“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

শুক্রবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৪

কাকতাড়ুয়ার গল্প -১


  ।। প্রলয় নাগ।।


 মাথাভাঙ্গা শহরে ঢুকতেই সুটুঙ্গা নদীর ওপর আব্বাসউদ্দিন আহমেদ সেতু সেতু পার করেই বা পাশে একটা পৌরসভার তৈরি করা পেচ্ছাবখানা তাড়াহুড়োর মাঝে সবাই এখানে চটজলদি কাজ সেরে নেয় আর সমস্ত পেচ্ছাবের ধারা গড়িয়ে কি সুটুঙ্গায় মেশে না-কি অন্য কোথাও যায় কেউ জানে না এই সেতু নিচে বছর ২১শের  ভেসে আসা এক যুবতী মেয়ের মড়াকে নিয়ে বেশ তোড়-জোড় শুরু হয়েছে  কবে ভেসে এসে এটা আটকে গেছে কেউ জানে না আসলে কয়েক দিন পুজোর জন্য সবাই ব্যস্ত ছিল হয়তো  
সকাল সকাল কতগুলো জেলে ঠ্যালা জাল নিয়ে মাছ ধরতে এসে মড়াখানি আবিষ্কার করেছে তবে জেলেরা খুঁজে না পেলেও আজ সবাই টের পেয়ে যেত গন্ধ একটু আধটু বেড়তে শুরু করেছে কাকের উপদ্রবও বাড়তে শুরু করেছিল পেচ্ছাবখানার ওপরে বসে কাকগুলি কা-কা কা-কা করেছে মড়ার দিকে চেয়ে মনে হচ্ছে ওদের ভাগের ধন অন্যকেউ নিয়ে যাবে
আব্বাসউদ্দিন সেতুর ওপর মানুষের ভিড় জমে গেছে  বুড়া-ছুড়া সকলে মড়া দেখছে হা হুতোস করছে ভাগা পান  বিক্রি করা এক বুড়ি - ‘কত সুন্দর ফুলের মতো মাইয়াডা, এইডা কেমন কইরা  হইল?’ রিবন সানগ্লাস-পড়া ছোকরাদের মধ্যে কেউ বলছে- ‘মালটা খাসা ছিল রে মমমু ছ্যাকাট্যাকা খাইছে হয়তো
পাশে নদীর ওপারে অভিজাত শ্মশান তার সাথে আর মা কালীর অধিষ্ঠান রোজ কেউ না কেউ পুড়ছে ওখানে
ঘণ্টা দুয়ে-কের চেষ্টায় মড়াখানি নদী থেকে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ ময়নাতদন্তের জন্য মৃতের চোখ দুটি হা-করে খুলেছিল আকাশের দিকে ঠ্যালা গাড়ি থেকে বাড় নেমে যাচ্ছিল নীল বড়-পলিথিনে জড়িয়ে গুম ঘরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে শহরের মাঝখানে গুম ঘর পাশে বিশাল বড় কাঠালি-বট গাছ হাজার হাজার চাম বাদুর ঝুলে থাকে তার নিচে স্বাস্থ্য-দপ্তরের অফিস। দিনের বেলায় যেতে ভয় লাগে ওই পথ দিয়ে যে ঠ্যালায় করে মড়াখানি শহরের মধ্যে নিয়ে আসা হল সে ঠ্যালায় করে কিছুদিন আগের এক ছোকরাকে নিয়ে আসা হয়েছিল ছোকরার বিয়ে ঠিক হয়ে ছিল কিন্তু শরীরে ছিল সিফিলিস বা গনোরিয়া জাতীয় রোগ ছোকরাটিও ফাঁসি দিয়ে মরে, নিজের পরনের শার্ট দিয়ে
পরদিন খবরে কাগজে বড় বড় করে লেখাযুবতী মেয়ের দেহ উদ্ধার ও গুম ঘর থেকে উধাও ছবিও ছেপে ছিল, সাথে দুএক ছেলে ছোকরার ছবি খবরের কাগজে ছবি দেখে তাদের আনন্দে আর ধরে না
পুলিশ প্রশাসনের ঘাম ছুটে যাচ্ছে মড়া খুঁজতে খুঁজতে  এস.পি স্বয়ং খুঁজতে বেড়িয়েছে মড়া খানি অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী নিয়োগ হয়েছে যে করেই  হোক মড়া খুঁজে বেড় করতে হবে লাল-বাজার থেকে ঘন ঘন ফোন আসছে টিভি চ্যানেল গুলিতে ঘুরে ফিরে মড়ার খবর সন্ধ্যায় কি সব তর্কের আসরও বসেছে এই মড়াকে নিয়ে
শহর ভয়ে জর সড় কত আজগুবি গল্প কে নাকি দেখেছে মড়াটি শহরের বটগাছটিতে বসে বাদুরের সাথে গল্প করেছে আর স্বাস্থ্যদপ্তরে ঢিল ছুড়ছে কেউ মড়াটিকে সরকারি বাস-স্ট্যান্ডে ভেতরে শুয়ে থাকতে দেখছে কেউ মড়াটিকে নাকি এলআইসি অফিসে টাকার কিস্তি জমা করতে দেখছে এক বেকার ছেলে দেখেছে মড়াটি নাকি ভিড় ঠেসে এসএসসি-র ফর্ম তুলেছে পোস্ট থেকে কেউ বলছে মড়াটি নাকি সঙ্গীদের সাথে দল বেঁধে অপ্সরা হলে সিনেমা  দেখেছে কেউ  মড়াটিকে সন্ধ্যা বেলা পিট ব্যাগ নিয়ে টিউশন পড়ে বাড়ি ফিরতে দেখেছে কেউ মনীষী পঞ্চানন বর্মার মূর্তিটিতে ফুল দিতে দেখছে কেউ বলছে – ‘দুর্- এ হল ঢপের চপ গুম ঘর থেকে হয়ত শেয়ালে টেনে নিয়ে গেছে
 কিন্তু কোথায় মড়া ?
কেউ খুঁজে পাচ্ছ না গুম ঘরের লোকটিকে স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকেরা দুদিন থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে চলেছে বেচারা কীভাবে জানবে? সে তো শুধু ঘরের তালাচাবি লাগায় আর খোলে
মড়া নিয়ে আন্দোলন হবে বিরোধীরা হুমকি দিয়েছে বিধান সভা ওয়াক আউট করেছে দক্ষিণী বুদ্ধিজীবীরা উত্তরে এসেছে মড়া খুঁজতে
মড়া পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও সরকার ঘোষণা করেছে মড়া খুঁজে দিলে দুলাখ
রাজা থেকে প্রজা সবাই মড়া খুঁজতে বেড়িয়েছে  মড়া কোথাও নেই, তবে গেল কোথায়?’ – সকালে চায়ের দোকানের আসরে প্রশ্ন উঠছে

কিছুদিন মড়া পাওয়া গেল। হৈ হৈ রব উঠেছে চারদিকে। ধরলা নদীতে যুবতী মেয়ের মড়া। সবাই হন্যে হয়ে ছুটছে মড়া দেখতে । আকাশে বগি উড়তে উড়তে বগাকে বলে-‘এই বুঝি সেই মড়া।’ বগা বলে-‘না, এ মড়া সে মড়া নয়।’
এক বড় নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে গুমঘরে আনা হল এ মেয়েটির মড়াকেও। বড় বড় অফিসার পাহারায় নিযুক্ত। প্রশাসন বলছে –‘দেখি এবার মড়া কোথায় যায়?’
পর দিন খবরে কাগজে ‘আবার মড়া উধাও’ গুম ঘরের লোকটিকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ লাঠি ডাণ্ডালোকটির একি কথা-  ‘আমি কি জানি? আমি তো শুধু তালা লাগাই আর খুলি। মড়া কই কীভাবে কমু?’
                                 ……………………………………………………………….

কোন মন্তব্য নেই: