(বরাক কণ্ঠের জন্য)
সেই সময়ের সৃষ্ট এবং সেই সময়কে বদলে দেওয়ার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত একজন শিল্পী কালজয়ী হয়ে যাওয়ার নিদর্শন হচ্ছেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় হেমাঙ্গ বিশ্বাস। কিন্তু আমাদেরই এই সুরমা-বরাক উপত্যকার সন্তান শহিদ মাধব নাথের স্মৃতিতে গাওয়া হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান ‘আমরা তো ভুলি নাই শহিদ, সেকথা কি ভুলা যায়......” কি সত্যিই আমাদের এখনও আবেগতাড়িত করে? করে না, করার কথা নয় – কারুর কাছে এটা স্মৃতিমেদুরতা – কাররু কাছে বিশেষ করে নব্য প্রজন্মের কাছে যোগসূত্রহীন। সেজন্যই সম্ভবত আমাদের এই সুরমা-বরাক অঞ্চলের একজন মহান সংগ্রামী শিল্পীর জন্মশতবর্ষেও আমরা বেশ নির্লিপ্ত। এঅঞ্চলের বোদ্ধারা তাদের ঘরের এই মহান মানুষকে নিয়েও যে বিশেষ কোন চর্চা করার, তার জীবন ও সৃষ্টির ডকুমেন্টশন করার ব্যপারে কোন উৎসাহ দেখান না, তার রহস্য লুকিয়ে রয়েছে সম্ভবত শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস যে আবেগকে সাধারণীকৃত ও আধুনিক প্রগতিশীল মননে পরিশীলিত করতে পেরেছিলেন তা আজকের এই পরজীবী মনস্কতায় আচ্ছন্ন মধ্যশ্রেণির সাথে যোগসূত্র স্থাপনের আবেগ নয়, এটা এমন এক আবেগ যা জাগ্রত লোকায়ত আবেগকে সাধারণীকৃত করে এবং আধুনিক সমাজ দেখতে আগ্রহী মধ্যবিত্ত মনকেও তার গণ্ডির মধ্যে আকৃষ্ট করে নিতে সক্ষম হয়। তাই এই আবেগ ফিরে ফিরে ভেসে আসে প্রবহমান কালের স্রোতকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে এবং মানুষ এই আবেগ-স্নাত হয় যখন তার মনে জয়ের আকাঙ্খা, পরিবর্তনের আকাঙ্খা, নতুনের আকাঙ্খা সঞ্চারিত হয়। পরাজয়ের গ্লানি ও সামগ্রিক হতাশার বাতাবরণেও কালজয়ী আবেগ মানুষের মন জয় করে নিতে পারে, কিন্তু সে এক ভিন্ন ধরনের আবেগ, এক ভিন্ন শ্রেণির – ভিন্ন পরিস্থিতির আবেগ যেখানে আলস্য - কর্মবিমুখতা – অসন্তুষ্টি আধুনিক বুর্জোয়া মনকে গ্রাস করে নেয়। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে মানুষ আত্মসন্তুষ্ট, ন্যায়-অন্যায় ভেদ ভুলে সাফল্য – আয়েস – স্থবিরতাকেই জীবনের লক্ষ্য হিসেবে জ্ঞান করতে শিখে সেই বাস্তব পরিস্থিতিতে কালজয়ী সৃষ্টির আবেগ চোরাস্রোতে বয়ে চলে, মানুষের আবেগে ধরা দেয় না। কালকে আমরা যদি এরকম বাস্তব পরিস্থিতির গুণাবলি দিয়ে ভাগ করি তাহলে কালজয়ী সৃষ্টি আমরা তাকেই বলতে পারি যা সময়ের এক বিশেষ মূহূর্তে নতুন রূপে নতুন বার্তা নিয়ে ফিরে ফিরে আসে।
যারা শ্রমিক-শ্রেণির নেতৃত্বাধীন এক নতুন সভ্যতা গড়ার কল্পনা করেন, তারা রাষ্ট্র-উৎপাদন পদ্ধতি-বিনিময় মূল্যকে যেমনি অন্য বিকল্প দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার রূপরেখা তৈরি করার কথা ভাবেন, ঠিক তেমনি সভ্যতার অবিভাজ্য অঙ্গ কলা-সংস্কৃতি চর্চার বিকল্প রূপরেখা তৈরির দায়ও তাদের উপর বর্তায়। তাদের কাছে হেমাঙ্গ বিশ্বাস চর্চা ভীষণ জরুরি বিশেষ কর সেই যুগ-সময়ের সন্ধিক্ষণে যখন জয়ের আকাঙ্খা, পরিবর্তনের আকাঙ্খা, নতুনের আকাঙ্খা সঞ্চারিত করার সামাজিক শক্তির আবারও ঘুম থেকে জেগে ওঠার বার্তা আকাশে-বাতাসে ভেসে বেরায়। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মত সংগঠক-শিল্পীর সৃষ্টি আবার ফিরে আসবে, কিন্তু সচেতনভাবে ফিরিয়ে আনতে হবে নতুন রূপে, নতুন উপলব্ধিতে, নতুন সভ্যতার প্রয়োজনে। সেজন্যই হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কর্মকাণ্ড নিয়ে চর্চা এতো জরুরি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সলিল চৌধুরী-হেমাঙ্গ বিশ্বাস বিতর্ক নিয়ে কিছু কথা বলা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম শতবর্ষে তারা মিউজিক চ্যানেলে আজ সকালের আমন্ত্রণের অতিথি শিল্পী শুভ প্রসাদ নন্দী মজুমদারের অনুষ্ঠানে শুভেন্দু মাইতী বলেন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস যে অহং-বর্জিত একজন বড়মাপের মানুষ তার প্রমাণ মেলে সলিল চৌধুরীর সংস্কৃতি-সংক্রান্ত মতকে মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। দুটি ভিন্ন মতের বিতর্কে অন্যের মতের সাথে একমত হয়ে গেলে নিজের মত ত্যাগ করে তার মান্যতা দেওয়ার মধ্যে নিশ্চয়ই নিরহংকারী ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো সাধারণ মানুষের কাছের শিল্পীর এই তথ্য থেকে তাঁর নিরহংকারী ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া খুব জরুরি বিষয় নয়, যা আমাদের কাছে জানা বেশি জরুরি তা হল সেই বিতর্কের মোদ্দা কথা এবং সলিল চৌধুরীর মতকে মেনে নেওয়ার সঠিকতার বিষয়। এই বিতর্কের কোন লিখিত ডকুমেণ্ট পাঠের সুযোগ না হওয়া সত্বেও, বিভিন্ন আলোচনা থেকে এই বিতর্কের সারকথা বিধৃত করা যায়। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মত ছিল এই যে লোকায়ত জীবন থেকে রূপ-বিষয়কে নিয়ে গান রচনা করে লোকায়ত মানুষকে ভবিষ্যত সমাজের জন্য লড়াইয়ে উদ্দীপ্ত করা, অন্যদিকে সলিল চৌধুরীর মত ছিল আধুনিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আধুনিক বিষয়কে নতুন রচনায় লোকায়েতের সাথে সমন্বিত করতে হবে।
এক সঠিক মত থেকে শুরু করে বিতর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সলিল চোধুরীর মতকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস নতুন সমাজ গড়ার প্রাণশক্তি স্তিমিত হয় আসার সেই সময়ের অন্তর্বস্তুকে মেনে নিয়েছেন। সেজন্যই হেমাঙ্গ বিশ্বাসরা আসামের সমাজ জীবনে অন্তর্নিহিত উগ্রজাতিয়তাবাদী মূল্যবোধ ও উত্থানোন্মুখ উগ্রজাতিয়তাবাদকে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করতে পারেননি এবং সেই শক্তির কাছে প্রগতিশীল শক্তির পরাজয়কে অসহায়ের মত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এই বাস্তবস্তাকে এবার খানিকটা ব্যাখ্যা করা যাক।
যখন কোন সমাজ আন্দোলিত হয় - যখন সমাজের প্রগতিশীল শ্রেণি-বর্ণ তাদের পুরোনো অবস্থা পরিবর্তনে সচল হয়ে উঠে, তখন পুরোনো-প্রতিক্রিয়াশীল ও নতুন-প্রগতিশীল মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির সংঘাত সমাজের অভ্যন্তরেই চলমান সংগ্রামের রূপে দেখা দেয়। এই সংঘাতে নতুনের বিজয় ঘটবে কিনা বা যদি বিজয় ঘটে তাহলে পরিবর্তিত সমাজের সংস্কৃতি চর্চার রূপ কী হবে বা হওয়া উচিত তা কিন্তু নির্ধারিত হবে সেই সমাজের অভ্যন্তরেই এবং তা বহন করবে সেই গণ-সমাজই। শিল্পসংস্কৃতি-সংগঠক এবং শিল্পের স্রষ্টাও কিন্তু এই জেগে ওঠা সমাজেরই অঙ্গ। সুতরাং শিল্পীর সৃষ্টি মানুষের অবচেতনে থাকা নতুনের বার্তাকে বহন করবে গণ-সমাজের সচেতন হয়ে ওঠার সংগ্রামী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এ এক বিচিত্র পথে বহুমুখী আন্তঃক্রিয়া যেখানে বিভিন্ন মত-পথ শুধু নয়, পুরোনোকে ভাঙার রস আস্বাদনে উত্থিত বিভিন্ন শ্রেণি-বর্ণের মূল্যবোধেরও এক অন্ত ও আন্তঃক্রিয়া। সুতরাং প্রগতিশীল শিল্পী যদি আধুনিক বা নতুন অন্তর্বস্তু সংগ্রামের স্থান-কালের সীমার বাইরে থেকে বহন করে এনে লোকায়ত চর্চার সাথে জুড়ে দিতে চান তাহলে তা আপাত আধুনিক মনে হতে পারে, কিন্তু গণ-সমাজ তাদের সংগ্রামের বর্ষাফলক যার দিকে তাক করার কথা তাকে চিনতে ভুল করবে এবং ফলে এই সংগ্রামের মধ্য থেকে সৃষ্ট শিল্প-রচনাকেও তার জীবনের অঙ্গ করে নিতে বিফল হবে।
আসামের উদাহরণ এব্যাপারে আমাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিতে পারে। আসামে কৃষক অভ্যুত্থানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চীনের শ্রমিক-কৃষকের লড়াই থেকে, আমেরিকার শ্রমিকদের লড়াই থেকে দিন-বদলের কথা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সংযোজিত করা হল, কিন্তু আসামের এই সংগ্রামী কৃষকদের অবচেতনে থাকা উগ্রজাতিয়তাবাদ বিরোধিতাকে (লোকায়ত স্তরে থাকা উগ্রজাতিয়তাবাদী আবছা রূপের বিরোধিতা) কোন ভাষা দেওয়ার প্রচেষ্টা হল না, আমেরিকার গণসঙ্গীত ‘নিগারদের’ চিনল – কিন্তু এখানে চা-শ্রমিক ঝাড়খণ্ডী-আদিবাসীদের জীবন সংগ্রাম নিয়ে তেমন কোন রচনা হল না এবং ফলে গণ-সমাজকে তাদের সংগ্রামের সমস্ত অন্তর্বস্তুকে জলাঞ্জলি দিয়ে আশ্রয় নিতে হয় উগ্রজাতিয়তাবাদী শিবিরের কাছেই ।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসই তখনকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব যিনি সঠিক পথটি চিনতে পেরেছিলেন, কিন্তু এই পথে আরও বহুদূর অগ্রসর হয়ে সঠিক চিন্তাকে সম্প্রসারিত ও সার-সংকলিত করার বিপরীতে তখনকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল ধারার চিন্তায় প্রভাবিত হয়ে গিয়েছিলেন। সে সময়ের সংগ্রামী উত্তাপ এবং চোখের সামনে থাকা মডেলকে অনুসরণ করার আবহ সম্ভবত বিকল্প চিন্তার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়েছিল। এই রুদ্ধদ্বার আমাদের সামনে আজ নেই, অথচ শীতের ভোরে সংগ্রামের উত্তাপ নেওয়ার সূর্য বহুদূরে উঁকিঝুঁকি মারছে, তাই এখনই সময় নতুন করে – নতুন ভাবে দিন-বদলের গান বাঁধার উদ্যোগ নেওয়ার এবং সেই কাজটি সবচে ভাল হতে পারে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কর্মকাণ্ডের চর্চার মধ্য দিয়েই।
আসামের উদাহরণ এব্যাপারে আমাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিতে পারে। আসামে কৃষক অভ্যুত্থানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চীনের শ্রমিক-কৃষকের লড়াই থেকে, আমেরিকার শ্রমিকদের লড়াই থেকে দিন-বদলের কথা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সংযোজিত করা হল, কিন্তু আসামের এই সংগ্রামী কৃষকদের অবচেতনে থাকা উগ্রজাতিয়তাবাদ বিরোধিতাকে (লোকায়ত স্তরে থাকা উগ্রজাতিয়তাবাদী আবছা রূপের বিরোধিতা) কোন ভাষা দেওয়ার প্রচেষ্টা হল না, আমেরিকার গণসঙ্গীত ‘নিগারদের’ চিনল – কিন্তু এখানে চা-শ্রমিক ঝাড়খণ্ডী-আদিবাসীদের জীবন সংগ্রাম নিয়ে তেমন কোন রচনা হল না এবং ফলে গণ-সমাজকে তাদের সংগ্রামের সমস্ত অন্তর্বস্তুকে জলাঞ্জলি দিয়ে আশ্রয় নিতে হয় উগ্রজাতিয়তাবাদী শিবিরের কাছেই ।
হেমাঙ্গ বিশ্বাসই তখনকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব যিনি সঠিক পথটি চিনতে পেরেছিলেন, কিন্তু এই পথে আরও বহুদূর অগ্রসর হয়ে সঠিক চিন্তাকে সম্প্রসারিত ও সার-সংকলিত করার বিপরীতে তখনকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল ধারার চিন্তায় প্রভাবিত হয়ে গিয়েছিলেন। সে সময়ের সংগ্রামী উত্তাপ এবং চোখের সামনে থাকা মডেলকে অনুসরণ করার আবহ সম্ভবত বিকল্প চিন্তার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়েছিল। এই রুদ্ধদ্বার আমাদের সামনে আজ নেই, অথচ শীতের ভোরে সংগ্রামের উত্তাপ নেওয়ার সূর্য বহুদূরে উঁকিঝুঁকি মারছে, তাই এখনই সময় নতুন করে – নতুন ভাবে দিন-বদলের গান বাঁধার উদ্যোগ নেওয়ার এবং সেই কাজটি সবচে ভাল হতে পারে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কর্মকাণ্ডের চর্চার মধ্য দিয়েই।
১) হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কিছু গানের সংযোগ-1।
২) হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কিছু গানের সংযোগ-2।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন