপ লাগিয়ে আমার উপরও লাফাল । কুকুরকে আদর করে সরালেও কেমন বোকা বোকা লাগে !

আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, 'তোমার বন্ধুটিকেও  কি নিয়ে যাচ্ছ ?'

সে মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকাল, কোন জবাব দিল না ।

আমি ক্রোধে চিৎকার করে বললাম, 'ওকে নিয়ে যাবে এক্ষুণি, নইলে আমিই তাকে বের করে দেব ।'

সে আমার কথায় পাত্তাই দিল না ।

আমি ফ্লোরেন্সকে আদেশ করলাম, 'আমাকে সাহায্য কর ।'

স্ত্রীলোকটি মুখ নিচের দিকে করে কুশনের বিছানায় শুয়েছিল, মুখের কোণাটায় ভিজে ছোপ । ফ্লোরেন্স তার হাত ধরে টানল । টলমল করে সে উঠে দাঁড়াল ।  কিছুটা তার হাত টেনে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরেন্স তাকে ঘর থেকে বের করল । বেরোনোর রাস্তায় ভারকুয়েইল আমাদের সঙ্গ ধরল । আমি ধমক দিয়ে বললাম, 'এসব অত্যন্ত বাড়াবাড়ি হচ্ছে ।'

ছেলেদুটো সাইকেল নিয়ে এর আগেই রাস্তায় বেরিয়ে গিয়েছিল । আমাদের ঝগড়াঝাটি না দেখবার ভান করে তারা স্কুনার স্ট্রিট ধরে চলে গেল, ভেকি সাইকেলের রডে বসে, তার বন্ধু প্যাডেলে ।

মহিলাটি কর্কশস্বরে অশ্লীল ভাষায় ফ্লোরেন্সকে গালি দিতে আরম্ভ করল । ফ্লোরেন্স আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল । 'বাজে লোক', বলে সে দুপদাপ  করে পা চালিয়ে চলে গেল ।

আমি ভারকুয়েইলকে বললাম, 'আমি যেন এই স্ত্রীলোকটাকে আর না দেখি ।'

ছেলেদুটোকে নিয়ে সাইকেলটা আবার স্কুনার স্ট্রিটের মোড়ে দেখা দিল, তারপর সেটা আমাদের দিকে আসতে থাকল । ভেকির বন্ধু জোরে জোরে সাইকেলে প্যাডেল করছিল । ওদের পেছনে ধাওয়া করছিল সেই হলদে রঙের পুলিশভ্যানটি ।

একটা ছোট ট্রাক রাস্তার ঢালুর দিকে দাড়িয়েছিল, কলমিস্ত্রির জিনিষপত্র, রড, পাইপ ইত্যাদি নিয়ে । সাইকেল যাবার জন্য যথেষ্ট জায়গা ছিল । কিন্তু হলুদ পুলিশের ভ্যানটা সাইকেলের সমানে সমানে যখনই এসে পড়ল, ঠিক তখনি ভ্যানটার রাস্তার দিকের দরজা খুলে গিয়ে একধার থেকে ছেলেদের ধাক্কা মারল । সাইকেলটা টলমল করতে করতে ছেলেদের বশের বাইরে চলে গেল । আমি একটুখানি  দেখলাম, ভেকি গড়িয়ে পড়ছে, তার একটা হাত মাথার উপর, অন্য ছেলেটা তখনো প্যাডেলে দাঁড়িয়ে, তার মুখটাকে কিছু একটা থেকে বাঁচাতে হাত বাড়িয়ে রয়েছে, । মিল স্ট্রিটের চলন্ত গাড়িগুলোর আওয়াজ ছাপিয়ে একটা চলমান শরীরের পতনের 'ধপ' শব্দ, একটা গভীর, চমকে যাওয়া 'আঃ' শব্দের সঙ্গে দীর্ঘ প্রশ্বাস, কলমিস্ত্রির গাড়ির সঙ্গে সাইকেলের ধাক্কা লেগে পড়ে যাবার আওয়াজ । 'হে ঈশ্বর !' আমার তীব্র চিৎকার আকাশে ঝুলে রইল, আমি নিজের স্বরকে নিজের বলে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । সময় যেন স্তব্ধ হয়ে গেল, তারপর একটু ফাঁকা রেখেই আবার চলতে শুরু করল । ছেলেটা এক মুহূর্ত হাত বাড়িয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল, পরমুহূর্তেই যেন দলা পাকিয়ে নালাতে গিয়ে পড়ল । আমার চিৎকারের প্রতিধ্বনি মৃদুতর হয়ে মিলিয়ে গেল, সব কিছু চেনা অবস্থায় ফিরে এল ; স্কুনার স্ট্রিট অভ্যস্ত সাপ্তাহিক সকালের মতই শান্ত, ক্যানারি-হলুদ* ভ্যানটা রাস্তার মোড় দিয়ে চলে যাচ্ছে ।

একটা রিট্রিভার জাতের কুকুর খোঁজ করতে চলে এল, ভারকুয়েইলের কুকুরটা রিট্রিভারের গন্ধ শুঁকল, রিট্রিভারটা তার দিকে মনোযোগ না দিয়ে ফুটপাথ শুঁকতে লাগল, তারপর চাটতে আরম্ভ করল । আমি সরতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারলাম না । আমার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল, হাতপাগুলো যেন দূর কোথাকার হয়ে গিয়েছিল, যাকে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বলে, তা-ই যেন আমার মধ্যে কাজ করছিল, যদিও আমি জীবনে কখনো অজ্ঞান হয়ে যাইনি । 'হায়, এই দেশ !' আমি ভাবলাম, তারপর আবার ভাবলাম, 'ভাগ্যিস আমার মেয়ে এখানে নেই ।'

গেট খুলে শ্রমিকের নীল রঙয়ের পোশাকপরা একজন লোক বেরোল । সে রিট্রিভারটিকে লাথি মারল । কুকুরটা আঘাত পেয়ে আশ্চর্য হয়ে লাফিয়ে পালাল । লোকটা বলল, 'হায় যিশু!' সে নিচু হয়ে সাইকেলের ভেতরে জড়ানো অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে সাবধানে বের করতে থাকল ।

আমি কাঁপতে কাঁপতে এগোলাম । ডাকলাম, 'ফ্লোরেন্স !' কিন্তু ফ্লোরেন্সের কোনো সাড়া পাওয়া গেল না । ছেলেদুটোর শরীর সাইকেলটা থেকে আলাদা করে দিয়ে লোকটা সেটাকে একপাশে রাখল । ভেকি অন্য ছেলেটার নিচে পড়েছিল । তার মুখ ব্যথায় ভীষণ বিকৃত, জিভ দিয়ে ঠোট বারবার ভিজাচ্ছিল, চোখ বন্ধ । ভারকুয়েইলের কুকুর তাকে চাটতে এল । আমি ফিসফিসিয়ে বললাম, 'চলে যা এখান থেকে ।' তাকে পা দিয়ে ধাক্কা দিলাম, সে ল্যাজ নাড়াতে থাকল ।

একটি মহিলা আমার কনুইয়ের কাছে তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে এল । 'ছেলেগুলো কি খবরের কাগজের হকার ? ওরা কি খবরের কাগজ বিলি করা ছেলে ? ' জিগ্যেস করতে লাগল । আমি মাথা নাড়লাম ।

একটু অনিশ্চয়তার মধ্যে নীল পোশাকপরা লোকটা ছেলেদের পা দুটো আলাদা করে দিল । তার যা উচিত ছিল সেটা হল একজনের ভার অন্যজনের উপর থেকে সরানো । কারণ ভেকি নিচে পড়েছিল । সে তা করতে চাইছিল না, আমিও চাইছিলাম না সে করুক । কারণ উপরের ছেলেটা যেভাবে পড়েছিল, তাতে মনে হচ্ছিল, কিছু একটা খারাপ, অস্বাভাবিক কিছু একটা হয়েছে ।

মহিলাটি বলল, 'আমি গিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করি ।'

আমি ঝুঁকে ছেলেটার অসাড় হাতটা তুললাম । 'দাঁড়ান,' লোকটা বলল, 'আমাদের এখন খুব সাবধান হতে হবে ।'

আমি সোজা হতেই আমার মাথা এমন ভাবে ঘোরাতে থাকল যে চোখ বন্ধ করলাম । ছেলেটার কাঁধের নিচে হাত দিয়ে লোকটা আস্তে আস্তে ভেকির উপর থেকে নামিয়ে ফুটপাথে শুইয়ে রাখল । ভেকি চোখ খুলল ।

'ভেকি,' আমি শান্ত স্বাভাবিক স্বরে ডাকলাম, 'সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে ।' সম্পূর্ণ শান্ত দৃষ্টিতে সে আমার মিথ্যেটা বুঝে মিথ্যেটাকে চলতে দিয়ে আমাকে দেখল । আমি বললাম, 'অ্যাম্বুলেন্স আসছে ।'

তখন ফ্লোরেন্স এল, ছেলের পাশে হাঁটু গেড়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে আর্ত গলায় কথা বলতে লাগল । সে জড়ানো গলায় আস্তে আস্তে জবাব দিল । ফ্লোরেন্স শুনতে শুনতে আদর করা হাত থামাল । আমি বোঝালাম, 'ট্রাকের পেছনে  ধাক্কা লেগে ওরা পড়ে গেছে ।' নীল পোশাক পরা লোকটা বলল, 'এটা আমারই ট্রাক ।' আমি বললাম, 'পুলিশ ওদের ধাক্কা মেরেছে । ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর, অত্যন্ত ভয়ঙ্কর । এরা নিশ্চয়ই কালকের সেই পুলিশদুটো ।'

ফ্লোরেন্স ভেকির মাথার নিচে হাত দিল । সে আস্তে আস্তে উঠে বসল । একটা জুতো খুলে পড়েছে, ট্রাউজারের একটা পা ছিঁড়ে রক্তে ভিজে গেছে । খুব সতর্কভাবে প্যান্টের ছেঁড়া জায়গাটা সরিয়ে সে জখমটা  পরখ করল । তার হাতের তালুর চামড়াটা উঠে ঝুলছিল । আমি বললাম, 'অ্যাম্বুলেন্স আসছে ।' ফ্লোরেন্স বলল, ' আমাদের অ্যাম্বুলেন্স চাই না ।'

সে ভুল করছিল । অন্য ছেলেটা পিঠ মাটিতে করে লম্বা হয়ে শুয়ে । কলমিস্ত্রিটা তার জ্যাকেট দিয়ে ছেলেটার মুখের উপর থেকে পড়তে থাকা রক্তের ধারা মুছবার চেষ্টা করছিল । কিন্তু রক্ত কিছুতেই বন্ধ হচ্ছিল না । সে জ্যাকেটটা চেপে আবার তুলছিল, একমুহূর্তে সেটা রক্তে ভিজে লাল হয়ে যাচ্ছিল । আমি দেখলাম ওর কপালের উপরের মাংস ঢিলে হয়ে ভাগ হয়ে গেছে, যেন কোন কসাইয়ের ছুরির কোপ পড়েছে । ছেলেটার চোখ এবং চুলের উপর চাপচাপ রক্ত জমে গেছে, তারপর ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পেভমেণ্টে পড়ছে, সর্বত্র পড়ছে । রক্ত যে এত ঘন, এত গাঢ় রঙের, এত ভারি হয় আমার জানা ছিল না । তার হৃদয়টা কিরকম, যে এত রক্ত পাম্প করছে, এবং পাম্প করেই চলেছে ?

-------------------------------------------------------------------------------------------------------
ক্যানারি   :  একজাতীয় হলুদ পাখি

-------------------------------------------------------------------------------------------------------





কোন মন্তব্য নেই: