।। সুপ্রদীপ দত্তরায়।।
(C)Image:ছবি |
"এই যে দিদি, জল
দেখতে এসেছেন বুঝি? এদিকটায় আসুন, এখান
থেকে ভালো ফটো তোলা যায়। " অচেনা লোকের মুখে দিদি ডাকটা শুনে প্রথমে বুঝতে
পারিনি আমাকেই উদ্দেশ্য করে লোকটা কিছু বলছে , কাছে এগিয়ে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, "আমাকে কিছু বলছো বুঝি? "
--- "হ্যাঁ দিদি জল দেখতে এসেছেন তো ?"
খানিকটা
ইতস্তত করে বললাম, " হ্যাঁ
- না মানে এদিকটায় এসেছিলাম, তাই
ভাবলাম কোনদিন তো বন্যা দেখা হয়নি, তাই
আর কি ।"
--- "ভালো করছেন দিদি, খুব
ভালো করেছেন । কোনদিন যদি কোথাও আলোচনা হয়, আপনিও বলতে পারবেন । নিজের চোখকে দেখা বলে কথা ।"
--- " ঠিক বলেছো ভাই, খবরের
কাগজে পড়া আর নিজের চোখে দেখার মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক ।"
ছেলেটি
সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছে । দুপাশে জল মধ্যে ইএনডির বাঁধ। আমরা
বাঁধের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি । চওড়া বাঁধ,
তার উপর ছোট ছোট অস্থায়ী তাবু আর ছাউনি
তৈরি করে মানুষ আর গবাদি পশুর সহাবস্থান । মহিলারা এরই মধ্যে খড় কুটো যোগাড় করে
কিছু একটা খাবার তৈরি করতে ব্যস্ত । কোথাও কোথাও বয়স্ক সদস্যরা উদাস চোখে বসা ।
হয়তো নিজের ভাগ্যের সাথে শেষ দর কষাকষি সেরে নিতে ব্যস্ত । ছেলেটি আমাদের গরু মহিষ
ছাগল আর ছাউনি টপকে সাবধানে এগিয়ে নিয়ে চলছে । আমার খুব ভয়
করছিল । আমি সাঁতার জানি না । এত লোকের চলাচলে বাঁধের মাটি খুব নরম মনে হচ্ছিল ।
ভয় হচ্ছিল যে কোন মুহূর্তে পায়ের নিচে মাটি জলের তোড়ে ভেসে যেতে পারে । তারই মধ্যে
যথাসম্ভব নিজেকে বাঁচিয়ে বেশ কিছু ফটো আর সেলফি তুলে নিলাম । এরকম সুযোগ তো আর
সচরাচর আসে না । একটা লেংটা বাচ্চা মেয়েকে ক্যাডবেরি খাইয়ে একটা মহিষের বাচ্চার
সাথে ফটো নিলাম । আমার ঠিক পাশে বাচ্চা মেয়েটা আর পিছনে দুরে একটা বাচ্চা সহ মহিষ।
খুব ভালো এসেছে ফটোটি । আবার সাবধানে এগোচ্ছি । ছেলেটি আমাকে সাবধান করে দিয়ে বললে,
"জলের খুব কাছাকাছি যাবেন না, বিপদ হতে পারে ।"
বাঁধের
দুপাশে জল । একপাশে স্থির অন্য পাশে স্রোতস্বিনী নদী। একটা চাপা আক্রোশ নিয়ে এগিয়ে
চলেছে । তারই মধ্যে ভেসে যাচ্ছে জার্মানি ফেনা, ছোট বড় গাছ আরো কত কি । ওপাশে কোমর অবধি জলে ডুবিয়ে একটা
যুবতী মেয়ে বসা । বুঝলাম প্রাকৃতিক কাজ সারতে ব্যস্ত । এতক্ষণ আমাকে দেখছিল । চোখাচোখি
হতেই অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলে। আমি অভ্যাস বশে নাকে রুমাল চাপা দিলাম । ছেলেটি
নির্বিকার এগিয়ে চলছে । ওকে ওর বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করায় দুরে জলের সমুদ্রের মধ্যে
একটা টিনের চালা দেখিয়ে বললে, "ওই
যে ওইটা আমার বাড়ি ।"
আঁতকে
উঠলাম । বললাম, "সত্যি তোমাদের খুব
কষ্ট, তাই না ?
--- " ও অভ্যাস হয়ে গেছে । প্রতি বছরই এভাবে বানের জলে ঘর ভাসে। আমরা
বাঁধের উপর ঘর বাঁধি । মন্ত্রী আমলা , বিভিন্ন
সংগঠন আসে । কেউ খাবার দেয়, কেউ
কাপড়। কখনো সবাই পায় আবার কখনো পায় না।
-- "কেন -- ?" আমি
মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করলাম ।
--- " আসলে সবটাই যার যার সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে । নানাভাবে ফটো
সেশন হয় , পত্রিকাতে ফলাও করে
ছাপে । পরদিন থেকে সেই দল উধাও, আবার
অন্য দল আসে। এই কদিন আমাদের আর রান্না বান্না করতে হয় না। আমরা এই বাঁধের উপরেই
পিকনিক সারি ।"
--- " কিন্তু তোমাদের ঘর বাড়ি ?"
--- " যে কদিন জল থাকে, ওভাবেই
থাকে । তারপর জল কমলে, রিলিফ
বন্ধ হলে আমরা আবার ফিরে যাই।"
--- " কিন্তু তোমাদের জিনিসপত্তর ?"
ছেলেটি
হয়তো কিছু একটা উত্তর দিচ্ছিল, আমার
শোনা হলো না । আসলে ঐ সময়ে একটা মাঝারি বয়সের মহিলা গলা অবধি জল ভেঙে বাঁধের দিকে
আসছে । মাথায় গামলা জাতীয় একটা পাত্রে কিছু জিনিস ।
আমি
এত সুন্দর ছবিটার ভিডিও করার লোভ সামলাতে পারলাম না । ছেলেটি পাশ থেকে বললো ,
"আমার বৌদি --।" তারপর চিৎকার করে মেয়েটির সাথে নানা কথা বলতে
লাগল ।
আমি
সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে ছবিটা তুলতে থাকলাম । ধীরে ধীরে মেয়েটি জল থেকে বেরিয়ে আসছে
। একটা ব্লাউজহীন ভেজা শাড়ি শরীরের সঙ্গে মিশে আছে । শরীরের প্রতিটি ঢেউ প্রতিটি খাঁজ
সুস্পষ্ট । যৌবনের জোয়ারে ভরা শরীর । মেয়েটি আঁচলের শেষ প্রান্ত দিয়ে নিজের
লজ্জাটুকু ঢাকার অসহায় চেষ্টা নিল। আমি হাসলাম । মনে মনে বললাম, যত
চেষ্টাই কর না কেন আমার ক্যামেরার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না । মনটা খুশিতে ভরে
গেল ।খুব ভালো ছবি এসেছে । আজকের জন্য ফেসবুক হিট। একবার রিভিউ করে ছবিগুলো দেখে
নিচ্ছিলাম, হঠাৎ আশেপাশে লোকদের মধ্যে দৌড়ঝাঁপ আর ব্যস্ততা দেখে বুকের
ভিতরটা কেঁপে উঠলো । কোথাও বাঁধ ভাঙলো নাতো ? একমুহূর্তের জন্য মনে হলো এত ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হয়নি । ছেলেটি ও
দেখলাম বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে এদিকে ওদিকে ছোটাছুটি করছে ।
আমি
হতভম্ব । সবার চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ । সবাই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । আমার
সাথের ছেলেটি অনেক আগেই চলে গেছে । অনেক কষ্টে একটা ছেলেকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করে
জানতে পারলাম একটা লাশ জলে ভেসে যাচ্ছে । মনের মধ্যে যেটুকু ভয় উদয় হয়েছিল সবটুকু
একনিমেষে উধাও হয়ে প্রচণ্ড কৌতূহল সৃষ্টি হলো। আমিও ওদের পেছনে পেছনে ছুটলাম
।ততক্ষণে আমার ডর ভয় সব চলে গেছে । ওদের পাশে গিয়ে দেখতে পেলাম সেই ছেলেটিও সেখানে
দাঁড়িয়ে । আমাকে দেখালো ফুট বিশেক দুর দিয়ে
একটা কিছু ভেসে যাচ্ছে । আর বেশ কয়েকটা কাক ওইটির ওপরে বসে ওই লাশটাকেই
খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে । ওরা বলল এটা নাকি কোন মহিলার লাশ। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না
। মুখ দেখা যাচ্ছে না, জলে
ডুবানো। খুব হতাশ হলাম, ভালো
ফটো আসবে কিনা সন্দেহ ।তথাপি যথাসম্ভব জুম
করে যতটা সম্ভব ফটো নিলাম ।বলা যায় না
হয়তো তার মধ্যে থেকে কিছু একটা লেগে যেতে পারে । মনটা খুশিতে ভরে গেল । যাক আসাটা
সার্থক হয়েছে ।
অনেকটা
সময় ওদের সাথে কাটিয়ে সবার কাছে থেকে বিদায় নিলাম । ফিরে আসছি পিছন থেকে কেউ
একজনের দিদি ডাকে হাসি মুখে ঘুরে বললাম, "কিছু
বলবে -- ?"
ওদের
মধ্যে থেকে একটা ছেলে এগিয়ে এসে বললো, " দিদি কেমন দেখলেন ?"
বললাম,
" খুব ভালো, সত্যি খুব ভালো ।ফটোগুলোও খুব ভালো এসেছে ।"
ছেলেটি
হাসলো । পকেট থেকে মোবাইল বের করে বলল, "আমার নম্বরটা রেখে দিন। সময় পেলে আবার আসবেন । বন্যার জলে শেষ
বেলার সূর্য ডোবার ছবি এখানে খুব ভালো আসে ।" তারপর খানিকটা ইতস্তত করে বললো,
" কিছু মনে করবেন না দিদি, একটা কথা বলি ।"
বললাম,
" বল---।"
---" আপনাদের
ফ্ল্যাট বাড়িতে যদি কখনো আগুন লাগে তবে দয়া করে একটা ফোন করবেন প্লিজ । ফ্ল্যাট
বাড়ি আগুনে পুড়তে আমরা কখনো দেখিনি দিদি ।"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন