“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৪

চিরিকন্যা

                          

           (  রণবীর পুরকাস্থের এই গল্পটি পড়লাম 'আরম্ভ' পত্রিকার এবারের পুজো সংখ্যাতে। ভালো লাগল বলে তুলে দিলাম।::  সুব্রতা মজুমদার।)

      শব্দের উৎস কী করে জানবে দয়াময়ী । ধ্বনি দিয়ে যে শব্দ তৈরি হয় সে কী কোনো ভাষার । অতশত না জানলেও চলে । মাত্র তিন শব্দে উৎসব আসে বাংলায় । ধর্মীয় উৎসব নয় ঢ্যাম কুড়া কুড় । ঢ্যাম কুড়া কুড় ঋতুর উৎসব, শরৎ আসে বাংলায় । বাংলা মানে এক বিশাল দেশ , ভাষাভূমি । ধর্মব্যবসায়ী, ভাষাব্যবসায়ী আর নেতৃত্বলোভী কতিপয় মানুষ কীটের দংশন - ক্ষতে ছারে খারে যাওয়া নকশীকাঁথা নিয়ে দয়াময়ীর ভাবনা এখন । সন্ধ্যারতির ঢাক আর কাঁশর ঘণ্টার বাদ্যি তার ব্যাথাতুর চেতনায় এক সুখ ও আনন্দের অনুরণন তোলে । ভাবে এখন যদি দু এক ফোঁড় সূচিকর্মে জুড়ে যেত বাংলা নামে দেশ ।  ভেঙ্গে গেছে তো কী হয়েছে । সব ভাঙনেই রোধ করা যায় । শিখিয়েছে শিবলি । দয়াময়ী তার পনের বছরের পঙ্গুত্বের নিরাময় পেয়েছে শিবলির মনের জোরে । শিবলি বলেছে শুভচিন্তায় সব হয় । বলেছে মন  দিয়ে চাইলে কী না হয় !

        দয়াময়ী তার ভাষা বুঝে না । সে বলে আমি তোমার ছোটবোন, আদরের ছোটবোন শিবলি। শিবলি ? এ আবার কেমন নাম? শিবলি বলে,যেমন নাম দয়াময়ী তেমনি তার ছোটবোন শিবলি । শিবলি সব পারে। দয়াময়ী বলে, সব পারিস ? সে চোখ পাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, হুঁ । দয়াময়ী বলে, জুড়ে দিতে পারিস ঢাকা বরিশাল কলকাতা সিলেট ময়মনসিংহ । জুড়ে দিতে পারিস  তোর চিরি নদীর দেশ করলা নদীর দেশ আর ভাগিরথীর দেশ ? শিবলি বলে, পারি । এই দেখো না তোমার হাড়গুলো কেমন জুড়ে গেল ? শাজাহান ডাক্তার জুড়ে দিল । দয়াময়ী জানে এসব কথার কথা নয় । শিবলি সব পারে , সব ব্যাথার নিরাময় জানে। শরীরের ব্যাথা , মনের ব্যাথা সব উপশম জানা আছে তার ।  বলে,আমি ফুল দিয়ে দিই আরোগ্য । কোথা থেকে যে এত ফুল যোগাড় করে প্রতিদিন । দয়াময়ীর কোঁচড় ভরে দেয়। বলে, হাত পাতো । অঞ্জলি ভরে দেয় । দয়াময়ীর মুখের হাসি দেখে গায় একটুকরো রবীন্দ্রগান , হাসি দেখে যাবো দেশান্তর । সকালবেলা ফুল দিয়েই সারাকর্ম শিবলির । দয়াময়ীকেও মনে করিয়ে দেয় পুরনো সেই দিনের কথা । বলে, দিদি তুমি সব ভুলে গেছ । আমাদের বাড়িতে কত কত ফুল ! জুঁই চাপা কেতকী মালতী কাঁথামালি বকুল চন্দন । দয়াময়ী বলে, চন্দন আবার ফুল হল কী করে ? চন্দনের ফুল হয় না ? দেখো নি দিদি ? শিবলি বলে, রক্তচন্দনের লাল লাল বিচি দিয়ে মালা গেঁথে দিয়েছি , তুমি পরেছ । আমার অতিথিদের পরিয়ে দিয়েছ । আজও দেবে । দয়াময়ী অবাক । কে অথিতি , কোথা থেকে পাবে হরিচন্দনের ফল । শিবলি বলে, আজ মালা গেঁথেছি রঙ্গনের । আর অতিথি  ? আজকের অথিতি একজন রাজকুমারী । রাজনগরের রাজকুমারী । সে তো আমি ? ডাক্তার শাজাহান আমাকে ডাকেন । আমাদের পাড়ার নাম রাজনগর তাই । আমার বাড়িতে আমি অতিথি ? দয়াময়ীর বাড়ির উঠোনে প্রতিদিন ভোরে কেউ না কেউ আসেন অতিথি । রবিঠাকুর আর দুখুমিয়া আসেন ঘনঘন ঈশ্বর মধু বঙ্কিম জগদীশ সত্যজিৎ জীবনানন্দ মানিক তারাশঙ্কর বিভূতিভূষণ থেকে শামসুর রাহমান শক্তি চট্টোপাধ্যায় পর্যন্ত । দয়াময়ীকে কোলে করে এনে বসিয়ে দেয় শিবলি বারান্দায় । দয়াময়ী হাসতে হাসতে বলে, পুঁচকে মেয়ের গায়ে এত জোর ? শিবলি বলে, চোখ বন্ধ কর । বলে, চোখ খোল । পাড়ার ঘরে ঘরে তার অবারিত বাগান । ভোরের প্রথম মিষ্টি হাসি আর ফুলের অধিকার যে তার । দয়াময়ী আদর করে শিবলিকে বলে, মোহনদাস সুভাষচন্দ্র শেখমুজিব কিংবা বিধান বাবুদের কেন ডাকিস না তোর প্রভাতী বৈঠকে ? সে বলে, আমি যাদের চিনি না তাদের ডেকে এনে বিপদে পড়ব নাকি ? ইনি আমার দিদি দয়াময়ী বৈরাগী , একে চিনি ছোটবেলা থেকে । চোখ খুলে, উঠোনে তাকিয়ে দেখে দয়াময়ী অবাক । অবিকল, অবিকল তারই মুখ । এ কী করে হয় । ফুল দিয়ে কখনও কেউ কারো মুখ আঁকতে পেরেছে । দয়াময়ীর মুখের যন্ত্রণাও উধাও । শিবলি তার ভুবনভোলানো হাসি দিয়ে বলে ফুলসেবা । দয়াময়ী বলে, তা না হয় হলো , তা বলে বৈরাগী হলাম কী করে ? শিবলি বলে, শিবলি বৈরাগীর দিদি আর কী হবে ? তাও তো কথা , যন্ত্রণাহীন মুখের হাসি বিস্তৃত করে বলে , বিয়ে হলে পাল্টে যায় না ? জিভ কেটে শিবলি বলে, ঠিক ঠিক ঠিক । তোমার সেবা করতে করতে সব ভুল হয়ে যায় । দয়াময়ী বলে, তোর যে এই সেবা , পুষ্পথেরাপি , এতে সত্যি নিরাময় হয় ? হয়, শিবলি বলে, নিয্যস হয় । তবে ওষুধ খেতে হয় , হাড় জোড়ার মলম লাগাতে হয় । শাজাহান ডাক্তার বললে ছুরি কাঁচিও করতে হয় , এত সোজা নাকি ? নাগো দিদি , ভয় ধরিয়ে দিলাম এমনি এমনি । হাতুড়ি বাটালি তো কম করল না হাঁটুর উপর , ব্যাথা লাগল ? আমি কী করে বুঝব অসাড় করে দিল যে , এবার যাও তো রঙ্গনের মালাটা পরিয়ে দাও আমার দিদির গলায় । দয়াময়ী উশখুশ করে ওঠার জন্য । কী করে উঠবে পঙ্গু মানুষ । হাসি মুখে কষ্ট চলে আসার আগেই শিবলি বলে, দুক্‌খু দুক্‌খু দুক্‌খু । দয়াময়ী বলে দুক্‌খু কী রে ? শিবলি বলে, তোমরা যে বলো সরি । তোমাকে কিছুই করতে হবে না । আমাকে দাও দেখি । উঠোন ছেড়ে এসে জ্যান্ত দিদির গলায় পরিয়ে দেয় সে ফুলহার । বলে, মনে নেই ডাক্তারের আদেশ ? পাঁচদিন পর মহাষ্টমীর দিন যাবে কাটাকুটির বাঁধাবাঁধির দড়িদড়া কেটে দেবে তবে না হাঁটি হাঁটি পা পা ।

     শিবলি দয়াময়ীকে বলে, দিদি তোমার সব মনে আছে দেশের কথা ? কোন দেশ রে ? দয়াময়ীর কিছু মনে নেই । বারে , আমাদের দেশের বাড়ি মনে নেই তোমার , চিরি নদী ? আমি নদীতে বাঁশের চালি বেয়ে চলে যেতাম লক্ষীপুর । তুমি খুঁজে খুঁজে হন্য হতে । খুঁজে পেয়ে আমার নামই তো দিয়ে দিলে চিরি কন্যা ।  তাই ? নদীর আবার মেয়ে হয় নাকি ? তোমাকেও আমি ডাকতাম জিরি নদীর মেয়ে জিরি সূতা । না না । আমি আমার মায়ের মেয়ে । দয়াময়ীর এক এক সময় মনে হয় সব সত্যি । বলে, আসাম না ? না দিদি ফেইল , মনে করো ? দয়াময়ী আবার বলে, ত্রিপুরা ? শিবলি বলে, আসাম তবে ব্রহ্মপুত্র না । আমাদের জিরি চিরি জাটিঙ্গা ঘাঘরা মধুরা ধলেশ্বরী লঙ্গাই কুশিয়ারার দেশ । বরাক নদী গো , বরাকেরই এত ছানা পোনা ।

       কী জানি বাবা কী সব বলে মেয়েটা । কত কিছু জানে । এক নতুন দেশের কথা বলে, দয়াময়ী জানেই না দেশ কথা । বলে ছোটবেলায় নাকি নদীতে চান করেছে । ধুর পাগলি , দয়াময়ী কলকাতা ছেড়ে যায় নি কোথাও । নোনা চন্দন পুকুর গোবিন্দপল্লির পিতা সন্তোষ সাহার মেয়ে দয়াময়ী । তার আছে এক ভাই মনা । দয়াময়ী পোদ্দারের বাবার কাটা কাপড়ের ব্যবসা বড়বাজারে । স্বামী সমর পোদ্দার ছিল কাঠবেকার । হকারি করত ট্রেনে , প্রেমও করত । লারসেন কোম্পানিতে ঢুকে গেল কম্পূটার চালক হয়ে । দয়াময়ীর ছোটভাই মনোতোষ ভাবী জামাইবাবুর হয়ে মেশিন চালিয়ে এল , কিউ ডব্লিউ ইআর টি । দয়াময়ীও মুখ্যু সুখ্যু না , কম্পূটার না জানলেও টাইপ জানে , সেও দিয়ে আসতে পারত টেস্ট । পড়াশুনায় খারাপ ছিল না । বাংলায় ইতিহাস পড়েছে , ভূগোল পড়েছে , ফুল্লরার গীতি পড়েছে । পড়েনি সেই নতুন দেশের কথা শুনেনি কোথাও । শিবলির চিরিনদীর বরাকনদীর নাম শুনেনি কোথাও। দয়াময়ীর স্বামী সমর পোদ্দার সব শুনে তো থ । একমাত্র পুত্র অমর কুমার হলদিয়ার হোস্টেলে থাকে। সে এসে সব কিছু দেখে শুনে মাকে বলে,           সন্দেহজনক ?

       শিবলির দেশের মানুষ নাকি কথা বলে বাংলায় । আবার এমন বাংলা যে শুনলে বাংলা বলে বুঝার উপায় নেই । সে শিম কে বলে উরি , হিঞ্চেকে বলে হেলাইঞ্চা, ডাটাকে বলে ডেঙ্গা কুমড়ো কে বলে লাউ । মোচাকে বলে থোড় । সমর পোদ্দারের সহকর্মী বাসুদেবও সব শুনে অবাক । বলে, তাই আবার বলে নাকি ? সমর কুমার বলে , বলে বলে । বন্ধু বলে, তোকে গুল ঝেড়েছে । ওরকম কোন দেশ থাকলেও, তার ভাষা বাংলা নয় । স্রেফগুল । সমর কুমার ও উত্তেজিত । বলে, গুল নয় গুলঞ্চ। সত্যি তো আমরা আছি পশ্চিমবাংলায় এতকাল জানি না । ভারতের প্রত্যেক প্রদেশেই আছে দুএক মহল্লা বাঙালি । চিত্তরঞ্জন পার্ক আছে বাঙালি টোলা আছে , কটকে আছে ঘাটশিলায় আছে ভাগলপুরে আছে রায়পুরে আছে । সমর বলে, একটা নদী উপত্যকা । বাসুদেব বলে, এইতো বেরিয়েছে , এবার বল নদীর নাম ? সমর কুমার মাথা চুলকোয় । বলে, বলল তো কী একটা , নদী না পাহাড় কে জানে । বলেছে, বড়াইল । বাসুদেব মাথা নাড়ে , উঁহু ওরকম শুনিনি । সমর কুমার বলে, নারে আছে । বন্ধু বলে, কী আছে ? সমর মনে করে , ঐ নদীর একটা অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ আছে । নদীর নাম কিছুতেই মনে পড়ছে না । বাসুদেব বলে, বাদ দে , তুই সব ভুলভাল বকিস । মেয়েটার নাম মনে আছে ? মেঘনা যমুনা না জিয়া ভরলি ? সমর কুমারের মনে পড়ে নাম । বলে, হাড়মুড়মুড়ি । বাসুদেব রাগে , বলে, ধুশ্‌  শালা, সব আষাঢ়ে কেস , যা ফুট !

        সেদিন মহালয়া । ডাক্তার শাজাহান বললেন , রাজনগরের রাজকুমারীকে আমি হাঁটিয়ে ছাড়ব । বিশ্বাস হয়নি দয়াময়ীর সমরকুমারের , পনের বছর ধরে তো কম ডাক্তার বদ্যি হয় নি । শাজাহান কিন্তু নাছোড়বান্দা । বললেন , হাঁটিয়ে ছাড়ব । বলেই হয়ে গেল অপারেশন । দয়াময়ী কত না করল । বলল , আমার ছেলে আসুক হলদিয়া থেকে । পূজোটা কাটাক আনন্দে , তারপর তো ? ডাক্তারবাবুও রাজি কোত্থেকে কী ; চিনি না জানি না আমি তোমার আতিথি , ডাক্তারের পাশে দাঁড়িয়ে মিট মিটিয়ে হাসে বহির্বিভাগের রোগীনি মেয়েটি । এইটুকুনি তো মেয়ে , কত আর হবে , বছর কুড়ি । বিয়ের চিহ্ন নেই হাতে মাথায় , আবার লালপেড়ে শাড়ি পড়ে আছে যেন কলাবউ । বলে, চল দিদি আমরা দুজনে পাশাপাশির  বেডে থাকব । আমার তো অপারেশন হবে না , তোমাকে দেখব । ডাক্তারবাবু আজই করে দিন ভর্তি । ডাক্তার বলেন, আজই কাটব । দয়াময়ী বলে, নানা কী কাটবেন? ডাক্তার বলার আগে মেয়েটি বলে, ভয় গো দিদি তোমার ভয় কাটাতে হবে না ? সমরকুমার ও কেমন সম্মোহিত হয়ে গেল, পুঁচকে মেয়েটার কথায় মাথা নাড়ল ।

       অপারেশন বললেই কী অপারেশন , তার কত প্রস্তুতি । খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল । ছুরি কাচি হাতুড়ি সব সেদ্ধ হল । দুপুরবেলা ডাক্তার শাজাহান বললেন, রেডি । হাঁটুর উপর কত কাটাকুটি কত কেরামতি । শুধু পা ঝুলিয়ে রাখার জন্য টিবিয়া ফুটো করে লোহার শলা ঢুকিয়ে দেওয়া হল । সমরকুমার বেডের পাশে থাকতে পারে না , বারান্দায় দাঁড়িয়ে যন্ত্রণায় কেঁদেই ফেলে ।

        কী জানি কী ছিল সমরের মনে । আনন্দ ও হতে পারে , খুশির অশ্রু । দয়াময়ী পনের বছর বিছানায় । কত ডাক্তার দেখিয়েছে তন্ত্রমন্ত্র করিয়েছে জলপড়া তেল পড়া কিছুই বাদ দেয় নি , কত ঠাকুর বাড়িতে হত্যে দিয়েছে সমর । কী কষ্টে তারকেশ্বরে দণ্ডি কেটেছে দয়াময়ী । হিমেন্দু ঘোষ এর মতো বড় ডাক্তার পর্যন্ত প্রেসক্রিপশন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে । বলেছে, ভগবানের বাপ এলেও কিছু করতে পারবে না । একা একা কেঁদেছে দয়াময়ী । সমরকুমার ও লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে বারান্দায় । ছেলের জন্মের তিন বছর পর শুরু হয় হাড়ের রোগ । হাঁটতে পারে না হাত নাড়তে পারে না । সকালে চান করিয়ে খাইয়ে যায় সমর , অফিস থেকে ফিরে আবার চা জলখাবার একসাথে । আর ছেলে, তাকেও ফেরার সময় নিয়ে আসে শ্বশুরবাড়ি থেকে । ছুটির দিন যায় মধ্যগ্রামের বাদুতে তেলসন্যাসীর তেল নিয়ে আসে , যায় রানাঘাটের জাগ্রত তুলসীমন্দিরে , খাজাবাবার দরবারে যায় দোয়া নিতে । তেলসন্যাসীর তেল লাগিয়ে দিতে যেন চমৎকার হয় । দয়াময়ী বলে, ব্যাথা কমেছে । খুশিতে সমরকুমার বলে এবার একটা ধুমধাম পার্টি লাগিয়ে দিই । কেন ? দয়াময়ী তো স্বামীকে খুশি করতে বলল কথা । সমরকুমার বলে, এবার একটা মহা বিস্ফোরণ হবে আমাদের বিবাহ বার্ষিকীতে । কুড়ি বছরের বিয়ে পার্টির জন্য অফিসের বন্ধুদের বলে এলো ভালো গিফট নিয়ে যেতে । বন্ধু বাসুদেবকে বলল, দয়াময়ীর মনটা ভাল রাখতে চাইরে । খুব ফুর্তি করবি কিন্তু । ফুর্তির মধ্যেই একজোড়া বন্ধু বলল , তুই আরেকটা বিয়ে করে ফেল বন্ধু । করুণার দৃষ্টিতে সমরকুমার তাকিয়ে ছিল বন্ধু দম্পতির দিকে । পরের বছর বিবাহবার্ষিকীতে আর পার্টি টার্টি নয় , দয়াময়ীকে নিয়ে চলে গেল পুরী হোটেলের সাগরমুখী ঘরে । এর পরের বার দার্জিলিং হলিডে হোম এ ।

        বাসুদেব থাকে ঠাকুর পুকুর । বলল, একবার যা না বড়কাছাড়ি , মানত বিফলে যায় না রে । যে যা বলে করে করে ক্লান্ত সমরকুমার প্রিয় বন্ধুর উপর রাগে । বলে, আর যাব না কোথাও , দয়াময়ীরও আর বিশ্বাস নেই । অলৌকিক কিছু হবে না । মহালয়ার আগের দিন একটি মেয়ে সমর কুমার কে বলে, এত সহজে হাল ছাড়লে হবে ? চলে আসুন কাল সকালে শিবতলার মোড়ে , শেখ শাজাহান ডাক্তারের কথা বললেই পৌঁছে দেবে ট্যাক্সিওলা । অফিসের ফোন থেকে কথা বলে সমর , বুঝতে পারে না ওপারে কে আছে । বলে, আপনি কে ? মেয়েটির কথায় রহস্যের আভাস । বলে, এলেই জানতে পারবেন । আমার নাম হাড়মুড়মুড়ি । সমরকুমারের সঙ্গে ইয়ার্কি । টেলিফোন কেটে দেয় । নিজের চেয়ারে বসে কম্পূটারের দিকে তাকিয়ে থাকে শূন্যদৃষ্টিতে । ভাবে মেয়েটি কে । ওর সঙ্গে কেন রসিকতা করবে । সমরকুমার তো এখন আর কোন ঝাড়ফুঁক কেরামতির ধারে কাছে যায় না , ডাক্তার বৈদ্যের কাছেও তার কোন প্রত্যাশা নেই । তবে টেলিফোনের ডাকটায় এক অপ্রতিরোধ্য বিশ্বাসের সত্য অস্বীকার করতে পারে না সমরকুমার । মহালয়ার ছুটির দিন দয়াময়ীকে ট্যাক্সিতে শুইয়ে নিয়ে যায় শহরের বাইরে বৈদ্যবাটি শিবতলায় । গাছপালা পুকুর আর ধানখেত ঘেরা গ্রামের বাড়ি , ওটাই হাসপাতাল , নিরাময় আশ্রম । সমরকুমারের ট্যাক্সি গাড়ি বারান্দায় ঢুকতেই শুনতে পায় পরিচিত কণ্ঠস্বরের সোল্লাস চিৎকার , এসে গেছে এসে গেছে । সেই মেয়েটি । লালপেড়ে শাড়ির এক যুবতি এসে পরম মমতায় দয়াময়ীকে নামিয়ে নেয় গাড়ি থেকে । বলে, এসো দিদিভাই । কে দিদিভাই, যন্ত্রণাহীন দৃষ্টিতে মেয়েটির হাসি মুখে তাকিয়ে দয়াময়ীও হেসে ফেলে । বলে, এসে গেলাম । জানতাম । কী করে ? কেন জামাইবাবু বলে নি ? না । তবে থাক ।                                                           

      থাকল কথা । দয়াময়ী কচিমুখের মেয়েটিকে হাসপাতালে দেখে নিজের দুঃখ ভুলে যায় । বলে, তোমার কী অসুখ ? দিদিভাই সব ভুলে গেলে ? তুমি করে বলছ কেন ? আচ্ছা আচ্ছা কী অসুখ ? দিব্যি তো হাঁটা চলা চলছে । আমাকে হেঁটে চলেই বেড়াতে হবে সর্বক্ষণ , থামলে চলবে না । ধেৎ , কী অলুক্ষুণে কথা  । হ্যাঁ গো সত্যি আমার যে হাড়মুড়মুড়ি । তাই ?

      দয়াময়ীকে সবাই বোকা ভাবে । ভাবে সাহাবাড়ির মেয়ে বলে কিছুই জানে না । দয়াময়ীরও ছেলেবেলা কেটেছে ঠাকুরমার ঝুলি পড়ে রাক্ষস খোক্কস , লালকমল নীলকমল পড়ে । বাংলা ভাষার রূপকথা উপকথার গল্প সেও শুনিয়েছে ছেলেকে । হাড়মুড়মুড়ির গল্প সেও জানে । লালপেড়ে মেয়েটি দিদির মেঘলা মুখ দেখে ফিক করে হাসে । বলে, সত্যি গো দিদি , হাড় ভেঙ্গে যাচ্ছে থেমে থাকলে । তাই দৌড়ই শুধু । শাজাহান ডাক্তার তো যায় আমাদের দেশে , বলেছে, শিবলিকে এবার বসিয়ে রাখবে । যেমন তোমাকে বলল হাঁটিয়ে ছাড়বে । এতো ডাক্তার নয় গো , রূপকথার সোনার কাঠি । ছুঁয়ে দিলেই নিরাময় । তোমার কোন চিন্তা নেই , ডাক্তারের  সঙ্গে  কথা হয়ে গেছে ভর্তি হব এক সঙ্গে বাড়ি যাব এক সঙ্গে ফিরে আসব আবার এক সঙ্গে । দয়াময়ী মেয়েটির আবোল তাবোল বুঝতে পারে না । তবে সমরকুমার বুঝে , ডাক্তারবাবুও সব জানেন । বলেন, নিয়ে যেও বাড়ি । আমার এখানে অস্ত্রোপচার করালে শিবলি ফ্রি ।

       জাদুও নয় মন্ত্রও নয় । অপারেশন করে ডাক্তার চলে যান বাড়ি । সেবিকাদের বলে যান কী করতে হবে , শিবলির দিকে তাকিয়ে হাসেন । সোনার কাঠি চলে যেতেই দয়াময়ীর হাঁটুতে বাঁধা সাদা গজ লাল হয় , গলগলিয়ে রক্ত বেরোয় । নার্স আসে অন্য ডাক্তার আসে । কিছুতেই কিছু হয় না । শিবলি তার ব্যাগ খুলে বের করে ফণীমনসার ডাঁটার মতো কিছু সবুজ জড়ি , নার্সের কাছ থেকে চেয়ে নেয় গজ , দুফালি করে জড় কাটে রস বেরোয় সাদাসাদা । দয়াময়ীর হাঁটুর কাটায় বেড়া দেওয়ার মতো দেয় আধফালি জড়ি , বাঁধে যত্ন করে । মহালয়ার দুদিন পর ঘা শুকিয়ে খট খটে । ডাক্তার বলেন, যাও রাজকুমারী ফ্রি । পূজোর মধ্যে যে কোন দিন এলে সব খুলে দেব , হাঁটিয়ে দেব । এবার বাড়ি গিয়ে ঠিক করো কার বাড়িতে প্রথম যাবে পায়ে হেঁটে । দয়াময়ী বলে, আপনার সামনে হাঁটব প্রণাম করব । শিবলিকে নেবে তো ? ওরও ছুটি কদিন । তোমার চেক –আপের সময় ফিরিয়ে দিয়ে যেও । ওর কেউ নেই এই শহরে ।

      লক্ষীপূজোর পর শাজাহান ডাক্তারের সামনে হেঁটে বেড়ালো দয়াময়ী । টুক করে একটা প্রণাম ও সেরে নিল । দয়াময়ী শিবলিকে খুঁজে । সমরকুমারও খুঁজে । শেষ পর্যন্ত শজাহান ডাক্তারকে বলে । ডাক্তার তো হতভম্ব । কে শিবলি ? কাকে খুঁজছে রাজকুমারী । দয়াময়ী বলে, আমার বোন শিবলি । আমার সঙ্গে সঙ্গে ছিল । তোমার সঙ্গে তোমার স্বামী ছিল সর্বক্ষণ । অমানুষিক পরিশ্রম করেছে । সমরকুমার বলে , এইবার মনে পড়েছে নদীর নাম । বরাক নদীর পারে ওর দেশ । দয়াময়ী বলে, চিরি নদীর পারে আমাদের বাড়ি । আমি জিরিকন্যা ও চিরিসূতা । দয়াময়ী সুস্থ হয়েও হয় না । বসে পড়ে মাটিতে । আর ওঠে না । আর হাঁটে না । আগের মতো বিছানায় শুয়ে থাকে । সমরকুমার ভাবে এ কী হল হিতে বিপরীত । তাহলে কী হিমেন্দু বিশ্বাসের কথাই সত্য । ভগবানেরও সাধ্য নেই ঠিক করার । সমরকুমার বন্ধু বাসুদেবের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে । বলে, চলে যাই বড়াইল পাহাড়ের দেশে ? বন্ধু বলে, হরগিজ না । ওসব গুল , তোদের মনের ভ্রম । আমি খবর নিয়ে দেখেছি শিবতলা বলে কোন জায়গাই নেই কলকাতার আশে পাশে । শেখ শাজাহান  বলে কোন ডাক্তারও নেই । কিন্তু শিবলি আছে । শিবলি ওকে তিলে তিলে সুস্থ করে তুলেছে , আমই দেখেছি । ভ্রম ভ্রম, তুই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিস । কিন্তু দয়াময়ী ? ওর এতো মনের জোর । ওকে আমি হাঁটতে দেখেছি । ওকে একবার নিয়ে যাই চিরিনদীর পারে । যদি ওখানে শিবলি থাকে । বাসুদেব বলে, ঠিক আছে রুবি একবার যাক তোদের বাড়ি । কথা বলতে তো আপত্তি নেই । মেয়েরা মেয়েদের মন বুঝতে পারে ।

       বাসুদেবের স্ত্রী রুবির কথায় কাজ হয় । একটু নড়াচড়া করে দয়াময়ী । বলে, ডাক্তারবাবুও বলেছেন ও মেয়ে জাদু জানে । রুবি বলে, ঠিক তাই , ও তোকে জাদু করেছে দয়াময়ী । ও মেয়ে ডাইনি । দয়াময়ীও রুবির কথায় সায় দেয় । বলে  অও তাই বলে জানিস ? রুবি জানতে চায় কী বলে । বলে ওর দেশ ডাইনে তাইও ডাইনি । ওর দিক নির্দেশের সহজ  উপায় হলো উপর দিকে উত্তর ডান দিকে পূর্ব বাঁয়ে পশ্চিম । ও ডাইন দেশের মেয়ে । ওরা তো ডান দিককে ডাইন দিক বলে । রুবি বলে , সে আবার কোন দেশ ? দয়াময়ীর চোখে  তখন ঘোর । বলে, আছে আছে একটি দেশ , মস্তবড়ো পাহাড় ঘেরা । পাহাড়ের নাম বরাক । ওদের দেশে পঁহুচিতে আটত্রিশটা সুড়ঙ্গ পেরিয়ে যেতে হয় । মাহুর লাংটিং মাইবং দামছড়া ডিটকছড়া আরো কত । রুবি অবিশ্বাসে শুনে । বলে, কী করে যায় ? হেঁটে ? না ট্রেনে ? কী ট্রেন ? দয়াময়ীর মাথায় যন্ত্রণা হয় । বলে,  সে তো জানি না । আবার প্রশ্ন রুবির , শিয়ালদা হাওড়া না কলকাতা ? দয়াময়ীর চোখে মুখে শ্রান্তি । ক্লান্ত স্বরে বলে, হবে কোন একটা । যাস নি উঠিয়ে দিতে  ? না , কখন যে চলে গেল হাসপাতাল থেকে জানতেই পারি নি । পাগলি তো , লক্ষীপূজোর  বাজার করবে বলে বেরোল আর ধা । কথা বলে বলে আমাকে পাগল করে দিয়েছে কদিনে । বলে, ওদের দেশ নাকি খুব বিখ্যাত । বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত ওর পাশের বাড়িতে থাকতেন । পৃথিবীর প্রথম ফুটবল খেলা ওদের দেশেই শুরু হয় । সে তো বিদেশ রে, কী মিথ্যাবাদী মেয়েটা । না ও মিথ্যে কথা বলে না । আমাদেরই দেশের মেয়ে শিবলি , ওই যে ঘোড়ার ফুটবল না কী একটা বলেছিল । আমি কী অতশত জানি । তবে বিদেশ নয় , বাংলা ও বাংলায় কথা বলে । আমি জানি আসামী ভাষা, ভূপেন হাজারিকা কথা বলতেন । না হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ভাষা , শ্রী চৈতন্যের বাপের ভাষা , বিপিন চন্দ্র পালের মাতৃভাষা , আলি সাহেবের ভাষা । এত অবিশ্বাস ভাল নয় রুবি । সামনের পূজোয় ও আবার আসবে , তখন নিয়ে যাব তোদের বাড়ি । আর আসবে না । শরৎ এলেই আসবে আবার । জানিস ওদের দেশে শরতে কাশফুল ফুটে, অনেক শিউলি । কোঁচড় ভরে শিউলি দিয়ে আমাকে ডেকে আনে উঠোনে । বলে ওর ফুল সেবায় আমি সুস্থ হয়ে উঠব । শুনেছি তোর পুষ্প থেরাপির কথা । সব ঢপ । আমার তো মনে হয় সমরদার সঙ্গে কোন কেস আছে মেয়েটার । আছে তো ? সমরটা জানিস রাগে না । বলে ওদের অনেক কালের চেনা জানা । যমুনার কূলে প্রথম দেখা । কোথায় যমুনা আর কোথায় বড়াইল নদী ? তুই বিশ্বাস করিস পুরুষমানুষকে ?  কী আর করব মুচকি মুচকি হাসে যে ? কিন্তু একটা খটকা থেকেই গেল রে দয়া , তোর আর ওর হাসপাতালে ভর্তি পাশাপাশি বেডে একদিনে হয় কী করে ? হয় হয় ।

        হয় বলেই বিহ্বল হয় দয়াময়ী । মেয়টাকে বিশ্বাস করে সে । দয়াময়ী জানে চিরিনদীর পারে ওদের একটা বাড়ি আছে । সেই বাড়িতে থাকে শিবলি বৈরাগী , ওর ছোটবোন । রুবিকে ঘরের ভিতর বসিয়ে রেখে বারান্দার চেয়ারে গিয়ে বসে দয়াময়ী । আপন মনে একা একা বলে , একটাও পার্থিব অভিজ্ঞান রেখে গেল না মেয়েটা ।

  

কোন মন্তব্য নেই: