“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

সোমবার, ২৩ নভেম্বর, ২০১৫

আয়স কাল ১০




 

(দক্ষিণ আফ্রিকীয় লেখক জে এম কোয়েটজি-র লেখা 'এজ অব আয়রন'- উপন্যাসের  বাংলা অনুবাদের দশম ভাগ । এই উপন্যাসের  ষষ্ঠ পোস্ট "ফ্লোরেন্স ফিরে এসেছে-----" থেকে দ্বিতীয় অধ্যায়ের শুরু এই অধ্যায়ে ইতিপূর্বে চারটি পোস্ট এখানে প্রকাশিত হয়েছিল । আজ এই  পুরো অধ্যায়ের শেষাংশ দেওয়া হল । --শিবানী দে)

(C)Image:ছবি

প্লাম্বার বলল, “অ্যাম্বুলেন্স কি আসছে ? আমি জানিনা কিভাবে এই রক্ত বন্ধ করব ।তার শরীর ঘামছিল । সে বসার ভঙ্গি বদল করল, তার রক্তে ভেজা জুতো চটচট করছিল ।
মনে আছে, তোমার যখন এগারো বছর বয়স, একবার রুটি কাটার মেশিনে তুমি তোমার বুড়ো আঙ্গুল কেটে ফেলেছিলেআমি তোমাকে নিয়ে গ্রূট শূর হাসপাতালে ইমার্জেন্সি বিভাগে নিয়ে গিয়েছিলাম । আমরা আমাদের পালা আসবার জন্য বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছিলাম । রক্ত বন্ধ করার জন্য তোমার বুড়ো আঙ্গুল  লিণ্ট কাপড়ে শক্ত করে বাঁধা । তুমি ফিস ফিস করে বলেছিলে, “আমার কি হবে ?” আমি ও ফিস্‌ফিস করে বলেছিলাম, “ওরা তোমাকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে জায়গাটা সেলাই করে দেবে । কয়েকটা মাত্র সেলাই, কয়েকটা ফোঁড়, ভয় পেয়ো না ।
সেটা ছিল এক শনিবার বিকেল, কিন্তু হাসপাতালে ক্যাজুয়েল্টি বিভাগে অনবরত রুগী আসছিল । সাদা জুতো ও কালো কোঁচকানো স্যুট পরা একটা লোক একটা থালায় অনবরত রক্ত থুথু ফেলছিল । স্ট্রেচারে করে এল একটা যুবক,তার ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, বেল্ট খোলা, পেটের উপর ভেজা কাপড় ভাঁজ করে রাখা । মেঝেয় রক্ত, বেঞ্চগুলোতেও রক্তআমাদের এই একটুখানি রক্ত এই কালো রক্তের স্রোতের মধ্যে কি গণ্য হবার যোগ্য ? শিশু বরফবিন্দু এই বিশাল রক্তগুহায় হারিয়ে যাবে, তার মা ও হারিয়ে যাবে । প্রচুর রক্তপাতে অভ্যস্ত এই দেশ । হলুদ অয়েলস্কিনের পোশাক ও বুট পরা ফ্লোরেন্সের স্বামী রক্তের মধ্য দিয়ে হাঁটছে ষাঁড়গুলো খুটির সঙ্গে উলটো করে বাঁধা, তাদের গলা কাটা, কাটা গলা থেকে তিমির ফোয়ারার মত ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটাচ্ছে শুকনো পৃথিবী তার জীবের রক্ত শুষে নিচ্ছে । এমন দেশ যে রক্তের নদী শুষে নেয়, তবু তৃপ্ত হয় না ।
আমি মিস্ত্রিকে বললাম, “আমাকে করতে দাও ।সে জায়গা ছেড়ে দিল । নিচু হয়ে আমি রক্তে ভেজা জ্যাকেটটা সরালাম, রক্ত ছেলেটার মুখের উপর দিয়ে সমানভাবে একটা চাদরের মত হয়ে পড়তে লাগল অঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনীর সাহায্যে আমি যতদূর সম্ভব শক্ত করে খোলা কাটা জায়গাটা চেপে ধরলাম । ভারকুয়েইলের কুকুরটা আবার ঠেলে কাছে চলে এলো । আমি বললাম, “কুকুরটাকে তাড়াও । লোকটা ওকে এক লাথি মারল ।  কুকুরটা কেঁউকেঁউ করে সরে গেল । ভারকুয়েইল কোথায় ? সে কি সত্যি কোনো কম্মের নয় ? আমি প্লাম্বারটাকে আদেশের সুরে বললাম, “যাও, এবং আবার ফোন কর ।যতক্ষণ পর্যন্ত আমি জখমটা শক্ত করে চেপে রাখতে পারছিলাম, রক্তপড়া রুখতে পারছিলাম । কিন্তু একটা ঢিলে হলেই আবার পড়তে শুরু করছিল । এ তো রক্ত, এ ছাড়া আর কিছু নয়, তোমার ও আমার রক্তের মতই রক্ত । তবুও এর আগে আমি এত লাল ও এত কালো দেখিনি । হয়তো এটা চামড়ার গুণে, যে চামড়া তরুণ, নরম, কালো মখমলের মত; তবুও আমার হাতে তা সাধারণ রক্তের থেকেও যেন বেশি উজ্জ্বল ও বেশি কালচে দেখাচ্ছিল । আমি ভীত, মন্ত্রমুগ্ধ বিবশ হয়ে তার থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না । তবুও আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকেই এই রক্তধারা বন্ধ করাতে উদাসীন থাকা, ঢিলে দেওয়া বা বিরত থাকা অসম্ভব, প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব ছিল । কেন ? আমি এখন নিজেকে প্রশ্ন করি । উত্তর পাই, যে রক্ত মূল্যবান, সোনা ও হিরে থেকেও বেশি মূল্যবান । রক্ত হল এক : রক্ত হল জীবনের হ্রদ যা আমাদের আলাদা আলাদা অস্তিত্বের মধ্যে পৃথক হয়ে আছে, কিন্তু সমস্ত রক্ত মিলিয়ে প্রকৃতির সম্পদ, প্রকৃতি আমাদের ধার দিয়েছে, দান দেয়নি : সামূহিকভাবে দেওয়া, এই বিশ্বাসে দেওয়া যে তাকে রক্ষা করতে হবে : মনে হচ্ছে যে আমাদের ভেতরে রক্ত বাস করছে, কিন্তু আসলে আমরাই তার মধ্যে জীবনধারণ করছি ।
এই রক্তের সাগর, যখন সমস্ত একসঙ্গে বেরোবে, তখনই কি শেষের দিন আসবে ? একসাথে সকলের রক্ত: শীতের সাইবেরিয়ার নীল আকাশের নিচে কালচে লাল বৈকাল সাগর, তার আশেপাশে তুষারাবৃত পাহাড় চুড়ো, তার বরফঢাকা তট সব রক্তরসে পিচ্ছিল, চটচটে । সমস্ত মানব-রক্ত একসাথে হলে কি এইরকমই হবে, একটা রক্তের আয়তন । সমস্ত মানুষের রক্ত ? না, একটা জায়গা বাদ দিয়ে । কারুতে জ্বলন্ত সূর্যের নিচে মাটির তৈরি মোটা পুরু দেওয়ালের উপর কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা জায়গা, যেখানে আফ্রিকানাররা ও তাদের ধ্বজাবাহীদের আবদ্ধ জলাশয়ের মত পঙ্কিল রক্ত বিরাজ করে ।
রক্ত পবিত্র, অথচ ঘৃণিত । আর তুমি, আমার মাংসের মাংস, আমার রক্তের রক্ত, প্রতি মাসে বিদেশভূমিতে তোমার রক্তপাত হচ্ছে ।
গত কুড়িবছর আমার মাসিক রক্তপাত হয়নি । যে অসুস্থতা আমাকে এখন কুরেকুরে খাচ্ছে, তা শুষ্ক, রক্তহীন, ধীর এবং শীতল, যেন শনিগ্রহ দ্বারা প্রেরিত । এর মধ্যে কি একটা যেন আছে যা ঠিক চিন্তার অধিগম্য নয় । সেইসব বর্ধমান, ঠাণ্ডা, অশ্লীল, ফোলা বস্তুগুলোকে দিয়ে যেন গর্ভবতী হওয়া । সেই বস্তুগুলোকে অস্বাভাবিক, অনির্দিষ্ট কালের জন্য বহন করতে থাকা, করতে থাকা, একসময় বইতে অপারগ হয়ে ওঠা, তাদের ক্ষুধা মিটাতে অসমর্থ হওয়া : এমন সন্তান যে যে আমার ভেতর খেয়ে ফেলছে প্রতিদিন, কিন্তু বাড়ছে না, ফুলছে, নখদন্তযুক্ত চিরকালের শীতল অথচ প্রচণ্ড বুভুক্ষু । শুষ্ক, শুষ্ক : আমার শুকনো শরীরের ভেতরে তাদের চলমানতা বোধ করা, সাধারণ মনুষ্যভ্রূণ যেভাবে মাতৃগর্ভে আড়মোড়া ভাঙ্গে, লাথি মারে, তা নয়, কিন্তু নিত্য নিত্য তার অবস্থিতি  পরিবর্তন করে নতুন জায়গা খুঁজে আরো কুরিয়ে কুরিয়ে খাবার জন্য, যেভাবে পোকার ডিম তার আশ্রয়দাতার ভেতরে ফুটে শূককীট হয়ে যায়, তারপর তা আশ্রয়দাতাকেই ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলে আমার ডিম আমার ভেতরেই জন্মেছে । আমি’, ‘আমারকথাগুলো লিখতেই আজকাল গা শিউরে ওঠে, তবুও তা সত্য ওরা আমার মৃত্যুরূপী কন্যা, তোমার বোনেরা, আর তুমি আমার জীবনরূপী কন্যা । মাতৃত্বের যখন এইরকম ব্যঙ্গাত্মক প্রকাশ হয়, তখন ব্যাপারটা কত ভয়ঙ্কর একটা হাড়জিরজিরে বুড়ি একটা ছেলের কাছে গুটি মেরে বসে আছে, তার হাত ছেলেটার রক্তে আঠা হয়ে গেছে : কি কুশ্রী ঠেকছে এই ছবিটা ! অনেক দিন তো বাঁচলাম, এখন আগুনে পুড়ে মরাটাই একমাত্র সম্মানের মৃত্যু । সোজা আগুনের মধ্যে ঢুকে পড়া, অঙ্গারের মত জ্বলে ওঠা, ভেতরের লুকোনো ভাগিদারগুলোও ভয়ে কুঁকড়ে  তাদের কখনো ব্যবহার না করা ক্ষীণ স্বরে কাঁদুক : জ্বলুক আর চিরতরে চলে যাক, দুনিয়া পরিষ্কার হোক । রাক্ষুসে, ভুলজন্মা জিনিষ । ওরা শুধু এটাই প্রমাণ করে যে কেউ কারো বাঁচামরার নিয়ম ঠিক করতে পারে না । এই দেশটারও আগুনে যাবার সময় হয়েছে, সময় হয়েছে সমাপ্তির, ভস্ম থেকে যেমনই হোক, কিছু একটা পুনরুত্থানের ।
অ্যাম্বুলেন্স যখন এল, আমার শরীর এত অসাড় হয়ে গিয়েছিল যে আমাকে তুলে দাঁড় করিয়ে দিতে হল । জখম থেকে আঠা হয়ে যাওয়া আঙ্গুলগুলো সরাতেই জখমটা আবার খুলে গেল । ওর অনেক রক্তপাত হয়েছে ,” আমি বললাম । খুব গুরুতর জখম নয়,” অ্যাম্বুলেন্সের লোকটা চাঁচাছোলা বলল । সে ছেলেটার চোখের পাতা খুলল । অজ্ঞান হয়ে আছে,” সে জিগ্যেস করল, “কিভাবে এটা হল ?’”

ভেকি বিছানায় বসেছিল, তার ট্রাউজার্স খোলা, হাতদুটো এক গামলা জলে । ফ্লোরেন্স তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার পা ব্যান্ডেজ করছিল
তুমি কেন ওকে দেখার জন্য আমাকে একা ছেড়ে এলে ? তুমি কেন একটু দাঁড়িয়ে আমাকে সাহায্য করলে না ?”
আমার গলা ঝগড়াটে শোনাচ্ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু আমি কি এবারে ঠিক কথা বলছিলাম না ?
ফ্লোরেন্স বলল, “আমি পুলিশের ঝামেলায় জড়াতে চাই না ।
কিন্তু এটা তো প্রশ্ন নয় । তুমি তোমার ছেলের বন্ধুকে দেখাশোনা করতে আমাকে একা ফেলে এলে । ওকে দেখবার জন্য আমি থাকব কেন ? ও তো আমার কেউ  নয় ।
ভেকি জিগ্যেস করল, “সে কোথায় ?”
ওরা তাকে নিয়ে উডস্টক হাসপাতালে গেছে । সে কন্‌কাস্‌ড্‌ ।
কন্‌কাস্‌ড্‌ মানে কি ?”
সে অজ্ঞান হয়ে আছে, তার মাথায় লেগেছে । তুমি কি জান তোমরা কীজন্য পড়লে ?”
সে বলল, ওরা আমাদের ধাক্কা মেরেছিল ।
হ্যাঁ, ওরা তোমাদের ধাক্কা মেরেছিল । আমি নিজেও দেখেছি । বেঁচে গেছ তোমরা, ভাগ্য ভাল । আমি একটা কমপ্লেন করব ।
ভেকি ও তার মা চোখাচোখি করল । আমরা পুলিশের ব্যাপারে জড়াতে চাই না,” ফ্লোরেন্স আবার বলল। আবার তাদের চোখাচোখি, যেন ছেলের সম্মতি আছে কি না সে যাচাই করে নিচ্ছে ।
তোমরা যদি নালিশ না কর, তাহলে ওরা এইরকম ব্যবহার করতেই থাকবে । হয়তো নালিশ করলে কিছুই হবে না, তবু তোমার ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেই হবেআমি শুধু পুলিশের কথা বলছি না । আমি বলছি ক্ষমতায় থাকা লোকেদের কথা । ওদের দেখাতে হবে তুমি ভয় পাওনি । এটা একটা গুরুতর ব্যাপার । ভেকি, ওরা তোমাকে মেরে ফেলতেও পারত । তোমার বিরুদ্ধে ওদের কি বলার আছে ? তুমি ও তোমার সেই বন্ধু এমন কি করেছ ?”
ফ্লোরেন্স ব্যান্ডেজটা পায়ের দুপাশ দিয়ে ঘুরিয়ে গিঁট দিল, তারপর মৃদুস্বরে ভেকিকে কিছু একটা বলল । সে গামলা থেকে হাতদুটো তুলল । একটা অ্যান্টি-সেপ্টিকের গন্ধ পাওয়া গেল ।
আমি বললাম, “ঘায়ে কি খুব লাগছে ?”
সে হাতের তেলো চিত করে ধরল । চামড়া উঠে গিয়ে মাংস বেরিয়ে গেছে, তা থেকে এখনও রক্ত বেরোচ্ছে । সম্মানের জখম ? এই যে ক্ষত, এটা কি সম্মানজনক, যোদ্ধার ক্ষত হিসেবে ধরা হবে ? আমরা দুজনে রক্তবেরোনো হাতটা দেখতে থাকলাম । আমার মনে হল সে যেন চোখের জল সংবরণের চেষ্টা করছে । একটা শিশু, শিশুর চেয়ে বড় বলা চলে না, যে সাইকেল চড়ে খেলছিল
আমি বললাম, “তোমার যে বন্ধু, তার বাবা-মাকে জানানো কি উচিত হবে না ?”
ফ্লোরেন্স বলল, “আমি ফোন করতে পারি ।
ফ্লোরেন্স টেলিফোন করল, উচ্চকণ্ঠে, অনেক ক্ষণ ধরে । উডস্টক হাসপাতাল, আমি শুনছিলাম ।
কিছুক্ষণ পর পাবলিক টেলিফোন থেকে একজন মহিলা ফ্লোরেন্সকে চাইল ।
ফ্লোরেন্স জানাল সে হাসপাতালে নেই ।
আমি জিগ্যেস করলাম, “ওর মা কি ?”
ওর দিদিমা ।
আমি উডস্টক হাসপাতালে ফোন করলাম । তোমরা হয়তো তার নাম জানবে না, কারণ সে হাসপাতালে ভর্তির সময় অজ্ঞান ছিল ।
লোকটা বলল, “এরকম কোন রুগীর রেকর্ড নেই ।
ওর কপালে একটা বড় জখম ছিল ।
না, কোনো রেকর্ড নেই লোকটা পুনরাবৃত্তি করল । আমি ছেড়ে দিলাম ।
ভেকি বলল, “ওরা পুলিশের সঙ্গে মিলে কাজ করে । ওরা সব একই, অ্যাম্বুলেন্স , ডাক্তার, পুলিশ
এসব বাজে কথা ,” আমি বললাম ।
আজকাল কেউ অ্যাম্বুলেন্সকে বিশ্বাস করে না । তারা রেডিওতে সব সময় পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে থাকে ।
বাজে কথা ।
আমাকে একটা লেকচার ঝাড়তে পেরে, বাস্তব জীবনের কথা বলতে পেরে সে বেশ একটা পরিতৃপ্তির মিষ্টি হাসি হাসল । আমি, আমি তো সেই বুড়ির মত, যে জুতোর ভেতরে থাকত, আর যার কোনো ছেলেমেয়ে নেই, যে কি করবে ভেবে পায় না। এটাই ঘটনা,” সে বলল, “শুনবার চেষ্টা কর, শুনতে   পাবে ।
কিন্তু পুলিশ কেন তোমার পিছু নিয়েছে ?”
ওরা আমার পেছনে আসছে না, ওরা সকলেরই পেছনে আছে । আমি কিছুই করি নি । কিন্তু যাকেই দেখে ওরা ভাবছে স্কুলে যাচ্ছে না কেন, তাকেই ধরতে চেষ্টা করছে । আমরা কিছুই করি না, শুধু বলি, আমরা স্কুলে যাচ্ছি না । এখন তারা আমাদের এই ভাবে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে । ওরা সন্ত্রাসবাদী ।
তোমরা স্কুলে যাও না কেন ?”
স্কুল কিসের জন্য ? এই বর্ণবৈষম্যবাদের পক্ষে আমাদের উপযুক্ত করে তোলার একটা ব্যবস্থা ।
মাথা নেড়ে আমি ফ্লোরেন্সের দিকে ফিরলাম । তার মুখে একটা হাসি লেগেছিল যা সে লুকোনোর চেষ্টা করল না তার ছেলে তর্কে জয়ী হয়েছে । ঠিক আছে, হতে দাও । আমি তাকে বললাম, “আমি এইসব ব্যাপারের পক্ষে অনেক বুড়ো হয়ে পড়েছি । আমি বিশ্বাস করতে পারি না তুমি তোমার ছেলেকে যতদিন না বর্ণবৈষম্যবাদ শেষ হয় ততদিন পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় সময় নষ্ট করতে দিতে চাইছ । বর্ণবৈষম্য কাল বা পরশুর মধ্যে শেষ হবার নয়সে তার জীবন নষ্ট করছে ।
কোনটা বেশি দরকারি, বর্ণবৈষম্যবাদ ধ্বংস হওয়া না আমার স্কুলে যাওয়া ?” ভেকি আমাকে চ্যালেঞ্জ করে তর্কে বিজয়ী হবার লক্ষ্যে জিগ্যেস করল ।
আমি সাবধানে বললাম, “দেখো, এটা কোনো পছন্দের ব্যাপার নয় ।কিন্তু আমার কথাটাই কি ঠিক  ? এটা যদি পছন্দের বিষয় না হয়, তাহলে কি পছন্দের বিষয় হবে ? আমি বললাম, “আমি তোমাদের নিয়ে উডস্টক হাসপাতালে যাব । তাহলে আমাদের এক্ষুনি বেরোতে হবে ।
যখন ফ্লোরেন্স ভারকুয়েইলকে অপেক্ষা করতে দেখল, তখন সে সঙ্কুচিত হয়ে গেল । কিন্তু আমি জেদের সাথে বললাম, “ওকে আসতে হবে, কারণ আমার গাড়ি চালু করতে অসুবিধে হতে পারে ।
তাই আমি তাদের নিয়ে উডস্টকে গেলাম, ভারকুয়েইল আমার পাশে, গায়ে আগের চাইতেও বেশি দুর্গন্ধ, কিছুটা বিষণ্ণ ও । ফ্লোরেন্স ও ভেকি চুপচাপ পেছনে বসে । গাড়িটা হাসপাতালে ওঠার ঢালু পর্যন্ত ঊঠালাম, মনে পড়ে গেল যে উঁচুতে উঠবার আগেই গাড়ি থামানো ভাল ।
ডেস্কের লোকটা বলল, “আমি তোমাদের তো বললামই, এরকম কেউ এখানে ভর্তি হয় নি । আমার কথা বিশ্বাস না হলে  ওয়ার্ডগুলোতে গিয়ে দেখো ।
যেহেতু আমি ক্লান্ত ছিলাম, পুরুষদের ওয়ার্ডে ফ্লোরেন্স ও ভেকির পিছু পিছু কোনোরকমে চলছিলাম । তখন ছিল বৈকালিক ঘুমের সময় । বাইরের কোনো গাছ থেকে ঘুঘুপাখি ডাকছিল । সেই ওয়ার্ডে কোনো মাথায় ব্যান্ডেজ কালো ছেলে চোখে পড়ল না , শুধু পাজামা পরা সাদা পুরুষ মানুষরা ছাদের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল । রেডিওতে গান বাজছিল আমার গোপন ভাইয়েরা, আমি ওদেরই সমাজের লোক ।
ওরা যদি এখানে নিয়ে না আসে তাহলে কোথায় নিয়ে যেতে পারে ?” আমি ডেস্কের লোকটাকে জিগ্যেস করলাম ।
গ্রূট শূর হাসপাতালে চেষ্টা কর ।
গ্রূট শূর হাসপাতালের পার্কিং ছিল একেবারে ভর্তি । আধঘণ্টা পর্যন্ত আমরা চালু ইঞ্জিন নিয়ে গেটে বসে থাকলাম ফ্লোরেন্স ও তার ছেলে নিজেদের মধ্যে আস্তে আস্তে কথা বলছিল, ভারকুয়েইল শূন্য দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল, আমি হাই তুলছিলাম । দক্ষিণ আফ্রিকার এক নিদ্রালু সপ্তাহান্ত, যেন এক পরিবার বেড়াতে বেরিয়েছে । আমরা শব্দ তৈরি করার খেলা খেলতে পারতাম, কিন্তু বাকি তিনজন কি এই খেলায় যোগ দিতে পারবে ? শব্দের খেলা হল একটা পুরোনো খেলা, সেই সময়কার, যার স্মৃতি এখনো আমার মনে পড়ে, যখন সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণী রবিবার হলেই একটা সুন্দর জায়গা থেকে আরেকটা সুন্দর জায়গায় ঘুরে বেড়াত, বিকেল শেষ করত পশ্চিম সমুদ্রের সুন্দর দৃশ্য যেখান থেকে দেখা যায় সেইরকম কোনো চা খাবার জায়গা থেকে, চা খেত, আর খেত স্কুন, স্ট্রবেরি জ্যাম  আর ক্রিম সহযোগে ।
একটা গাড়ি বেরোল, আমরা ঢুকলাম । ভারকুয়েইল বলল, “আমি এখানেই থাকব ।
আমি ক্লার্ককে জিগ্যেস করলাম, “আঘাত পেয়ে অজ্ঞান রুগিকে কোথায় নেওয়া হয় ?”
নিচে ভিড়জমা করিডরে আমরা ওয়ার্ড নং সি-৫ খুঁজতে থাকলাম। লিফটে চারজন বোরখাপরা মুসলিম মহিলা খাবারের থালা নিয়ে যাচ্ছিল, আমরা তাদের সঙ্গে ঠেসাঠেসি করে উঠলাম । ভেকি তার ব্যান্ডেজকরা হাতদুটোর জন্য বিব্রত বোধ করছিল, তাই পেছনে লুকিয়ে রাখছিল । সি-৫ এর পর সি-৬ আমরা দেখলাম, কিন্তু ছেলেটার দেখা পেলাম না  ফ্লোরেন্স একজন নার্সকে থামাল । সে বলল, “নতুন তৈরি অংশের দিকে দেখ ।আমার শক্তি নিঃশেষিত, মাথা নাড়লাম , “আমি আর চলতে পারছি না,” আমি বললাম । তুমি ও ভেকি যেতে থাক । তোমাদের সঙ্গে গাড়িতে দেখা হবে ।
এটা সত্যি যে আমি ক্লান্ত ছিলাম, আমার পেছনটা ব্যথায় টনটন করছিল । আমার হৃদ্‌পিণ্ড ধুক ধুক করছিল, মুখে একটা তেতো ভাব । কিন্তু তার চাইতেও বেশি কিছু ছিল । আমি হঠাৎ একই দিনের মধ্যে অনেক বেশি অসুস্থ লোক দেখে ফেলেছিলাম । এরা আমাকে নিপীড়ন করছিল, বিভীষিকা দেখাচ্ছিল । কালো এবং সাদা, পুরুষ এবং নারী করিডরে যাতায়াত করছিল, প্রত্যেকে প্রত্যেকের দিকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল, আমাকেও দেখছিল, মনে হচ্ছিল আমার মধ্যে মৃত্যুর গন্ধ পেয়েছেওরা যেন ফিস্‌ফিস করে বলছিল, “ভণ্ড ছদ্মবেশী ।আমাকে যেন ওরা হাত ধরে টেনে বের করে দেবে । তুমি এখানে যেমন খুশি আসতে যেতে পার ? তুমি কি নিয়ম জান না ? এটা হল ছায়াময় বাড়ি যার মধ্যদিয়ে ভুগতে ভুগতে তুমি মৃত্যুর দিকে যাবে । এই দণ্ড সব মানুষের উপরই আজ্ঞা করা আছে । ফাঁসির আগের বন্দিদশা ।বুড়ো কুকুররা করিডর পাহারা দিচ্ছে, যাতে দণ্ডিতরা কেউই যাতে হাওয়াতে, আলোতে, কিংবা উপরের সমৃদ্ধ বিশ্বে আবার পালিয়ে যেতে না পারে। এই স্থানটা নরক, আমি একটা পলাতক ছায়া । দরজা দিয়ে যেতে যেতে আমার শরীর শিউরে উঠল ।
নীরবে আমরা গাড়িতে অপেক্ষা করতে থাকলাম, ভারকুয়েইল আর আমি যেন অনেকদিনের বিবাহিত দম্পতি দুজনের মধ্যে কথা বন্ধ, বদ্‌মেজাজি । আমি তার গায়ের গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি, আমি ভাবলাম । দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটির প্রতিও কি আমার মনোভাব এইরকম, ভালোবাসিনা, কিন্তু তার বাজে গন্ধে অভ্যস্ত ? বিবাহ তো ভাগ্য, আমরা যেরকম বিয়ে করি, সেরকমই হয়ে যাই । আমরা যারা দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটিকে বিয়ে করেছি, দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী হয়ে গেছি ----কুৎসিত, বিষাদগ্রস্ত , উদ্যমহীন, জীবনের একমাত্র চিহ্ন হল যখন আমাদের মেজাজ খারাপ হয়, তখন বিষদাঁত বেরিয়ে পড়ে । দক্ষিণ আফ্রিকা : একটা বদ্‌মেজাজি বুড়ো কুকুর দরজার কাছে বসে ঝিমোয়, মরবার অপেক্ষা করে । দেশের পক্ষে একটা কি নিরুদ্যমকারী নাম আশা করা যাক যখন এরা নতুন আরম্ভ করবে তখন নামটা পাল্টাবে ।
একদল নার্সের শিফট শেষ হয়ে গেছে, ওরা হাসতে হাসতে খুশিমনে বেরিয়ে গেল । আমি ভাবলাম, আমি ওদের সেবা, ওদের পরামর্শ এতদিন পরিহার করার চেষ্টা করেছি । এখন মনে হচ্ছে, নিজেকে ওদের হাতে সঁপে দিলেই আরাম পেতাম । পরিষ্কার চাদর, আমার শরীরের নিচে ওদের চটপটে হাত, ব্যথার থেকে আরাম, অসহায়তা থেকে মুক্তি----আমি কি কারণে আত্মসমর্পণ করি না ? গলার মধ্যে একটা দলাপাকানো টের পেলাম, চোখ জলে ভরে যাচ্ছে, আমি মুখ অন্যদিকে ফেরালাম । নিজেকে প্রবোধ দিলাম----এ ইংল্যান্ডের আবহাওয়ার মত---- ছোট একপশলা বৃষ্টি । কিন্তু সত্যটা হল যে আমি আজকাল অনেক সহজেই অনেক সময়েই লজ্জার বালাই না রেখে কাঁদি । আমি একজন মহিলাকে জানতাম (তুমি কি তোমার মা এখন যেসব কথা বলতে যাচ্ছে তার জন্য কি কিছু মনে করবে ?) যার যৌনতৃপ্তি খুব তাড়াতাড়ি এসে যেত । সে বলত, যৌনতৃপ্তির ছোট ছোট শিহরণ ওর শরীরকে ছোট ছোট  জলের ঢেউয়ের মত অনুভূতি এনে দিতআমি আশ্চর্য হয়ে ভাবি, আমি যদি এই রকম শরীরে বাঁচতাম ? জলের মত শরীর হয়ে যাওয়া : এটা কি কোনো শান্তি ? এখন আমার একরকম উত্তর আছে---- এই কান্নার পশলার মধ্যে, এই লবণজলের ধারার মধ্যে । চোখের জল----দুঃখের নয়, বিষাদের । একটা অল্প, চঞ্চল বিষণ্ণতা : নীল, কিন্তু ঘন নীল নয় : বরং পরিষ্কার শীত-দুপুরের দূর আকাশের হালকা নীল । একটা নিজস্ব ব্যাপার, মনের হ্রদের চাঞ্চল্য উপচে পড়া, যাকে আমি লুকোনোর কমই চেষ্টা করি ।
আমি চোখ মুছলাম, নাক ঝাড়লাম । ভারকুয়েইলকে বললাম, “তোমার বিব্রত হবার দরকার নেই। আমি কোনো কারণ ছাড়াই কাঁদি । ধন্যবাদ যে তুমি আমার সঙ্গে এসেছ ।
সে বলল, আমাকে তোমার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না ।
সব সময় একা থাকা কঠিন । এটাই হল কথা । আমি তোমাকে চেয়ে আনিনি, কিন্তু তুমি নিজেই এসেছ, এবং এরকমই ঘটেছে, তুমি এসেছ । এ যেন একটা শিশুর জন্ম দেওয়ার মত । তুমি শিশুটাকে পছন্দ করে আনতে পার না । সে এসে যায় ।
সে অন্যদিকে তাকিয়ে একটা মৃদু, চতুর হাসি হাসল ।
তা ছাড়া,” আমি বললাম, “তুমি গাড়িটাকে ঠেলে দাও । আমি গাড়িটাকে ব্যবহার করতে না পারলে গৃহবন্দি হয়ে থাকব ।
তোমার যা দরকার তা হল একটা নতুন ব্যাটারি ।
আমার নতুন ব্যাটারিতে দরকার নেইতুমি হয়তো কথাটা বুঝতে পারছ না, তাই না ? আমি কি বুঝিয়ে বলব ? এই গাড়িটা পুরোনো, এটা হল সেই সময়কার পৃথিবীর গাড়ি যার খুব কমই এখন টিকে আছে , কিন্তু এটা দিয়ে কাজ চলে । সেই দুনিয়ার যা বাকি আছে তার যা কিছু এখনো কাজ করে, আমি তা-ই অবলম্বন করে আছি ।  আমি তাকে ভালবাসি কিংবা ঘৃণা করি তাতে কিছু এসে যায়না । কথাটা হল আমি ঈশ্বরের কৃপায় এই দুনিয়ায় যা ছিল, তারই আছি, যা হচ্ছে তার নই । আমার দুনিয়া হল সেই দুনিয়া যাতে তোমার ইচ্ছে হলেই গাড়ি গাড়ি চলবে তা হয় না । আমার দুনিয়ায় গাড়িতে প্রথম সেলফ-স্টার্টার দিয়ে শুরু করতে হয় । সেলফ-স্টার্টার  কাজ না করলে হ্যান্ডেল ঘোরাতে হয় । হ্যান্ডেল ও কাজ না করলে কাউকে দিয়ে ধাক্কা দেওয়াতে হয় । আর গাড়ি যদি তাও না চলে তাহলে তুমি নিজের সাইকেলে যাবে , সাইকেল না থাকলে পায়ে হেঁটে যাবে, না হলে বাড়িতে বসে থাকবে । আমার পৃথিবীতে ব্যবস্থা এইরকমই । এই দুনিয়াকেই আমি বুঝি, আমি খুশিতে থাকি, বদলাতে চাওয়ার কোনও কারণ দেখিনা ।
ভারকুয়েইল কোনো জবাব দিল না ।
তুমি যদি মনে কর আমি একটা পুরোনো যুগের ফসিল, তাহলে তোমার নিজের দিকে তাকানোর সময় হয়েছে তুমি দেখেছ, ছেলেরা তোমার মদ খাওয়া, শুয়ে থাকা, অলসতা----এইসবকে কি চোখে দেখে । সাবধান হও । ভবিষ্যতের দক্ষিণ আফ্রিকায় তুমি সহ সকলকেই কাজ করতে হবে । তোমার হয়তো ব্যাপারটা ভাল লাগতে নাও পারে, কিন্তু তোমাকে এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে ।
পার্কিং লটে অন্ধকার নেমে আসছিল । ফ্লোরেন্স কোথায় ? পিঠের ব্যথা আমাকে কাবু করে ফেলছিল । আমার ওষুধ খাবার সময় পেরিয়ে গেছে ।
আমার নির্জন বাড়ির মনে পড়ল, মনে পড়ল যে দীর্ঘ রাত্রি আমাকে হাই তুলতে তুলতে  পোহাতে হবে । আবার চোখে জল এলো । অনায়াস অশ্রু
আবার কথা বললাম : তোমাকে বলেছিলাম না আমেরিকায় থাকা আমার মেয়ের বিষয়ে । আমার মেয়েই আমার কাছে সব কিছু । আমি ওকে আমার অবস্থার ব্যাপারে সত্যি কথাটা বলিনিসে জানে আমি অসুস্থ ছিলাম, আমার একটা অপারেশন হয়েছে । সে মনে করে অপারেশন ঠিকঠাক এবং সফল হয়েছে , এবং আমি ভালো আছি রাতে যখন বিছানায় শুই এবং যে গর্তে আমি ধীরে ধীরে পড়তে যাচ্ছি তার দিকে দেখি, তখন যে জিনিষটা আমাকে ধরে রাখে তাহলো আমার মেয়ের কথা চিন্তা করা । আমি নিজেকে বলি , আমি এই দুনিয়াতে একটা সন্তান এনেছি, তাকে নারী হতে দেখেছি, সে যাতে একটা নিরাপদ জীবন পায় তা দেখেছি । আমি যা করেছি তা কখনো আমার থেকে কেউ নিতে পারবে না । যখন ঝড় আমাকে আঘাত করে, এই চিন্তাই আমার আঁকড়ে ধরার খুঁটি ।
একটা ছোট কৃত্য আমি যার মধ্য দিয়ে প্রতিদিন যাই এবং যেটা আমাকে শান্ত রাখে তা হল : আমি নিজেকে বলি : এখন এখানে, এই পৃথিবীর এদিকে ভোর দুটো বেজেছে, তাই ওর, মানে আমার মেয়ের দিকে এখন সন্ধে ছটা । ভাবো তো, সন্ধে ছটা, বাকিটা কল্পনা করে নাও ---- সে রিফ্রিজারেটার খুলছে, একপ্যাকেট বরফজমা মটর বের করেছে, একটা বাটিতে মটরগুলো ঢেলেছে দুটো পিঁয়াজ নিয়ে খোলা ছাড়াচ্ছে, কল্পনা কর সেই মটর, সেই পিঁয়াজ, একই ধরণের কাজ, কিন্তু সেই জগত, তার গন্ধ, শব্দ, সব তার নিজস্ব । উত্তর আমেরিকার একটা গরমের সন্ধ্যা----দরজার সার্সিতে গ্ন্যাট পোকা, বাচ্চারা রাস্তা থেকে ডাকছে, বাড়িতে আমার মেয়ে নিজস্ব ছন্দে এক হাতে পিঁয়াজ নিয়ে, এমন এক ভূমিতে যেখানে সে শান্তিতে বাঁচবে এবং মরবে । ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যায় ওই ভূমিতে, এবং এখানে, আর বাকি সব জায়গাতেও, সেই একই দ্রুতিতে । কল্পনা কর, এভাবেই সময় যায়, এখানে আলো, ওখানে সন্ধ্যা হচ্ছে । সে বিছানায় যায় তাদের শান্তিপূর্ণ দেশে, তার বিবাহশয্যায়, তার স্বামীর শরীরের পাশে তার নিজের নিদ্রালস শরীরটা পাতে । আমি তার শরীরের কথা ভাবি, এখনো কঠিন, শান্ত, অথচ জীবন্ত, এই নরক থেকে পলায়িত । তাকে জড়িয়ে ধরতে বড়ো ইচ্ছে করে, পরিপূর্ণ হৃদয় দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, “আমি কৃতজ্ঞ যে তুমি তোমার জীবনে পরিপূর্ণ ।আমার অবশ্য আরোও বলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু বলি না কখনো-----আমাকে বাঁচাও
তুমি বুঝেছ ? তুমি কি কিছু বুঝলে ?”
গাড়ির দরজা খোলা ছিল । ভারকুয়েইল আমার থেকে দূরে দরজার কিনারে মাথা ঠেকিয়ে ঝুঁকে বসেছিল, এক পা মাটিতে । সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, আমি শুনলাম। নিশ্চয়ই ফ্লোরেন্স কতক্ষণে আসবে ও তার মুক্তি হবে এই অপেক্ষায়কী ক্লান্তিকর এই আত্মকথন, এই উপরোধ, এই দাবি !
আমি বলে চললাম, “কারণ সেটা হল এমন জিনিষ যা কেউ তার সন্তানের থেকে দাবি করবে না, এই জড়িয়ে ধরা, এই সান্ত্বনা দেওয়া, বাঁচানো । আশ্বাস, ভালোবাসা, সামনের দিকে প্রবাহিত হবে, পেছনদিকে নয় । এসবই হল নিয়ম, অলঙ্ঘনীয় একটা নিয়ম । যখন একজন বয়স্ক ব্যক্তি স্নেহের কাঙ্গাল হয়ে যায়, সবকিছু কুৎসিত হয়ে যায়, ঠিক যেভাবে মাবাবা সন্তানের সঙ্গে ঘুমোলে হয়, তেমনি অস্বাভাবিক ।
তবুও জীবনের স্পর্শ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা বড় শক্ত, জীবনের সেই সমস্ত স্পর্শ, যা আমাদের জীবনের সঙ্গে জুড়ে রাখে ! ঠিক যেমন একটা স্টিমার জেটি থেকে সরে যাচ্ছে, যেসব শক্ত দড়ি দিয়ে সে বাঁধা ছিল, সেই দড়িগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে । শেষ যাত্রার পথে সে চলেছে সে এখন মৃত প্রিয়জন । বড়, বড় দুঃখ লাগে । একটু আগে যখন ওই নার্সগুলো এখান দিয়ে চলে গেল, আমার মনে হচ্ছিল গাড়ি ছেড়ে গিয়ে হাসপাতালে আত্মসমর্পণ করি, ভর্তি হয়ে যাই,ওরা আমাকে পোশাক ছাড়িয়ে বিছানাতে শুইয়ে ওদের মত করে শুশ্রূষা করুক । আমি ওদের হাতের সেবাই চাই । হাতের স্পর্শ চাই । না হলে কেন আমরা এই মেয়েদের, এই বাচ্চাদের কাজে নিই, যদি তারা তাদের তরুণ হাত দিয়ে  বৃদ্ধ এবং আদরের অযোগ্য শরীরকেও স্পর্শ, আদর না করে না হলে কেন আমরা তাদের হাতে দীপ দিই আর বলি, এরা হল দেবদূত ? সেটা কি এজন্য যে ওরা শেষ রাতে এসে বলবে, এখন যাবার সময় হল ? হয়তো তাই । কিন্তু এজন্যও কি নয় যে তারা, যে স্পর্শ অনেকদিন হারিয়ে গিয়েছে, যে সুতো ছিঁড়ে গেছে, তাকে নিজের হাতে একটু মেরামত করবে ?’’
ভারকুয়েইল শান্তভাবে বলল, “তোমার মেয়েকে এই কথাগুলো বলো । সে নিশ্চয়ই আসবে ।’’
না ।’’
এক্ষুনি বলো, আমেরিকাতে তাকে ফোন করো । ওকে বলো তোমার তাকে এখানে বড়ো প্রয়োজন ।
না ।
তাহলে তাকে আর পরে, যখন অনেক দেরি হয়ে যাবে, তখন কিছু বলো না । সে তোমাকে ক্ষমা করবে না
তার এই তিরস্কার যেন মুখে থাপ্পড় কষানোর মত মনে হল ।
আমি বললাম, “কিছু জিনিষ আছে যা তুমি বুঝবে না । আমার মেয়েকে এখানে ডাকবার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই । আমি তাকে চাই, কিন্তু এখানে চাই না । কথাটাকে লঙ্গিং’(longing) বলে, কারণ তার জন্য দীর্ঘ রাস্তা যেতে হয় । পৃথিবীর শেষ প্রান্ত অবধি ।
আমার এই বাজে কথাতেও সে মূল কথার খেই হারাল না । তোমাকেই ঠিক করতে হবে,” সে বলল, “তোমার মেয়েকে ডাকবে কি ডাকবে না ।
তুমি নিশ্চিত থাকতে পার, আমি তাকে বলব না ।” (আমি কি মিথ্যাবাদী ?) আমার গলার স্বর একটু উঁচু হয়ে গেল, নামাতে পারলাম না । তোমাকে মনে করিয়ে দিই, এ দেশটা স্বাভাবিক দেশ নয় । লোকে এখানে ইচ্ছেমত আসতে ও যেতে পারে না ।
সে আমাকে সাহায্য করবার কোনো চেষ্টা করল না ।
আমার মেয়ে এখানের অবস্থা পরিবর্তন না হলে আসবে না । সে প্রতিজ্ঞা করেছে । দক্ষিণ আফ্রিকা দেশটাকে তুমি বা আমি যেমন জানি তেমন অবস্থাতে সে ফিরে আসবে না । সে নিশ্চিতভাবে ওই লোকগুলোর কাছে এখানে আসবার জন্য অনুমতি চাইতে আবেদন করবে না   সে বলেছে, যখন ওই লোকগুলোকে তাদের পা থেকে ল্যাম্প পোস্টে ঝোলানো হবে, তখনই সে ফিরবে । লোকগুলোর গায়ে পাথর ছুঁড়তে সে তখন ফিরবে, আর রাস্তায় নাচবে ।
ভারকুয়েইল একটা চওড়া হাসি হেসে দাঁত দেখাল । হলুদ ঘোড়ার দাঁত । একটা বুড়ো ঘোড়া ।
আমি বললাম, “তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না ? কিন্তু হয়তো কখনো তার সঙ্গে তোমার দেখা হবে, তখন তুমি দেখবে সে লোহার মত । আমি তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়ে তাকে এখানে আসতে বলব না ।
সে আমাকে বলল, “তুমিও লোহার মত ।
দুজনের মধ্যে নিস্তব্ধতা নামল । আমার ভেতরে কিছু একটা ভেঙ্গে গেল ।
আবার আমার বাক্‌শক্তি ফিরে এল । শুধু কিভাবে বলব তাই বুঝতে পারছিলাম না । আমি বললাম, যখন তুমি ওই কথাটা বললে, কিছু একটা আমার ভেতরে ভেঙ্গে গেল । আমি যদি লোহা দিয়ে তৈরি হতাম, এত তাড়াতাড়ি ভেঙ্গে পড়তাম না ।
যে চারজন মহিলাকে আমরা লিফটে দেখেছিলাম, ওরা একজন নীল স্যুট ও সাদা টুপি পরা ছোটখাটো লোককে সঙ্গে করে পার্কিং লট পেরোল । লোকটা তাদের একটা গাড়িতে ডাকল, তারপর ওদের নিয়ে চলে গেল ।
ভারকুয়েইল বলল, “তোমার মেয়ে কি কিছু করেছিল যে তাকে দেশ ছাড়তে হল ?”
না, সে কিছুই করেনি । শুধু এখানকার অবস্থাতে তার একেবারে ভাল লাগছিল না । তাই সে চলে গেল, আর ফিরে আসেনি । সেখানে সে নিজের অন্যরকম জীবন গড়ে তুলেছে। সে বিয়ে করে পরিবার গড়েছে। সেই হল সবচেয়ে ভাল, বিবেচনার কাজ।
কিন্তু সে ভুলে যায় নি ।
না, সে ভুলে যায় নি । যদিও সেকথা বলবার আমি কে ? লোকে হয়তো ভুলে, ধীরে ধীরে । আমি কল্পনা করতে পারছি না, কিন্তু হয়তো এরকমই হয় । সে বলে, ‘আমি দক্ষিণ আফ্রিকা দেশে জন্মেছিলাম ।আমি তার কথাবার্তায় একথা বলতে শুনেছি । আমার মনে হয় এটা একটা বাক্যের প্রথম অর্ধাংশ । তারপরে বাক্যের আরো কিছু হবে, কিন্তু সেটা আর আসেনা । তাই সেই না-বলা বাক্যাংশটা হারানো যমজ সন্তানের মত বাতাসে ভাসতে থাকে । আমি দক্ষিণ আফ্রিকাতে জন্মগ্রহণ করেছিলাম, আর কখনও সেই দেশকে দেখতে চাইনা ।আমি দক্ষিণ আফ্রিকাতে জন্মগ্রহণ করেছিলাম এবং সেখানে একদিন ফিরবকোন বাক্যাংশটা যমজ ?”
তাহলে সে এখন নির্বাসনে ?”
না, সে নির্বাসনে নয়, আমি নির্বাসনে আছি ।
সে আমার সঙ্গে কথা বলতে শিখছিল সে আমাকে চালাতে শিখছিল । আমি বাধা দিয়ে বলতে চাইছিলাম, “খুব ভাল লাগল আসলে অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতার পর এটাও খুব ভাল লাগছিল : চোখে আবার জল ।
আমি জানি না তোমার সন্তান আছে কিনা । আমি এও জানিনা যে পুরুষের ব্যাপারে ও সব সমান কিনা । তুমি যখন নিজের শরীর থেকে শিশুর জন্ম দাও, সেই শিশুকে জীবনও দাও । বিশেষ করে প্রথম সন্তানকে, প্রথমজাত শিশুকে । তোমার জীবন আর তোমার থাকেনা, তা শিশুটির হয়ে যায় । সেই জন্যই আমরা আসলে মরে যাইনা । আমরা আমাদের যে জীবন কিছু সময়ের জন্য আমাদের ছিল, তা সন্তানকে দিয়ে পড়ে থাকি । আমি যেন একটা খোলস, তুমি দেখতে পাচ্ছ । একটা খোলস যা আমার সন্তান ফেলে গেছে । আমার কি হবে তা কোনো ব্যাপার নয় । বুড়ো লোকদের কি হবে সেটা কোনো ব্যাপারই নয় । তবুও আমি কথাগুলো বলছি, যদিও তুমি বুঝবে বলে আমি আশা করি না, কিছু মনে করো না ---- জীবনের শেষ সীমায় পৌঁছানো বড় ভয়াবহ। এমন কি যদি আঙ্গুলের ডগা দিয়ে আঙ্গুলের ডগা ছোঁয়া হয়, সেই স্পর্শকেও যেতে দিতে ইচ্ছে করেনা।
ফ্লোরেন্স ও তার ছেলে পার্কিং লট দিয়ে দ্রুতপদে আমাদের দিকে আসছিল ।
ভারকুয়েইল বলল, “তোমার তার সঙ্গে আমেরিকা গিয়ে থাকা উচিত ।
 আমি হাসলাম । আমি আমেরিকা গিয়ে মরতে পারি না, কেউই পারে না , শুধু আমেরিকানরা ছাড়া ।
ফ্লোরেন্স তাড়াতাড়ি করে পেছনের সিটে বসে পড়ল । সে এত জোরে বসল যে গাড়ি নড়ে উঠল ।
আমি জিগ্যেস করলাম, “তাকে দেখতে পেলে ?”
হ্যাঁ,” সে জবাব দিল, তার মুখ বজ্রগর্ভ মেঘের মত গম্ভীর । ভেকি তার পাশে বসল ।
তারপর ?” আমি জিগ্যেস করলাম ।
হ্যাঁ, আমরা তাকে দেখলাম, সে এই হাসপাতালেই আছে ।
সে কি ভাল আছে ?”
হ্যাঁ , সে ভাল আছে ।
ভাল খবর,” আমি বললাম । আমাকে জানানোর জন্য ধন্যবাদ ।
আমরা চুপচাপ চললাম । যখন বাড়ির উঠোনে পৌঁছালাম, ফ্লোরেন্স নীরবতা ভেঙ্গে বলল, “ওরা হাসপাতালে তাকে বুড়ো লোকেদের মধ্যে রেখেছে । ভয়ঙ্কর ব্যাপার । তার মধ্যে একজন পাগল, সে সারাক্ষণ চিৎকার করছে আর গালি দিচ্ছে । নার্সরা পর্যন্ত তার কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে । একটা বাচ্চা ছেলেকে এরকম জায়গায় রাখা মোটেই উচিত হয়নি । ছেলেটা যেখানে আছে, সেটা হাসপাতাল নয়, সেটা যেন কবরে যাবার জন্য অপেক্ষা করার ঘর ।
কবরে যাবার জন্য অপেক্ষা করার ঘর: আমার মন থেকে কথাটা যাচ্ছিল না । আমি খেতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু ক্ষুধা ছিল না ।
কাঠের শেডে ভারকুয়েইল মোমবাতির আলোয় একটা জুতোয় কিছু করছিল । আমি তাকে বললাম, “আমি হাসপাতালে যাব । তুমি কি আমার সঙ্গে যাবে ?”
ফ্লোরেন্স বলেছিল ছেলেটা হাসপাতালের যেখানটাতে আছে, সেটা হল পুরোনো বিল্ডিং-এর একেবারে শেষ মাথায়, বেসমেণ্টে নেমে  রান্নাঘরের পাশ দিয়ে আবার উপরে উঠতে হয় ।
ফ্লোরেন্স সত্যি বলছিল । একটা কাঠির মত রোগা লোক, ন্যাড়া মাথা, বিছানায় বসে নিজের উরুতে দুহাত বাজাচ্ছিল আর জোরে জোরে কিছু আবৃত্তির মত করছিল । একটা মোটা কালো স্ট্র্যাপ তার শরীরের মাঝখান ও বিছানার সঙ্গে বাঁধা । আমি যা বুঝলাম, ওর ভাষা আমার জানামতো কোনো ভাষার অন্তর্ভুক্ত ছিল না । আমি দরজায় দাঁড়িয়ে পড়লাম, ভয় হচ্ছিল যে কোনো সময় সে তার কঙ্কালসার কালো হাত তুলে আঙ্গুল দিয়ে আমার দিকে জ্বলজ্বল দৃষ্টিতে দেখাবে ।
ভারকুয়েইল বলল, ‘লোকটা প্রলাপ বকছে, প্রলাপ ।
আমি ফিসফিস করে বললাম, “না, তার চাইতেও বেশি কিছু
ভারকুয়েইল আমার কনুই ধরল । আমি তাকে আমাকে নিয়ে যেতে দিলাম ।
ওয়ার্ডের মাঝখানে একটা লম্বা টেবিলে অনেকগুলো ট্রে স্তূপীকৃত রাখা ছিল । কেউ এমন ভাবে কাশছিল যে তার ফুসফুস যেন দুধে ভর্তি । ভারকুয়েইল বলল ওই যে, ওই কোণায় ।
সে আমাদের চিনতে পারল না, আর যে ছেলেটির রক্তে আমার আঙ্গুল চটকে গিয়েছিল, তাকে আমিও চিনতে পারলাম না । তার মাথা ছিল ব্যান্ডেজ করা, মুখ ফোলা, বাঁ হাতটা বুকের সঙ্গে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা । তার পরনে হাসপাতালের হাল্কা নীল পাজামা । আমি বললাম, “কথা বলো না । আমরা শুধু দেখতে , নিশ্চিত হতে এসেছি যে তুমি ঠিক আছ ।
সে তার  ফোলা ঠোট একটু ফাঁক করে আবার বন্ধ করল
তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ ? ভেকির মা যার জন্য কাজ করে, আমি হচ্ছি সেই মহিলা । আমি সকালে দেখছিলাম । যা কিছু ঘটেছে, সব আমি দেখেছি তুমি তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যাবে । তোমার জন্য কিছু ফল এনেছি । তাকের উপর ফলগুলো রাখলাম : একটা আপেল, একটা নাসপাতি ।
তার অভিব্যক্তি পাল্টাল না ।
আমি তাকে পছন্দ করতাম না । আমি তাকে পছন্দ করি না । আমি আমার হৃদয়ে দেখলাম যে কোথাও তার জন্য কোন ভালবাসার অনুভূতির লেশমাত্র নেই । যে ভাবে কোনো কোনো লোক আছে তাদের দেখলেই মনটা উষ্ণতায় ভরে ওঠে , ঠিক সেভাবেই কিছু কিছু লোক আছে যাদের দেখলে প্রথম থেকেই শীতলতা জন্মায় । এই-ই ব্যাপার । এই ছেলেটা ভেকির মত নয় । এর কোনো মধুরতা নেই তার মধ্যে কিছু একটা বোকা বোকা, স্বেচ্ছাকৃতভাবে বোকা, নিরেট, অবোধ্য ব্যাপার আছে । এ হল সেইরকম ছেলে যাদের গলার স্বর খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হয়ে যায়, বারো বছর হতে না হতেই যাদের বাচ্চাভাব চলে গিয়ে একটা জান্তব, সবজান্তা পাকা ভাব এসে যায় । একটা সরলীকৃত ব্যক্তিত্ব, সবদিক দিয়ে সরলীকৃত : আরো দ্রুত, আরো চটপটে, সাধারণ লোকেদের তুলনায় বেশি অক্লান্ত; বিবেক বা সন্দেহ যেমন মনের মধ্যে নেই, তেমনি নেই রসবোধ ; ক্রুর, সরল । যখন সে রাস্তায় পড়েছিল, আমি ভেবেছিলাম সে মরতে চলেছে, তাই আমি ওর জন্য যা পারি করেছিলাম । কিন্তু খোলাখুলি বলতে গেলে, অন্য কারো জন্য সেই কাজ করতে পারলে আমি বেশি খুশি হতাম ।
আমার মনে পড়ল, আমি একবার একটা বেড়ালকে শুশ্রূষা করেছিলাম । বেড়ালটা লালচেবাদামি রঙের বুড়ো হুলো , তার থুতনিতে ফোঁড়া হয়ে মুখ খুলতে পারত না । সে যখন খুব দুর্বল হয়ে প্রতিরোধ করবার অবস্থায় ছিল না, সেই সময়ে আমি তাকে নিয়েছিলাম, একটা নল দিয়ে দুধ খাওয়াতাম, অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছিলাম । যখন সে নিজের শক্তি খুঁজে পেল, তাকে ছেড়ে দিলাম, কিন্তু তাকে খাবার দিতে থাকতাম । কমবেশি বছরখানেক সে আমার বাড়ির আশেপাশেই থাকত ; বছরখানেক খাবার খেয়েছিল । তারপর চিরকালের মত চলে গেল । এই পুরো সময়টা সে কোনো বোঝাপড়া ছাড়াই আমাকে একজন শত্রু হিসেবেই দেখত । যখন সে সবচেয়ে বেশি  দুর্বল ছিল,তখনো আমার হাতে এলে তার শরীর শক্ত, ভীত, প্রতিরোধপ্রবণ হয়ে থাকত । এই ছেলেটার চারদিকেও তেমনি একটা প্রতিরোধের দেওয়াল রয়েছে বলে মনে হচ্ছিল । তার চোখ খোলা থাকলেও সে দেখছিল না, আমি যা বলছিলাম, তা সে শুনছিল না ।
আমি ভারকুয়েইলকে বললাম, “আমরা কি যাব ?” আর একটা ঝোঁকের বশে, না, তার চেয়েও বেশি কিছু----ঝোঁকটাকে অকেজো না করার চেষ্টিত ইচ্ছায়, আমি ছেলেটার খোলা হাতটা স্পর্শ করলাম ।
হাতটা আমি ধরিনি, ছোঁওয়াটা ও লম্বা সময়ের জন্য ছিল না । এ তো শুধুমাত্র ঘষটে যাওয়া-----তার হাতের পিছনদিকটায় আমার আঙ্গুলের ডগা একটুক্ষণের জন্য হালকা ছুঁয়ে চালানো । কিন্তু আমি বুঝলাম যে সে শক্ত হয়ে গেল, যেন ক্রোধের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হল ।
মনেমনে বললাম, “তোমার মায়ের হয়ে, যে এখানে নেই ।প্রকাশ্যে বললাম,“ধীরেসুস্থে বিচার করো
ধীরে সুস্থে বিচার করো’ ---- বলতে কি বোঝালাম ? আমি নিজেই যদি না জানি, তাহলে কে জানবে বলে আশা করা যায় ? সে নিশ্চয়ই নয় । তবুও তার ক্ষেত্রে, আমি নিশ্চিত যে অবোধ্যতা আরো গভীর । যখনই আমি তা উচ্চারণ করলাম, সেটা তার কানে একটা মরা পাতার মত পড়ল । একজন নারীর কথা, তাই অবহেলাযোগ্য । একটি বুড়ির কথা, তাই দ্বিগুণ অবহেলার যোগ্য । কিন্তু সর্বোপরি, একজন শ্বেতাঙ্গ মানুষের ।
আমি, শ্বেতাঙ্গ । আমি যখন শ্বেতাঙ্গদের কথা ভাবি, কি দেখি ? একদঙ্গল ভেড়া, জ্বলন্ত সূর্যের নিচে ধূলি প্রান্তরে খুরের ছাপে ছাপে ছয়লাপ করে যাচ্ছে । আমি খুরের তালহীন খটখট শব্দ শুনি । যখন কান অভ্যস্ত হয়ে যায়, একটা আমি’ ‘আমিআওয়াজ নানারকম ম্যা ম্যাধ্বনিতে বাজে । সেই ভেড়ার দঙ্গলের মধ্যে ঠেলে থুলে থপ থপ করে ঢুকে পড়ে ছুঁচলো লোমওলা পিঠ, করাত-দাঁত, লাল লাল চোখ অপরিশীলিত বর্বর বুড়ো শুয়োরগুলো, ঘোঁত ঘোঁত করতে করতে শুধু মৃত্যু’ ‘মৃত্যুবলতে থাকে । ওতে আমার কোনো ভাল হয় না, তবুও আমি ওই শ্বেতাঙ্গ-ছোঁয়া থেকে কুঁকড়ে যাই, যেভাবে এই ছেলেটা যায় । যে শ্বেতাঙ্গ বুড়িই ওর হাত ছুঁত, সে যদি আমি না হত, তাহলেও একই ভাবে কুঁকড়ে যেত ।
আমি আবার চেষ্টা করলাম ।
অবসর নেবার আগে”, আমি বললাম, “আমি একজন শিক্ষক ছিলাম । আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম ।
ভারকুয়েইল বিছানার অন্যদিক থেকে মনোযোগ সহকারে আমাকে দেখছিল । কিন্তু আমি তার সঙ্গে কথা বলছিলাম না ।
তুমি যদি আমার থুসাইদিদিস* ক্লাসে থাকতে”, আমি বলে চললাম, তাহলে তুমি হয়তো এই বিষয়ে কিছু জানতে পারতে যে যুদ্ধের সময় মনুষ্যত্বের কি হয় ; আমাদের মনুষ্যত্ব , যা নিয়ে আমরা জন্মাই, যার মধ্যে আমরা জন্মাই ।
ছেলেটার চোখে যেন ধোঁয়াটে মত কিছু ছিল : চোখের সাদা অংশ অনুজ্জ্বল, মণিগুলো চ্যাপ্টা, ছাপার কালির মত কালো । হয়তো তকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, তবু সে জানত আমি এসেছি, জানত আমি কে, এবং জানত আমি তার সঙ্গেই কথা বলছি । সে জানত, কিন্তু শোনেনি, যেভাবে সে কোনো দিন তার শিক্ষকদের কথা শোনেনি, ক্লাসরুমে পাথরের মূর্তির মত বসে থাকত, কথার প্রতি উদাসীন, শুধুমাত্র সময় কাটানো ও ছুটির ঘণ্টার জন্য অপেক্ষা ।
থুসাইদিদিস সেই সমস্ত লোকেদের বিষয়ে লিখেছিলেন যারা নিয়ম বানাতো ও অনুসরণ করত । সেই নিয়ম অনুসারে তারা শত্রুর সমস্ত শ্রেণীকে নির্বিচারে হত্যা করত । আমার মনে হয় যারা মরত, তাদের বেশির ভাগই অনুভব করত একটা ভীষণ ভুল করা হচ্ছে, যে নিয়মই হোক না কেন, তাদের ক্ষেত্রে এটা লাগু হতে পারে না । আমি’! এটাই ছিল তাদের শেষ কথা, সঙ্গে সঙ্গে তাদের গলা কেটে ফেলা হত । প্রতিবাদের ভাষা : আমি’, ব্যতিক্রম আমি
ওরা কি ব্যতিক্রম ছিল ? সত্য হল, কথা বলার সময় পেলে আমরা সবাই নিজেদের ব্যতিক্রম বলে দাবি করতাম । আমাদের প্রত্যেকের জন্যই আলাদা আলাদা কেস হওয়া উচিত । আমাদেরকে সন্দেহের লাভ (benefit of doubt)  দেওয়া উচিত
কিন্তু  এমন এমন কাল আসে যখন এইসব কথা ভাল করে শুনবার, এইসব ব্যতিক্রমের, এইসব দয়া দেখানোর সময় হয় না । সময় যখন নেই, তখন আমরা বাঁধা নিয়মের নিগড়ে পড়ে যাই, সেটাই হল বড় দুঃখের, সবচাইতে বেশি দুঃখের । থুসাইদিদিস-এর থেকে তুমি এই শিক্ষাই পেতে পারতে । আমরা যখন এইরকম সময়ে প্রবেশ করি, তখন বড় দুঃখের সময় । আমরা ভয়স্তব্ধ হৃদয়ে সেই সময়ে প্রবেশ করি, কিন্তু এই রকম সময়কে স্বাগত জানানো যায় না ।
রীতিমত ইচ্ছাকৃতভাবে সে তার ভাল হাতটা বিছানার চাদরের ভেতর রাখল যেন আমি ওটা আবার ছুঁয়ে ফেলব ।
আমি বললাম, “শুভরাত্রি। আশা করছি তুমি ভাল করে ঘুমোবে ও সকালবেলা একটু সুস্থবোধ করবে ।
বুড়ো লোকটা আবৃত্তি বন্ধ করল । হাতদুটো তার উরুর উপর মৃতপ্রায় মাছের মত ঢিলেঢালা ভাবে পড়ে নড়ছিল । তার চোখদুটো প্রায় স্থির । তার চিবুকের কষ দিয়ে লালা গড়াচ্ছিল ।
গাড়িটা কিছুতেই স্টার্ট হচ্ছিল না , তাই ভারকুয়েইলকে ধাক্কা দিতে হল ।
এই ছেলেটা ভেকির থেকে আলাদা, অনেক আলাদা ।আমি বললাম, এখন যেন আমাকে কথা বলায় পেয়ে বসেছে, একটু বেশিই বকবক করছি ।আমি চেষ্টা করি এটা না দেখতে, কিন্তু সে আমাকে নার্ভাস করে তোলে । আমার খারাপ লাগে যে ভেকি তার পাল্লায় পড়েছে । কিন্তু আমি জানি যে এরকম হাজার হাজার ছেলে আছে । এই বর্ধমান প্রজন্মে তাদের সংখ্যা ভেকির মত ছেলের চাইতে অনেক বেশি ।
আমরা বাড়ি পৌঁছলাম । না ডাকলেও ভারকুয়েইল আমার পিছনে  ভেতরে চলে এল ।
আমি বললাম, “আমি এখন খুব ক্লান্ত , আমাকে ঘুমোতে হবে ।কিন্তু সে যখন নড়বার কোনো উপক্রম করল না , জিগ্যেস করলাম, “তোমার কি কিছু খাবার চাই ?”
আমি ওর সামনে কিছু খাবার রাখলাম, আমার ওষুধ খেলাম, অপেক্ষা করতে থাকলাম ।
পাউরুটিটা তার খারাপ হাতে ধরে সে একটা টুকরো কাটল, মোটা করে মাখন লাগাল, চীজ কাটল । তার নখগুলো নোংরা, কে জানে সে কি জিনিষ ওই হাতদুটো দিয়ে ধরেছে । এই লোকটাকে আমি আমার হৃদয় খুলে কথা বলি, তাকে আমি সবকিছুতে বিশ্বাস করছি । আমার জন্যই এই বাঁকা পথ কেন?
আমার মনটা একটা হ্রদের মত, যার মধ্যে তার আঙ্গুলটা ঢোকে ও নাড়ায় । সেই আঙ্গুলটা ছাড়া নিস্তরঙ্গ ও বদ্ধ ।
দিশাহীন পথ । দিশাহীন মানে বোঝাচ্ছি দিক্‌ভ্রষ্ট, কাঁকড়ার মত চলা ।
ওর ময়লা নখ আমার ভেতর ঢুকছে ।
তোমাকে ধূসর দেখাচ্ছে ।
আমি ক্লান্ত ।
সে তার লম্বা লম্বা দাঁত দেখিয়ে চিবুতে লাগল ।
সে দেখে, কিন্তু বিচার করে না । সব সময়েই তার চোখে একটা হালকা নেশার ঘোর লেগেই থাকে । সুরাসার, যা নরম করে, পচন থেকে বাঁচায় । মনকে নরম করে, যা ক্ষমা করতে সহায়ক হয় । সে মদ্যপান করে ও ছেড়ে দেয় । তার জীবন সবটাই ছেড়ে দেবার । সে, মিঃ ভি, যার সঙ্গে আমি কথা বলি । কথা বলি, অন্যদিকে নতুন জাগ্রত প্রজন্ম, যারা মদ খায় না, তাদের সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি না , শুধু উপদেশ দিতে পারি । তাদের হাত পরিষ্কার, নখ পরিষ্কার । তারা নতুন শুচিবাদী, নিয়মপালনকারী, নিয়মের ধ্বজাধারী । সুরার প্রতি ঘৃণা, কারণ সুরা নিয়মকে নমনীয় করে, লোহাকে গলায় । নতুন প্রজন্ম হল যা কিছু অলস, ছেড়ে দেওয়া, ঘোরানোফেরানো,তাদের প্রতি সন্দিহান । অপ্রাসঙ্গিক, প্রসঙ্গান্তর আলোচনা তাদের কাছে সন্দেহজনক ।
আমি বললাম, “আমি অসুস্থ ও । অসুস্থ ও ক্লান্ত, ক্লান্ত ও অসুস্থ । আমার ভেতর একটা বাচ্চা আছে আমি যার জন্ম দিতে অক্ষম । অক্ষম, কারণ সেটা জন্মাবে না । কারণ সেটা আমার শরীরের বাইরে  বাঁচবে না । আমি ওর বন্দি, অথবা ও আমার বন্দি । সে দরজায় ধাক্কা মারে, কিন্তু বেরোতে পারে না, সারাক্ষণ এই চলছে, ভেতরের শিশুটি দরজা ধাক্কা দিচ্ছে । আমার মেয়ে আমার প্রথম সন্তানএই দ্বিতীয়টা, জন্মদানের ফল, অনাহূত । আচ্ছা, তুমি কি টিভি দেখবে ?”
আমি ভেবেছিলাম তুমি ঘুমোবে ।
না, আমি এখন আর একা থাকতে চাই না । ভেতরেরটা আমাকে এখন খুব বেশি মারছে না । ও তার পিল খেয়েছে, এখন ঝিমন্ত । ওষুধের ডোজ হল দুটো পিল, তুমি হয়তো দেখেছ । একটা আমার, একটা ওর জন্য ।
আমরা সোফাতে পাশাপাশি বসলাম । একটা লালমুখো লোকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছিল । তার একটা জন্তুর খামার আছে, লোকটা সিংহ ও হাতি সিনেমা কোম্পানিকে ভাড়া দেয় ।
যে সাক্ষাৎকার নিচ্ছিল, সে বলল, “তুমি সাগরের অপরপারে যে সব ব্যক্তিত্বকে পেয়েছ, তাদের বিষয়ে আমাদের কিছু বল ।
আমি উঠলাম, বললাম, “আমি চা করতে যাচ্ছি ।
শেরি
আমি যখন শেরির বোতল নিয়ে ফিরলাম, সে তখন বইয়ের তাকের কাছে দাঁড়িয়েছিল । আমি টেলিভিশন বন্ধ করলাম । জিগ্যেস করলাম, “কি দেখছ ?”
সে চার ভল্যুমের একটা উঠাল ।
এই বইটা পড়ে আনন্দ পাবে,” আমি বললাম । যে মহিলা এই বইটি লিখেছিলেন, তিনি প্যালেস্তাইন ও সিরিয়ায় ঘুরেছিলেন পুরুষের ছদ্মবেশে, গত শতাব্দীতে । সে সময়কার ডাকাবুকো ইংরেজ মহিলাদের একজন । কিন্তু ছবিগুলো উনি আঁকেননি । সেগুলো একজন পেশাদার চিত্রকর এঁকেছেন ।
দুজনে একসঙ্গে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছিলাম । দৃষ্টিভঙ্গীর চাতুরী দ্বারা চিত্রকর জ্যোৎস্না রাতের ভ্রমণকারীদের তাঁবু, মরুভূমির এবড়োখেবড়ো পাথুরে পাহাড়, ভাঙ্গা মন্দির সব কিছুকে একটা রহস্যময় চেহারা দিয়েছেন । দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য কেউ এধরণের কাজ করেনি, কেউ তাকে রহস্যময় করে তোলে নি । এখন অনেক সময় পেরিয়ে গেছে । এখন সবার মনে গেঁথে গেছে দেশটার এই ছবিটা---- চ্যাপ্টা মালভূমি, প্রখর আলো, ছায়াহীন, গভীরতাহীন ।
আমি বললাম, “যা ইচ্ছে পড়তে পারো । উপরের তলায় আরো অনেক বই আছে । তুমি কি পড়তে ভালবাস ?”
ভারকুয়েইল বইটা রেখে দিল । বলল, “আমি এখন ঘুমোব ।
আবার একটা অস্বস্তির অনুভূতি আমার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে গেল । কেন ? কারণ খোলাখুলি বলতে গেলে, তার গায়ের গন্ধ আমার কাছে বড় কটু লাগে । অন্তর্বাসপরা ভারকুয়েইলএর কথা  আমি ভাবতেও পছন্দ করি না । বিশেষ করে তার পাগুলো সবচেয়ে খারাপ, শিঙয়ের মত, ফাটাফাটা পায়ের নখ ।
আমি বললাম, “একটা কথা জিগ্যেস করব ? তুমি আগে কোথায় থাকতে ? কখন থেকে ভবঘুরের বৃত্তি আরম্ভ করলে ?”
ভারকুয়েইল বলল, “আমি সাগরে ছিলাম । সেকথা আগেই তোমাকে বলেছি ।
কিন্তু সাগরে তো কেউ বাস করে না । কেউ সাগরে জন্মায় না । নিশ্চয়ই তুমি সারাজীবন ধরে সাগরে থাকনি ।
আমি মাছধরা ট্রলারে যেতাম ।
আর ?”
সে মাথা নাড়ল
আমি বললাম, “আমি এমনি জিগ্যেস করছি । যারা কাছাকাছি থাকে, তাদের কথা একটু জানতে ইচ্ছে করে । এটা স্বাভাবিক ।
সে তার সেই বাঁকা হাসি হাসল । হাসিতে হঠাৎ করে তার লম্বা ও হলুদ শ্বদন্ত বেরিয়ে পড়ল । তুমি নিশ্চয়ই কিছু লুকোচ্ছ, আমি ভাবলাম । কোনো বিয়োগান্ত প্রেম, কোনো কয়েদির সাজা ? আমি নিজেও একটু হাসলাম ।
দুজনেই দুজনের নিজস্ব কারণে মৃদু হেসে দাঁড়িয়ে পড়লাম । বললাম, “তুমি যদি চাও, তাহলে আবার সোফায় শুয়ে পড়তে পার ।
সে একটু দোনামনা করল । কুকুরটার আমার সঙ্গে শোবার অভ্যাস ।
কিন্তু গতরাতে কুকুরটা তোমার  কাছে ছিল না ।
আমি না গেলে কুকুরটা ডাকতে থাকবে ।
আমি কিন্তু কাল রাতে কুকুরটাকে ডাকতে শুনিনি । যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে খেতে দেওয়া হয়, কুকুর কি কোথায় শোবে তার পরোয়া করে ? আমার সন্দেহ হয়, যেভাবে অন্য লোকেরা বাড়িতে উদ্বিগ্ন বৌয়ের ওজর দেখায়, তেমনি সে উদ্বিগ্ন কুকুরের ওজর দেখায় । অন্যদিকে, কুকুরটা আছে বলেই আমি তাকে বিশ্বাস করি । কুকুরেরা কি ভাল, কি মন্দ, তা শুঁকে বুঝতে পারে: সীমানায় পাহারা দেয়, নজরদার ।
কুকুরেরা অবশ্য আমার ভালবাসা জাগ্রত করেনি । আমার এখানে বেড়ালের গন্ধ । ক্যাটওম্যান, বেড়ালনারী : সার্সী । আর সে, ট্রলারে করে সাগর চষে এখন এখানের ভূমিতে নোঙ্গর করেছে
যেমন তোমার ইচ্ছে ।আমি বললাম, সে যে শেরির বোতলটা নিয়ে যাচ্ছে  তা না দেখার ভান করে যেতে দিলাম ।
পিলগুলো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগে সর্বশেষ চিন্তা ছিল, “কি করুণ ! আমরা মোটামুটি একধরণের ঘর করতে পারতাম, আমি উপরের তলায়, সে নিচে---- এই শেষ কদিনের জন্য । যাতে রাতে দরকার হলে একজন লোক কাছে থাকে । সর্বোপরি, শেষের সময়ে মানুষ তাই তো চায় : কেঊ থাকবে, অন্ধকারে ডাকবার জন্য । মা, অথবা মায়ের জায়গাতে কেউ প্রস্তুত হয়ে থাকবার জন্য ।
যেহেতু আমি ফ্লোরেন্সের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমি ক্যালেডন স্কোয়ারে গিয়ে সেই দুজন পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে নালিশ করার চেষ্টা করলাম । কিন্তু দেখা গেল, কমপ্লেন করতে গেলে যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তাদের উপস্থিত থাকতেই হয় ।
ডেস্কে যে অফিসার ছিল, সে বলল, “আমাদের নামধাম সব দিয়ে যাও, আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব । ছেলেদুটোর নাম কি ?”
ওদের অনুমতি না নিয়ে ওদের নাম ত বলতে পারিনা ।
সে কলম রেখে দিল । একজন পরিচ্ছন্ন নিয়মনিষ্ঠ যুবক, আজকালকার নতুন জাতের পুলিশকর্মী । উদার মানবতাবাদী চেহারা দেখিয়ে  আত্মনির্ভরতা বাড়ানোর জন্য যাদের কেপটাউন এলাকায়  কিছুদিন রেখে ট্রেনিং সম্পূর্ণ করানো হয় ।
আমি জানিনা তুমি তোমার ইউনিফর্মের জন্য গর্বিত কি না,” আমি বললাম, “কিন্তু তোমার রাস্তার সহকর্মীরা এর সম্মান করছে না । আমি লজ্জিত । ওদের জন্য নয়, নিজের জন্য । তুমি বলছ যে যেহেতু আমি নিজে জড়িত নই, তাই আমি কোনো চার্জ আনতে পারব না । কিন্তু আমিও জড়িত,অত্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত । তুমি কি বুঝতে পারছ আমি কি বলতে চাইছি ? ”
সে কোনো জবাব দিল না, বরং পরে আরও কি আসতে পারে তার অপেক্ষায় টানটান সোজা বসে রইল । তার পেছনের লোকটা কিছু না শোনার ভান করে তার কাগজপত্রের উপর ঝুঁকে রইল । কিন্তু ভয়ের কিছু ছিল না । আমার আর কিছু বলার ছিল না, অন্তত: কিছু বলার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল না ।
বুইটেন্‌কান্‌ট স্ট্রিটে ভারকুয়েইল আমার গাড়িতে বসেছিল । আমার নিজেকে এত বোকা মনে হচ্ছিল,” বলতে বলতে চোখে হঠাৎ জল এসে গেল । আমি ওদের বললাম, “তোমরা আমাকে লজ্জিতবোধ করালে । ওরা নিশ্চয়ই এখন নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে । বুড়িটা নিগ্রো ছেলেদের হয়ে ওকালতি করতে এসেছিল । হয়তো আমার বোঝা উচিত ছিল যে এখন থেকে এভাবেই আমাদের থাকতে হবে----একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে । হয়তো বা এখনকার রাস্তার নামই লজ্জা, যা আমি সব সময়ই অনুভব করছি । বোধহয় এই ভাবে থাকার চাইতে লোকে মরতেই বেশি ভাল বোধ করবে ।
লজ্জা । চরম লজ্জা । জীবনেই মৃত্যু ।
দীর্ঘ সময় নৈঃশব্দ্য ।
ভারকুয়েইল বলল, “আমি কি দশ র‍্যাণ্ড ধার পেতে পারি? বৃহস্পতিবার পর্যন্ত আমার অসুবিধে আছে, তারপর তোমাকে ফেরত দেব ।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------
থুসাইদিদিস (খৃষ্টপূর্বাব্দ ৪৬০---৪০০)
আথেন্সীয় গ্রিক ঐতিহাসিক, রাজনীতিবিদ, দার্শনিক এবং সেনাপতি । এঁকে বিজ্ঞান- ভিত্তিক ইতিহাসের জনক বলা হয় ।



কোন মন্তব্য নেই: