।। চিরশ্রী দেবনাথ।।
আসন্ন বর্ষার দুপুর। রোদ উছলে পড়ছে চারপাশে। রোশনাইর
ব্যাগ ভারী। ক্লান্ত পা। শুকনো মুখ। খিদেও পেটে অনেক অনেক। সেই সকাল দশটায়
ফ্যাক্টরির অফিস থেকে বেরিয়েছে। আজ দুপুর তিনটের মধ্যে সব প্রোডাক্ট বেচে তবে কাগজ
জমা দিতে হবে।
নাহলে কাল আর চাকরি থাকবে কিনা বলা শক্ত।
এই সামনের বাড়িটায় যাওয়া যাক। বাইরে সায়া, চুড়িদার, শাড়ি ঝুলছে
বেশ কয়েকটি। নিশ্চয়ই অনেক মহিলা আছেন এ বাড়িতে। অবশিষ্ট স্যানিটারি ন্যাপকিন আর কয়েকটি
সাবান, শ্যাম্পু এ
বাড়িতেই বিক্রি হয়ে যাওয়ার কথা।
রোশনাই দরজার পাশে কলিং বেলে আঙুল রাখলো।
দরজা খুলে সামনে যিনি দাঁড়ালেন, তিনি মহিলা।
দীর্ঘ ।
ঋজু। ফর্সা। হালকা রঙের শাড়ি, ব্লাউজ। সধবার চিহ্ন নেই।
রোশনাই বলল, সে সের্লসগার্ল।
স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি করতে এসেছে।
ভদ্রমহিলা একটু গম্ভীর হলেন।
তারপর আবার হাসলেন।
ওকে যত্ন করে ভেতরে নিয়ে বসালেন। এই আদরটুকু রোশনাইর
কাছে অপ্রত্যাশিত। কেউ করে না। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘর। ভেতর দিকে একচিলতে
রোদেলা বারান্দা দেখা যাচ্ছে। কয়েকটি টব। তাতে সতেজ হয়ে আলো করে আছে বাহারি
কচুপাতা। একটাতে আবার খুব ঘটা করে লঙ্কা লাগানো। লাল লাল লঙ্কা ঝুলে আছে, তীব্র অহংকারের
মতো।
অহংকার কেমন হয়। রোশনাই ভাবতে লাগলো। তারও কি আছে
এমন অহংবোধ। কই নাতো।
পোড় খাওয়া জীবনে অহংকারের চুমু থাকে না।
সেই মহিলা আবার ফিরে এলেন।
একটা প্লেটে খিচুড়ি, আলুভাজা, আর
এক গ্লাস সরবত।
রোশনাই খুব অবাক হলো। তিনি বললেন খাও।
পেটে আগুন জ্বলছে। না খেয়ে হবে। সে খেতে লাগলো। একদম
সিলেবাস মেনে রান্না করা খিচুড়ি। ভাজা মুগ, গোবিন্দভোগ চাল, পাঁচফোড়নের
ভাজা গুঁড়ো, ঘি, তেজপাতা, গরমমশলা। আহা কতদিন এধরনের যত্নশীল রান্না খাওয়া হয়নি।
খুব তৃপ্তি করে খেলো রোশনাই।
ঠিক এইসময় খোলা দরজা দিয়ে ঢুকলো দুজন মেয়ে।
নাহ্ মেয়ের
মতো দেখতে দুজন ছেলে...আসলে ঠিক ছেলেও নয়।
যেন তারা অন্য কেউ।
ভীষণ সরল মুখমণ্ডল। কোঁকড়ানো একটু লম্বা চুল। মসৃণ
গাল।
দুজোড়া তরুণ চোখ রোশনাইকে দেখছে। রোশনাইও তাদের
দেখছে।
তারা কলকল করতে করতে ভেতরে চলে গেলো।
রোশনাই এবার মূলকাজে উদ্যোগী হলো।
ব্যাগ থেকে অবশিষ্ট ন্যাপকিনের প্যাকেট গুলো বের করে
টেবিলে রাখলো। দুটো শ্যাম্পু আর দুটো সাবান।
ভদ্রমহিলা কাউকে নিধি বলে ডাকলেন। নিধি এলো, একজন বছর
পঁয়তাল্লিশের দুর্বল স্বাস্থ্যের ফ্যাকাসে দেখতে মহিলা।
বয়স্কা ভদ্রমহিলা বললেন , সব জিনিসগুলো
ঘরে নিয়ে যাও, আর টাকা দিয়ে দাও ওকে। আমরা কিনলাম সব।
নিধি সঙ্গে সঙ্গে বলল, কেন মা? সাবান
শ্যাম্পু না হয় ঠিক আছে, কিন্তু ওসব।
ভদ্রমহিলা শুধু বললেন হোক না একটু বেহিসেব।
রোশনাই অবাক হয়ে সব দেখছিল। তার জিনিস বিক্রি হয়ে
গেলো।
তবু ইচ্ছে
করছিল, একটু জিজ্ঞেস করে, যদিও এধরনের কৌতূহল ওর স্বভাববিরুদ্ধ...।
তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে, সেই ভদ্রমহিলা
বললেন, জানি তুমি একটু অবাক হয়েছো, তাই
বলছি, আসলে আমার বয়স ষাট পেরিয়েছে কবেই, আমার আর ন্যাপকিনের দরকার নেই।
নিধি আমার একমাত্র ছেলের বউ, বিধবা। জরায়ুতে ক্যান্সার হয়েছিল আমার ছেলে বেঁচে থাকতেই, কেটে বাদ দিতে হয়েছে, ওরও দরকার নেই। আর যে দুজনকে
দেখলে, ঈশ্বরের অসীম পরিহাস, ওরা যমজ।
ঈশ্বর তাদেরকে ছেলে না মেয়ে চিহ্নিত করেননি। তাই ওদেরও দরকার নেই।
রোশনাই স্তব্ধ হয়ে রইলো। তারপর বললো, তাহলে মাসিমা কেন শুধু শুধু টাকা খরচ
করলেন। দিয়ে দিন, কিছু মনে করবো না।
ভদ্রমহিলা মাথা নিচু করলেন। বললেন, আসলে আমি এসব
তোমার জন্য কিনেছি।
আমার জন্য? আরোও অবাক হলো রোশনাই।
হ্যাঁ তোমার জন্য।
এ বাড়ি থেকে মেয়ে গন্ধ হারিয়ে গেছে। অনুর্বর হয়ে গেছে গর্ভধারণের মাটি। যাকে বলে
ব্যারন ফিল্ড।
তুমি যখন রজঃস্বলা থাকবে, এ বাড়ির সামনে
দিয়ে যাবে, একটু আসবে। থাকবে। যদি লাগে তখন।
আমি শিক্ষিকা ছিলাম। নিজের আর স্বামীর পেনশন পাই।
টাকার জন্য ভেবো না।
এই দেখো কচু গাছও টবে লাগিয়ে রেখেছি। কচুগাছের নাকি
বংশ শেষ হয় না।
মনে শুধু
আজকাল কুসংস্কার।
কিসের অভিশাপ
আমার ঘরে !
তাই তোমার পিরিয়ডসের দিনে তুমি আমার বাড়িতে আসবে।
আমি তোমাকে একটু খাওয়াবো। যদি এ জন্মের অভিশাপ কাটাতে পারি।
রোশনাই দেখল ভদ্রমহিলার চোখ শালগ্রাম শিলার মতো কালো, স্তব্ধ। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন মরুভূমির বুকে উটের মত।
সে শুধু অস্ফুটে বলল, আসব, অবশ্যই
আসব।
মনে থাকবে ঠিকানা।
ধূসর রঙের বাড়ি। ব্যারন ফিল্ড।
সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে রোশনাই ভাবতে
লাগলো...সংস্কার, কুসংস্কার, ঈশ্বর এসবের কি সত্যিই কোন মানে আছে ।
এই ভদ্রমহিলা কি আলোর যাত্রী না অন্ধকারের?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন