তেরো
(দেশভাগ
এবং পরের দশকের কাছাড় সিলেটের প্রেক্ষাপটে রণবীর পুরকায়স্থের এই উপন্যাস
ছেপে বের করেছে দিন হলো। ভালো লাগা এই
উপন্যাস পুরোটা টাইপ করে তুলে আমার
প্রিয় কথা শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। আশা করছি আপনাদের সবার এটি পড়তে
ভালো লাগবে। সম্পূর্ণ উপন্যাসের সংলাপ ভাগটি সিলেটিতে -সে সম্ভবত এই
উপন্যাসের সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক। আপনাদের পড়বার সুবিধে করে দিতে, ঈশানে এই
উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে আসছে। আজ তার ত্রয়োদশ অধ্যায় ---সুব্রতা মজুমদার।)
গুরু সৃষ্টিধর
নিজেকে মিস্তিরি মানুষ বলতে ভালবাসেন । ভেতরে বাইরে এরকম সাদা মানুষ দেখেনি বৈতল ।
যা বলেন মনের ভিতর দিয়েই বেরিয়ে আসে কথা । মানুষটিকে যেন গড়ার সময় সৃষ্টিকর্তা রাগ
দিতে ভুলে গেছেন । সমীহ হয় দেখলে , সদাহাসি যে থাকে তাও নয় , কিন্তু মুখে এক অনাবিল
প্রশান্তি । বৈতল বুঝতে পারে , তার স্বকীয়তা নষ্ট হচ্ছে , সেও ভালমানুষ হয়ে যাচ্ছে
গুরুর সঙ্গে থাকতে থাকতে । গুরু ওকে ওর মতাদর্শে দীক্ষা দিচ্ছেন নীরবে । পুঁথির
পাঠ নাচ আর কাঠচেরায়ই সব নয় , নীরবে যেন অন্য মানুষ গড়তে চাইছেন শিষ্যকে । বৈতলও
সম্মোহিত হয়ে তাঁর কথার টানে ছুটছে । ছোটবেলায় যেমন বাপ বলত , ‘হেই বৈতল পানিত
লাম’ , বৈতল নেমে যেত জলের অতলে । গুরু সরাসরি নির্দেশ দেন না , ওকে বিবশ করে দেন
প্রতিবেদনে । পাহাড়ে চড়ার সময় এক গ্রাম পড়েছে সোনাপুর । ওঝা থেমেছেন পাহাড়চূড়ায় ।
বুকভর দম নিয়ে বলেছেন ,
--- দেখো রেবা , আমরার দেশ । কুটি কুটি মানুষ নিচে দেখরায় ,
এরা সব আমরার ভাই বেরাদর । সব সিলেটি । আর অউযে বড় দড়ি এক গাছা দেখরায় , দড়ি নায় ,
আমরার মা , আমরার সুরমা নদী । কী সুন্দর দেখরায় নি । অউতান অউগদাউ আমরার শরীর ।
পন্নাম কর নদীরে ।
গুরুবাক্য পালন
করছে বৈতল । প্রণাম করেছে নদী মাকে । আর ভেবেছে সুরমা সিলেট নিয়ে পাগল মানুষটা কেন
যে সংসারী হয়েছে । উল্টোদিকে আর এক গাছি দড়ি দেখিয়েছে বৈতল । বলেছে,
--- আর হউ নদী ।
--- অউ আর হউ কই রেবা । এইন একজন অউ । আমরা চিনি না তানে ।
তাইন আমরার মা নায় । সুরমার উপরে কোনও নদী নাই , সিলেটর উপরে দেশ নাই ।
নদীর উপর রাগ আভিমান শেষ করে শিষ্যকে বলেছেন ,
--- অউ নদীর নাম বরাক । উল্টাদিকে এক পাহাড় আছে, বড়াইল,
অখান থাকি বার অইছইন । সিলচরর উপরে দিয়া অউ দেখ ত্রিভঙ্গ অইয়া নাচিতরা । তেড়া
বেকার লাগি নাম বড়বক্র , বুলে বরাক । বরাকর পারো যারা থাকইন তারা সিলেটিও না
বাঙালিও না কাছাড়িও না মনিপুরিও না , সব মিলাইয়া তারা এক আজব চিজ । হিবায় চাওন
লাগতনায় , মুখ ফিরাই লাও । হিখান বলে হিন্দুস্থানো পড়ব । হের লাগি সবে ভাগের
হিবায়দি । আমরা যাইতাম নায় । বাপদাদার দেশ ছাড়িয়া যাইবায় নিবা ।
--- না । এক নদী দিয়া কিতা অইব । হাওর আছে নি , বিল আছে নি
।
--- আছে কিতাকিতি । চাতলার হাওর , নদীও আছে ছুটো ছুটো ।
জিরি চিরি মধুরা ধলেশ্বরী সোনাই । জেতাউ
হউক মা থাকতে মইর বাড়ি কতদিন থাকতায় পারবায় ।
--- আমার তো মা নাই ।
--- এ, তোমার দেখি রেবা নিয়ত বালা নায় ।
--- না । আমি যাইতাম নায় । আমার বড় হাওর অউ বালা ।
হাকালুকির লাখান হাওর আছেনি দুনিয়াত । পানি যেখানো , আমিও হিখানো ।
গরীব সূত্রধরের মেয়ের কন্যাদায় উদ্ধারে অপারগ
বৈতল স্তোকবাক্যে ভুলিয়ে দেয় গুরুকে । এছাড়া কীই বা করতে পারে সে । তার বয়স কম ,
রইদপুয়ানিতে পড়ে থাকতে পারে না সারাজীবন । চায়নাকে বিয়ে করার অর্থ , গোটা পরিবারের
দায়িত্ব কাঁধে নেওয়া । সৃষ্টিধর ওঝা বড় মাপের মানুষ ঠিকই কিন্তু সংসারী হতে পারেন
নি । পাঁচ মেয়ের সংসার প্রতিপালনে অমানুষিক পরিশ্রম করেন । পাহাড়ে এসে , পরিচিত
মানুষ থেকে দূরে এসে দুএক পাত্র নেশা করে মনের দুঃখ শোনায় শিষ্যকে । বলে,
--- রোজগারর পয়সা আমি আনে বানে খরচ করি না রেবা । আমি খুব
বেড়াই , বেড়ানির পয়সা আমার আলাদা । সিলেটখান অউ দেখতাম পারলাম না ভালা করি , জানি
না কাশী বৃন্দাবন যাইতাম পারমু নি। কিন্তু একবার নবদ্বীপ যাইমু । যাইবায় নি আমার
লগে ।
--- যাইমু ।
--- তেউ অইব , বুড়া মানুষরে টানন লাগব । দেখমু, দেখমু সব ।
আইয়ে চাইলে সব অইব ।
বৈতলের মন আই বিরূপতায় রুদ্ধ । তাই গুরুকে প্রশ্ন করে ,
--- আপনে ভগবান মানইন নি ।
--- মানি বাবা । মানি । ভগবান মানি , আল্লা মানি । মহাভারত
পড়ছ না তুমি , ভিষষয় কইছলা মরার আগে ‘ মানুষ ছাড়া মানার মতো আর কিচ্ছু নাই’ ।
বুঝলায় নি কিতা ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন