।। জয়শ্রী ভূষণ।।
কেন জানি না ভাতের সাথে ছোটবেলায়
একদমই ভাব ছিল না, খুব আড়ি ছিল আমার...ভাত খেতে কখনোই ভালবাসতাম
না আমি...এখনো মনে আছে সন্ধেবেলা প্রায়ই
একটি মাঝারে সাইজের বাটি টুবুটুবু ভর্তি করে ভুজিয়া খেতাম..আর রাতে খিদে পেলে বিস্কুট...
বালিশের নীচে, জামার পকেটে থাকতো বিস্কিট, অবশ্যই মাকে লুকিয়ে...রাতে এমন ভাবে ঘুমুতে ঘুমুতে বিস্কুট খেতাম যাতে
কুড়মুড় শব্দে মার ঘুম না ভেঙ্গে যায়....আসলে নিঝুম রাতে নিজের বিস্কুটের কামড়ের
শব্দ আমার কানেই বেশি বাজতো মনে হয়। আমার জন্য
একটা সাদা ঘিয়ের রঙের ডিশ ছিল....মা কত কিছু রান্না করতো...একান্নবর্তী পরিবারে বড়
হয়েছি, তখন অত ফ্রিজ টিজ ছিল না, বাপি
প্রায়ই মাছের মুড়ো, বড় ছোট রকমারি মাছ, মাংস, অনেক শাকসবজি বাজার করে আনত। আমার মা খুব
টিপটপ আর পরিপাটি ছিলেন। মাকে দেখেছি ঘরেও খুব কমদামী প্রিন্টের শাড়ি পরতেন কিন্তু
সব সময় ভাতের মাড় দিয়ে কলপ দিয়ে পরতেন। অনেক উঁচুতে তার বাঁধা থাকতো। ভেজা শাড়িটা
এক ঢিলে উঁচু তারে উড়িয়ে মারতেন ওপরে, তারপর
লম্বা শাড়ি টানটান করে টেনে দিতেন। শুকিয়ে গেলে সুন্দর ভাঁজ করে বালিশের নীচে
রাখলেই ইস্ত্রি শাড়ি তৈরি। তো আমার টিপটপ পরিপাটি পাটভাঙা শাড়ি
পরনে ভীষণ সুন্দরী মা আবার খুব কাজও করতেন, সবার জন্য রান্নাবান্না,
যে যখন বাড়িতে আসছে চা তার সাথে টা এসব লেগেই থাকতো....কতদিন মাকে
দেখেছি দুপুরে খেতে বসেছেন...কেউ বেড়াতে এসেছে তাকে বাটি ভরে তরকারি খেতে দিতেন।
কোন সময়ে অতিথিরা ভাতও খেয়ে যেতেন। আগে অত কে কার বাড়িতে কখন যাবে আসবে তার সময়
গময় ছিল না। বাড়ির বাবা কাকা পিসিরা খুব চা খেতেন সবাই, তাই
মা কাকিমারা সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন। তাছাড়াও
আচার বানানো, ঘর গোছানো, আমাদের দেখভাল
করা, আজ ওর জন্মদিন লুচি বানানো, কাল
পৌষ সংক্রান্তিতে সবাই মিলে মা কাকিমারা পিঠেপুলি, পরশু পয়লা
বৈশাখে নানা রান্নাবান্না ইত্যাদি লেগেই থাকতো। বাড়িতে সবসময় আত্মীয় স্বজনরা
বিভিন্ন জায়গা থেকে বেড়াতে আসা যাওয়া করতেন,তাই এসবের মধ্যে
আমাদের পেছনে অত সময় দিতে পারতেন না। তো আমি ছিলাম ডিস্টার্বিং এলিমেণ্ট। মানে
খেতাম না ভাত এক্কেবারেই। আমাকে বলা হতো আমি নাকি পাখির মত
খেতাম।এখনো মনে আছে মা ভাত বেড়ে দিলে অপেক্ষা করতাম কখন মা
রান্নাঘরে যাবে। তখন আবার রান্নাঘর স্নানঘর আমাদের বাড়িতে অত গায়ে গায়ে ছিল না।
বাড়ির মাঝে মস্ত উঠান তার ওপারে একটু গিয়ে রান্নাঘর তার পাশে পুকুর
এবং সেই পুকুর থেকে ডান দিকে ছিল স্নানঘর। তো এত সব করে আমাদের মা এত খেয়াল করতে
পারতেন না আর তার মধ্যে আমি একটু বেয়ারা ছিলুম, তা যেই মা
একটু চলে যেতেন প্রায়ই জানালা দিয়ে ফেলে দিতাম
মাছের টুকরো, গ্লাস ভর্তি দুধ, ভাত ডিসের সাইডে ফেলে দিতাম এমন ভাবে যেন পড়ে গেছে । কোনমতে ভাতের থেকে নিষ্কৃতি
পাওয়ার ব্যবস্থা আর কি। কারণ না খেলে আবার মায়ের উত্তম মধ্যম খেতে হবে, তাই সটান ফেলে দেওয়াটাই সেইফ আর নির্ভেজাল ছিল আমার জন্য। তবে একদম যে
খেতাম না তা নয়, একমাত্র আলু সেদ্ধ বাটার দিয়ে দিলে গপাগপ
সেটা খেয়ে নিতাম। আমি খুব লিকপিকে কাঠির মত ছিলাম দেখতে । তার কারণ
ভাত জাতীয় খাদ্যে আমার তেমন রুচি ছিল না,হাবিজাবিই
ভাজাভুজি প্রিয় ছিল । না খেলেই আমি ভাল থাকতাম
যেন, বিশেষ করে ভাত । আসলে বেশি পেলে যা হয় তাই বোধহয়।
এখনো যখন মুড়িঘণ্ট, চিংড়ি মাছ, মাংস হরেক রকম মিষ্টি, দই এগুলোর কথা মনে পড়ে,
মনে হয় ইসস যদি এখন পেতাম,ভেবেই জিভে জল আসে।
কোন কাপড় জামাই আমার গায়ে ফিট হতো না। এমনও হয়েছে বাপির সাথে কোথাও গেছি, কেউ হয়তো মজা করে বলেছে কি রে তোকে তোর বাবা খেতে দেয় না, শুনেই আমি চটে লাল, একে আমায় সবাই রোগা বললেই আমার মাথা
খারাপ হত, তার ওপর আমার বাপিকে বলে কিনা খেতে দেয় না,
খুব তেড়েমেরে বলে উঠতাম কে বলেছে তোমায় খেতে দেয় না, জানো আমার জন্য আমার বাপি বোর্ণভিটা আনে তাই দিয়ে দুধ খাই আমি। এইকথা শুনে
সে কি হাসাহাসি হল সেদিনও আমায় নিয়ে । প্রায়ই রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম,সারাদিন এত দৌরাত্মপনা আর কত সেই লিকপিকে
শরীরে সইবে। আমার বাপি যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন রাতে টেনে হিঁচড়ে তুলে বলতেন মা মা
এরকম করে না মা, রাতে না খেলে এক চড়া রক্ত কমে যাবে শরীর থেকে
তাই এক গরাস হলেও খেতেই হবে। এখানে চড়া বলতে একটা চড়াই পাখির শরীরের রক্তের কথা
বোঝাতেন আর গরাস মানে এক গ্রাস ভাত। এই কথাগুলো আবার আমায় বাপি বুঝিয়ে বলতেন কারণ
আমিও প্রশ্ন করতাম চড়া কি গরাস কি। আমার এইসব দুরন্তপনার দরুন যেহেতু মা নানা কাজে
ব্যস্ত থাকতেন তাই খাওয়া দাওয়া নিয়ে মা আমার খেয়াল সেভাবে কোনদিনই রাখতে পারেননি,
আর তাই আমার খাবার ফেলে দেওয়া সংক্রান্ত এই কাণ্ডকারখানাগুলি কখনোই
টের পাননি।না হলে ওগুলোর জন্য এডিশন্যাল গরুপেটা করতেন। ..... কাজেই বোঝাই যাচ্ছে
সমস্ত দুষ্টুমি ও দুরন্তপনার সাক্ষী ও সাথী ছিলেন আমার বাবা....সেই বাপির সাথেই
আমি বেশি লেপ্টে থাকতাম। বেড়ানো, ঘোরাঘুরি, রথের মেলা, দুর্গা পুজো, মিশন,
কালীবাড়ি, দশমীতে মূর্তি বিসর্জন, স্কুল, খেলাঘর, মেলা, নাচ গানের অনুষ্ঠান, সব কিছুর সাথী ছিলেন
বাপি...এরকমই বাপির সাথে একটা দিন...সেদিনটা কোন এক
দশমী বা রথের মেলা এমন কিছু একটা উৎসব ছিল ভালো করে মনে পড়ছে না ।
খুউউব ভিড় ছিল সেদিনও। বাপি আমাদের দুজনকে মানে আমার
ভাই ও আমাকে নিয়ে কালীবাড়ির সামনে নরনারায়ণ ট্রেডিং কোং এর বারান্দায় নিয়ে উঠিয়ে
দিয়ে গেলেন। দশমীর দিন সমস্ত দুর্গা প্রতিমাগুলি
নিরঞ্জনের জন্য কুশিয়ারা নদীর ঘাটে নিয়ে আসা হত। হ্যাঁ সেদিন মনে হয় দশমীই ছিল। তো
সেই দিনও একের পর এক প্রতিমা শম্ভু সাগরের পার্কের রাস্তা ঘেঁষে
বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। নারায়ণ ট্রেডিং কোং এর এই
বারান্দাটায় বেঞ্চ পাতা থাকে....তাতে সবাই বসা অনেক মানুষ দাঁড়ানো আসছে যাচ্ছে
গিজগিজ তারই মাঝে ছোটখাটো মেলা মতন সবাই যার যার পসরা নিয়ে বসেছে..আর এর সামনে
দিয়ে কালীবাড়ি পেরিয়ে এই রাস্তা গিয়েই তো সামনেই কুশিয়ারা নদীর ঘাট....…..তবে আমার ওসবে অত মন ছিল না, না বসার ইচ্ছে ছিল,
বাপি নারায়ণ ট্রেডিং কোং দোকানের ভেতরে গিয়ে বসলেন...আমি এদিক উদিক ঘুরঘুর
করছিলাম আর উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলাম। এত্ত ভিড়ের মাঝেই বারান্দায় একদম একটা কোনায়
দেখতে পেলাম আমার বয়সের দুটো বাচ্চা একটু উবু হয়ে
বসে আছে...ওদের সামনে একটা ছোট্ট মাটির উনুন জ্বলছে...উনুনে একটা এনামেলের ডেগচি
বসানো মাটি দিয়ে লেপা তাই কালো কুচকুচে ডেকচির বাইরেটা... একটা বাঁশ দিয়ে ডেকচির
ভেতরে নাড়াচ্ছিল একটু পরপর একজন ময়লা সাদা কাপড় পরিহিত মধ্য বয়সের এক মহিলা।
বাচ্চাদুটি জ্বলজ্বল চোখে বারবার উঁকি দিয়ে দেখছিল। কৌতূহলে সেদিনের সেই ফর্সা
বাদামী চুলওয়ালা ফিনফিনে বাচ্চা মেয়েটি গুটিগুটি ওদের পাশে গিয়ে উঁকি মারলো। একটা
কুপিতে আলো জ্বলছিল সেই আলোতে ওদের তিন জনের চেহারা আর সেই সাথে ডেগের ভেতরে সাদা
ভাতের টগবগ করে ফেনা শুকিয়ে ভাতের ধোঁয়া এখনো চোখে
ভাসছে... আজও স্টিল ফোটোর মত স্মৃতিতে ফ্রিজ হয়ে আছে যেন....খুব আশ্চর্য হয়েছিল
সেই বাচ্চা মেয়েটি..সেই মেয়েটি উবু হয়ে প্রশ্ন করছে তোমরা খালি
ভাত খাবে...উত্তর এসেছিল... না না কাঁচালঙ্কা আর তেল আছে তো... সেই সাথে বাচ্চাটির
মুখের পরিতৃপ্তির হাসি,
সাদা দাঁত, ধুলোয় মাখা হাত কাটা গেঞ্জি সেই
চাউনি.... আর সেই বাচ্চা মেয়েটির জানার পিপাসা, অবাক
হওয়া...ভাতের এই অন্য রূপ, সেদিনের ভিড়ের মাঝে মগ্ন হয়ে ওদের
ভাত-প্রীতি যদিও আশ্চর্য
করেছিল সেই ছোট্ট দুষ্টু মেয়েটিকে........
দুরন্ত লিকপিকে ছোট্ট মেয়েটির সেই ছোট্ট অবুঝ বেলায় আশ্চর্য
ঘটনার জট যেন এতদিনে খুললো... সেই সন্ধ্যার
ওই অদ্ভুত ঘটনার দৃশ্যটি
হঠাৎ হঠাৎ অবচেতনে যেন তাড়া করে...যদিও সব কিছু
আবছা হয়ে গেছে তবুও আজকাল বিশেষ করে এই করোনা ভাইরাসের প্রকোপের দৌরাত্ম্যের চোটে
কোভিড -১৯ থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য এই লকডাউন এবং তার পরবর্তী সময়ে পরিযায়ী
শ্রমিক, খাদ্যাভাব, খিদে, এবং শুধুমাত্র ক্ষইদের জন্য মৃত্যুগুলো সেইদিনের দৃশ্যটা চোখের সামনে
জীবন্ত করে তোলে যেন। তেলেঙ্গানা থেকে হাঁটতে হাঁটতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া ১২
বছরের সেই কিশোরী, লকডাউনের প্রথম বলি ১১ বছরের সেই ছেলেটি,
ছোট বাচ্চাগুলো যারা শুধু দুমুঠো অন্নের জন্য এই পৃথিবী ছাড়তে বাধ্য
হচ্ছে...সবকিছুরই এতদিনে কোথায় যেন সেই ছেলেবেলার ছবিটির সাথে আজকের
সাদৃশ্য খুঁজে পাই।
....
সেই মেয়েটি যখন একদিন বিকেলে,
মাত্র ১০ বছর বয়সে দুম করে একা হয়ে
গেছিল, বাবার ছায়াটা হারিয়ে গেছিল, সেই
যেদিন সেই মেয়েটি বাবার প্রিয় মাকালীর সমস্ত ছবি ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলেছিল,
সেই মেয়েটি নীল রঙের চেকচেক জামা পরে সারারাত মাটিতে মায়ের সাথে বসেছিল,
ভাই বড়দের সাথে বাপিকে নিয়ে নাকি শ্মশানে গেছে, সেই রাতে অঝোর ধারে বৃষ্টি হচ্ছে, সবাই বাপিকে
চিরজীবনের জন্য সেই মেয়েটির থেকে দূরে নিয়ে গেছে, সেই
অন্ধকার রাতে সেই মেয়েটি হঠাৎ করেই মাকে বলছিল মা আর কোনদিন আমায় কেউ এত আদর
করবেনা না মা, তুমিও না,
তুমি তো আমায় কক্ষনো আদর করো না মা, মা চোখের
জল মুছিয়ে আস্তে আস্তে বলে উঠেছিলেন না আর কোনদিন এত আদর তোমায় আর কেউ করবে
না....সেই প্রথম আর শেষ দিন মা মেয়ে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল...তারপর আস্তে আস্তে
কিছুদিন পর থেকেই বুঝেছিল জীবন কাকে বলে। ছোটবেলা
দুরন্তপনা ছেলেমানুষি সব আস্তে আস্তে উধাও হয়েছিল।সেই টিপটপ পরিপাটি সুন্দরী
৩২ বছরের বিধবা মায়ের ১০ বছরের দুটো ছেলে মেয়েকে নিয়ে যুদ্ধটা
বুঝতেও সেই মেয়েটির আরো দু এক বছর সময় লেগেছিল। কিন্তু মা তাকে বিস্কুট খাবার
অভ্যেস ছাড়াতে বাধ্য করেছিল , রাতে অভিমান করে খাবো না বল্লেও
কেউ দুবার খেতে আয় বলার কেউ ছিল না। আত্মসম্মানবোধের চোটে সারারাত খিদের জ্বালায়
দুমুঠো ভাতের গুরুত্ব কয়েক বছরের মধ্যেই সেই বাচ্চা মেয়েটিকে হুট করেই বড়বেলায়
পৌঁছে দিয়েছিল। এক একটা মৃত্যু এক একটা পরিবারকে কিভাবে তছনছ করে দেয় তা শুধু যার
যায় তারাই জানে। আসলে এই মৃত্যুগুলি যদিও খুব ভাইটেল ফ্যাক্টর আমাদের জীবনে,
কিন্তু সময় বিশেষে, ক্ষেত্র বিশেষে, পারিপার্শ্বিকতা বিশেষে, শ্রেণি বিশেষে মৃত্যুরও যেন
শ্রেণিভেদ আছে। মনে আছে এখনো ধুম করে একটা মানুষ বলা নেই কওয়া নেই- নেই হয়ে
গেল...সেই পরিবারের মানুষগুলি কি করবে কোথায় যাবে এই দিশেহারা সময়ে হুঁশ ফিরে আসতে
আসতে খিদে নামের ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে হয় সবাইকে। সবাই আবার আমার কিছু নেই,
হাত পাততে পারে না, ভিক্ষে করতে পারে না,
আমায় দাও দাও বলতে পারে না, হাভাতে হতে সবাই
চট করে শিখে নিতে পারে না, তার জন্য চাই অনুশীলন,
যারা ভদ্র গোছের দেখতে, সেইসব মানুষদের শাঁখের করাত জীবন।
এদিকেও কাটে ওদিকেও কাটে। এই যে
হাজার হাজার মানুষ দিনরাত দিনপাত করে দুমুঠো খাবারের জন্যে, দুটো
পয়সা রোজগার করে নিয়ে গেলে ঘরের বাকিরা দুবেলা খেতে পায়, তাদের
যে কাজ বন্ধ এই এত দিন ধরে, শয়ে শয়ে অটো রিক্সা, ফুটপাতে ব্যাগ চপ্পল নানা পসরা চাপিয়ে যারা খিদে নিবারণের যুদ্ধের সৈনিক,
তারা সবাই কিন্তু ভিক্ষা করতে পারে না, সবাই
কিন্তু ত্রাণের জন্য হত্যে দিতে পারবে না, তাদের সাবেকি মধ্যবিত্ত
চেহারা, মোটামুটি পোশাক বুঝিয়ে দেয় তারা সচ্ছল। কিন্তু খিদে তো
সবার পায়। সব ধর্মের সব বর্ণের সব ক্যাটাগরির মানুষের খিদে পাবেই।
শ্বাস প্রশ্বাসের মত খিদেটাও ততক্ষণ শ্বাস যতক্ষণ। খিদেটাও ক্রমাগতই
চাগাড় দিতে থাকে। এখন বুঝি মার কত কষ্ট হয়েছিল। কেন শিখিয়েছিল ঘরে
খাবার না থাকলে লবণ দিয়ে খাও, না থাকলে লবণ ছাড়াই। বিজয়া
দশমীতে তিতকরলা ভাজা আর ভাত দিয়ে কেন বলতেন তিতকরলা শরীরের জন্য খুব ভালো। আসলেই
সবাই পারে না, মাও নিজেও পারে
নি ছেলে মেয়েকেও শেখাতে পারে নি। আত্মসম্মানবোধটুকু বড় শক্ত। কিছু মানুষ ভেঙ্গে
চুরমার হয়ে যায় কিন্তু মাথানিচু করতে পারে না। বুঝি এখন কেন একটা মা ছেলে মেয়ে
শুদ্ধু সবাই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে....সেই মায়েরও কি ইচ্ছে করছিল না নিজেদের ছেলেমেয়ের
মুখে দুবেলা অন্ন তুলে দিতে। কাল যে লোকটা হাফলঙে নিজের মেয়েকে মাছের জন্য ১০০
টাকা দিতে পারেনি বলে আত্মহত্যা করলো, সেই মেয়েটি হয়তো আর
কোনদিন মাছ খেতেই পারবে না, যতদিন বাঁচবে নিজেকে ঘৃণা করবে বাবার
কাছে খাবারের আব্দার করার জন্য। আর যে বাবাটি আত্মহত্যা করলো তার
কি করনীয় ছিল,কতখানি কষ্টে পরিবার থেকে চিরকালের মত অভিমানে অপমানে
অপরাধীর মত সে এই মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে এগুলো ভাবার জন্য কার সময় আছে । কিন্তু
আবারও আরো একটা মৃত্যু আরেকটা
পরিবারটাকে তছনছ করে দিল। আবার অনেকদিন লাগবে ঘা সেরে উঠতে। ওই যে
মা তার বাচ্চাটা কোলে নিয়ে ছুটছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা আহা সেই বাছাটিকে শ্মশানে ছাই
হতে দিতে মন চাইছিল কি? সেই মারও খিদে পাবে কিন্তু সেই
সন্তানকে ছুঁয়ে স্নেহের মায়ায় জড়ানোর খিদের জ্বালায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কষ্ট
পাবে। আহা সেই মার বুকের জ্বালা কবে কমবে। তা এই
মৃত্যুগুলো কিন্তু আমাদের আশেপাশের কাউকে তেমন ভাবায় না, আমরা
মোটামুটি এসব প্রুফ হয়ে গেছি। শুধু নিজেকে নিয়ে আমাকে দেখো, আমি,
আমার ঘর পরিবার নিয়েই আমরা এক মনের মধ্যে কাঁচের দেওয়ালে আবদ্ধ
কমবেশি সবাই।
...."ছোঁয়াচে" এই শব্দটা মনে এলেই
আর একটা শব্দ তার পেছনে চলে আসে যেন..." অসুখ".... কিন্তু
শুধু অসুখই কি ছোঁয়াচে হয়, আর কিছু না। আজকাল আমাকে প্রায়ই
এরকম একেকটা শব্দ তাড়া করে যেন পেছন থেকে..মাথার ভেতর বোঁ বোঁ করে ঘুরতে
থাকে...আবার কোথায় হারিয়ে যায়, আবার কিছুক্ষণ পর উদয়
হয়.....আবার হারিয়ে যায়... ঠিক যেন জলের মধ্যে বুদবুদের মত। কিন্তু এই ছোঁয়াচের যে
প্রথম শুরু সেটা কখন কোথায় হল বলুন তো....কেউ কি ভেবেছি কখনো...মানে সব কিছুরই একটা
আরম্ভ থাকে শেষ থাকে চরম সীমা থাকে....ভাবছি সেই থেকেই....আসলেই এই ছোঁয়া
ব্যাপারটাই গোলমেলে। এই ছোঁয়া ছাড়া পৃথিবীতে কিছুই নেই।
সব কিছুই যেন সব কিছুকে কেমন অদ্ভুত ভাবে ছুঁয়ে আছে। গোটা পৃথিবীতে
এক কঠিন ছোঁয়াচে অসুখ...সবাইকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে...। কে
দিয়েছে? এক মারাত্মক ছোঁয়াচে অসুখ..। কি আশ্চর্য না, আমরা একবারও ভাবছি না শুরুটা কোথা থেকে হল এই অসুখের। চীনের ইউহানেই নাকি
প্রথম এই অসুখ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো কেন এমন এক অসুখ যে কাউকে
ছুঁয়ে দিলেই হয়ে যাচ্ছে.... সেই ভাইরাসের সূত্রপাত বিন্দুটা কি? পাগলের প্রলাপ মনে হচ্ছে তাই না? আসলেই আমারও মনে
হচ্ছে নিজেকে। এই কিছুদিন আগেও যখন চীনে হাজার হাজার মানুষ মরছিল রোজ....তারপর
আস্তে আস্তে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ল এক দেশ থেকে আরেক দেশ....এতদিন
অনেক দূরে ছিল... পৃথিবীর অন্য প্রান্তে এই ছোঁয়াচে অসুখ ছুঁয়ে ছিল মানুষকে ..সেই
অসুখ সেই ভাইরাস কি করে যেন আস্তে আস্তে গুটিগুটি পায়ে চলে এল এই ভারতবর্ষেও। এই
দেশে আসার আগে পর্যন্ত বেজায় গুজব, চাইনিজ ভাইরাস
বিশ্বে সন্ত্রাস শুরু করেছে...। লক্ষলক্ষ মানুষ
মরছে রোজ কিন্তু আমরা তারপরও কি
নিজেদের তৈরি করেছি এই সহসা মৃত্যুকে ঠেকাতে,
না তেমন ভাবে করছি না। কারণ কিছু মৃত্যু আমাদের ভাবায় না।
মৃত্যু আজকাল গুরুত্ব হারাচ্ছে। করোনায় রোজ আমাদের দেশেও মরছে
মানুষ। মৃত্যু সব সময়ই আমাদের জীবনে ওৎ পেতে থাকে জীবন উপড়ে নেবার জন্য। কিন্তু যতক্ষণ
আমরা বেঁচে আছি, বেঁচে থাকার জন্য ক্ষুধা নিবারণ করার
ব্যবস্থা করতেই হবে। আর এই অধিকার পৃথিবীতে সবার আছে। কিন্তু আমরা মানুষই এক ঘৃণ্য
প্রাণীকুল একা থাকা একা খাওয়া আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যেন। তাই প্রকৃতিও
প্রতিশোধ নিয়ে নিচ্ছে। এই ক্ষুধা ও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্যই হাজার হাজার
মানুষ এখনো রাস্তায় হাঁটছে, হাঁটতে হাঁটতে প্রাণ হারাচ্ছে।
ক্ষুধায় প্রাণ হারাচ্ছে আত্মহত্যা করছে, আবার করোনা আক্রান্ত
বলে সন্দেহে মরে যাবে সেই ভয়ে নিজেই আরেকটা জ্যান্ত মানুষকে পিটিকে কুপিয়ে মেরে
ফেলছে। এত মৃত্যু এত ভয়াবহ সংক্রমণের পরও আমরা সাবধান হইনি,আমরা
জানি না কাল কি হবে, ভাবছি সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু এই যে
মৃত্যুগুলো, এই যে হাজার হাজার খিদের ভাইরাস লক্ষ কোটি
মানুষের জীবন হারাম করে দিচ্ছে এই ভাবনাটুকুন কে ভাববে....। দুম করে বলে দিলাম
তবলীগি ও জমিয়াত দিল্লি থেকে আমাদের মৃত্যুদূত পাঠিয়েছে, এই ইউরেকা
ইউরেকা শব্দে আমরা করোনার উৎসস্থল আবিষ্কার করলাম যেন। খিদের জ্বালায় অতিষ্ঠ মানুষ
ঘর থেকে বেরোবেই তা সে যদি শ্রমিক হয়, ওর যদি ভালো জামাকাপড়
না থাকে তাহলে
তাকে তুমি লাঠিপেটা করো...এদিকে আবার
সাধুপেটা ও সাধু হত্যাও শুরু হয়েছে। মুসলমানদের রক্তে আজকাল আর তেমন মজা আসছে না। আসলে
এই যে পিটিয়ে খুন করা তার মধ্যেও নিশ্চয়ই একটা আমেজ আছে। আসলে এ সবই ছোঁয়াচে। কে
কখন কোথা থেকে সংক্রমিত হয়ে আসবে..….সব কিছুর পর
একটাই সত্য মৃত্যু..... তারপরও আমরা বেঁচে আছি বেঁচে থাকবো...মরে গিয়েও আমরা
আমাদের আপনজনের স্মৃতিতে ভালোবাসায় হাড়ভাঙা পরিশ্রমে আদর্শে বেঁচে থাকি...এটাও ভীষণ
সত্যি..হ্যাঁ এই শব্দগুলোও ভীষণ ছোঁয়াচে....তাই তো এত মৃত্যু মিছিলেও অগুনতি মানুষ
খাবার বানাচ্ছে, রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন,
ব্রিজের নীচে এই লকডাউনে মানুষগুলোকে একবেলা অথবা দুবেলা অন্ন তুলে
দেবার চেষ্টা করছে....আর তাই বোধহয় তিনদিন পর খাবার পেয়ে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে
ক্লান্ত সেই শ্রমিক ছেলেটি এক বিন্দু মমতার ছোঁয়ায় ডুকরে কেঁদে উঠেছিল।
হ্যাঁ এই মায়া, মমতা, ভালোবাসা,
আত্মসম্মান, সংযম, ভালোলাগা,
একে অপরের বিপদে একটু হাত বাড়িয়ে দেওয়া এগুলোও কিন্তু ছোঁয়াচেই হয়,
এক বিশাল বিপুল সংখ্যক মানুষ নীরবে কিন্তু এই ভাবেই ছুঁয়ে আছে গোটা
বিশ্বকে গোটা পরিবেশকে। তারা জানে মৃত্যু কাউকে ছেড়ে কথা কয় না,
তারা জানে মৃত্যু মানেই শেষ নয়, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ
যেভাবে আমরা পারি সবাই যে যার মত যতটুকু পারা যায় আশেপাশের মানুষগুলোর মুখে খিদে
মেটানোর ভার আমরা নিতেই পারি....
একটা অদৃশ্য সুতোর মতন এই ছোঁয়াচেপনাও কিন্তু সবার
মধ্যেই ছড়িয়ে আছে। কারণ বিশ্ব জুড়ে ওই লক্ষ লক্ষ মৃত লাশগুলির মত কাল বা
হয়তো আজই কোন একটা সময় আমিও আপনিও নিমেষেই
লাশ হয়ে যেতে পারি...তার আগে এক মুঠো ভাতের গন্ধ...আসলে
ভালোবাসাগুলি বড্ড নীরব নিঃশব্দ নিস্তব্ধতার তরঙ্গ তাই শোনা যায় না দেখা যায়
না...অর্ণবের মত চেঁচায় না...। আহ এত রাতে কে ফোন করলো, মোবাইলে
আলো জ্বলে উঠলো...রাত্রি ৩-১৫ বাজে...ওপাশ থেকে ভেসে উঠলো প্রভার স্বর.. ভাঙ্গা
গলায় দিদি বৌদির শরীরটা ভীষণ খারাপ গো কালকে বাসার কাজে আইতাম না, অখন মেডিকেলে যামু আমিও....ছ্যাঁৎ করে উঠলো বুকের ভেতরটা.... এযাত্রা
বোধহয় আর রাখা যাবে না একে...একটু পরেই আবার ফোন.....দিদি নাই গো বৌদি
আর....অস্ফুটস্বরে ইসইসইসসস করে উঠলো মনটা....আরেকটা পরিবার, বছর দশেকের ওর মেয়েটি সোনালি, হোক না গরীব,
অসুস্থ বউকে ভালোবাসায় আগলে রাখা সেই মানুষটির চেহারা ভেসে উঠলো....
কি যে হয়েছে লেখাগুলো কিছুতেই যেন থামতে চাইছে না আজ.....পাথরে ফুল ফোটানোর মত
জীবনেও মৃত্যুগুলোকে মনের ভাঁজে গুছিয়ে রাখলাম...নতুন করে আবার বাঁচার লড়াই এর সময়
যদি সমস্ত ভাইরাসের সাথে এন্টিভাইরাস একটু ভাত....ও হ্যাঁ সেই রোগা পাতলা মেয়েটি
এখন দুবেলা ভাত ছাড়া পারে না আর একটি ভাতের কণাও ফেলে না....তবে তার সেই মা এখনো
একবেলাই ভাত খায়....। এক একটা মৃত্যুকে তুচ্ছ করে, জলে
বৃষ্টিভেজা মাটির মতন থকথকে হয়ে একে অপরের সাথে
থেকে গোটা সমাজে জীবন মরণের খুনসুটিতে আজও সাগরের নোনা
জলেও যেমন ঝিনুকে মুক্তো তৈরি হয়, সবুজে ছেয়ে যায় মরুভূমি
ঠিক সেই ভাবে ছোঁয়াচে হয়ে ভালোবাসার উষ্ণতায়
জড়িয়ে থাকুক আমাদের এক অন্য পৃথিবী আমাদের জীবনে মননে
.......।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন