।। ধ্রুবজ্যোতি মজুমদার।।
একটা কথা প্রায়ই শুনা
যায় যে-ভারতবর্ষ এই বিশ্বের মধ্যে হিন্দু গরিষ্ঠ দেশ। তারপরও সেটা ধর্ম নিরপেক্ষ
রাষ্ট্র। বিপরীত দিকে বিশ্বে যতগুলি দেশই মুসলিম বহুল তার প্রত্যেকটিই
ইসলামিক দেশ বলে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, তার কোনোটাই ধর্ম-নিরপেক্ষ নয়। সনাতনী
আধ্যাত্মবাদের দৃষ্টিতে অনেকেই হয়ত সেটাকে সনাতন ধর্মীয় চরম উদারতার পরাকাষ্ঠা হিসাবেই বর্ণনা
ব্যাখ্যা দেবেন। সনাতন ধর্ম সর্বাবস্থায় সহাবস্থান সৌভাতৃত্ব ও সহনশীলতার
শিক্ষাই দেয়। তা বলে ইসলাম ও কিন্তু হিংসা ও তথাকথিত জেহাদের ধর্ম নয়।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। কিন্তু
প্রশ্ন হচ্ছে- প্রত্যেক ধর্মই যদি শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তাবাহক তাহলে ‘ধর্ম’-‘সাম্প্রদায়িকতা’-‘জেহাদ ’-‘মৌলবাদ’ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছই
আজকের দিনে বিশ্ব-রাজনীতির বিশেষ অস্ত্র কেনো? এমনটা নয় যে আমাদের সমাজপতিরা এই নিগুঢ় সত্য
জানেন না। শিক্ষিত সমাজ সবটাই জানেন বুঝেন। কিন্তু তারপরও স্বার্থপূরণের
বিভিন্ন রকমফেরের গ্যাঁড়াকলে নিত্যদিন অপব্যাখ্যার ঘি ঢেলে রক্তে আগুন জ্বালানোর খেলা
চলতেই আছে। মানুষকে মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে অনায়াসে নিজের ন্যস্ত
স্বার্থটুকু বের করিয়ে নেওয়ার এই খেলায় প্রতিনিয়ত যূপ-কাষ্ঠে চড়ছে হতভাগা সাধারণ
মানুষ।ওরা সাধারণত জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে জন্মেও মাথা ঘামায়নি। অথবা
সেই অবসর ও নেই ওদের জীবনে। ওদের পুরো দুনিয়াটা ওদের ছোট্ট পরিবার অবধিই সীমিত।
এর বাইরে কোনোকিছুই হয়ত কোনোদিন তেমন গুরুত্বই রাখেনি। অথচ মহামতি সমাজপতিদের
বুদ্ধির ঝড়ে হঠাৎ করেই একদিন তছনছ হয়ে যায় সেই ছোট্ট দুনিয়াটা। সে বাংলাদেশই হোক
অথবা হউক মায়ান্মার সিরিয়া আফগানিস্তান কাশ্মীর। বুদ্ধিজীবীর বুদ্ধির কাছে
হার মেনে রাম রহিমকে মারতে আসে। কুরুক্ষেত্র থেকে অনুপ্রাণিত উজ্জীবিত হয়
রাম ও কৃষ্ণরা। ধর্ম-যুদ্ধে যতটুকু নেশা প্রয়োজন ঠিক ততটাই নির্যাস অত্যন্ত
সুকৌশলে ভরে দেওয়া হয় সেইসব ধর্মযোদ্ধার রক্তে, বাকি সারটুকু ; ধর্মের মূল সার বস্তুটা ব্রাত্যই থেকে যায়।
অপরদিকে নির্যাতন নিপীড়নের
বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো তথা বিশ্বময় তথাকথিত বিধর্মী কাফেরমুক্ত একটা পরিবেশ
গড়ে তোলার ললিপপ ঝুলিয়ে কারবালার মাঠের স্মৃতি জাগরূক করে তোলা হয় রহিমের রন্ধ্রে
রন্ধ্রে। সেক্ষেত্রেও ধর্ম কোন তিমিরে বসে কাঁদে।
ক্ষেত্র-বিশেষে দেখা যায় এই
গোষ্ঠীবাজির আগুন ধরানো হাত অভিন্ন। উভয় দিকে একই হাত আগুন জ্বালে। আশ্চর্য!
আমাদের সমাজে যারা নিজেদেরকে বুদ্ধিজীবী অথবা সমাজ সচেতন নাগরিক বলে দাবি করেন ; সেই তাদের ভূমিকাটাই
সবচেয়ে আশ্চর্যজনক, বিপজ্জনক
ও বটে। নিমিষে রঙ
পাল্টানো বা অবস্থান পাল্টানোটা বুদ্ধিজীবীদের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাপড় পাল্টানোর মতো।
প্রচার মাধ্যমের শিরোনামে আসার জন্য অথবা সস্তা প্রচারের আলোকে আসার সুখ-স্বপ্নে
বিভোর এহেন ব্যক্তিত্বরা আলটপকা মন্তব্য করেই চলেন অহরহ। একবারও ভেবে দেখেন না
যে উনাদের এই অবিবেচক মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ার জের কতটুকু হতে পারে। কতটা আগুন
জ্বলতে পারে। আদতে সেসব ব্যাপারে উনারা ভাবতেই চান না।
এই জায়গায় নব্য সংযোজন হলো-
সোস্যাল মিডিয়া। ফেসবুক টুইটার ইত্যাদি আন্তর্জালীয় উপাদানের দৌলতে এখন শব্দের
গতির চেয়ে দ্রুত ছড়ায় আতঙ্ক। উত্তেজক পোষ্ট ও মন্তব্যে ছেয়ে আছে নেট-বিশ্ব।
যেকোনো পোষ্টের সত্যতা যাচাই এর আগেই ছেয়ে যায় অস্থিরতার বাদল। যে ব্যক্তি
বিতর্কিত মন্তব্য অথবা পোষ্ট করলেন উনি নিজেই বা কতটুকু গভীর চিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব
সেটা প্রায়শই বিচারে আসেনা। তার আগেই ছড়িয়ে পড়ে বিষবাস্প। নিকট অতীতেই আমরা এর অনেক
বাস্তব উদাহরণ দেখেছি। রাম-শ্যাম-যদু-মধু যে কেউ আজ পারে সম্প্রীতিতে চির ধড়াতে, অথবা যেকোনো
ব্যাপারকে একটা আজব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করে একটা উদ্ভট ও কিম্ভুতকিমাকার
মতামত জাহির করতে। লহমায় নাড়িয়ে দিতে পারে জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক
সমাজের ভীত।
আর এই সুযোগ হাতছাড়া করতে
চান না কিছু মানবতার ভেকধারী উভচর বুদ্ধিজীবী মহল। যাদের কথায় আর কাজে ন্যূনতম
মিল নেই। ওদের ভাষ্য ও চরিত্রে দুই মেরুর দূরত্ব। যদিও মানবিকতার ধ্বজা যারা বহন
করেন তাদের একটাই আদর্শ ও গন্তব্য হওয়া উচিত, কিন্তু বাস্তবে চিত্র তার উল্টো।
নিজেকে নিরপেক্ষতা ও মানবিকতার উপাসক পরিচয় প্রদানকারী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও আবার
অজস্র শাখা প্রশাখা কেনো থাকতে যাবে? মানবিকতার পরিভাষা কি স্থান-কাল-পাত্র
বিবেচনায় বদলে যায়?! দলবাজি
গোষ্ঠীবাজির মধ্যে পেঁচিয়ে থাকাটা কি কোনো অবস্থাতেই একজন মুক্তমনার লক্ষণ বলে বিবেচিত
হতে পারে?
এই জাতীয় ভণ্ডদের
দৌরাত্মই সমাজের জন্য সবচেয়ে বড় আতঙ্ক। পরমাণু অস্ত্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর। ওদের
প্রত্যেকেরই একটা নিজস্ব অভিধান রয়েছে। যেহেতু এটা ( ভারতবর্ষ ) হিন্দু বহুল রাষ্ট্র তাই
কোনো কোনো নিরপেক্ষ (!) বুদ্ধিজীবীর কাছে হিন্দুত্বের বিরোধিতা করাটাই নিরপেক্ষতা বলে
বিবেচিত হয়। এবং এটা করতে গিয়ে উনি যদি ইসলামের কিছু অন্যায়কেও প্রশ্রয়ের
চোখেও দেখেন তাতেও কিছু আসে যায় না। নিরপেক্ষ মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকেই
আছেন যারা ইসলামের অপব্যবহারের বিরোধিতা করেন বটে কিন্তু কট্টর হিন্দুত্বের
বিরুদ্ধে তেমন বলতে দেখা যায় না। অথচ এরা সকলেই নিজেদেরকে সেকুলার পরিচয় দিতেই
অভ্যস্ত।
একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী
আছেন যাদের চোখে শুধু ইসলামী মৌলবাদই ঠেকে। যেন তেন প্রকারেণ ইসলাম মানেই সন্ত্রাস
এটা প্রতিপন্ন করাটাই ধ্যান জ্ঞান, তদ্রূপ একশ্রেণির কাছে হিন্দুত্বটাই সন্ত্রাস।
কেউ যতই নিজেকে গোঁড়া হিন্দু
অথবা গোঁড়া মুসলমান অথবা খ্রিষ্টান বলুক না কেনো আদতে সে যে কোনো ধর্মেরই অন্তর্ভুক্ত
নয় সেটা ওর কার্যকলাপেই স্পষ্ট ধরা দেয়। কারণ মানবতা সহনশীলতাকে বাদ
দিয়ে কোনো ধর্ম অথবা সম্প্রদায় হতেই পারেনা। অসহিষ্ণুতা কখনই সুস্থ সমাজ বা ধর্মের
অঙ্গ নয়।
গোঁড়ামিকে কোনোকালেই
নৈতিক ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি।
গোঁড়ামিকে হয়ত প্রতিহত করা
যেতে পারে। ধর্মের যথাযথ ব্যাখ্যা ও সঠিক অনুশীলনের মাধ্যমে সেটা সম্ভব। কিন্তু
পক্ষপাতদুষ্ট সেকুলারিজম কে এবং ওই জেগে ঘুমানো স্বার্থান্বেষীদের প্রতিহত করাটাই
আজকের দিনে বড় চ্যালেঞ্জ। যতদিন বিবেকের ঘুম না ভাঙানো যায় ততদিন ISIS আল-কায়দার মতো কট্টরবাদের
নব্য নব্য রূপে আবির্ভাব হতেই থাকবে। “মাদ্রাসা
মানেই সন্ত্রাসের আঁতুড় ঘড়”
এবং “হিন্দু মানেই শিবসেনা অথবা
বজরংগী” এমন
ধারণাই পত্রে পুষ্পে ফলে বিকশিত হতেই থাকবে। আর এর পুরো কৃতিত্বের দাবিদার হবেন
তথাকথিত শিক্ষিত সুশীল সমাজ, যারা নিজেদেরকে বুদ্ধিজীবী পরিচয় দিয়ে গর্বে ফুলে
উঠেন। রাজনেতাদের চেয়েও অধিক কৃতিত্বের দাবীদার হবেন উনারা।
তথাকথিত সেকুলার সমাজের
এটা মনে রেখে চলা উচিত যে- একজন হিন্দু হয়ে ইসলামকে সমর্থন করা অথবা মুসলিম
হয়ে হিন্দুত্বকে সমর্থন করাটাই নিরপেক্ষতা নয়, এটাও পক্ষপাতিত্ব। প্রত্যেক গোষ্ঠী-
সম্প্রদায়ের মধ্যে থাকা মানবিক উপাদান গুলিকে সমর্থন করা এবং অমানবিক যাবতীয় কিছুকে
জাতি বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে বর্জন ও প্রতিহত করাটাই যথার্থ নিরপেক্ষতা। তবেই একটা
সুস্থ-ভারসাম্যতাপূর্ণ-নিরপেক্ষ সমাজ আশা করা যেতে পারে।
আমরা যদি নিজের নাম পদবী জাতির পর নিজেকে কোনো না কোনো
অবস্থায় ‘মানুষ’ বলে পরিচয় দেই
তবে মানবিকতাই কি মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন