“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১২

আমানত


কিছু আগাছার মধ্যে বড় হচ্ছে একটি বনফুলের গাছ। গত কদিন ধরে প্রতিদিন সকালে পরখ করে দেখি কবে ফুটবে বেগুনি ফুলের গোছা। বনফুলেরা একা ফোটে না। একসাথে একই বৃন্তে বেশ কিছু ফুল জানান দেয়, তারা ফুটেছে। অযত্নে হলেও তার রুপের জৌলুসে বনে আজ সুখ লেগেছে। অহংকারী হয়ে ওঠে বনরাজী আর ঝরা পাতার দল।

হেমন্ত সকালের শিশির লেগে আছে বনফুলেদের পাপড়িতে। মনে হয় সঙ্গম শেষে ঘামে ভিজে আছে ফুলের শরীর। সবসময় দেখেছি বন্যতায় প্রকৃতি রঙ ঢালে অকাতরে। বেগুনি, লাল, গাড়ো সবুজ, হলুদ। এই সব রঙের গভীরতায় আছে এক আদীম ভালোবাসার উচ্ছ্বাস। এই জগতের যাবতীয় রঙ ঠিক করে দেয় প্রকৃতি।

আমাদের ভালোবাসার রঙ লাল, মৃত্যুর রঙ সাদা বা শোকের রঙ কালো সব নির্দিষ্ট। আমাদের আমানত এই দুনিয়া। প্রকৃতির আমানত ঈশ্বর। ঈশ্বরের আমানত সৃষ্টি।
আজ সকালে চোখ খুলেই দেখলাম রক্ত মাংসের এক আমানত সাদা কাপড়ের ঢেকে পিস অব হেভেনে জিরিয়ে নিচ্ছে শেষবার। গত কদিন ধরে উশখুশ করছিল মনটা। তেরো দিন, তেরো রাত, তেরোটি সকাল আবার প্রমান করলো ব্ল্যাক ফ্রাইডের কথা।
শুক্রবার আমার প্রার্থনার দিন। তোমার নামাজ পড়ার দিন। ভাবিনি শেষরাতে অপেক্ষা করছে এমন একটা ভয়ানক ডেট লাইন।

আজ ঈশ্বর রোদ্দুর দিয়েছেন ঢেলে আমার উপত্যকায়। অনেকদিন পর রোদে পিঠ দিয়ে কমলা খাচ্ছে পাহাড়ি ছেলে উমন। গত একবছরে আরও একটু বড় হয়েছে ছেলেটি। এই কৈশোরের সন্ধিক্ষণে বাচ্চা গুলি একটা নিজস্ব জগৎ তৈরি করে নেয় মনে মনেই। আজকাল বেশ সুখ এসেছে ওদের ঘরে। মাথায় টিনের ছাদ, ঘরে রঙিন টেলিভিশন, সৌরবিদ্যুতের আলো সর্বক্ষণ জ্বলে ঘরে। অনেকরাত পর্যন্ত রিমোটে চ্যানেল চেঞ্জ হয়। দুমদাম পাল্টে যায় অন্ধকারের রঙ।
ফুলবতীর শরীরে বাড়তি লাবণ্য এসেছে। মুখে মধু আর কমলার খোসার রস মেখে, বসে থাকে সকাল সকাল রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে। এরপর কাঁচা দুধ মেখে জলপাইয়ের আচার খায়। শুনেছি শীত গেলেই আবার পোয়াতি হবে ফুলবতী। এবারও মেয়ে চাই তাদের।

ফুলবতীর স্বামী আজকাল আর মধ্যরাতে দেশী খেয়ে চিৎকার করেনা। চোখ লুকিয়ে চলে। মাঝে মধ্যে আঙ্গুলের ডগায় ধরে থাকে তুলো দেয়া সিগারেট। ধোঁয়ার রিং বাতাসে উড়িয়ে, আবার নিজেই এলোমেলো করে দেয়।

নেই শুধু ফুলবতীর মেয়েটা। শুনেছি, কাঁচুলিতে বেঁধে গত চৈত্রে গাছের মগডালে ঝুলিয়ে দিয়ে এসেছে মেয়েটাকে। অকালে মরেছে এই পাহাড়ের আমানত। বছর দুই ছিল বয়েস। গোলগাল মুখ, লাল খয়েরি চুল, কাঁচা হলুদ রঙের তুলতুলে শরীর, আমপাতায় তোলা কাজল টিপ কপালে। মিষ্টি হেসেই জানান দিত পাহাড়ের সুখ আর সকাল আহ্লাদী হয়েছে এবার।
ঈশ্বরের উদ্দেশ্যেই মেয়ের জান নিবেদন করেছে ফুলবতী! এরপর থেকে সংসারে সুখ এসেছে। ঈশ্বর মেয়েকে নিয়ে, তাদের করে গেছে দোয়া। তাই ফিরেছে দিন।

একটা গর্হিত কাজ আমি করেছি জানো! একটা দুই লাখের ড্রাফট গত তেরোদিন ধরে আমার কাছে। এটা ফুলবতীর নামে এসেছে।
সেদিন পোস্ট অফিসে গিয়েছিলাম তোমার কোন চিঠি এসেছে কিনা তার খোঁজ নিতে। আসার কথা ছিল কিছু বই পত্তরও। কিছুই পেলাম না। মন খারাপ করে বেড়িয়ে আসছি তখন পোস্টম্যানটা ডাক দিয়ে বললো,
- বাবু কিছু যদি মনে না করেন এই চিঠিটা দিয়ে দেবেন ফুলবতীরে! যা ঠাণ্ডা পাহাড়ে, তাইলে আর আমারে যাইতে হয়না এতদূরে...।

হাত বাড়িয়ে নিলাম খামটা। ফুলবতীর নামে চিঠি! একটু অবাকই হলাম। জানি আমাকেই পরে দিতে হবে। তাই খামটা খুললাম। খুলেই দেখি এই দুলাখের ড্রাফট আর সাথে একটা ছোট্ট চিরকুটে লেখা,
'তোমার মেয়ে ভালো আছে। সব টাকা দেয়া হয়ে গেল। ও এখন আমাদের আমানত। ভালো থেকো।'
কোন নাম বা ঠিকানা লেখা নেই।

ভাবছি জানো! ড্রাফটটা কাকে দেবো! ফুলবতীর হাতে না ঈশ্বরের জন্য লটকে দিয়ে আসবো ঐ পাহাড়ের কোন গাছের মগডালে! না ঐ পাহাড়ী নদীর বুকে ভাসিয়ে দেবো!
না রেখে দেবো আমানত করে আমার কাছেই!

কোন মন্তব্য নেই: