।। প্রলয় নাগ।।
(C)Image:ছবি |
কিছুদিন পরে বাপ মরল সাপের কামড়ে। বাপ মারা
যেতেই সৎমা চার বছরের কাকতাড়ুয়া ফেলে এক পিয়াজের ব্যাপারীর সঙ্গে হাঙ্গা করে চলে আসে
ধুবড়িতে। সেইদিন ফেলে আসা শণের ঘরে কাকতাড়ুয়া বসে খুব কাঁদছিল, কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর কতজনের
কতকি- মুড়ি, চালভাজা, ভাতের ফ্যান, বাসিপান্তা খেয়ে খেয়ে বড় হয়ে গেল। লোকের ধান
গম বেগুন ক্ষেতে তেলের টিন বাজিয়ে বাজিয়ে কাকপক্ষী তাড়াতে তাড়াতে নাম হয়ে গেল কাকতাড়ুয়া। এখন নিউ জলপাইগুড়ি – নিউ বঙ্গাইগাও লোকালে মুড়ি চানা বিক্রি করে। আর মাঝে মাঝে কুষানযাত্রার পালাতে বাঁশের বাঁশি বাজায়। মাসে এক-আধ বার বাড়ি আসলে আসে, আর না হলে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের পাশে বস্তিতে এক বিধবার সাথে রাতে থেকে যায়।
কাকতাড়ুয়ার মনে আসে তার পুরনো দিন গুলির কথা। হকার বন্ধুদের
কাছে আক্ষেপ করে –‘ইস এখন যদি পাইতাম।’ ট্রেনে চলতে
অনেক মেয়েকেই সে দেখে। সব মেয়েকে তার বোন-মা বলে মনে
হয় না। অনেককে দেখে চোখের সামনে তার অতীত জীবনটি ভেসে ওঠে। তখন সে মুড়ির
বাক্স নামিয়ে দরজা রেলিংয়ে ধরে বুকের বোতাম খুলে দিয়ে বাতাস লাগিয়ে শরীর ঠাণ্ডা করে।
সব কথা তার মনেও নেই। তার চেয়ে বয়সে বড় ধাড়ি ধাড়ি মেয়ে গুলো তাকে ডেকে নিয়ে
যেত পাট ক্ষেতে বা নদীর চরে গরু চরাতে। তারা নির্দ্বিধায় জামা খুলে ফেলত তার সমানে। বলত- ‘সুড়সুড়ি দে।’ ওসব তখন সে কিছু বুজত না, ভাবতো এও বুঝি রান্নাবাটির মতো কোন খেলা।
একসময় ধীরে ধীরে কাকতাড়ুয়া সব বুঝতে
শেখে। এখন আর তাকে কেও ডেকে নিয়ে যায় না শীতের সকালে টিন বাজিয়ে কাক তাড়াতে। ফ্রক পড়া
মেয়েদের ডাকলেও আর তার কাছে আসে না।
কাকতাড়ুয়া জানে না প্রেম কী ? সে শুধু এই খেলাটাই জানত। তার বিশ্বাস হয়ে গেছে প্রেম মানে ছোট বেলায় শেখা এই খেলাটাই। অনেক খেলেছে
ও, অনেককে দেখেছে এই খেলা খেলতে। তার মাকেও
দেখেছে বাবা বাড়িতে না থাকলে মদনের সাথে এই খেলা খেলছে। হিরুয়াকে
দেখেছে তার বৌ থাকা সত্ত্বেও ধান ক্ষেতে নিখিলার বৌয়ের সাথে ওই খেলা খেলছে।
কাকতাড়ুয়ার মনে কি হয় না হয় সে বলতে
পারে না গুছিয়ে। একদিন এক বিকেলে পাশের বাড়ির লক্ষ্মীকে সে বলেছিল – ‘তুই আমার লগে পেম করবি?’ লক্ষী চিৎকার করে
তার মাকে বলে দেয়। কাকতাড়ুয়ার কপালে জোটে ঝাঁটা জুতা। তার পর থেকে সে ভয়ে কাওকে কিছু বলে
না। এর কিছুদিন পড়ে লক্ষ্মী ভরা পুকুরে পা পিছলে পরে গিয়ে ডুবে মরছিল। কাকতাড়ুয়া
জল খেতে খেতে বাঁচিয়েছে। তারপর থেকে লক্ষ্মী-কাকতাড়ুয়ার
একটা ভাব জমে উঠেছিল। এসব দেখতে পেয়ে কম বয়সী মেয়েটাকে জোড়
করেই বিয়ে দিয়ে দেয় লক্ষ্মীর বাপ মা। কাকতাড়ুয়ার মন খারাপ। কিছুদিন কোথায়
চলে গেছিল কেউ জানে না। কিছু দিন পরে আবার ফিরে এলো গ্রামে ।
কাকতাড়ুয়াকে যারা প্রেম শিখিয়েছে
তাদের সকলেরই বিয়ে হয়ে গেছে। কারো তো দু’তিনটে ছাওয়া পুয়াও হয়ে গেছে। তাদের সাথে
হঠাৎ দেখা হলে কাকতাড়ুয়া হাসি হাসি মুখ করলেও তারা যেন চেনেই না কাকতাড়ুয়াকে এমন ভান। কাকতাড়ুয়ার
মনে প্রথম প্রথম একটু কষ্ট লাগলেও পরে সব সয়ে
গেছে।
কাকতাড়ুয়ার জীবনে একবার প্রেম এসেছিল
তখন সে উনিশ কি কুড়ি হবে। চড়া রোদে
ধান বাঁধতে বাঁধতে ক্লান্ত হয়ে ক্ষেতের পাশে বননাইল্যা গাছের নিচে বসে বিশ্রাম করছে। পাশে সুটকার জোয়ান বিধবা বৌ-টাও এসে বসল। জল খাওয়াল কাকতাড়ুয়াকে। তেষ্টায় কাতর কাকতাড়ুয়ার মনে হল এমন আদর করে কেউ কোন
দিন তাকে জল খাওয়ায়নি।
কাকতাড়ুয়ারও মনে হয় পছন্দ হয়েছিল বৌ-টাকে। তা না হলে সে দিন সন্ধ্যা বেলা গিয়ে হাজির হলই বা কেন তার বাড়িতে। তারপর রোজ
রোজ সন্ধ্যা হলেই কাকতাড়ুয়ার আর দেখা পাওয়া না। গল্পগুজব
হাসিঠাট্টা রমরমা চলছে। এরই মধ্যে দু’জনে একদিন নীলকুঠির মাঠে জ্যোতি
বসুর জনসভাও করে এসেছে।
এর কিছুদিন পর কাকতাড়ুয়া ধরা পড়ল খড়ের গাদায় জোয়ান বৌটার সাথে। পাড়াপড়শিরা
মারধোর করে কাকতাড়ুয়ার নাক মুখ ফাটিয়ে গ্রাম
ছাড়া করল। দু’দিন পরে বৌটিও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। এ ঘটনার পর
থেকে কাকতাড়ুয়ার গ্রামের প্রতি টান চলে গেছে। আসলে আসে,
না এলে বিধবা বৌটির সঙ্গে পড়ে থাকে স্টেশনের বস্তিতে। আর জ্যোৎস্না রাতে বাঁশি বাজায়, গলা ছেড়ে গান ধরে –
‘সাধের জনম মাটি হইয়া গেল রে
প্রেম কইরাছি অবুজ বয়সে
প্রেম কারে কয় বুঝি নাই রে
সাধের জনম মাটি হইয়া গেল রে।’
~~~~~~~~~০০০~~~~~~~~~~~~~
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন