“...ঝড়ের মুকুট পরে ত্রিশূণ্যে দাঁড়িয়ে আছে, দেখো ,স্বাধীন দেশের এক পরাধীন কবি,---তার পায়ের তলায় নেই মাটি হাতে কিছু প্রত্ন শষ্য, নাভিমূলে মহাবোধী অরণ্যের বীজ...তাকে একটু মাটি দাও, হে স্বদেশ, হে মানুষ, হে ন্যাস্ত –শাসন!—সামান্য মাটির ছোঁয়া পেলে তারও হাতে ধরা দিত অনন্ত সময়; হেমশষ্যের প্রাচীর ছুঁয়ে জ্বলে উঠত নভোনীল ফুলের মশাল!” ০কবি ঊর্ধ্বেন্দু দাশ ০

রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৪

মনের মৃত্যু




।।শৈলেন দাস।।

শেষ ডিসেম্বরের রাত। শীত ঝাঁকিয়ে বসেছে। শিশিরের ছোঁয়ায় সবকিছু ভেজা ভেজা। চাঁদটাও যেন একটু কুঁড়ে হয়ে গেছে নয়ত সাড়ে সাতটার পরও গায়ে আঁধার জড়িয়ে থাকবে কেন? গুয়াহাটীর অফিস থেকে সন্ধ্যা পাঁচটায় মোবাইলে জরুরী মেসেজ পেয়ে ছুটে এসেছি শিলচর আইএসবিটি-তে। চলতি মাসের ব্যবসা সম্পর্কিত কাগজ-পত্র নিতে ঘরে যাওয়াতেই এত দেরী, অথচ মাকেও জানানো হয়নি ভাল করে। কাল দশটায় মিটিং-এ উপস্থিত না হতে পারলে উর্ধ্বতন কর্তার রোষানলে পড়ব, ছাটাইও হয়ে যেতে পারি চাকরি থেকে। টিকিটের অগ্রীম বুকিং ছিলনা। তাছাড়া পৌঁছতে পৌঁছতে সব কয়টি গাড়িও ছেড়ে দিয়েছে। টিকিট কাউণ্টার থেকে জানতে পেরেছি শুধু একটি গাড়িই বাকি রয়েছে তবে তা ঢুকবেনা আইএসবিটি-তে। তাই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি, যেতে হবেই কোন মতে। এদিকে তাড়াহুরা করে বেরিয়ে পড়ায় গরম কাপড়ও নিয়ে আসিনি। হাফ হাতা শার্টের উপর শুধু একটি হাফ সুয়েটার। ঠাণ্ডায় কাঁপছি তবু নিরুপায়, গাড়িটি মিস করা যাবেনা যে! বাস এসেছে প্রায় এক ঘণ্টা পরে। পেছনের একটা সীট পেয়েগেছি বরাত জোরে। পাশের সীটে একজন মেয়েমানুষ। আলো কম থাকায় ভাল করে দেখতে পারিনি তাকে তাছাড়া সংকোচও হচ্ছিল তাকাতে। এদিকে ঠাণ্ডা কাবু করে ফেলেছে আমাকে, গা গুলানো ভাব। মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। জানালার পাশে কোরকম বসেছি দাঁতে দাঁত চেপে।
         গাড়ি ছুটছে। শিলং এর পাহাড়ি এলাকায় ঢুকে গাড়ি যেই দ্রুত বাঁক নিয়েছে আর সামলাতে পারিনি নিজেকে। হরহর করে বমি করলাম জানালা খুলে। তারপর সব অন্ধকার। বলতে পারব না জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম না ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মাঝপথে। যখন হুঁশ ফিরল বাস ততক্ষণে গিয়ে থেমেছে খানাপাড়া এলাকায়, গুয়াহাটির যেখানে অধিকাংশ যাত্রীরা নেমে পড়ে। চেয়ে দেখি বাসের সবাই নেমে গেছে, মেয়েটিও নেই। আমার গায়ে ফুলের নক্সা করা একটি মেয়েদের চাদর আবিষ্কার করে তাড়াতাড়ি নামলাম বাস থেকে। যার সহনুভূতির কারণে শীতের রাতেও আমাকে জড়িয়ে রেখেছিল ছিল উষ্ঞতা তাকে কৃতজ্ঞতা না জানালে বিবেক বলে কিছু থাকবেনা যে।
             যাত্রীরা যে যার গন্তব্যে রওয়ানা দিচ্ছে। কয়েকজন মেয়েকে দেখলাম পরিবারের লোকেজনের সাথে। একজন যুবতীই কেবল নিজের মালপত্র নিয়ে একা দাঁড়িয়ে। দ্বিধা ও সংকোচ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করতে যাব যে সে-ই আমার সহযাত্রী ছিল কিনা, চাদড়টা কি সে্-ই আমাকে দিয়েছে? হঠাৎ একটি গাড়ি এসে থামল আমার সামনে। জানলার কাঁচ নামিয়ে অতি পরিচিত একখানা মুখ, যা সেই কৈশোর থেকে গেঁথে আছে মনে। বলল- আপনি কি এখন ভাল আছেন? ‘আপনি’ বলায় ঝাঁকুনি একটু লাগল হৃদযন্ত্রে। হাতের শিরাগুলিতে শ্লথ হল রক্তের চলাচল। বিহ্বলতা কাটিয়ে কিছু বলব সে হুঁশ আমার কই! শুধু একবার এবং একবারই এক মূহূর্তের জন্য ঠোঁট দুটি কাঁপল আবেগে। জানি না সে কি ভাবল। কিছুক্ষণ উত্তর না পেয়ে চলে গেল গাড়ি করে।

       মনে করার চেষ্টা করলাম আমি এত সহজে ভূলার পাত্র হয়ে গেলাম কি করে? কৈশোরের কোন কৃতিত্বের ছাপই থাকল না কারো মনে।

কোন মন্তব্য নেই: