(অধ্যাপক তপোধীর
ভট্টাচার্য, মিথিলেশ ভট্টাচার্য এবং রণবীর পুরকায়স্থ সম্পাদিত 'অনিশ' এবং
'শতক্রতু'র শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী স্মরণে বিশেষ সংখ্যাতে লেখাটির প্রথমাংশ প্রকাশিত। লেখটির দ্বিতীয়াংশেরই ছিল যা কিছু সাহিত্যের জন্যে প্রাসঙ্গিক। সেই অংশ সম্পাদক মণ্ডলির দৃষ্টিভঙ্গী বহির্ভূত হতো নিশ্চয়। সেটাই বাদ দিয়ে তাঁরা কাজটা ভালো করেন নি। পরে বাংলামেইল ২৪ডট কমে পুরো প্রকাশিত হয়েছে।--সুশান্ত কর। )
১
তাঁর পোশাকের মতোই শুভ্র এবং সপ্রতিভ ছিল তাঁর হাসি। সত্তর দশকের মাঝামাঝি যখন পাবলিক স্কুলে আমরা পড়তে গেছি , তখন মনে হয় না খুব বেশি বছর হয়েছে তিনি এখানে শিক্ষক হয়ে এসছেন। একরাশ মাথা ভর্তি চুলের সঙ্গে তাঁর পৌরুষতো বটেই তারুণ্যকেও জানান দিতে সদা উদ্যত থাকত কুচকুচে কালো রোম। নজরে যে পড়ত সে আমাদের চোখের দোষে নয়, তাঁর হাত গোটানো সাদা পাঞ্জাবির গুণে। তার উপরে যদি কোনও এক কব্জিতে সময়ের জানান দিতে কালো বেল্টে বাঁধা থাকে ঘড়ি আর পেন্ডুলামের মতো ধুতির কুঁচিটা নিয়ে সেই কব্জি দুলতে থাকে সামনে পেছনে-- নজর না পড়ে যায় কোথায়! কারণ, এই দশকেই এই দৃশ্যটি দুর্লভ হতে যাচ্ছিল। আমরা তখন স্কুলে যাচ্ছি হাফপ্যান্ট পরে। শুনেছি আগের দশকেও আমাদের অগ্রজেরা কলেজ অব্দি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ধুতিতে। পাবলিক স্কুলে তখন ধুতি পরেন প্রবীণ জনাকয় শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক কিরণময় নাগ কিম্বা মন্মথ দাশ যেমন। নবীনেদের মধ্যে এই পোশাকে প্রিয় ছিল শুধু তাঁর আর প্রসূন কান্তি দেবের। আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের দিশারি এবং সংগঠক। কিন্তু প্রসূন বাবু পাঞ্জাবির হাত গোটাতেন না, আর ক্লাসে ছাত্র হাসাতেন না। এই কাজটি করতেন শ্যামলেন্দু বাবু। তাও কিনা কঠিন সব অংকের ক্লাসে, কিম্বা সৌর জগতের জটিলতার গল্প শোনাতে শোনাতে , অথবা পাস্ট পার্টিসিপলের সঙ্গে বি-ভার্বের ভাব-অভাবের কাহিনি বোঝাতে বোঝাতে। এ কি ছিল চাট্টিখানি কথা! যে ক্লাসগুলোতে পালানোই ছিল ছাত্রের ধর্ম কিম্বা জানালা দিয়ে তাকিয়ে পথ দিয়ে যাচ্ছে যদি কোনও কিশোরী-- তার চলনের ছন্দ গুনা-- সেই ক্লাসগুলোতে তিনি ছাত্র ধরে রাখতেন সেই হাসির জোরে। হাতে বেত দেখিনি, মুখে নীল ডাউন শুনিনি।
তিনি যখন পাবলিক স্কুলে ফিরে আসেন, দু’বছর জিসি কলেজে বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে এমনি এমনি ব্যাঙের শবচ্ছেদ করে, লবণ জলের রং পাল্টাবার কীসব দুর্বোধ্য দুঃস্বপ্ন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আমিও তদ্দিনে সাহিত্যের মানুষ ফিরে এসছি পাবলিক স্কুলে বাংলা ভাষাতে বাংলা নিয়ে পড়ব বলে। সেইসব দিন, সেই মেজাজের কিছুই ছিল না আর। কৈশোরের দুষ্টুমির সেই সব দুর্ধর্ষ সঙ্গীরাইতো ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। সঙ্গে যারা পড়বে বলে জুটেছে, সম্পর্কে আমি এদের দাদা -- মনে মনে জানি । এদের সঙ্গে আর যা হোক, কোনও দুষ্টুমি চলে না। শিক্ষকেরাও অনেকে পালটে গেছেন। স্নেহময় প্রধান শিক্ষক কিরণময় নাগও অবসর নিয়েছেন। আর যে শিক্ষিকাদের কারো কোনও অস্তিত্বই ছিল না, তাঁরাও অনেকে এসে জায়গা জুড়েছেন। তেমনি এক শিক্ষিকা বিজয়া দেব আমাকে বাংলা পড়াতেন। পাস করে বেরুলে পলাতক একমাত্র ছাত্রকে বলেছিলেন, আর একটু হলে আমারও চাকরি যেতো। যেতো না, নিশ্চয়। কিন্তু প্রথম ছাত্রের ব্যর্থতা কোনও শিক্ষিকার সুনাম বাড়াতো না নিশ্চয়। পরে জেনেছি, তিনিও তো গল্প লেখেন! এও আরেক হীরে হারানোর গল্প! দশম মানের পরে স্কুল থেকে বেরিয়েই আমার সাহিত্য সঙ্গী বাড়ে দিনে দিনে। ‘গণতান্ত্রিক লেখক সংস্থা’তে ভিড়েছিলাম ক্রমে। তারই এক আড্ডা ছিল প্রয়াত কবি দিগ্বিজয় পালের হোমিওপ্যাথ চেম্বারে, হাসপাতাল রোডে দেশবন্ধু রোডের ঠিক উলটো দিকে। আমি আড্ডারও সভ্য হয়ে গেলাম। সেই আড্ডাতে অনেকই আসতেন, আসতেন আমার তখনকার শিক্ষক কবি শক্তিপদ, এবং অবশ্যই বিমলেন্দু চৌধুরী । তিনিই তখন ছন্দ আর রসের রহস্য জানাতে বোঝাতে গিয়ে স্নেহে আর প্রশ্রয়ে বিজ্ঞানের সেই কারাগার থেকে আমাকে মুক্ত করেন। নিয়ে আসেন আবার নিজের স্কুলে। কিন্তু তখন সময় আশির দশক। অসম আন্দোলন মিইয়ে এসছে, চুক্তি তখনো হয় নি। ৮৩র গণহত্যা হয়ে গেছে। ইন্দিরা গান্ধি মারা গেছেন। শিখ বিরোধী প্রবল হাঙ্গামা হয়ে গেছে দেশ জুড়ে। ভূপালে হয়ে গেছে শতাব্দীর সবচে’ বড় রাসায়নিক দুর্ঘটনা। শীত যুদ্ধের দামামাতো আছেই, সেই সঙ্গে পালেস্তাইনের লড়াই তুঙ্গে, ফাঁসি হচ্ছে কবি বেঞ্জামিন মোলায়েজের দক্ষিণ আফ্রিকাতে। আমার তরুণ মন তখন টগবগিয়ে ফুটছে ক্রোধে। সুতরাং স্কুলে গেলেও তখন আর সেই সুবোধ বালকটি নই, যে ক্রমেই নিষ্ঠা দিয়ে শিক্ষক মন জয় করে চলেছিল। যারা সে কাজটি করে-- আমাদের তখনকার বহু বন্ধুদের কাছে এরা ‘ক্যারিয়ারিস্ট’। এদের কোনও সম্মানই ছিল না ‘আমাদের’ সমাজে। সেই সমাজের অনেকেই এখনো গল্প লেখে, কবিতা লেখে, সাহিত্য পত্র সম্পাদনা করে, কিম্বা নাটক করে, অথবা শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করে। কিন্তু সমস্ত প্রতিভা নিয়েও তাদের অনেকেই আমার মতো ‘অধ্যাপনা’ মতো কোনও জটিল জালে জড়িয়ে পড়ে শহর থেকে দূরে নির্বাসিত হয় নি। আমার সেই অনিষ্ঠা দেখে বিমল বাবুও হতাশ হয়েছিলেন নিশ্চয়। আমার তখন জড়িয়ে পড়া বিপ্লবী বাম ছাত্র আন্দোলনে, আর অন্যদিকে চুটিয়ে কবিতা লেখা। সেই কবিতাতেও চলছে বর্তমানের জমি দখলের লড়াই। বিতর্ক চলছে, আজ অব্দি কবিরা কবিতা লিখছিলেন কিনা গজদন্ত মিনারের চূড়ায় বসে! আমাদের তবে সেই মিনার ভাঙার পণ। কে সেই মিনার গড়েছিলেন, কিম্বা কারা --এতো সব তলিয়ে দেখবার আমাদের ধৈর্য কিম্বা সময় ছিল না তখন। ‘বাস্তিল বৈ এদেশে ওদেশে কোনও মানুষের নেই ঘর!’ আমরই আস্ত এক কবিতা এটা। সেই বাস্তিল যখন ভাঙতে হবে , ভেতরের অন্ধকারে বসে ইতিহাসের তলা খুঁড়ে দেখাটা কোন কাজ নয় তখন। সেই মনও গড়ে উঠেনি । আমাদের তখন, বুকে আঠারো এসেছে নেমে!
এমন ইতিহাসের একটি বিপদ আছে। সামান্য এগিয়ে এটি ইতিহাসেরই পথ আটকে দাঁড়ায়। প্রমাণতো এই প্রশ্ন করলেই জুটে যাবে, ‘শতক্রতু’র যৌক্তিক সম্প্রসারণ তবে কী? অথবা ‘সাহিত্যে’র? তাই যখন ‘গল্প আন্দোলনের ভগীরথ’ কথাটা একই লেখকের একই লেখার শিরোনামে হয়ে যায় ‘ছোটগল্পের ভগীরথ’ -- তখন বিপদ ঘণ্টা বেজে উঠে। মানেটা কিন্তু দাঁড়ালো-- তাঁর থেকেই আমাদের ছোট গল্পের শুরু! অমনোযোগী পাঠক কিন্তু সেভাবেই ধরে নেবেন, এবং জনপ্রিয়ও করে তুলবেন! এরা তাই করেন। এভাবেই তৈরি হয় মিথ। এভাবে লিখলে তখন সাহিত্যের ইতিহাসের পেছনের সামাজিক ইতিহাস নিয়েও কোনো কৌতূহল জাগে না, আর নতুন ইতিহাস রচনার জন্যেও আত্মবিশ্বাসটি প্রবল হয় না। আত্মমর্যাদা বোধের বিস্তারতো ঘটেই না। আমাদের এই কথাওতো মনে রাখতে হবে যে ‘কাছাড়’ কিম্বা ‘বরাক উপত্যকা’র যে এক আঞ্চলিক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে সেই বোধেরও জন্ম ষাটের দশকেই। ৬১র ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে। তপোধীরই লিখেছেন, “... তবে সংঘবদ্ধ উদ্যম গড়ে উঠতে পারে সামাজিক ইতিহাসের যেসব বাধ্যবাধকতায় কিংবা প্রেরণায়, দেশ বিভাগের আগে তাদের উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে ওঠেনি” ৫ এর আগেতো সবাই ‘সুরমা উপত্যকা’র এবং একাধারে অসম এবং বাংলার মানুষ । তার প্রাণ কেন্দ্র তখন কিছুটা সিলেট, বাকিটা সবই কলকাতার হতে কোনও রাজনৈতিক বা সামাজিক বাধা ছিল না। সিলেটের প্রতিভা বিপিন চন্দ্র পাল তাই সেখানে গিয়েই প্রত্যাহ্বান জানান স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে। সেই অবিভাজিত সিলেট থেকেই উঠে আসছেন অশোক বিজয় রাহা, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, খালেদ চৌধুরীদের মতো প্রতিভা। এমন কি করুণা রঞ্জন ভট্টাচার্য, অতুল রঞ্জন দে’র মতো মানুষেরও সাহিত্য কৃতির পেছনকার কাহিনি লেখা হয়েছিল সেখানেই। আর যেমন বাংলা কিম্বা ভারতীয় সাহিত্যে ছোট গল্প এসেছে উপন্যাসের পরে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। মনে রাখতে হবে সেই রামকুমার নন্দি মজুমদার, সুরেন্দ্র কুমার চক্রবর্তীদের কথা। ‘অশ্রুমালিনী’র মতো উপন্যাসের কথা।
• “ লোকটা
সটান শুয়ে আছে। মুখ অল্প হাঁ করা। হয়তো শেষ দম মুখ দিয়েই
টেনেছিল। এখন ও পথে বাতাসের আনাগোনা নেই। পরিবর্তে কয়েকটি মাছি
নিশ্চিন্তে যাওয়া-আসা করছে” ---গল্প ‘একটি
মৃত্যু এবং তারপর’।
• “পাশের
দিকে চাইতেই একটা বোর্ডে-মুক্ত হস্তে দান করুণ—বানানের
এহেন করুণ অবস্থায় করুণায় কৌশিকের সত্যি সত্যি ওর ঝুলাঝুলি মায় পাঞ্জাবী সুদ্ধ দান
করে দেবার মত মনটা বিবাগী হয়ে ওঠে। ভাগ্যিস গ্রহীতারা কেউ
ধারে কাছে নেই” --
গল্প ‘গ্রন্থি’।
• “লোকটিকে
রাজপথে এই রাজসুখ থেকে অন্তত কোনও দোকানের মসৃণ বারান্দায় ওর উপযুক্ত ক্লেশে নেয়া
দরকার। ইতিউতি চাইল কৌশিক—ডানে বা বাঁয়ে। সামনে বা পেছনে—শুধুই ব্যস্ততা। না ডানপন্থী না
বামপন্থী, অবশ্য এখনতো আর নির্বাচন নেই---কৌশিকের
মনে হল থাকলে ভালো ছিল—সেই ডামাডোলের বাজারে
এই বৃদ্ধের একটা হিল্লে হয়ে যেত---হয়তো প্রসেশন বা
প্রতিবাদ মিছিল-টিছিল বা নিদেন পক্ষে ধর্মীয় জিগিরটিগির
তুলে একটা এসপার নয় ওসপার—পাজামার টান পরে নীচের
দিকে চাইতেই কচি শব্দ হয় ভা---
ভা
মানে কি--ভাগো-- ভাংগো--ভাস
না কি ভারত...ভাঁড়।। দু কাঁধের ওপর কৌশিকের
মনে হয় ভৃগুর পদভার।...টুক টুক পা ফেলে অতি
আপন জনের মত শিশুটি ওর পেছনে। আবারও কচি শব্দ—ভা---
ওঃ
ভা মানে ভাত!” --গল্প ‘গ্রন্থি’
• “ঠিক
এমন সময় এক রাশ ঝড়ো বাতাসের মতো ঢোকে অবিনাশ।
আরে
তোর এখনো বিনাশ হয় নি দেখছি। তুই কী করে জানলি আমি এখানে!—অনিন্দর
অবাক কণ্ঠ।
আমার
নামটি জানিসতো, সব কিছুর বিনাশ হলেও আমি ছিলাম,আছি
ও থাকব।
তা
বিজয়ী সিজার-- কী খাবি বল।”--- ‘অক্টোপাস’ গল্পের
থেকে।
• “ সংক্রান্তির
সকালে ফোন করলেন,
কী? পিঠেপুলি
কিছু করেছো? না কি ওসব কিছু শেখোই নি।
একটু
বাহাদুরি করে বললাম,
কেন
করব না? কী বানিয়েছি জানেন? মুগডাল
দিয়ে নতুন রেসিপিতে মুগমোহিনী।
আসলে
ওটা সিম্পল মুগের পিঠে ছিল। দুপুর বারোটা নাগাদ শ্যামলেন্দুদা আমার ঘরের
দরজায়। একমুখ মধুর হাসি।
তোমার
মুগমোহিনী কোথায়? অটো রিজার্ভ করে এলাম। সদর গেটে অটো দাঁড়িয়ে।” ---২৩শে
মার্চ দৈনিক যুগশঙ্খের ‘রবিবারে’র
বৈঠকে তাঁর এককালের সহকর্মী আমাদের উচ্চমাধ্যমিক কালের বাংলার শিক্ষিকা, আরেক
কথাশিল্পী বিজয়া দেবের স্মৃতিচারণ থেকে।
কয়েকটি গল্প-টুকরোর
সঙ্গে তাঁর জীবনকথা পাশাপাশি তুলে দিয়ে আমরা দেখালাম যে,
কথাসাহিত্যে যেমন, জীবনেও তেমনি -- তিনি হাসতে এবং হাসাতে
জানতেন।
সবচাইতে করুণ পরিস্থিতিতেও। ভুল বানানেও, কিম্বা পথের পাশে মৃত
বৃদ্ধকে রেখে যেমন তাঁর গল্পের চরিত্র কিম্বা কথক সপ্রতিভ কৌতুক করতে ভুলত না, জীবনেও তিনি শতসংকটের মধ্যেও হাসতে ভুলতেন না। গোটা জীবনটাতো আর ছিল
না পৌষপার্বণ। বরং সেটিও সংকট দীর্ণ ছিল শুরু থেকেই। সে কথা আমরা ছাত্রেরা বা কাছে
থেকে দেখেছি যারা জানতামই, আর এখনতো মৃত্যুর পরে তা
প্রকাশ্যে এসে পড়েছে।
তাঁর পোশাকের মতোই শুভ্র এবং সপ্রতিভ ছিল তাঁর হাসি। সত্তর দশকের মাঝামাঝি যখন পাবলিক স্কুলে আমরা পড়তে গেছি , তখন মনে হয় না খুব বেশি বছর হয়েছে তিনি এখানে শিক্ষক হয়ে এসছেন। একরাশ মাথা ভর্তি চুলের সঙ্গে তাঁর পৌরুষতো বটেই তারুণ্যকেও জানান দিতে সদা উদ্যত থাকত কুচকুচে কালো রোম। নজরে যে পড়ত সে আমাদের চোখের দোষে নয়, তাঁর হাত গোটানো সাদা পাঞ্জাবির গুণে। তার উপরে যদি কোনও এক কব্জিতে সময়ের জানান দিতে কালো বেল্টে বাঁধা থাকে ঘড়ি আর পেন্ডুলামের মতো ধুতির কুঁচিটা নিয়ে সেই কব্জি দুলতে থাকে সামনে পেছনে-- নজর না পড়ে যায় কোথায়! কারণ, এই দশকেই এই দৃশ্যটি দুর্লভ হতে যাচ্ছিল। আমরা তখন স্কুলে যাচ্ছি হাফপ্যান্ট পরে। শুনেছি আগের দশকেও আমাদের অগ্রজেরা কলেজ অব্দি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ধুতিতে। পাবলিক স্কুলে তখন ধুতি পরেন প্রবীণ জনাকয় শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক কিরণময় নাগ কিম্বা মন্মথ দাশ যেমন। নবীনেদের মধ্যে এই পোশাকে প্রিয় ছিল শুধু তাঁর আর প্রসূন কান্তি দেবের। আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের দিশারি এবং সংগঠক। কিন্তু প্রসূন বাবু পাঞ্জাবির হাত গোটাতেন না, আর ক্লাসে ছাত্র হাসাতেন না। এই কাজটি করতেন শ্যামলেন্দু বাবু। তাও কিনা কঠিন সব অংকের ক্লাসে, কিম্বা সৌর জগতের জটিলতার গল্প শোনাতে শোনাতে , অথবা পাস্ট পার্টিসিপলের সঙ্গে বি-ভার্বের ভাব-অভাবের কাহিনি বোঝাতে বোঝাতে। এ কি ছিল চাট্টিখানি কথা! যে ক্লাসগুলোতে পালানোই ছিল ছাত্রের ধর্ম কিম্বা জানালা দিয়ে তাকিয়ে পথ দিয়ে যাচ্ছে যদি কোনও কিশোরী-- তার চলনের ছন্দ গুনা-- সেই ক্লাসগুলোতে তিনি ছাত্র ধরে রাখতেন সেই হাসির জোরে। হাতে বেত দেখিনি, মুখে নীল ডাউন শুনিনি।
সেই মাস্টারমশাইকে কিনা,
যদ্দূর মনে পড়ে সপ্তমশ্রেণির মাঝামাঝি থেকে আর পেলাম না। বিষণ্ণ ছাত্রদের কানে
কানে সেই বার্তা রটে গেল ক্রমে –তিনি স্নাতকোত্তর পড়তে
গেছেন। তার মানে এম-এ। বি-এ পড়তে পারলেই স্বপ্নপুরুষ সব মাস্টারমশাই হয়ে
যাওয়া যায়। আমাদের কাছে সেই অনেক তখন। তিনি কিনা গেছেন,
তারও উপরে কিছু পড়তে! আমাদের বিষণ্ণতা রূপান্তরিত হলো গৌরববোধে। আমরা তাঁর মতো
এক বড় মানুষের ছাত্র ছিলাম বটে! জানি না, আমার সহপাঠীরা এমনতর
ভেবেছিল কিনা। আমি ভেবেছিলাম। আমার মতো সামান্য স্বল্প-শিক্ষিত নিম্নবিত্ত
পরিবারের ছাত্রের কাছে এ ছিল এভারেস্ট অভিযানের সমান । এর পরে তাঁকে পেয়েছিলাম, যখন স্কুলটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছিল। তার আগে তিনি
করিমগঞ্জ জেলার অন্য কোথাও (পাথারকান্দি বা দুর্লভছড়া) অন্য কোন উচ্চমাধ্যমিক
বিদ্যালয়ে ঘুরে এসেছেন। ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর, ইংরেজিই
পড়িয়েছেন নিশ্চয়।
শ্রেণি
কোঠার বাইরে মঞ্চে কিম্বা ময়দানে শ্যামলেন্দু বাবুকে পেয়েছি বলে মনে পড়ে না।
সেখানকার পাঠ নিতে গিয়ে , এবং উপরের ক্লাসে উঠতে উঠতে আরো বহু
শিক্ষকের কাছে আসবার সুযোগ সবার যেমন হয়, আমাদেরও হয়েছে।
কিন্তু শ্যামলেন্দু বাবুর কাছে পৌঁছুনো যায় নি। ফলে মনে হয় তাঁকে নিয়ে রহস্য আরো
ঘনিয়েছিল। তাঁর গল্পে চরিত্র হয়ে ঢোকা যায় না,
বাইরে থেকে শুনতে হয়। তিনি আমাদের স্কুলকথার নায়ক। খুব বেশি কথা নেই। কিন্তু তাঁর
লেখা গল্পগুলোর মতোই যা আছে সোজা, সরল, সুপরিমিত,
সরোষ যদিবা সে কৌতুকসহ
এবং
অবশ্যই সপ্রতিভ। আমাদের
স্কুলে ছিলেন আরেক শ্যামল । শ্যামল দেব। ষষ্ঠ, সপ্তম মানে তাঁর বাড়িতে
যেতে হতো ‘ট্যুশন’ নিতে। তিনি
আমাদের একই পাড়াতে থাকতেন, শহীদ চণ্ডীচরণ রোডে। এক বাড়ির দোতলায়,
যার নিচে শ্যামলেন্দু থাকতেন। শ্যামল বাবুর কাছে দশমমান পার করবার পরেও
মার্চপাস্টের অভ্যেস করতে হয়েছে
বছরে দু’বার। ২৩ শে জানুয়ারি এবং ১৪ এপ্রিল, বাংলা
নববর্ষের দিনে। সুতরাং একটা টানা যোগাযোগ ছিল। পরে যখন তিনি পাবলিক স্কুলের পাশে
বাসা করেন, এবং তারপরে লিংকরোডে --তখনো। কিন্তু
শ্যামলেন্দু বাবুর সঙ্গে হয়ে উঠে নি। তিনি সেই দূরের নক্ষত্র , তাঁকে দূর থেকেই সমীহ আর সম্মান নিয়েই দেখতে হয়। কাছে যেতে ভয় করে না, সশ্রদ্ধ লজ্জা হয়। তেমনিই থেকে গেলেন। শ্যামলবাবুর দোতালাতে উঠা
কিম্বা নামার সময়ে আমরা কখনো উঁকি দিয়ে দেখে নিতাম শ্যামলেন্দুর নীরব সংসারের ছবি।
তাঁর বড় ছেলে ‘পিকলু’ তখন কোল
ছেড়েছে বেশিদিন হয় নি। তাঁর সঙ্গে কখনো বা খুনসুটি সেরে নিতাম, তিনি সেই অমল হাসিটি মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেন। তাই
আমার মনে হয় না, তাঁকে নিয়ে তাঁর ছাত্রদের খুব একটা
স্মৃতি রয়েছে এর বেশি কিছু, যদি না সাহিত্য কর্ম করতে
গিয়ে গড়ে উঠেছে অন্য রকম কিছু। আমি সপ্তমমান থেকেই রবীন্দ্র, নজরুল , মধুসূদনের নকলে এবং পরে সুকান্তের
মতো কবিতা লিখতে হাত পাকাচ্ছি। বঙ্কিম শরতের নকলে দু’চারটা
উপন্যাসও লিখে ফেলেছি। খুব কাছের বন্ধুরা এগুলো জানত,
একটা সমীহও আদায় করা গেছিল। কিন্তু এতো ছোট ছেলেকে যে এগুলো ছাপাবার কথা ভাবতে হবে
বা শিক্ষকদের দেখিয়ে ব্যাপারটা জানাজানি করে দিতে হবে --সেই বুদ্ধি মাথাতে মোটেও
আসে নি। এলে হয়তো, স্কুলেই আমার দম্ভ মাটিতে মিশে যেতো।
আমার ধারণা ছিল, রবীন্দ্রনাথ,
শরৎচন্দ্রের পরে আর কোনও বাঙালির লেখক হবার কথাটা মাথাতে আসে নি, আমাদের
সেই ছোট্ট শহর শিলচরেতো কথা ই নেই----সবাই শুধু কেরানি হতে চায়,
কিম্বা ডাক্তার। এখনো যদি অসমের স্কুলগুলোতে কোনও ছাত্র সেরকমই কিছু অদ্ভুত ভাবনা
লালন করতে থাকে তাকে দোষ দেয়া যাবে না, বদল শুধু এই যে
এখন সবাই দিল্লি কিম্বা বাঙ্গালুরু ছুটে
যেতে চায়। আরো
যত
অসম্ভব পরিকল্পনা মাথাতে গিজ গিজ করছিল তখন--শুধু সিদ্ধান্ত নেবার পাট মুলতুবি
রাখা ছিল দশমমান অব্দি। এ
ছিল তখন, এবং সম্ভবত এখনো, এক সাধারণ ছাত্র সংস্কৃতি।
যা কিছু করো-- মেট্রিক দেবার পর। অথচ যদি মুলতুবি করা না থাকত! জানা হয়ে যেতো যে
আমাদেরই স্কুলে রয়েছেন দুই আশ্চর্য প্রতিভা শ্রী বিমলেন্দু চৌধুরী আর শ্রী শ্যামলেন্দু
চক্রবর্তী। তাও কি যে সে ! প্রথম জন যদি বরাক উপত্যকার অন্যতম কাব্য আন্দোলনের
মুখপত্র ‘অতন্দ্রে’র, তো দ্বিতীয়জন কথাশিল্প আন্দোলনের মুখপত্র ‘অনিশ’এর মধ্যমণি! এ যেন ‘চাঁদের পাহাড়ে’র সেই শঙ্করের মতো যে হীরের
গুহা থেকে বহু দূরে এগিয়ে তবে জানতে পারে গুহাটাতো হীরেরই ছিল –যার সন্ধানে এই জীবন পণ।
তিনি যখন পাবলিক স্কুলে ফিরে আসেন, দু’বছর জিসি কলেজে বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে এমনি এমনি ব্যাঙের শবচ্ছেদ করে, লবণ জলের রং পাল্টাবার কীসব দুর্বোধ্য দুঃস্বপ্ন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আমিও তদ্দিনে সাহিত্যের মানুষ ফিরে এসছি পাবলিক স্কুলে বাংলা ভাষাতে বাংলা নিয়ে পড়ব বলে। সেইসব দিন, সেই মেজাজের কিছুই ছিল না আর। কৈশোরের দুষ্টুমির সেই সব দুর্ধর্ষ সঙ্গীরাইতো ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। সঙ্গে যারা পড়বে বলে জুটেছে, সম্পর্কে আমি এদের দাদা -- মনে মনে জানি । এদের সঙ্গে আর যা হোক, কোনও দুষ্টুমি চলে না। শিক্ষকেরাও অনেকে পালটে গেছেন। স্নেহময় প্রধান শিক্ষক কিরণময় নাগও অবসর নিয়েছেন। আর যে শিক্ষিকাদের কারো কোনও অস্তিত্বই ছিল না, তাঁরাও অনেকে এসে জায়গা জুড়েছেন। তেমনি এক শিক্ষিকা বিজয়া দেব আমাকে বাংলা পড়াতেন। পাস করে বেরুলে পলাতক একমাত্র ছাত্রকে বলেছিলেন, আর একটু হলে আমারও চাকরি যেতো। যেতো না, নিশ্চয়। কিন্তু প্রথম ছাত্রের ব্যর্থতা কোনও শিক্ষিকার সুনাম বাড়াতো না নিশ্চয়। পরে জেনেছি, তিনিও তো গল্প লেখেন! এও আরেক হীরে হারানোর গল্প! দশম মানের পরে স্কুল থেকে বেরিয়েই আমার সাহিত্য সঙ্গী বাড়ে দিনে দিনে। ‘গণতান্ত্রিক লেখক সংস্থা’তে ভিড়েছিলাম ক্রমে। তারই এক আড্ডা ছিল প্রয়াত কবি দিগ্বিজয় পালের হোমিওপ্যাথ চেম্বারে, হাসপাতাল রোডে দেশবন্ধু রোডের ঠিক উলটো দিকে। আমি আড্ডারও সভ্য হয়ে গেলাম। সেই আড্ডাতে অনেকই আসতেন, আসতেন আমার তখনকার শিক্ষক কবি শক্তিপদ, এবং অবশ্যই বিমলেন্দু চৌধুরী । তিনিই তখন ছন্দ আর রসের রহস্য জানাতে বোঝাতে গিয়ে স্নেহে আর প্রশ্রয়ে বিজ্ঞানের সেই কারাগার থেকে আমাকে মুক্ত করেন। নিয়ে আসেন আবার নিজের স্কুলে। কিন্তু তখন সময় আশির দশক। অসম আন্দোলন মিইয়ে এসছে, চুক্তি তখনো হয় নি। ৮৩র গণহত্যা হয়ে গেছে। ইন্দিরা গান্ধি মারা গেছেন। শিখ বিরোধী প্রবল হাঙ্গামা হয়ে গেছে দেশ জুড়ে। ভূপালে হয়ে গেছে শতাব্দীর সবচে’ বড় রাসায়নিক দুর্ঘটনা। শীত যুদ্ধের দামামাতো আছেই, সেই সঙ্গে পালেস্তাইনের লড়াই তুঙ্গে, ফাঁসি হচ্ছে কবি বেঞ্জামিন মোলায়েজের দক্ষিণ আফ্রিকাতে। আমার তরুণ মন তখন টগবগিয়ে ফুটছে ক্রোধে। সুতরাং স্কুলে গেলেও তখন আর সেই সুবোধ বালকটি নই, যে ক্রমেই নিষ্ঠা দিয়ে শিক্ষক মন জয় করে চলেছিল। যারা সে কাজটি করে-- আমাদের তখনকার বহু বন্ধুদের কাছে এরা ‘ক্যারিয়ারিস্ট’। এদের কোনও সম্মানই ছিল না ‘আমাদের’ সমাজে। সেই সমাজের অনেকেই এখনো গল্প লেখে, কবিতা লেখে, সাহিত্য পত্র সম্পাদনা করে, কিম্বা নাটক করে, অথবা শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করে। কিন্তু সমস্ত প্রতিভা নিয়েও তাদের অনেকেই আমার মতো ‘অধ্যাপনা’ মতো কোনও জটিল জালে জড়িয়ে পড়ে শহর থেকে দূরে নির্বাসিত হয় নি। আমার সেই অনিষ্ঠা দেখে বিমল বাবুও হতাশ হয়েছিলেন নিশ্চয়। আমার তখন জড়িয়ে পড়া বিপ্লবী বাম ছাত্র আন্দোলনে, আর অন্যদিকে চুটিয়ে কবিতা লেখা। সেই কবিতাতেও চলছে বর্তমানের জমি দখলের লড়াই। বিতর্ক চলছে, আজ অব্দি কবিরা কবিতা লিখছিলেন কিনা গজদন্ত মিনারের চূড়ায় বসে! আমাদের তবে সেই মিনার ভাঙার পণ। কে সেই মিনার গড়েছিলেন, কিম্বা কারা --এতো সব তলিয়ে দেখবার আমাদের ধৈর্য কিম্বা সময় ছিল না তখন। ‘বাস্তিল বৈ এদেশে ওদেশে কোনও মানুষের নেই ঘর!’ আমরই আস্ত এক কবিতা এটা। সেই বাস্তিল যখন ভাঙতে হবে , ভেতরের অন্ধকারে বসে ইতিহাসের তলা খুঁড়ে দেখাটা কোন কাজ নয় তখন। সেই মনও গড়ে উঠেনি । আমাদের তখন, বুকে আঠারো এসেছে নেমে!
তাই, উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে আর
আমাদের সেই সেকালের স্বপ্নপুরুষ শ্যামলেন্দু বাবুরও
ক্লাস করেছি বলে মনে পড়ে না, না জিজ্ঞেস করেছি তিনি
তখন কী লিখছেন । সাহিত্য নিয়েও তাঁর সঙ্গে কোনোদিন আড্ডা দেয়া হয়ে উঠে নি আমার। এর হয়তো একটা কারণ এও যে ১৯৯৫তে চাকরি
থেকে তাঁর অবসর নেবার আগে
অন্তত কোনোদিন কোন সাহিত্যের আড্ডা আসর বা সংগঠনে তাঁকে দেখিনি। ‘অনিশ’
যদ্দিন ছিল তার বাইরে অন্য কিছু নিয়ে মনে হয় না তিনি ব্যস্ত
হয়েছেন বলে। বিচ্ছিন্ন ভাবে এখানে ওখানে গল্প পড়েছি হয়তো,
কিন্তু গল্পের বই করবার সংস্কৃতিটাও তো আমাদের অসমে অতি সাম্প্রতিক। আর তাঁর বই
বেরিয়েছে এই সেদিন ২০১০এ। ‘অনিশ-শতক্রতু’র পরের পর্বে আমাদের কালের এক অতি দুর্ধর্ষ গল্প লিখিয়ে মলয় কান্তি দে’র আজ অব্দি কোনও বই নেই! আর সংকলন? ষাটের
দশকের সেই ‘নীলগোলাপে’র পরে মনে
হয় প্রথম গল্প সংকলনটি বের করেছিল বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন, আর তার পরে করিমগঞ্জের অক্ষর। গল্প সংকলন করবার আজ যে জোয়ার চতুর্দিকে
--এসব একুশশতকের জন্যে জমানো ছিল। আমি তদ্দিনে নির্বাসিত আমার স্বপ্নের শহর থেকে
বহু দূর! সেই দূরত্ব পরে আবার এসে ঘুচিয়ে দেবে নতুন প্রযুক্তি, মোবাইল এবং আন্তর্জাল। সে অনেক পরের কথা!
সেই প্রযুক্তির সুবাদেই ঐ সেদিন,
সেখান থেকেই লেখা চেয়ে ডাক পাঠিয়েছিল রাহুল কান্তি দেব। দৈনিক জনকণ্ঠের জন্যে।
বছর খানিক লিখেছিলাম। এই
প্রথম ‘লেখাকর্ম’ নিয়ে সম্পর্ক গড়ে উঠে স্যরের সঙ্গে।
তিনি সেই কাগজের সম্পাদক। সেবারে শারদ সংখ্যা একটা করবেন বলে পরিকল্পনা করেছিলেন, আমার থেকে লেখা চাই! বহু শ্রম করে লিখে ফেলেছিলাম,
রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহ থেকে শ্রীনিকেতনের কাজকম্ম নিয়ে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ। শ্রমটি
মনে হয় তাঁকে খুশি করেছিল, দৃষ্টিতো বটেই-- নিজে ফোনে সে
কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু শারদ সংখ্যাটি বেরুলো না। লেখাটি পরে বেরুলো উত্তর
সম্পাদকীয় হয়ে ধারাবাহিক । নতুন সম্পর্কে পুনরুজ্জীবিত হচ্ছিলাম। তখনই একদিন রাহুল
জানালো দুঃসংবাদ! মাস্টার মশাই আক্রান্ত দুরারোগ্য রোগে। গেছিলাম পরের বারে শিলচর গেলে,
তাঁকে দেখতে। ছেলেবেলার সেই সুন্দর মানুষ আর তাঁর ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাগিচা তুল্য বাড়িটিকে স্রেফ খুঁজে পাচ্ছিলাম না, খুব কষ্ট হয়েছিল। আর কষ্ট হবে না। তিনি ইতিহাস হয়ে গেছেন। সত্যি আকাশের তারা হয়ে
গেছেন।তাঁর গল্প আছে-- থাকবে । তাঁকে
নিয়ে গল্প তৈরিও হবে। তাঁকে নিয়ে আপাতত
আমার গল্প এইটুকুনই। এর বেশি কিছু নেই!
২
তবে আর আজ তাঁকে নিয়ে লিখছি কেন! লিখছি ,
কেননা মাঝে পেরিয়ে গেছে তিনটি দশক। পৃথিবী পালটে যায় বহু সময় তিনটি দিনে!
আশির দশকেই আরো একবার ঢেউ উঠে উপত্যকার
ইতিহাস লেখার। এর আগে যা কিছু হয়েছিল, বোধ করি ব্রিটিশ ভারতে।
আশির দশকের শুরুতে সনৎ কুমার কৈরি একটি চটি বই লেখেন ১৯৬১র ভাষা আন্দোলন নিয়ে , আর দশক শেষ হতে হতে সুজিত চৌধুরী হাত দিয়ে ফেলেন ‘শ্রীহট্ট কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস’ লেখার কাজে।
কলেজে আমাদের আরো এক গুণোত্তম শিক্ষক অমলেন্দু ভট্টাচার্য সেই দশকেই লিখে
ফেলেছিলেন বরাক উপত্যকার বাংলা সাহিত্যের এক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। আর ছোট খাটো নিবন্ধ
লিখে, বক্তৃতা করে সেই দশকের সাহিত্যকে মহিমান্বিত করে
চলেছিলেন আমাদেরই অগ্রজ অনুরূপা বিশ্বাস, আবুল হোসেন
মজুমদার, এবং অবশ্যি তপোধীর ভট্টাচার্য-- যিনি পরে বরাক উপত্যকা তথা
পূর্বোত্তরে সাহিত্য তত্ত্বে মহিরুহ সমান হয়ে উঠবেন। যারা প্রশ্ন করতে শেখাবেন।
আমি সেই শিক্ষাতে ক্রমে দীক্ষিত হব নব্বুই দশক আসতে আসতে। নিজেও সাহিত্যে
স্নাতকোত্তর করতে করতে।
১৬ মার্চ,১৪ বিকেলে রণবীরদাই
প্রথম জানিয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর কথা। আন্তর্জালে কথাটা জানাবার ভার অনেকটা অলিখিত
ভাবেই চেপেছিল আমার উপরে। সেদিনই একটা ভুল করেছিলাম। লিখেছিলাম, “... শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী সম্পাদিত কাগজ, 'অনিশ' । বরাক উপত্যকারতো বটেই, যদ্দূর জানি জ্যোতির্ময়
ভালো বলতে পারবেন, গোটা অসমেই এটি ছিল প্রথম বাংলা গল্প-কাগজ।” জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত। ‘অসমের
বাংলা লিটিল ম্যাগাজিনঃ ছোট গল্প চর্চার প্রেক্ষাপট এবং ক্রমবিকাশ’ নিয়ে
অসম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তপোধীর ভট্টাচার্যেরই তত্ত্বাবধানে গবেষণা করেছেন। তিনি পরে ফোনে
জানিয়েছেন, ‘অনিশ’ বরাক
উপত্যকাতে প্রথম বটে, কিন্তু অসমে এর আগেও বেরিয়েছে
গল্পের কাগজ। গুয়াহাটি থেকে ‘সূর্য’ ১৯৫৪তে, আর ‘একাল’
১৯৬৭তে! শিলং থেকে অনিশের বছরেই বেরুনো ‘পূর্বভারতী’রও মনে হয় ছিল গল্পই মূল বিষয়। তবে
এরা বেরুতো বছরে একটা। অনিশের পরিকল্পনা ছিল মাসিক। সেদিক থেকে একটা আন্দোলনের
নেতৃত্ব দেবার দায় কাঁধে তুলে নিয়েছিল ‘অনিশ’-- বলা যেতেই পারে। কিন্তু তারও আগে শিলচরেই ‘অনিশে’র জন্যেই হয়তো একটি সলতে পাকানোর
পালা সেরেছিল
‘নীলগোলাপ’ গল্পের সংকলন। সেই সংকলনটি কিন্তু ছিল অসমে প্রথম। এর
প্রায় দেড় দশকের পরে ১৯৮৪ নাগাদ বেরোয় লামডিং থেকে দ্বিতীয় গল্প সংকলন। বের করে
শারদোৎসব উপলক্ষে ছোট কাগজ ‘দৃষ্টি’। করুণারঞ্জন ভট্টাচার্য সম্পাদিত সংকলন,
কিম্বা করিমগঞ্জের ‘অক্ষর’ প্রকাশিত
সংকলন তারও অনেক পরের কথা। কিন্তু শ্যামলেন্দু বাবু, গণেশ
দে-দের আগেই করুণা রঞ্জন ভট্টাচার্য কিম্বা অতুল রঞ্জন দে-রাও কিন্তু গল্প
লিখেছেন। বিশেষ করে অতুল রঞ্জনের কবিতা যেমন, ছোট গল্পেরও
পাতে তুলে নেবার মতো জোর ছিল।
এগুলো তথ্যমাত্র নয়। এগুলোরও বলবার কথা অনেক
আছে। শ্যামলেন্দুরই
ভাবশিষ্য
তপোধীর ভট্টাচার্য দেখলাম বরাক উপত্যকার ছোট গল্প লেখার ইতিহাসকে টেনে নিয়ে গেছেন
১৯১৫তে। ‘শিক্ষাসেবক’, ‘বিজয়িনী’র মতো কাগজেও ছোট গল্প বেরিয়েছে এই
তথ্যের তিনি উল্লেখ করেছেন। ১ । বাংলা
তথা ভারতীয় সাহিত্যেই ছোট গল্পের তখন বয়স এমনিতেই বেশি কিছু নয়। রবীন্দ্রনাথের
হাতে সে গড়ে উঠছে, আর তাঁর ভাবশিষ্যরা কলাটি শিখছেন।
আমাদের এই
কথার সঙ্গেও দ্বিমত
তত নেই, “ ...নির্দ্বিধায় লিখতে চাই, শিলচর সহ বরাক উপত্যকায় গল্প আন্দোলনের ভগীরথ তিনি, শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী। যে-পথ দিয়ে তিনি প্রথমে পদাতিক এবং পরে
অশ্বারোহী হয়ে এগিয়ে গেছেন, সেই পথ তাঁরই শ্রম ও
তিতিক্ষায় তৈরি। ‘অনিশ’ই তো
আশ্রয় দিয়েছিল সেদিনকার সমস্ত তরুণ গদ্য শ্রমিকদের। শান্ত নিস্তরঙ্গ শিলচরে
কথাবয়নের আকল্প (মডেল) তৈরি হয়েছিল ‘অনিশে’র সুবাদে।” রণবীর পুরকায়স্থের এই
কথার আবেগও আমরা সম্মানেই বুঝি, , “ ...তখন সময় সত্তর। ‘কাছাড়ে গল্পকার সাহিত্য
শ্রমিকদের প্রথম (বা প্রথম প্রকাশ্য) সংঘবদ্ধ শ্রেণি সংগ্রাম শুরু হয় সেই সময়ে।” ২ নিশ্চয়ই তাঁরা এক উজ্জ্বল ইতিহাস লিখছিলেন তখন। দুই রঙের
প্রচ্ছদ আর পনেরোটি গল্প নিয়ে ১৯৭০এর শারদ সংখ্যা প্রকাশের কাহিনি
শ্যামলেন্দুও যেটি শুনিয়েছেন তাঁর গল্প বইএর মুখবন্ধে সেটিও বেশ রোমাঞ্চকর। ৩
আমাদের
তপোধীরের এই
কথাও মানতে অসুবিধে নেই, নীলগোলাপের আবির্ভাব “আসলে
নতুন কালের অস্তিত্ব ঘোষণা। প্রকাশিত গল্পগুলির রচনামূল্য বিচার্য নয়; লক্ষ করতে হবে তাদের উপস্থিতির চিহ্নায়ন। এর পরেই আবিভূর্ত হলো ‘অনিশ’।” ৪
এবং “‘ শতক্রতু’তো আসলে ‘অনিশে’রই
যৌক্তিক সম্প্রসারণ।” এবং “অনিশের
গল্প...শ্যামলেন্দুরও গল্প। এই গল্প আমারও, মিথিলেশেরও, রণবীরেরও।” কিন্তু আমরা শুধু কথাগুলো
উচ্চারণে তত ‘নির্দ্বিধ’ নই। মনে
হয় যেন, অতন্দ্রেই বরাক উপত্যকার কবিতার ইতিহাসের শুরু আর
‘সাহিত্য’ তার যৌক্তিক
সম্প্রসারণের তত্ত্বের
--- এ হলো সমান্তরাল
প্রকল্প। অথচ ইতিহাস কিন্তু এমন সমান্তরাল কিম্বা সরল গতিতে এগোয়না। অনিশের না
থাকুক কবিকুলের সঙ্গে কোনো বিরোধ, অনেকেই সে কাগজে কবিও
ছিলেন , কিন্তু ‘অতন্দ্র’
নিয়ে একটি বিরোধ কবিদের মধ্যেও শুরু থেকেই ছিল। ‘সংলগ্ন বাস্তবের ধূসর দিগন্ত থেকে সরে গিয়ে সাধারণভাবে কবিরা’ লিখেছেন কিনা, ‘ নিসর্গ ও ব্যক্তিসত্তার
চিরাগত ও অজিজ্ঞাসিত অন্বয়ের বোধ থেকে’ –এমন
কিছু প্রশ্ন তখনো উঠত, এখনো উঠে। এমন কখনোবা হয়, যে প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিরোধ অবচেতনে বিরোধের স্বরও গড়ে উঠে তারই আদলে।
এমন ইতিহাসের একটি বিপদ আছে। সামান্য এগিয়ে এটি ইতিহাসেরই পথ আটকে দাঁড়ায়। প্রমাণতো এই প্রশ্ন করলেই জুটে যাবে, ‘শতক্রতু’র যৌক্তিক সম্প্রসারণ তবে কী? অথবা ‘সাহিত্যে’র? তাই যখন ‘গল্প আন্দোলনের ভগীরথ’ কথাটা একই লেখকের একই লেখার শিরোনামে হয়ে যায় ‘ছোটগল্পের ভগীরথ’ -- তখন বিপদ ঘণ্টা বেজে উঠে। মানেটা কিন্তু দাঁড়ালো-- তাঁর থেকেই আমাদের ছোট গল্পের শুরু! অমনোযোগী পাঠক কিন্তু সেভাবেই ধরে নেবেন, এবং জনপ্রিয়ও করে তুলবেন! এরা তাই করেন। এভাবেই তৈরি হয় মিথ। এভাবে লিখলে তখন সাহিত্যের ইতিহাসের পেছনের সামাজিক ইতিহাস নিয়েও কোনো কৌতূহল জাগে না, আর নতুন ইতিহাস রচনার জন্যেও আত্মবিশ্বাসটি প্রবল হয় না। আত্মমর্যাদা বোধের বিস্তারতো ঘটেই না। আমাদের এই কথাওতো মনে রাখতে হবে যে ‘কাছাড়’ কিম্বা ‘বরাক উপত্যকা’র যে এক আঞ্চলিক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে সেই বোধেরও জন্ম ষাটের দশকেই। ৬১র ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে। তপোধীরই লিখেছেন, “... তবে সংঘবদ্ধ উদ্যম গড়ে উঠতে পারে সামাজিক ইতিহাসের যেসব বাধ্যবাধকতায় কিংবা প্রেরণায়, দেশ বিভাগের আগে তাদের উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে ওঠেনি” ৫ এর আগেতো সবাই ‘সুরমা উপত্যকা’র এবং একাধারে অসম এবং বাংলার মানুষ । তার প্রাণ কেন্দ্র তখন কিছুটা সিলেট, বাকিটা সবই কলকাতার হতে কোনও রাজনৈতিক বা সামাজিক বাধা ছিল না। সিলেটের প্রতিভা বিপিন চন্দ্র পাল তাই সেখানে গিয়েই প্রত্যাহ্বান জানান স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে। সেই অবিভাজিত সিলেট থেকেই উঠে আসছেন অশোক বিজয় রাহা, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, খালেদ চৌধুরীদের মতো প্রতিভা। এমন কি করুণা রঞ্জন ভট্টাচার্য, অতুল রঞ্জন দে’র মতো মানুষেরও সাহিত্য কৃতির পেছনকার কাহিনি লেখা হয়েছিল সেখানেই। আর যেমন বাংলা কিম্বা ভারতীয় সাহিত্যে ছোট গল্প এসেছে উপন্যাসের পরে, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয় নি। মনে রাখতে হবে সেই রামকুমার নন্দি মজুমদার, সুরেন্দ্র কুমার চক্রবর্তীদের কথা। ‘অশ্রুমালিনী’র মতো উপন্যাসের কথা।
দুই উপত্যকা নামে আলাদা হলেও,
দ্বন্দ্ব মুখর হলেও সম্পর্কতো ছিল না বৈরি। তাই
দেখা যাবে লেখা হচ্ছে, ‘ডিহাং নদীর বাঁকে’ কিম্বা ‘হাফলং হিল’ কিম্বা
‘শিলঙের চিঠি’র মতো কবিতা। এগুলো কিন্তু লেখা
হচ্ছে, পড়া হচ্ছে ‘অতন্দ্রে’রও বহু আগে। সেই আবহে জন্মে সিলেট-কাছাড়ের মানুষ কবি ঊর্ধেন্দু দাশ
ডিব্রুগড়ে এসেও লেখেন ‘ঘরের ঠিকানা’। ১৯৬২তে তিনি যে কাগজের সম্পাদনা শুরু করেন ‘সংবর্ত’
নামে-তারও অন্যতম বিষয় কিন্তু ছিল ছোট গল্প। সিলেটের লোক পদ্মনাথ
ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদ এসে শিলঙে গুয়াহাটিতে বঙ্গ সাহিত্য পরিষদের শাখা করবার কথা
ভাবছেন, সেরকম ভাবনার বিস্তারই হচ্ছে কামরূপ অনুসন্ধান
সমিতি, কিম্বা অসম সাহিত্য সভা। শিলঙে তিনি করছেন ‘সাহিত্য
সেবক’, একই ধারাতে শিলচরের শিক্ষকেরা বের করছেন ‘শিক্ষাসেবক।’ সিলেটের লোক হেমাঙ্গ বিশ্বাস
সুরমা ভ্যালি কালচারাল স্কোয়াড নিয়ে এসে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা বিজয় করছেন, গড়ে তুলছেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ
ইতিহাস কিন্তু এগিয়েছে ঐ পথেও। আর এটা সত্যি বলেই কিনা শেষ জীবনে শ্যামলেন্দুকে
সভাপতিত্ব করতে হয় বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের মতো
সংগঠনের---সে কথাও গুরুত্ব দিয়ে ভাববার। শক্তিপদ ব্রহ্মচারীরাও কিন্তু একবার গড়ে
তুলেছিলেন, ‘কাছাড় সাহিত্য পরিষদে’র মতো সংগঠন। শেষে তিনিও ভিড়েছিলেন বঙ্গসাহিত্যে সম্মেলনে।
হয়েছিলেন তার সভাপতি। আমাদের কি পড়তেই হবে—কল্লোল-কালিকলম-কবিতা-কৃত্তিবাসের
সরলরৈখিক ‘কলকাতা’তে নির্মিত ইতিহাস?
কিম্বা শ্রুতি-হাংরি-প্রগতি আন্দোলনের হাত ধরে এখানেও কি লিখতেই হবে ‘নন-ফিকশন’ ফিকশন! আমাদেরও কি হতেই হবে
উত্তরাধুনিক! এসবের গতি কি হয়েছিল, সে আমরা জানি। কলকাতা কি
ছিল আর অবিভক্ত বাংলা কিম্বা ভারতের রাজধানী? সাহিত্যের রাজধানী
তাকে কি থেকে
যেতেই হবে?
স্বয়ং
শ্যামলেন্দুর জীবন ইতিহাসই তো খুব সরল নয়। ময়মন সিংহ থেকে হোজাই , লংকা
হয়ে শিলচরে গিয়ে থিতু হয়েও যিনি হতে পারলেন না,
স্বর্ণলতার মতো স্কুলের পাশে বাসাবাড়িতে সান্ত্বনা
খুঁজে নিয়েও জীবনকে নিয়ে হাসতে পারলেন। তাঁর গল্পে কেন শেকড়ের সন্ধান মেলে না-- এই
প্রশ্ন আজ ‘রাজধানী’র
তত্ত্বে সমৃদ্ধ যে কেউ করে উড়িয়ে দিতেও পারে কিন্তু। শুধু সেই সমালোচকের
জানা হবে না তত সহজ ছিল না আমাদের শেকড় ছড়ানো। এ এক নতুন বরাক উপত্যকা। সম্প্রসারিত সুরমা
উপত্যকা নয় আর। এখানে
শ্যামলেন্দু যেমন এসে জড়ো হচ্ছেন ময়মন সিংহের থেকে ,
এখান কার ঊর্ধ্বেন্দু দাশ যাচ্ছেন ডিব্রুগড়ে, নির্মল
চৌধুরী যাচ্ছেন ডিগবয়ে। এমন কতশত মানুষ যে এখানে এসে বাসা বেঁধেছেন, তেমনি আরো কতশত মানুষ এবং প্রতিভা বেরিয়েও গেছেন! আমরা কি জেনেছি এখনো
সমস্ত খবর তার? স্মৃতিগুলোইতো সব এলোমেলো হয়ে গেছে। সে এক
বিশৃঙ্খল দশা। সে দশার সবটা আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তাদের পক্ষে বিরাগে
কিম্বা বিস্ময়ে চারপাশটা বুঝে নেয়াই বড় কাজ তখন। স্মৃতি হাতড়ানো বিপজ্জনক কাজ। সে তখন সত্যি আস্থার
ঈশ্বর হারিয়ে ‘অনিশ’, ইন্দ্রহারা রাজ্যে সেই তখন ‘শতক্রতু!’ শ্যামলেন্দু তাই করছেন, তাঁর গল্পে। চারপাশে
যা দেখছেন তারই বহিরঙ্গকে কাহিনির আদলে বেঁধে ফেলছেন। এও কিন্তু কম কিছু নয় ইতিহাসের কাছে দায়।
তাঁর
গল্পের বই ‘যে গল্পের শেষ নেই’ বেরুলো কবে! ২০১০এ তাও বন্ধুদের চাপে। তাও তিনি নিজেই নিজের সব লেখা গল্প খুঁজে
পেলেন কই? সেই বইখানাও না পড়েই আমাকে লিখতে
হচ্ছে। অতিক্রম করতে হচ্ছে ‘চাঁদের পাহাড়ে’র মতো বিপত্তি যত। সে দোষটা আমার না এখনো অব্যাহত প্রতিকূল
কোনো বাস্তবতার
--এই প্রশ্ন যথাযথ না করতে পারলে কিন্তু সত্যি অর্থে আমাদের আন্দোলন,
আমাদের অবয়ব দাঁড়াবে না কিছু। যা কিছু দাঁড়িয়েছে সব বর্জ্যে পরিণত করবে চেনা পথের
সরল রৈখিক নিক্তি! আমাদের ভাড়া করা বাসা, কখনো বাড়ি হয়ে উঠবে কিনা
সংশয় আছে। বাড়িটা ভালো করে হোক তো। এহেন আক্ষেপও থাকবে না আর,
“স্রষ্টা লেখক শ্যামলদার বহুমুখি প্রতিভার মূল্যায়ন হয়নি বেঁচে থাকতে।” ৬ হিসেব করা যাক আরো কত
প্রতিভার মূল্যায়ন আমাদের বাকি, ঠিকঠাক জায়গা করে দেয়া
বাকি।
আমাদের সাহিত্য আকাশের বহু নক্ষত্রকে এখনো আমাদের চেনা বাকি। সেই দূরবীনটাই
যে তৈরি সারা হয় নি!
সূত্রঃ
১) বরাক উপত্যকার
ছোটগল্পের ভগীরথঃ কথকতার অন্তঃপুর; শতক্রতু , শতক্রতু, নবপর্যায়,
তৃতীয়
সংখ্যা, অগ্রহায়ণ ১৮১৯; পৃঃ ২৫৬তে পুনঃপ্রকাশিত।
২) শ্যামলদা;রণবীর
পুরকায়স্থ; রবিবারের বৈঠক;
দৈনিক যুগশঙ্খ; ২৩ মার্চ, ১৪; পৃঃ৯।
৩)
পূর্বোক্ত ভূমিকা; শতক্রতু, নবপর্যায়,
তৃতীয় সংখ্যা, অগ্রহায়ণ ১৮১৯;
পৃঃ ২৪৮-এ
পুনঃপ্রকাশিত।
৪) ঐ ,
২৫৭।
৫) ঐ;
পৃঃ ২৫৪।
৬) রণবীর পুরকায়স্থ;
পূর্বোক্ত প্রবন্ধ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন