ভূমিকার বদলে
শতবর্ষে পা দিলেন গণনাট্য আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী-সংগঠক হেমাঙ্গ বিশ্বাস। একাধিক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ত্বের জন্মের শতবর্ষ বা সার্ধশতবর্ষ চলছে এখন। তার মানে আজ থেকে দেড়শো থেকে একশ বছর আগে অবধি যে সময়পর্ব ছিল তা সত্যিই আমাদের অবিভক্ত বঙ্গের জন্যে ছিল হিরণ্যগর্ভা। এই সময়পর্বে জন্ম নেওয়া উজ্জ্বল মানুষেরাই প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বাঙালির সাংস্কৃতিক সামাজিক রাজনৈতিক জীবনের ভিত গড়ে দিয়েছেন। উনবিংশ শতকের নবজাগরণ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কারো মতে, এই নবজাগরণ খণ্ডিত, কারণ এই জাগরণের আলো পড়েছিল শুধু নগর কলকাতায়। যুক্ত বাংলার বাকি জনপদ ছিল এই আলোকচ্ছটার থেকে অনেক দূরে অন্ধকারে। এ কথাটি বলা বাহুল্য, সর্বাংশে সত্য নয়। কলকাতার অদূরবর্তী গ্রামাঞ্চল হয়ত এই আলোর রশ্মিরেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, কিন্তু দূরে উত্তর পূর্ব ভারত ও পূর্ববঙ্গের ছোট শহর ও মফস্বলে সেদিনের সেই নবজাগরণের বার্তা যে যথেষ্টই পৌঁছেছিল তার চিহ্ন এখনও দেখতে পাওয়া যায়। তবে অপূর্ণতা তো একটা ছিলই, ওই আলো ছিল সমাজের উচ্চকোটির বা মধ্যবিত্ত মানুষের একান্ত আলো। উনবিংশ শতকের সেই খণ্ডিত নবজাগরণের অপূর্ণতা অনেকটাই ঘুচিয়ে দিয়েছিল চল্লিশের প্রগতি সাহিত্য ও গণনাট্য আন্দোলন। সমাজের শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিকতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ এই আন্দোলনের তরঙ্গস্পর্শে শিল্পকলা সাহিত্য সঙ্গীত নাটকে সৃষ্টিশীলতার নতুনতর অভিযানে কাঁধেকাঁধ দিয়ে শামিল হলেন শহুরে আর গ্রামীণ শিল্পীরা। তখন দেখা গেল, গ্রামীণ লোকশিল্পী নিবারণ পণ্ডিত ও টগর অধিকারীর সাথে একই মঞ্চে সঙ্গীতের আসরে হাজির হচ্ছেন কলকাতা মহানগরীর সুচিত্রা মিত্র হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দেবব্রত বিশ্বাসেরা। মহানগরী, মফস্বল, গ্রামাঞ্চল- সৃষ্টিশীলতার সব পথ যেন এসে মিলল গণনাট্যের মোহনায়। নাটক ও গল্পে উপন্যাসে চিত্রকলায় তখন নায়কের আসনে অভিষিক্ত হলেন সমাজের শ্রমিক কৃষক নিপীড়িত ব্রাত্যজনেরা। উনিশ শতক এবং বিংশ শতকের চল্লিশের দুই নবজাগরণের কী উত্তরাধিকার আমরা রচনা করে চলেছি আজ এই মুহূর্তে, সেটা অন্য আলোচনার বিষয়। তবে কোথায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তা ঠাওর করার জন্যেও প্রয়োজন শতবর্ষ ও সার্ধশতবর্ষ পদার্পণ করা সেই সমস্ত মানুষের জীবনের নানাদিকের প্রতি দৃষ্টি ফেরানোর। এঁদের মধ্যে অনেককেই তাঁদের জীবদ্দশায় প্রকৃত সম্মান পান নি। এই না-পাওয়া জীবনের নানা পর্বে দারুণভাবেই বেদনাবিদ্ধ করেছিল তাঁদের। আজ তাঁদের জন্মের শতবর্ষ বা সার্ধশতবর্ষে এসে কিছুটা হয়ত পাপ স্খলন হবে যদি এই কাজ আমরা করতে পারি। শুধু অপরাধবোধ থেকে মুক্তি কেন, সাম্প্রতিকের অনেক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আঁধার-রহস্যও খোলসা হবে এই চর্চার মধ্য দিয়ে।
আপোষহীন শিল্পীসংগ্রামী
হেমাঙ্গ বিশ্বাসও ছিলেন এমন মানুষ যিনি জীবদ্দশায় তাঁর অনেক সহ-পথিক বন্ধুদের উপেক্ষা ও অবহেলার শিকার হয়েছেন। উত্তরপর্বের একজন গণনাট্যকর্মী ও সংগঠক হিসেবে নিজেদের অপরাধ কবুল করা আজ আমাদের জন্যে এক ঐতিহাসিক কর্তব্য। গণনাট্যের অসংখ্য আলোকোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ত্বের ভিড়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস অনন্য ছিলেন নানা কারণে। গণনাট্যের সে যুগের মানুষদের মধ্যে একইসাথে নেতৃস্থানীয় সংগঠক ও অগ্রণী শিল্পী হয়ত হেমাঙ্গ বিশ্বাসই একা। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের শিল্পী স্রষ্টা সত্তার সাথে পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক মহল হয়ত পরিচিত, কিন্তু সংগঠক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পরিচিতি মূলত আসামে। সেখানে তাঁর অতীতের সাংগঠনিক অবদান আজো মূর্ত হয়ে আছে আসামের গণনাট্য আন্দোলন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে। সেই সময়ে উত্তর পূর্বের নানা ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর শ্রমজীবী অংশের শিল্পী থেকে শুরু করে তৎকালীন আসামের সংস্কৃতি ক্ষেত্রের বিশিষ্ট মানুষদের তিনি গণনাট্যের মঞ্চে সমবেত করেছিলেন। এখনো আসামের নানা আলোচনা সভায়, পত্রপত্রিকায় বারবার উঠে আসে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নাম। গণনাট্যের অনেকেই সাংগঠনিক জীবনের একটা পর্যায়ে এসে সংগঠনের কাজে বেশি মন দিতে গিয়ে সৃষ্টিশীলতার দিকটিকে ধরে রাখতে পারেন নি। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই উল্টো। তিনি যখন সংগঠক হিসাবে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন, সেই সময়েই তাঁর সৃষ্টির প্রবাহ ছিল বেশি। সংগঠক ও শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিলেন একই সূত্রে গাঁথা। সংগঠনের কাজে সুরমা উপত্যকা থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, সেখান থেকে উত্তর পূর্বের পার্বত্য অঞ্চলে চষে বেড়ানোর জীবনে তিনি শুধু সংগঠনের মাটি খুঁজে পান নি, পেয়েছেন সৃষ্টির অফুরান রসদও। আরেকটি কারণেও হেমাঙ্গ বিশ্বাস অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গণনাট্যের স্বর্ণালী যুগের বহু প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ত্ব, প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক যোগাযোগ ক্ষীণ হতেই গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন বাণিজ্যিক সংস্কৃতির বাজারের স্রোতে। কখনো সখনো ‘ইস্যুভিত্তিক’ ডাক এলে হয়ত সাড়া দিয়েছেন খানিকটা। বাণিজ্যের সাথে দায়বদ্ধতার একটা ‘ব্যালেন্স’-এর খেলা খেলেই কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের বেশিরভাগ সময়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস ব্যতিক্রম। মতাদর্শগত কারণে একটা সময়ে সরে গেছেন গণনাট্যের মূল প্রবাহ থেকে কিংবা সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনও ত্যাগ করেছেন একটা সময়পর্বের পর, তবু একটি দিনের জন্যেও বাণিজ্যের কাছে মাথা নত করেন নি। তাঁর ভেতরের অ্যাক্টিভিস্ট সত্তা জাগ্রত ছিল জীবনের শেষ দিন অবধি।
ব্যক্তিগত স্মৃতি
তাঁর জীবনের অন্তিম পর্বে খানিকটা সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল আমার হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সাথে । ১৯৮২ সালে শিলচরে আমাদের সংগঠন ‘দিশারী’র আমন্ত্রণে হেমাঙ্গ বিশ্বাস এসেছিলেন তাঁর মাস সিঙ্গার্সের সদস্যদের নিয়ে। শিলচর তাঁর পুরনো কর্মক্ষেত্র। বহু বছর পরে এখানে এসে তিনি পেয়েছিলেন তাঁর এক সময়ের সহকর্মীদের। শিলচরের মানুষও উদ্বেল হয়ে উঠেছিলেন তাঁকে কাছে পেয়ে। তরুণ বয়সী আমরা তখন প্রথম গণসঙ্গীত গাইছি। কিন্তু শিলচরে গণনাট্যধর্মী সংগঠন বা আন্দোলনের অবর্তমানে সেই গানের রূপায়ন সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও তাঁর মাস সিঙ্গার্সের সদস্যরা আমাদের ভাবনাতে ঝড়ের হাওয়া লাগিয়ে দিলেন। কয়েকটি দিন খুব কাছাকাছি থেকে দেখেছি তাঁদের। অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে একান্ত আলাপচারিতা- সবকিছু নিয়ে মানুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাস আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখলেন কয়েকটা দিন। সেবার চাঁদের হাট বসেছিল ‘দিশারী’র ‘মৈত্রী উৎসব’ নামের বার্ষিক অনুষ্ঠানে। সঙ্গীত পরিবেশন করতে একই সঙ্গে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল হেমাঙ্গ বিশ্বাসের এক সময়ের সহকর্মী আসামের দুই বিশিষ্ট কন্ঠশিল্পীকে। গুয়াহাটি থেকে এসেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী দিলীপ শর্মা ও গোয়ালপাড়ার লোকশিল্পী প্রতিমা বড়ুয়া। আলোচনা সভায় এসেছিলেন আসামের বিশিষ্ট বামপন্থী সমাজবিজ্ঞানী ড০ অমলেন্দু গুহ। মানুষের স্বতস্ফূর্ত সাড়ায় তিনদিনের উৎসবকে একদিন বাড়াতে হয়েছিল। তারপরও প্রবল বর্ষণমুখর সন্ধ্যার ওই অনুষ্ঠানে তিলধারণের জায়গা ছিল না। মঞ্চে দাঁড়িয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস যখন শিলচরের অদূরের আঠারোটিলার তেভাগা আন্দোলনের শহীদ মাধব নাথকে নিয়ে লেখা তাঁর অবিস্মরণীয় গান ‘আমরা তো ভুলি নাই শহীদ’ গাইছেন, তখন দর্শকাসনে বসা শিলচরের প্রবীণ বামপন্থী নেতাকর্মীদের চোখে অঝোরে ঝরছে অশ্রু। হেমাঙ্গ বিশ্বাসও গানের ফাঁকে ফাঁকে কথায় কথায় ফিরে যাচ্ছিলেন চল্লিশের দশক পঞ্চাশের দশকের কাছাড়ের গণনাট্য আন্দোলন কৃষক আন্দোলনের নানা স্মৃতিচারণে। সেবারের উৎসবে তাঁর অংশগ্রহণ শিলচরের প্রগতিশীল সংস্কৃতির মরা গাঙে জোয়ার নিয়ে এসেছিল। সেই সফরের পরই শিলচরে একের পর এক গড়ে ওঠে গণসঙ্গীতের দল। প্রতিবাদী সংস্কৃতি শিলচরের সংস্কৃতি অঙ্গনে আবার ফিরে এলো হারানো মর্যাদা নিয়ে। তাঁর মৃত্যুর বছর খানেক আগে আমার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলিতে আবার যোগাযোগ হয় তাঁর সাথে। মনে আছে, তারুণ্যের তেজে অস্থির হয়ে আমি এক সন্ধ্যায় খানিকটা রাজনৈতিক তর্কেও মেতে উঠেছিলাম তাঁর সাথে। সেই তর্কে কখনো তিনি বয়োজ্যেষ্ঠের মত আমাকে শিশু ভেবে এড়িয়ে যান নি, তর্কে মেতেছেন সমবয়সী সহ-পথিকের মত। পরে আবার সস্নেহে বলেছেন, তোমাদের বাপদাদার গ্রাম বেজুড়া আমার মামার বাড়ি। তুমি আমার মামার বাড়ির দেশের ছেলে। তোমার কাকা পিসি সিলেটে আমাদের সংগঠনের সাথে কাজ করত। তবে এত সামান্য সম্পর্কের মধ্য দিয়ে তাঁর মতো মানুষের বিশাল বিস্তৃত জীবনের কিছুই জানা যায় না। মনে পড়ে, কী গভীর বেদনাবোধ থেকে সে সময়ে বলেছিলেন কিছু কিছু কথা। যার মধ্যে তাঁর এককালের সংগঠন ও একসময়ের সতীর্থদের জন্যে ছিল বুকভরা অভিমান। অভিন্ন রাজনৈতিক মত সত্ত্বেও শুধু ভিন্ন পথের প্রতি আস্থার জন্যে তাঁর সৃষ্টিকেও কখনো কখনো উপেক্ষা করেছেন তাঁর এক সময়ের সতীর্থরা। গণনাট্যের গোড়ার যুগের গানের সঙ্কলন প্রকাশ করতে গিয়ে উপেক্ষিত হয়েছে তাঁর গান নিছক রাজনৈতিক সংকীর্ণতায়। যদিও সেই সঙ্কলনে এমন অনেকেরই গান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যাঁরা উত্তরজীবনে গণনাট্যের ভাবধারা থেকে সহস্র যোজন দূরে চলে গিয়েছিলেন। এমন সংকীর্ণতা তাঁকে পীড়িত করত। তিনি চাইতেন, রাজনৈতিক সংকীর্ণতার বাইরে গিয়ে বিভিন্ন ধারার বামপন্থীদের মিলিত মঞ্চ হোক গণনাট্য। যেমনটা হয়েছিল গণনাট্যের সূচনার যুগে। তিনি বলতেন গণনাট্যের উত্তরাধিকার ছড়িয়ে আছে বহু দূর অবধি। তিনি বলেছিলেন, গণনাট্য আন্দোলন গণনাট্য সঙ্ঘের সাংগঠনিক চৌহদ্দির চেয়েও অনেক বেশি বিস্তৃত। সংগঠনের সংকীর্ণসীমার ভেতর এখন আর তা সীমাবদ্ধ নয়।
হয়ে ওঠার দিনগুলি
১৯১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার মিরাশী গ্রামে এক রক্ষণশীল জমিদার পরিবারে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম। বাবা হরকুমার এবং মা সরোজিনী। তাঁর পিতৃ বংশ ছিল পুরোহিততন্ত্র ও জাতবিচারের প্রাবল্যের ঘেরাটোপে বন্দী, অন্যদিকে মাতুল বংশ হবিগঞ্জ মহকুমারই বেজোড়া গ্রামের চৌধুরী পরিবার ছিল উদার ও সাঙ্গীতিক। তাঁর নিজের ভাষাতেই, তাঁর বাবা ছিলেন ছোট অথচ জাঁদরেল জমিদার। পূজাআর্চা আর আচারের বাড়বাড়ন্তের তাঁদের নিজের বাড়িকে তিনি অভিহিত করেছেন ‘ধমক দিয়ে ঠাসা রামগরুড়ের বাসা’ হিসেবে। নানা উৎসবে উপলক্ষ্যতে সেই রামগরুড়ের বাসাতেও এসে ঢুকত হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ভাষায় ‘মাঠের হাওয়া’। বৃহত্তর সিলেটের নানা বর্গের লোকায়ত গানের সুরে ভরে উঠত তাঁদের ঘরের আঙিনা। এই সমস্ত গানের পশরা নিয়ে হাজির হতেন তাঁদের গ্রাম ও আশপাশ অঞ্চলের লোকশিল্পীরা যাঁদের অনেকে তাঁদের বাড়িরই নানা কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। অন্ত্যজ এই মানুষগুলির কন্ঠনিসৃত গানের শ্রবণেই বালক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানের হাতেখড়ি। অবশ্য হাতেখড়ি হয়েছিল মায়ের গানেও। বাপের বাড়ির সঙ্গীতধারায় স্নাত তাঁর মা গাইতেন নানা মেয়েলি গান, রজনীকান্তের গান, শ্যামাসঙ্গীত প্রভৃতি। তবে কানে যে গানগুলি প্রবেশ করত, তা বাড়ির পরিবেশে গেয়ে ওঠার সুযোগ ছিল না। ধানখেতের পাশ ধরে পাঠশালায় যাওয়া আসার পথে গলা ছেড়ে সেই গানগুলি গাইতেন বালক হেমাঙ্গ বিশ্বাস। খেতে কাজ করতে করতে মাঠের কৃষকরা তারিফ করত, সপ্রশংস মাথা নাড়ত পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়িয়ে যেত পথচলতি মানুষ। পরবর্তী জীবনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও লোকায়ত গানের তুলনামূলক আলোচনায় হেমাঙ্গ বিশ্বাস শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঘরানার উল্টোপিঠে লোকসঙ্গীতে বাহিরানার সংজ্ঞায়ন করেছেন। ভিন্ন অর্থে সঙ্গীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসও বাহিরানারই সন্তান। বাল্যকালে পাঠশালায় যাওয়ার পথে প্রাণের আনন্দে গেয়ে ওঠা গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া অন্ত্যজ মানুষদের আদরের লালুবাবু থেকে যৌবনের হেমাঙ্গ বিশ্বাস হয়ে ওঠার সময়পর্বটি প্রকৃতপক্ষেই নানা রঙে রঙে ফুটে ওঠারই প্রহর। ভূগোলের দিক থেকে যেমন, সাংস্কৃতিক পরিসরের দিক থেকেও তাই। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বাল্য থেকে যৌবন যেন এক সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা। জীবনের প্রথম পর্বের এই বর্ণময় সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতাই শিল্পী, সংগঠক এবং আপোষহীন সংগ্রামী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গড়ে ওঠার গোর্কি-বর্ণিত পৃথিবীর পাঠশালা। এই পর্বটি বিভক্ত নানা পর্যায়ে। বাল্য ও কৈশোরের প্রথম পর্ব তাঁর কাটে মিরাশী গ্রামে। কৈশোরের দ্বিতীয় পর্বে বাবার আদেশে উজান আসামের ডিব্রুগড় শহরে বাবার গুরুদেব মুক্তানন্দ স্বামী ওরফে ওঁ বাবার আশ্রমের আশ্রমিক পরিবেশে বছর দুয়েক কাটে তাঁর। এখানে আশ্রমের কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় তাঁর মন হাঁসফাঁস করত। তবে বিদ্যালয়ে পেতেন মুক্ত জীবন। এখানেই তাঁর প্রথম পরিচয় অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতির সাথে। সহপাঠী লোহিত কাকতীর কাছে শেখেন জীবনের প্রথম অসমীয়া গান। হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, কিশোর বয়সেই অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুবাদেই পরবর্তী জীবনে তিনি পেরেছিলেন আসামের অসমীয়া অধ্যুষিত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় গণনাট্য আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে অসমীয়া সমাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে। ওঁ বাবার আশ্রমের নানা উত্থান পতনের প্রেক্ষিতে বাবা হরকুমার হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে ডিব্রুগড়ের আশ্রম থেকে নিয়ে এসে হবিগঞ্জ শহরের হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। আশ্রমের কঠোর অনুশাসন বা বাড়ির সংস্কারাচ্ছন্ন পরিবেশের কোনোটিই এখানে ছিল না। ফলে বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর অভিষেক হয় হবিগঞ্জ শহরেই। খেলাধুলা স্বাধীনতা সংগ্রাম গান গাওয়া, সব কিছুই অর্গলমুক্ত তাঁর নতুন জীবনকে ভরিয়ে দিল। তখন সারা দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনে জোয়ার এসেছে। তার ঢেউ এসে লাগল সিলেটের এই মহকুমা শহরেও। স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচণা হল। মিছিলে পা মেলানোর পাশাপাশি চলল দেশাত্মবোধক গানে গলা মেলানোও। মাত্র ১৮ বছর বয়সে জীবনের প্রথম জেলবাস হল তাঁর। নগাঁও জেলে থাকার সময় তৎকালীন আসামের বিশিষ্ট কংগ্রেসী নেতা ও পরবর্তী কালে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা তাঁকে শেখান প্রথম অসমীয়া বনগীত। এ ভাবে অসমীয়া লোকগানের সাথেও তাঁর পরিচয় ঘটে যায়। আসামের সে সময়ের বিশিষ্ট গীতিকার পার্বতী প্রসাদ বরুয়ার লেখা ওই বনগীতটির কথা সারাজীবন মনে রেখেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর তিনি সিলেটের মুরারী চাঁদ কলেজে ভর্তি হন। এখানে আসার পর তাঁর রাজনৈতিক কর্মকা-ও বেড়ে যায়। কলেজের ক্লাসে শিক্ষকদের মুখে সোভিয়েতের বিপ্লবের কথা ও নতুন সমাজ গত্তনের কথা শুনে বলশেভিকবাদের প্রতি কিছুটা আকর্ষণ গড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু সিলেটে তখনও কমিউনিস্ট পার্টির কোনও শাখা গড়ে ওঠে নি। কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে কলেজীয় শিক্ষা ত্যাগ করে পুরোদস্তুর ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতা আন্দোলনে। জেলার নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে অংশ নেন লবণ সত্যাগ্রহে। এই অভিযানে অংশ গ্রহণ করার সময়ই দ্বিতীয়বার কারাবরণ করেন। এবার তাঁর সাজা হয় আড়াই বছরের। জেলজীবনে নানা জাতির কয়েদীদের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। গান জানা বন্দী হিসেবে সহবন্দীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠেন। এবার জেলে অসমীয়া বন্দীদের কাছে শেখেন অসমীয়া কাব্য সঙ্গীত নাটকে নতুন জোয়ার আনা জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালার গান। অসমীয়া ভাষা সংস্কৃতির নতুন দিনের পথিকৃৎ এই ব্যক্তিত্ত্বকে পরে তিনি টেনে আনেন গণনাট্যের অভ্যন্তরে। চা মালিক পরিবারের সন্তান অথচ শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর জ্যোতিপ্রসাদ হন গণনাট্যের প্রথম রাজ্য সভাপতি। এই জেলে বন্দী থাকার সময়ই যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। গুরুতর অসুস্থতার সুযোগে সরকার চেয়েছিল মুচলেকার বিনিময়ে তাঁকে মুক্তি দিতে। সহবন্দী স্বাধীনতা সংগ্রামীরা বা অন্য কয়েদীরাও তাঁকে বোঝান শারীরিক অসুস্থতার প্রেক্ষিতে মুচলেকার বিনিময়ে মুক্তি নিতে। কিন্তু আজীবন সংগ্রামী হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে কেউই মুচলেকা দিতে রাজী করাতে সমর্থ হল না। দেড় বছরের মাথায় সরকার নিজে থেকেই তাঁকে মুক্তি দিল। চিকিৎসার জন্যে পরে তাঁর বাবা তাঁকে যাদবপুরের কে এস রায় স্যানিটোরিয়ামে পাঠান। এখানে ভর্তি ছিলেন অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী, যাঁরা জেলজীবনের অত্যাচারে বা স্বাধীনতা সংগ্রামের কঠোর জীবনে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এখানেই অনিলেন্দ্র রায় নামের একজন কমিউনিস্ট রোগীর সংস্পর্শে এসে বিভিন্ন কমিউনিস্ট সাহিত্য পড়ার সুযোগ হয় তাঁর। এই হাসপাতালেই তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত হন। কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক রাজনীতির সাথেও তাঁর যোগাযোগ হয় এখানে। আসামের প্রথম যুগের কমিউনিস্ট নেতা সিলেটের দিগেন দাশগুপ্ত ও চঞ্চল শর্মা হাসপাতালে এসে তাঁকে সিলেটে কমিউনিস্ট পার্টির শাখা গড়ে ওঠার খবর দিয়ে তাঁকে এতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। এটা ছিল সংগ্রামী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জীবন-নদীর সমুদ্রে এসে পৌঁছনোর মতোই স্বাভাবিক ঘটনা। গুয়াহাটি জেলে বন্দী থাকার সময়েই মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলার খবর শুনে হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও আরো কয়েকজন বন্দী কমিউনিস্ট মতবাদের দিকে খানিকটা ঝুঁকেই পড়েছিলেন। তখন সাংগঠনিক ভাবে ভারতের নবগঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব ছিল না। পরে যাদবপুর হাসপাতালে কমিউনিস্ট মতাবলম্বী নানা পত্রপত্রিকা অন্য রোগীদের মারফৎ হাতে এলে পত্রিকার যোগাযোগের ঠিকানায় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলেন তিনি। কমিউনিস্ট মতবাদ স্বাধীনতা সংগ্রামী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মধ্যে নিয়ে এল শ্রেণিচেতনা। শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর হয়ে ফিরে এলেন সিলেটে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে মিলিয়ে দিতে হবে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির লড়াই। গ্রামে ফিরে এসে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুললেন শ্রমজীবী কৃষক ও গরিব মানুষের সাথে। সংস্কারাচ্ছন্ন পরিবারে উদ্যত হলেন ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানতে। জমিদার বাড়ির ছেলে হয়ে গ্রামের অন্ত্যজ শোষিত মানুষদের অঞ্চলে গিয়ে সভাসমিতি সংগঠিত করতে শুরু করলেন। অবস্থা এমন জায়গায় গেল বাবার সভাপতিত্বে আয়োজিত এক গ্রামের সভায় ধর্মীয় ভাবাবেগ তৈরির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শ্রেণি রাজনীতির বার্তা নিয়ে জড়িয়ে পড়লেন বাবার সাথে বিতর্কে। কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক দায়িত্ব হিসেবেই রাজনৈতিক কাজের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলার কাজ শুরু হল। গড়ে তুললেন সুরমাভ্যালি কালচ্যারাল স্কোয়াড। আবাল্য শোনা লোকায়ত গানের সুরে বাঁধলেন কৃষক সংগ্রামের নতুন গান। মিরাশী গ্রামের জমিদার পরিবারের ছেলে হেমাঙ্গ বিশ্বাস পরিণত হলেন কমিউনিস্ট গণশিল্পী সংগঠক হেমাঙ্গ বিশ্বাসে।
গণআন্দোলনের কর্মী থেকে শিল্পীসেনানী
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পরবর্তী জীবনের খ্যাতি যদিও শিল্পী স্রষ্টা হিসেবে, তাঁর জীবনের গতিপথের দিকে তাকালে দেখব, তিনি মূলত চেয়েছিলেন জনসাধারণের মুক্তির সংগ্রামের একজন সৈনিক হয়ে উঠতে। জীবনের শুরুতে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় শামিল হয়েছেন। আন্দোলনের জোয়ারভাঁটায় শেষপর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছেন সর্বহারার মুক্তিসংগ্রামের আন্তর্জাতিকতার মহাসমুদ্রে। এই যাত্রাপথে গান তাঁর সাথে ছিল প্রথম থেকেই। ১৯৩০ সালেই তিনি গান গেয়েছেন সত্যাগ্রহের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মিছিলে পা মিলিয়ে। তিরিশের দশকের শেষের দিকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভ করেন। তাঁর সময়ের গণনাট্যের শিল্পী সাহিত্যিকদের অনেকেই যেমন শিল্পী বুদ্ধিজীবী হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পৃক্ত হন, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তেমনটা ছিল না। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেই তিনি যুক্ত হয়েছিলেন কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টিতে। তাঁর গান রচনাও ছিল না কোনো সাঙ্গীতিক পিপাসানিবৃত্তিও। অর্থাৎ তিনি প্রথমে একজন রাজনৈতিক কর্মী, পরে শিল্পী। আন্দোলন সংগ্রামের প্রয়োজনে তিনি গান লিখেছেন, গান গেয়েছেন। আন্দোলন সংগ্রামের বাস্তব অভিজ্ঞতা তাঁর গানের ভাষা পাল্টে দিয়েছে। আবার এটাও সত্যি, সঙ্গীতকে রাজনৈতিক সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে তিনি কখনোই গান থেকে নিরাসক্তির দূরত্বে বাস করেন নি। সংগ্রামের হাতিয়ারকে শাণিত করার কাজের প্রক্রিয়ার মধ্যেই নানা ধরনের সঙ্গীতের সাথে তাঁর একটি সংলাপ গড়ে ওঠে। এই সংলাপ একদিকে তাঁর গানকে বিশিষ্টতা দিয়েছে, অন্যদিকে সঙ্গীতের নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রেও তাঁর অবস্থানকেও সুস্পষ্ট করেছে। তাঁর আন্দোলন সংগ্রামের গতিপথ যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, সেভাবেই পরিবর্তিত হয়েছে তাঁর গানের ভাষা। তিরিশের দশকের শেষের দিকে লেখা তাঁর একটি গান ‘আগে চল আগে চল মজুর কিষাণ/ সমরশিবিরে শোন হাঁকিছে বিষাণ’ তৎকালীন আসামের রাজধানী শহর শিলং-এ একটি কৃষক সমাবেশে কৃষকদের মুখে মুখে গীত হয়। তাঁর এই সময়ের গানগুলি সহজ সুরে নজরুলের দেশাত্মবোধক গানের ঢঙে লেখা বাণীতে লিখিত। পরবর্তী কালে কৃষক আন্দোলনের সাথে তাঁর সম্পর্ক যত নিবিড় হয়েছে, ততই তাঁর গান লোকসঙ্গীতের কাছাকাছি এসেছে। একটি গান লিখেছিলেন বেহেলীর কৃষক সম্মেলনের জন্যে, ‘আমরা দেবো না, দেবো না/ দস্যুকে পথ ছেড়ে দেবো না/ ওই দস্যু আসে হুশিয়ার/ মুসোলিনি তোজো আর হিটলার/ সাথে আছে রুশ-চীন/ বেপরোয়া চলো বাধাহীন’। হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়, এই গানগুলো তাঁরা অত্যন্ত উৎসাহভরে দলবেঁধে গাইলেও এ ধরনের গান কৃষকদের হৃদয় স্পর্শ করতে ব্যর্থ হত। এটা বুঝতে পারার পরই কৃষক সাধারণ যে সঙ্গীতধারায় বাস করেন, যে ভাষায় গান শোনেন, সেই ভাষার কাছাকাছি গানকে নিয়ে যাওয়ার তাগিদ অনুভব শুরু হয়। তারপরই ভাটিয়ালি সুরে রচনা করেন, ‘ও চাষী ভাই/ তোর সোনার ধানে বর্গী নামে দেখরে চাহিয়া’। সে সময় গানটি সিলেটের গ্রামাঞ্চলের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। সিলেটের সারিগান, ‘সাবধানে গুরুজীর নাম লইওরে সাধুভাই’ এর সুরে কথা বসিয়ে লিখলেন ‘তোমার কাস্তেটারে দিও জোরে শান কিষাণভাই’ গানটি। চল্লিশের কৃষক আন্দোলনের সূত্রে এই গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে মনিপুরের কমিউনিস্ট নেতা ইরাবত সিংহ এই গানটি মনিপুরি ভাষায় অনুবাদ করেন। পরবর্তী সময়ে মনিপুরি গানটির রেকর্ডও প্রকাশিত হয়। মনিপুরে এই গানটির মনিপুরি অনুবাদটি যথেষ্ট জনপ্রিয়। দুর্ভিক্ষ ও জাপবিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে ময়মনসিংহের শরৎ নাথের ‘আইলরে চৈতন্যের গাড়ি সোনার নদীয়ায়’ গানের সুরে হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছিলেন, ‘ঘোর কলিকাল আইল আকাল/ সোনার বাংলায়, হায় হায়/ ক্ষুধার অনল ধিকিধিকি দিকে দিকে ধায়/ ক্ষুধার পাগল মানুষ ঘুরে ফিরে/ মায়ের বুকে দুধের ছাওয়াল মরে অনাহারে/ মৃত সন্তান বুকে লইয়া কান্দে বাপে মায়’। সিলেটের অত্যন্ত জনপ্রিয় ধামাইল গান, ‘আসবে শ্যামকালিয়া কুঞ্জ সাজাও গিয়া’-র সুরে লিখেছেন, ‘তোরা বল সখী বল বল, বল আমারে/ ওকে ঘরের বার কূলের বার করলো নারীরে’। লোকায়ত সুরে সবচেয়ে তীক্ষè রাজনৈতিক গান লিখেছিলেন দেশভাগের সময়। গ্রামের এক অত্যাচারী জমিদারের মৃত্যুতে গ্রামের লোককবি লিখেছিলেন, ‘বাবু গোপীচান্দ রায়/ সোনারপুরী আন্ধার কইরা লুকাইলায় কোথায়/ পুয়ায় কান্দে পুরিয়ে কান্দে কান্দে বাবুর মা’য়/ দুই তালার উপরে কান্দে রাসমণি বেশ্যায়’। একই ধরনের শ্লেষাত্মক ভাষায় হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখলেন, ‘মাউন্টব্যাটন সাহেব ও, তোমার সাধের ব্যাটন কার হাতে থুইয়া গেলায় ও/ তোমার সোনার পুরী আন্ধার কইরা ও প্রভু কই চলিলায়/ সর্দার কান্দে, পণ্ডিত কান্দে, কান্দে মৌলানায়/ আর মাথাইয়ে যে মাথা কুটে বলদায় বুক থাপরায়/ তোমার শ্যামাচেট্টি ভক্তবৃন্দে গো, তোমার লেডির গাউন কান্দিয়া ভিজায়’। কীর্তন ও লোকায়ত নানা সুরে লেখা এই দীর্ঘ গানটি দিক থেকে একটি সার্থক রাজনৈতিক গান। তৎকালীন পুলিস বিভাগের নজরেও ছিল এই গান ও তার প্রভাব। দেশভাগের পর যখন ওপার থেকে এপারে উদ্বাস্তু মানুষের স্রোত এই সার্বিক ট্র্যাজেডির মুখোমুখি করিয়ে দিল বাঙালিকে, তখন হেমাঙ্গ বিশ্বাস এই ভেঙে পড়া মানবগোষ্ঠীকে উজ্জীবিত করতে সিলেটের হোলি গানের সুরে লেখেন, ‘বাঁচবো বাঁচবো রে আমরা বাঁচবো রে বাঁচবো/ ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়া নয়া বাংলা গড়বো’। এই সময়পর্বে লোকায়ত সুরের কাঠামোয় লেখা গানের আধিক্য থাকলেও অন্য সুর ও ভাষায়ও অসংখ্য গান লিখেছেন। ছাত্র সম্মেলনের উদ্বোধনী সঙ্গীত হিসেবে গাওয়ার জন্যে তিনি লিখেছিলেন, ‘উদয় পথের যাত্রী ওরে রে ছাত্রছাত্রী/ মশার জ্বালো মশাল জ্বালো’। আসামে কালচ্যারাল স্কোয়াডের সফরের সময় ‘রক্তের ঋণ’ নামে যে ব্যালে প্রযোজিত হয় পানু পাল ও ঊষা দত্তের পরিচালনায় তার জন্যে তিনি লিখেছিলেন, ‘মহানগরীর রাজপথে যত রক্তের স্বাক্ষর/ অগ্নিশিখায় অঙ্কিত হল লক্ষ বুকের পর’। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কর্মক্ষেত্র যখন সিলেট জেলা থেকে আসাম রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়াতে থাকে, তাঁর গানেও আসে বৈচিত্র্যের আভা। দেশভাগের পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস থেকে ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’ শ্লোগানের সঙ্গে ডাক দেওয়া হয় গণ অভ্যুত্থানের। পার্টি বেআইনী হয়ে যায়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস আত্মগোপন করেছিলেন আজকের মেঘালয়ের জয়ন্তিয়া পাহাড়ে। ও্ই সময়ে তিনি শোনেন জয়ন্তিয়াদের একটি লোকগান। সেখানে জ্যোৎস্না রাতে যুবকেরা গিটার নিয়ে দল বেঁধে এক ধরনের প্রেম নিবেদনমূলক গান গায়। সেই গানের সুরেই তখনকার রাজনৈতিক লাইনের সাথে সঙ্গতি রেখে হেমাঙ্গ বিশ্বাস লেখেন, ‘আজাদী হয় নি আজো তোর/ নববন্ধনশৃঙ্খলডোর/ দুখরাত্রি হয় নি ভোর, আগে কদম কদম চলো জোর’। পরবর্তী জীবনে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বেশ কিছু বিদেশি গণসঙ্গীত অনুবাদ করেন। এই গুলির মধ্যে অন্যতম ‘জন ব্রাউন’ বা ‘জন হেনরী’। জন হেনরী সম্ভবত সত্তর আশির দশকের সবচাইতে জনপ্রিয় গণসঙ্গীতের অন্যতম। বাংলা জন হেনরীর সুরে তিনি মূল থেকে সামান্য পরিবর্তন করেছিলেন। এই পরিবর্তনের ফলে পাশ্চাত্য সুরের কাঠামোর মধ্যেও শিবরঞ্জনী রাগের খানিকটা ছোঁয়া লেগে গানটি যেন ভারতীয় রূপ পেয়েছে। লেনিনের জন্মশতবর্ষে ল্যাংস্টন হিউজের কবিতা কমরেড লেনিন অব রাশ্যা এবং তার বিষ্ণু দে কৃত অনুবাদ রুশ দেশের কমরেড লেনিন-এ সুরারোপ করেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। এই গানেও প্রত্যেকটি স্তবকের শেষ পংক্তিতে জন হেনরীর মত শিবরঞ্জনীর ছোঁয়া স্পষ্ট। একটা সময়ে গণনাট্য আন্দোলনে গণসঙ্গীতের রূপ কেমন হবে তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়েছিল গণনাট্যের সর্বভারতীয় সম্মেলনের মঞ্চে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও তাঁর সমমতের বন্ধুদের মত ছিল শ্রমিক কৃষককে উদ্বুদ্ধ করবে যে গান তা লোকসঙ্গীত নির্ভর হতে হবে। তার সুরের চলন এবং বাণী হবে সহজ সরল। হারমনি বা অর্কেস্ট্রেশনের সেখানে কোনও অবকাশ থাকা উচিত নয়। অন্যদিকে, সলিল চৌধুরী ও তাঁর সমমতের বন্ধুদের মত ছিল শ্রমিক কৃষককে উদ্বুদ্ধ করবে যে মতাদর্শ তা তো আন্তর্জাতিক, কোনও অঞ্চলের আঞ্চলিক বিষয় নয়। প্রতিবাদী চেতনাকে ওই আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করতে প্রয়োজনে গণসঙ্গীতে হারমনি অর্কেস্ট্রেশন সবই করতে হবে। সলিল চৌধুরীরা বলেছিলেন, শ্রমিক কৃষক লোকসঙ্গীত গায় বলে যদি তাঁর প্রতিবাদের সঙ্গীতকে তাঁর লোকসঙ্গীতে আটকে থাকতে হয়, তবে যে কৃষক শ্রমিক গরুর গাড়ি চড়ে, তাঁদের সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের গরুর গাড়ি চড়ে আসাই উচিত সেক্ষেত্রে। সেদিন সে বিতর্কের কোনও সমাধা হয় নি। যে যার পথে সৃষ্টিকর্ম চালিয়ে গেছেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাস পরবর্তীকালে তাঁর স্মৃতিকথায় সেদিনের বিতর্কে নিজেদের অবস্থানকে একদেশদর্শী বলে মেনে নিয়েছেন। নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রে এই অবস্থানের পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করি তাঁর ‘শঙ্খচিল’গানে, যেখানে নানা জাতির লোকসুরের আভাস আছে, আছে বাঙালির নিজস্ব সুর। আর তার সঙ্গে মিশে গেছে পাশ্চাত্যের সুর ও চলন। শেষ পর্যন্ত গানটি হয়ে উঠেছে সত্যিকারের আধুনিক প্রতিবাদী গান। নানা বিদেশি গানের অনুবাদের সুরেও একই ধরনের সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষাও করেছিলেন প্রতিবাদী সঙ্গীত নিয়ে। চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা একটি গান ‘আমি যে দেখেছি সেই দেশ’ গানে আমরা পাই চীনা সুর। আবার চীনের শাওশান নিয়ে লেখা গান, ‘আমি যাই শাওশান’ গানে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরের আভাস। মাও সে তুঙকে নিয়ে লেখা গান ‘আরো বসন্ত’ গানে কেদার রাগের সুর খুঁজে পাওয়া যায়।
কবি হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পরিচয় পশ্চিমবঙ্গে কতটা আছে জানি না। কিন্তু আসামের অসমীয়া কবিতায় তিনি যুগান্তরের অনুপ্রেরণা। তাঁর রচিত বাংলা কবিতার সঙ্কলন ‘সীমান্তপ্রহরী’ ও অসমীয়া কবিতার সংকলন ‘কুলখুড়ার চোতাল’ (কুলখুড়োর উঠোন) আসামের সাংস্কৃতিক-রাজনীতির একটি নতুন পথের দিশারী। আসাম বহুভাষিক বহুজাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত রাজ্য। এখানকার প্রধান ভাষা অসমীয়া হলেও একমাত্র ভাষা নয়। আসামের সমাজ ও সংস্কৃতির বহুত্বই আসামের বৈশিষ্ট্য। প্রতিক্রিয়াশীলেরা এই বহুত্বের ওপরই আঘাত করেছে বারবার বিভিন্ন সময়ে। ফলে এখানকার প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য এই বহুত্বের স্বপক্ষে লড়াই করাই। আসামে অসমীয়ার অসমীয়াত্ব, বাঙালির বাঙালিত্ব বিকশিত হয়েছে তার প্রতিবেশীচেতনার মধ্যেই। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের অসমীয়া ও বাংলা কবিতা এই প্রতিবেশীচেতনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই চেতনাই পথ দেখিয়েছে সেখানকার কাব্য সাহিত্যকে নতুন পথে হাঁটতে।
নিজেদের প্রথম দিককার গান নিয়ে পরবর্তী জীবনে আলোচনা করেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর স্মৃতিকথায়। এই আলোচনা প্রকৃতপক্ষে গণনাট্যের গীতধারার একটি নন্দনতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক মূল্যায়ন। এই মূল্যায়নের সাথে কেউ একমত হতে নাও পারেন, কিন্তু এই বিতর্কটির গুরুত্ব কেউ উপেক্ষা করতে পারবেন না। সমস্যার উদয় সম্ভবত হয় কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে প্রচলিত ধারণার জায়গা থেকেই। প্রথমযুগ থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি সংস্কৃতিকে শুধুমাত্র প্রচারের হাতিয়ার হিসেবেই ভেবে এসেছে। এ ছাড়া সংস্কৃতির আর কোনো মূল্য প্রত্যক্ষত খুব কমই অনুভূত হয়েছে। সংস্কৃতির অঙ্গনের অভ্যন্তরেও যে প্রতিনিয়ত একটি লড়াই চলতে থাকে এবং সংস্কৃতির গভীরেও মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাসের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়, সেদিকের প্রতি তেমন নজর ছিল না পার্টির। প্রতিদিনের বাস্তবতায় যে লড়াই বিকাশমান তার বার্তা বৃহত্তর জনসমাজে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে গান নাটক চিত্রকলা ইত্যাদির ব্যবহার, এটাই ছিল সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে কমিউনিস্ট পার্টির আগ্রহের জায়গা। ফলে লোকসঙ্গীতের প্রতি মানুষের অনুরাগ দেখে মনে হয়েছে বোধহয় এই গানের সুরের জাদুতেই মাত্র মানুষ মোহাবিষ্ট হয়ে আছে। ফলে কমিউনিস্ট শিল্পীদের ওপর দায়িত্ব পড়েছে এই সুরে একটি রাজনৈতিক গান বাঁধা। গানের প্রয়োজন জনসভার বা হাটের সভার শুরুতে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছেন, তখন পার্টির রাজনৈতিক লাইনের অনুসরণে গান লিখতে গিয়ে নানা ধরনের তাৎক্ষণিক আহ্বানকে কৃত্রিমভাবে গানের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হয়েছে। তা ছাড়া পার্টির রাজনৈতিক লাইন যখন সংস্কারবাদের আবর্তে ঘুরছে তখন গানের বাণী মাথা নিচু করে তাকে অনুগমন করেছে। আবার যখন সরাসরি লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান এসেছে রাজনৈতিক লাইনে, তখন গানের ভাষাতেও উত্তেজনা যুক্ত হয়েছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের স্মৃতিকথায় এই কথাগুলি পড়তে পড়তে মনে পড়ে যায় একটি সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা। একটি গ্রামীণ ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। প্রতিযোগিতার বিভাগ বাউল গানের এবং গানের বিষয় বিজ্ঞানসম্মত শৌচাগার নির্মাণ। শার্টপ্যান্ট পরা প্রতিযোগীরা এসে গানের আগে গেরুয়া পোশাক পড়ে ‘ভোলামন, বিজ্ঞানসম্মত শৌচাগার তৈরি কর ভাই’ বলে গান গাইছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের স্মৃতিকথায় যা পেয়েছি, তাই দশকের পর দশকের যান্ত্রিক অনুকরণের পর এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাউল গানের সুরে লেখা গণসঙ্গীতে ‘ভোলামন’ এর জায়গায় ‘বন্ধুগন’ বা ‘সাথী’ বা ‘কমরেড’ বসিয়ে দিলেই হল। এখানে দু’টি বিষয় রয়েছে। এক, ধরে নেওয়া হচ্ছে লোকগানের সুর বিষয়টি স্থির, শুধু নতুন কথা দিলেই গানটি নতুন গান হয়ে যাবে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস লোকসঙ্গীত সম্পর্কিত আলোচনায় বলেছেন, লোকসঙ্গীত কোনো স্থাণু বিষয় নয়। সেখানেও পরিবর্তন আসে, সেটা বাইরের হস্তক্ষেপে নয়। নতুন সময়ে নতুন জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতায় লোকশিল্পী ও স্রষ্টারাই তাঁদের সৃষ্টিতে পরিবর্তন আনেন। এই সঙ্গীতধারার বাইরে থাকা মানুষেরা হঠাৎ একদিন গিয়ে কোনো পরিবর্তন করতে পারেন না। এখানেও বাহিরানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে ওই বাহিরানায় অন্তর্ভুক্ত নয়, সে ওই পরিবর্তন আনতে পারে না। দ্বিতীয়ত, এমন একটি প্রতিযোগিতা আয়োজনের মধ্যে সুরকে আঙ্গিক আর কথাকে বিষয়বস্তু বলে ধরে নেওয়ার একটি মনোভাবও পরিস্ফুট হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই সুর আর বাণীকে কৃত্রিমভাবে আঙ্গিক আর বিষয়বস্তু বলে বিভাজিত করে দেখে এসেছেন বামপন্থীরা। আঙ্গিক আর বিষয় যে পরস্পরের দ্বন্দ্বসমন্বয়ে গড়ে ওঠে এবং একটি বিশেষ বিষয়বস্তুর জন্যেই একটি বিশেষ আঙ্গিকের জন্ম হয়, এ কথাটি বিস্মৃত থেকেছে। ফলেই এমন কাণ্ড ঘটে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। বিজ্ঞানসম্মত শৌচাগার নির্মানের আন্দোলনের জন্যে কোনো গান তৈরি হবে না, কথাটা এমন নয়। কিন্তু এই বার্তাটির জন্যে যে গান তৈরি হবে তার সুরও হবে আলাদা। হয়ত গ্রামীণ সমাজে এটা একটা নতুন বার্তা আনছে। ফলে নতুন আঙ্গিকেই সেই কথাটি বলতে হবে। বাউল গানের আঙ্গিকটি একটি বিশেষ দার্শনিক অভিব্যক্তির সাথে বিকশিত হয়েছে। সেখান থেকে কৃত্রিমভাবে সুরকে ছেঁটে এনে গান তৈরি করলে সেটা কৃত্রিম ও চাপিয়ে দেওয়া ব্যাপার হবে। তা ছাড়া, এই গানের রসিকদের কাছে এই সুরে এই কথা বসানোটা ব্লাসফেমির মতই শোনাবে, আর সেটা হলে খুব একটা অন্যায়ও হবে না। প্রতিবাদী গানের রাজনীতি ও আঙ্গিক নিয়ে একটি জরুরি বিতর্কের দিকে ইঙ্গিত করেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর স্মৃতিকথায়। ইদানিং কালে বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকে হিন্দুত্বের রাজনীতির উত্থানের পর সাংস্কৃতিক সংগ্রামের বিষয়টি কিছুটা আলোচিত হতে শুরু করেছে বামপন্থী মহলে। সংস্কৃতিকে শুধুমাত্র লড়াইয়ের হাতিয়ার না ভেবে লড়াইয়ের ময়দান ভাবা, এরও একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে এই আলোচনা পশ্চিমবাংলার বামমহলে এখনো সেভাবে গতি পায় নি।
লোকগানের সুজন
চল্লিশের গণনাট্য আন্দোলনের সূত্রে যে সমস্ত সঙ্গীত স্রষ্টাদের আমাদের পেয়েছি, তাঁদের মধ্যে হেমাঙ্গ বিশ্বাসই বোধহয় আমাদের লোকায়ত সঙ্গীতধারার সবচেয়ে গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। কথাটা হয়ত ভুলই হল। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সাঙ্গীতিক বসবাসই হয়ত ছিল আমাদের লোকায়ত সঙ্গীতধারার অন্তরতম প্রদেশে। কিন্তু যেহেতু তিনি সর্বাগ্রে ছিলেন শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক মুক্তিব্রতের এক রাজনৈতিক কর্মী, সেজন্যে লোকায়ত সঙ্গীতধারায় এই বসবাস তাঁকে মোহান্ধ করে নি। অভ্যন্তরে বাস করেই তিনি গভীর অভিনিবেশে লক্ষ্য করেছেন এর সম্পদ, লক্ষ্য করেছেন তার উজ্জীবনের দিক ও একই সাথে বন্ধ্যাত্বের দিক। এই বসবাস ও সহযাত্রা কমিউনিস্ট রাজনৈতিক কর্মী হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে গড়ে তুলেছে আমাদের লোকায়ত সঙ্গীতের এক অনন্য তাত্ত্বিক হিসেবেও। লোকসঙ্গীতের সাথে তাঁর সারাজীবনের সম্পর্ককে তিনটি পর্বে দেখা যেতে পারে। প্রথমপর্ব তাঁর ছেলেবেলা। পূর্ব বাংলার গ্রামীণ সমাজজীবনের বৈশিষ্ট্য এই যে, সেখানকার লোকায়ত গানের ধারার প্রধান কাণ্ডারী গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষ হলেও গ্রামের উচ্চকোটির মানুষের সমাজও এই গানের ধারার সাথে নাড়ীর যোগেই বাঁধা। বাল্য ও শৈশবে এক বিমুগ্ধ বিস্ময়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁদের গ্রামের বাড়িতে শুনেছেন তাঁদের অঞ্চলের লোকায়ত নানা ধারার গান। পাঠশালায় যাওয়া আসার পথে ধানখেতের হাওয়া গায়ে মেখে প্রাণের গভীরে গিয়ে বাসা বাঁধা এই গানগুলিকে গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠার মধ্যদিয়েই তিনি হয়ে ওঠেন লোকায়ত গানের অন্দরমহলের সুজনে। দ্বিতীয় পর্বে কমিউনিস্ট রাজনৈতিক কর্মী হেমাঙ্গ বিশ্বাস কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে লোকায়ত গানের সাথে আত্মীয়তায় যুক্ত হয়েছেন কৃষিজীবী সমাজের ঘনিষ্ঠ দোসর হওয়ার লক্ষ্যে। তিনি বলেছেন, তিনি ও তাঁর সহযোগী বন্ধুরা গ্রামাঞ্চলে গিয়ে সভাসমিতি করার ফাঁকে ফাঁকে সে অঞ্চলের লোকায়ত গান গলায় তুলে নিতেন। পরে এই লোকায়ত গানের সুরে ও বাগধারায় তিনি বাঁধতেন নতুন নতুন গান কৃষক আন্দোলনের সেই সময়ের চাহিদা অনুযায়ী। এই পর্বেই পরবর্তী সময়ে প্রথমে সুরমাভ্যালি কালচ্যারাল স্কোয়াড ও পরে আসামের নানা স্থানে গণনাট্য সঙ্ঘের সাংগঠনিক ভিত্তি প্রসারের কাজে ঘুরে বেড়ানোর সময় নানা জাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর লোকশিল্পীরা তাঁর ঘনিষ্ঠজন হয়ে ওঠে । তিনি পরিচিত হন তাঁদের সৃষ্টির সাথে। এই পরিচয় এতটাই গভীর ও আত্মিক ছিল যে, লোকশিল্পীরা কখনোই তাঁকে শহুরে বহিরাগত ভাবত না। ভাবত একান্ত আপন। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মৃত্যুর পরের দিন শিলচরে একটি কৃষক সমাবেশে যখন তাঁর মৃত্যুসংবাদটি ঘোষিত হয়ে শোকপ্রস্তাব উত্থাপিত হয়, তখন গ্রামাঞ্চল থেকে আসা অনেক বয়স্ক কৃষক কর্মীর চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। ছাত্র আন্দোলনের সূত্রে কাছাড়ের বিভিন্ন অঞ্চলগুলিতে ঘোরার সময় কৃষক আন্দোলনের পুরনো ঘাঁটি অঞ্চলগুলিতে মনিপুরি বা হিন্দিভাষী কৃষকদের বাড়িতে গানের খাতায় হেমাঙ্গ বিশ্বাসের হাতের লেখা দেখেছি। একটি নিবন্ধে পড়েছিলাম, আসামের প্রবাদপ্রতিম ঢোলবাদক মঘাই ওঝা শেষজীবনে বলতেন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছাড়া আমাদের মূল্য আর কেউ বুঝল না। এখনও আসামের গ্রামাঞ্চলগুলিতে গণনাট্য আন্দোলনের সেযুগের একটি নামই মানুষ মনে করতে পারেন, সেটি হেমাঙ্গ বিশ্বাসের। তাঁর এই আত্মিক সম্পর্কের জন্যে তিনি পেরেছেন পরবর্তী সময়ে তৃতীয় পর্বে লোকসঙ্গীতের সংকট ও বিকৃতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এই সঙ্গীতধারার ভিতরতম প্রদেশে আলো ফেলতে। তাঁর এই তাত্ত্বিক নিবন্ধগুলি বিশিষ্ট এ জন্যেই যে এতে কোনও অ্যাকাডেমিক শুষ্কতা নেই। লোকসঙ্গীত সংক্রান্ত তাত্ত্বিকচর্চায় তাঁর মহত্তম অবদান শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঘরানার বিপরীতে লোকসঙ্গীতের বাহিরানার সংজ্ঞায়ন। তিনি বলেছেন, একটি অঞ্চলের সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, ভাষা, বাগধারা সে অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের সুর ও ভাষায় বিশিষ্টতা দেয়। এই আঞ্চলিকতাকে বাদ দিয়ে লোকসঙ্গীতকে চেনা যায় না। এই আঞ্চলিকতাকেই তিনি বলেছেন বাহিরানা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত যেমন গুরুর বংশপরম্পরার মধ্য দিয়ে বিশিষ্টতা অর্জন করে, তেমনি একটি অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের গড়নটিও তৈরি হয় সেই অঞ্চলের আঞ্চলিকতার মাধ্যমেই। অনেক শাস্ত্রীয় ঘরানা অঞ্চলের নাম দিয়ে পরিচিত হলেও তা আসলে একটি বংশ পরম্পরা বা খানদানের দ্বারাই বিশেষায়িত। তেমনি লোকসঙ্গীতেও গুরুমুখীনতা আছে, কিন্তু তা আঞ্চলিকতার বাইরে নয়। নানা ক্ল্যান রেস ও ট্রাইবের দ্বন্দ্বসমন্বয়ে যেভাবে একটি জাতি গড়ে ওঠে, তেমনি একটি জাতির সাঙ্গীতিক কাঠামোটিও গড়ে ওঠে সেই ক্ল্যান রেস ও ট্রাইবের লোকসঙ্গীতের দ্বন্দ্বসমন্বয়ে। একটি জাতির নির্মাণ এই প্রক্রিয়ার হওয়ার পরও যেমন তার গায়ে নানা গোত্র ও জাতিগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য বেঁচে থাকে, তেমনি একটি জাতির জাতীয় সঙ্গীতের কাঠামোটি গড়ে ওঠার পরও দেখা যায় সমান্তরালে সেই আঞ্চলিক সুরগুলি আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেঁচে আছে। সাংস্কৃতিক যোদ্ধা হেমাঙ্গ বিশ্বাস খুঁজতে চেয়েছেন লোকসঙ্গীতের দর্পণে মানুষের সামাজিক ইতিহাসকে। পাশ্চাত্যের সঙ্গীত-নৃতত্ত্বের তত্ত্বের নিরিখে বিচার করেছেন আসাম ও বাংলার লোকগানকে। এ ভাবেই আমাদের লোকসঙ্গীতের সঙ্গীত-নৃতাত্ত্বিক চর্চারও তিনি হয়ে উঠেছেন পথিকৃৎ। সম্ভবত তাঁর আগে কেউ বাংলা আসামের লোকসুরের এভাবে সঙ্গীত-নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেন নি। কলকাতা মহানগরীর বাণিজ্যিক সংস্কৃতির পরিম-লে লোকসঙ্গীতের বিকৃতি নিয়েও তিনি ছিলেন সোচ্চার। অসাধারণ পর্যবেক্ষণে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন কেন ঢাকা মহানগরীতে লোকসঙ্গীতের যে বিকৃতির সম্ভাবনা তুলনায় কম, তা কলকাতায় কেন এত সর্বগ্রাসী।
রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠক
জীবনের শেষ পর্বে কলকাতাবাসী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মূল পরিচয় ছিল একজন শিল্পীর। প্রকৃতপক্ষে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নামটি উচ্চারিত হলে পশ্চিমবঙ্গের গণনাট্য আন্দোলন বা প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে যে ছবিটি ভেসে ওঠে তার চেয়ে অনেক বড় পরিচয় তাঁর স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী সময়ের আসামের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে। তাঁর জীবনের দু’টি পর্ব, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে তিনি ছিলেন মূলত কলকাতা শহর কেন্দ্রিক। এখানে তাঁর ভূমিকা মূলত একজন শিল্পী-স্রষ্টার। আসামে তাঁর ভূমিকা ছিল আরো বিস্তৃত প্রেক্ষাপট জুড়ে। সেখানে তিনি গণনাট্য আন্দোলন গড়ে তোলার এক মুখ্য কারিগর। আসামে গণনাট্য আন্দোলনের ভূমিকাও আরো বিস্তৃত ও গভীর। আসামের অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতির আধুনিক যুগের গড়নটি নির্মিত হওয়ার সময়কালেই আসামে সমান্তরালে গড়ে উঠেছে গণনাট্যের সংগঠন। ফলে সেই সংক্রান্তিকালীন সময়ের অনেক যুগ-কর্তব্যই সমাধা হয়েছে গণনাট্য আন্দোলনের অঙ্গন থেকেও। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য, আসামের আধুনিক সাহিত্য সঙ্গীত নাট্য চলচ্চিত্রচর্চার যুগন্ধর পুরুষেরা অনেকেই সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন গণনাট্য আন্দোলনের সাথে। তাঁদের মধ্যে জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা, বিষ্ণু রাভা, নবকান্ত বরুয়া, ভূপেন হাজারিকা উল্লেখযোগ্য। বহুভাষিক আসামে সংখ্যার দিক থেকে প্রধান ভাষাগোষ্ঠী অসমীয়া ও বাঙালি। এ ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট ভাষাগোষ্ঠী। চা বাগান শ্রমিক, পূর্ববঙ্গাগত বাঙালি মুসলিম কৃষক সম্প্রদায়ও এর অন্তর্ভুক্ত। এই বহুভাষিক বহুজাতিক সামাজিক পরিম-লে বিভিন্ন ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগসূত্র গড়ে তোলে গণনাট্য আন্দোলন। এই কাজে হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিলেন প্রধান পুরোহিত। আসামের বহু অঞ্চল রয়েছে যেখানে কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রথম ভেরীটি বেজেছিল গণনাট্যের মাধ্যমেই। একজন কমিউনিস্ট সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবেই হেমাঙ্গ বিশ্বাস ঘুরে বেরিয়েছেন আসামের প্রান্তে প্রান্তরে, গ্রামে গঞ্জে, পাহাড়ে সমতলে। এভাবেই বিভিন্ন জাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে গড়ে উঠেছিল গণনাট্য আন্দোলনের ভিত এবং এই জনগোষ্ঠীগুলির জাতীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ত্বরা সমবেত হয়েছেন গণনাট্যের পতাকাতলে। মনিপুরি নৃত্যশিল্পী গুরু কামিনী সিংহ, আসামের ঢোলের যাদুকর মঘাই ওঝা, ডিমাসা জাতীয় নেতা মনীন্দ্র বর্মন, খাসি শিল্পী জেছ প্রিটার সহ আসামের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ত্ব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা, বিষ্ণু রাভা, প্রতিমা বরুয়া। সংগঠক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পাশাপাশি শিল্পীস্রষ্টা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গীতভুবনও পূর্ণাঙ্গতা পায় এই সময়পর্বেই।
১৯৬০ সালে যখন সারা আসামে অসমীয়া ও বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা দেখা দিয়েছিল, যখন আইন রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলিও কোনোভাবেই শান্তি আনতে পারছিলেন না, তখন পথে নেমেছিল হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নেতৃত্বে আসামের গণনাট্য। সঙ্গে ছিলেন ভূপেন হাজারিকা। উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যের শিল্পীদের নিয়ে তাঁরা তৈরি করেছিলেন এক শান্তির অভিযাত্রীদল। এই ঐতিহাসিক শান্তিযাত্রাকে সামনে রেখে তৈরি হয়েছিল ‘হারাধন-রঙমন কথা’ গানটি। যৌথভাবে এই গানটি লিখেছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও ভূপেন হাজারিকা। হারাধন একজন বাঙালি কৃষক, রঙমন অসমীয়া কৃষক। হারাধন কথা বলে ভাটিয়ালি সুরে, রঙমন বিহুর সুরে ও ছন্দে। হারাধন কথা বলে বাংলায়, রঙমন কথা বলে অসমীয়া ভাষায়। দুজনেই কথা বলে নিজের ভাষায়, গান গায় নিজের লোকায়ত সুরে। দু’টি ভাষা ও সুর তৈরি করে দু’টি হৃদয়ের মধ্যে একটি অভিন্ন সাঙ্গীতিক সেতু। ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় সর্বস্ব হারানো হারাধনের পাশে দাঁড়ায় রঙমন। নিজেদের দুঃখের কথা শোনায় একে অপরকে। সবশেষে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যয়ে বিহু ও ভাটিয়ালির মিলনে তৈরি নতুন সুরে তাঁরা আবাহন জানায় আগামীর মিলন-বিহুকে। এই গানকে কন্ঠে নিয়ে সেদিন শিলং থেকে সদিয়া অবধি সংগঠিত হয়েছিল শান্তিযাত্রা। পুলিস মিলিটারি লাঠি বন্দুক যে শান্তি সেদিন আনতে পারেনি, আসামের গণনাট্য হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নেতৃত্বে সেদিন সেই অভাবনীয় কাজটি করেছিলেন। একের পর এক শহরে যখনি শান্তিযাত্রা প্রবেশ করেছে, অবিশ্বাসের বাতাবরণ কেটে গিয়েছে জাদুমন্ত্রের ছোঁয়ায় যেন। কাছাকাছি এসে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছে বিবদমান দুই ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ। এই শান্তিযাত্রার সংবাদ বিবরণী শুধু আসামের সংবাদপত্রেই নয়, পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘স্বাধীনতা’-তেও প্রকাশিত হয়েছে।
এ সময় ও হেমাঙ্গ বিশ্বাস
এখন এমন একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যখন প্রগতি শিবির এ রাজ্যে খানিকটা কোনঠাসা। এই সময়েই আবার গণনাট্য আন্দোলনের নানা উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ত্বের জন্মশতবর্ষ। অস্বীকার করার অবকাশ নেই, সাম্প্রতিক অতীতে এই রাজ্যে প্রতিবাদী সঙ্গীতের চর্চা কিছুটা অবহেলিতই ছিল। একটা সময় ছিল যখন রবীন্দ্রনাথের গানকেও পরিত্যাজ্য মনে হয়েছে কারো কারো, আবার সম্প্রতি দেখা গেছে কোনও কিছুতেই কারো আপত্তি থাকছে না। শীতকাল এলে সারা পশ্চিমবাংলায় বামপন্থীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উদ্যোগে যে অসংখ্য সাংস্কৃতিক মেলা উৎসব আয়োজিত হয়ে এসেছে এতটা বছর, সেখানে কোন বাছবিচার লক্ষ্য করা যায় নি। অথচ এই উৎসবগুলি বিকল্প সংস্কৃতির এক একটি মঞ্চ হয়ে উঠতে পারত। জনচিত্তজয়ী সংস্কৃতির পেছনে ধাবমান হয়ে পাশ্চাত্যের জঞ্জাল ও মুম্বাইয়ের বাণিজ্যিক বেনোজল ও কলকাতার আবর্জনার বাৎসরিক প্রদর্শনীতে শেষপর্যন্ত পরিণত হয়েছে এই উৎসবগুলি। এই উদাসীনতার ফল কী হয়েছে তা এখন চোখের সামনেই স্পষ্ট।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস চাইতেন গণনাট্য তার প্রথমযুগের আদলে বামপন্থী ও প্রগতিশীল শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের বৃহত্তর মঞ্চ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক। কোনো একটি বিশেষ বামপন্থী দলের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হওয়া তাঁর কাছে বাঞ্ছনীয় মনে হয় নি। সিপিআই-এর নেতৃত্বাধীন গণনাট্যের সংগঠন সর্বভারতীয় ভিত্তিতে যখন আবার সংগঠিত হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল সিপিআই দলের সাথে তাঁর চরম মতাদর্শগত পার্থক্য সত্ত্বেও তিনি তাঁদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের গণনাট্যের মূলধারাও একই পথে হাঁটুক তিনি চাইতেন। সেটা অবশ্য হয় নি। সিপিআই(এম)-এর রাজনীতির সাথে তাঁর ছিল চরম আদর্শগত পার্থক্য। তবে সত্তরের দশকের শুরুতে রাজ্যব্যাপী স্বৈরতান্ত্রিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদেরকে যখন গণতান্ত্রিক লেখক-শিল্পী-কলাকুশলী সম্মিলনী নামের ব্যাপক মঞ্চ গঠন করার মধ্য দিয়ে সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তখন তিনি সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সম্মিলনীর সহ-সভাপতির পদ গ্রহণ করেছিলেন। নানা সময়ে নানা প্রশ্নে বামফ্রন্টের তীব্র সমালোচনা করলেও নির্বাচনী সংগ্রামে বামফ্রন্টেরই পাশেই দাঁড়িয়েছেন। তাঁর কাছে মনে হয়েছিল, ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে এলে ফ্যাসীবাদের পথ প্রশস্ত হবে। তাঁর জন্মশতবর্ষের প্রাক-মুহূর্তে পশ্চিমবাংলায় অবশ্য তাঁর উত্তরসূরী একাধিক সিপিআই(এম) বিরোধী বামপন্থী বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতিকর্মীরা সিপিআই(এম)-এর চেয়ে ইন্দিরার উত্তরসূরীকেই বেশি জনদরদী ভেবে একটি বিশেষ অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তারও ফলাফল চোখের সামনে। এর রাজনৈতিক মূল্যায়ন যাইহোক, পশ্চিমবাংলায় আবার অনেকবেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে গণনাট্যধর্মী প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলন। গণনাট্য সঙ্ঘে তিনি শেষদিন অবধি ছিলেন কি না, সেটা আজ আর বিচার্য নয়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও গণনাট্য আন্দোলন কখনোই আলাদা সত্তা ছিল না। তিনি সারাজীবন যা করেছেন তা মূলগতভাবে গণনাট্য আন্দোলনেরই কাজ। কোনো দলের রাজনৈতিক লাইনের সাথে তাঁর হয়ত মতপার্থক্য ছিল। তবু নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন গণসংস্কৃতির এক মহান রূপকার। পশ্চিমবাংলার বামপন্থী ভবিষ্যৎ হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে এড়িয়ে গিয়ে কখনোই রচিত হতে পারে না। সেজন্যেই বামপন্থার এই ঘোর দুর্দিনে হেমাঙ্গ বিশ্বাসই প্রকৃতার্থেই ‘পান্থজনের সখা’।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গুটি কয় গান শুনতে বোতাম টিপে দিনঃ
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
(সৌজন্য: সৃষ্টির একুশ শতক, কলকাতা)
শতবর্ষে পা দিলেন গণনাট্য আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী-সংগঠক হেমাঙ্গ বিশ্বাস। একাধিক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ত্বের জন্মের শতবর্ষ বা সার্ধশতবর্ষ চলছে এখন। তার মানে আজ থেকে দেড়শো থেকে একশ বছর আগে অবধি যে সময়পর্ব ছিল তা সত্যিই আমাদের অবিভক্ত বঙ্গের জন্যে ছিল হিরণ্যগর্ভা। এই সময়পর্বে জন্ম নেওয়া উজ্জ্বল মানুষেরাই প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বাঙালির সাংস্কৃতিক সামাজিক রাজনৈতিক জীবনের ভিত গড়ে দিয়েছেন। উনবিংশ শতকের নবজাগরণ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। কারো মতে, এই নবজাগরণ খণ্ডিত, কারণ এই জাগরণের আলো পড়েছিল শুধু নগর কলকাতায়। যুক্ত বাংলার বাকি জনপদ ছিল এই আলোকচ্ছটার থেকে অনেক দূরে অন্ধকারে। এ কথাটি বলা বাহুল্য, সর্বাংশে সত্য নয়। কলকাতার অদূরবর্তী গ্রামাঞ্চল হয়ত এই আলোর রশ্মিরেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, কিন্তু দূরে উত্তর পূর্ব ভারত ও পূর্ববঙ্গের ছোট শহর ও মফস্বলে সেদিনের সেই নবজাগরণের বার্তা যে যথেষ্টই পৌঁছেছিল তার চিহ্ন এখনও দেখতে পাওয়া যায়। তবে অপূর্ণতা তো একটা ছিলই, ওই আলো ছিল সমাজের উচ্চকোটির বা মধ্যবিত্ত মানুষের একান্ত আলো। উনবিংশ শতকের সেই খণ্ডিত নবজাগরণের অপূর্ণতা অনেকটাই ঘুচিয়ে দিয়েছিল চল্লিশের প্রগতি সাহিত্য ও গণনাট্য আন্দোলন। সমাজের শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিকতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ এই আন্দোলনের তরঙ্গস্পর্শে শিল্পকলা সাহিত্য সঙ্গীত নাটকে সৃষ্টিশীলতার নতুনতর অভিযানে কাঁধেকাঁধ দিয়ে শামিল হলেন শহুরে আর গ্রামীণ শিল্পীরা। তখন দেখা গেল, গ্রামীণ লোকশিল্পী নিবারণ পণ্ডিত ও টগর অধিকারীর সাথে একই মঞ্চে সঙ্গীতের আসরে হাজির হচ্ছেন কলকাতা মহানগরীর সুচিত্রা মিত্র হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দেবব্রত বিশ্বাসেরা। মহানগরী, মফস্বল, গ্রামাঞ্চল- সৃষ্টিশীলতার সব পথ যেন এসে মিলল গণনাট্যের মোহনায়। নাটক ও গল্পে উপন্যাসে চিত্রকলায় তখন নায়কের আসনে অভিষিক্ত হলেন সমাজের শ্রমিক কৃষক নিপীড়িত ব্রাত্যজনেরা। উনিশ শতক এবং বিংশ শতকের চল্লিশের দুই নবজাগরণের কী উত্তরাধিকার আমরা রচনা করে চলেছি আজ এই মুহূর্তে, সেটা অন্য আলোচনার বিষয়। তবে কোথায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তা ঠাওর করার জন্যেও প্রয়োজন শতবর্ষ ও সার্ধশতবর্ষ পদার্পণ করা সেই সমস্ত মানুষের জীবনের নানাদিকের প্রতি দৃষ্টি ফেরানোর। এঁদের মধ্যে অনেককেই তাঁদের জীবদ্দশায় প্রকৃত সম্মান পান নি। এই না-পাওয়া জীবনের নানা পর্বে দারুণভাবেই বেদনাবিদ্ধ করেছিল তাঁদের। আজ তাঁদের জন্মের শতবর্ষ বা সার্ধশতবর্ষে এসে কিছুটা হয়ত পাপ স্খলন হবে যদি এই কাজ আমরা করতে পারি। শুধু অপরাধবোধ থেকে মুক্তি কেন, সাম্প্রতিকের অনেক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আঁধার-রহস্যও খোলসা হবে এই চর্চার মধ্য দিয়ে।
আপোষহীন শিল্পীসংগ্রামী
হেমাঙ্গ বিশ্বাসও ছিলেন এমন মানুষ যিনি জীবদ্দশায় তাঁর অনেক সহ-পথিক বন্ধুদের উপেক্ষা ও অবহেলার শিকার হয়েছেন। উত্তরপর্বের একজন গণনাট্যকর্মী ও সংগঠক হিসেবে নিজেদের অপরাধ কবুল করা আজ আমাদের জন্যে এক ঐতিহাসিক কর্তব্য। গণনাট্যের অসংখ্য আলোকোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ত্বের ভিড়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস অনন্য ছিলেন নানা কারণে। গণনাট্যের সে যুগের মানুষদের মধ্যে একইসাথে নেতৃস্থানীয় সংগঠক ও অগ্রণী শিল্পী হয়ত হেমাঙ্গ বিশ্বাসই একা। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের শিল্পী স্রষ্টা সত্তার সাথে পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক মহল হয়ত পরিচিত, কিন্তু সংগঠক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পরিচিতি মূলত আসামে। সেখানে তাঁর অতীতের সাংগঠনিক অবদান আজো মূর্ত হয়ে আছে আসামের গণনাট্য আন্দোলন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে। সেই সময়ে উত্তর পূর্বের নানা ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর শ্রমজীবী অংশের শিল্পী থেকে শুরু করে তৎকালীন আসামের সংস্কৃতি ক্ষেত্রের বিশিষ্ট মানুষদের তিনি গণনাট্যের মঞ্চে সমবেত করেছিলেন। এখনো আসামের নানা আলোচনা সভায়, পত্রপত্রিকায় বারবার উঠে আসে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নাম। গণনাট্যের অনেকেই সাংগঠনিক জীবনের একটা পর্যায়ে এসে সংগঠনের কাজে বেশি মন দিতে গিয়ে সৃষ্টিশীলতার দিকটিকে ধরে রাখতে পারেন নি। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই উল্টো। তিনি যখন সংগঠক হিসাবে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন, সেই সময়েই তাঁর সৃষ্টির প্রবাহ ছিল বেশি। সংগঠক ও শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিলেন একই সূত্রে গাঁথা। সংগঠনের কাজে সুরমা উপত্যকা থেকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, সেখান থেকে উত্তর পূর্বের পার্বত্য অঞ্চলে চষে বেড়ানোর জীবনে তিনি শুধু সংগঠনের মাটি খুঁজে পান নি, পেয়েছেন সৃষ্টির অফুরান রসদও। আরেকটি কারণেও হেমাঙ্গ বিশ্বাস অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গণনাট্যের স্বর্ণালী যুগের বহু প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ত্ব, প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক যোগাযোগ ক্ষীণ হতেই গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন বাণিজ্যিক সংস্কৃতির বাজারের স্রোতে। কখনো সখনো ‘ইস্যুভিত্তিক’ ডাক এলে হয়ত সাড়া দিয়েছেন খানিকটা। বাণিজ্যের সাথে দায়বদ্ধতার একটা ‘ব্যালেন্স’-এর খেলা খেলেই কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের বেশিরভাগ সময়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস ব্যতিক্রম। মতাদর্শগত কারণে একটা সময়ে সরে গেছেন গণনাট্যের মূল প্রবাহ থেকে কিংবা সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনও ত্যাগ করেছেন একটা সময়পর্বের পর, তবু একটি দিনের জন্যেও বাণিজ্যের কাছে মাথা নত করেন নি। তাঁর ভেতরের অ্যাক্টিভিস্ট সত্তা জাগ্রত ছিল জীবনের শেষ দিন অবধি।
ব্যক্তিগত স্মৃতি
তাঁর জীবনের অন্তিম পর্বে খানিকটা সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল আমার হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সাথে । ১৯৮২ সালে শিলচরে আমাদের সংগঠন ‘দিশারী’র আমন্ত্রণে হেমাঙ্গ বিশ্বাস এসেছিলেন তাঁর মাস সিঙ্গার্সের সদস্যদের নিয়ে। শিলচর তাঁর পুরনো কর্মক্ষেত্র। বহু বছর পরে এখানে এসে তিনি পেয়েছিলেন তাঁর এক সময়ের সহকর্মীদের। শিলচরের মানুষও উদ্বেল হয়ে উঠেছিলেন তাঁকে কাছে পেয়ে। তরুণ বয়সী আমরা তখন প্রথম গণসঙ্গীত গাইছি। কিন্তু শিলচরে গণনাট্যধর্মী সংগঠন বা আন্দোলনের অবর্তমানে সেই গানের রূপায়ন সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও তাঁর মাস সিঙ্গার্সের সদস্যরা আমাদের ভাবনাতে ঝড়ের হাওয়া লাগিয়ে দিলেন। কয়েকটি দিন খুব কাছাকাছি থেকে দেখেছি তাঁদের। অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে একান্ত আলাপচারিতা- সবকিছু নিয়ে মানুষ হেমাঙ্গ বিশ্বাস আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখলেন কয়েকটা দিন। সেবার চাঁদের হাট বসেছিল ‘দিশারী’র ‘মৈত্রী উৎসব’ নামের বার্ষিক অনুষ্ঠানে। সঙ্গীত পরিবেশন করতে একই সঙ্গে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল হেমাঙ্গ বিশ্বাসের এক সময়ের সহকর্মী আসামের দুই বিশিষ্ট কন্ঠশিল্পীকে। গুয়াহাটি থেকে এসেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী দিলীপ শর্মা ও গোয়ালপাড়ার লোকশিল্পী প্রতিমা বড়ুয়া। আলোচনা সভায় এসেছিলেন আসামের বিশিষ্ট বামপন্থী সমাজবিজ্ঞানী ড০ অমলেন্দু গুহ। মানুষের স্বতস্ফূর্ত সাড়ায় তিনদিনের উৎসবকে একদিন বাড়াতে হয়েছিল। তারপরও প্রবল বর্ষণমুখর সন্ধ্যার ওই অনুষ্ঠানে তিলধারণের জায়গা ছিল না। মঞ্চে দাঁড়িয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস যখন শিলচরের অদূরের আঠারোটিলার তেভাগা আন্দোলনের শহীদ মাধব নাথকে নিয়ে লেখা তাঁর অবিস্মরণীয় গান ‘আমরা তো ভুলি নাই শহীদ’ গাইছেন, তখন দর্শকাসনে বসা শিলচরের প্রবীণ বামপন্থী নেতাকর্মীদের চোখে অঝোরে ঝরছে অশ্রু। হেমাঙ্গ বিশ্বাসও গানের ফাঁকে ফাঁকে কথায় কথায় ফিরে যাচ্ছিলেন চল্লিশের দশক পঞ্চাশের দশকের কাছাড়ের গণনাট্য আন্দোলন কৃষক আন্দোলনের নানা স্মৃতিচারণে। সেবারের উৎসবে তাঁর অংশগ্রহণ শিলচরের প্রগতিশীল সংস্কৃতির মরা গাঙে জোয়ার নিয়ে এসেছিল। সেই সফরের পরই শিলচরে একের পর এক গড়ে ওঠে গণসঙ্গীতের দল। প্রতিবাদী সংস্কৃতি শিলচরের সংস্কৃতি অঙ্গনে আবার ফিরে এলো হারানো মর্যাদা নিয়ে। তাঁর মৃত্যুর বছর খানেক আগে আমার বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দিনগুলিতে আবার যোগাযোগ হয় তাঁর সাথে। মনে আছে, তারুণ্যের তেজে অস্থির হয়ে আমি এক সন্ধ্যায় খানিকটা রাজনৈতিক তর্কেও মেতে উঠেছিলাম তাঁর সাথে। সেই তর্কে কখনো তিনি বয়োজ্যেষ্ঠের মত আমাকে শিশু ভেবে এড়িয়ে যান নি, তর্কে মেতেছেন সমবয়সী সহ-পথিকের মত। পরে আবার সস্নেহে বলেছেন, তোমাদের বাপদাদার গ্রাম বেজুড়া আমার মামার বাড়ি। তুমি আমার মামার বাড়ির দেশের ছেলে। তোমার কাকা পিসি সিলেটে আমাদের সংগঠনের সাথে কাজ করত। তবে এত সামান্য সম্পর্কের মধ্য দিয়ে তাঁর মতো মানুষের বিশাল বিস্তৃত জীবনের কিছুই জানা যায় না। মনে পড়ে, কী গভীর বেদনাবোধ থেকে সে সময়ে বলেছিলেন কিছু কিছু কথা। যার মধ্যে তাঁর এককালের সংগঠন ও একসময়ের সতীর্থদের জন্যে ছিল বুকভরা অভিমান। অভিন্ন রাজনৈতিক মত সত্ত্বেও শুধু ভিন্ন পথের প্রতি আস্থার জন্যে তাঁর সৃষ্টিকেও কখনো কখনো উপেক্ষা করেছেন তাঁর এক সময়ের সতীর্থরা। গণনাট্যের গোড়ার যুগের গানের সঙ্কলন প্রকাশ করতে গিয়ে উপেক্ষিত হয়েছে তাঁর গান নিছক রাজনৈতিক সংকীর্ণতায়। যদিও সেই সঙ্কলনে এমন অনেকেরই গান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যাঁরা উত্তরজীবনে গণনাট্যের ভাবধারা থেকে সহস্র যোজন দূরে চলে গিয়েছিলেন। এমন সংকীর্ণতা তাঁকে পীড়িত করত। তিনি চাইতেন, রাজনৈতিক সংকীর্ণতার বাইরে গিয়ে বিভিন্ন ধারার বামপন্থীদের মিলিত মঞ্চ হোক গণনাট্য। যেমনটা হয়েছিল গণনাট্যের সূচনার যুগে। তিনি বলতেন গণনাট্যের উত্তরাধিকার ছড়িয়ে আছে বহু দূর অবধি। তিনি বলেছিলেন, গণনাট্য আন্দোলন গণনাট্য সঙ্ঘের সাংগঠনিক চৌহদ্দির চেয়েও অনেক বেশি বিস্তৃত। সংগঠনের সংকীর্ণসীমার ভেতর এখন আর তা সীমাবদ্ধ নয়।
হয়ে ওঠার দিনগুলি
১৯১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার মিরাশী গ্রামে এক রক্ষণশীল জমিদার পরিবারে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম। বাবা হরকুমার এবং মা সরোজিনী। তাঁর পিতৃ বংশ ছিল পুরোহিততন্ত্র ও জাতবিচারের প্রাবল্যের ঘেরাটোপে বন্দী, অন্যদিকে মাতুল বংশ হবিগঞ্জ মহকুমারই বেজোড়া গ্রামের চৌধুরী পরিবার ছিল উদার ও সাঙ্গীতিক। তাঁর নিজের ভাষাতেই, তাঁর বাবা ছিলেন ছোট অথচ জাঁদরেল জমিদার। পূজাআর্চা আর আচারের বাড়বাড়ন্তের তাঁদের নিজের বাড়িকে তিনি অভিহিত করেছেন ‘ধমক দিয়ে ঠাসা রামগরুড়ের বাসা’ হিসেবে। নানা উৎসবে উপলক্ষ্যতে সেই রামগরুড়ের বাসাতেও এসে ঢুকত হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ভাষায় ‘মাঠের হাওয়া’। বৃহত্তর সিলেটের নানা বর্গের লোকায়ত গানের সুরে ভরে উঠত তাঁদের ঘরের আঙিনা। এই সমস্ত গানের পশরা নিয়ে হাজির হতেন তাঁদের গ্রাম ও আশপাশ অঞ্চলের লোকশিল্পীরা যাঁদের অনেকে তাঁদের বাড়িরই নানা কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। অন্ত্যজ এই মানুষগুলির কন্ঠনিসৃত গানের শ্রবণেই বালক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গানের হাতেখড়ি। অবশ্য হাতেখড়ি হয়েছিল মায়ের গানেও। বাপের বাড়ির সঙ্গীতধারায় স্নাত তাঁর মা গাইতেন নানা মেয়েলি গান, রজনীকান্তের গান, শ্যামাসঙ্গীত প্রভৃতি। তবে কানে যে গানগুলি প্রবেশ করত, তা বাড়ির পরিবেশে গেয়ে ওঠার সুযোগ ছিল না। ধানখেতের পাশ ধরে পাঠশালায় যাওয়া আসার পথে গলা ছেড়ে সেই গানগুলি গাইতেন বালক হেমাঙ্গ বিশ্বাস। খেতে কাজ করতে করতে মাঠের কৃষকরা তারিফ করত, সপ্রশংস মাথা নাড়ত পাশ দিয়ে হেঁটে বেড়িয়ে যেত পথচলতি মানুষ। পরবর্তী জীবনে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও লোকায়ত গানের তুলনামূলক আলোচনায় হেমাঙ্গ বিশ্বাস শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঘরানার উল্টোপিঠে লোকসঙ্গীতে বাহিরানার সংজ্ঞায়ন করেছেন। ভিন্ন অর্থে সঙ্গীতশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসও বাহিরানারই সন্তান। বাল্যকালে পাঠশালায় যাওয়ার পথে প্রাণের আনন্দে গেয়ে ওঠা গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া অন্ত্যজ মানুষদের আদরের লালুবাবু থেকে যৌবনের হেমাঙ্গ বিশ্বাস হয়ে ওঠার সময়পর্বটি প্রকৃতপক্ষেই নানা রঙে রঙে ফুটে ওঠারই প্রহর। ভূগোলের দিক থেকে যেমন, সাংস্কৃতিক পরিসরের দিক থেকেও তাই। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বাল্য থেকে যৌবন যেন এক সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা। জীবনের প্রথম পর্বের এই বর্ণময় সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতাই শিল্পী, সংগঠক এবং আপোষহীন সংগ্রামী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গড়ে ওঠার গোর্কি-বর্ণিত পৃথিবীর পাঠশালা। এই পর্বটি বিভক্ত নানা পর্যায়ে। বাল্য ও কৈশোরের প্রথম পর্ব তাঁর কাটে মিরাশী গ্রামে। কৈশোরের দ্বিতীয় পর্বে বাবার আদেশে উজান আসামের ডিব্রুগড় শহরে বাবার গুরুদেব মুক্তানন্দ স্বামী ওরফে ওঁ বাবার আশ্রমের আশ্রমিক পরিবেশে বছর দুয়েক কাটে তাঁর। এখানে আশ্রমের কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় তাঁর মন হাঁসফাঁস করত। তবে বিদ্যালয়ে পেতেন মুক্ত জীবন। এখানেই তাঁর প্রথম পরিচয় অসমীয়া ভাষা-সংস্কৃতির সাথে। সহপাঠী লোহিত কাকতীর কাছে শেখেন জীবনের প্রথম অসমীয়া গান। হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, কিশোর বয়সেই অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুবাদেই পরবর্তী জীবনে তিনি পেরেছিলেন আসামের অসমীয়া অধ্যুষিত ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় গণনাট্য আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে অসমীয়া সমাজের সাথে সম্পৃক্ত হতে। ওঁ বাবার আশ্রমের নানা উত্থান পতনের প্রেক্ষিতে বাবা হরকুমার হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে ডিব্রুগড়ের আশ্রম থেকে নিয়ে এসে হবিগঞ্জ শহরের হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। আশ্রমের কঠোর অনুশাসন বা বাড়ির সংস্কারাচ্ছন্ন পরিবেশের কোনোটিই এখানে ছিল না। ফলে বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর অভিষেক হয় হবিগঞ্জ শহরেই। খেলাধুলা স্বাধীনতা সংগ্রাম গান গাওয়া, সব কিছুই অর্গলমুক্ত তাঁর নতুন জীবনকে ভরিয়ে দিল। তখন সারা দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনে জোয়ার এসেছে। তার ঢেউ এসে লাগল সিলেটের এই মহকুমা শহরেও। স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচণা হল। মিছিলে পা মেলানোর পাশাপাশি চলল দেশাত্মবোধক গানে গলা মেলানোও। মাত্র ১৮ বছর বয়সে জীবনের প্রথম জেলবাস হল তাঁর। নগাঁও জেলে থাকার সময় তৎকালীন আসামের বিশিষ্ট কংগ্রেসী নেতা ও পরবর্তী কালে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা তাঁকে শেখান প্রথম অসমীয়া বনগীত। এ ভাবে অসমীয়া লোকগানের সাথেও তাঁর পরিচয় ঘটে যায়। আসামের সে সময়ের বিশিষ্ট গীতিকার পার্বতী প্রসাদ বরুয়ার লেখা ওই বনগীতটির কথা সারাজীবন মনে রেখেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর তিনি সিলেটের মুরারী চাঁদ কলেজে ভর্তি হন। এখানে আসার পর তাঁর রাজনৈতিক কর্মকা-ও বেড়ে যায়। কলেজের ক্লাসে শিক্ষকদের মুখে সোভিয়েতের বিপ্লবের কথা ও নতুন সমাজ গত্তনের কথা শুনে বলশেভিকবাদের প্রতি কিছুটা আকর্ষণ গড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু সিলেটে তখনও কমিউনিস্ট পার্টির কোনও শাখা গড়ে ওঠে নি। কংগ্রেসের আইন অমান্য আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে কলেজীয় শিক্ষা ত্যাগ করে পুরোদস্তুর ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতা আন্দোলনে। জেলার নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে অংশ নেন লবণ সত্যাগ্রহে। এই অভিযানে অংশ গ্রহণ করার সময়ই দ্বিতীয়বার কারাবরণ করেন। এবার তাঁর সাজা হয় আড়াই বছরের। জেলজীবনে নানা জাতির কয়েদীদের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। গান জানা বন্দী হিসেবে সহবন্দীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠেন। এবার জেলে অসমীয়া বন্দীদের কাছে শেখেন অসমীয়া কাব্য সঙ্গীত নাটকে নতুন জোয়ার আনা জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালার গান। অসমীয়া ভাষা সংস্কৃতির নতুন দিনের পথিকৃৎ এই ব্যক্তিত্ত্বকে পরে তিনি টেনে আনেন গণনাট্যের অভ্যন্তরে। চা মালিক পরিবারের সন্তান অথচ শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর জ্যোতিপ্রসাদ হন গণনাট্যের প্রথম রাজ্য সভাপতি। এই জেলে বন্দী থাকার সময়ই যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। গুরুতর অসুস্থতার সুযোগে সরকার চেয়েছিল মুচলেকার বিনিময়ে তাঁকে মুক্তি দিতে। সহবন্দী স্বাধীনতা সংগ্রামীরা বা অন্য কয়েদীরাও তাঁকে বোঝান শারীরিক অসুস্থতার প্রেক্ষিতে মুচলেকার বিনিময়ে মুক্তি নিতে। কিন্তু আজীবন সংগ্রামী হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে কেউই মুচলেকা দিতে রাজী করাতে সমর্থ হল না। দেড় বছরের মাথায় সরকার নিজে থেকেই তাঁকে মুক্তি দিল। চিকিৎসার জন্যে পরে তাঁর বাবা তাঁকে যাদবপুরের কে এস রায় স্যানিটোরিয়ামে পাঠান। এখানে ভর্তি ছিলেন অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী, যাঁরা জেলজীবনের অত্যাচারে বা স্বাধীনতা সংগ্রামের কঠোর জীবনে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এখানেই অনিলেন্দ্র রায় নামের একজন কমিউনিস্ট রোগীর সংস্পর্শে এসে বিভিন্ন কমিউনিস্ট সাহিত্য পড়ার সুযোগ হয় তাঁর। এই হাসপাতালেই তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শে দীক্ষিত হন। কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক রাজনীতির সাথেও তাঁর যোগাযোগ হয় এখানে। আসামের প্রথম যুগের কমিউনিস্ট নেতা সিলেটের দিগেন দাশগুপ্ত ও চঞ্চল শর্মা হাসপাতালে এসে তাঁকে সিলেটে কমিউনিস্ট পার্টির শাখা গড়ে ওঠার খবর দিয়ে তাঁকে এতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। এটা ছিল সংগ্রামী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জীবন-নদীর সমুদ্রে এসে পৌঁছনোর মতোই স্বাভাবিক ঘটনা। গুয়াহাটি জেলে বন্দী থাকার সময়েই মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলার খবর শুনে হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও আরো কয়েকজন বন্দী কমিউনিস্ট মতবাদের দিকে খানিকটা ঝুঁকেই পড়েছিলেন। তখন সাংগঠনিক ভাবে ভারতের নবগঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব ছিল না। পরে যাদবপুর হাসপাতালে কমিউনিস্ট মতাবলম্বী নানা পত্রপত্রিকা অন্য রোগীদের মারফৎ হাতে এলে পত্রিকার যোগাযোগের ঠিকানায় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলেন তিনি। কমিউনিস্ট মতবাদ স্বাধীনতা সংগ্রামী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মধ্যে নিয়ে এল শ্রেণিচেতনা। শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির স্বপ্নে বিভোর হয়ে ফিরে এলেন সিলেটে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে মিলিয়ে দিতে হবে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির লড়াই। গ্রামে ফিরে এসে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুললেন শ্রমজীবী কৃষক ও গরিব মানুষের সাথে। সংস্কারাচ্ছন্ন পরিবারে উদ্যত হলেন ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানতে। জমিদার বাড়ির ছেলে হয়ে গ্রামের অন্ত্যজ শোষিত মানুষদের অঞ্চলে গিয়ে সভাসমিতি সংগঠিত করতে শুরু করলেন। অবস্থা এমন জায়গায় গেল বাবার সভাপতিত্বে আয়োজিত এক গ্রামের সভায় ধর্মীয় ভাবাবেগ তৈরির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে শ্রেণি রাজনীতির বার্তা নিয়ে জড়িয়ে পড়লেন বাবার সাথে বিতর্কে। কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক দায়িত্ব হিসেবেই রাজনৈতিক কাজের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলার কাজ শুরু হল। গড়ে তুললেন সুরমাভ্যালি কালচ্যারাল স্কোয়াড। আবাল্য শোনা লোকায়ত গানের সুরে বাঁধলেন কৃষক সংগ্রামের নতুন গান। মিরাশী গ্রামের জমিদার পরিবারের ছেলে হেমাঙ্গ বিশ্বাস পরিণত হলেন কমিউনিস্ট গণশিল্পী সংগঠক হেমাঙ্গ বিশ্বাসে।
গণআন্দোলনের কর্মী থেকে শিল্পীসেনানী
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পরবর্তী জীবনের খ্যাতি যদিও শিল্পী স্রষ্টা হিসেবে, তাঁর জীবনের গতিপথের দিকে তাকালে দেখব, তিনি মূলত চেয়েছিলেন জনসাধারণের মুক্তির সংগ্রামের একজন সৈনিক হয়ে উঠতে। জীবনের শুরুতে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় শামিল হয়েছেন। আন্দোলনের জোয়ারভাঁটায় শেষপর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছেন সর্বহারার মুক্তিসংগ্রামের আন্তর্জাতিকতার মহাসমুদ্রে। এই যাত্রাপথে গান তাঁর সাথে ছিল প্রথম থেকেই। ১৯৩০ সালেই তিনি গান গেয়েছেন সত্যাগ্রহের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মিছিলে পা মিলিয়ে। তিরিশের দশকের শেষের দিকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ লাভ করেন। তাঁর সময়ের গণনাট্যের শিল্পী সাহিত্যিকদের অনেকেই যেমন শিল্পী বুদ্ধিজীবী হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পৃক্ত হন, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ক্ষেত্রে তেমনটা ছিল না। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেই তিনি যুক্ত হয়েছিলেন কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টিতে। তাঁর গান রচনাও ছিল না কোনো সাঙ্গীতিক পিপাসানিবৃত্তিও। অর্থাৎ তিনি প্রথমে একজন রাজনৈতিক কর্মী, পরে শিল্পী। আন্দোলন সংগ্রামের প্রয়োজনে তিনি গান লিখেছেন, গান গেয়েছেন। আন্দোলন সংগ্রামের বাস্তব অভিজ্ঞতা তাঁর গানের ভাষা পাল্টে দিয়েছে। আবার এটাও সত্যি, সঙ্গীতকে রাজনৈতিক সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে তিনি কখনোই গান থেকে নিরাসক্তির দূরত্বে বাস করেন নি। সংগ্রামের হাতিয়ারকে শাণিত করার কাজের প্রক্রিয়ার মধ্যেই নানা ধরনের সঙ্গীতের সাথে তাঁর একটি সংলাপ গড়ে ওঠে। এই সংলাপ একদিকে তাঁর গানকে বিশিষ্টতা দিয়েছে, অন্যদিকে সঙ্গীতের নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রেও তাঁর অবস্থানকেও সুস্পষ্ট করেছে। তাঁর আন্দোলন সংগ্রামের গতিপথ যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, সেভাবেই পরিবর্তিত হয়েছে তাঁর গানের ভাষা। তিরিশের দশকের শেষের দিকে লেখা তাঁর একটি গান ‘আগে চল আগে চল মজুর কিষাণ/ সমরশিবিরে শোন হাঁকিছে বিষাণ’ তৎকালীন আসামের রাজধানী শহর শিলং-এ একটি কৃষক সমাবেশে কৃষকদের মুখে মুখে গীত হয়। তাঁর এই সময়ের গানগুলি সহজ সুরে নজরুলের দেশাত্মবোধক গানের ঢঙে লেখা বাণীতে লিখিত। পরবর্তী কালে কৃষক আন্দোলনের সাথে তাঁর সম্পর্ক যত নিবিড় হয়েছে, ততই তাঁর গান লোকসঙ্গীতের কাছাকাছি এসেছে। একটি গান লিখেছিলেন বেহেলীর কৃষক সম্মেলনের জন্যে, ‘আমরা দেবো না, দেবো না/ দস্যুকে পথ ছেড়ে দেবো না/ ওই দস্যু আসে হুশিয়ার/ মুসোলিনি তোজো আর হিটলার/ সাথে আছে রুশ-চীন/ বেপরোয়া চলো বাধাহীন’। হেমাঙ্গ বিশ্বাস বলেছেন তাঁর স্মৃতিকথায়, এই গানগুলো তাঁরা অত্যন্ত উৎসাহভরে দলবেঁধে গাইলেও এ ধরনের গান কৃষকদের হৃদয় স্পর্শ করতে ব্যর্থ হত। এটা বুঝতে পারার পরই কৃষক সাধারণ যে সঙ্গীতধারায় বাস করেন, যে ভাষায় গান শোনেন, সেই ভাষার কাছাকাছি গানকে নিয়ে যাওয়ার তাগিদ অনুভব শুরু হয়। তারপরই ভাটিয়ালি সুরে রচনা করেন, ‘ও চাষী ভাই/ তোর সোনার ধানে বর্গী নামে দেখরে চাহিয়া’। সে সময় গানটি সিলেটের গ্রামাঞ্চলের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। সিলেটের সারিগান, ‘সাবধানে গুরুজীর নাম লইওরে সাধুভাই’ এর সুরে কথা বসিয়ে লিখলেন ‘তোমার কাস্তেটারে দিও জোরে শান কিষাণভাই’ গানটি। চল্লিশের কৃষক আন্দোলনের সূত্রে এই গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে মনিপুরের কমিউনিস্ট নেতা ইরাবত সিংহ এই গানটি মনিপুরি ভাষায় অনুবাদ করেন। পরবর্তী সময়ে মনিপুরি গানটির রেকর্ডও প্রকাশিত হয়। মনিপুরে এই গানটির মনিপুরি অনুবাদটি যথেষ্ট জনপ্রিয়। দুর্ভিক্ষ ও জাপবিরোধিতার পরিপ্রেক্ষিতে ময়মনসিংহের শরৎ নাথের ‘আইলরে চৈতন্যের গাড়ি সোনার নদীয়ায়’ গানের সুরে হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছিলেন, ‘ঘোর কলিকাল আইল আকাল/ সোনার বাংলায়, হায় হায়/ ক্ষুধার অনল ধিকিধিকি দিকে দিকে ধায়/ ক্ষুধার পাগল মানুষ ঘুরে ফিরে/ মায়ের বুকে দুধের ছাওয়াল মরে অনাহারে/ মৃত সন্তান বুকে লইয়া কান্দে বাপে মায়’। সিলেটের অত্যন্ত জনপ্রিয় ধামাইল গান, ‘আসবে শ্যামকালিয়া কুঞ্জ সাজাও গিয়া’-র সুরে লিখেছেন, ‘তোরা বল সখী বল বল, বল আমারে/ ওকে ঘরের বার কূলের বার করলো নারীরে’। লোকায়ত সুরে সবচেয়ে তীক্ষè রাজনৈতিক গান লিখেছিলেন দেশভাগের সময়। গ্রামের এক অত্যাচারী জমিদারের মৃত্যুতে গ্রামের লোককবি লিখেছিলেন, ‘বাবু গোপীচান্দ রায়/ সোনারপুরী আন্ধার কইরা লুকাইলায় কোথায়/ পুয়ায় কান্দে পুরিয়ে কান্দে কান্দে বাবুর মা’য়/ দুই তালার উপরে কান্দে রাসমণি বেশ্যায়’। একই ধরনের শ্লেষাত্মক ভাষায় হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখলেন, ‘মাউন্টব্যাটন সাহেব ও, তোমার সাধের ব্যাটন কার হাতে থুইয়া গেলায় ও/ তোমার সোনার পুরী আন্ধার কইরা ও প্রভু কই চলিলায়/ সর্দার কান্দে, পণ্ডিত কান্দে, কান্দে মৌলানায়/ আর মাথাইয়ে যে মাথা কুটে বলদায় বুক থাপরায়/ তোমার শ্যামাচেট্টি ভক্তবৃন্দে গো, তোমার লেডির গাউন কান্দিয়া ভিজায়’। কীর্তন ও লোকায়ত নানা সুরে লেখা এই দীর্ঘ গানটি দিক থেকে একটি সার্থক রাজনৈতিক গান। তৎকালীন পুলিস বিভাগের নজরেও ছিল এই গান ও তার প্রভাব। দেশভাগের পর যখন ওপার থেকে এপারে উদ্বাস্তু মানুষের স্রোত এই সার্বিক ট্র্যাজেডির মুখোমুখি করিয়ে দিল বাঙালিকে, তখন হেমাঙ্গ বিশ্বাস এই ভেঙে পড়া মানবগোষ্ঠীকে উজ্জীবিত করতে সিলেটের হোলি গানের সুরে লেখেন, ‘বাঁচবো বাঁচবো রে আমরা বাঁচবো রে বাঁচবো/ ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়া নয়া বাংলা গড়বো’। এই সময়পর্বে লোকায়ত সুরের কাঠামোয় লেখা গানের আধিক্য থাকলেও অন্য সুর ও ভাষায়ও অসংখ্য গান লিখেছেন। ছাত্র সম্মেলনের উদ্বোধনী সঙ্গীত হিসেবে গাওয়ার জন্যে তিনি লিখেছিলেন, ‘উদয় পথের যাত্রী ওরে রে ছাত্রছাত্রী/ মশার জ্বালো মশাল জ্বালো’। আসামে কালচ্যারাল স্কোয়াডের সফরের সময় ‘রক্তের ঋণ’ নামে যে ব্যালে প্রযোজিত হয় পানু পাল ও ঊষা দত্তের পরিচালনায় তার জন্যে তিনি লিখেছিলেন, ‘মহানগরীর রাজপথে যত রক্তের স্বাক্ষর/ অগ্নিশিখায় অঙ্কিত হল লক্ষ বুকের পর’। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কর্মক্ষেত্র যখন সিলেট জেলা থেকে আসাম রাজ্যের অন্যান্য অঞ্চলে ছড়াতে থাকে, তাঁর গানেও আসে বৈচিত্র্যের আভা। দেশভাগের পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস থেকে ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’ শ্লোগানের সঙ্গে ডাক দেওয়া হয় গণ অভ্যুত্থানের। পার্টি বেআইনী হয়ে যায়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস আত্মগোপন করেছিলেন আজকের মেঘালয়ের জয়ন্তিয়া পাহাড়ে। ও্ই সময়ে তিনি শোনেন জয়ন্তিয়াদের একটি লোকগান। সেখানে জ্যোৎস্না রাতে যুবকেরা গিটার নিয়ে দল বেঁধে এক ধরনের প্রেম নিবেদনমূলক গান গায়। সেই গানের সুরেই তখনকার রাজনৈতিক লাইনের সাথে সঙ্গতি রেখে হেমাঙ্গ বিশ্বাস লেখেন, ‘আজাদী হয় নি আজো তোর/ নববন্ধনশৃঙ্খলডোর/ দুখরাত্রি হয় নি ভোর, আগে কদম কদম চলো জোর’। পরবর্তী জীবনে হেমাঙ্গ বিশ্বাস বেশ কিছু বিদেশি গণসঙ্গীত অনুবাদ করেন। এই গুলির মধ্যে অন্যতম ‘জন ব্রাউন’ বা ‘জন হেনরী’। জন হেনরী সম্ভবত সত্তর আশির দশকের সবচাইতে জনপ্রিয় গণসঙ্গীতের অন্যতম। বাংলা জন হেনরীর সুরে তিনি মূল থেকে সামান্য পরিবর্তন করেছিলেন। এই পরিবর্তনের ফলে পাশ্চাত্য সুরের কাঠামোর মধ্যেও শিবরঞ্জনী রাগের খানিকটা ছোঁয়া লেগে গানটি যেন ভারতীয় রূপ পেয়েছে। লেনিনের জন্মশতবর্ষে ল্যাংস্টন হিউজের কবিতা কমরেড লেনিন অব রাশ্যা এবং তার বিষ্ণু দে কৃত অনুবাদ রুশ দেশের কমরেড লেনিন-এ সুরারোপ করেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। এই গানেও প্রত্যেকটি স্তবকের শেষ পংক্তিতে জন হেনরীর মত শিবরঞ্জনীর ছোঁয়া স্পষ্ট। একটা সময়ে গণনাট্য আন্দোলনে গণসঙ্গীতের রূপ কেমন হবে তা নিয়ে তীব্র বিতর্ক হয়েছিল গণনাট্যের সর্বভারতীয় সম্মেলনের মঞ্চে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও তাঁর সমমতের বন্ধুদের মত ছিল শ্রমিক কৃষককে উদ্বুদ্ধ করবে যে গান তা লোকসঙ্গীত নির্ভর হতে হবে। তার সুরের চলন এবং বাণী হবে সহজ সরল। হারমনি বা অর্কেস্ট্রেশনের সেখানে কোনও অবকাশ থাকা উচিত নয়। অন্যদিকে, সলিল চৌধুরী ও তাঁর সমমতের বন্ধুদের মত ছিল শ্রমিক কৃষককে উদ্বুদ্ধ করবে যে মতাদর্শ তা তো আন্তর্জাতিক, কোনও অঞ্চলের আঞ্চলিক বিষয় নয়। প্রতিবাদী চেতনাকে ওই আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করতে প্রয়োজনে গণসঙ্গীতে হারমনি অর্কেস্ট্রেশন সবই করতে হবে। সলিল চৌধুরীরা বলেছিলেন, শ্রমিক কৃষক লোকসঙ্গীত গায় বলে যদি তাঁর প্রতিবাদের সঙ্গীতকে তাঁর লোকসঙ্গীতে আটকে থাকতে হয়, তবে যে কৃষক শ্রমিক গরুর গাড়ি চড়ে, তাঁদের সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিদের গরুর গাড়ি চড়ে আসাই উচিত সেক্ষেত্রে। সেদিন সে বিতর্কের কোনও সমাধা হয় নি। যে যার পথে সৃষ্টিকর্ম চালিয়ে গেছেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাস পরবর্তীকালে তাঁর স্মৃতিকথায় সেদিনের বিতর্কে নিজেদের অবস্থানকে একদেশদর্শী বলে মেনে নিয়েছেন। নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রে এই অবস্থানের পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করি তাঁর ‘শঙ্খচিল’গানে, যেখানে নানা জাতির লোকসুরের আভাস আছে, আছে বাঙালির নিজস্ব সুর। আর তার সঙ্গে মিশে গেছে পাশ্চাত্যের সুর ও চলন। শেষ পর্যন্ত গানটি হয়ে উঠেছে সত্যিকারের আধুনিক প্রতিবাদী গান। নানা বিদেশি গানের অনুবাদের সুরেও একই ধরনের সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষাও করেছিলেন প্রতিবাদী সঙ্গীত নিয়ে। চীন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা একটি গান ‘আমি যে দেখেছি সেই দেশ’ গানে আমরা পাই চীনা সুর। আবার চীনের শাওশান নিয়ে লেখা গান, ‘আমি যাই শাওশান’ গানে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরের আভাস। মাও সে তুঙকে নিয়ে লেখা গান ‘আরো বসন্ত’ গানে কেদার রাগের সুর খুঁজে পাওয়া যায়।
কবি হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পরিচয় পশ্চিমবঙ্গে কতটা আছে জানি না। কিন্তু আসামের অসমীয়া কবিতায় তিনি যুগান্তরের অনুপ্রেরণা। তাঁর রচিত বাংলা কবিতার সঙ্কলন ‘সীমান্তপ্রহরী’ ও অসমীয়া কবিতার সংকলন ‘কুলখুড়ার চোতাল’ (কুলখুড়োর উঠোন) আসামের সাংস্কৃতিক-রাজনীতির একটি নতুন পথের দিশারী। আসাম বহুভাষিক বহুজাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত রাজ্য। এখানকার প্রধান ভাষা অসমীয়া হলেও একমাত্র ভাষা নয়। আসামের সমাজ ও সংস্কৃতির বহুত্বই আসামের বৈশিষ্ট্য। প্রতিক্রিয়াশীলেরা এই বহুত্বের ওপরই আঘাত করেছে বারবার বিভিন্ন সময়ে। ফলে এখানকার প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য এই বহুত্বের স্বপক্ষে লড়াই করাই। আসামে অসমীয়ার অসমীয়াত্ব, বাঙালির বাঙালিত্ব বিকশিত হয়েছে তার প্রতিবেশীচেতনার মধ্যেই। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের অসমীয়া ও বাংলা কবিতা এই প্রতিবেশীচেতনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এই চেতনাই পথ দেখিয়েছে সেখানকার কাব্য সাহিত্যকে নতুন পথে হাঁটতে।
নিজেদের প্রথম দিককার গান নিয়ে পরবর্তী জীবনে আলোচনা করেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর স্মৃতিকথায়। এই আলোচনা প্রকৃতপক্ষে গণনাট্যের গীতধারার একটি নন্দনতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক মূল্যায়ন। এই মূল্যায়নের সাথে কেউ একমত হতে নাও পারেন, কিন্তু এই বিতর্কটির গুরুত্ব কেউ উপেক্ষা করতে পারবেন না। সমস্যার উদয় সম্ভবত হয় কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে প্রচলিত ধারণার জায়গা থেকেই। প্রথমযুগ থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি সংস্কৃতিকে শুধুমাত্র প্রচারের হাতিয়ার হিসেবেই ভেবে এসেছে। এ ছাড়া সংস্কৃতির আর কোনো মূল্য প্রত্যক্ষত খুব কমই অনুভূত হয়েছে। সংস্কৃতির অঙ্গনের অভ্যন্তরেও যে প্রতিনিয়ত একটি লড়াই চলতে থাকে এবং সংস্কৃতির গভীরেও মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাসের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়, সেদিকের প্রতি তেমন নজর ছিল না পার্টির। প্রতিদিনের বাস্তবতায় যে লড়াই বিকাশমান তার বার্তা বৃহত্তর জনসমাজে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে গান নাটক চিত্রকলা ইত্যাদির ব্যবহার, এটাই ছিল সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে কমিউনিস্ট পার্টির আগ্রহের জায়গা। ফলে লোকসঙ্গীতের প্রতি মানুষের অনুরাগ দেখে মনে হয়েছে বোধহয় এই গানের সুরের জাদুতেই মাত্র মানুষ মোহাবিষ্ট হয়ে আছে। ফলে কমিউনিস্ট শিল্পীদের ওপর দায়িত্ব পড়েছে এই সুরে একটি রাজনৈতিক গান বাঁধা। গানের প্রয়োজন জনসভার বা হাটের সভার শুরুতে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস লিখেছেন, তখন পার্টির রাজনৈতিক লাইনের অনুসরণে গান লিখতে গিয়ে নানা ধরনের তাৎক্ষণিক আহ্বানকে কৃত্রিমভাবে গানের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হয়েছে। তা ছাড়া পার্টির রাজনৈতিক লাইন যখন সংস্কারবাদের আবর্তে ঘুরছে তখন গানের বাণী মাথা নিচু করে তাকে অনুগমন করেছে। আবার যখন সরাসরি লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান এসেছে রাজনৈতিক লাইনে, তখন গানের ভাষাতেও উত্তেজনা যুক্ত হয়েছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের স্মৃতিকথায় এই কথাগুলি পড়তে পড়তে মনে পড়ে যায় একটি সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা। একটি গ্রামীণ ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। প্রতিযোগিতার বিভাগ বাউল গানের এবং গানের বিষয় বিজ্ঞানসম্মত শৌচাগার নির্মাণ। শার্টপ্যান্ট পরা প্রতিযোগীরা এসে গানের আগে গেরুয়া পোশাক পড়ে ‘ভোলামন, বিজ্ঞানসম্মত শৌচাগার তৈরি কর ভাই’ বলে গান গাইছে। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের স্মৃতিকথায় যা পেয়েছি, তাই দশকের পর দশকের যান্ত্রিক অনুকরণের পর এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। বাউল গানের সুরে লেখা গণসঙ্গীতে ‘ভোলামন’ এর জায়গায় ‘বন্ধুগন’ বা ‘সাথী’ বা ‘কমরেড’ বসিয়ে দিলেই হল। এখানে দু’টি বিষয় রয়েছে। এক, ধরে নেওয়া হচ্ছে লোকগানের সুর বিষয়টি স্থির, শুধু নতুন কথা দিলেই গানটি নতুন গান হয়ে যাবে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস লোকসঙ্গীত সম্পর্কিত আলোচনায় বলেছেন, লোকসঙ্গীত কোনো স্থাণু বিষয় নয়। সেখানেও পরিবর্তন আসে, সেটা বাইরের হস্তক্ষেপে নয়। নতুন সময়ে নতুন জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতায় লোকশিল্পী ও স্রষ্টারাই তাঁদের সৃষ্টিতে পরিবর্তন আনেন। এই সঙ্গীতধারার বাইরে থাকা মানুষেরা হঠাৎ একদিন গিয়ে কোনো পরিবর্তন করতে পারেন না। এখানেও বাহিরানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে ওই বাহিরানায় অন্তর্ভুক্ত নয়, সে ওই পরিবর্তন আনতে পারে না। দ্বিতীয়ত, এমন একটি প্রতিযোগিতা আয়োজনের মধ্যে সুরকে আঙ্গিক আর কথাকে বিষয়বস্তু বলে ধরে নেওয়ার একটি মনোভাবও পরিস্ফুট হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই সুর আর বাণীকে কৃত্রিমভাবে আঙ্গিক আর বিষয়বস্তু বলে বিভাজিত করে দেখে এসেছেন বামপন্থীরা। আঙ্গিক আর বিষয় যে পরস্পরের দ্বন্দ্বসমন্বয়ে গড়ে ওঠে এবং একটি বিশেষ বিষয়বস্তুর জন্যেই একটি বিশেষ আঙ্গিকের জন্ম হয়, এ কথাটি বিস্মৃত থেকেছে। ফলেই এমন কাণ্ড ঘটে চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। বিজ্ঞানসম্মত শৌচাগার নির্মানের আন্দোলনের জন্যে কোনো গান তৈরি হবে না, কথাটা এমন নয়। কিন্তু এই বার্তাটির জন্যে যে গান তৈরি হবে তার সুরও হবে আলাদা। হয়ত গ্রামীণ সমাজে এটা একটা নতুন বার্তা আনছে। ফলে নতুন আঙ্গিকেই সেই কথাটি বলতে হবে। বাউল গানের আঙ্গিকটি একটি বিশেষ দার্শনিক অভিব্যক্তির সাথে বিকশিত হয়েছে। সেখান থেকে কৃত্রিমভাবে সুরকে ছেঁটে এনে গান তৈরি করলে সেটা কৃত্রিম ও চাপিয়ে দেওয়া ব্যাপার হবে। তা ছাড়া, এই গানের রসিকদের কাছে এই সুরে এই কথা বসানোটা ব্লাসফেমির মতই শোনাবে, আর সেটা হলে খুব একটা অন্যায়ও হবে না। প্রতিবাদী গানের রাজনীতি ও আঙ্গিক নিয়ে একটি জরুরি বিতর্কের দিকে ইঙ্গিত করেছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর স্মৃতিকথায়। ইদানিং কালে বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকে হিন্দুত্বের রাজনীতির উত্থানের পর সাংস্কৃতিক সংগ্রামের বিষয়টি কিছুটা আলোচিত হতে শুরু করেছে বামপন্থী মহলে। সংস্কৃতিকে শুধুমাত্র লড়াইয়ের হাতিয়ার না ভেবে লড়াইয়ের ময়দান ভাবা, এরও একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে এই আলোচনা পশ্চিমবাংলার বামমহলে এখনো সেভাবে গতি পায় নি।
লোকগানের সুজন
চল্লিশের গণনাট্য আন্দোলনের সূত্রে যে সমস্ত সঙ্গীত স্রষ্টাদের আমাদের পেয়েছি, তাঁদের মধ্যে হেমাঙ্গ বিশ্বাসই বোধহয় আমাদের লোকায়ত সঙ্গীতধারার সবচেয়ে গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। কথাটা হয়ত ভুলই হল। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সাঙ্গীতিক বসবাসই হয়ত ছিল আমাদের লোকায়ত সঙ্গীতধারার অন্তরতম প্রদেশে। কিন্তু যেহেতু তিনি সর্বাগ্রে ছিলেন শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক মুক্তিব্রতের এক রাজনৈতিক কর্মী, সেজন্যে লোকায়ত সঙ্গীতধারায় এই বসবাস তাঁকে মোহান্ধ করে নি। অভ্যন্তরে বাস করেই তিনি গভীর অভিনিবেশে লক্ষ্য করেছেন এর সম্পদ, লক্ষ্য করেছেন তার উজ্জীবনের দিক ও একই সাথে বন্ধ্যাত্বের দিক। এই বসবাস ও সহযাত্রা কমিউনিস্ট রাজনৈতিক কর্মী হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে গড়ে তুলেছে আমাদের লোকায়ত সঙ্গীতের এক অনন্য তাত্ত্বিক হিসেবেও। লোকসঙ্গীতের সাথে তাঁর সারাজীবনের সম্পর্ককে তিনটি পর্বে দেখা যেতে পারে। প্রথমপর্ব তাঁর ছেলেবেলা। পূর্ব বাংলার গ্রামীণ সমাজজীবনের বৈশিষ্ট্য এই যে, সেখানকার লোকায়ত গানের ধারার প্রধান কাণ্ডারী গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষ হলেও গ্রামের উচ্চকোটির মানুষের সমাজও এই গানের ধারার সাথে নাড়ীর যোগেই বাঁধা। বাল্য ও শৈশবে এক বিমুগ্ধ বিস্ময়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁদের গ্রামের বাড়িতে শুনেছেন তাঁদের অঞ্চলের লোকায়ত নানা ধারার গান। পাঠশালায় যাওয়া আসার পথে ধানখেতের হাওয়া গায়ে মেখে প্রাণের গভীরে গিয়ে বাসা বাঁধা এই গানগুলিকে গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠার মধ্যদিয়েই তিনি হয়ে ওঠেন লোকায়ত গানের অন্দরমহলের সুজনে। দ্বিতীয় পর্বে কমিউনিস্ট রাজনৈতিক কর্মী হেমাঙ্গ বিশ্বাস কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে লোকায়ত গানের সাথে আত্মীয়তায় যুক্ত হয়েছেন কৃষিজীবী সমাজের ঘনিষ্ঠ দোসর হওয়ার লক্ষ্যে। তিনি বলেছেন, তিনি ও তাঁর সহযোগী বন্ধুরা গ্রামাঞ্চলে গিয়ে সভাসমিতি করার ফাঁকে ফাঁকে সে অঞ্চলের লোকায়ত গান গলায় তুলে নিতেন। পরে এই লোকায়ত গানের সুরে ও বাগধারায় তিনি বাঁধতেন নতুন নতুন গান কৃষক আন্দোলনের সেই সময়ের চাহিদা অনুযায়ী। এই পর্বেই পরবর্তী সময়ে প্রথমে সুরমাভ্যালি কালচ্যারাল স্কোয়াড ও পরে আসামের নানা স্থানে গণনাট্য সঙ্ঘের সাংগঠনিক ভিত্তি প্রসারের কাজে ঘুরে বেড়ানোর সময় নানা জাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর লোকশিল্পীরা তাঁর ঘনিষ্ঠজন হয়ে ওঠে । তিনি পরিচিত হন তাঁদের সৃষ্টির সাথে। এই পরিচয় এতটাই গভীর ও আত্মিক ছিল যে, লোকশিল্পীরা কখনোই তাঁকে শহুরে বহিরাগত ভাবত না। ভাবত একান্ত আপন। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মৃত্যুর পরের দিন শিলচরে একটি কৃষক সমাবেশে যখন তাঁর মৃত্যুসংবাদটি ঘোষিত হয়ে শোকপ্রস্তাব উত্থাপিত হয়, তখন গ্রামাঞ্চল থেকে আসা অনেক বয়স্ক কৃষক কর্মীর চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। ছাত্র আন্দোলনের সূত্রে কাছাড়ের বিভিন্ন অঞ্চলগুলিতে ঘোরার সময় কৃষক আন্দোলনের পুরনো ঘাঁটি অঞ্চলগুলিতে মনিপুরি বা হিন্দিভাষী কৃষকদের বাড়িতে গানের খাতায় হেমাঙ্গ বিশ্বাসের হাতের লেখা দেখেছি। একটি নিবন্ধে পড়েছিলাম, আসামের প্রবাদপ্রতিম ঢোলবাদক মঘাই ওঝা শেষজীবনে বলতেন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছাড়া আমাদের মূল্য আর কেউ বুঝল না। এখনও আসামের গ্রামাঞ্চলগুলিতে গণনাট্য আন্দোলনের সেযুগের একটি নামই মানুষ মনে করতে পারেন, সেটি হেমাঙ্গ বিশ্বাসের। তাঁর এই আত্মিক সম্পর্কের জন্যে তিনি পেরেছেন পরবর্তী সময়ে তৃতীয় পর্বে লোকসঙ্গীতের সংকট ও বিকৃতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এই সঙ্গীতধারার ভিতরতম প্রদেশে আলো ফেলতে। তাঁর এই তাত্ত্বিক নিবন্ধগুলি বিশিষ্ট এ জন্যেই যে এতে কোনও অ্যাকাডেমিক শুষ্কতা নেই। লোকসঙ্গীত সংক্রান্ত তাত্ত্বিকচর্চায় তাঁর মহত্তম অবদান শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঘরানার বিপরীতে লোকসঙ্গীতের বাহিরানার সংজ্ঞায়ন। তিনি বলেছেন, একটি অঞ্চলের সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, ভাষা, বাগধারা সে অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের সুর ও ভাষায় বিশিষ্টতা দেয়। এই আঞ্চলিকতাকে বাদ দিয়ে লোকসঙ্গীতকে চেনা যায় না। এই আঞ্চলিকতাকেই তিনি বলেছেন বাহিরানা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত যেমন গুরুর বংশপরম্পরার মধ্য দিয়ে বিশিষ্টতা অর্জন করে, তেমনি একটি অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের গড়নটিও তৈরি হয় সেই অঞ্চলের আঞ্চলিকতার মাধ্যমেই। অনেক শাস্ত্রীয় ঘরানা অঞ্চলের নাম দিয়ে পরিচিত হলেও তা আসলে একটি বংশ পরম্পরা বা খানদানের দ্বারাই বিশেষায়িত। তেমনি লোকসঙ্গীতেও গুরুমুখীনতা আছে, কিন্তু তা আঞ্চলিকতার বাইরে নয়। নানা ক্ল্যান রেস ও ট্রাইবের দ্বন্দ্বসমন্বয়ে যেভাবে একটি জাতি গড়ে ওঠে, তেমনি একটি জাতির সাঙ্গীতিক কাঠামোটিও গড়ে ওঠে সেই ক্ল্যান রেস ও ট্রাইবের লোকসঙ্গীতের দ্বন্দ্বসমন্বয়ে। একটি জাতির নির্মাণ এই প্রক্রিয়ার হওয়ার পরও যেমন তার গায়ে নানা গোত্র ও জাতিগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য বেঁচে থাকে, তেমনি একটি জাতির জাতীয় সঙ্গীতের কাঠামোটি গড়ে ওঠার পরও দেখা যায় সমান্তরালে সেই আঞ্চলিক সুরগুলি আপন বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেঁচে আছে। সাংস্কৃতিক যোদ্ধা হেমাঙ্গ বিশ্বাস খুঁজতে চেয়েছেন লোকসঙ্গীতের দর্পণে মানুষের সামাজিক ইতিহাসকে। পাশ্চাত্যের সঙ্গীত-নৃতত্ত্বের তত্ত্বের নিরিখে বিচার করেছেন আসাম ও বাংলার লোকগানকে। এ ভাবেই আমাদের লোকসঙ্গীতের সঙ্গীত-নৃতাত্ত্বিক চর্চারও তিনি হয়ে উঠেছেন পথিকৃৎ। সম্ভবত তাঁর আগে কেউ বাংলা আসামের লোকসুরের এভাবে সঙ্গীত-নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেন নি। কলকাতা মহানগরীর বাণিজ্যিক সংস্কৃতির পরিম-লে লোকসঙ্গীতের বিকৃতি নিয়েও তিনি ছিলেন সোচ্চার। অসাধারণ পর্যবেক্ষণে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন কেন ঢাকা মহানগরীতে লোকসঙ্গীতের যে বিকৃতির সম্ভাবনা তুলনায় কম, তা কলকাতায় কেন এত সর্বগ্রাসী।
রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠক
জীবনের শেষ পর্বে কলকাতাবাসী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মূল পরিচয় ছিল একজন শিল্পীর। প্রকৃতপক্ষে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নামটি উচ্চারিত হলে পশ্চিমবঙ্গের গণনাট্য আন্দোলন বা প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে যে ছবিটি ভেসে ওঠে তার চেয়ে অনেক বড় পরিচয় তাঁর স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী সময়ের আসামের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে। তাঁর জীবনের দু’টি পর্ব, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গে তিনি ছিলেন মূলত কলকাতা শহর কেন্দ্রিক। এখানে তাঁর ভূমিকা মূলত একজন শিল্পী-স্রষ্টার। আসামে তাঁর ভূমিকা ছিল আরো বিস্তৃত প্রেক্ষাপট জুড়ে। সেখানে তিনি গণনাট্য আন্দোলন গড়ে তোলার এক মুখ্য কারিগর। আসামে গণনাট্য আন্দোলনের ভূমিকাও আরো বিস্তৃত ও গভীর। আসামের অসমীয়া ভাষা ও সংস্কৃতির আধুনিক যুগের গড়নটি নির্মিত হওয়ার সময়কালেই আসামে সমান্তরালে গড়ে উঠেছে গণনাট্যের সংগঠন। ফলে সেই সংক্রান্তিকালীন সময়ের অনেক যুগ-কর্তব্যই সমাধা হয়েছে গণনাট্য আন্দোলনের অঙ্গন থেকেও। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য, আসামের আধুনিক সাহিত্য সঙ্গীত নাট্য চলচ্চিত্রচর্চার যুগন্ধর পুরুষেরা অনেকেই সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন গণনাট্য আন্দোলনের সাথে। তাঁদের মধ্যে জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা, বিষ্ণু রাভা, নবকান্ত বরুয়া, ভূপেন হাজারিকা উল্লেখযোগ্য। বহুভাষিক আসামে সংখ্যার দিক থেকে প্রধান ভাষাগোষ্ঠী অসমীয়া ও বাঙালি। এ ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট ভাষাগোষ্ঠী। চা বাগান শ্রমিক, পূর্ববঙ্গাগত বাঙালি মুসলিম কৃষক সম্প্রদায়ও এর অন্তর্ভুক্ত। এই বহুভাষিক বহুজাতিক সামাজিক পরিম-লে বিভিন্ন ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগসূত্র গড়ে তোলে গণনাট্য আন্দোলন। এই কাজে হেমাঙ্গ বিশ্বাস ছিলেন প্রধান পুরোহিত। আসামের বহু অঞ্চল রয়েছে যেখানে কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রথম ভেরীটি বেজেছিল গণনাট্যের মাধ্যমেই। একজন কমিউনিস্ট সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবেই হেমাঙ্গ বিশ্বাস ঘুরে বেরিয়েছেন আসামের প্রান্তে প্রান্তরে, গ্রামে গঞ্জে, পাহাড়ে সমতলে। এভাবেই বিভিন্ন জাতি ও ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে গড়ে উঠেছিল গণনাট্য আন্দোলনের ভিত এবং এই জনগোষ্ঠীগুলির জাতীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ত্বরা সমবেত হয়েছেন গণনাট্যের পতাকাতলে। মনিপুরি নৃত্যশিল্পী গুরু কামিনী সিংহ, আসামের ঢোলের যাদুকর মঘাই ওঝা, ডিমাসা জাতীয় নেতা মনীন্দ্র বর্মন, খাসি শিল্পী জেছ প্রিটার সহ আসামের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ত্ব জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা, বিষ্ণু রাভা, প্রতিমা বরুয়া। সংগঠক হেমাঙ্গ বিশ্বাসের পাশাপাশি শিল্পীস্রষ্টা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গীতভুবনও পূর্ণাঙ্গতা পায় এই সময়পর্বেই।
১৯৬০ সালে যখন সারা আসামে অসমীয়া ও বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা দেখা দিয়েছিল, যখন আইন রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলিও কোনোভাবেই শান্তি আনতে পারছিলেন না, তখন পথে নেমেছিল হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নেতৃত্বে আসামের গণনাট্য। সঙ্গে ছিলেন ভূপেন হাজারিকা। উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রাজ্যের শিল্পীদের নিয়ে তাঁরা তৈরি করেছিলেন এক শান্তির অভিযাত্রীদল। এই ঐতিহাসিক শান্তিযাত্রাকে সামনে রেখে তৈরি হয়েছিল ‘হারাধন-রঙমন কথা’ গানটি। যৌথভাবে এই গানটি লিখেছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও ভূপেন হাজারিকা। হারাধন একজন বাঙালি কৃষক, রঙমন অসমীয়া কৃষক। হারাধন কথা বলে ভাটিয়ালি সুরে, রঙমন বিহুর সুরে ও ছন্দে। হারাধন কথা বলে বাংলায়, রঙমন কথা বলে অসমীয়া ভাষায়। দুজনেই কথা বলে নিজের ভাষায়, গান গায় নিজের লোকায়ত সুরে। দু’টি ভাষা ও সুর তৈরি করে দু’টি হৃদয়ের মধ্যে একটি অভিন্ন সাঙ্গীতিক সেতু। ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় সর্বস্ব হারানো হারাধনের পাশে দাঁড়ায় রঙমন। নিজেদের দুঃখের কথা শোনায় একে অপরকে। সবশেষে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের প্রত্যয়ে বিহু ও ভাটিয়ালির মিলনে তৈরি নতুন সুরে তাঁরা আবাহন জানায় আগামীর মিলন-বিহুকে। এই গানকে কন্ঠে নিয়ে সেদিন শিলং থেকে সদিয়া অবধি সংগঠিত হয়েছিল শান্তিযাত্রা। পুলিস মিলিটারি লাঠি বন্দুক যে শান্তি সেদিন আনতে পারেনি, আসামের গণনাট্য হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নেতৃত্বে সেদিন সেই অভাবনীয় কাজটি করেছিলেন। একের পর এক শহরে যখনি শান্তিযাত্রা প্রবেশ করেছে, অবিশ্বাসের বাতাবরণ কেটে গিয়েছে জাদুমন্ত্রের ছোঁয়ায় যেন। কাছাকাছি এসে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছে বিবদমান দুই ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ। এই শান্তিযাত্রার সংবাদ বিবরণী শুধু আসামের সংবাদপত্রেই নয়, পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘স্বাধীনতা’-তেও প্রকাশিত হয়েছে।
এ সময় ও হেমাঙ্গ বিশ্বাস
এখন এমন একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যখন প্রগতি শিবির এ রাজ্যে খানিকটা কোনঠাসা। এই সময়েই আবার গণনাট্য আন্দোলনের নানা উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ত্বের জন্মশতবর্ষ। অস্বীকার করার অবকাশ নেই, সাম্প্রতিক অতীতে এই রাজ্যে প্রতিবাদী সঙ্গীতের চর্চা কিছুটা অবহেলিতই ছিল। একটা সময় ছিল যখন রবীন্দ্রনাথের গানকেও পরিত্যাজ্য মনে হয়েছে কারো কারো, আবার সম্প্রতি দেখা গেছে কোনও কিছুতেই কারো আপত্তি থাকছে না। শীতকাল এলে সারা পশ্চিমবাংলায় বামপন্থীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উদ্যোগে যে অসংখ্য সাংস্কৃতিক মেলা উৎসব আয়োজিত হয়ে এসেছে এতটা বছর, সেখানে কোন বাছবিচার লক্ষ্য করা যায় নি। অথচ এই উৎসবগুলি বিকল্প সংস্কৃতির এক একটি মঞ্চ হয়ে উঠতে পারত। জনচিত্তজয়ী সংস্কৃতির পেছনে ধাবমান হয়ে পাশ্চাত্যের জঞ্জাল ও মুম্বাইয়ের বাণিজ্যিক বেনোজল ও কলকাতার আবর্জনার বাৎসরিক প্রদর্শনীতে শেষপর্যন্ত পরিণত হয়েছে এই উৎসবগুলি। এই উদাসীনতার ফল কী হয়েছে তা এখন চোখের সামনেই স্পষ্ট।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস চাইতেন গণনাট্য তার প্রথমযুগের আদলে বামপন্থী ও প্রগতিশীল শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের বৃহত্তর মঞ্চ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুক। কোনো একটি বিশেষ বামপন্থী দলের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হওয়া তাঁর কাছে বাঞ্ছনীয় মনে হয় নি। সিপিআই-এর নেতৃত্বাধীন গণনাট্যের সংগঠন সর্বভারতীয় ভিত্তিতে যখন আবার সংগঠিত হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল সিপিআই দলের সাথে তাঁর চরম মতাদর্শগত পার্থক্য সত্ত্বেও তিনি তাঁদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের গণনাট্যের মূলধারাও একই পথে হাঁটুক তিনি চাইতেন। সেটা অবশ্য হয় নি। সিপিআই(এম)-এর রাজনীতির সাথে তাঁর ছিল চরম আদর্শগত পার্থক্য। তবে সত্তরের দশকের শুরুতে রাজ্যব্যাপী স্বৈরতান্ত্রিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদেরকে যখন গণতান্ত্রিক লেখক-শিল্পী-কলাকুশলী সম্মিলনী নামের ব্যাপক মঞ্চ গঠন করার মধ্য দিয়ে সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তখন তিনি সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সম্মিলনীর সহ-সভাপতির পদ গ্রহণ করেছিলেন। নানা সময়ে নানা প্রশ্নে বামফ্রন্টের তীব্র সমালোচনা করলেও নির্বাচনী সংগ্রামে বামফ্রন্টেরই পাশেই দাঁড়িয়েছেন। তাঁর কাছে মনে হয়েছিল, ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে এলে ফ্যাসীবাদের পথ প্রশস্ত হবে। তাঁর জন্মশতবর্ষের প্রাক-মুহূর্তে পশ্চিমবাংলায় অবশ্য তাঁর উত্তরসূরী একাধিক সিপিআই(এম) বিরোধী বামপন্থী বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতিকর্মীরা সিপিআই(এম)-এর চেয়ে ইন্দিরার উত্তরসূরীকেই বেশি জনদরদী ভেবে একটি বিশেষ অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তারও ফলাফল চোখের সামনে। এর রাজনৈতিক মূল্যায়ন যাইহোক, পশ্চিমবাংলায় আবার অনেকবেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে গণনাট্যধর্মী প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক আন্দোলন। গণনাট্য সঙ্ঘে তিনি শেষদিন অবধি ছিলেন কি না, সেটা আজ আর বিচার্য নয়। হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও গণনাট্য আন্দোলন কখনোই আলাদা সত্তা ছিল না। তিনি সারাজীবন যা করেছেন তা মূলগতভাবে গণনাট্য আন্দোলনেরই কাজ। কোনো দলের রাজনৈতিক লাইনের সাথে তাঁর হয়ত মতপার্থক্য ছিল। তবু নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন গণসংস্কৃতির এক মহান রূপকার। পশ্চিমবাংলার বামপন্থী ভবিষ্যৎ হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে এড়িয়ে গিয়ে কখনোই রচিত হতে পারে না। সেজন্যেই বামপন্থার এই ঘোর দুর্দিনে হেমাঙ্গ বিশ্বাসই প্রকৃতার্থেই ‘পান্থজনের সখা’।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গুটি কয় গান শুনতে বোতাম টিপে দিনঃ
!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
(সৌজন্য: সৃষ্টির একুশ শতক, কলকাতা)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন